আমেরিকার বন্ধু হওয়া মারাত্মক ব্যাপার

জেফ্রি স্যাকস

 


এই নিবন্ধটি বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ, লেখক এবং সাস্টেনেবল ডেভলপমেন্ট-বিশেষজ্ঞ প্রফেসর জেফ্রি ডি স্যাকসের একটি সাম্প্রতিক ভাষণের পূর্ণাঙ্গ রূপান্তর। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে এই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিস্তারিত ভাষণটি প্রদান করেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ, ন্যাটো সম্প্রসারণ, আমেরিকার বিদেশনীতি এবং ইউরোপের ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ, গভীর ও প্রায়শই প্রচলিত ধারণার বিপরীত বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। প্রফেসর স্যাকস দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশের সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতি বিষয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। এই নিবন্ধে তাঁর মূল বক্তব্যকে যথাসম্ভব অবিকৃত রেখে একটি পাঠযোগ্য ও পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে যুদ্ধবিরোধী প্রেক্ষাপটে তাঁর ভাবনাগুলো বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারে। মূল বক্তব্যটি ইউটিউবে উপলব্ধ। সেটি নিবন্ধের শেষ দেওয়া থাকল

 

সময়টা জটিল। বদলাচ্ছেও দ্রুত। বেশ বিপজ্জনকও। ফলে আমাদের চিন্তাভাবনাগুলো স্পষ্ট ও পরিষ্কার হওয়া খুব জরুরি। আজকের এই আলোচনাটায় আমি বিশেষভাবে আগ্রহী। তাই চেষ্টা করব যতটা সম্ভব সংক্ষেপে এবং স্পষ্টভাবে আমার কথা বলতে।

আমি গত ৩৬ বছর ধরে পূর্ব ইউরোপ, প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং রাশিয়ার ঘটনাগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছি। ১৯৮৯ সালে আমি পোল্যান্ড সরকারের উপদেষ্টা ছিলাম। ১৯৯০-৯১ সালে প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভের, এরপর ১৯৯১-৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের এবং ১৯৯৩-৯৪ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট কুচমার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছি। এস্তোনিয়ার মুদ্রা চালুর ক্ষেত্রে আমি সাহায্য করি। প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়ার কয়েকটি দেশ, বিশেষ করে স্লোভেনিয়াকেও সাহায্য করেছি।

এই দীর্ঘ সময়ে ঘটনাগুলি দেখেছি খুব কাছ থেকে। ময়দানের ঘটনার পর নতুন সরকার আমাকে কিয়েভে আমন্ত্রণ জানায়। আমাকে ময়দান চত্বর ঘুরিয়ে দেখানো হয়, আর আমি অনেক কিছু সরাসরি জানার সুযোগ পাই। তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়ার নেতাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ রয়েছে। আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও আমি কাছ থেকে চিনি। আমাদের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী, ৫১ বছর আগে আমার ম্যাক্রোইকোনমিক্সের শিক্ষক ছিলেন। আমাদের বন্ধুত্বের বয়স অর্ধশতাব্দী।

এই কথাগুলো বলার কারণ একটাই— আমি যা বলব, তা আমার নিজের চোখে দেখা। কোনও শোনা কথা বা মতাদর্শ নয়। এই সময়কে ঘিরে এ-সবই আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

আমার মতে, ইউরোপের ওপর দিয়ে যে-সব নানা সংকট এসেছে তার মধ্যে শুধু ইউক্রেনের যুদ্ধই নয়, ১৯৯৯ সালের সার্বিয়ার ঘটনা, ইউরোপের বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ— যেমন ইরাক, সিরিয়া, কিংবা আফ্রিকার যুদ্ধ— যেমন সুদান, সোমালিয়া, লিবিয়া— এই সবের পেছনেই বহুলাংশে আমেরিকার হাত রয়েছে। অনেক সময় তারা সরাসরি এইসব যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, আবার কখনও পেছন থেকে উসকানি দিয়েছে।

এই কথাগুলো শুনে আপনারা হয়তো অবাক হলেন— কেউ কেউ আমার সমালোচনাও করতে পারেন— কিন্তু, এটাই সত্যি। আর এই বিষয়টা গত ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে। ১৯৯০-৯১ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ল, আমেরিকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে দুনিয়ার নিয়ন্ত্রক এখন তারাই। তাদের আর কারও মতামত, ‘রেড লাইন’, উদ্বেগ, নিরাপত্তা-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি, কোনও আন্তর্জাতিক আইন বা জাতিসংঘের কাঠামোকে পাত্তা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।

কথাগুলো কঠিন শোনালে আমি দুঃখিত— কিন্তু আমি চাই বিষয়টা আপনাদের উপলব্ধিতে গভীরভাবে পৌঁছক।

১৯৯১ সালে আমি গর্বাচেভের জন্য সাহায্য জোগাড় করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। সম্প্রতি আমি ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের একটি আর্কাইভ করা স্মারকলিপি (memo) পড়ছিলাম— যেখানে আমার সেই সময়ের প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেখানে দেখি, আমি যখন বলেছিলাম যে আমেরিকার উচিত সোভিয়েত ইউনিয়নকে আর্থিক স্থিতিশীলতা ও সংস্কারে সাহায্য করা, তখন তারা সেই প্রস্তাব হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। ওই মেমোতে লেখা আছে, হার্ভার্ডে আমার কিছু প্রাক্তন সহকর্মী বলেছিলেন, আমরা যতটুকু করলে বিপর্যয়টা পুরোপুরি এড়ানো যায়, সেটুকু করব— তবে তার বেশি নয়। কারণ, সোভিয়েত ইউনিয়নকে সত্যিকারের সাহায্য করা আমাদের স্বার্থের পরিপন্থী।

…আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি [গর্বাচেভ] আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন…
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এই ভাবনাটা আরও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আমি আজও নাম করে বলতে পারি— চেইনি (Cheney), উলফোভিৎজ (Wolfowitz) এবং আরও অনেকে সত্যিই বিশ্বাস করতেন: “We run the show”— আমরাই দুনিয়ার চালক। তাঁদের মনে হত, প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে যতটা সম্ভব নিংড়ে নিতে হবে, আর ইরাক, সিরিয়ার মতো তাদের মিত্ররা যারা তখনও টিকে আছে, তাদের সরিয়ে দিতে হবে।

এই পররাষ্ট্রনীতি আমরা গত ৩৩ বছর ধরে দেখতে পাচ্ছি।

এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে ইউরোপকে। কারণ এই পুরো সময়ে আমি ইউরোপের পক্ষ থেকে কোনও বলিষ্ঠ, স্বতন্ত্র পররাষ্ট্রনীতি দেখিনি। তাদের মধ্যে না আছে নিজস্ব কণ্ঠস্বর, না আছে ঐক্য, না আছে স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। ইউরোপীয় স্বার্থের চেয়ে অনেক বড় হয়ে উঠেছে আমেরিকার প্রতি আনুগত্য।

তবে, এমন কিছু মুহূর্ত এসেছিল যখন মতপার্থক্য প্রকাশ পেয়েছিল— আর আমার মতে সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের সময় ফ্রান্স ও জার্মানি সোজাসুজি বলেছিল যে, তারা রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটিয়ে আমেরিকার যুদ্ধ-অভিযানকে সমর্থন করে না। প্রসঙ্গত, সেই যুদ্ধের পরিকল্পনা সরাসরি করেছিলেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর পেন্টাগনের কিছু সহযোগী। আমি বলছি না এটার কোনও পরোক্ষ প্রভাব ছিল; আমি বলছি এটা ছিল সম্পূর্ণ স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ— এই যুদ্ধ হয়েছিল ইজরায়েলের স্বার্থরক্ষার জন্য। সেই সময় পল উলফোভিৎজ আর ডগলাস ফেইথ এই যুদ্ধ পরিচালনায় নেতানিয়াহুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন।

