
তপারতি গঙ্গোপাধ্যায়
এক অসামান্য ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ও সংগঠক ছিলেন অধ্যাপক জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার। তাঁর অসংখ্য লেখা, পাঠ্যবই, সাক্ষাৎকার, বিজ্ঞানদর্শনের মধ্যে তিনি আগামীর স্বপ্ন রেখে গেছেন। তাঁর যত্নের প্রতিষ্ঠান বহু প্রজন্মের বিজ্ঞানচর্চার সাক্ষী থাকবে, তাঁর আপাত-অনুত্তীর্ণ তত্ত্বের মধ্যে তাঁর মেধা, উদ্যম এবং অধ্যবসায়ের ছাপ রয়ে যাবে। অসংখ্য হৃদয়ে মহাকাশের স্বপ্ন, মৌলিক বিজ্ঞানের চেতনা বপন করেছেন জয়ন্ত। ভারতের জনবিজ্ঞান আন্দোলন তাঁর কাছে চিরঋণী
সালটা সম্ভবত ২০১২। আয়ুকার চন্দ্রশেখর অডিটোরিয়ামে “জেভিএন”-এর পাবলিক লেকচার। “There is always a significant correlation between taking the right bus and constructing your life.” জীবন গড়ে তোলার প্রতিটি ধাপের একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। ব্যর্থতা বা সাফল্যের প্রেক্ষিত আসলে সময়ের গুরুত্ব। সহজ, প্রাণবন্ত ছিল তাঁর উপস্থিতি ও জীবনবোধ।
কসমোলজি বা মহাবিশ্বতত্ত্বও ঠিক তাই। সময়ের আপেক্ষিকতা, গুরুত্ব। আজ থেকে একশো বছর আগে কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে কসমোলজির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। স্ট্যান্ডার্ড মডেলে চারটি মৌলিক বলের একত্রীকরণের তত্ত্ব অন্যতম। গ্র্যাভিটি, উইক, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ও স্ট্রং ফোর্স। বিগ ব্যাং নিউক্লিওসিন্থেসিস অনুসারে, এই মহাবিশ্ব যখন তৈরি হয়েছিল, সেই সময় প্রায় অসীম শক্তির সৃষ্টি হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের মতে, সেই শক্তিতেই মৌলিক বলগুলি একত্রিত ছিল। সৃষ্টির পরমুহূর্তেই মহাবিশ্ব অতি দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে— যাকে ‘ইনফ্লেশন’ বলে। সেই সময় শক্তি ছড়িয়ে পড়তে থাকে, উষ্ণতা কমতে থাকে এবং মৌলিক বলগুলি একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র হতে থাকে। প্রসঙ্গত, স্ট্যান্ডার্ড মডেলের কিছু ত্রুটিও রয়েছে, যেমন মহাকর্ষ বলকে এখনও এই মডেলে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। স্ট্রিং থিওরি বা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির মাধ্যমে মহাকর্ষের কণাধর্মকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা চলছে। তবে, আজকের মহাবিশ্বের যে রূপ আমরা জানি, সেখান থেকে ওই শুরুর মুহূর্তের উষ্ণতা ও ঘনত্বের কাছাকাছি পরীক্ষামূলকভাবে পৌঁছনো সম্ভব কি না বলা যায় না।
১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের ধর্মযাজক ও শিক্ষক অ্যাবি জর্জ ল্যামেত্রা আইনস্টাইনের সাধারণ অপেক্ষবাদ এবং ফ্রীডম্যানের সমীকরণ থেকে বিগ ব্যাং তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। তার তিন বছর আগেই এডুইন হাবল আবিষ্কার করেছেন অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথ এবং দেখিয়েছেন এই ব্রহ্মাণ্ড প্রসারিত হচ্ছে। স্থিতিশীল ব্রহ্মাণ্ডের ধারণা থেকে বেরিয়ে বিজ্ঞানীরা এক নতুন বিস্ময়ের মুখোমুখি হন।
