স্মৃতিপরব: অধ্যায় ২, পর্ব ৮-খ

নীহারকান্তি হাজরা

 

নদ-নদীর সঙ্গমভূমে

অধ্যায় ১: পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮পর্ব ৯
অধ্যায় ২: পর্ব ১ পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮-ক

 

ক্ষেত থেকে রান্নাঘর: গুড়মুড়িমেঠাই

আমার স্মৃতিতে থাকা শৈশব-কৈশোরের নানা কিছুর সঙ্গে আজকের প্রাত্যহিক জীবননির্বাহের যে অপরিমেয় পার্থক্য দেখি তার মধ্যে বোধ করি সবচেয়ে বড় পার্থক্য এসেছে খাদ্যাভ্যাসে। দৈনন্দিন পাতে, উৎসবে, কুটুম্বদের যাতায়াত উপলক্ষে, গ্রামীণ মেলায় বা পূজাপার্বনে যে সাধারণ ও অ-সাধারণ খাদ্য আমাদের আহার্য ছিল তার প্রায় প্রতিটিই ছিল আমাদের আপন গণ্ডির পরিসরে উৎপাদিত, সেগুলির সঙ্গে আমাদের একপ্রকার আত্মীয়তাই ছিল বলা যায়।

যেমন, সর্বাধিক দৈনন্দিন প্রচলনের মিষ্টি ছিল গুড়। দরিদ্রতমের গৃহেও অতিথি এলে গৃহিণী এক ঘটি জল ও গুড় সহযোগে তাঁকে আপ্যায়ন করতেন। আমাদের বসতির তিনদিকে ছিল ঘন লাল, পুরুষ্টু আখের বাদা। তখনকার সবচেয়ে আধুনিক আখ— জাভা। শীত এলে চোখ মেলে দিলে রবিশস্য। ছোলার ক্ষেত। আলের ধারে টুমুর, মানে অড়হর। খাড়া যবের ক্ষেত। একটু আধটু গম। আবার বর্ষার আগে বিস্তৃত তিল। সেটার পরে আউস ধান। এই খণ্ডপল্লির পিছনে একটুকরো জমিতে একটা দাঁতওলা চাকা ঘুরিয়ে চলেছে দুটো পালিশ করা পুষ্ট বলদ। গভীর কুয়ো থেকে শিকলে বাঁধা শ্রেণিবদ্ধ অর্ধবৃত্তের বালতিতে উঠছে জল। নালায় পড়ে চলে যাচ্ছে বাদায়। জলকল।

আবার গরমে এই টুকরো জমিতেই একটা আখমাড়াই কল বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে চলত ওই বলদেরা। একপাশে স্তূপাকার আখ। সবুজ রস গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে বসানো একটি বিস্তৃত-মুখ মাটির পাত্রে। বড় গ্লাস নিয়ে বসে পড়ো। একটু ঘরে-পাতা দই থাকলে তো… আখের রসে দই, অমৃত। রস খাও। খেয়ে যাও। খেতেই থাকো। একটু দূরে একটা আয়তাকার লম্বা পাত্র ওই মাপের লম্বা উনুনের উপরে। আখের শুকনো পাতার জ্বালানি। ফুটছে রস। নাড়া চলছে লম্বা খুন্তি দিয়ে। আলুথালু বাতাসে গুড়ের গন্ধ বাধাহীন। একটার পর একটা সোনালি গুড়ের পায়া, মানে কলসি, ভর্তি হয়ে চলেছে। আর ফুটন্ত রসের ফেনা তুলে জমিয়ে রাখো। ঠান্ডা হলে নরম তুলতুলে গুড়ের মাখন— ভিড়া গুড়।

আবার গ্রামপ্রান্তের পুঁড়ি আখের ক্ষেতগুলি ছিল যে শৃগালদলের কথা আগেই বলেছি তাদের পছন্দের। স্বল্প দৈর্ঘ্যের এই গাছগুলি হত খুবই নরম। শেয়াল দাঁত বসালেই রসধারায় ভরে যেত মুখ। শেষ পর্যন্ত চাষিরা এই আখ চাষ বন্ধ করে দেয়। আরও পরে সারা বছর শিয়ালের দল জমি দখল করে থাকে বলে গ্রামে গ্রামে আখ চাষও বন্ধ হয়ে যায়। চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যায় অভ্যাগত বাড়িতে এলে জল আর গুড় দেওয়ার আপ্যায়ন। পালে-পার্বনে চলে এল উত্তরপ্রদেশের টিনবদ্ধ গুড়। আর গুড়ের জমানো ডেলা— ভেলি গুড়।

