
স্টেশনমাস্টারের কলম
...যুদ্ধকে আর ‘অনিবার্য পাপ’ বলে সাফাই দেওয়ার ভণ্ডামি চলতে দেওয়া যায় না। যুদ্ধ অপরিহার্য নয়। যুদ্ধ একটা অপরাধ। বারবার যুদ্ধ বেছে নেয় তারাই— যাদের হারানোর প্রায় কিছুই নেই (শৃঙ্খল তো নয়ই), কিন্তু পাওয়ার আছে অনেক কিছু। এই অন্তহীন আবর্ত থেকে যদি আমরা বেরিয়ে আসতে চাই, তবে যুদ্ধকে তার সমস্ত রোমান্টিক মোহ আর কৃত্রিম মহিমা থেকে মুক্ত করতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের নবম বর্ষের এই প্রথম সংখ্যার অবতারণা— ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা?...
O war! thou son of hell,
Whom angry heavens do make their minister…Play: Henry IV, Part 2
যুদ্ধের নির্মমতা ঢাকতে শিল্পসাহিত্যকাব্য চিরকালই বেশ নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। সম্মান, দেশপ্রেম আর অপরিহার্যতার অলঙ্কারে যুদ্ধ নিজেকে সাজায় এক অবশ্যম্ভাবী নিয়তির মতন— আসলে যা মূর্তিমান নরক বই নয়। মহামতি শেক্ষপীর বিষয়টি ধরেছিলেন ঠিকই— আজ থেকে চারশো বছর আগে হলেও বা। একটিমাত্র ছত্রে তিনি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলা সামরিক আড়ম্বরের পর্দা সরিয়ে যুদ্ধের আসল চেহারাটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রতিটি যুদ্ধ শুরু হয় ন্যায়ের দোহাই দিয়ে। ন্যায়ের জন্য প্রতিশোধ নেওয়া নাকি অবশ্যকর্তব্য। অথচ, যারা এই কর্তব্য স্থির করেন, শাস্তি বিধান করেন, তাঁরা কখনওই এর বলি হন না। যুদ্ধের পরিকল্পনা হয় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে, পরিখায় নয়। যারা যুদ্ধ ঘোষণা করে, তারা নিজেরা যুদ্ধে প্রাণ দেয় না। আর যারা সবচেয়ে বেশি ফায়দা লোটে, তারা লাভ করে উভয় পক্ষ থেকেই। বোমা চেনে না, তার গায়ে কার নাম লেখা। It is the poor who die, লিখেছিলেন উইলফ্রেড আউয়েন। বোধহয় একথাই সব যুদ্ধের সবচেয়ে অনাড়ম্বর সারসংক্ষেপ।
আমাদের প্রতিবারই বোঝানো হয়, এই যুদ্ধটা আলাদা। এবারের কারণটা খাঁটি। ধর্ম সংস্থাপনের জন্যই এই লড়াই। অথচ, প্রতিবারই আমাদের সেই একই পোড়ো রাস্তায় ঠেলে দেওয়া হয়। যুদ্ধ কদাচিৎ আত্মরক্ষার তাগিদে হয়, বেশিরভাগ সময়ই তার লক্ষ্য থাকে আধিপত্য বিস্তার। জলে-স্থলে কত ছলে মায়াজাল গাঁথি! সীমান্তেরা বদলায়, অস্ত্রশস্ত্র নতুন প্রযুক্তিতে আরও ধারালো হয়, কিন্তু ভেতরের প্রবৃত্তিগুলো সেই মধ্যযুগীয়ই থেকে যায়: মুনাফা, দম্ভ, ক্ষমতা।
এখন শান্তিও একটি পণ্য— একটা PR প্রজেক্ট, যা ধূসর পোশাক, হেলমেট আর হেলিকপ্টারের শব্দে ঢেকে দেওয়া। যুদ্ধের দানবাকার মহাযন্ত্র শুধু আদর্শের জোরে চলে না— বিদেশনীতির চেয়ে বেশি করে অর্থনীতি তাকে সচল রাখে। অস্ত্রনির্মাতাদের ফুলেফেঁপে ওঠা, শেয়ারহোল্ডারদের প্রচ্ছন্ন অনুমোদন, ভোটের বিনিময়ে রক্ত নিয়ে বাণিজ্য করা রাজনীতিবিদদের হিসেবনিকেশ— এগুলোই হল বাগাড়ম্বরের আড়ালের আসল চালিকাশক্তি। তথ্য বলছে— ২০২৩ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি অস্ত্র ও সামরিক পরিষেবা সংস্থা মিলিয়ে মোট ৬৩২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪.২ শতাংশ বেশি। এই আয়ের সবচেয়ে বড় বৃদ্ধি মূলত ইউক্রেন ও গাজায় চলমান সংঘাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
আধুনিক যুদ্ধ গুলি দিয়ে শুরু হয় না, শুরু হয় যত্নে সাজানো গল্প দিয়ে— যা সুকৌশলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ডিপফেক, সম্পাদিত ছবি, কারসাজি করা তথ্য— সবই এখন যুদ্ধাস্ত্রের অংশ। একাধিক রাষ্ট্র আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ লড়ে। মিথ্যে ছড়ায় বিদ্যুতের চেয়েও দ্রুত। ভিন্নমত পোষণকারীরা ‘বিশ্বাসঘাতক’ তকমা পায়, আর পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা সম্মিলিত আক্রোশে চাপা পড়ে যায় সব জটিল বিশ্লেষণ। যা জনমত বলে বাজারে চলে, তা প্রায়শই সুনিয়ন্ত্রিত অ্যালগরিদমের প্রতিধ্বনি মাত্র।