কিন্তু বিগ ব্যাং সম্পর্কে অসংখ্য প্রশ্ন ও বিতর্ক গড়ে উঠতে শুরু করল। পাশাপাশি বেশ কিছু বিকল্প তত্ত্বেরও জন্ম হল। তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ১৯৪৮ সালে ফ্রেড হয়েল, হারম্যান বন্ডি এবং থমাস গোল্ড প্রস্তাবিত “স্টেডি স্টেট থিওরি”। এই তত্ত্ব অনুযায়ী মহাবিশ্বের কোনও শুরু ও শেষ নেই। এটি প্রসারণশীল হলেও তার গড় ঘনত্ব ধ্রুবক, সেটা সম্ভব হচ্ছে কারণ একটি নির্দিষ্ট হারে নতুন পদার্থের জন্ম হচ্ছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ছায়াপথের দূরত্ব, ঔজ্জ্বল্য, হাবল ধ্রুবক— সবই অপরিবর্তনীয়। যার মানে দাঁড়ায় যে ওই সৃষ্টির নির্দিষ্ট মুহূর্ত বা বিগ ব্যাং বলে কিছু নেই।
কিন্তু ১৯৬০-এর দশকে ওই তত্ত্বের বিপরীতে বহু পর্যবেক্ষণ প্রমাণিত হয়। বিশেষ করে দেখা যায়, হাবলের সূত্র এবং রেডিও পালসারগুলির সংখ্যা সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হচ্ছে। অর্থাৎ স্টেডি স্টেট এখানে খাটছে না। এখানে একটি মজার বিষয় উল্লেখ করি, বিখ্যাত “বিগ ব্যাং” নামটি স্যার ফ্রেড হয়েলেরই দেওয়া, যদিও সারাজীবন তিনি এই তত্ত্বের বিপরীতেই কাজ করেছেন।
জয়ন্ত বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে কেমব্রিজে যোগ দেন ১৯৫৭ সালে। ১৯৫৯ সালে গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর-সহ ‘সিনিয়র র্যাংলার’ উপাধি পান। ১৯৬০ সালে ফ্রেড হয়েলের কাছে গবেষণা শুরু করেন। শুরুতে ফ্রেড তাঁকে পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে বেছে নিতে বলেন— ঘূর্ণায়মান মহাবিশ্ব, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, শোয়ার্জশিল্ড সমীকরণ এবং রেডিও উৎস সম্পর্কে কাজ। কিন্তু জয়ন্তর মূল আগ্রহ ছিল ফ্রেডের ‘স্টেডি স্টেট’ তত্ত্বে।
বিগ ব্যাং যেখানে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির একটিই উৎসবিন্দুর কথা বলে, স্টেডি স্টেট তত্ত্ব সেখানে ছোট ছোট শক্তিক্ষেত্রের মাধ্যমে নিরন্তর পদার্থ সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করে। সেই সময় ক্যাভেন্ডিশ গবেষণাগারে অধ্যাপক মার্টিন রাইল রেডিও উৎস পর্যবেক্ষণ শুরু করেন— অর্থাৎ খুব দূরের, বিশাল বড় ছায়াপথগুলি, যারা রেডিও তরঙ্গ বিকিরণ করে। রাইল দেখেন, এই উৎসগুলির ঘনত্ব দূরত্বের সঙ্গে বাড়ছে। অর্থাৎ অতীতে মহাবিশ্বে রেডিও উৎসের সংখ্যা বেশি ছিল— অর্থাৎ মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে, তার ঘনত্ব কমছে। রাইল সরাসরি স্টেডি স্টেট তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন।
এর উত্তরে জয়ন্ত একটি গাণিতিক মডেলের সাহায্যে দেখান, মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে এটি অতি অসম ‘সুপারক্লাস্টার’-এর মতো অবস্থায় ছিল, এবং ছায়াপথগুলি সময়ের সঙ্গে শক্তি হারিয়ে রেডিও উৎসে পরিণত হয়। তিনি দেখান, রাইলের পর্যবেক্ষণ দূরত্বনির্ভর এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের পরে এই উৎসগুলির ঘনত্ব আবার কমতে থাকবে। নারলিকারের গাণিতিক মডেলের গ্রাফ রাইলের পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিলে যায়। বস্তুত, পর্যবেক্ষণের সঙ্গে তত্ত্বকে মিলিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনও অনুভব করেন তিনি।
