
জয়ন্ত দেবব্রত চৌধুরী
রত্নগিরির শ্বেত হস্তী
বিরূপার স্ফটিকস্বচ্ছ জলে শশধরের স্মিত হাস্য মিশে গেলে রত্নগিরির চূড়ায় পরিস্ফুট হয় দেবতাদের সমাধিক্ষেত্র। রানিপুখুরির বনের ভেতর সন্তর্পণে ঢুকলে দেখা যায় রক্তমৃত্তিকায় অর্ধপ্রোথিত অবলোকিতেশ্বরের কঙ্কাল; কালপেঁচা এসে ঠুকরে খেয়েছে তার অপরূপ লাবণ্য, বনরুই আঠালো জিভ দিয়ে চেটে নিয়েছে তার বিগতজন্মের যত স্মৃতি। আকন্দের ঝোপ সযত্নে ঢেকে রাখে পুরনো মঠের গর্ভগৃহে উপবিষ্ট মুণ্ডহীন মঞ্জুশ্রীর অপার দৈন্য। বাঁশঝাড়ের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে হাজার বছরের সাধনার ধন, বল্মীকে ঘেরা ভগ্ন বুদ্ধমূর্তি। কিয়দ্দূরে শেষশয়ানরত মহাবিহারের নিচে চাপা পড়ে আছে মহাকালচক্র; মহাস্তূপের পূজার স্থলে ছড়িয়ে আছে কত ভগ্ন অণ্ড হর্মিকা ছত্রী সোপানসারি; নিশ্চেষ্ট প্রস্তরপ্রান্তে জেগে থাকে শুধু প্রাচীন প্রহরী উগ্রসিংহের করুণ মুখব্যাদান।
রুক্ষ টিলার ওপর পরিত্যক্ত কোনও মন্দিরচত্বরে নিভুনিভু অগ্নিকুণ্ড ঘিরে বসে থাকে জটাজুটধারী বৃদ্ধ তাপস আর তাকে জড়িয়ে বসে থাকে ছোটবড় কত উৎসর্গস্তূপ। বাল্যে দাঁড়কাক নিয়ে গেছে তার ডান চোখ, কৈশোরে জাদুকরী এক ডোমনী নিয়ে গেছে তার জবাকুসুমের মালা, যৌবনে জমিদারের লেঠেল এসে নিয়ে গেছে তার সমূদয় কৃষিযোগ্য ভূমি, আর প্রৌঢ়ত্বের মুখে গুরুর আশিস নিয়ে গেছে তার পূর্বাশ্রমের নাম!
রাত্রি দ্বিপ্রহরে আলি-কালি চরণে ঘণ্টানূপুর দুলিয়ে আসে শিখীপুচ্ছপরিহিতা ষোড়শী শবরীবালা; গলায় ঝোলে তার গুঞ্জার মালা, রবি-শশী দোলে তার কুণ্ডল আভরণ হয়ে, নামটি তার সহজসুন্দরী। এসে কানে কানে বলে গুহ্যসাধনার যত সারকথা, পূর্ণচন্দ্রের রাতে ক্ষুধিত বাঘিনীতে রূপান্তরিত হওয়ার হারানো মন্ত্র, একাকী পুরুষের দু-হাতে তুলে দিতে চায় ঢিবির তল থেকে বের করে আনা হেব্রজ্রের প্রস্তরপেটিকা। প্রবীণ তপস্বী শুনেও শোনে না নারীর আলতো শীৎকার, দেহভর কাঁপতে থাকা মৃদুমন্দ গর্জন। ধীর পায়ে চলে আসে খাদের প্রান্তে, যেখানে ময়ূরকণ্ঠী পাহাড়ের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকেন চতুর্ভুজা তারা, একহাতে জপমালা আর অন্যহাতে বরদমুদ্রা নিয়ে। মূর্তির মসৃণ শ্যাওলামাখা শরীরে চাঁদের থকথকে সবুজ আলো পিছলে পিছলে যায়, মাথার পেছনে তিনটে খদ্যোতিকার আলো যেন অলৌকিক জ্যোতির্বলয় রচনা করে। তার সামনে দাঁড়িয়ে একক নয়নে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে বিমুগ্ধ সাধক। কখন যেন নতজানু হয় নিজের অজান্তেই; সুদীর্ঘ রজনীর অন্তিম মুহূর্তগুলোর মতো, শীতের শরীরে জমিয়ে রাখা শেষ উত্তাপের মতো, কুয়াশায় ঝরে পড়া বুনোফুলের শেষ ঘ্রাণটুকুর মতো কুড়িয়ে বাড়িয়ে দেবীর পায়ে সমর্পণ করে দিনান্তের সাধনার যত পুণ্যফল।
