
নীহারকান্তি হাজরা
নদ-নদীর সঙ্গমভূমে
অধ্যায় ১: পর্ব ১। পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪। পর্ব ৫। পর্ব ৬। পর্ব ৭। পর্ব ৮। পর্ব ৯
বাঁকী— জলধারার মিলনক্ষেত্রে
১৯৫২ সালের এক শীতের দিনে লাল ধুলোয় আনখশির আচ্ছাদিত হয়ে যেখানে আমরা নামলাম সেখানে মাটির রং আটার মতো। পা ফেললেই পাতা ভরে যায়। আমার ডানদিকে এক বিস্তীর্ণ বালুরাশি। বহুদূরে তটরেখা। অস্পষ্ট। আর আমার সোজা কয়েক পা হাঁটলেই একটি নিবিড় কাঁঠালের বনস্পতির তলা দিয়ে একটি সংকীর্ণ নদী, যেটি হারিয়ে গেছে ডানদিকের বিস্তীর্ণ বালুরাশির ভিতরের আর এক নদীতে। বুঝলাম এটি সঙ্গমস্থল। এর আগে কখনও নদী পার হইনি। বালুরাশিও দেখা নেই। এগিয়ে গিয়ে সংকীর্ণ স্রোত। স্বচ্ছ। অসংখ্য অতি ছোট মাছ। আর কোথাও জমে
থাকা জলে চঞ্চল মাছেরা। হুলিমাছ সব। আবার বালুরাশি পার হয়ে পুরু ঘাসে ঢাকা নদীতীর। নদী ছেড়ে উঠলেই ঠিক আগের মতো একটি কাঁঠালগাছ। তার পিছনে নদীর তীর ধরে পুরু ঘাসে ঢাকা একটি খুব বড় মাঠ। তার পাশ দিয়ে যে সাদা ধুলোর পথ, তা হারিয়ে গেছে একটা ঘন জমাট আমবাগানের মধ্যে। আমরা সোজা ঢুকব। পথে তেঁতুল আর চাকলতা আর শাখা-প্রশাখায় ঘন হয়ে থাকা আর একটা গাছ। পরে জানব এর নাম হিজল। আরও পরে দেখব সমস্ত গ্রাম ঘিরে অসংখ্য হিজলগাছ। আরও দেখব এখানে-ওখানে
গরমের শুরু থেকে হিজলের শাখাপ্রশাখা ধরে ঝুলে থাকা গোলাপী-সাদা ফুলের অসংখ্য মালা। ঘন ছায়ায় বিছিয়ে পড়ে থাকা তাদের গোলাপী রেণুর গলিচা। পিতৃদেবের বাড়িতে ঢোকার আগে একটি বাঁধানো কুয়ো। লেখা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড। তার ডানদিকে স্বল্প পায়ে চলার পথের ধারে এক বিশাল বটগাছের জঠরে জীর্ণ একটি মন্দির। পরে পরিচয় হবে এটি এককালের গোপীনাথ জিউ-এর মন্দির। আরও দেখব গ্রাম ছাড়িয়ে একটু দূরে বাউরিপাড়ার ওপারে একটি ফুলে ভরা বিশাল বাগান। এখনও থোপা থোপা করবীফুল
ফোটে। মন্দিরের পাশেই গোপীনাথের সেবাইত বংশ মুখুজ্যে পরিবারের বাখুল। তার অদূরে ভোর প্রহর থেকে শব্দ তুলে ঢেঁকিতে চিঁড়ে তৈরি করে মাজিদের ঘর গৃহস্থ। গোপীনাথের ভোগ হয়। আর তারপরেই বড়নদীর তীর ধরে বিশাল পাশাপাশি দুটি অশ্বত্থগাছ। রাজার লাগানো। হাতি বাঁধার গাছ। দেখব এখানে বসুধারা। দেখব নদীস্নান করে এসে জল আর ছোলা দিয়ে