তেভাগা আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য— চা-বাগানের প্রেক্ষিতে

পৃথা তা

 


তেভাগার ভূমি-সংগ্রামের আলোকে পরিষ্কার যে— পশ্চিমবঙ্গের চা-বাগিচার জমিসমস্যা মূলত জমির অধিকার থেকে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক বঞ্চনা। তেভাগা প্রশ্ন তুলেছিল: যিনি শ্রম দেন, তিনি জমির ওপর অধিকার পাবেন। কিন্তু চা–শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সেই দাবি এখনও অসম্পূর্ণ, এবং তাই পশ্চিমবঙ্গের চা-অঞ্চলে জমিসংক্রান্ত আন্দোলন আজও একপ্রকার ‘অসমাপ্ত তেভাগা’র প্রতিধ্বনি

 

১৯৪০-এর দশকে বাংলায় চাষবাস এবং উৎপাদিত ফসল বণ্টনের একটি পদ্ধতি (sharecropping system) ছিল। তাকে বলা হত ‘আধিয়ার’, ‘ভাগচাষ’। অর্থাৎ যাঁরা জমিদারের বা জমির মালিকের জমিতে চাষ করতেন এবং উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক বা কাছাকাছি অংশ জমিদার বা জমির মালিকের কাছ থেকে দাবি করতেন। এই পদ্ধতিকে বাংলায় সাধারণত “আধি/ভাগ/আধিয়রি” ব্যবস্থা বলা হত।

তবে, এই বণ্টন-ব্যবস্থা চাষিদের জন্য ছিল অত্যন্ত অসাম্যের ও অন্যায়ের। তাঁদের মূল দাবি ছিল: তাঁরা শ্রম দেন, জমি চাষ করেন, ফসল উৎপাদন করেন— কিন্তু ফলাফল হিসেবে তাঁদের অংশ অত্যন্ত কম। এছাড়া, ১৯৪৩ সালের বাংলায় দুর্ভিক্ষের প্রাদুর্ভাব ঘটে৷ তখন থেকেই গ্রামীণ অঞ্চলে তীব্র দারিদ্র্য, ক্ষোভ এবং কৃষকশ্রেণির মধ্যে আন্দোলনের বীজ বোনা হতে থাকে।

এর আগে-আগেই ১৯৩৮ সালে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, দিনাজপুর, রংপুর ও অন্যান্য অঞ্চলে জমিদারি প্রথা ও ভাগচাষি শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠতে থাকে। মূলত এই প্রতিবাদই তীব্র আকার ধারণ করে দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে।

ঐতিহাসিকভাবে বলতে গেলে, ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণসভা— কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার কৃষক ফ্রন্ট— উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলায় তেভাগা আন্দোলন ঘোষণা করে। “তেভাগা” শব্দটির অর্থ হল “তিন ভাগ” বা “তিন ভাগের অধিকার”। আসলে দাবি ছিল— ভাগচাষি যাতে উৎপাদিত ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ নিজেরা পায়, এবং জমিদার বা মালিক শুধুমাত্র এক-তৃতীয়াংশ পায়।

এই আন্দোলন মূলত ১৯৪৬-৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গপ্রদেশে (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অংশ) সংগঠিত হয়।

 

আন্দোলনের গতিপথ

প্রথম দিকে, আন্দোলন শুরু হয় গ্রামীণ অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, রংপুর, খুলনা, ২৪ পরগনা ও যশোর জেলা–তে। দায়িত্বশীল কৃষক সংগঠন ও কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ওইসব এলাকায় সংগঠিত আন্দোলন চালায়, ভাগচাষিদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে।

ভাগচাষিরা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে দাবি তোলে— “আধি নয়, তেভাগা চাই” (আধি = অর্ধেক, তেভাগা = দুই-তৃতীয়াংশ)। তারা কোঠা গুদামে বা জমিদারের খামারে, ফসল জমা দেওয়া থেকে বিরত থাকে, নিজেরা যৌথভাবে খামার বানিয়ে ধান মাড়াই শুরু করে।

এর ফলে জমিদার বা জমির মালিকদের প্রতিক্রিয়া কঠোর ছিল— পুলিশি অভিযান শুরু হয়। হিংস্র দমনপীড়ন, গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয় আন্দোলনকারীদের৷ তাঁদের মধ্যে মহিলা আন্দোলনকারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটানো হয়। আন্দোলন-ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও ভাগচাষিরা নিজেদের এলাকায় “তেভাগা এলাকা” বলে ঘোষণা করেন এবং স্থানীয় কমিটি গঠন করেছিলেন।