ঊনকোটির কৃষ্ণ বৃষভ
হেমন্তের শ্রান্ত অপরাহ্ণে যখন পঞ্চদশী পাহাড়ি ঝোরা রঘুনন্দন শৃঙ্গ হতে অতলে ঝাঁপ দেয় তীব্র আত্মঘাতী ইচ্ছেয়; প্রবল ফেনার মধ্যে তখন রুগ্ন গিরিখাত গর্ভমোচন করে জন্ম দেয় কঙ্কালসার গণেশমূর্তির। বিকট ক্ষুধায় হাহাকার করেন সদ্যোজাত হস্তীদেব, অতিকায় শুণ্ড আর ক্ষুদ্র ষড়বাহু বিস্তার করে জড়িয়ে ধরতে চান জগৎসংসার; আপন অলৌকিক আয়ুধ দেখিয়ে তাঁকে ভুলিয়ে রাখেন আকস্মিক পালকপিতা, চতুর্ভুজ তন্ত্রবিষ্ণু।
জটাজালের জীবন্ত সাঁকো বেয়ে উপরে উঠলে দৃশ্যমান হয় দেড়ক্রোশব্যাপী মাংসাশী মুণ্ডমূর্তির প্রস্তরপ্রাচীর। উগ্রদংষ্ট্রা অঘোররুদ্রের মণিমণ্ডিত রত্নমুকুট নিঃশর্ত প্রহরা দেয় তপঃক্লিষ্টা মকরবাহিনি গঙ্গা। মনু নদীর মৃদু বুকের মাঝে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে সদ্যোত্থিত চতুর্মুখলিঙ্গ। অধঃপতিত এক দৈবীমুখ নিষ্পলক নেত্রে চেয়ে থাকেন তাঁর অমোঘ আততায়ী আঙুরলতার পানে, স্মিত হেসে খোলা আকাশের নিচে স্থির প্রতীক্ষা করেন আবশ্যিক লয়প্রাপ্তির।
ময়নামতির টিলার মাথায় শজারু শিকারে মাতে নিষ্পাপ কিরাতদম্পতি— সদ্যযুবার হস্তে থাকে সতর্ক ধনুর্বাণ, কণ্ঠে দোলে অস্থিমালা; সঙ্গিনী কোমল নারী কর্ণকুণ্ডলবজ্রধারিণী, বাহুতে পুষ্পকবচ। পিতামহ পিতামহী তার পাঁচ দশক আগের উচ্ছল এক জ্যোৎস্না রাতে নৃত্যগীতের মধ্যপথেই পর্বতগাত্রে ক্ষোদিত গুহাচিত্র বনে গেছে কার যেন অকারণ অভিশাপে। কীসের অজানা আশঙ্কায় শিংশপা শাখা হতে সুবিশাল লম্ফে গহীন বনে গিয়ে ঢোকে চিরঞ্জীবী চন্দ্রবানর, আর আজীবন তাকে তাড়া করে ফেরেন সিংহমুখী স্থানীয় অপদেবী।
পুজোর পাহাড়ের শেষ সেবায়েত তাম্রপাত্রে নারিকেল পত্র-পুষ্প ভোগ এনে অর্পণ করে ত্রিশূলের দীর্ঘ ছায়ার তলায়। আদিম দেবতা লোলুপদৃষ্টে দেখতে থাকেন মলিন নাথযোগীকে, ভক্ত পিছন ফিরলে মহাকালের প্রকাণ্ড পাথুরে চোয়াল গ্রাস করে তার তুচ্ছ অস্তিত্ব; কালভৈরবের বক্র ওষ্ঠে দেখা দেয় ক্রূর হাস্যরেখা, শিরোভূষণের রুদ্রাক্ষমালায় সহসা যেন জ্বলে ওঠে সূর্য-চন্দ্র, তৃতীয় নয়ন ঝলমল করে খরশান খুশিতে। দিনান্তের দগ্ধ আলোয় রুক্ষ ভূমিতে শুধু শুক্লবায়সের কিছু ছিন্ন পালক ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে ইতস্তত।
গোপাচলের লোহিত সিংহ