পুজো। পিছন ফিরলেই কাঠবেড়ালির ভোজ। একটু পিছিয়ে বাঁদিকে দেবঘরিয়াদের জড়াজড়ি চালাঘর। এরাও সেবাইত। পরে জানব এদের নিষ্কর ভূমি আছে। কিছু উৎপন্ন হয়। পেট চলে। কিন্তু এখানের এই উর্বর ভূমিতে একদা হাতির পিঠে চেপে রাজা আসত। হাতির হাওদার দুপাশে ঝোলানো ঘন্টা। হেলে দুলে টুং টাং-টুং টাং। গ্রামের লোক তখন আশুততলায়। দৃষ্টি পূবে। বড় নদী পার হয়ে তপোবন গ্রামের সবুজ তীরভূমিতে। ওখানে নামছে হাতি। সঙ্গে লোক-লস্কর। গোপীনাথ জিউয়ের প্রশস্ত উঠোনে রাজার সামিয়ানা। চোখ বন্ধ করে দেখি।
দত্ত আর পালিতদের বাড়ির মাঝখানের বেশ চওড়া পথ ধরে গিয়ে আমাদের বাড়ি। পথের দুদিকে দত্ত আর পালিতদের কোঠাবাড়ি। শেষে সিংহ পরিবার। এটা একটা পাড়া। আমাদের পদবী দে। উপাধি ভিন্ন— হাজরা। এ পাড়ায় বাস: দে, দত্ত ,পালিত, এবং সিংহ। নাম কায়স্থপাড়া। পরে টের পাব এই গোটা গ্রামটাই পৃথক চাকবন্দি জাতি-নির্ভর। ঢোকার মুখে বাঁদিকে মাটির চালাঘর। বাইরের ঘর। পরে শুনব এখানে আমার জ্যাঠামশাইয়ের পাঠশালা বসত। তারপর সরু পথ চলে গেছে ঘাটে। পুকুরের নাম পূজারু। ডানদিকে পলেস্তারাহীন একটি ছোট দোতলা বাড়ি। পশ্চিম মুখ। উঠোনের পশ্চিমে এক বিরাট আমগাছ। সিঁদুরী আম। তার নীচে চালাঘর। দক্ষিণে একটি বড় দোতলা কোঠাবাড়ি। এর পিছনে বিশাল বড় হিজল আর নোনা আতাগাছের নীচে ক্ষেত্রদেবতার স্থান। গ্রাম্য দেবতা— গেরাম দেউতি। তিথি ধরে পুজোপাঠ। উঠোনে দাঁড়িয়ে রক্ত হিম। দোতলার কার্নিসে, জানালায়, দেয়ালের খাঁজে সর্বত্র লিক লিকে গাঢ় খয়েরি রঙের উপরে সবুজ, হলুদ, সাদা বিন্দুময় অসংখ্য সাপ। তাদের অধিকারে সম্ভাব্য হস্তক্ষেপে চঞ্চল। না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওঁরা মা মনসার হাতের চুড়ি। বাজুবন্ধ। গলার
হার। কোমরের পৈছা। উদয় নাগ। শব্দ পেলেই চলে যাবেন। গেলেনও তাই। লাফ দিয়ে সিঁদুরী। তারপর আরও কোথাও। তারপর অনেক দিন ঘুমের মধ্যে তাঁরা আমার অনুরূপ জায়গায় অবস্থান করবেন। আর আমি ঘেমে মাঝরাতে বিছানায় বসে। জয় মা বিষহরী। আর সর্বত্র পায়রার বাসা। একটানা অবসাদের ঢেউ গলার কুঞ্চনে। এখানে-ওখানে ফাটা ডিম। পিঁপড়ের স্রোত। আর একটু পরেই শুনব গাছে গাছে হুঙ্কার। বাঁদরের পাল। একটি একটি বীরের অধীন। ঝড়ের গতিতে এসে সব লন্ডভন্ড করে চলে যায়। আবার আসে। নাম করতে নেই। ওরা বুঝতে পারে। চলে আসবে।
