অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়
ক্ষেত্রে অবস্থিতকরণ
ধুমজ্বরের মতো প্রায় এক নিঃশ্বাসে বইটি পড়তে পড়তে কানের মধ্যে সমানে বেজে যাচ্ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ভবানী সেনগুপ্ত ওরফে ঔপন্যাসিক চাণক্য সেনের এই আশ্চর্য কথাগুলি:
ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে বাংলা সবচেয়ে বেশি ‘politically radical’ হলেও, তার সাহিত্যে রাজনৈতিক উপন্যাস এখনও ‘adult literary personality’ পায়নি, বাঙালি নাট্যকার এবং কবির তুলনায় বাঙালি ঔপন্যাসিক ‘far less politically sensitive’।[1]
বাংলা উপন্যাসে এই রাজনৈতিক খরার মধ্যে গুপ্ত নিজের ছদ্মনামে লেখা রাজপথ জনপথ, মুখ্যমন্ত্রী ইত্যাদি ছাড়া আর কিছুই নাম করার মতো পাননি— বোধহয়, নাম না করলেও যুধাজিত তথা বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের লেখা খাদ্যমন্ত্রী ছাড়া। বাংলার বাইরে তাঁর হয়তো-বা পছন্দ হত চতুর্সেন শাস্ত্রীর বগুলে কে পঙ্খ— যেখানে কংগ্রেস সাংসদ এবং পরে জাতীয় সরকারে বাণিজ্যমন্ত্রী বনে যাওয়া জুগ্নুর ভণ্ডামি, সুযোগসন্ধান, যে-কোনও মূল্যে ও উপায়ে ক্ষমতার্জন ছাড়াও বিভিন্ন দলের নির্বাচনী কৌশল এবং রাজনৈতিক প্রচারকৌশলের ব্যঙ্গাত্মক আখ্যান আছে। সেখানে তিনি এক চরিত্রকে দিয়ে বলালেন:
ব্রিটিশ রাজ চলে গেছে। কংগ্রেস তার জায়গা নিয়েছে, কিন্তু ঐতিহ্যগুলি অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। আমাদের ইংরেজ অফিসারের জায়গায় একজন কংগ্রেসি মন্ত্রী এখন সুযোগ্য ও দক্ষ কর্মচারীদের মনিব। কংগ্রেস দলের মন্ত্রীর সঙ্গে তফাৎ নেই বললেই চলে। ইংরেজ অফিসারের চামড়া সাদা, কিন্তু পরতেন কালো স্যুট। কংগ্রেসি মন্ত্রীর চামড়া কালো, কিন্তু পরেন সাদা খদ্দরের শেরওয়ানি। তিনি নিজের অফিস সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, কিন্তু (সরকারের) কাজ এগিয়ে চলে। তাঁকে কেবল কাগজ সই করতে হয় আর তিনি সেটা একটা দামি পেন দিয়ে করেন। যিনি [রাষ্ট্রকৃত্যকীয় আমলা] তাঁর অফিসের প্রধান, তিনি জানেন যে তিনি [মন্ত্রী] একটা রামগাধা।[2]
অথবা, গুপ্তর হয়তো পছন্দ হত অনন্ত গোপাল শেওয়াডের ভগন মন্দির (ভগ্ন/ধ্বস্ত মন্দির, ১৯৬০), বগুলে কা পঙ্খ-এর মতোই যেটি রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নৈতিক অধঃপতনের বৃত্তান্ত বলে, নেহরুর সমাজতন্ত্রী স্বপ্নের অধঃখননের প্রসঙ্গে।[3] কারণ, আমার মনে হয়— কোনও রেজিমের প্রত্যক্ষ বৃত্তান্ত ছাড়া অপ্রত্যক্ষ কিছুকে তিনি রাজনৈতিক বলতে রাজি নন। অথচ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের এই অপ্রত্যক্ষতার অভাব সম্পর্কে লিখেছিলেন—
“বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক উপন্যাসের অতি-প্রাদুর্ভাবের একটা ফল হয়েছে যে এতে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মধ্যে সীমারেখা অস্পষ্ট ও বিলুপ্তপ্রায় হয়ে উঠেছে। উপন্যাস যেন প্রাত্যহিক ঘটনার দিনলিপিতে পর্যবসিত হতে চলেছে। সংবাদপত্রের স্তম্ভে যে আবেগময় নিবন্ধ রচিত হয়, যে রকম আলোচনা প্রসার লাভ করে, সাহিত্যে তাই অকিঞ্চিতকর পরিবর্তনের সঙ্গে ঔপন্যাসিক চরিত্রের সংলাপ ও মনোবিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিবেশিত হচ্ছে। সাংবাদিকের নৈর্ব্যক্তিকতা ঔপন্যাসিকের ব্যক্তি-চরিত্র বিশ্লেষণের অক্ষম প্রয়াসে প্রায় অপরিবর্তিত থাকছে।”[4]
তৃষ্ণা বসাকের এই বইটি পড়লে গুপ্তর কী মনে হত, তা অনুমান করারও ক্ষমতা আমার নেই। কারণ, এক তো সেন দেখতেই পাননি যে বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক উপন্যাস অগুন্তি। তার সম্ভারে এক খামচা দিলেই, এক এক মুঠোয় উঠে আসবে বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক ফিকশন— তাদের ‘inclusion’ আর ‘exclusion’, উভয় কারণেই। বঙ্কিমের আনন্দমঠ, রবীন্দ্রনাথের গোরা, ঘরে বাইরে কিংবা চার অধ্যায় উপন্যাস কেবল দেশ ও রাষ্ট্রভাবনার কারণেই রাজনৈতিক নয়, শ্রেণিগত ‘exclusion’-এর কারণেও রাজনৈতিক উপন্যাস। তারাশঙ্করের গণদেবতা চণ্ডীমণ্ডপ, গণদেবতা পঞ্চগ্রাম থেকে শুরু করে প্রচুর লেখাই, উপন্যাস তো বটেই, এমনকি জলসাঘর-এর মতো গল্পও রাঢ়বঙ্গের স্থানিক প্রেক্ষাপটে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সামন্ততন্ত্র ও বাণিজ্যিক পুঁজিবাদের লড়াইয়ের দলিল। সেখানেও ‘inclusion’ আর ‘exclusion’-এর খেলা ও তার বিরুদ্ধে লড়াই চলছে।
