ঋণের ফাঁদে তুলোচাষি, অথচ শুল্ক বাতিল— কটন মিশন কার স্বার্থে?

দেবাশিস মিথিয়া

 


আমদানি করা তুলো থেকে সরকারের শুল্ক-মকুবের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি এখন গুরুতর প্রশ্নের মুখে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে একপেশে বলেছেন। সরকার বস্ত্রশিল্পকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি-আয়ের উৎস হিসেবে দেখছে এবং সেটিকে তাৎক্ষণিক সহায়তা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সুবিধা করে দিচ্ছে। অথচ তুলোচাষিদের কেবল বৃহৎ বস্ত্রশিল্পের কাঁচামালের জোগানদাতা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট— সরকার ক্ষুদ্র কৃষকদের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার চেয়ে বড় কাপড় ব্যবসায়ীদের লাভ ও বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে

 

মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চলের তুলোচাষিদের মর্মান্তিক কাহিনি নিয়ে নির্মিত মারাঠি চলচ্চিত্র কাপুস কোন্ডিয়াচি গোস্টা। ছবিটিতে এক তুলোচাষি পরিবারের করুণ পরিণতি তুলে ধরা হয়েছে। তুলোচাষের জন্য নেওয়া ঋণ শোধ করতে না পেরে এক দম্পতি আত্মহত্যা করেন। সেই দম্পতির মৃত্যুর পর তাঁদের চার মেয়ে কীভাবে চরম দারিদ্র্য ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হয়, সেই কাহিনিই ছবিটির পরতে পরতে প্রকাশ পেয়েছে। ভারতের ‘তুলো বলয়’ (কটন বেল্ট) হিসেবে পরিচিত এই বিদর্ভ অঞ্চল বর্তমানে কৃষিসংকটের কেন্দ্রে। এখানে প্রায় ৩৪ লক্ষ তুলোচাষি ঋণের বোঝা বয়ে কঠিন সংগ্রাম করছেন। কেউ কেউ ঋণের জ্বালায় জর্জরিত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। গত ২৪ বছরে বিদর্ভের অমরাবতী রাজস্ব বিভাগে ২১,২১৯টি আত্মহত্যার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০২৩ সালেই ভারতে ১০,৭৮৬ জন কৃষক ও কৃষিশ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন, যার ৩৮.৫ শতাংশই মহারাষ্ট্রে— যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে মহারাষ্ট্রে ৭৬৭ জন কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে। কৃষকদের আত্মহত্যার এই হার এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে আরও বেড়ে যায়, কারণ তখন ফসল নষ্ট নিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং মহাজনরা ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও দেখা গেছে, বৃষ্টি-নির্ভর অঞ্চলে বিটি তুলোর চাষ যত বেড়েছে, কৃষকদের আত্মহত্যার হারও তত বেড়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষক আত্মহত্যার মূলে রয়েছে অতিরিক্ত ঋণ ও ফসলের অনিশ্চয়তা। ছোট কৃষকদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সুযোগ কম থাকায় তাঁদের চড়া সুদের মহাজনি ঋণের ওপরই ভরসা করতে হয়, যা তাঁদের পাকাপাকিভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলে। চাষের খরচ বৃদ্ধি ও ফসলের কম দাম— এই চাপকে আরও বাড়িয়ে তোলে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে ভারত মূলত পুরনো বিটি বীজ (বোলগার্ড-II) ব্যবহার করছে, অথচ এই বীজ গোলাপি বলওয়ার্মের মতো কীটপতঙ্গকে প্রতিরোধ করতে পারে না। অন্যদিকে, ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়ায় ব্যবহৃত উন্নততর বীজ (বোলগার্ড-III) ভারতে ছাড়পত্র পায়নি। অর্থাৎ এই বাধাও পরোক্ষে ফসল নষ্টের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যথাযথ সেচের অভাব ও জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব।

এছাড়াও, ক্ষুদ্র তুলোচাষিদের প্রতি সরকারের উদাসীনতা এবং ত্রাণ বিতরণে বৈষম্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। সরকারি ত্রাণের সুবিধা প্রায়ই প্রান্তিক কৃষকদের কাছে পৌঁছায় না। ত্রাণ বিতরণকারী আধিকারিকদের সঙ্গে ধনী কৃষকদের যোগসাজশে সরকারি সাহায্য মাঝারি বা বড় চাষিদের কাছেই চলে যায়।