সেটাই ছিল শেষবারের মতো, যখন ইউরোপ কোনও স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছিল। আমি তখন ইউরোপের বহু নেতার সঙ্গে কথা বলেছিলাম— তাঁদের অবস্থান ছিল পরিষ্কার ও দৃঢ়, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।

এর পর থেকেই ইউরোপ সম্পূর্ণভাবে নিজের কণ্ঠস্বর হারিয়ে ফেলে— বিশেষ করে ২০০৮ সালের পর থেকে। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত আমেরিকার কৌশল ছিল খুব পরিষ্কার: একমেরু বিশ্বব্যবস্থায় তারা ধাপে ধাপে ন্যাটো-কে সম্প্রসারিত করবে— ব্রাসেলস থেকে শুরু করে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত। এই পূর্বমুখী সম্প্রসারণের কোনও সীমা থাকবে না। এইভাবেই তারা একমেরু দুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।

যাঁরা ছোটবেলায় আমার মতো Risk গেম খেলেছেন, তাঁরা হয়তো বুঝবেন আমেরিকার আইডিয়াটা কেমন ছিল— বোর্ডের প্রতিটি জায়গায় তাদের ঘুঁটি থাকা চাই। পৃথিবীর এমন কোনও অঞ্চল নেই যেখানে তাদের সামরিক ঘাঁটি না থাকলেও তারা নিশ্চিন্ত বোধ করে। বরং, যেখানে তাদের ঘাঁটি নেই, সেটাই তাদের চোখে শত্রুপ্রবণ এলাকা।

আসলে ‘নিরপেক্ষতা’ (neutrality) কথাটাই আমেরিকার রাজনৈতিক অভিধানে এক ধরনের অশ্রাব্য শব্দ, সম্ভবত সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য শব্দ। কারণ আপনি যদি শত্রু হন, অন্তত তারা জানে আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু আপনি যদি নিরপেক্ষ থাকেন, তাহলে তাদের চোখে আপনি আরও বিপজ্জনক— কারণ নিরপেক্ষতার মুখোশ পরে আপনি তাদের কিছুই বলছেন না। এটাই ছিল তাদের দৃষ্টিভঙ্গি।

এই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৪ সালে নেওয়া হয়, যখন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ন্যাটো‑র পূর্বে সম্প্রসারণের প্রস্তাবে সই করেন। আপনাদের মনে থাকবে, ১৯৯১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি, Hans‑Dietrich Genscher এবং James Baker III গর্বাচেভের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এরপর Genscher একটি প্রেস কনফারেন্স করেন, যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে ন্যাটো পূর্বদিকে যাবে না; ওয়ারশ চুক্তির বিলুপ্তির সুযোগ তারা নেবে না।

বুঝতে হবে, এটা কোনও সাধারণ কথাবার্তা নয়, বরং আইনগত প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছিল। এটি জার্মান পুনঃএকত্রীকরণের জন্য তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির আলোচনার অংশ, যেখানে চুক্তি হয়েছিল যে ন্যাটো এক ইঞ্চিও পূর্বে অগ্রসর হবে না। এটা সুস্পষ্ট, এবং অসংখ্য নথিতে এর প্রমাণ আছে। আপনি George Washington University‑র National Security Archive‑এ খুঁজে দেখতে পারেন— ডজন ডজন নথি পাবেন। উদাহরণস্বরূপ, একটি ওয়েবসাইটের নাম হল “What Gorbachev Heard About ন্যাটো”. একটু দেখে নেবেন, কারণ আমেরিকা এ-বিষয়ে যা বলছে, তার প্রায় সবই মিথ্যা— কিন্তু আর্কাইভগুলো একেবারে পরিষ্কার।

…ন্যাটো পূর্বদিকে যাবে না; ওয়ারশ চুক্তির বিলুপ্তির সুযোগ তারা নেবে না…

১৯৯৪ সালে ন্যাটো‑কে ইউক্রেন পর্যন্ত প্রসারিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এটা কোনও নির্দিষ্ট প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নয়; এটা মার্কিন সরকারের একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প, যা ৩০ বছরেরও বেশি আগে শুরু হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে ব্রজেজিনস্কি The Grand Chessboard নামে একটি বই লিখেছিলেন। এটা শুধু মিঃ ব্রজেজিনস্কির ব্যক্তিগত মত নয়; বরং মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির প্রকাশ্য ব্যাখ্যার একটি উদাহরণ। এভাবেই এই বইগুলো কাজ করে।

বইটিতে ইউরোপ ও ন্যাটো‑র একযোগে পূর্বমুখী সম্প্রসারণের রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে: “ইউরোপ ও ন্যাটো যখন পূর্বদিকে প্রসারিত হবে, তখন রাশিয়া কী করবে?”

আমি ব্রজেজিনস্কিকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম। তিনি আমার প্রতি সদয় ছিলেন, এবং যখন আমি পোল্যান্ডকে পরামর্শ দিচ্ছিলাম, তখন তিনি আমাকে সাহায্যও করেছিলেন। তিনি নিঃসন্দেহে একজন ভাল ও মেধাবী মানুষ ছিলেন, কিন্তু আমার মতে তাঁর বিশ্লেষণগুলোর বেশিরভাগই ভুল ছিল। ১৯৯৭ সালে তিনি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কেন রাশিয়ার ন্যাটো ও ইউরোপের পূর্বমুখী সম্প্রসারণ মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকবে না। তিনি বলেছিলেন, রাশিয়া কখনও চিনের সঙ্গে জোট বাঁধবে না— ভাবা যায়! রাশিয়া ইরানের সঙ্গেও মিত্রতা গড়বে না। তাঁর মতে, রাশিয়ার সামনে নাকি একমাত্র পথ হচ্ছে ইউরোপীয় হয়ে ওঠা। তাই, ইউরোপ যখন পূর্বদিকে এগোবে, রাশিয়া কিছুই করতে পারবে না— এই ছিল তাঁর এবং আরও কয়েকজন মার্কিন কৌশলবিদের বক্তব্য।

যুদ্ধ বস্তুটা যে সবসময় আমাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে, সে-নিয়ে আর কোনও সন্দেহ থাকে কি?

… ১৯৯৭ সালে ব্রজেজিনস্কি The Grand Chessboard নামে একটি বই লিখেছিলেন…

আমেরিকার একটা স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হল— ওরা ধরেই নেয় প্রতিপক্ষ কী করবে, কিন্তু ওরা নিজেরা প্রায়শই ভুল করে। আর সেই ভুলের একটা বড় কারণ হল, আমেরিকান স্ট্র্যাটেজিস্টরা যে গেম থিওরির ওপর নির্ভর করেন, সেখানে প্রতিপক্ষের সঙ্গে সরাসরি আলোচনার কোনও জায়গা নেই; আপনি শুধু অনুমান করেন ওপারের কৌশল কী হতে পারে। ব্যস! এতে সময় বাঁচে, কূটনীতির দরকার পড়ে না।

এইভাবেই প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল। এবং প্রায় ৩০ বছর ধরে— হয়তো গতকাল পর্যন্ত— একটা ধারাবাহিক সরকারি প্রকল্প হিসেবে তা চলেছে। ইউক্রেন ও জর্জিয়া ছিল এই প্রকল্পের কেন্দ্রবিন্দু। কেন?