বাঁকুড়ার গ্রাম। কাজেই মুড়ির দাপট দেখে এসেছি আজন্ম। বাঁকিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা নামের ধানের চাষ হত। কয়েকটি নাম এখনও মনে আছে— ভাসামানিক, কলমকাটি, শীতাসাল— এই সব। আর এজমাল কোনও কোনও জমিতে চাষ হত ভূতমুড়ি ধানের। ধানটা কালো আর এর চাল মোটা কালচে লাল। এটা মুড়ি তৈরির ধান। বেশ কিছু চাষিঘরের মহিলা ধান নিয়ে গিয়ে সেদ্ধ করে শুকিয়ে আনত। কোনও কোনও ধান আবার দু-বার সেদ্ধ করে শুকোতে হত। মুড়ির চাল দু-বার সেদ্ধ হত। এই মহিলাদের বলত ভাচাতি। এরা পাই মাপে ধান মজুরি পেত। বেশ খানিকটা ধানসেদ্ধ শুকোনোর পরে চাষিরা গরুর গাড়িতে করে এগুলি নিয়ে যেত হাস্কিং মিলে। আসলে ডিহাস্কিং। চাল আর ধানের কুঁড়ো বাড়িতে আসত। এই কুঁড়ো আবার দু-ধরনের হত। ওপরের শক্ত খোসাটা ছাড়া চালের গায়ে যে পাতলা আবরণ থাকে তার কুঁড়ো। চালগুলি কুলো দিয়ে ঝাড়বার পরে এই তেলতেলে কুঁড়ো বার হত। এটি হত উৎকৃষ্ট গরুর খাদ্য। ওপরের শক্ত খোসাটি ধানসেদ্ধ করার জ্বালানি হত। মুড়ির ধান পাক করতে অভিজ্ঞতার দরকার পড়ত। মোটা এই ধান প্রথমবার ভাপ সেদ্ধ করার পর চাটাইতে মেলে দিয়ে অল্প রোদে খানিকটা শুকোতে হত। তারপরে দাঁতে পরীক্ষা করে দ্বিতীয়বার ভাপে নির্দিষ্ট সময় সেদ্ধ করার কালে আবার দাঁতে কেটে আন্দাজ করতে হত ভবিষ্যত মুড়ির পরিণাম। তারপর বিছিয়ে শুকনোর সময় মাঝেমাঝেই এর নিগূঢ় রস পরীক্ষা হত দাঁতে কেটে। নির্দিষ্ট সময়ে ভানানো হত। এই যে চালটি হল এর পরিণামী মুড়ির আবার কঠিন পরীক্ষা। মুড়ি ভাজা।