এই পরিস্থিতি থেকে তুলোচাষিদের মুক্তি দিতে কেন্দ্রীয় সরকার ২০২৫-২৬ বাজেটে ‘মিশন ফর কটন প্রোডাক্টিভিটি’ ঘোষণা করেছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এই মিশনের মূল উদ্দেশ্য হল তুলোর উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করা। এর জন্য বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নেওয়া হবে। চাষিদের উন্নত জাতের বীজ (বিশেষত এক্সট্রা-লং স্টেপল বা ইএলএস) সরবরাহের পাশাপাশি জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি অনুশীলন শেখানো হবে। এছাড়াও, এই মিশন গুণমানসম্পন্ন তুলোর নিরবচ্ছিন্ন জোগান নিশ্চিত করে বস্ত্রশিল্পের আমদানি-নির্ভরতা কমাতে সহায়তা করবে।

 

কৃষকের জীবন বনাম শিল্পের লাভ

ভারতীয় বস্ত্রের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার ফলে বস্ত্রশিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সংকট দেখা দিয়েছে। সেই সংকট থেকে উদ্ধার পেতে সম্প্রতি ভারত সরকার তুলো আমদানির ওপর থেকে ১১ শতাংশ শুল্ক সাময়িকভাবে বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বস্ত্র ও পোশাক শিল্প এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি (সিআইটিআই) যুক্তি দিয়েছে, এটি সুতোর দাম স্থিতিশীল রাখতে ও বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে সাহায্য করবে। কটন অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (সিএআই) আশা করছে, ব্রাজিল থেকে ১০-১৫ লক্ষ গাঁট তুলো আমদানি হবে; ফলে মিলগুলির উৎপাদন খরচ কমবে এবং রপ্তানিকারকরা উৎসাহিত হবেন। মার্কিন শুল্কের জেরে চলতি আর্থিক বছরে ভারত আনুমানিক ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা হারানোর সম্ভাবনায় রয়েছে। এই প্রেক্ষিতে শুল্ক বাতিল একটি তাৎক্ষণিক সমাধান মাত্র।

সরকারের এই সিদ্ধান্ত তুলোচাষিদের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মহারাষ্ট্র, গুজরাত এবং তেলেঙ্গানার মতো প্রধান তুলো-উৎপাদনকারী রাজ্যের কৃষকরা একে “কৃষকবিরোধী” আখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা (এআইকেএস)-র মতো সংগঠনগুলির যুক্তি, সস্তা বিদেশি তুলোর আমদানি বাড়লে দেশীয় বাজারে তুলোর দাম কমে যাবে, যা লক্ষ লক্ষ চাষির আয়কে সরাসরি আঘাত করবে। কৃষক নেতা রাজু শেট্টি জানিয়েছেন, এই ঘোষণার পর থেকেই তুলোর দাম ইতিমধ্যেই প্রতি ক্যান্ডিতে ১,১০০ টাকা কমে গেছে। তাঁরা সরকারকে কৃষকদের আয় রক্ষার লক্ষ্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) মাধ্যমে তুলো সংগ্রহের দাবি জানিয়েছেন।

সরকারের শুল্ক-মকুবের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তটি এখন গুরুতর প্রশ্নের মুখে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই এই সিদ্ধান্তকে একপেশে বলেছেন। সরকার বস্ত্রশিল্পকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি-আয়ের উৎস হিসেবে দেখছে এবং সেটিকে তাৎক্ষণিক সহায়তা (শুল্ক-মকুব) দিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সুবিধা করে দিচ্ছে। অথচ তুলোচাষিদের কেবল বৃহৎ বস্ত্রশিল্পের কাঁচামালের জোগানদাতা (প্রাথমিক সম্পদ ইনপুট) হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। যখন তুলোচাষিরা চরম আর্থিক সংকটে ভোগেন, তখন সরকার দ্রুত ও সরাসরি সাহায্যের বদলে এমন দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তিগত সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা কার্যকর হতে অনেক সময় নেয় এবং কৃষকের দুর্ভোগ আরও বাড়ায়। এতে একটি বিষয় স্পষ্ট— সরকার ক্ষুদ্র কৃষকদের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার চেয়ে বড় কাপড় ব্যবসায়ীদের লাভ ও বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।

 