প্রাগৈতিহাসিক নভশ্চরের ন্যায় অতিকায় জলধর হিংস্র পক্ষবিস্তার করে নেমে আসে অতর্কিতে গোপাচলগিরিকে গ্রাস করতে; ঘোর কৃষ্ণ গগনগাত্রে দৃশ্যমান হয় ঘন ঘন অশনিসঙ্কেত। প্রাচীন প্রস্তরকূপ পরিপূর্ণ হয়ে উপচে পড়ে শ্রাবণের বারিধারা, পঙ্কপিচ্ছিল হয়ে ওঠে পাহাড়ি সাধনপথ। বিদ্যুৎচমকে ক্ষণিকের তরে দৃশ্যমান হয় পর্বতপ্রকোষ্ঠে শিলীভূত অর্হতের সারি; প্রতি বজ্রপাতের সাথে ঝলসে ওঠে তাঁদের বক্ষস্থিত শ্রীবৎস চিহ্ন। মঙ্গলকলস উল্টে গিয়ে ধ্যানস্থ মূলনায়কের মসৃণ দেহ চুইয়ে নামে বিন্দু বিন্দু কৈবল্য। নেমিনাথের শঙ্খের ওপর জন্মানো বিষণ্ণ ছত্রাকের বন্য ঘ্রাণ ছড়িয়ে যায় চরাচরে; ঋষভনাথের ভগ্ন মস্তকে অসহায় আশ্রয় নেয় গ্রহান্তরের অষ্টভুজ কম্বোজ; শ্রেয়াংসনাথের স্বর্ণাভ গণ্ডারের সতর্ক প্রহরা দেয় গজারূঢ় গদাধারী গোমুখ যক্ষ; প্রবল বাতাসে প্রভু পার্শ্বনাথের গুহাচৈত্যর কুলুঙ্গিতে রাখা জীর্ণ মৃৎপ্রদীপ নির্বাপিত হয়। অবিশ্বাসীর দীর্ঘশ্বাসে পরিত্যক্ত এই অনৈসর্গিক নির্বাণক্ষেত্র, বিধর্মীর অকুণ্ঠিত খড়্গ সযত্নে মুছে দিয়েছে তীর্থঙ্করের যত লাঞ্ছনচিহ্ন, ভুলে যাওয়া ভক্তের নির্লিপ্তি দশকে দশকে শল্কমোচনের মতো খসিয়ে দিয়েছে দেবতার দেহত্বক; অরিহান্তের অস্থি কটা ভদ্রাসনে বসে আছে শুধু।
বিস্মৃতপ্রায় বিবরমন্দিরে শয়িত কৃশতনু নিঃসঙ্গ শ্রমণের নিদ্রাভঙ্গ হয় সহসা চকিত চাঁদের আলোয়, গুহামুখে এসে পড়ে একশিলা চন্দ্রপ্রভর চল্লিশ হাত ছায়া। মহাজাগতিক কোনও মুহূর্তে জ্ঞানী আত্মার মৃদু কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয় পারিপার্শ্বিক, মুছে যায় লৌকিক স্থান-কাল-মাত্রার স্থির সংজ্ঞা। তখন কল্পবৃক্ষের কাণ্ডের করুণ স্পর্শে যোগী লাভ করে অনন্ত জ্ঞান, উড়ন্ত নিশিময়ূরের কণ্ঠনীলিমায় সে দেখতে পায় অনন্ত দর্শন, জ্যোতির্ময় জিনমূর্তির হস্তধৃত কমলকোরকে সে খুঁজে পায় অনন্ত সুখের সঠিক সন্ধান, ছেদনিকার অমোঘ আঘাতে মৃত মর্মরে সপ্তফণার প্রাণসঞ্চারে সে লাভ করে অনন্ত বীর্য। কর্কশ কক্ষতলে জমা জলজ দর্পণে প্রতিফলিত হয় চৌবিংশতি দৈবী প্রতিবিম্ব; সেই রূপ দেখে কায়োৎসর্গ মুদ্রায় নিশ্চেষ্ট দাঁড়িয়ে থাকে মোহিত যোগী। তার বাহুমূলে জড়িয়ে যায় কচি আকর্ষী লতা, তার কেশজটায় গুটি বাঁধে রেশমকীট, তার জঙ্ঘার ’পরে সরসর সরে যায় বিষধর ভুজঙ্গ; তবুও সে স্থাণুবৎ রয়ে যায়। নিষ্পলক নয়নসম্মুখে শুধু নির্গ্রন্থ নটপুত্তের প্রকাণ্ড পাদপদ্ম জেগে থাকে বাস্তবের শেষ দিকচিহ্ন হয়ে।
*সমস্ত ছবি লেখকের তোলা