এখানে যে জীবন শুরু হল, তার সঙ্গে আমার জন্ম-সূত্রী জনপদ বা তার পরিপার্শ্বের কোনও মিল নেই। সেখানে মাটির কোঠাবাড়ির বাইরে এলেই চোখ বাধাহীন। অন্তত তিনদিকে খোলা মাঠের উপর দিয়ে চোখ চলে যায় ঋতুধরে রং বদলানো পাহাড়শ্রেণির অর্ধবৃত্তে। তার মাটি লাল। ঢেউ খেলানো। কাঁকুরে। কিছু অসংলগ্ন ইতস্তত গাছের ভিতর দিয়ে নিবিড় বনভূমি। তাদেরও রঙের বদল ঋতু ধরে। আর সেই প্রকৃতি সংলগ্ন প্রাকৃতিক মানুষ। তাদের সমূহ অস্তিত্ব সেই জনপদের মানুষের প্রতিদিনে।
আর এ জনপদে দৃষ্টি অপরিসর। মাটি কালো-ধূসর। কোথাও নুড়িখণ্ড নেই। সবুজ পুরু ঘাস। এখানকার জাতিনির্ভর মানুষেরা আপন কাজে, নিজেদের বৃত্তে নিম্নমুখী। আকাশে উঠে দেখলে দেখা যাবে গ্রামটা পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা। নদীর তীর বরাবর। অর্ধবৃত্ত শেষে। শুরুরটা উত্তরে পিঠ হেলিয়েছে। শেষেরটা দক্ষিণে। গ্রামটা বাঁশবনে ঢাকা। জনপদের পিছনে একটা খাল। সেটা গ্রামটাকে উত্তরে ঘিরে পশ্চিমে আর পূর্বে একই নদীতে মিশেছে। তাই বর্ষায় এ জনপদ একটি দ্বীপের মতো। নদীগুলোর নাম আছে। গ্রামটার সঙ্গে জুড়ে আছে ছোট নদী— গন্ধেশ্বরী। গ্রামের পূর্বরেখায় বড় নদী— দ্বারকেশ্বর। পরে আরও একটা নাম জানব— ঢলকিশোর। গরমে-শীতে তিরতির করে স্বচ্ছ মন্দবেগ জলধারা। বর্ষায় দুটো নদীতে একই সঙ্গে বান এলে মেটে রঙের উত্তাল গর্জন। সে সময় ছোট নদীর জল বড়র সঙ্গে মিশতে পারে না। নিরন্তর প্রবাহ মাথায় এসে থিতোতে থাকে। তারপর পূর্বদিক ধরে গ্রামে উঠে যায়। প্রথমে খায় বাউরিপাড়া। তারপর জোড়া অশ্বত্থের ভিতর দিয়ে মাজিপাড়া। এর পরে আমাদের খামারের ভিতর দিয়ে কায়স্থপাড়া। পশ্চিমে পূজারু ভর্তি হয়ে পরের ষোলো আনার পুকুরে। মাছ উঠে ডাঙায়-উঠোনে খাবি খায়। বাস্তুর নিরন্তর বদল ঘটে চলে।
এতকাল পরে আমার স্মরণ রেখাধরে যে গ্রামটাকে দেখছি সেটা সেই মুহূর্তের বাস্তবিক কিনা আমার জানার উপায় নেই। চোখ বন্ধ করে দেখা। আড়াআড়ি সেই শালুকফুলে ভরা ষোলো আনার পুকুরটার পরে একাদশ তিলি পাড়ার চমৎকার নিকানো, নিপাট ছাওয়া খড়ের ঘরের সমষ্টি। গোকুল-হাবল এরা সব। প্রশস্ত গোয়াল। সম্পন্ন চাষি।