একটা বড় বেশ ছড়ানো মাটির গামলা। ভেতরটা মসৃণ, নাম খাপরি। এটাতে আট থেকে দশ পাই চাল ধরে। সাধারণত পাঁচ থেকে আট পাই চাল নেওয়া হত। উনুনে চড়ানোর আগে এটাতে পরিমাণমতো জল আর নুন দিতে হত। এখানেই ছিল মুড়ির বাড়বাড়ন্তের প্রথম পরীক্ষা। নুন বেশি হলে মুড়ি কুঁকড়ে পুড়ে যাবে। আর কম হলে মুড়ি হয়ে যাবে চালভাজা। একবারে পাঁচ পাই চাল, পাঁচ পাই মুড়ি। রসস্থ চাল আর নুন বেশ খানিক নাড়াচাড়ার পর উনুনে বসত খাপরি। চাল নাড়ার একটা বিশেষ কাঠের হাতা থাকত। এটা হুবহু টেবলটেনিসের ব্যাটের মতো। কাঠের উনুনের জ্বাল কমবেশি করে চাল নাড়াচাড়া চলত। মাঝেমাঝে দাঁতে পরীক্ষা। উপযুক্ত সময়ে খাপরি নামিয়ে চড়ত মাটির বড় খোলা। এ-পাত্রটা তৈরি করা হত একটা মাটির বড় কলসির মাঝ থেকে কেটে নিয়ে তলার দিকটা। ভেতরে দেওয়া হত বেশ খানিকটা বালি। তৈরি থাকত এক গোছা কাশগাছের শুকনো মসৃণ ডাঁটা। কাঠের জ্বালে বালি সঠিক গরম হলে এক মুঠো চাল তপ্ত বালিতে ছড়িয়ে দিয়ে আঙুলের খেলায় কাঠিগুলি মেলে দিয়ে চাল কয়েকবার নাড়লেই শব্দ তুলে ফাটত মুড়ি। বালির ওপর থেকে মুড়িগুলি নিপুণ অভিজ্ঞতায় চেঁছে নিয়ে উনুনের পাশে ফেলা হত। বালি উঠত না। প্রথম উৎপাদন অঞ্জলি ভরে উনুনে যেত: অগ্নিদেবায় নমঃ। প্রতি গ্রামে এরকম দু-তিনজন ভাজিয়ে থাকতেন যাঁরা সাধারণত একপাই চাল পিছু আট থেকে বারো পাই মুড়ি তৈরি করে দিতেন। এর মাপ হত শলির মাপে। কুড়ি পা্ইতে এক শলি। এর মাপে মিলত তাঁদের মজুরি। সেটাও মুড়ি। আবার মুড়ির মাপ ধরেই তাঁদের যশ। গ্রামের নদী-পুকুরের ঘাটে এঁদের খ্যাতি থাকত বহুকাল। আর খ্যাতি রয়ে গেল আবদাল্লার: হীরে-জহরতের গুহার মুখে নিজস্ব শ্রেণির কল্পনার উপর দাঁড়িয়ে উল্লাস: মুড়ি খাব বস্তা বস্তা।

স্বচ্ছল গৃহস্থের একজন সারা বছরের ‘ভাজিয়ে’ থাকতেন। আমাদের বাড়িতে ছিলেন চারুবালা প্রামাণিক। মাঠের ধান উঠলে (আমন ধান) এঁরা একটা বাঁধা ধান পেতেন। পালে পার্বনে শাড়ি আর চাদর। আরও কয়েকটা ঘরে চারুবালা ভাজিয়ে ছিলেন। তাঁর সারা বছর এভা্বেই চলে যেত। প্রায় প্রতি গ্রামে অনেক মহিলা মুড়ি ভেজেই সংসার নির্বাহ আর ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার কাজ চালিয়ে যেতেন।

আগেই বলেছি, রাসবিহারী ঘোষাল আমাদের কুলপুরোহিত ছিলেন। তাঁর অজস্র শিষ্য বাড়ি থেকে আসত আতপচাল ছাড়া মুড়কি, ঢেঁকিতে কুটে খইয়ের দানায় গুড় সহযোগে হাতের তালু-প্রমাণ নাড়ু, চিনির নানা আকারের গজা, বিশাল আকারের টানা নাড়ু, বোঁদে গাঢ় চিনির পাকে ফেলে হাতের তালু ধারণে অক্ষম গোলাকার বল, আর এরই প্রকারভেদ একটি ত্রিকোণাকার মিঠাই— নাম মঠ, আর চালের গুঁড়ো গুড়ে পাক করে তেলে ভেজে চ্যাপ্টা গোলাকার গুড়-পিঠে। এগুলির সরবরাহ মাস-বছরভর মন্থর হত না। তাঁর কোঠাঘরের উপরে শ্রেণিবদ্ধ হাঁড়িতে এগুলি রক্ষিত হত। আশ্চর্য এই যে তিনি আমাকে অজ্ঞাত কারণে এতটাই স্নেহ করতেন যে, আমি না থাকলেও ওই সব মিষ্টান্নের একটা বিরাট অংশ তাঁর আদেশে আমার জন্য রক্ষিত হত।