আবার, বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা যে বঙ্গবিভাজন তা নিয়ে যে-স্তরের সাহিত্য লেখা উচিত ছিল, তা লেখা হয়নি। কিন্তু যতখানি লেখা হয়েছে, তাও exclusionary— অতীব গরিষ্ঠাংশ ভদ্রলোকের কথা, মধ্যশ্রেণির ‘আমাদের’ কথা। উদাহরণ, সাবিত্রী রায়ের ১৯৪৬-১৯৫১-র মধ্যে লেখা স্বরলিপি (১৯৫২)[5]— যার চরিত্ররা কেবল কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গেরই বাসিন্দা নয়, সেই সময়ের পূর্ব-পাকিস্তানেরও বটে। যদিও এই এককালে কমিউনিস্ট লেখিকার আটটি উপন্যাসের মধ্যেই গরিব মানুষের কথা আছে, স্বরলিপি উপন্যাসে তো দুই বাংলাতেই কৃষক আন্দোলনের অনুষঙ্গে হাজং বিদ্রোহের কথাও রয়েছে।
এরকম উপন্যাস আরও অনেক আছে। আছে জীবনানন্দের জলপাইহাটি (১৯৪৮)[6]— দেশভাগের সময়ে জলপাইহাট নামের এক অঞ্চলকে নিয়ে এক প্রতীকী, কাব্যিক ভাষার মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। নারায়ণ সান্যালের বকুলতলা পি.এল. ক্যাম্প (১৯৫৫) ও বল্মীক (১৯৫৮)— দুটিতেই আছে বাধ্য হয়ে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের জীবনযাপনের ছবি। বল্মীক-এ আছে মতিগঞ্জের বাসিন্দা হরিপদ চক্রবর্তীর চোখ দিয়ে দেখা ক্যাম্পবাসীদের দুঃখ-কষ্ট।[7] এছাড়া উল্লেখ্য অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে (১৯৭১)[8], সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অর্জুন (১৯৭১) ও পূর্ব ও পশ্চিম (১৩৯৫/১৯৮৮)[9], শঙ্খ ঘোষের কাব্যিক গদ্যের উপন্যাস সুপুরিবনের সারি (১৩৯৭/১৯৯০)[10], অমিতাভ ঘোষের The Shadow Lines (১৯৮৮)[11], অভিজিৎ সেনের স্বপ্ন ও অন্যান্য নীলিমা (২০০২)[12], শান্তা সেনের পিতামহী (২০০৯)[13]।
এই সব উপন্যাস ছাড়াও আছে জ্যোতির্ময়ী দেবী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, দিনেশচন্দ্র রায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবেশ রায় প্রমুখের অজস্র ছোটগল্প। এগুলিও এই ‘exclusion’-এর কারণেই রাজনৈতিক। আবার, এগুলির মধ্যেও ‘inclusion’-এর সাহিত্য আছে। তাদের অধিকাংশের উপজীব্য— প্রথমে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের ভারতে আগমনে নিরাশ্রয় বোধ করার ফলে মুরুব্বিহারা যে নমঃশূদ্র এবং অন্যান্য লক্ষ লক্ষ তফসিলভুক্ত হিন্দু উঁচু জাতের ভদ্রলোকশ্রেণির বাঙালির/মানুষের মতো কলকাতার উত্তরে বরানগরে বা দমদমায় কিংবা দক্ষিণে জবরদখল কলোনিতে জায়গা পায়নি তারা। প্রথমে শেয়ালদা বা অন্যান্য রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে ধুবুলিয়া-রানাঘাটের মতো ক্যাম্প হয়ে ডোল বন্ধ হওয়ার চাপে তরাইয়ের বন, আন্দামান, দণ্ডকারণ্য-মালকানগিরি অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হয়।[14] তাদের নিয়ে লেখা বলতে, আন্দামান-প্রসঙ্গে প্রফুল্ল রায়ের নোনা জল মিঠে মাটি উপন্যাস[15]; দণ্ডকারণ্য-মালকানগিরির অসহনীয় পাথুরে জীবনের কষ্টের প্রসঙ্গে নারায়ণ সান্যালের অরণ্যদণ্ডক[16]; আর অনেক পরে সেখান থেকে অভ্যস্ত নদীজলের জীবনের আশায় সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে উপনিবেশ গড়ে তোলা মানুষদের সহিংস উৎখাত নিয়ে লেখা অমিতাভ ঘোষের Hungry Tide[17]।
নোনা জল মিঠে মাটি-তে রায় বলছেন— ‘এবার আর এক অঙ্ক, অন্য এক দৃশ্য। এবার আর কয়েদি নয়, জাহাজ বোঝাই হয়ে পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুরা এসেছে।’ তাদের মধ্যে নিত্য ঢালী, রসিক শীল, বুড়ি বাসিনী, মহিন্দর সোনা ইত্যাদিরা কালাপানি পেরিয়ে জঙ্গলের ভয়, মাটির টান আর উপযুক্ত সাজসরঞ্জামের অভাবে মাটির চাষযোগ্যতার অসম্ভাব্যতা— এই ত্রিফলায় ছিঁড়ে খানখান হয়ে যাচ্ছে।[18]
এগুলি বাদে অধিকাংশেই বধির করা নীরবতা, আর সেটাও রাজনৈতিক। তাদের দেখতেই পেলেন না রাজনীতিজ্ঞ সাহিত্যিক সেনগুপ্ত, তথা গুপ্ত! বোধহয়, ক্যাবিনেট ডিপ্লোমেসি ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে লেখা উপন্যাসকে তিনি রাজনৈতিক ভাবেনই না!