 

রাজনৈতিক গুরুত্ব

তেভাগা আন্দোলনের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেকদিক দিয়ে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে:

এক, কৃষকশ্রেণির রাজনৈতিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি: ভাগচাষিদের মধ্যে দলবদ্ধ ভাবনা ও সংগ্রামের মনোভাব গড়ে উঠেছিল। পূর্বে যেসব মানুষ শুধু চাষি বা শ্রমিক ছিলেন, আন্দোলনের ফলে তারা শ্রেণিগত দাবি ও রাজনৈতিক দাবির অংশীদার হয়ে ওঠেন।

দুই, ভূমিসংস্কার ও জমিদারি প্রথার অবসান: যদিও আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সব দাবি মেটেনি, কিন্তু গণ-স্তরে জমিদারি প্রথা ও ভাগচাষি শোষণের বিরুদ্ধে একটি বাস্তব চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়।

তিন, ধর্ম ও জাত-ভিত্তিক বিভাজনের বাইরে শ্রেণিভিত্তিক ঐক্য: বাংলা অঞ্চলে ধর্ম বা গোত্রভিত্তিক বিভাজন প্রচলিত ছিল নানারকমভাবে। শুধু হিন্দু-মুসলমান না, হিন্দুদের মধ্যেও ব্রাহ্ম, বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব ভাগ ছিল। এই প্রথম দেখা গেল মানুষ সবরকম সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও ভেদাভেদ দূরে রেখে শ্রেণির পরিচয়ে গর্বিত হচ্ছেন ও শ্রেণিসংগ্রামের ভিত্তিতে আন্দোলনের অংশ হচ্ছেন। তেভাগা আন্দোলনের সময় হিন্দু-মুসলিম ভাগভেদ বহুল অংশে কম লক্ষিত হয়েছিল সমাজে৷

চার, বামচিন্তার উত্থান ও দলীয় রাজনীতিতে উৎপাদক অংশের যোগদান: অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভা (এআইকেএস) এবং কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া-র হাত ধরে কৃষক রাজনীতির একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়। জমিদারি, ভূমি-অধিকার, ভাগচাষির অধিকার ইত্যাদির প্রশ্ন রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে উঠে আসে। এর আগে কংগ্রেসের হাত ধরে, মূলত মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, শিল্প-সাহিত্যে ও সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে থাকা এক অংশ ছিল বাংলার রাজনীতির ধারকবাহক। এই প্রথম দেখা গেল মেহনতি, ঘাম ঝরানো, শিক্ষার আলো না পাওয়া, দরিদ্র, শ্রমদানকারী উৎপাদক মানুষেরা রাজনৈতিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন।

 

কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা

তৎকালীন সময়ের বাম রাজনীতি, বিশেষ করে সিপিআই ও তার কৃষক সংস্থা এআইকেএস-এর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য।

  • এআইকেএস ও বিপিকেএসএর মাধ্যমে সংগঠিত: তেভাগা আন্দোলন মূলত এআইকেএস বা তার প্রাদেশিক শাখা বিপিকেএস দ্বারা সংগঠিত হয়।
  • নেতৃত্ব-প্রশিক্ষণ-সমর্থন: কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডার গ্রামীণ এলাকায় কাজে নামে— চাষিদের সঙ্গে উঠেপড়ে লড়াই শুরু করে, মিছিল করে, দাবি সংগঠিত করে।
  • প্রচার ও রাজনীতি: বাম-মতবাদী দলগুলো ভাগচাষিদের মধ্যে শ্রেণির সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক শিক্ষা দেয়।
  • সংগ্রামের রাস্তায় সহিংস প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ: যখন জমিদার-মালিক ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী দমনপীড়ন চালায়, ওই সংগঠনগুলির সঙ্গে ভাগচাষিরা দলবদ্ধভাবে লড়াই চালান।

সুতরাং, কমিউনিস্ট পার্টি ও তার কৃষক ফ্রন্টের কারণেই আন্দোলনের সাধারণ চাহিদা, সংগঠিত রাজনৈতিক আঙ্গিকে রূপান্তরিত হয়, শ্রমজীবী মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় তার শ্রেণিপরিচয়— এ-কথা উঠে আসে সমাজের উচ্চকোটির মধ্যেও।