এরপরে ভট্টাচার্যপাড়া। মাঝখানে হিজল আর আমের বিস্তৃত বাগানের সীমানায় বালকরাম ওরফে বলিরামের চারচালা মন্দির। মাকড়া পাথরের। বাঁদিকে নদীতীরের সামান্য খাঁজের উপরে একটি মন্দির একইরকম। অটুট। কিন্তু পরিত্যক্ত। নদী খাবে যে কোনও দিন। খেলও তাই। এক মেঘভরা দুপুরে রোদ মেলতেই। নীচের ঘাটের নাম দহ ঘাট। গভীর জল। বালি নেই। শীতে নীল-সবুজ। আম বাগানের শেষ মাথায় ডানদিকে ঘন বাঁশবন, আাঁকড়, ফণিমনসা আর নানা আগাছার দুর্ভেদ্য জঙ্গল ঘেরা একটি পরিত্যক্ত ভিটে। ইটের পাকা বাড়িগুলি জানালা দরোজা খুইয়ে দাঁড়িয়ে। তার মাঝখানে জড়াজড়ি দুটি মাকড়া পাথরের মন্দির। চার চালা। বিগ্রহহীন। ঠিক তাদের পিছনে একটি খুবই প্রাচীন বেলগাছ। আর একটু দূরে অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা লম্বা মাটির ঢিবি। সাপভূম ডাঙ্গা— সার্বভৌম ভট্টাচার্যদের একদা আবাসভূমি। ওই উঁচু ঢিবিটা ছিল ছাত্রাবাস। চতুষ্পাঠী আর টোল। বহুদূর থেকে ছাত্ররা টোলে যেমন আসত, আসত নানা পণ্ডিত। এঁদেরই একজন বিখ্যাত নৈয়ায়িক ছিলেন। দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত তাঁর খ্যাতি ছিল। একদিন সেখান থেকেই এলেন এক দ্রবিড় পণ্ডিত। তিনি তর্কভূষণ। গ্রামের চারপাশের টোলের পণ্ডিতেরা জড়ো হলেন। তর্ক বসল ওই বেলগাছের তলায়। সাত দিন সাত রাত। শেষ পর্যন্ত জয় হল ওই সার্বভৌম পণ্ডিতের। তিনি জয়ে উন্মত্ত হয়ে বসার আসনটা তুলে ঝেড়ে দিলেন দ্রাবিড় পণ্ডিতের মাথায়। পণ্ডিত বললেন তিনি অবশ্যই জয়পতাকা লিখে দেবেন কিন্তু ন্যায়বিচারে তাঁর হার হয়নি, একটা সামান্য ব্যাকরণের ভুলে তাঁর পরাজয়। তিনি অভিশাপ দিলেন ওই আচরণের: এই ভিটেতে সার্বভৌম বংশের বাতি দেওয়ার আর কেউ থাকবে না। তারপর নদীতীরের ওই মন্দিরের পাশ দিয়ে দহঘাট পার হয়ে চলে গেলেন। তারপর? তারপর অপঘাতে একটি একটি করে মরল সকলে। টোল চতুষ্পাঠী সব উঠে গেল। ওই বেলগাছে এখন ব্রহ্মদৈত্যের বাস। একজন এখনও দিল্লি থেকে আসেন বছরে একবার। একাই আসেন। জঙ্গল সরিয়ে ভিটেয় গিয়ে উপুড় হয়ে খানিকক্ষণ কাঁদেন। তারপর ওই দহঘাট দিয়েই ফিরে যান।
এর পরে পরেই অনেক উপাধিধারী এক পাড়া: ঘোষাল, মুখুজ্জে, ভট্টাচার্য, চাটুজ্জেদের বাস। চারপাশে দুর্ভেদ্য বাঁশবন। শতাব্দীপ্রাচীন অশ্বত্থ।
দ্বারকেশ্বর আর গন্ধেশ্বরীর নিরন্তর সঙ্গমের প্রশস্ত বঙ্কিম রেখা ধরে গড়ে ওঠা এই জনপদের নাম— বাঁকী।
[আবার আগামী সংখ্যায়]