নইলে গুপ্ত বুঝতেন যে বাংলা সাহিত্যে তাঁর পছন্দের অপ্রত্যক্ষ রাজনৈতিক উপন্যাসেরই অনেক ভাগ। ১৯৫০-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার কলোনিজীবন ও পুঁজিবাদীদের সৃষ্ট সমস্যা নিয়ে লেখা সমরেশ বসুর বি. টি. রোডের ধারে উপন্যাসে; ১৯৫৩ সালের খাদ্য সংকটের পটভূমিতে রচিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেরিওলা গল্পগ্রন্থের ‘ফেরিওলা’[19]; ‘এসমালগার’, ‘জলসা’ ইত্যাদি গল্পে প্রশাসনের সাহায্যে মালিকশ্রেণি কী ঘৃণ্য কৌশলে শ্রমিকদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালায় সে-বিষয়ে সমরেশ বসুর গল্প; বা ‘জোয়ার ভাঁটা’ ও ‘উজান’ গল্পে কর্মহীনতায় শ্রমিকের অস্তিত্বের সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে সমরেশের লেখা কখনওই সমসাময়িক রেজিমের প্রত্যক্ষ সমালোচনায় বা বিশ্লেষণে নামেনি। আমি অনেক পরের যুগ যুগ জিয়ে (১৯৮১)[20] বা শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে (১৯৮৪)[21]-র কথা এখানে ছেড়েই দিলাম।
তেমনিই, ১৯৬৭ সালের চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনের পরে, কংগ্রেস সিস্টেম এবং তার ‘কম্যান্ড পলিটিক্স’ ভেঙে গিয়ে সারা ভারতে ‘ডিম্যান্ড পলিটিক্স’-এর[22] আবহে, পশ্চিমবঙ্গে ১৯৬৭–৭২ পর্যন্ত যে সামাজিক গণতান্ত্রিক টালমাটাল এসেছিল, ভূমিসংস্কারের সীমিত প্রচেষ্টার সূত্র ধরে, তাকে যখন ১৯৭২–১৯৭৭ কালপর্বে নতুন সরকার বা রেজিমের মোড়কে ভূস্বামী–বুর্জোয়া আঁতাতের সাহায্যে নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তখন ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্টের আবির্ভাবের সুযোগ নিয়ে, ১৯৬৭–৭২ পর্বে পশ্চিমবঙ্গে গরিবপন্থী সমাজবদলের আশা-নিরাশার প্রসঙ্গে বামপন্থী প্রগতি সাহিত্যধারার লেখাগুলিতে অত্যাচারের যে বিবরণ তুলে দেওয়া হয়, তাতেও এই প্রত্যক্ষতা নেই।
আমি এঁদের কথা বলার সময় মনে রাখছি, যে তাঁদেরকে পড়ার সম্ভাবনা সেন বা গুপ্তর ছিল না। এঁরা অনেক পরের। কিছু লেখকের বইয়ের সালতামামি মনে আছে, কিছুর নেই। সেগুলো প্রকাশকের নাম ছাড়াই দিচ্ছি। নইলে গ্রন্থসূত্র কণ্টকিত হয়ে যাবে। যেমন:
- তপোবিজয় ঘোষ: রাত জাগার পালা (১৯৬৪), সামনে লড়াই (১৯৭০), দহন দাহন, কালচেতনার গল্প (১৯৯০)।
- সুখরঞ্জন মান্না: নরক।
- কৃষ্ণ চক্রবর্তী: অমানবিক (সত্তরের দশকের দ্বিতীয় জরুরি অবস্থায় নরক উপন্যাসের সঙ্গে নিষিদ্ধ); আশির দশকে প্রকাশিত— চোরাবালি, জন্মভূমি, যে মাটি সোনা হবে, পা-টা নামিয়ে বসুন; গল্প: ‘তুলসী’, ‘লৌকিক থেকে অলৌকিক’।
- গুণময় মান্না: গল্প: ‘এখন যুদ্ধ শুরু’, ‘ঘৃণা’, ‘সালতি’; উপন্যাস: অসামাজিক (১৯৭২)।
- কার্ত্তিক লাহিড়ী: যাওয়া (১৯৭৮), আমিষাশী তরবার (১৯৮২), রক্তবীজ (১৯৯৩), অন্তরীণ (২০০১), স্বেচ্ছামৃত্যু (২০০৮), লালফিতের গেরো (২০১০)।
- বিষ্ণু চক্রবর্তী: অতলে অন্তরীণ।
- মণি মুখোপাধ্যায়: নিতাই চরিত মানস, চেনা মানুষের গল্প।
- দেবদত্ত রায়: ‘ময়নার সুখদুঃখ’, ঠিকানা।
- সাধন চট্টোপাধ্যায়: পানিহাটা, অগ্নিদগ্ধ (১৯৭০), গহিন গাঙ (১৯৮০), মাটি ও মানুষ (১৯৮২), পিতৃভূমি (১৯৮৫), পক্ষ বিপক্ষ (১৯৮৮), তেঁতুল পাতার ঝোল (১৯৯৫), জলতিমির (১৯৯৮), মাটির অ্যান্টেনা (২০০০), গুল্মলতার ইলেকট্রন (২০০২)।
- রামরমণ ভট্টাচার্য: কুরুক্ষেত্র।
- কেয়া চট্টোপাধ্যায়: পৃথিবীর এদিক ওদিক।
- কৌণিক সেন: আলোর সহোদর।
- সুভাষ চন্দ্র গুহ: আততায়ী।
- রাম শঙ্কর চৌধুরী: বেড়া।
- চিত্ত ঘোষাল: উপন্যাস: বৃহন্নলা সুরভির প্রেমকথা, ওরা চারজন, ঘোড়সওয়ার, প্যানাসিয়া, যে বুড়োটা উড়ুক্কু গণ্ডার বানাতে চেয়েছিল, বিশ (২০০১), ছোটগল্প: ‘কৃষ’, ‘ক্ষুধা’, ‘একটি বৃহৎ ভোজন ব্যাপার’, ‘অপকর্মে অনিলবাবু’, ‘শিবু মস্তানের উপাখ্যান’।
- বারিদবরণ চক্রবর্তী: হ্রেষা।
- সমীর রক্ষিত: স্বপ্নের কোলাহল।
- অমলেন্দু চক্তবর্তী: গোষ্ঠবিহারীর জীবনযাত্রা।
- অমর মিত্র: মাঠ ভাঙে কালপুরুষ।
- শংকর বসু: কপিলের মুলুক যাত্রা, ভূঃ, বাদার গল্প।
- রবি সেন: ঠাকুমার শতবার্ষিকী ও ফাঁসির দড়ি।
এঁদের সকলের, আর অনুল্লিখিত অন্যদের কথা মনে রেখে বলছি— এখানে সর্বত্রই আছে একটি metonymic খণ্ডচিত্র। কিন্তু এই বামসাহিত্য স্লোগানধর্মী ও আত্মসমালোচনাহীন হওয়া ছাড়াও এর মধ্যে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সরকারের রেজিম অ্যানালিসিস নেই, নেই ঘটনঘটনপটীয়ান অদ্ভুতকর্মা কোনও মুখ্যমন্ত্রী বা খাদ্যমন্ত্রীর লড়াইয়ের বিবরণ। গুপ্ত এদের তাই হয়তো রাজনৈতিক বলতেন না।