এই আন্দোলনের কাণ্ডারীরা ছিলেন—

ইলা মিত্র: পিতৃতন্ত্রে, স্ত্রীবিদ্বেষে, অপুষ্টি-অশিক্ষায় জর্জরিত দেশে, শ্রেণি-আন্দোলনের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে রয়ে যাবে কমরেড ইলা মিত্রের নাম। তাঁকে আন্দোলনকারী হওয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার, লাঞ্ছনা, চরম শারীরিক, মানসিক হেনস্থা করা হয়। রাজবন্দি হওয়া সত্ত্বেও পুলিশি হেফাজতে তার ওপর হওয়া ধর্ষণের বিবরণ শুনে কেঁপে উঠেছিল সমগ্র উপমহাদেশ। তিনি ছিলেন বর্তমানে বাংলাদেশ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। তিনি নিজে একটি জমিদার পরিবারে বিবাহিত ছিলেন, কিন্তু ভাগচাষিদের সংগঠনে যোগ দিয়ে “রানিমা” নামে পরিচিত হন। সাঁওতাল ও অন্যান্য আদিবাসী মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে ভাগচাষিদের সংগঠিত করেন, সভা-সমাবেশ আয়োজন করেন এবং দমনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।

হরেকৃষ্ণ কোনার: বর্ধমানের ধনী পরিবারের সন্তান হয়েও নিজেকে মতাদর্শে শানিত করে শ্রেণিচ্যুত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিমবাংলার বিশেষ করে রাঢ় অঞ্চলে কৃষকদের একত্রিত করে শুরু করেন ব্যাপক আন্দোলন। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট কৃষক সংগঠক, বাম রাজনীতির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, তেভাগা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।

মণি সিংহ: বাংলাদেশের তেভাগা আন্দোলনে ভাগচাষিদের সংগঠনে সক্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে তেভাগা নিয়ে বিরাট অংশের কৃষকসমাজকে একত্রিত করে লাগাতার আন্দোলনের সূচনা করেন। সহ্য করেন বহুবিধ দমন-পীড়ন।

বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়: পশ্চিমবঙ্গের বাম নেতা, যিনি কৃষক আন্দোলনে কার্যকর ভূমিকা নিয়েছিলেন।

পূর্ণেশ্বরী বর্মন: উত্তরবঙ্গের এক মহিলা আন্দোলনকারী, এই আন্দোলনের সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন। সহ্য করেছেন দমনপীড়ন। ছিলেন বহু আন্দোলনের সংগঠক ও সাথী।

এছাড়াও কৃষ্ণবিহারী পাণ্ডে, গুরুপ্রসাদ সিং, সত্যেন বসু, জ্ঞানু সর্দার, তুলসী বর্মন, চারু মজুমদার প্রমুখরা অতি উজ্জ্বল ভূমিকা নিয়েছিলেন দুই বাংলার তেভাগা আন্দোলনের উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে।

এই নেতা-নেত্রীরা শুধু সংস্কারমূলক দাবি তোলেননি, তাঁরা সরাসরি মাঠে নামেন— সভা করেন, মিছিল করেন, ভাগচাষিদের সঙ্গে ঘাঁঘি দেন, কয়েকবার পুলিশ ও জমিদার-বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষেও অংশ নেন।

 

আন্দোলনের ফলাফল

তেভাগা আন্দোলনের ফলাফল অনেকস্তরীয়— যার মধ্যে অনেকগুলিই দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ।

  • সরাসরি ফলাফল: আন্দোলনের ফলে বেশ কিছু এলাকায় ভাগচাষিদের দাবি অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ ফসল ভাগের ধারণা বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়।
  • আইনগত ও নীতিগত পরিবর্তন: পশ্চিমবঙ্গের পরবর্তী ভূমিসংস্কার কর্মসূচি ও বর্গাদারি আইন গ্রহণের পেছনে তেভাগা আন্দোলনের সরাসরি ও মুখ্য প্রভাব ছিল। ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার “বর্গাদারি আইন” প্রণয়ন করে, যেখানে ভাগচাষিদের অধিকার ও ফসলের অংশের বিষয়ে কিছু স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
  • সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব: সাধারণ কৃষকের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, কৃষক-শ্রমিক সমাজ আরও সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়।
  • মহিলা নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ: আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ নজরকাড়া— নারী বাহিনী নামে পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে নামেন অনেক মহিলা।
  • দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব: যদিও তৎক্ষণাৎ সব দাবি পূরণ হয়নি, তবে এই আন্দোলন পরবর্তী কৃষক আন্দোলন, বাম রাজনীতির উত্থান, এবং বাংলার গ্রামীণ রাজনীতিতে একটি মাইলস্টোন হয়ে ওঠে।