শালডাঙার পিছনে পূর্বে গতিমান দ্বারকেশ্বরের উত্তর তীর ধরে যে-সব গ্রামগুলি ছিল সেখানে উৎপাদন হত প্রচুর ছানার। জেলাসদরের মিষ্টান্নবাজারের একটা বড় অংশ সেখান থেকেই সরবরাহ হত। বাঁকের দুদিকে গামছা ঢাকা দেওয়া জলসিক্ত ছানা বাঁশের ঝুড়িতে চাপিয়ে গোপ যুবকেরা সারি দিয়ে আলপথ ধরে এসে উঠত আমাদের গ্রামে, তারপরে গন্ধেশ্বরী পার হয়ে সদরের পথে। শহরে ছানা সরবরাহের আরও দুটি প্রধান ক্ষেত্র ছিল। বাঁকুড়া জং-এর হাওড়াগামী পরের স্টেশন ভেদুয়াশোল। আর উত্তর-পশ্চিমে ছাতনা কমলপুর। এগুলি থেকে ছানা আসত বিএনআর রেলপথে। সেকালে যে কোনও উত্তম ছানার মিষ্টির দাম দু-আনার বেশি ছিল না। ওই মিষ্টি আকারে ছোট হলে দাম হত এক আনা।

সেকালে যে-সব মিষ্টান্ন হত তাদের নামগুলি এখনও বর্তমান। রসগোল্লা। প্রাণতোষিণী— পানতুয়া। লেডিকেনি। এটি পানতুয়ার থেকে এক পোঁচ বেশি ভাজা, একটু লম্বা। (পিতৃদেব বলতেন লেডি ক্যানিং। তাঁর নামেই এই মিষ্টি।) তখনকার সব ভাজা মিষ্টি দেশি অর্থাৎ ভঁইসা ঘিতে ভাজা হত। (আর একটা ঘি আমদানি হত টিনবদ্ধ হয়ে: চালু নাম ছিল ঘন্টুর ঘি। আসলে নামটা পরে জেনেছি, গুন্টুর ঘি। এটি ছিল গরু এবং ভঁইসের মিশ্র ঘি। নতুন গঞ্জের মারোয়াড়ি সম্প্রদায় এর আমদানি করত। ভোজনও করত।) চমচম— চ্যাপ্টা জিবের আকার, চিনির পুরু রসে ডুবিয়ে তোলার পরে চিনিতে গড়াগড়ি দিয়ে তুলে রাখা। বাটা ছানার সন্দেশ। আমআদা দেওয়া আমসন্দেশ। বিশুদ্ধ ক্ষীরের ‘আবার খাব’। শক্ত ক্ষীরের প্যাঁড়া। নিখুঁতি, এটি ইঞ্চি পরিমাণ ছানার মিষ্টি, উত্তম কড়া পাকে ঘিয়ে ভাজা, আর আদি মিষ্টান্ন— জিলিপি। এটা দু-ধরনের হত। বেসন এবং চালের গুঁড়ো রাতভর গাঁজিয়ে পরের দিন একটা বহুব্যবহৃত ফুটো-সহ মাপমতো পুরু কাপড়ে রেখে ভর্তি কড়াই গরম তেলে ভাজা হত পাক দিয়ে। তারপরে চিনির রসে। আর অন্যটা ছানার। ফেটানো ছানা ওই পদ্ধতি ধরে ঘিয়ের কড়াইয়ে ভেজে সরল রসে ফেলা হত। বোঁদে ছিল সর্বসাধারণের ভোগ্য।

একটা সময়, বাহান্ন-তিপ্পান্ন সালে, লালবাজারের ময়রার দোকানগুলিতে বোঁদের প্রতিযোগিতামূলক দাম টাঙিয়ে দেওয়া হত। এক সের দেড় টাকা। পরের দিন পাশের দোকানে, এক টাকা চার আনা। তারপরে একদিন আর একটা দোকানে, এক টাকা। এইটাই মান দাঁড়িয়ে গেল। আর দেবভোগ্য যে মিষ্টি দুটি আবহমান চলে আসছে: মণ্ডা আর বাতাসা। তবে দেবতাদের উদ্দেশে তৈরি মণ্ডা গুঁড়ো চিনির মধ্যে অত্যল্প ছানার প্রক্ষেপ দিয়ে পেটাই, আর মনুষ্যভক্ষ্য মণ্ডা ক্ষীর-ছানার মিশ্রণের সঙ্গে হালকা চিনির পেটাই।