কারণ আমেরিকা ব্রিটিশদের কাছ থেকেই তাদের কৌশল শিখেছে, আর তাই এক ধরনের নকল ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হয়ে উঠতে চাইছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ১৮৫৩ সালেই বুঝেছিল— যা লর্ড পামারস্টনের উপলব্ধি ছিল— রাশিয়াকে কৃষ্ণসাগরে ঘিরে ফেলতে হবে এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তাদের প্রবেশাধিকার রুখে দিতে হবে। আজকের দিনে যা দেখা যাচ্ছে, তা সেই একই পরিকল্পনার আধুনিক সংস্করণ: ইউক্রেন, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, তুরস্ক ও জর্জিয়া— এই কৃষ্ণসাগর-সংলগ্ন দেশগুলো রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে এই সমুদ্র থেকে। এর ফলে রাশিয়ার আন্তর্জাতিক কৌশলগত গুরুত্ব কমে যাবে, এবং তারা কেবল একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবেই সীমিত হয়ে পড়বে।

ব্রজেজিনস্কি এ-বিষয়ে অত্যন্ত স্পষ্ট ছিলেন। আর তাঁরও আগে ছিলেন ম্যাকিন্ডার, যিনি বলেছিলেন: যিনি বিশ্বের দ্বীপের মালিক, তিনিই বিশ্বের মালিক। সুতরাং এই প্রকল্পের শিকড় বহু পুরনো, আমার ধারণা, তা লর্ড পামারস্টনের আমলেই প্রোথিত হয়েছিল।

আমি আবারও বলছি— আমি প্রতিটি মার্কিন প্রশাসনের সময়েই সক্রিয়ভাবে উপস্থিত ছিলাম। আমি এই প্রেসিডেন্টদের এবং তাঁদের পরামর্শদাতা দলগুলিকে চিনি। ক্লিনটন থেকে শুরু করে বুশ, ওবামা, ট্রাম্প কিংবা বাইডেন— এই সময়কালে নীতিগত কোনও বড় পরিবর্তন হয়নি। বরং, সম্ভবত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও খারাপ হয়েছে।

আমার মতে, বাইডেন ছিলেন সবচেয়ে খারাপ। সম্ভবত, কারণ, বিগত কয়েক বছর ধরে তিনি মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন না। আমি এটা কোনও ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য হিসেবে নয়— একেবারেই সিরিয়াসভাবে বলছি।

আমেরিকার রাজনৈতিক ব্যবস্থা মূলত একটা ভাবমূর্তির খেলা। প্রতিদিনের মিডিয়া ম্যানিপুলেশন, জনমত নিয়ন্ত্রণের কৌশল, এবং একটা পিআর ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় এমন একজন প্রেসিডেন্টও ক্ষমতায় থাকতে পারেন, যিনি কার্যত অক্ষম। তিনি দু-বছর ক্ষমতায় থাকতে পারেন, এমনকি তিনি পুনঃনির্বাচনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করতে পারেন। সবচেয়ে করুণ ব্যাপারটা ঘটে যখন তাঁকে একবার ৯০ মিনিটের জন্য একা মঞ্চে দাঁড়াতে হয়— সেখানেই সব শেষ হয়ে যায়। যদি সেই ভুলটা না হত, তাহলে হয়তো তিনি তাঁর প্রার্থিতা চালিয়ে যেতেন— সে তিনি বিকেল ৪টের পর ঘুমিয়ে পড়ুন বা না পড়ুন!

এটাই আসলে বাস্তবতা। সবাই এর সঙ্গেই তাল মেলায়।

আমি জানি, আজকাল এমন কথা বলাটা ‘অভদ্রতা’ বলে ধরা হয়, কারণ এই পৃথিবীতে আমরা আর সত্যি কথাগুলো বলি না।

যা বলছিলাম— এই প্রোজেক্ট শুরু হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে। ১৯৯৯ সালে টানা ৭৮ দিন ধরে বেলগ্রেডে বোমাবর্ষণ সেই প্রোজেক্টেরই অংশ ছিল— একটি দেশকে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার প্রয়াস। সীমান্ত তো অলঙ্ঘনীয়, তাই না? কসোভোর ক্ষেত্রে অবশ্য সেই নিয়ম মানার দরকার নেই— কারণ সীমান্ত কেবল ততক্ষণই অলঙ্ঘনীয়, যতক্ষণ না আমেরিকা তা বদলাতে চায়।

… ১৯৯৯ সালে টানা ৭৮ দিন ধরে বেলগ্রেডে বোমাবর্ষণ সেই প্রোজেক্টেরই অংশ ছিল…

সুদানও ছিল এই একমেরু প্রকল্পের আরেক অংশ। দক্ষিণ সুদানে যা ঘটেছিল, সেটা কি নিছক স্থানীয় বিদ্রোহ ছিল? নাকি আমি আপনাদের CIA-র ‘প্লেবুক’-এর পাতাগুলো দেখাব, যাতে বড়দের মতো বুঝতে পারেন কৌশলটা আসলে কীভাবে কাজ করে? সামরিক অভিযান চালানো একটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ব্যাপার। এর জন্য দরকার অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণ, বেস ক্যাম্প, গোয়েন্দা তথ্য, আর বড় শক্তিগুলোর অর্থলগ্নি। এইসব জিনিস কখনও কোনও নিছক স্থানীয় বিদ্রোহে লাগে না। দক্ষিণ সুদান কোনও উপজাতীয় যুদ্ধে উত্তর সুদান বা মূল সুদানকে হারিয়ে দেয়নি; এটা একটা মার্কিন প্রকল্প। আমি প্রায়ই নাইরোবি যেতাম এবং সেখানে সুদানের রাজনীতিতে গভীরভাবে আগ্রহী মার্কিন সামরিক আধিকারিক, সিনেটর এবং অন্যান্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করতাম। পরিষ্কার বুঝতাম, সুদান একমেরু বিশ্ব-প্রকল্পের কৌশলগত দাবার চালগুলোরই একটা।

ন্যাটো সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে— হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড এবং চেক প্রজাতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে। রাশিয়া এতে প্রবলভাবে অসন্তুষ্ট হয়েছিল। তবে এই দেশগুলো তখনও রুশ সীমান্ত থেকে বেশ দূরে ছিল, ফলে রাশিয়ার প্রতিবাদে তেমন কাজ হয়নি। এরপর এলেন জর্জ বুশ জুনিয়র। ৯/১১ হামলার পর প্রেসিডেন্ট পুতিন সব ধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। আর তার মাত্র ক-দিন পর, ২০০১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, আমেরিকা সিদ্ধান্ত নেয়— আগামী পাঁচ বছরে তারা সাতটি যুদ্ধে জড়াবে।

আপনারা চাইলে জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্কের সেই সাক্ষাৎকার অনলাইনে শুনতে পারেন। তিনি ১৯৯৯ সালে ন্যাটো-র সুপ্রিম কমান্ডার ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, ২০০১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি যখন পেন্টাগনে যান, তখন তাঁকে একটি নথি দেওয়া হয়— সেখানে সেই সাতটি যুদ্ধের পরিকল্পনার কথা লেখা ছিল।