 

তেভাগা আন্দোলন বাংলা কৃষক-জমিদারি সম্পর্ক এবং গ্রামীণ রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই আন্দোলন শুধু একটি অর্থনৈতিক দাবির আন্দোলন ছিল না— এটি ছিল ভূমি, শ্রম, স্বার্থ, শ্রেণি এবং রাজনীতির মধ্যেকার সংগ্রাম। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া ও তার কৃষক সংগঠন শিল্পী-সহায়ক হয়ে আন্দোলনকে সংগঠিত ও গতিময় করে তোলে। নারী-নেতৃত্বও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, যা তখনকার সময়ের জন্য অত্যন্ত অগ্রগামী। ফলাফল আজকের দিনে পুরোপুরি হয়নি বললেও, এই আন্দোলনের কারণে কৃষক আন্দোলনকে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে স্থান দেওয়া সম্ভব হয়, বামচিন্তার কৃষক রাজনীতিকে নতুন শক্তি দেওয়া হয় এবং বাংলার গ্রামীণ সমাজে এক নতুন সচেতনতা এসেছে।

এই আন্দোলনের আর এক বিরাট ভূমিকা ছিল সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। প্রচুর নাটক, পথনাটিকা, গান (সলিল চৌধুরীর অনেক গান আছে), সাহিত্য, সিনেমায় এর প্রভাব পড়েছে সরাসরি। বাংলা সাংস্কৃতিক জগতে ফুলেল ও উচ্চমার্গীয় উন্নাসিকতা কাটিয়ে এই প্রথম শ্রমজীবী মানুষের লড়াই, আন্দোলন ও জয়ের প্রভাব পড়ল।

 

বর্তমান: চা-বাগানের জমি সমস্যা

এখন এই আলোকে বর্তমানের চা-বাগিচার জমি-সংক্রান্ত সমস্যা আমরা দেখবার চেষ্টা করব।

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম আর পশ্চিমবাংলার উত্তর প্রান্তের পাঁচটা জেলা জুড়ে পাহাড় ও পাহাড় পাদদেশের তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে বিছিয়ে আছে চা-বাগিচা।

চা-শিল্প এক সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে গড়ে উঠেছিল। এই শিল্প শুধু একটি বাণিজ্যিক অঙ্গ নয়, বরং সেখানকার লক্ষ লক্ষ শ্রমিক পরিবারের জীবিকা, সামাজিক সংগঠন, ভূমিসম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক চিত্রের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এই শিল্পের ঘাঁটিতে অনেক সমস্যা লুকিয়ে আছে— বিশেষ করে চা-বাগানের জমি ও শ্রমিক-সম্পর্কিত অধিকার, ভূমি অধিকার, সালিশি দুর্বলতা ইত্যাদি। চা-বাগান সংক্রান্ত ভূমিসমস্যার বিভিন্ন দিক বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভূমি অধিকার না থাকা, চা-বাগানের জমির বিক্রয় ও হস্তান্তর, শ্রমিকদের বসবাস ও ভূমিব্যবহার-সংক্রান্ত অসুবিধা, এবং সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয় ভীষণ জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

 

পশ্চিমবাংলার নিরিখে চা-বাগিচার জমির অধিকার সংক্রান্ত প্রধান সমস্যাগুলি হল—

এক. জমির মালিকানা ও লিজ সংক্রান্ত সমস্যা: পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ চা-বাগান সরকারি ল্যান্ড লিজ-এর ওপর দাঁড়িয়ে। চা–কোম্পানিগুলো জমির মালিক নয়— তারা দীর্ঘমেয়াদি লিজে জমি ব্যবহার করে। লিজের শর্ত অনুযায়ী বাগানের জমি শুধু চা চাষ এবং সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহারের কথা। কিন্তু সমস্যা হল, বহু বাগানে দেখা গেছে, মালিকপক্ষ লিজের শর্ত ভেঙে জমি অন্য কাজে ব্যবহার বা রূপান্তর করতে চাইছে। পুনরায় লিজ নবীকরণে প্রশাসনিক জটিলতা ও অনিয়মও দেখা যায়।