ফ্রেড একজন নতুন গবেষককে স্টেডি স্টেট কসমোলজির মতো বিতর্কিত বিষয় থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু গবেষণা শুরুর মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই নারলিকার তাঁর কাজের উৎকর্ষ প্রমাণ করেন। পরে আইনস্টাইনের সাধারণ অপেক্ষবাদের বিকল্প হিসেবে, ম্যাকের সূত্র অনুসারে মহাবিশ্বকে দেখার কাজ— যেখানে একটি রেফারেন্স ফ্রেমে ঘূর্ণায়মান বস্তুর জাড্যের উপর তার চারপাশের স্থানের চরিত্রগত প্রভাব এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিনিয়ত নতুন পদার্থ সৃষ্টির মাধ্যমে আজকের প্রসরণশীল সমসারক ব্রহ্মাণ্ডকে বোঝার চেষ্টা করেন। ১৯৬৩ সালে গবেষণাটি প্রকাশিত হয় ‘হয়েল-নারলিকার মহাকর্ষ তত্ত্ব’ হিসেবে। কিন্তু ১৯৬৫ সালে স্টিফেন হকিং এই তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা বিষয়ে বিস্তারিত লেখেন যা হয়েল-নারলিকারের তত্ত্বগুলির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৬৪ সালে আর্নো পেনজিয়াস ও রবার্ট উইলসন বেল ল্যাবে কাজ করার সময় কিছুটা আকস্মিকভাবেই কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন (CMBR) আবিষ্কার করেন। এই বিকিরণকে পরবর্তীতে স্টেডি স্টেট তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। বিগ ব্যাং-এর অবশেষ হিসেবেই CMBR প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু হয়েল এবং নারলিকারের মনে হয়েছিল, বিগ ব্যাং তত্ত্বের মধ্যে অনেক কিছুই অনুমান করে নেওয়া হয়েছে, যেখানে স্টেডি স্টেট একটি গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ডকে ব্যাখ্যা করে।
এর প্রায় তিরিশ বছর পরে, ১৯৯৩ সালে ফ্রেড হয়েল, জিওফ্রে বারবিজ ও জয়ন্ত নারলিকার মিলে একটি নতুন তত্ত্বের জন্ম দিলেন— কোয়াসি-স্টেডি স্টেট কসমোলজি, যার প্রেরণা এসেছিল তাঁদের আগের মহাকর্ষ তত্ত্ব থেকেই। কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশনকে তাঁরা এখানে ‘ক্রিয়েশন ফিল্ড’, সুপারনোভা ও নক্ষত্র থেকে নির্গত শক্তি ও ধাতব ধূলির তাপীয় অবশেষ হিসেবে দেখান, এবং তার সঠিক উষ্ণতা নির্ণয় করেন। এছাড়া, ডিউটেরিয়াম-সহ হালকা মৌলের অস্তিত্ব, দূরবর্তী ছায়াপথের রেডশিফট, বয়স, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, ডার্ক ম্যাটার ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেন এই তত্ত্বের মাধ্যমে। স্টেডি স্টেট কসমোলজির সীমাবদ্ধতাগুলি কাটিয়ে ওঠে কোয়াসি-স্টেডি স্টেট তত্ত্ব। জীবনের শেষ পর্যায় অবধি এই বিষয়ে ধারাবাহিক গবেষণা করেছেন নারলিকার।
এই বিস্তারিত ব্যাখ্যার অন্যতম কারণ জয়ন্ত নারলিকারকে চেনার চেষ্টা। প্রচলিত ধারণার বিপরীতে তৈরি একটি গাণিতিক তত্ত্বকে তিনি বিভিন্নভাবে নিরীক্ষা করেছেন, কিন্তু তা থেকে কখনও পিছিয়ে আসেননি। পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন আঙ্গিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন মহাবিশ্বের বিবর্তনের রহস্য। অর্থাৎ, একটি র্যাডিক্যাল আইডিয়ার যে যুক্তিনির্ভরতা, তা বিজ্ঞানীর বড় সম্পদ। এখান থেকেই তাঁর কথা শুরু হতে পারে। নারলিকার ছাত্র হিসেবে, গবেষক হিসেবে কেমন ছিলেন, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একজন মৌলিক চিন্তক হিসেবে তাঁর ভূমিকা।
১৯৬০-এর দশককে পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক মাইলফলক বলা যায়। রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে নিজের গবেষণার স্বপক্ষে তথ্য উপস্থাপন করার রোমাঞ্চ, হয়েলের উৎসাহে ডিসকভারি ম্যাগাজিনে প্রথম মহাকর্ষবিষয়ক প্রবন্ধ- তাঁকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সুপরিচিত করেছিল। ১৯৬৪-এর মাঝামাঝি থেকেই নারলিকারকে দেশে ফেরানোর একটি প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। তখন স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারত গড়ছেন নেহরু, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, হোমি ভাবা, বিক্রম সারাভাইয়েরা। ইসরোর ভিত্তি হিসেবে তৈরি হচ্ছে ইনকসপার, Space Science and Technology Centre।