এই যুদ্ধগুলো আসলে ছিল নেতানিয়াহুর পরিকল্পনার অংশ— তাঁর নিজের কথায়, ‘এক রাষ্ট্রের পরিকল্পনা’। উদ্দেশ্য ছিল একদিকে পুরনো সোভিয়েত মিত্রদের সরিয়ে দেওয়া, আরেকদিকে হামাস ও হেজবোল্লাহর মতো ইজরায়েলবিরোধীদের নির্মূল করা। এই ‘এক রাষ্ট্র’ মানে শুধু ইজরায়েল— পুরো অঞ্চল থাকবে ইজরায়েলের নিয়ন্ত্রণে। আর যারা এর বিরোধিতা করবে, তাদের ‘আমরা’— আমরা নয় ঠিক, আমাদের মিত্র আমেরিকা— মুছে ফেলব। আজ সকাল পর্যন্ত এটিই ছিল মার্কিন নীতি। এখন সেটা বদলাবে কি না, আমরা জানি না। একমাত্র পার্থক্য হতে পারে— ইজরায়েলের বদলে হয়তো এবার আমেরিকা গাজার মালিক হবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা কমপক্ষে ২৫ বছর পুরনো।

আসলে এই কথাগুলো ১৯৯৬ সালের “Clean Break” নামের একটি নথির কথা। এটি নেতানিয়াহু ও তাঁর আমেরিকান রাজনৈতিক পরামর্শকদের তৈরি— মূল উদ্দেশ্য ছিল দুই-রাষ্ট্র সমাধানের ধারণাটিকে চূড়ান্তভাবে পরিত্যাগ করা। আপনি এই নথিটি অনলাইনে পেয়ে যাবেন।

তাই, এই সব কিছুই প্রোজেক্ট— দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। এগুলো কোনও বিশেষ প্রেসিডেন্টের কারসাজি নয়: এটা ক্লিনটনের আমলে হল কি না, বা বুশ, ওবামা, এমনকি ট্রাম্প বা বাইডেন— এইভাবে ব্যক্তিনির্ভর করে দেখাটা ভুল। আমেরিকান রাজনীতিকে যদি কেউ দৈনন্দিন কূটচাল বা নাটকের মতো ভাবে, সেটা আসলে একঘেয়েমি হয়ে দাঁড়াবে। কারণ মার্কিন রাজনীতি প্রকৃত অর্থে সেইরকম নয়।

ন্যাটো সম্প্রসারণের দ্বিতীয় ধাপ এল ২০০৪ সালে— আরও সাতটি দেশ যুক্ত হল: তিনটি বাল্টিক রাষ্ট্র (এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া), রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, স্লোভেনিয়া ও স্লোভাকিয়া। এই পর্যায়ে রাশিয়ার ক্ষোভ প্রবল হয়ে ওঠে। এ একেবারে জার্মান পুনঃএকত্রীকরণে সম্মত হওয়া যুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সরাসরি লঙ্ঘন। মূলত, একটি সহযোগিতামূলক ও ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা থেকে আমেরিকার মৌলিক বিচ্যুতি— বা বলা যায়, একরকম বিশ্বাসঘাতকতা। কারণ ওয়াশিংটন তখন একমেরু তত্ত্বে পুরোপুরি বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে।

তাহলে, যেমন অনেকে স্মরণ করতে পারবেন— বিশেষত যাঁরা গত সপ্তাহে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের খবর অনুসরণ করেছেন— ২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট পুতিন স্পষ্টভাবে বলেছিলেন: “থামুন। যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়। এখন থামুন।” এই বক্তব্যের অর্থ ছিল একটাই— ২০০৮ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের গলা টিপে ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে ন্যাটো-তে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টা চাপিয়ে দিয়েছিল।

আবারও বলছি, এটা কোনও আকস্মিক সিদ্ধান্ত ছিল না— এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রোজেক্ট।

আমি নিজে ২০০৮ সালের মে মাসে নিউ ইয়র্কে মিঃ সাাকাশভিলির বক্তৃতা শুনি। বক্তৃতা শেষে আমার স্ত্রী সোনিয়াকে ফোন করে বলেছিলাম: “এই লোকটা তো পুরোপুরি উন্মাদ!” আর তার ঠিক এক মাস পরেই একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। কারণ আমেরিকা এই লোকটাকে বলেছিল: “আমরা জর্জিয়াকে রক্ষা করব।” আর তিনি Council on Foreign Relations-এ দাঁড়িয়ে বললেন: “জর্জিয়া হল ইউরোপের কেন্দ্র।”

ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, জর্জিয়া ইউরোপের কেন্দ্র নয়।

আর সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো জর্জিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেনি। আপনাদের এমপি, এমইপি, কিংবা ইউরোপীয় রাজনীতিকরা যখন জর্জিয়ায় ঘুরে বেড়ান, তাতে জর্জিয়া বাঁচে না— জর্জিয়া ধ্বংস হয়। ২০০৮ সালে দেশটি কার্যত সম্পূর্ণই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।

সবাই জানেন, আমাদের প্রাক্তন CIA ডিরেক্টর উইলিয়াম বার্নস কন্ডোলিজা রাইস-কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মেমো পাঠিয়েছিলেন: “Nyet means nyet”— “না মানে না”। এটা ছিল ন্যাটো সম্প্রসারণ নিয়ে রাশিয়ার অবস্থানের স্পষ্ট বার্তা। আমরা এই তথ্য জেনেছি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ-এর ফাঁস করা উইকিলিকস নথি থেকে। কারণ, বিশ্বাস করুন, আজকাল মার্কিন জনগণকে, কিংবা সংবাদমাধ্যমকে এসব বিষয়ে কিছুই জানানো হয় না। তাই আমাদের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। এই মেমো আমরা এখন পড়তে পারি— সম্পূর্ণভাবে, বিশদে।

…আমাদের জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে…

আপনারা জানেন, ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ২০১০ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন ‘নিরপেক্ষতার’ প্ল্যাটফর্মে। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার কোনও ভূখণ্ডগত লোভ বা পরিকল্পনা ছিল না। আমি জানি— কারণ আমি তখন সেখানেই ছিলাম, ওই বছরগুলোতে। রাশিয়া যা আলোচনা করছিল, তা শুধু সেভাস্তোপলের নৌঘাঁটি নিয়ে। ২০৪২ সাল পর্যন্ত ২৫ বছরের লিজ নিয়ে কথা হচ্ছিল। ব্যস। ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ নয়, ডনবাস নয়, অন্য কিচ্ছু নয়। এই যে আজ বলা হয়— পুতিন রুশ সাম্রাজ্য পুনর্গঠন করছেন, এটা— দুঃখিত— নেহাতই একটা ছেলেমানুষি প্রচার। যদি কেউ সেই সময়কার ইতিহাস, ঘটনাপ্রবাহ, এবং বাস্তবতা জানেন, তাহলে বুঝবেন, এ ধরনের প্রচার কতটা কল্পনাপ্রসূত। তবে আজকাল দেখছি, ছেলেমানুষি ব্যাপারগুলোই প্রাপ্তবয়স্কদের ব্যাপারগুলোর চেয়ে ভালো কাজ করে।