এই মিষ্টান্নগুলির মধ্যে টানা নাড়ু খাদ্যটির সঙ্গে বাঁকুড়া জেলার বাইরের মানুষেরা বোধকরি বিশেষ পরিচিত নন। এ মেঠাইটিও গুড়ের। সর্বসাধারণের মেঠাই। এটি প্রতিষ্ঠিত মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে মিলত না। এখনও মেলে না। মিলত দক্ষিণ রাঢ় বরাবর মুড়ি-চপ-তেলেভাজার দোকানে। মুটে-মজদুর, সাধারণ কর্মচারী, এবং মধ্যবিত্তের সকালের নিয়মিত আহার। শালপাতার খালায় (পাতাটিকে মুড়ে চোঙার আকার দেওয়ার নাম খালা) সের মাপের মানে (আধসের, এক কনা, অর্থাৎ এক পোয়া) তৈরি চোঙাটিতে আদেশমতো মুড়ি দেওয়া হত। চিবুকের পরিশ্রম লাঘব করার জন্য পড়ত জল। এর পরে আলুর চপ চটকে মুড়ির ভিয়েন হত নমনীয়। সুবাসে ভরপুর। তেলে ভাজা একটি শুকনো লঙ্কা। সব শেষে একটি টানা নাড়ু। নাড়ুটির দাম অনুযায়ী আকারের বৃদ্ধি ঘটত। ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে একটি বড় টানা নাড়ুর দাম ছিল দু-পয়সা। ময়রা রাত্রে পাকাত নাড়ু। ছোলার বেসন পুরু বেশ মোটা করে ফেটানো হত। নুন ছাড়া। এর পর মোটা চানা তৈরি করা হত সরষের তেলে ভেজে। ভাজা চানাগুলি ইঞ্চিখানিক আকারে ভেঙে তুলে রাখা হত। এর পরে একটা বড় কড়াইতে গুড়ের পাক। পাকটি গাঢ় হলে নামিয়ে মৃদু গরম রেখে তার মধ্যে দেওয়া হত চানাগুলি। দু-হাতের তালুতে সরষের তেল মেখে পাকানো হত নাড়ু। হাতে গুড় লাগত না। বর্ষাকাল ছাড়া নাড়ুগুলির পরমায়ু তিন মাসের কম হত না।

জেলাসদরের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন রকমের তেলেভাজার প্রসিদ্ধি ছিল। দুটি এলাকার কথা মনে পড়ে: রাসতলা আর দোলতলা। বিভিন্ন মশলা আর উপকরণ দিয়ে চপ তৈরি হত। আবার তার বিজ্ঞাপনও বের হত, যেমন পেঁয়াজ-বিযুক্ত নিরামিষ চপ। তখন গাজর-বিটের চাষ হত না, আমদানিও হত না, কাজেই এখনকার ভেজিটেবল চপ বলতে যা বোঝায় তা ছিল না। সদর বাজারে, কোর্ট-কাছারির আশে পাশে নানা মাপের ভোজনালয় গড়ে উঠেছিল। এগুলির নাম ছিল পাইস হোটেল। ভাত, ডাল, ভাজা, একটা পাঁচতরকারি বা কুমড়োর ঘ্যাঁট আর একটি চারাপোনা। সব মিলিয়ে দাম পড়ত ন-আনা। অতিরিক্ত এক বাটি ভাত এক আনা। ডাল বা ঘ্যাঁট এমনিই পাওয়া যেত। আবার রুটির দাম ছিল চার আনায় চারটে, সঙ্গে ছোলাসেদ্ধ দিয়ে কুমড়োর ছক্কা। দেশি ঘিয়ের পরোটার দাম ছিল দু-আনা। সঙ্গে আলুভাজা। একটি মিষ্টি এক আনা।

বাঁকুড়ার মেঠাই প্রসঙ্গে বিষ্ণুপুরের মোতিচুর লাড্ডুর কথা আসে। আমি শৈশবে বা যৌবনে কখনও বিষ্ণুপুরে এই লাড্ডু খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। পরে আমার পুত্রের কাছে শুনেছি এটি মুঘল মেঠাই। মুঘলদের সঙ্গে বিষ্ণুপুরের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ সুবিদিত— গঞ্জিফা যদি দশাবতার তাস হয়ে আসতে পারে, মোতিচুরই বা নয় কেন? তবে আমি দেখিনি বা খাইনি।

 

[ক্রমশ]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5222 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...