এগুলি ছাড়াও, রাজনৈতিক বিষয়বৈচিত্র্যে বাংলা ফিকশনের তুলনা নেই। ১৯৫০ থেকে ২০০০ সালাবধি পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বামপন্থার প্রভাব ও তার বদল এবং আত্মসমালোচনার জন্য আমি প্রথমে তাকাই অসীম রায়ের কটি কৃশকায় গল্পের দিকে। এদের মধ্যে আছে স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনের সময়েই ব্যক্তিসত্তার অঙ্গনে তার স্থূল হস্তাবলেপের ইঙ্গিত (‘প্রেমের হাল কে বোঝে শালা’, ‘অবনীভূষণ-চাটুজ্জে-সুষমা’); যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের সময়েই কমিউনিস্ট কর্মীদের আশা-আশঙ্কার দোলাচল (‘আরম্ভের রাত’, ১৯৬৮); এছাড়াও ‘অনি’, ‘ধোঁয়া-ধুলো-নক্ষত্র’, ‘শ্রেণীশত্রু’, ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’ ইত্যাদি।[23]
আবার সত্তরের দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যে মহাশ্বেতা দেবী, দেবেশ রায়, অভিজিৎ সেন, সাধন চট্টোপাধ্যায়, ভগীরথ মিশ্র ইত্যাদিরা বেশ কিছু উপন্যাস লেখেন, যেগুলিতে নিম্নবর্গীয় চেতনার, স্বাধীনতা পরবর্তী উত্তর-ঔপনিবেশিক মোহভঙ্গের কথা আছে। কিন্তু নিম্নবর্গের মানুষদের— Michael Hechter কথিত— internal colonialism-প্রতিম আর্থ-সামাজিক শোষণ-পীড়নের কথা বলার সময়েও সত্তরের দশকের পরের সাহিত্য গুপ্তর সম্ভাব্য মনঃপীড়া ঘটিয়ে সমসাময়িক রাজনৈতিক রেজিমের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বা কমেন্টারি কম করেছে। মহাশ্বেতা দেবীর এই সময়কার লেখাগুলির কথা যদি ধরি— যেমন কবি বন্দঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু (১৯৬৭), অরণ্যের অধিকার (১৯৮৪), চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর (১৯৮২)— এমনকি তাঁদের পক্ষেও এই কথা প্রযোজ্য।
প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে লেখা বাংলা রাজনৈতিক উপন্যাসে একটি বড় উপজীব্য ছিল, এই কারণেই যে তাঁরা মূলপ্রবাহের সাহিত্যে উপেক্ষিত। তাঁদের নিয়েই লেখা দেবেশ রায়ের বহু উপন্যাস, যেমন: যযাতি (১৯৭৩), শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে (১৯৭৩), মানুষ খুন করে কেন (১৯৭৬); প্রতিবেদন ও বৃত্তান্ত সিরিজে মফস্বলি বৃত্তান্ত (১৯৮০), তিস্তাপারের বৃত্তান্ত (১৯৮৮), আত্মীয় বৃত্তান্ত (১৯৯০), খরার প্রতিবেদন (১৯৯৩), সময়-অসময়ের বৃত্তান্ত (১৯৯৩), দাঙ্গার প্রতিবেদন (১৯৯৪), ইচ্ছামৃত্যুর প্রতিবেদন (১৯৯৫), শিল্পায়নের প্রতিবেদন (১৯৯৬) ইত্যাদি। অভিজিৎ সেনের বর্গক্ষেত্র (১৯৮১), রহু চণ্ডালের হাড় (১৯৮৫), ছায়ার পাখি (১৯৯৩), আঁধার মহিষ (১৯৯৩) ইত্যাদি অসাধারণ উপন্যাসেও প্রান্তিক মানুষের অসহায়তার মরমি বর্ণনায় রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক সমাজ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ কথা নেই। এমনকি সুবিমল মিশ্র তাঁর ‘অ্যান্টি-গল্পে’ বহুলোকের শোষণে-অত্যাচারে, সম্ভোগে-আদরে শেষে গলায় দড়ি দিতে বাধ্য হওয়া এক তরুণীর প্রসঙ্গে/অনুষঙ্গে গান্ধিবিগ্রহের যে স্থাপন/প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছেন তাতে রাষ্ট্র, সরকার, রেজিম অ্যানালিসিস— সবই সেই ঘটনার আলোকে আলোকিত হয়ে ওঠে।[24]
এই প্রান্তিক মানুষের গল্প বলায় পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যে তথাকথিত দক্ষিণপন্থী লেখকদের অবদানও কম নয়। প্রথমেই উল্লেখযোগ্য, পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদতরণী, হা হা গল্পগ্রন্থটির অনেক কালজয়ী গল্পের, যেমন— ‘হঠাৎ জোয়ার’, ‘আরশোলা’, ‘যাহা যায়’, ‘পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদতরণী, হা হা’, ‘তলিয়ে যাবার আগে’— লেখক এবং রূপদর্শী নামে একাধিক রঙ্গব্যঙ্গ, যেমন— ‘জ্যোতি রাজা প্রমোদ মন্ত্রী’, ‘কলকাতা ৭৩’, ‘ওফ্, আজ যদি প্রমোদ দা থাকতেন’, ‘পশ্চিমবঙ্গের মর্মপীড়া’ (ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২) ইত্যাদির লেখক গৌরকিশোর ঘোষ। কিন্তু বামপন্থী সাহিত্য লেখার রাজনীতি বা লেখকের রাজনীতি— কোনও দিক থেকেই— অবিভক্ত বাংলায় এবং খণ্ডিত পশ্চিমবাংলায় সাধারণ মুসলিম নাগরিকদের দুঃখদুর্দশার বাণীরূপ দেওয়া আর জল পড়ে পাতা নড়ে, প্রেম নেই, বা প্রতিবেশীর লেখক, এবং ১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থার সন্নিষ্ঠ, জোরালো প্রতিবাদী কণ্ঠ গৌরকিশোর ঘোষকে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার প্রতীক বলে ফেলে দেওয়া চলে না। রূপদর্শী সমগ্র-র দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় গৌতম ভদ্র লিখেছিলেন—