দুই. শ্রমিকদের আবাসিক এলাকার মালিকানা নিয়ে অনিশ্চয়তা: চা-বাগানের শ্রমিকরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম লেবার লাইনে বসবাস করলেও তাঁরা জমির আইনি মালিক নন। ফলে, শ্রমিকরা বাড়ি মেরামত, ঘর বড় করা বা নিজের জায়গায় কিছু নির্মাণ করতে গেলেও নানা বিধিনিষেধের মুখে পড়েন। আর যদি বাগান বন্ধ বা লকআউট হয়ে যায়, তাহলে শ্রমিকরা বাসস্থানের অধিকারই হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন।

তিন. বাগান বন্ধ হওয়া ও জমি বিক্রির চেষ্টা: দার্জিলিং, ডুয়ার্স ও জলপাইগুড়ি অঞ্চলে অনেক চা–বাগান বন্ধ হয়ে গেছে বা দীর্ঘদিন ধরে অচল। এর ফলে যে সমস্যাগুলি তৈরি হয়েছে, সেগুলি হল— মালিকপক্ষ বাগানের জমিকে আবাসন বা পর্যটন প্রকল্পে রূপান্তর করতে চাইছে বলে কিছু অভিযোগ উঠেছে। শ্রমিকরা জমিতে বসবাস ও চাষের অধিকার দাবি করলেও মালিকপক্ষ আইনি মালিকানার কথা বলে বিরোধ সৃষ্টি করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ বাগানের জমিতে অবৈধ দখল, জমি লেনদেন বা প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দখলদারির অভিযোগও ওঠে।

চার. চা-বাগানের জমি ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ল্যান্ড’ হিসেবে গণ্য হওয়ায় অধিকার সংকট: চা-বাগানের এলাকা সাধারণ কৃষিজমি নয়, এগুলি ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্ল্যান্টেশন’ হিসেবে স্বীকৃত। ফলে, শ্রমিকরা জমিতে কৃষিকাজ বা বাড়তি ব্যবহার করতে পারেন না। এমনকি, বাগান বন্ধ হলেও আইন অনুসারে ওই জমিকে কৃষিজমি বা গ্রামবাসীর জমি হিসেবে রূপান্তর করা কঠিন হয়ে যায়। শ্রমিক তথা আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য জমির আইনি অধিকার অর্জন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

পাঁচ. বনভূমি ও সংরক্ষিত এলাকার সঙ্গে সংঘাত: ডুয়ার্সের বহু বাগান বনাঞ্চল-সংলগ্ন বা আংশিকভাবে বন এলাকার ভেতরে। ফলে, বাগানের বিস্তার বনভূমি দখলের অভিযোগ তোলে। সংরক্ষিত বন বা হাতির চলাচলের পথ বন্ধ বা সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ায় পরিবেশগত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। অনেক বন্যপ্রাণী— যেমন লেপার্ড, গন্ডার, হরিণ ইত্যাদি চলাচলের রাস্তা থাকে সেখানে।

আবার, বনাধিকার আইনের আওতায় বসবাসরত আদিবাসীরা নিজেদের অধিকার দাবি করলে তা বাগান প্রশাসনের সঙ্গে একটা সংঘর্ষের দিকে চলে যায়।

ছয়. জমি উন্নয়ন, পর্যটন প্রকল্প ও রিয়েল এস্টেটের চাপ: বিশেষ করে দার্জিলিং অঞ্চলে হোমস্টে, হোটেল ও রিসর্ট নির্মাণের প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। চা-বাগানের কিছু অংশ পর্যটনের জন্য লিজ দেওয়া হচ্ছে, এমন ঘটনাও ঘটছে। ফলে জমির বাণিজ্যিক রূপান্তর নিয়ে স্থানীয় মানুষ, শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছে।

সাত. জমির রেকর্ড ও নথিপত্রে অসঙ্গতি: অনেক চা–বাগানের পুরনো লিজ ডকুমেন্ট বা ‘রেকর্ড অফ রাইটস’ অসম্পূর্ণ বা আপডেটেড নয়। এর ফলে সঠিক জমির পরিমাপ ও ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। এবং মালিক-সরকার-শ্রমিক— তিন পক্ষের দাবি একে অপরের সঙ্গে যুযুধান অবস্থান নেয়।

আট. শ্রমিকদের জমির অধিকার নিয়ে আন্দোলন: শেষ ১৫–২০ বছরে পশ্চিমবঙ্গের চা–শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবি তুলেছে— শ্রমিকদের আবাসস্থল ও লাগোয়া জমিতে পাট্টা দিতে হবে; বন্ধ বাগানের জমি শ্রমিকদের যৌথ চাষ বা সমবায় ব্যবস্থার জন্য হস্তান্তর করতে হবে।