আমেরিকা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল— এই লোকটাকে উৎখাত করতে হবে। এটাকে বলে: ‘রেজিম চেঞ্জ’ অপারেশন। এমন ঘটনা আমেরিকা প্রায় একশোবার ঘটিয়েছে— আপনাদের দেশে, অন্য দেশে, সারা দুনিয়ায়। এটাই তো CIA-এর কাজ। দয়া করে এটা জেনে রাখুন। এ খুব অস্বাভাবিক এক ধরনের বৈদেশিক নীতি। আমেরিকা যদি কোনও সরকার বা নেতৃত্বকে পছন্দ না করে, তবে তারা আলোচনায় যায় না— তারা চেষ্টা করে সেই সরকারকে উৎখাত করতে। প্রথমে গোপনে। আর যদি গোপনে কাজ না হয়, তাহলে সরাসরি, প্রকাশ্যে। তারপর বলা হয়— এটা আমাদের দোষ নয়। ওরাই আগ্রাসী। ওরাই হিটলারের মতো। এই কথাটা প্রতি দুই-তিন বছর অন্তর ফিরে আসে। সে সাদ্দাম হোসেন হোক, বা আসাদ, কিংবা পুতিন। এটা খুবই সুবিধাজনক একটি কৌশল। কারণ আমেরিকান জনগণকে কখনও অন্য কোনও ধরনের বৈদেশিক নীতির ব্যাখ্যাই দেওয়া হয় না। শুধু এটা কপচে গেলেই হয়: “আমরা আবার মিউনিখ, ১৯৩৮-এর মুখোমুখি।” “আমরা আবার মিউনিখ, ১৯৩৮-এর মুখোমুখি।” অন্য পক্ষের সঙ্গে কথা বলা যাবে না— কারণ তারা শয়তান। তারা অপ্রতিরোধ্য শত্রু। এটাই একমাত্র ফরেন পলিসি মডেল যা গণমাধ্যমে বারবার শোনানো হয়। আর গণমাধ্যমগুলিও এই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করে যায়, কারণ তারা মার্কিন সরকারের সম্পূর্ণ অধীনস্থ।

২০১৪ সালে আমেরিকা সক্রিয়ভাবে ইয়ানুকোভিচকে উৎখাত করার জন্য কাজ করছিল। আমার কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সহকর্মী ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ড এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সেই ফোনকল ইন্টারসেপ্টের কথা তো সবাই জানেনই। এর চেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ আর পাওয়া যায় না। রুশরা ওই ফোনকল ইন্টারসেপ্ট করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছিল। শুনবেন, এটা সত্যিই দারুণ।

আমি এই সব মানুষগুলোকেই চিনি। এভাবেই তারা সবাই বাইডেন প্রশাসনে পদোন্নতি পেয়েছে। এটাই তাদের কাজ।

তারপর যখন ময়দান শুরু হল, আমাকে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করা হল— “ওহ, প্রফেসর স্যাক্স, নতুন ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।” কারণ আমি ওসব বিষয়ে বেশ পটু। সুতরাং আমি কিয়েভে গিয়েছিলাম। আমাকে ময়দান ঘুরিয়ে দেখানো হল, আর জানানো হল কীভাবে আমেরিকা ময়দানের আশপাশে জড়ো হওয়া সবাইকে খরচ জুগিয়েছিল।

মর্যাদার স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব— ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ— দয়া করুন!

এই সব মিডিয়া আউটলেটগুলো কোথা থেকে আসে? এই সব সংগঠন কোথা থেকে আসে? এই সব বাসগুলো কোথা থেকে আসে? এই সব ডেকে আনা মানুষগুলো কোথা থেকে আসে? আপনারা কি মজা করছেন? এটা একদমই সংগঠিত প্রচেষ্টা। এবং সেটা কোনও গোপন বিষয়ও নয়। শুধু ইউরোপ ও আমেরিকার নাগরিকদের কাছে এগুলো আড়াল করা হয়। বাকি সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারে।

তারপর এল মিনস্ক, বিশেষ করে মিনস্ক II চুক্তি। এটি, প্রসঙ্গত, দক্ষিণ টাইরোলের স্বায়ত্তশাসনের মডেলে তৈরি হয়েছিল, আর বেলজিয়ানরাও মিনস্ক II-এর সঙ্গে খুব ভালোভাবে একাত্ম বোধ করতে পারত। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের রুশভাষী অঞ্চলগুলিতে স্বায়ত্তশাসন থাকবে। চুক্তিটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের (UN Security Council) সর্বসম্মতিক্রমে সমর্থিত। কিন্তু আমেরিকা ও ইউক্রেন সিদ্ধান্ত নিল যে, এটি কার্যকর করা হবে না। জার্মানি ও ফ্রান্স, যারা নর্ম্যান্ডি প্রক্রিয়ার গ্যারান্টার ছিল, তারা এটি উপেক্ষা করল।

ইউরোপের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আমেরিকান একমেরু পদক্ষেপের এটি আরেকটি নজির। যথারীতি, গ্যারান্টার হওয়ার পরও ইউরোপের ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ অকেজো ও অপ্রভাবশালী।

ট্রাম্পের আমলে অস্ত্রশস্ত্র বাড়ানো হয়। ডনবাসে ইউক্রেনের গোলাবর্ষণে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। তখন মিনস্ক II চুক্তি কার্যত নিষ্ক্রিয়। এরপর বাইডেন ক্ষমতায় এলেন।

আবারও বলছি, আমি এইসব মানুষদের চিনি। আগে আমি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য ছিলাম, কিন্তু এখন কঠোরভাবে কোনও দলের সদস্য না হওয়ার শপথ নিয়েছি, কারণ দুটোই আসলে একই। এবং এর কারণ হল, ডেমোক্র্যাটরাও সময়ের সঙ্গে পুরোপুরি যুদ্ধবাজ হয়ে উঠেছে। শান্তির বিষয়ে কোনও কণ্ঠস্বর ছিল না, ঠিক যেমন আপনারা বেশিরভাগ সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রেও দেখছেন।

২০২১ সালের শেষে পুতিন দুইটি নিরাপত্তা চুক্তির খসড়া নিয়ে শেষ চেষ্টা করেছিলেন— একটি ইউরোপের সঙ্গে, আর একটি আমেরিকার সঙ্গে। আমেরিকা ১৫ ডিসেম্বর, ২০২১-এ একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। হোয়াইট হাউসে জেক সালিভানের সঙ্গে আমার এক ঘণ্টার ফোনকল হয়েছিল। আমি জেককে অনুরোধ করেছিলাম—

—যুদ্ধ এড়িয়ে যান। আপনি যুদ্ধ এড়াতে পারেন। আপনাকে শুধু বলতে হবে যে ন্যাটো ইউক্রেনে সম্প্রসারিত হবে না।
—ওহ, ন্যাটো ইউক্রেন পর্যন্ত যাবে না, চিন্তা করবেন না।
—জেক, এটা প্রকাশ্যে বলুন।
—না, না, না, আমরা এটা প্রকাশ্যে বলতে পারি না।
—বলুন, জেক, এমন একটা বিষয় নিয়ে যুদ্ধ হতে চলেছে যা আসলেই ঘটছে না।

তিনি আবার বললেন, “চিন্তা করবেন না, জেফ, কোনও যুদ্ধ হবে না।”

আমি আপনাদের বলছি, এরা কিন্তু খুব কিছু বুদ্ধিমান নয়। এ একদম আমার সৎ মতামত, কারণ আমি এদের সঙ্গে ৪০ বছরেরও বেশি সময় কাজ করেছি। এরা নিজেদের সঙ্গেই কথা বলে, অন্য কারও সঙ্গে নয়। এরা গেম থিওরি খেলে— non-cooperative game theory। অর্থাৎ, আপনি অন্যপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন না; শুধু নিজের স্ট্র্যাটেজি তৈরি করেন। এটাই গেম থিওরির সারমর্ম। নেগোশিয়েশন থিওরি নয়, পিসমেকিং থিওরি নয়— এ হল একতরফা নন-কোঅপারেটিভ থিওরি। যদি আপনি ফর্মাল গেম থিওরি বোঝেন, বুঝতে পারবেন। এরা এটাই খেলে।

