বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে: ভাষা, সত্তা এবং অপরীকরণের রাজনীতি— নবম বর্ষ, তৃতীয় যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

…আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জটা স্পষ্ট: অপরীকরণের রাজনীতিকে প্রতিরোধ করা, জাতীয় অখণ্ডতা এবং ভাষাগত বৈচিত্র্যের মধ্যে মিথ্যা বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করা এবং জোর দিয়ে বলা যে বাংলা ভাষায় কথা বলা— মালদহ, দিল্লি বা বেঙ্গালুরু যেখানেই হোক না কেন— কোনও অপরাধ নয়, বরং ভারতের বহুমাত্রিক গণতন্ত্রের এক দৃঢ় ঘোষণা।…

 

বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে পদ্মার এই পারে নিকোনো উঠোনে রৌদ্র ঝরে না আর, বারান্দায় লাগে না জ্যোৎস্নার চন্দন…

গত কয়েক মাস ধরে ভারত জুড়ে বাংলাভাষী মানুষদের প্রতি এক উদ্বেগজনক বিদ্বেষ দেখা যাচ্ছে। অভিবাসী শ্রমিকদের আটক করা হচ্ছে, ‘বিদেশি’ তকমা দেওয়া হচ্ছে, বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কেবল এই সন্দেহে সীমান্ত পেরিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে তাঁদের মাতৃভাষা ‘বাংলা’ নয়, তথাকথিত ‘বাংলাদেশি ভাষা’। ভাষার এই নিষ্ঠুর অবমাননা— একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষাকে অবৈধতার প্রতীক বানিয়ে ফেলা— কথা বলাটাকেই যেন দমনের কারণ বানিয়ে তুলছে।

 

এ-কৌশল অবশ্য নতুন নয়। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে আসামে শুরু হওয়া ‘বিদেশি খেদাও আন্দোলন’ থেকে শুরু করে আজকের আটক শিবির আর ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া পর্যন্ত বাঙালি পরিচয়কে বারবার কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। তাকে নিজের ভারতীয়ত্ব প্রমাণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। আজকের দিনে বিস্ময়কর ব্যাপার হল এই যে, এই সন্দেহ আর কেবলমাত্র আসামে সীমাবদ্ধ নেই। দিল্লি, গুজরাত, উত্তরপ্রদেশ এবং কর্নাটকেও বাংলা উচ্চারণ শুনলেই কাউকে ‘বহিরাগত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যার প্রাপ্য কড়া নজরদারি ও সম্ভব হলে অর্ধচন্দ্রের প্রয়োগ। তবে শুধু অন্য প্রদেশ কেন? প্রগতিশীলতার পোষণভূমি এই খাস কলকাতার বুকেও মালদহ বা দিনাজপুরের গ্রামবাসীদের ভাষাকে ‘বিদেশি’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

এইসব কাণ্ডকারখানাকে একটি বৃহত্তর বিশ্বজনীন চিত্রের অংশ হিসেবেও দেখা যায় বই কী। ভারতে ‘বাংলাদেশি’ বিতর্ক কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিকভাবে বাড়তে থাকা কট্টর ডানপন্থী রাজনীতির বোলবোলাওয়েরই অংশ, যা অভিবাসনকে ব্যবহার করতে চায় অস্ত্র হিসেবে। লন্ডনের টমি রবিনসন যেমন ‘আমাদের সংস্কৃতি ও শহর হারাচ্ছি’ বলে চিৎকৃত উল্লম্ফন করেন, তেমনি ভারতে সিংহাসনে আসীন ‘দেশপ্রেমী’ নেতারা বাঙালি অভিবাসীদের জনগোষ্ঠীগত বিপত্তি, অর্থনৈতিক প্রতিযোগী এবং সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশকারী বলে নির্দ্বিধায় দাগিয়ে দেন। উদ্দেশ্য একই: বহিরাগতদের ভয় দেখিয়ে ভোটারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা এবং ক্ষমতাকে পোক্ত করা।

হার্বার্ট মার্কুসের ‘repressive tolerance’-এর ধারণাটি বর্তমান সংকটকে কিছুটা স্পষ্ট করে। যে রাষ্ট্র সহনশীলতার ভান করে অথচ নির্বিচার ঘৃণা ছড়ানো এবং প্রোফাইলিংকে প্রশ্রয় দেয়, তা আসলে গণতন্ত্র পালন করে না, বরং দমনেরই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। পঁচিশ কোটি মানুষের ভাষাকেই অনুপ্রবেশের প্রমাণ হিসেবে দেখানো— এই অপরীকরণ— উৎপীড়কের এই আপাত-সহিষ্ণু ভাবের চমৎকার উদাহরণ। সহনশীলতার আড়ালে বৈচিত্র্যকে নয়, বরং একরঙা একটা ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখো, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের নিরাপত্তার নামে সংখ্যালঘুদের বলি দেওয়াটাই হবে আসল উদ্দেশ্য।

প্রকৃত সহনশীলতা— মার্কুস যেমনটি মনে করিয়ে দিয়েছেন— হল ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, নীরবে তা মেনে নেওয়া নয়। ভারত যদি এই পথে চলতে থাকে, তাহলে তার গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি— ছোটবেলার ইতিহাস বইতে পড়া ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য’— সেই বহুত্ববাদকেই ঝুঁকির মুখে ফেলবে। ভারতরাষ্ট্রের ভিত্তিটাকেই দুর্বল করে দেবে।

আমাদের সামনে এখন চ্যালেঞ্জটা স্পষ্ট: অপরীকরণের রাজনীতিকে প্রতিরোধ করা, জাতীয় অখণ্ডতা এবং ভাষাগত বৈচিত্র্যের মধ্যে মিথ্যা বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান করা এবং জোর দিয়ে বলা যে বাংলা ভাষায় কথা বলা— মালদহ, দিল্লি বা বেঙ্গালুরু যেখানেই হোক না কেন— কোনও অপরাধ নয়, বরং ভারতের বহুমাত্রিক গণতন্ত্রের এক দৃঢ় ঘোষণা। বাঙালির বার্ষিক উৎসব মরসুমের প্রাক-মুহূর্তে সেই ঘোষণাটিই আমরা করতে চেয়েছি— যে-উদ্যোগে আমাদের সঙ্গে পেয়েছি আশীষ লাহিড়ী, আশিস গুপ্ত, আইরিন শবনম এবং সঞ্জীব দেবলস্কর মহাশয়কে। এবং, বলা বাহুল্য, সঙ্গে চাই আপনাদের সবাইকে।

সঙ্গে অন্যান্য বিভাগগুলি থাকল যথাবিধি…

ভালো থাকবেন…

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...