এই দাবিগুলিকে কেন্দ্র করে নানা জেলা জুড়ে আন্দোলন, মানববন্ধন, স্মারকলিপি ইত্যাদি হয়েছে।

এগুলির ফলে একদিকে যেমন জমি-সংক্রান্ত উত্তেজনা আরও বেড়েছে, অন্যদিকে প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে দেশ যতই এগিয়ে গেছে বলে কাড়া-নাকাড়া বাজুক, কৃষক-শ্রমিকদের নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার পথ সেই আন্দোলন। তেভাগার যুগে— আজকেও।

 

চা-বাগানের জমি সমস্যা: আসাম

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে চা-বাগান ও চা-শিল্প ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অর্থনীতির একটি প্রধান ভিত্তি ছিল। এই শিল্প শুধু অর্থনৈতিক কাঠামো নয়, বরং শ্রম, জমি, ও সামাজিক সম্পর্কের জটিল ইতিহাসের প্রতিফলন। চা-বাগানের শ্রমিকরা একদিকে চা-শিল্পের মূল চালিকাশক্তি, অন্যদিকে তাঁরা আজও ভূমি-অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত।

এই জমি-সংক্রান্ত বঞ্চনা ও শোষণের ধারাটির ঐতিহাসিক শিকড় ১৯৪০-এর দশকের তেভাগা আন্দোলন-এ খুঁজে পাওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ কৃষকরা যেমন জমির ন্যায্য ভাগ ও মালিকানার দাবি তুলেছিলেন, আসামের চা-বাগান শ্রমিকরা আজ সেই একই স্বপ্নের আধুনিক রূপ— ভূমির স্বত্ব ও জীবিকার মর্যাদা— বাস্তবায়নের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

চা-বাগানের পটভূমি ও ভূমি-কাঠামো: ব্রিটিশরা ১৯শ শতাব্দীতে আসামে চা-বাগান প্রতিষ্ঠা করে। শ্রমিকদের আনা হয়েছিল ভারতের মধ্য ও দক্ষিণ রাজ্যগুলি থেকে, কঠিন চুক্তির অধীনে। তাঁরা বাগান-সংলগ্ন এলাকায় প্রজন্ম ধরে বাস করছেন, কিন্তু জমির কোনও পাট্টা বা স্বত্ব তাঁদের হাতে নেই।

আজও আসামে প্রায় ৮ লক্ষাধিক চা-শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার বাগানের অভ্যন্তরে থাকা জমিতে বসবাস করেন, কিন্তু আইনি দৃষ্টিতে তাঁরা “বাসিন্দা”, মালিক নন। এই প্রেক্ষাপটে ভূমি-সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব, জমি বিক্রয়, এবং অধিকারবিহীন জীবনের সমস্যা ক্রমেই গভীর হয়েছে।

সম্প্রতি ডিব্রুগড় জেলার বিজুলিবাড়ি টি এস্টেট-এর শ্রমিকরা প্রতিবাদে নামেন, কারণ বাগানের একটি বড় অংশ বেসরকারি কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হচ্ছিল। তাঁরা আশঙ্কা করেন, এতে তাঁদের জীবিকা ও বসবাসস্থল উভয়ই হারানোর ঝুঁকি তৈরি হবে।

 

বর্তমান ভূমি সমস্যা

অধিকারবিহীন পরিশ্রম— তেভাগা আন্দোলনের কৃষকরা যেমন নিজেদের উৎপাদনের উপর অধিকার চাইছিলেন, তেমনি আসামের চা-শ্রমিকরা আজ তাঁদের বসবাসের ভূমির উপর অধিকার দাবি করছেন।

বিক্রয় ও উচ্ছেদের ভয়— তেভাগায় জমিদারেরা ফসলের ভাগ বাড়াতে ও চাষিদের উচ্ছেদ করতে চাইত; বর্তমানে চা-বাগান মালিক বা বেসরকারি কোম্পানিগুলি জমি বিক্রি করে শ্রমিকদের উচ্ছেদের আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।

সংগঠিত প্রতিবাদ ও শ্রেণিচেতনাতেভাগায় কৃষকরা সংগঠিত হয়েছিল কৃষকসভার নেতৃত্বে; আজ চা-বাগান শ্রমিকরা ইউনিয়ন ও সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে তাদের ভূমি-অধিকার নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন।