যুদ্ধের ক্ষত কি শুধু শরীরে? যে শিশু শরণার্থী শিবিরে বড় হয়, সে ভাষার আগে শেখে ভয়ের বর্ণমালা। যে মা তার সন্তানকে সমাধিস্থ করে, বোমাবর্ষণ থামার পর তার হাহাকার কি বন্ধ হয়ে যায়? আর সেই সৈনিক— প্রায়শই তরুণ, প্রায়শই দরিদ্র, প্রায়শই দিশাহীন— ফিরে আসে বীরের সম্মানে নয়, বরং নিজেরই প্রেতাত্মার মতো।
এমনকি প্রকৃতিও এর অভিঘাত থেকে রেহাই পায় না। অরণ্যভূমি সাফ হয়ে যায়, নদীর জল বিষাক্ত হয়, ধ্বংসলীলার অবশেষ মাটিকে অনুর্বর করে তোলে। গাজার কৃষিজমি, গাছপালা, জল ও মাটির সম্পদ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; ৮০ শতাংশ গাছ ধ্বংস হয়েছে, বিশাল পরিমাণে কৃষিজমি ও জলাধান ধ্বংস হয়েছে, এবং প্রতিদিন লক্ষাধিক ঘনমিটার মল ও বর্জ্য ভূমি ও জলে মিশে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে উর্বরা জমিকে মরুভূমিতে রূপান্তরিত করতে পারে। সাইপ্রাস থেকে শুরু করে গাজা বা ডনবাস— পরিবেশ প্রতিবারই সবচেয়ে কম-কথিত অথচ সবচেয়ে গভীর ক্ষতির শিকার। আমরা ভুলে গেলেও যুদ্ধের কথা মাটি মনে রাখে।
তথাকথিত যুদ্ধ ‘জয়’ হলে কী পড়ে থাকে শেষ পর্যন্ত? গর্তে ভরা একটা মানচিত্র। প্রায়-হারিয়ে-যাওয়া একটা প্রজন্ম। প্রাণহীনভাবে গড়ে ওঠা নতুন শহর। সমাধিক্ষেত্রের ওপর ওড়ানো পতাকা। ২০১১-র লিবিয়া কিংবা ২০০৩-এর ইরাক আজ কী বলে সেই “জয়” কে?
যুদ্ধকে আর ‘অনিবার্য পাপ’ বলে সাফাই দেওয়ার ভণ্ডামি চলতে দেওয়া যায় না। যুদ্ধ অপরিহার্য নয়। যুদ্ধ একটা অপরাধ। বারবার যুদ্ধ বেছে নেয় তারাই— যাদের হারানোর প্রায় কিছুই নেই (শৃঙ্খল তো নয়ই), কিন্তু পাওয়ার আছে অনেক কিছু। এই অন্তহীন আবর্ত থেকে যদি আমরা বেরিয়ে আসতে চাই, তবে যুদ্ধকে তার সমস্ত রোমান্টিক মোহ আর কৃত্রিম মহিমা থেকে মুক্ত করতে হবে।
এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের নবম বর্ষের এই প্রথম সংখ্যার অবতারণা— ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা? শেষের প্রশ্নচিহ্নটি একটি আশার প্রতীক— যে-আশাকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতেই হবে যে-কোনও মূল্যে। আমরা সকৃতজ্ঞচিত্তে ঋণ স্বীকার করছি আশীষ লাহিড়ী, আশিস গুপ্ত, পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, শ্রীরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রতীক এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্যের প্রতি— যাঁরা তাঁদের মূল্যবান লেখাগুলি দিয়ে আমাদের ঋণী করেছেন। সেই সঙ্গেই অনিল আনন্দ-এর একটি লেখা আমরা প্রকাশ করেছি অনুবাদ করে। তার সঙ্গেই বিশেষ নিবন্ধ বিভাগে আমরা অর্থনীতিবিদ জেফ্রি স্যাকস-এর একটি বক্তৃতাও অনুবাদ করে প্রকাশ করেছি। আমাদের আশা এই মূল্যবান নিবন্ধটি পাঠকদের চিন্তার খোরাক জোগাবে।
একটু অন্য কথায় আসা যাক। কিছুদিন আগেই আমরা হারিয়েছি আমাদের অভিভাবকসম শ্রদ্ধেয় আখ্যানকার পীযূষ ভট্টাচার্য-কে। চার নম্বরে তাঁর আত্মজৈবনিক আখ্যান ‘অন্তেবাসী’ প্রকাশিত হচ্ছিল ধারাবাহিকভাবে। অসমাপ্তই রয়ে গেল। আমরা হারিয়েছি আমাদের আর এক প্রিয় মানুষ শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক এবং সমাজকর্মী বিশ্বজিৎ রায়-কে। দুজনকেই স্মরণ করেছি আমরা এই সংখ্যায়। এঁদের সঙ্গেই স্মরণ করা হয়েছে সদ্য-প্রয়াত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার-কে।
এ-ছাড়াও অন্যান্য নিয়মিত বিভাগ রয়েছে যথাবিহিত। পড়বেন, মতামত দেবেন, আর, অবশ্যই, যুদ্ধকে ঘৃণা করবেন…
Khub bhalo laglo mukhabandha ta pare. Hard copy ki paoa jabe??
আজ্ঞে আমাদের তো হার্ডকপির ব্যবস্থা নেই।