এই নীতির সূত্রপাত RAND Corporation-এ। ২০১৯ সালে র‍্যান্ড-এর একটি পেপার ছিল: “How do we extend Russia?” আপনারা কি জানেন, তারা একটা পেপার লিখেছিল যা বাইডেন প্রশাসন অনুসরণ করেছিল? “কীভাবে রাশিয়াকে ব্যস্ত রাখা যায়?”— আক্ষরিক অর্থে এটাই তাদের স্ট্র্যাটেজি। কীভাবে রাশিয়াকে ব্যস্ত রাখা যাবে? একে উস্কে দেওয়া হবে, ওকে ভাঙা হবে, হয়তো ‘রেজিম চেঞ্জ’ ঘটানো হবে, হয়তো অস্থিরতা সৃষ্টি করা হবে, হয়তো অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করা হবে।

একে আপনারা মিত্রতা বলেন? আপনারা কি মজা করছেন?

সালিভানের সঙ্গে আমার একটা দীর্ঘ এবং হতাশাজনক ফোনকল হয়েছিল। আমি তখন কনকনে ঠান্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেদিন স্কি করতে গিয়েছিলাম। আর সেখানেই বলেছিলাম, “জেক, দয়া করে যুদ্ধটা কোরো না।” সে সান্ত্বনা দিয়েছিল— “ওহ, কোনও যুদ্ধ হবে না, জেফ।” কিন্তু আমরা জানি, ঠিক তার পরের মাসেই কী ঘটেছিল। তারা যথারীতি আলোচনা করতে অস্বীকার করেছিল।

ন্যাটো-র সবচেয়ে নির্বোধ ও বিপজ্জনক ধারণা হল তথাকথিত ‘খোলা দুয়ার’ নীতি। আবদারটা বুঝুন। এর মানে হল, ন্যাটো যেখানে খুশি যাবে, আর কোনও প্রতিবেশীর কিছু বলার অধিকার থাকবে না। আমি মেক্সিকান এবং কানাডিয়ানদের বলি, ওটা একবার চেষ্টা করে দেখুন। ধরুন, ট্রাম্প হয়তো কোনওদিন কানাডা দখল করতে চাইতে পারেন। তাই কানাডা চিনকে বলল, “আপনারা অন্টারিওতে একটা মিলিটারি বেস তৈরি করুন না কেন?” আমি এই পরামর্শ দিচ্ছি না, কিন্তু ভেবে দেখুন, আমেরিকা কি তখন বলবে, “ওহ, এটা তো ‘খোলা দরজা’, এটা ওদের ব্যাপার!”

কিন্তু ইউরোপের তথাকথিত প্রাপ্তবয়স্করা এ-কথাগুলিরই পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছেন। আপনাদের কমিশন, আপনাদের ‘হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ’, সবাই এই অর্থহীন কথাবার্তা বলে চলেছেন। এটা এমনকি baby geopolitics-ও নয়— এটা একেবারেই চিন্তাভাবনার অভাব।

সুতরাং যুদ্ধ শুরু হল। এই যুদ্ধে পুতিনের উদ্দেশ্য কী ছিল? আমি আপনাদের স্পষ্ট করে বলতে পারি, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল— জেলেনস্কিকে নিরপেক্ষতা নিয়ে আলোচনায় বসতে বাধ্য করা। আর সেটা আগ্রাসনের মাত্র সাত দিনের মধ্যেই ঘটেছিল। আপনাদের এটা বোঝা উচিত, এই বিষয়ে যে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়, যেমন, “ওহ, তারা ব্যর্থ হয়েছে”, “সে ইউক্রেন দখল করতে যাচ্ছিল”— এসব আসলে বাস্তবতা নয়। ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, একটা সাধারণ বিষয় বুঝুন— এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল ন্যাটো, আর ন্যাটো মানেই, শেষ পর্যন্ত, আমেরিকা। উদ্দেশ্য ছিল— ন্যাটো-কে, অর্থাৎ আমেরিকাকে, রাশিয়ার সীমান্ত থেকে দূরে রাখা। এর চেয়ে কম কিছু নয়, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।

এখানে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমি যোগ করতে চাই— আমেরিকা কেন এত আগ্রহী?

প্রথমত, ভাবুন, যদি চিন বা রাশিয়া রিও গ্র্যান্ডে নদীর ধারে বা কানাডার সীমান্তে মিলিটারি বেস বানাতে চায়, তাহলে শুধু আমেরিকা আতঙ্কে কাঁপবেই না, ১০ মিনিটের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, আমেরিকা ২০০২ সালে একতরফাভাবে Anti-Ballistic Missile Treaty (ABM চুক্তি) বাতিল করে, আর সেইসঙ্গে ধ্বংস করে ফেলে নিউক্লিয়ার অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের গোটা কাঠামো। এটা বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ— এই অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি হয়েছিল প্রথম আঘাত (first strike) প্রতিরোধের ধারণার উপর ভিত্তি করে। আর ABM চুক্তি ছিল তার এক কেন্দ্রীয় উপাদান। ২০০২ সালে, যখন আমেরিকা একতরফাভাবে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে, রাশিয়ার ক্ষোভ তখন চরমে পৌঁছায়।

সুতরাং আমি যা কিছু বলছি, তা শুধু ইউক্রেন প্রসঙ্গে নয়, বরং পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর সম্পূর্ণ ধ্বংসের প্রেক্ষাপটেও।

২০১০ সাল থেকে, আমেরিকা পোল্যান্ডে এবং পরে রোমানিয়ায় এজিস মিসাইল সিস্টেম স্থাপন করে। রাশিয়া সেটা পছন্দ করেনি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আলোচনার টেবিলে থাকা অন্যতম বিষয় ছিল— আমেরিকা কি ইউক্রেনে মিসাইল সিস্টেম বসানোর অধিকার দাবি করে? আর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ব্লিনকেন লাভরভকে বলেছিলেন, আমেরিকা যেখানে খুশি মাঝারি পাল্লার মিসাইল সিস্টেম বসানোর অধিকার রাখে। এই লোকটিই আপনাদের তথাকথিত “মিত্র”। এখন তো আবার কথাবার্তা চলছে জার্মানিতে আবার মাঝারি পাল্লার মিসাইল সিস্টেম ফিরিয়ে আনার!