রাষ্ট্র ও নীতির ভূমিকা— তেভাগা আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে পশ্চিমবাংলায় জমিদারি প্রথা বিলোপ ও ভূমিসংস্কার আইন আসে। একইভাবে, আসাম সরকার এখন চা-শ্রমিকদের জমি-অধিকার বিল প্রণয়নের পথে, যা তেভাগা আন্দোলনের একটি আধুনিক প্রতিধ্বনি বলা যায়।

 

জীবিকা, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তার সংকট

চা-বাগান শ্রমিকদের জীবিকা মূলত জমির সঙ্গে সম্পর্কিত— তাঁরা যেখানে থাকেন, সেখানেই তাঁদের জীবন ও সমাজ গড়ে উঠেছে। কিন্তু জমি-স্বত্ব না থাকায় তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। ভূমি বিক্রয় বা বাগান বন্ধ হয়ে গেলে তাঁদের বাসস্থান হারানোর ভয় থাকে, ফলে একপ্রকার স্থায়ী উদ্বাস্তু-অবস্থা তৈরি হয়।

তেভাগা আন্দোলনের সময়েও কৃষকরা এই ভয় অনুভব করেছিলেন— জমির উপর মালিকানা না থাকলে, শ্রম আর উৎপাদন তাঁদের মুক্তি দিতে পারে না। আজও চা-বাগানের শ্রমিকরা সেই একই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন।

 

সম্ভাব্য সমাধান: তেভাগার শিক্ষায় বর্তমানের দিশা

স্থায়ী পাট্টা ও আইনগত সুরক্ষা— যেমন তেভাগার পর কৃষকদের জন্য ভূমি-সংস্কার হয়েছিল, তেমনি চা-শ্রমিকদের জন্য স্থায়ী পাট্টা আইন বাস্তবায়ন জরুরি। আসাম সরকার প্রস্তাবিত বিলটি দ্রুত কার্যকর করা প্রয়োজন।

শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত— তেভাগা আন্দোলনে চাষিরাই সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। চা-বাগানের নীতি প্রণয়নে শ্রমিকদের মতামত ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

স্বচ্ছতা ও ভূমি-বিনিয়োগে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ— বেসরকারি কোম্পানি বা রাজ্য কর্তৃপক্ষের জমি-বিক্রয় ও হস্তান্তরের আগে শ্রমিকদের সম্মতি ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবিকা উন্নয়ন— ভূমি-অধিকারকে শুধুমাত্র আইনি স্বীকৃতি নয়, বরং সামাজিক উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে দেখতে হবে। তেভাগা আন্দোলনের পর যেমন শিক্ষিত কৃষকসমাজ গঠনের প্রয়াস হয়েছিল, তেমনি আজ চা-শ্রমিক সমাজের সামাজিক পরিকাঠামো গঠনে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

 

সীমাবদ্ধতা

চা-বাগানের জমি-সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন— আইনি বিল থাকলেও প্রশাসনিক স্তরে তার বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত ধীর; শুধু বাগান-মালিকদের আর্থিক চাপই নয়, কর্পোরেট হস্তক্ষেপও এ-বিষয়ে যথেষ্ট সক্রিয়; ভূমি-রেকর্ড ও মালিকানা নির্ধারণ নিয়ে অজস্র জটিলতা রয়েছে; এবং শেষত, পরিবেশগত ঝুঁকিও— যেমন, নদীভাঙন ও বন্যা— যথেষ্ট।

এই বাধাগুলো সেই পুরনো প্রাতিষ্ঠানিক শোষণের রূপ, যা তেভাগা আন্দোলনের সময় জমিদার-চাষি সম্পর্কের মধ্যে ছিল— আজ তা পুঁজিবাদী শিল্প-কাঠামোর আকারে ফিরে এসেছে।

 

তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে চা-বাগিচার জমিসমস্যাকে কীভাবে লড়াইয়ের প্রেক্ষাপট হিসেবে দেখব আমরা

তেভাগা আন্দোলন ভারতের কৃষক ইতিহাসে শুধু একটি বিদ্রোহ নয়— এটি ভূমি-অধিকার ও শ্রমের মর্যাদার এক স্থায়ী প্রতীক। আসামের চা-বাগান শ্রমিকদের আজকের সংগ্রাম সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের আধুনিক প্রতিরূপ। তেভাগা যেমন জমির উপর চাষির অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল, তেমনি চা-শ্রমিকদের লড়াইও দাবি করছে, “আমরা যারা কাজ করি, এই ভূমি আমাদেরও।” চা-বাগানের জমিবিক্রয়-সংকট, শ্রমিক উচ্ছেদ ও অধিকারহীনতা যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তবে এই অঞ্চল আবারও এক নতুন “তেভাগা”-র জন্ম দিতে পারে— শ্রমিকশ্রেণির মর্যাদা ও অধিকার পুনরুদ্ধারের লড়াই হিসেবে।