“‘প্রেম নেই’-এর লেখক গ্রাম জানতেন, কিন্তু সমসাময়িক বাংলা তথা ভারতের উপর সংবাদভাষ্যে গ্রাম প্রান্তেবাসী। মার্কসবাদী বা কংগ্রেসি সন্ত্রাস, জরুরি অবস্থা, খাদ্যসংকট, জঙ্গিবাদী রাষ্ট্র, মৌলবাদ, সংহতি, দাঙ্গা— নানা বিষয়ে তাঁর ভাষ্যে যে লোকটার অস্বস্তি, আশা ও আশাভঙ্গের কথা ফুটে উঠেছে, সেই লোকটা ছাপোষা সাধারণ গৃহস্থ, বুদ্ধি আছে কিন্তু সাহস কম, গণতন্ত্রের কাছে সে এক চিলতে নিরাপত্তা ও একটু সম্মান চায়।”[25]
ফলে বাংলা রাজনৈতিক উপন্যাসের এই বিস্তৃত অঙ্গনে বিপন্ন অদীক্ষিত পাঠক আমি— কী করে মেলাই ভগীরথ মিশ্রের তস্কর-এ বামশাসন ও জরুরি অবস্থার চিত্রায়নের সঙ্গে জরুরি অবস্থার প্রতিবাদী গৌরকিশোর ঘোষের পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদতরণী, হা হা গল্পগ্রন্থটিতে ১৯৬৭–৭১ কালে বামশাসনে কলকাতার চিত্রায়নকে? কিংবা তস্কর-এ বামশাসনের চিত্রায়নের সঙ্গে সমরেশ বসুর তিন পুরুষ (১৯৮৬) ও শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে (১৯৮৪) উপন্যাসের আখ্যানকে? প্রথমটিতে আছে— গান্ধিবাদী প্রথম পুরুষের পরে মার্কসবাদী দ্বিতীয় পুরুষের হাতে তাঁর এককালের অনুগামী মার্কসবাদী হয়েও তৃতীয় পুরুষের নিগ্রহের কথা। দ্বিতীয় উপন্যাসটিতে আছে— শ্রমিকের ঘর থেকে উঠে আসা শ্রমিকনেতা নওয়াল আগারিয়ার পার্টি সম্পর্কে মোহভঙ্গের কথা।
শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে উপন্যাসের সঙ্গে সমরেশ বসুর প্রিয় বন্ধু গৌরকিশোর ঘোষের সাগিনা মাহাতো গল্পটির যে কী গভীর মিল! পার্টিজান সাহিত্যের দ্বিমেরুকরণে আমার এই জ্বালা।
এবার আলোচ্য উপন্যাসটি
উপরের এই কথাগুলিই আমার আবার মনে এল তৃষ্ণা বসাক-এর অজিত সিং বনাম অজিত সিং উপন্যাসটি পড়ে। পড়ে আমার অবস্থা হল তাৎমাটুলির মেথরদের মতো—
“মূরতটাকে” নিয়ে মহাবিপদ। এখন কী করা যায় ওটাকে নিয়ে। এমনভাবে মূরতের দর্শন পাওয়া গিয়েছে। রামসীতার পাশে যদি রাখতে না পারা যায়, তাহলে? “থানেই” বা “গোঁসাইয়ের” পাশে কী করে রাখা যাবে?[26]
বাংলার মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনে কংগ্রেসের আনা centrist consensus[27]-এর অবক্ষয়ের এবং সংসদীয়-অসংসদীয় বামপন্থার আহ্বান, আগমন, আশ্বাস ও ক্ষয়িষ্ণুতার গল্প বলা অসংখ্য রাজনৈতিক উপন্যাসের ‘রামসীতা’ বা ‘গোঁসাইয়ের’ থানের চেয়ে ভীষণই আলাদা এই সাতান্নটি অধ্যায়ে বিধৃত, একুশটি প্রধান ও অপ্রধান চরিত্রের অভিজ্ঞতাবর্ণনের ভিত্তিতে গঠিত এই বইয়ের কাহিনি। তার উপজীব্য মোটামুটি আগের শতকের আশির দশকের থেকে শুরু হওয়া অব-আদর্শতাত্ত্বিকায়নের থেকে এই একুশ শতকের প্রথম দশক থেকে শুরু হয়ে তৃতীয় দশকের গোড়া পর্যন্ত চলা এক অনাদর্শিকায়নের অনুষঙ্গে বহুচর্চিত Bengali exceptionalism-এর রাংতা খসার গল্প।[28] এমনকি বাঙালিদের অবজ্ঞাস্থল ‘অবাঙালি’, কিন্তু পশ্চিমবাংলায় রাজ্যপাট বসানো অজিত সিং-এর চোখেও।
এই রাংতা খসার একটা দিক বাঙালির বিপ্লবিয়ানার অবসান। এদের ভিত্তি-চরিত্রগুলির মধ্যে অনেক কটির এপিফ্যানি[29]; এবং অ্যাপোক্যালিপ্স[30]।
সাদা বাংলায়, গল্পটা প্রথমত পশ্চিমবঙ্গের বাম-মূল জমানায় বিহারি ফোর্থ ক্লাস স্টাফ, চোখে বাঙালির মেধার মায়াঞ্জন মাখা দাদাজির নাতি অজিত সিং-এর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সম্ভবত যাদবপুর) কিং-মেকার হয়ে ওঠার এবং ক্রূর জ্যোতিষী ভবানী শাস্ত্রীর স্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপসী রেজিস্ট্রার মোহরমালা ধরের শয্যাসঙ্গী হয়ে ওঠার সঙ্গে সলিলসমাধি অবধি ক্রমাগত উত্থানের গল্প।
দ্বিতীয়ত, এই উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকারের আদর্শগত পতন ও পরের আদর্শহীন সরকারের উত্থানের প্রেক্ষিতে স্বজনপোষণ ও clientelism–এর আবহে যে সমস্ত মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে, তাঁদের কাহিনি।