আমেরিকা ২০১৯ সালে একতরফাভাবে INF চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আজ আর কোনও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কাঠামো নেই— কিছুই নেই।

যখন জেলেনস্কি আগ্রাসনের সাত দিনের মধ্যেই বলেছিলেন, “আসুন আলোচনা করি,” আমি তখন এ-বিষয়ে বিস্তারিত জানতাম, কারণ আমি সব পক্ষের সঙ্গে সরাসরি এবং গভীরভাবে কথা বলেছি। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে একখানা খসড়া চুক্তিপত্র তৈরি হয়, যা প্রেসিডেন্ট পুতিন অনুমোদনও করেছিলেন। চুক্তিটি লাভরভ উপস্থাপন করেছিলেন এবং তুর্কি মধ্যস্থতাকারীরা ওই প্রক্রিয়া চালাচ্ছিলেন। আমি নিজে আঙ্কারায় উড়ে গিয়েছিলাম— জানতে চেয়েছিলাম, এই মধ্যস্থতাকারীরা কী করছেন, কীভাবে করছেন।

ইউক্রেন একতরফাভাবে প্রায় চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া সেই চুক্তি থেকে সরে আসে। কেন? কারণ আমেরিকা তাদের সেটাই করতে বলেছিল। আর যুক্তরাজ্য তো তাতে আরও ঘি ঢালল— বরিস জনসনকে (BoJo) ২০২২ সালের এপ্রিলের শুরুতে ইউক্রেনে পাঠিয়ে, বুঝিয়ে বলার জন্য। (যদি আপনাদের কারও নিরাপত্তা বরিস জনসনের হাতে থাকে, ঈশ্বর রক্ষা করুন)। এখন দেখা যাচ্ছে, কিয়ার স্টারমার হয়তো তার চেয়েও খারাপ। বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু বাস্তব।

বরিস জনসন তখন একেবারে স্পষ্ট করে বলেছিলেন— আপনারা ওয়েবসাইটে সেটা এখনও দেখতে পারেন— “What’s at stake here is Western hegemony, not Ukraine. Western hegemony.” (এখানে যা ঝুঁকির মুখে আছে তা ইউক্রেন নয়, বরং পশ্চিমি আধিপত্য।)

মাইকেল আর আমি ২০২২ সালের বসন্তে ভ্যাটিকানে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। সেখানে আমরা একটি নথি লিখেছিলাম, যেখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল— এই যুদ্ধ থেকে ইউক্রেনের পক্ষে কিছুই ভালো হতে পারে না। আমরা বলেছিলাম, এখনই আলোচনা শুরু করুন। কারণ যত সময় যাবে, তত বেশি মানুষের মৃত্যু হবে, পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়বে, আর সম্ভবত যুদ্ধের পরাজয় ঘটবে।

আমরা তখন যা লিখেছিলাম, আজও তার একটি শব্দও আমি পাল্টাতে চাই না— সেই নথিতে কোনও ভুল ছিল না। সেই নথির পর থেকে, আমেরিকা যখন আলোচকদের টেবিল থেকে সরিয়ে দেয়, তারপর থেকে প্রায় দশ লক্ষ ইউক্রেনীয় মারা গিয়েছেন বা গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। আর আমেরিকার যেসব সিনেটর— যাঁদের নৈতিক অবস্থা অকল্পনীয়রকম নোংরা, নিষ্ঠুর এবং দুর্নীতিপূর্ণ— তাঁরা বলেন, এটা আমাদের অর্থের এক দারুণ খরচ, কারণ কোনও আমেরিকান তো মরছে না।

এটা একেবারে খাঁটি প্রক্সি যুদ্ধ। আমার খুব কাছের এক সিনেটর, ব্লুমেন্থাল, এটা প্রকাশ্যে বলেন। মিট রমনিও প্রকাশ্যে বলেন। তাঁদের মতে, এটা আমেরিকার জন্য একেবারে লাভজনক বিনিয়োগ— কারণ কোনও আমেরিকান মরছে না।

ভাবতে পারছেন!

এখন, গতকাল পর্যন্ত যা ঘটেছে— এই “প্রোজেক্ট” ব্যর্থ হয়েছে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, রাশিয়া হাত গুটিয়ে নেবে। প্রথম থেকেই তাদের ধারণা ছিল, রাশিয়া কোনও প্রতিরোধ করতে পারবে না। ১৯৯৭ সালে ব্রজেজিনস্কি যেমন ব্যাখ্যা করেছিলেন, আমেরিকানরা ভেবেছিল— “আমাদের হাতেই সব তাস। আমরা জিতব, কারণ আমরা ওদের ব্লাফ করব। ওরা আসলে লড়বে না। ওরা একজোটও হবে না।” SWIFT সিস্টেম থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়া— এই পারমাণবিক অর্থনৈতিক অস্ত্র দিয়েই কাজ হবে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েই ওদের কাবু করা যাবে। HIMARS দিয়েই ওদের দমিয়ে দেওয়া যাবে। F-16 হামলায় সব শেষ হয়ে যাবে…

সত্যি বলতে, আমি এটা অন্তত ৫৬ বছর ধরে শুনে আসছি। ওরা প্রতিদিন এসব আজেবাজে কথা বলে। ওদের এই আচরণ আমার কাছে সম্পূর্ণ চেনা, পুরনো গল্প।

আমার ইউক্রেনীয়দের সঙ্গে বহু বছরের সম্পর্ক আছে— আমি কোনওভাবেই ইউক্রেনবিরোধী নই, আমি সম্পূর্ণভাবে ইউক্রেনপন্থী। আমি ইউক্রেনীয়দের কাছে বারবার অনুরোধ করেছিলাম— “তোমাদের জীবন বাঁচাও, তোমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করো, তোমাদের ভূখণ্ড রক্ষা করো। নিরপেক্ষ থাকো। আমেরিকানদের কথায় কান দিও না।” আমি তাদের হেনরি কিসিঞ্জারের সেই বিখ্যাত প্রবাদটি বারবার বলেছিলাম— “To be an enemy of the United States is dangerous, but to be a friend is fatal.”

আর আজ আমি এই একই কথা ইউরোপের জন্যও বলছি—

আমেরিকার শত্রু হওয়া বিপজ্জনক, কিন্তু বন্ধু হওয়া মারাত্মক ব্যাপার।

এখন আমি ট্রাম্প সম্পর্কে কয়েকটা চূড়ান্ত কথা বলি। ট্রাম্প কোনওভাবেই হারের দায় নিতে চান না। আর এটাই এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার সবচেয়ে বড় সম্ভাবনার জায়গা— কারণ ট্রাম্প এবং প্রেসিডেন্ট পুতিন, দুজনেই যুদ্ধ শেষ করতে প্রস্তুত থাকবেন। ইউরোপ যতই যুদ্ধবাজি করুক, তাতে কিছু আসে-যায় না। এই যুদ্ধ শেষ হচ্ছে। তাই এই বিষয়টা আপনাদের সিস্টেম থেকে মুছে ফেলুন। অনুগ্রহ করে আপনাদের সহকর্মীদের বলুন— এই যুদ্ধ শেষ। আর এটা শেষ হচ্ছে শুধু একটাই কারণে— ট্রাম্প হারতে চান না। ব্যস। এর মধ্যে কোনও মহান নৈতিকতার আদর্শ নেই। তিনি কেবল হারতে চান না। আর ইউক্রেন এখন একটা হারার বাজি।

যে আলোচনা এখন চলছে তাতে ইউক্রেনই প্রথম, যে বাঁচবে। দ্বিতীয় বাঁচবে ইউরোপ। আপনাদের শেয়ারবাজার, যা এই আলোচনার ‘ভয়াবহ’ খবরে চাঙ্গা হচ্ছে— আমি জানি খবরটা এই চেম্বারগুলিতে আতঙ্কের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়েছে— কিন্তু এটাই আসলে আপনাদের জন্য সবচেয়ে ভালো খবর।