নীতিগত অনিশ্চয়তা ও কাঠামোগত দুর্বলতা

তুলো উৎপাদনশীলতার বিচারে ভারত অনেকটাই পিছিয়ে (বিশ্বে ৪৪তম স্থানে)। এটি বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার ‘কটন মিশন’ গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে তা শুরুর আগেই কয়েকটি সমস্যা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সরকারের তুলো-আমদানি শুল্ক-মকুবের সিদ্ধান্তে স্থানীয় তুলোচাষিরা সমস্যায় পড়েছেন। নীতিগত অনিশ্চয়তার কারণে তাঁরা এখন তুলোকে একটি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ফসল বলে মনে করছেন। তাই চাষিরা তুলোচাষ ছেড়ে ধান, ভুট্টা ও চিনাবাদামের মতো তুলনামূলকভাবে বেশি লাভজনক ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। এর ফলে এই মরশুমে দেশে তুলো চাষের মোট এলাকা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩ শতাংশ কমেছে। হরিয়ানায় ফলন হ্রাস, পোকার আক্রমণ ও জলের অভাবে তুলো চাষ প্রায় ১৬ শতাংশ কমেছে। তুলোর এমএসপি থাকলেও সমালোচকদের বক্তব্য, এটি নির্ধারণের সময় চাষের সব খরচ ধরা হয়নি এবং এমএসপিতে তুলো কেনার প্রক্রিয়াটিও স্বচ্ছ নয়। ফলে ‘কটন মিশন’ একদিকে যেমন আশা জাগাচ্ছে, অন্যদিকে আমদানি-শুল্ক মকুবের মতো ভুল নীতিগুলি ক্ষুদ্র কৃষকদের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই দ্বিমুখী নীতি শেষ পর্যন্ত কৃষকদের জন্য আরও বড় সংকট তৈরি করতে পারে।

আমদানি শুল্ক মকুব নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কটি আসলে ভারতের তুলো খাতের দীর্ঘদিনের অন্তর্নিহিত দুর্বলতাকেই উন্মোচিত করেছে। কৃষি ও শিল্পের তাৎক্ষণিক সংঘাতের বাইরেও মূল সমস্যাগুলি রয়ে গেছে— উৎপাদনশীলতার ঘাটতি, পুরনো প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং দুর্বল সরবরাহ শৃঙ্খল।

উৎপাদনশীলতার দুর্বলতা: ভারতের তুলো উৎপাদন ক্ষমতা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই কম। বর্তমানে ভারতে প্রতি হেক্টরে মাত্র ৪৩৭ কেজি তুলো উৎপাদিত হয়, যা বিশ্ব-গড়ের (৮৩৩ কেজি) প্রায় অর্ধেক। এই কম ফলনের কারণে তুলো চাষে আয় কমে, তাই কৃষকরা ধীরে ধীরে তুলো চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন। এর ফলে তুলোর জাতীয় উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে এবং দেশীয় বাজারে তুলোর দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পুরনো বীজ প্রযুক্তি: ভারতের তুলো চাষিরা প্রায় দুই দশকের পুরনো বিটি হাইব্রিড বীজপ্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পুরনো প্রযুক্তি কীটপতঙ্গ প্রতিরোধের ক্ষমতা হারাচ্ছে এবং ফলন কমছে। অন্যদিকে, ব্রাজিল ও চিন অনেক উন্নত ও আধুনিক বীজপ্রযুক্তি (বোলগার্ড-III বা সিআরআইএসপিআর-ভিত্তিক জিন এডিটিং) ব্যবহার করে তুলোর উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। এই প্রযুক্তিগত ব্যবধান ভারতের তুলোকে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিচ্ছে।

কৃষি-শিল্প সম্পর্কের অবনতি: অতীতে কাপড় মিলগুলির সঙ্গে তুলোচাষিদের সম্পর্ক জোরদার ছিল, বর্তমানে তা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভারতে তুলোচাষের খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় তুলোর দাম বেশি, সেই কারণে কাপড়ের মিলগুলি এখন সস্তা আমদানি করা তুলোর দিকে ঝুঁকছে। এই প্রবণতা অভ্যন্তরীণ সরবরাহশৃঙ্খলকে দুর্বল করছে এবং দেশের ক্ষুদ্র কৃষকদের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

 