১৯৬৫ সালে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হন জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার, তখন তিনি মাত্র ছাব্বিশ বছরের। সেই বছরই তাঁর নেতৃত্বে সারা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এক লেকচার ট্যুরের আয়োজন করে Indian Council for Cultural Relations (ICCR)। “ভারত দর্শন” নামে পরিচিত এই সফর শুরু হয় ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। দিল্লি থেকে শুরু হয়ে আমেদাবাদ, বোম্বে, হায়দরাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, মাদ্রাজ, কলকাতা, বেনারস, আগ্রা হয়ে আবার দিল্লিতে শেষ হয়। দেশের মানুষের কাছে বিজ্ঞানের মৌলিক বোঝাপড়া পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে বিজ্ঞান-জনপ্রিয়করণের এই অনন্য প্রচেষ্টা অত্যন্ত সফল হয়। সারা ভারতের শহর থেকে গ্রাম নারলিকারকে চিনতে শুরু করে। এ ছিল তাঁর নিজেরও “ভারত দর্শন”। এখানেই হয়তো তিনি তাঁর জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছিলেন, আর একজন কমিউনিকেটর হিসেবে আর পিছনে তাকাননি।
১৯৭২ সালে টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে যোগ দেন নারলিকার। ১৯৮১ সালে তিনি বিশ্বের শতাধিক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর সঙ্গে যৌথভাবে মেক্সিকোয় World Cultural Council তৈরি করেন। সেই সময় থেকেই তাঁর মধ্যে একটি নতুন ভাবনার জন্ম হয়— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীতে বিজ্ঞানচর্চার মূল ক্ষেত্র হয়ে উঠবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি।
‘A university stands for humanism, for tolerance, for reason, for the adventure of ideas and for the search of truth. It stands for the onward march of the human race towards ever higher objectives. If the universities discharge their duties adequately, then it is well within the nation and the people.’- Jawaharlal Nehru
ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (IUCAA) গড়ে তোলার মূল ভাবনাও ছিল এটি— জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সক্রিয় অংশগ্রহণ। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল বিজ্ঞান সংযোগ, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে বিজ্ঞানকে নিয়ে যাওয়া, সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে আদানপ্রদানের মাধ্যমে ও হাতে-কলমে বিজ্ঞানচর্চার মৌলিক ধারণা তৈরি করা। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান ছিল নারলিকারের পরম স্বপ্নপূরণ। আয়ুকা ভারতের স্থাপত্যেরও এক অনবদ্য নিদর্শন। প্রত্যেকটি ইমারত, তার গঠনকৌশল, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন নকশা— সব কিছু ভারত তথা বিশ্বের বিজ্ঞান ও গণিতচর্চার সাক্ষ্য বহন করে।