সেই কারণে, ইতিহাসের শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক। ভূমি শুধু সম্পত্তি নয়— এটি জীবনের শিকড়, আর শিকড়ের অধিকার কেড়ে নিয়ে কোনও উন্নয়নই টেকসই হয় না।

তেভাগা আন্দোলন ছিল জমিদারি ও শোষণমূলক জমি-বণ্টনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐতিহাসিক লড়াই। যদিও এ-আন্দোলন প্রধানত বঙ্গের ভাগচাষিদের অধিকারের প্রশ্নে গড়ে উঠেছিল, কিন্তু তার বৃহত্তর অন্তর্নিহিত প্রশ্ন ছিল— জমির মালিকানা কার, আর জমির উৎপাদনের উপর কার অধিকার থাকবে? এই প্রশ্নই পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গের চা–বাগিচার জমি সংক্রান্ত সমস্যাগুলো বোঝার মূল চাবিকাঠি হয়ে ওঠে।

চা–বাগানের জমি কখনওই শ্রমিক বা স্থানীয় জনগণের মালিকানায় ছিল না। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরও বাগানের জমি সরকারের মালিকানা থেকে বিভিন্ন চা–কোম্পানিকে লিজ দেওয়া হয়। ফলে চা-শ্রমিকরা, যাঁদের অধিকাংশই আদিবাসী ও অভিবাসী শ্রমিক— ভূমির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও বাসস্থান বা জমির ওপর তাঁরা কোনও আইনি অধিকার পাননি। তেভাগা আন্দোলনে যেখানে বর্গাদাররা জমির উৎপাদনের ‘আগের অর্ধেক নয়, তিন ভাগের দুই ভাগ’ নিজেদের অধিকার বলে দাবি করেছিলেন, সেখানে চা-বাগানের শ্রমিকরা জমির ওপর ন্যূনতম বসবাসের অধিকারও পাননি।

তেভাগার মূল মনোভাব ছিল ভূমির ওপর সরাসরি কাজ করা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সের, তরাই ও দার্জিলিং অঞ্চলে চা–বাগানের লিজ–ভিত্তিক ব্যবস্থায় মালিকপক্ষ জমিকে শিল্পভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে শ্রমিকদের আবাসস্থল, বাগানের ভিতরের বনভূমিসংলগ্ন এলাকা, কবরস্থান বা চাষযোগ্য ফাঁকা জমি— সবই মালিকের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাগান বন্ধ হয়ে গেলে শ্রমিকদের বাসস্থান ও জীবিকা একসঙ্গে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে— যা তেভাগার জমির ওপর অধিকার-সংগ্রামের বিপরীত পরিস্থিতি তৈরি করে।

বছরের পর বছর ধরে চা-বাগানের জমি রূপান্তর নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে— অনেক মালিক বাগানের লিজ ভেঙে জমি পর্যটন, রিসর্ট বা রিয়েল এস্টেট প্রকল্পে ব্যবহার করতে চাইছেন। এতে শ্রমিকরা আশঙ্কা করছেন যে, তাঁদের বাসস্থান ও প্রজন্মগত বসতির অধিকার সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে পারে। তেভাগা আন্দোলনে যেখানে ভূমি-বণ্টনের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন দাবি করা হয়েছিল, সেখানে চা-বাগান এলাকায় আজও জমি-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে মালিক ও প্রশাসনের হাতে থেকে শ্রমিকদের অদৃশ্য করে রাখে।

অতএব, তেভাগার ভূমি-সংগ্রামের আলোকে পরিষ্কার যে— পশ্চিমবঙ্গের চা-বাগিচার জমিসমস্যা মূলত জমির অধিকার থেকে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক বঞ্চনা। তেভাগা প্রশ্ন তুলেছিল: যিনি শ্রম দেন, তিনি জমির ওপর অধিকার পাবেন। কিন্তু চা–শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সেই দাবি এখনও অসম্পূর্ণ, এবং তাই পশ্চিমবঙ্গের চা-অঞ্চলে জমিসংক্রান্ত আন্দোলন আজও একপ্রকার ‘অসমাপ্ত তেভাগা’র প্রতিধ্বনি।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...