তাদের মধ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যুজ্জ্বল ছাত্রী দোলনচাঁপা বক্সী বারিক এবং তাঁর ভ্রষ্ট স্বামী প্রদীপ্তকুমার বারিক। এছাড়া মূলত অজিত সিং, মোহরমালা, ভবানী শাস্ত্রী, দোলনচাঁপা, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী, কিছু সুপারি কিলার এবং বাম আমলে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া কিন্তু আসলে আত্মগোপন করে থাকা অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অফিসার শতরূপা ব্যানার্জি, যিনি পশ্চিমবঙ্গকে তার অধুনান্তন politics of banality[31] থেকে উদ্ধার করতে চান তাদের নিয়েও লেখা তৃষ্ণা বসাকের এই মহাগ্রন্থটি। গল্পের শেষে স্বাভাবিকভাবেই শতরূপার কাজ অসমাপ্ত রয়ে গেছে। লেখক বোধহয় তার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন এই পতনকাহিনির পাঠকদের।
বইটির চরিত্রগুলির এবং তাদের ‘এপিফ্যানি’ আর অ্যাপোক্যালিপ্সগুলির একটি গ্রাফ নিচে দিলাম। জানি, বাংলা ভাষার দীক্ষিত সমালোচকরা দেন না। কিন্তু আমি অদীক্ষিত, আর আমার আদর্শ এক্ষেত্রে জেমস জয়েসের মহাগ্রন্থ ইউলিসিস-এর দুটি মহাটীকা— একটি তাঁর বন্ধু কার্লো লিনাটিকে দেওয়া Linati Schema[32], আর একটি তাঁর মিত্র, ভক্ত ও পরিচায়ক স্টুয়ার্ট গিলবার্ট-এর দেওয়া Gilbert Schema[33]। সেগুলির চেয়ে এটির চরিত্র অবশ্য আলাদা। এটি চরিত্রদের নাম, পরিচয়, উপন্যাসে তাঁদের গুরুত্ব, স্বপ্নভঙ্গ ও ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’-র মতো সত্যদর্শনের উপর জোর দিয়েছে। সেটি আমি নিচে উপন্যাসটির সংস্থানিক বিশ্লেষণ হিসেবে দেখাচ্ছি।
| সূচক চরিত্র অধ্যায় পৃষ্ঠাসংখ্যা শতাংশে পুস্তকপরিধি |
এপিফ্যানি আমার মন্তব্য (যেখানে প্রয়োজন) |
অ্যাপোক্যালিপ্স আমার মন্তব্য (যেখানে প্রয়োজন) |
| অজিত সিং। উপন্যাসের নামচরিত্র; বিহার থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোর্থ ক্লাস স্টাফ, বাঙালি মণীষার একনিষ্ঠ ভক্ত ‘দাদাজির’ নাতি; পরে রাজনৈতিক মস্তান; দুর্নীতি সিন্ডিকেটের (কোম্পানি) প্রধান, কিংমেকার; বাঙালি অনন্যতার মোহগ্রস্ত/মোহভঙ্গে আহত যুগবিবেক; প্রোফেসর ডঃ বক্সীর বালিকা কন্যা দোলনচাঁপার প্রতি মোহ কাটাতে না পারা দূরপ্রেমিক; পরে না জেনে দোলনচাঁপার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পাওয়ার অন্তরায়, এবং তা জেনেই ধ্বস্ত।
১-২, ৭, ১৬, ২৯, ৪০, ৫৩, ৫৫, ৫৭। ৯-১৫ ৩০-৩৪, ৭৯-৮৫, ১৬৪-৭০, ২৩৭-৪৪, ৩২৯-৩৬, ৩৪২-৪৮, ৩৫৮-৬৫, ৩৬৭-৬৮ = ৫৯। ১৬.০৩ শতাংশ। |
১। ‘নীল আর গোলাপি ফুল ফুল ছাপ জামা পরা, বুকের কাছে আবার একটা হলুদ প্রজাপতি’, খাতা-পেনসিল হাতে, ডঃ বক্সীর মেয়ে, (পৃঃ ১২) তার প্রাণের বালিকা-প্রতিমাটিই পিকেবির স্ত্রী, ইন্টারভিউ-ধর্ষণের শিকার, নিরুদ্দিষ্ট দোলনচাঁপা (পৃঃ ৩৪২-৪৬)।
২ক। একসময় ‘দুনিয়ার সব ডাক্তার, প্রফেসর, অফসর, রাইটার সবাই বঙ্গালি’ (পৃঃ ৮৫)। ২খ। ‘আর দাদাজি যেমন সব বাঙালির কথা বলেছিল, যারা নিজেদের আদর্শের জন্য জান বাজি রাখতে পারে, তেমন বাঙালি ওর নজরেই আসেনি … সেই ইমানদার লম্বা বাঙালি দেখেছে কি কোথাও অজিত? তাহলে কি পেছনের কয়েক দশক ধরে, হয়তো আজাদির পর থেকে মড়ক লেগে উঁচু মানুষরা হারিয়ে গেছে, পড়ে আছে শুধু বেঁটে ফোঁপরা মানুষ? যারা আর নতুন কিছুই তৈরি করে না, শুধু ইমারত বানায়, শুধু তোলা তুলে খায়, তবু তার মধ্যে তার তিতলি ছিল (পৃঃ ৩৪৩)। |
‘…গাড়ি ব্যাক করতে গিয়ে একদম বমকে গেল পটা। শুধু গরু আর গরু। এত গরু এল কোত্থেকে? আবার এত রাতে চারদিকে এত গমগমে শহর, তার মধ্যে এত গরু কোথা থেকে এল?’ পেছনে বসা লোকটা (অজিত) ‘বলে উঠল “গরু আমার একদম ভালো লাগে না ভাই … গরুরা মোটেই গোবেচারা নয়, হেব্বি ছুতা রুস্তম টাইপ। দেখলেই কেমন মনে হয় ওদের ভোলাপনের মধ্যে অনেক প্যাঁচ লুকিয়ে আছে। ড্যাবড্যাবে চোখের পিছনে গিজগিজ করছে শয়তানি বুদ্ধি। কত ডাকল আমায়, এত, এত টাকা, টাকা, আমায় টাকা দেখাচ্ছে।’ (পৃঃ ৩৫৫)
তুলনীয়: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, ‘ফজল আলি আসছে’। এবং মনে করিয়ে দেয় তেলেগু লেখক রাচাকোণ্ডা বিশ্বনাথ শাস্ত্রীর ‘গোভুলোস্তুন্নাই জাগ্রাত্তা’ (‘লক্ষ রাখো গরুরা আসছে’) (১৯৭৩)। |
| মোহরমালা ধর। পার্টিকে ধরে আর দালাল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সৈকত সেনগুপ্ত ভবানী এবং প্রভাবশালী জ্যোতিষী স্বামী ভবানী শাস্ত্রীর সাহায্যে মফস্বল কলেজের অধ্যাপিকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার; ভ্রষ্ট মানুষ; অজিত সিং-এর অনুরক্তা শয্যাসঙ্গিনী; ভালো মা।