যদিও তাঁরা আমার কথা শোনেন না, তবুও আমি চেষ্টা করেছিলাম কিছু ইউরোপীয় নেতার কাছে পৌঁছাতে। কিন্তু, ওই যে বললাম, বেশিরভাগই আমার কাছ থেকে কিছু শুনতেই চান না। তবুও আমি বলেছিলাম— “কিয়েভে যাবেন না, মস্কোতে যান। আপনাদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে কথা বলুন। আপনারা কি মজা করছেন? আপনারা তো ইউরোপ! আপনাদের আছে ৪৫০ মিলিয়ন মানুষ, আপনাদের অর্থনীতি ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের। আপনারা তো রাশিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক অংশীদার হওয়া উচিত। এটাই তো স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক সংযোগ।” যাই হোক, যদি কেউ আলোচনা করতে চান কীভাবে আমেরিকা নর্ড স্ট্রিম উড়িয়ে দিয়েছিল, আমি সে-বিষয়ে কথা বলতে পারলে খুশি হব।

… কীভাবে আমেরিকা নর্ড স্ট্রিম উড়িয়ে দিয়েছিল…

সত্যি বলতে, ট্রাম্প প্রশাসন অন্তরে সাম্রাজ্যবাদী। তাদের ধারণার মূল কথা হল— মহাশক্তিরাই বিশ্ব শাসন করে। আমরা যা চাই, যখন পারি, তা-ই করব। আমরা বাইডেনের মতো অকর্মণ্য নই। আমরা বুঝব কখন ক্ষতি কমাতে হবে, আর তখনই তা করব।

বিশ্বে একাধিক যুদ্ধক্ষেত্র আছে। মধ্যপ্রাচ্য তার মধ্যে আরেকটি। সেখানে কী ঘটবে, কেউ জানে না। আবারও বলছি— যদি ইউরোপের সঠিক নীতি থাকত, তারাই এই যুদ্ধও থামাতে পারত। ওদিকে কিন্তু চিনের সঙ্গে যুদ্ধও একটা সম্ভাবনা। আমি বলছি না যে আমরা কোনও শান্তির নতুন যুগে ঢুকেছি। কিন্তু আমরা এখন একেবারেই ভিন্ন ধরনের রাজনীতির মধ্যে আছি।

আবারও জোর দিয়ে বলছি, ইউরোপের একটা নিজস্ব বিদেশনীতি থাকা উচিত। শুধু রুশ-ভীতি বা রুশোফোবিয়া দিয়ে বিদেশনীতি চলে না— বাস্তববাদী একটা বিদেশনীতি দরকার। একটা নীতি যা রাশিয়ার পরিস্থিতি বোঝে, ইউরোপের বাস্তবতা বোঝে, আর বোঝে আমেরিকা কী এবং কীসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। এমন নীতি, যা ইউরোপকে আমেরিকার আধিপত্য থেকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে। কারণ এটা অসম্ভব নয় যে আমেরিকা ডেনমার্কের ভূখণ্ডে সৈন্য নামাবে। আমি মজা করছি না। আর আমার মনে হয় না, আমেরিকাও মজা করছে।

তাই, ইউরোপের দরকার একটা সত্যিকারের বিদেশনীতি। এরকম একেবারেই নয় যে— “হ্যাঁ, আমরা মিঃ ট্রাম্পের সঙ্গে দরকষাকষি করব, এবং অর্ধেক পথে তার সঙ্গে দেখা করব…” আপনারা জানেন কি সেরকম ঘটনা কীভাবে শেষ হবে? পরে সেই আমাকে ফোন করবেন।

কিন্তু আমি অনুরোধ করছি— আমেরিকান কর্তাদের ইউরোপের মাথায় বসাবেন না। ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিন। একটা ইউরোপীয় foreign policy রাখুন। আপনারা দীর্ঘদিন রাশিয়ার সঙ্গে বাস করতে চলেছেন। তাই অনুরোধ করছি, রাশিয়ার সঙ্গে বসে আলোচনা করুন। টেবিলে সত্যিকারের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ইস্যু রয়েছে। কিন্তু এই যত আড়ম্বর আর রুশোফোবিয়া— এগুলো আপনাদের নিরাপত্তার কোনও কাজেই আসছে না। এগুলো ইউক্রেনেরও কোনও কাজে আসছে না। বরং, এই নির্বোধ আমেরিকান অ্যাডভেঞ্চারে— যাতে আপনারা সই করেছিলেন এবং তারপর তার প্রধান চিয়ারলিডার হয়ে উঠেছিলেন— ইউক্রেনে প্রায় দশ লক্ষ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। কোনও সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি।

মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে, প্রসঙ্গত বলি, আমেরিকা প্রায় ৩০ বছর আগেই মধ্যপ্রাচ্যসংক্রান্ত বিদেশনীতির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি নেতানিয়াহুর হাতে তুলে দিয়েছে। ইজরায়েল লবি আমেরিকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে— এ-নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাখ্যা করতে পারি কীভাবে এই সিস্টেমটা চলে। এটা খুবই বিপজ্জনক সিস্টেম। আমি আশা করি, ট্রাম্প নিজের প্রশাসনকে, আর আরও খারাপভাবে বললে, প্যালেস্তাইনের জনগণকে নেতানিয়াহুর কারণে ধ্বংস করবেন না।

নেতানিয়াহুকে আমি ICC দ্বারা সঠিকভাবে অভিযুক্ত একজন যুদ্ধাপরাধী মনে করি। এবং এ-বিষয়ে এটাই আমার শেষ কথা।

…নেতানিয়াহুকে আমি ICC দ্বারা সঠিকভাবে অভিযুক্ত একজন যুদ্ধাপরাধী মনে করি…

আগামী ৪ জুন, ১৯৬৭ সালের সীমান্ত অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে শান্তির একমাত্র পথ হিসেবে একটি স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র হবে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি পেতে এটাই একমাত্র পথ: দুই-রাষ্ট্র সমাধান।

এ-পথে একটাই বাধা রয়েছে, আর সেটা হল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকার ভেটো। তাই, যদি আপনারা কোনও প্রভাব ফেলতে চান, তাহলে আমেরিকাকে বলুন— “ভেটো তুলে নাও।” আপনারা থাকবেন বিশ্বের ১৮০টি দেশের সঙ্গে। প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের বিরোধিতা করছে কেবল আমেরিকা, ইজরায়েল, মাইক্রোনেশিয়া, নাউরু, পালাউ, পাপুয়া নিউ গিনি এবং প্যারাগুয়ে। সুতরাং এটা এমন একটা ক্ষেত্র যেখানে ইউরোপের বড় ধরনের প্রভাব থাকতে পারত।

কিন্তু ইউরোপ এখনও JCPOA এবং ইরান প্রসঙ্গে একেবারে নীরব।

নেতানিয়াহুর জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন হল আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ লাগানো। তিনি এখনও হাল ছাড়েননি, আর সেটা ঘটতেও পারে, কারণ এই ক্ষেত্রে আমেরিকার কোনও স্বাধীন বিদেশনীতি নেই— পুরোটাই ইজরায়েল দ্বারা পরিচালিত। এটা দুঃখজনক, অবিশ্বাস্য— যেমনই মনে হোক না কেন— সত্য।

এই বিষয়টা কিন্তু শেষ হওয়া সম্ভব ছিল। হয়তো ট্রাম্প বলবেন, “আমি বিদেশনীতি নিজের হাতে ফেরত নিতে চাই।” হয়তো সেটাই হবে। আমি অন্তত সেই আশাই করছি।

সবশেষে, চিন সম্পর্কে শুধু এতটাই বলি: চিন কোনও শত্রু নয়। চিন আসলে একটা সাফল্যের কাহিনি। এই কারণেই আমেরিকা তাকে শত্রু হিসেবে দেখে— কারণ চিন এখন আমেরিকার চেয়ে বড় অর্থনীতি।

ব্যস, এটুকুই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...