আন্তর্জাতিক মডেল থেকে শিক্ষা

তুলোচাষে ফলন বাড়িয়ে লাভের মুখ দেখতে, ভারতকে আন্তর্জাতিক মডেলগুলি থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি কার্যকর কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

প্রথমত, তুলোচাষের ঝুঁকি কমাতে এবং বৃহদায়তনে উৎপাদন বাড়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের মডেল অনুসরণযোগ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুলোচাষে ব্যাপক ভর্তুকি (বিমা প্রিমিয়ামের ৮০ শতাংশ পর্যন্ত) দিয়ে কৃষকদের ঝুঁকি কমানো হয়। ভারতের পক্ষে সেই স্তরের ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব না হলেও, একটি শক্তিশালী ও সর্বজনীন শস্যবিমা ব্যবস্থা চালু করে ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, ব্রাজিলের মতো উচ্চ-প্রযুক্তি বীজ (বোলগার্ড-III) এবং আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করে ফলন বাড়াতে হবে এবং চাষিরা যাতে উৎপাদন স্কেলের সুবিধা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, ভারতের তুলো উৎপাদন অঞ্চলে তীব্র জলসংকট মোকাবিলা করতে অস্ট্রেলিয়ার ওয়াটার ইউস এফিসিয়েন্সি (ওবলুইউই) মডেল শিক্ষণীয়। এই মডেল ব্যবহার করে তারা প্রতি মেগালিটারে আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ তুলোর গাঁট উৎপাদন করছে। জল ব্যবহারের এই দক্ষতা বাড়াতে অস্ট্রেলিয়া সেচব্যবস্থাকে অত্যাধুনিক করেছে। দেশটি ফাটলযুক্ত কাদামাটির জন্য ফারো সেচ, ঘনঘন জল প্রয়োগের জন্য সেন্টার পিভট ল্যাটারাল মুভ (সিপিএলএম) এবং জল ব্যবহারের দক্ষতা নিশ্চিত করতে সাবসারফেস ড্রিপ (এসএসডি) সেচ চালু করেছে। তাছাড়া, অস্ট্রেলিয়ান খামারগুলিতে টেইল ওয়াটার রিসাইক্লিং সিস্টেমের মাধ্যমে ব্যবহৃত প্রায় সমস্ত জল সংগ্রহ করে পুনর্ব্যবহার করা হয়। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং জলসংকটের কারণে কৃষকদের আত্মহত্যা রোধ করতে ভারতের তুলোচাষে এই সুনির্দিষ্ট সেচপ্রযুক্তি ও জল পুনর্ব্যবহারের পদ্ধতি অবিলম্বে গ্রহণ করা জরুরি।

মানবিক মূল্যবোধ ও বাণিজ্যিক স্বার্থের এই সংঘাতে একটি বিষয় স্পষ্ট— তাৎক্ষণিক বাণিজ্যিক স্বার্থ দীর্ঘমেয়াদি কৃষকের কল্যাণকে ছাপিয়ে গেছে। এটি ভারতীয় কৃষির কাঠামোগত দুর্বলতাকেও তুলে ধরে। তুলোচাষিদের এই মর্মান্তিক ঘটনা শুধু মহারাষ্ট্রের কৃষকদের চরম দুর্দশাকে বোঝায় না, এটি ভারতীয় কৃষিব্যবস্থার ভেতরের বড় ফাঁকগুলিকেও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

দীর্ঘদিন নিয়ম-নীতির পরিবর্তন না হওয়া (জড়তা), নীতি বাস্তবায়নের দুর্বলতা এবং সরকারি সাহায্যের অভাব দেশের লক্ষ লক্ষ তুলোচাষিকে ঋণের জালে স্থায়ীভাবে জড়িয়ে ফেলছে এবং আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিচ্ছে। ভারতের ‘তুলো বলয়’-এর প্রতিটি আত্মহত্যা আমাদের কৃষি-নির্ভর অর্থনীতির দুর্বলতম অংশের প্রতি সমাজ ও সরকারের দায়িত্বহীনতাকে তীব্রভাবে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। এই সংকট নিরসনে শুধু ত্রাণ নয়, প্রয়োজন মানবিক ও সুসংগঠিত নীতিগত হস্তক্ষেপ— যা ফসলের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, কার্যকর বীজপ্রযুক্তির ব্যবস্থা করবে এবং প্রান্তিক কৃষকের কাছে সরকারি সুবিধা পৌঁছে দেবে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5222 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...