৩, ১৪, ২৪, ৩৫, ৪৯ ১৫-১৮, ৬৬-৭২, ১৩২-৩৮, ২০২-০৮, ২৯৯-৩০৯, ৩৬৫ = ৩৭। ১০.৫ শতাংশ। |
এই সত্যটা মেয়ে কিঞ্জলের কাছ থেকে জানা যে ‘রেপ করার কি দরকার ছিল মা? ও (ভবানী) তো সারাজীবনের মতো পুরুষ সম্পর্কে ভীতি ধরিয়ে দিয়ে গেছে, ওর উদ্দেশ্য ছিল আমার মনোবল ভেঙে দেওয়া। প্রতিদিন ঘর বন্ধ করে আমাকে তন্ন তন্ন করে দেখত উলটেপালটে। কীসব লক্ষণ খুঁজত।’ কিঞ্জলের পিসিঠাকুমার সতর্কবাণীতে আর মোহর ওকে নিতে চলে আসায় হয়তো ‘রেপটা করতে পারেনি। নইলে করত’, আর কিঞ্জলের বন্ধু বিঘ্নেশকে ভবানীই ওকে স্ট্রিপ অফ করতে বলেছে, ‘বলেছে, আমার মতো সুলক্ষণা নগ্নিকাকে দেখলে ওর উন্নতির রাস্তা খুলে যাবে, ওর সিদ্ধিলাভ হবে।… আমার জন্মের পর থেকেই ও অপেক্ষা করে চলেছে, কুমারী ভজনা। একজন ভার্জিনকে ও ভোগ করবে, সেটাও তিথি, নক্ষত্র মেনে, যার ফলে ও হবে অমর অজেয়।’ (পৃঃ ৩০৫-০৬) | ১। ‘এই যে ভবানী কোনোদিন স্বাভাবিক একটা দাম্পত্য যাপন করল না, শুধু দাম্পত্য কেন? ওর মধ্যে বাৎসল্যের ছিটেফোটা নেই। … অথচ ভবানী আর অজিত এদের দুজনকেই দরকার তাঁর। একজন ভাগ্যের চাকাটা ঘুরিয়ে যাবে মসৃণভাবে, আরেকজন ক্ষমতার অলিন্দে তাঁর উত্থান আরও নিশ্চিত করবে। কিন্তু শব্দটা কিসের? … একটা মন্ত্রের সুরে কে যেন বলছে “মোহর তুমি যে ঘরে থাকো সেটা ভেঙে পড়বে এখুনি। ওঠো। পালাও।’ (পৃঃ ১৩৪)
২। ক্যাম্পাসের দুটি পোস্টার: ক) ‘শহিদ স্মরণে আপন মরণে রক্তঋণ শোধ করো’। (পৃঃ ১৩৪, ১৩৮) খ) ‘সাবধান/বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের দিন আসন্ন।/এর জন্য প্রয়োজন অরিষ্টনেমি যজ্ঞ। যোগাযোগ করুন ভবানী শাস্ত্রীর সঙ্গে’ (পৃঃ ৬৭, ১৩৮) |
| দোলনচাঁপা (বক্সী) বারিক, ওরফে তার অল্টার ইগো বিদিশা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দমিত, বঞ্চিত, নিষ্পেষিত উজ্জ্বলতম ছাত্রীদের একজন; সম্ভবত কম্পিউটার সায়েন্স বা ইনফর্মেশন টেকনোলজিতে প্রথম স্থানাধিকারিণী গোল্ড মেডেলিস্ট; কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার ইন্টারভিউতে সাতবার প্রত্যাখ্যাত (ওর মতে ধর্ষিত) হওয়ার পরে/ফলে বিপর্যস্ত পারিবারিক জীবন ও শেষে স্বামীর বিশ্বাসভঙ্গের ফলে নিরুদ্দিষ্টা; সুপারিকিলার মার্কেস-জগার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভিউ ও মানসিক বিপর্যয়ের থেকে উত্তরণ।
৪, ১৩, ২০, ৩০, ৪১, ৪৫। ১৮-২২, ৬০-৬৪, ১০৫-১১১, ১৭০-৭৬, ২৪৪-৫৪, ২৭৪-৮২, ৩৬৬-৬৭ = ৪৬। ১২.৫ শতাংশ। |
১। ‘দোলন আবার সেই স্বপ্নটা দেখছিল। একটা খুব বড় টেবিল, এত বড় যে সমুদ্রের কথা মনে হল তার। … সমুদ্রের একেবারে ও প্রান্তে, ওর ঠিক উলটোদিকে যে লোকটা বসে আছে, সে ওর দিকে ঠান্ডা চোখে চেয়ে বলল “পুট অফ ইয়োর ক্লোথস প্লিজ। কুইক।” দোলন বলতে পারত, “আমি তো ইন্টারভিউ দিতে এসেছি, জামা খুলব কেন?” তার বদলে সে বলল “আমার বড্ড শীত করছে জানেন।” অমনি সবাই আবার সেইরকম কানে তালা দেওয়ার মত হেসে ওঠে।’ (পৃঃ ১৮-১৯)
২। প্রদীপ্তকে— ‘কিসের খোঁজ নেবে তুমি? লজ্জা করে না তোমার? আমি রেপড হচ্ছি। আর তুমি মজা দেখছ।’ (পৃঃ ৬৪) ৩। ‘আসল কারণটা হল ইটজ তা এজ অফ মিডিওক্রেসি, … ম্যামথদের দিন শেষ, এখন মানুষ সব দিকেই খুব ছোট হয়ে গেছে। আর সেই ছোট ছোট মানুষদের মধ্যে যদি বড় কেউ আসে, যোগ্য কেউ, বাকিরা তাদের সঙ্গে কমফর্টেবল ফিল করে না। … তাই নৈবেদ্যের চালকলার ওপর যে দু’একটা সন্দেশ থাকে, শোভাবর্ধনের জন্য, সেখানেও আমার ঠাঁই হল না।’ (পৃঃ ২৭৫) |
‘হাঁটতে হাঁটতে আমি একটা বন্ধ ল্যাবরেটরির মধ্যে ঢুকে পড়েছিলাম, রাস্তার ওপারে। … কোনোদিন খেয়াল করিনি। সেদিন কী হল, ভীষণ টানল আমাকে। ওই যে নির্জন পরিত্যক্ত বাড়িটা, নিঃসঙ্গ মেশিনঘর, বন্ধ থাকা মেশিনগুলো আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। আগে ডাকেনি তো। আমার কী মনে হয় জানিস বিদিশা, সব ডাক সব সময় আসে না।… আসলে আগে তো আমি ছিলাম একটা ব্যস্ত কেরিয়ারসর্বস্ব মানুষ। এরকম কিছুর দিকে তাকানোর সময় আমার ছিল না। আজ আমি আর ল্যাবরেটরিটা, ওই মেশিনগুলোর মতই পরিত্যক্ত। সেটা ওরা বুঝতে পেরেছে, বুঝলি, ওই মেশিনগুলো।’ (পৃঃ ২৭৮)
মার্কেজের কাছ থেকে— ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয় তোমাকে নেবে বলে অপেক্ষা করছে, তার নাম জীবন।’ (পৃঃ ২৯৮) ‘বিদিশা বিদিশা কী করব আমি? বিদিশা উত্তর দিল না, দোলন যত নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে, বিদিশা তত সরিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। যেন কেউ নেই। বিদিশা বলে কোনোদিন ছিল না। দোলন কারও নির্দেশের অপেক্ষা না করেই মার্কেজের হাত ধরে বলল ‘চলো’।’ (পৃঃ ২৯৯) |