“Scientific temper requires us to have an open mind”— নারলিকার এটা সবসময় বলতেন। নতুন গবেষণায় উৎসাহ দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গবেষণাগারের সুবিধা অনেকটা কম, ব্যয়বহুল। ফলে অনুদান ছাড়া কাজের গতি অনেকটা ব্যাহত হয়। কোনও পূর্বধারণা নিয়ে বিজ্ঞান গবেষণা বা পর্যবেক্ষণ সম্ভব না। প্রচলিত ধারণাকে গোঁড়াভাবে সমর্থন করাও বিজ্ঞানীর কাজ হতে পারে না। তাহলে বিজ্ঞানের লক্ষ্য কী? বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনের রসদ যুগিয়ে তার দিগন্ত বিস্তার করা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হয়ে ওঠা, সাহসী ও জিজ্ঞাসু মন তৈরি করা, এবং প্রজন্মান্তরে স্বাধীন, যুক্তিনির্ভর চিন্তার উন্মেষ ঘটানো। তাঁর মুক্তচিন্তার প্রতিফলন আমরা দেখি তাঁর কল্পবিজ্ঞানের কাহিনিগুলিতে, তাঁর আত্মজীবনীতে— যা তাঁকে সাহিত্য আকাদেমি সম্মান এনে দিয়েছে। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রবক্তা হিসেবে আশির দশকে রেডিও ও টেলিভিশনে নিরলস বিজ্ঞান সংযোগ করেছেন তিনি। কার্ল সাগানের “Cosmos” অনুষ্ঠান উপস্থাপনা ছাড়াও নিজের লেখা “ব্রহ্মাণ্ড: দ্য ইউনিভার্স” নামক একটি সিরিজ তৈরি করেন। চিলড্রেনস ফিল্ম সোসাইটি অফ ইন্ডিয়ার প্রযোজনায় তাঁর লেখা কাহিনি অবলম্বনে শিশুদের বিজ্ঞানভিত্তিক ছবি “ধূমকেতু” তৈরি হয়। বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ১৯৯৬ সালে ইউনেস্কোর কলিঙ্গ পুরস্কারে সম্মানিত হন। ১৯৯৮ সালে ইসরো ও টাটা ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথভাবে পৃথিবীর স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অঞ্চলে বেলুন-পেলোডের মাধ্যমে প্রাণের নমুনা সন্ধানের একটি প্রজেক্ট শুরু করেন। ২০০১ এবং ২০০৫ সালে সাফল্যের সঙ্গে ১২ ধরনের নতুন ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পাওয়া যায়। পৃথিবীর বাইরে অথবা অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব সম্পর্কে দৃঢ় ধারণা তৈরি করে এই পর্যবেক্ষণ।
গবেষণার বহু সময় জুড়ে আমি IUCAA-র অমূল্য রসদ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছি। জয়ন্ত এবং তাঁর স্ত্রী মঙ্গলাকে দেখেছি। সামান্য আদানপ্রদান এবং কাজের সাথে পরিচিত হয়েছি। মঙ্গলা নারলিকার ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই তাঁর অবলম্বন। জয়ন্তর কথা মনে পড়লেই আয়ুকার লাইব্রেরির দোতলা, প্যানট্রির পাশের বারান্দার টেবিল-চেয়ার, ধবধবে কফি কাপ, ভাস্কর লেকচার থিয়েটার, চন্দ্রশেখর অডিটোরিয়াম, অরবিন্দ গুপ্তার অফিস মনে পড়ে। এমন একজন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ মানুষ, কিন্তু এক শিশুসুলভ উদারতা, এক অদ্ভুত শান্ত রসবোধ ছিল তাঁর। কয়েক বছর আগে বেঙ্গালুরুর ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল সায়েন্সেস-এ ডার্ক ম্যাটারের বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে “উলঙ্গ রাজা”-র উদাহরণ দিয়েছিলেন।
এক অসামান্য ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ও সংগঠক ছিলেন অধ্যাপক জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার। তাঁর অসংখ্য লেখা, পাঠ্যবই, সাক্ষাৎকার, বিজ্ঞানদর্শনের মধ্যে তিনি আগামীর স্বপ্ন রেখে গেছেন। তাঁর যত্নের প্রতিষ্ঠান বহু প্রজন্মের বিজ্ঞানচর্চার সাক্ষী থাকবে, তাঁর আপাত-অনুত্তীর্ণ তত্ত্বের মধ্যে তাঁর মেধা, উদ্যম এবং অধ্যবসায়ের ছাপ রয়ে যাবে। অসংখ্য হৃদয়ে মহাকাশের স্বপ্ন, মৌলিক বিজ্ঞানের চেতনা বপন করেছেন জয়ন্ত। ভারতের জনবিজ্ঞান আন্দোলন তাঁর কাছে চিরঋণী।