
সুমিত চৌধুরী
শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রাপ্য পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য মধুদা পরিবর্তন-এ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত করেছিল। সাংবাদিকদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করা এমনিতে খুব একটা সহজ কাজ না। কিন্তু মধুদা সহকর্মীদের আশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিল। তবে এ-কথাও ঠিক, পরবর্তীতে মধুদাকে এ-জন্য বড় বড় হাউজে কাজ করলেও একটু গোত্রছাড়া হয়ে থাকতে হয়েছিল। কোনওদিন ম্যানেজমেন্টের সুনজরে থাকেনি। পরিবর্তন-এর ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠক ছাপটা পড়ে গিয়েছিল
বিশ্বজিৎ রায় অথবা মধু। আমার থেকে প্রায় সাত-আট বছরের বড়। তাও আমি কখনও বলতাম মধু, কখনও মধুদা। মধুদা কখনও কিছু মনে করত না। একটা অমলিন হাসিতে সবসময়ই উত্তর ফিরে আসত, হ্যাঁ বল। মধুদা যখন নকশালপন্থী রাজনীতি করতে এসেছিল তখন নকশালপন্থার জোয়ারের দিন শেষ। অন্তত কলকাতায়। কিন্তু ভাঁটার টানের মুখেও কেউ কেউ উল্টোদিকে সাঁতার কাটতে যায়। মধু বা মধুদা ছিল সেইরকম একজন। বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখে দলের নির্দেশে শ্রমিক সংগঠন করতে চলে যায়। সত্যনারায়ণ সিং-এর নকশালপন্থী শ্রমিক সংগঠন ইফটুর অন্যতম সংগঠক ছিল মধুদা।
মধুদার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ যখন মধুদা পুরোদস্তুর সাংবাদিক। ১৯৮৩ সাল নাগাদ। মধুদা তখন পরিবর্তন-এ কাজ করছে। পরিবর্তন সেই সময় প্রচণ্ড জনপ্রিয় একটি পাক্ষিক। যতদূর জানি সেটাই মধুদার প্রথম পেশাদারি সাংবাদিকতা। তখন কলেজ স্ট্রিটে ছাত্রদের মধ্যে হেরোইনের প্রচণ্ড চল। ক্ষতিকর দিকগুলো তখনও অতটা প্রকাশ্যে আসেনি। আমাদের কলেজচত্বর, সংস্কৃত কলেজের পেছনের দিকে, কফি হাউজের টেবিল— সর্বোচ্চ আচমকা পাতাখোরদের উৎপাত। এদের মধ্যে অনেকে আবার একটু রাউডি টাইপের। ভালো কথায় বুঝিয়েও কোনও কাজ হচ্ছে না। ফলে মাঝেসাঝেই সামনাসামনি খুচরো মারপিট। পুলিশ দেখি উল্টে এসে আমাদেরকে বলছে তোমরা আইন নিজেদের হাতে তুলে নিচ্ছে কেন?… ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা তখন ঠিক করলাম পুলিশকেও চাপে রাখতে হবে। অগত্যা কফি হাউজের সামনে মাচা বেঁধে মিটিং। তারপরই পরিবর্তন পত্রিকা থেকে এই হেরোইনের সমস্যা নিয়ে কভার করতে কলেজ স্ট্রিটে এসেছিল মধুদা। সংস্কৃত কলেজের সামনে সিঁড়িতে প্রথম আলাপ। প্রথমে মনে হয়েছিল আপাদমস্তক ভদ্রলোক। পরে আবিষ্কার করলাম পাক্কা নকশাল।
মধুদা নকশালপন্থী পার্টি করা ছেড়ে দিয়েছিল ঠিক, কিন্তু প্রতিবাদী হওয়ার ভূত মাথা থেকে নামেনি। পরিবর্তন-এ যখন কর্মী অসন্তোষ হয়, পত্রিকা উঠে যায়, তার আগে শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রাপ্য পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার জন্য মধুদা পরিবর্তন-এ ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠিত করেছিল। সাংবাদিকদের নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করা এমনিতে খুব একটা সহজ কাজ না। কিন্তু মধুদা সহকর্মীদের আশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিল। তবে এ-কথাও ঠিক, পরবর্তীতে মধুদাকে এ-জন্য বড় বড় হাউজে কাজ করলেও একটু গোত্রছাড়া হয়ে থাকতে হয়েছিল। কোনওদিন ম্যানেজমেন্টের সুনজরে থাকেনি। ওই পরিবর্তন-এর ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠক ছাপটা পড়ে গিয়েছিল। মধুদা সাংবাদিকতার প্রয়োজনে পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে প্রাইভেটে অনার্স কমপ্লিট করে। মধুদা যে-ধরনের সাংবাদিকতা করত তাতে ওই ডিগ্রি-টিগ্রির খুব একটা দরকার ছিল না। তাও প্রতিষ্ঠানে সদর দরজা ঠেলে ঢোকার জন্য কিছু অপ্রয়োজনীয় জিনিসের দরকার হয়। এটাও সেইরকম।
মধুদা বড় বড় কাগজে কাজ করলেও কোনও জায়গাতেই খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করত না। আনন্দবাজার-টেলিগ্রাফের মধুদাকে দেখেছি দীর্ঘদিন লালবাজার বিট করতে। মানে পুলিশ বিট। পুলিশ বিট করতে করতে অনেক সাংবাদিক নিজেরাই কীরকম পুলিশ পুলিশ হয়ে যায়। কিন্তু মধুদা পুলিশ বিট করবার সময়েও মানবাধিকারের স্টোরি নিজের আগ্রহে করেছে আমার মনে আছে।
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রথম চেষ্টা থেকেই শুরু হয়। সেই যখন আদবানি রথ বার করলেন। গোটা দেশের আবহাওয়া মধুদাকে খুব উত্তেজিত করত। সব সময় চেষ্টা করত নিজের ক্ষমতামতো সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী প্রচার সংগঠিত করতে অথবা কোনও উদ্যোগে সামিল থাকতে। প্রায় তিন দশক ধরে এরকম অজস্র উদ্যোগের মূল উদ্যোগপতি ছিল মধুদা।
এপিডিআর-এর দীর্ঘদিনের পুরনো সংগঠক ছিল মধুদা। যতদূর মনে পড়ে একবার এপিডিআরের সাইকেল র্যালিতে মধুদা প্রচণ্ড খেটেছিল।
এখন সাংবাদিকতায় পড়াশোনা না করলেও কর্তাভজা সম্প্রদায়ে নাম লিখিয়ে অনায়াসে চলে যায়। কিন্তু মধুদা নিজের মনের ক্ষিদের তাগিদে প্রচুর পড়াশোনা করত। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পড়াশোনা এবং লেখালেখিতেই দিন কাটিয়েছে।
তবে মধুদা ভেতরে ভেতরে খুব অভিমানী ছিল। অনেক সময় বাস্তবের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারত না। প্রভাবশালী কণ্ঠের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য মঞ্চে অপ্রিয় সত্য বলে অপ্রিয়তর হয়েছে। তবু আপস করেনি। জীবনের শেষদিকে কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনে আশ্রয় খুঁজে ছিল। কতটা কী পেয়েছিল জানি না।
মধুদা যেদিন মারা যায় আমি কলকাতার বাইরে ছিলাম।
মধুদার শেষ যাত্রায় কেউ মধুদাকে একটা লাল পতাকায় ঢেকে দেয়নি।
আমি নিশ্চিত মধুদা যদি এটা জানতে পারত আমাদের সকলের উপর অভিমান করত।