| ভবানী শাস্ত্রী। যৌন বিকারগ্রস্ত, ক্রূর জ্যোতিষী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রক। অতীতে গ্রামে যতীন ভুঁইয়ার স্ত্রী মণিকাবৌদির গর্ভসঞ্চার করে পিতৃত্ব অস্বীকার করে তার আত্মহত্যার কারণ ঘটিয়ে পলাতক। পরে ট্রেনে আলাপ হওয়া মোহরমালা ধরের স্বামী। তাঁকে প্রথমে কলকাতার কলেজে ঢুকিয়ে, পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকিয়ে মানসিক দাস বানিয়ে রেখেছেন, অজেয়, অমর হওয়ার জন্য নিজের মেয়েকে দিয়ে কুমারীভজনার ছক কষছেন।
৫, ২২, ৩৩। ২২-২৬, ১১৮-১৯, ১৮৯-৯৬ = ১৫। ৪.০৮ শতাংশ। |
১। ‘জ্যোতিষচর্চার অনেকখানি মনস্তত্ত্ব আর বাস্তববুদ্ধি। সেই বাস্তববুদ্ধিই তাঁকে বলেছিল নারীশরীরের থেকে অনেক জরুরি সেই নারীর হাত ধরে ক্ষমতার অলিন্দে ঢুকে পড়া। তিনি ঢুকে পড়লেন, দেখলেন কী জনসম্মোহনী শক্তি এই জ্যোতিষের।’ (পৃঃ ১৯০)
২। ‘ক্ষমতার অলিন্দে তিনি ঢুকে পড়লেন আর ছিটকে পড়ল সেই মেয়ে [শতরূপা]। তার কারণ কি একজন মেয়ের উত্থান কেউ মেনে নিতে পারেনি? অথচ বাঙালি শুধু না, শক্তির সাধনা আর মাতৃপূজা ভারতীয়দের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারাও কেন নারীর উত্থান মেনে নিতে পারে না? … কিন্তু তিনি জানেন যে বেঁচে আছে। তার ছক তো তিনিই করেছিলেন। জাতিকা দীর্ঘজীবী, তাঁর থেকে ভালো কেউ জানে না। এবং প্রতিশোধপরায়ণ। শব্দটি তাঁকে কাঁপিয়ে দিল।… কেন মনে হয় আড়ালে ওৎ পেতে কে যেন বসে আছে।’ (পৃঃ ১৯১) ৩। ‘মোহর তো ছেলে দিতে পারল না। তবে যাকে দিয়েছে, তাকে দিয়ে তাঁর অনেক কাজ সিদ্ধ হবে। এর জন্য বহুদিন অপেক্ষা করছেন তিনি। বাঘ যেমন ধৈর্য ধরে শিকারের জন্য ওৎ পেতে থাকে। একটি প্রকৃত কুমারী সংসর্গ করে তিনি হবেন অমর অজেয়। এর জন্যে তো তিনি সর্বত্র পোস্টার ছড়িয়ে মোহরের মনোবল ভেঙে দিয়েছেন। শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছেন বিঘ্নেশের ফ্ল্যাটে। আজ এই যজ্ঞ সেরে বাড়ি ফিরবেন সোজা। মা মেয়েকে আজ তাঁর পায়ে পড়তেই হবে।’ (পৃঃ ৩৪১) |
‘ভবিষ্যৎ— কী মোহ এই শব্দের। কী ডান, কী বাম, কী মধ্যপন্থী— সবাই নিজের ভবিষ্যৎ জানতে চায়। অথচ কেউ অতীত জানতে আগ্রহী নয়। বরঞ্চ অতীতকে ভয় পায়, অথবা অতীতকে নিয়ে কোনো কৌতূহলই নেই। অতীত যেন দুঃস্থ সাহায্যপ্রার্থী আত্মীয়ের মত। অথচ মজার কথা হল, ভবিষ্যৎ কী হবে, তার সব সঙ্কেত ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে অতীতের মধ্যেই।’ (পৃঃ ১৯০)
‘বেদিতে আহুতি দেবার সঙ্গে সঙ্গে দারুণ তেজে আগুন জ্বলে ওঠে। আহা। সব শত্রুর শেষ হোক। … ধীরে ধীরে মারণ উচাটন মন্ত্রের মধ্যে ডুবে যায় তাঁর চেতনা। গগন কখন দরজা আলতো খুলে কী ছুঁড়ে দেয় খেয়াল করেন না তিনি। চারপাশ কেমন উষ্ণ হয়ে ওঠে। আগুনের শিখা ঘিরে আসছে যেন। ভাঙা গলায় চিৎকার করেন “গগন গগন আমাকে বাঁচা।”’ (পৃঃ ৩৪১) —জ্যোতিষীর নিজের জন্মছক মিলল না। নিজের ভবিষ্যৎ গণতে পারেননি। |
| পদ্মনাভ। ঐতিহাসিক চরিত্র; উন্নাসিক, উচ্চ-সংস্কৃতিমনস্ক গণমানস-অচেতন, প্র্যাক্সিস-হীন তত্ত্বসর্বস্ব বাম নেতা; বাংলার প্রাক্তন বাম মুখ্যমন্ত্রীর ছায়া আছে উন্নাসিকতায়। বাকিটা লেখককল্পনা। যুগপুনরুজ্জীবনের জন্য শতরূপার তুলে নেওয়া, কিন্তু আবার হারিয়ে যাওয়া মানুষ।
৬, ১২, ২৬। ২৬-৩০, ৫৪-৬০, ১৪৫-৪৬= ১৪। ৩.৮ শতাংশ। |
১। ‘শতরূপাকে সরিয়ে দেওয়া হবে, আর তাঁর কাছে কোনও খবর থাকবে না! তার মানে তখন থেকেই নাকি তারও আগে থেকেই রাশ আলগা হতে শুরু করেছে, কেন্দ্রীয় কমিটি নেহাতই কথার কথা। দল নয় ব্যক্তিই বড়। এই সব ব্যক্তিরাই চালক, তারাই সব ঠিক করছে, পদ্মনাভ কি তাহলে শুধু পুতুল। … শতরূপাকে খুন করা হয়েছে, এরকম খবরের পাশাপাশি আরও একটি কথাও তো উড়ছিল হাওয়ায়। শতরূপা যোগিনী হয়ে গেছে। পুরুলিয়ার এক আশ্রমে মুণ্ডিত মস্তকে তার ছবি এসেছে পুলিশের হাতে। আর তার পাশে? নামটা জেনে চমকে গেছিলেন পদ্মনাভ। এও কি সম্ভব?’ (পৃঃ ৫৫-৫৬)
২। ‘সেই পেছনে কলের জল পাম্প করতে করতে বালিকাটির কাঁধ থেকে বারবার নেমে যাওয়া ফ্রক টেনে তোলার দিন? … সেই দিন খুব মুষড়ে পড়েছিলেন পদ্মনাভ তা বেশ মনে আছে, শতরূপাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলেন “আমরা ওদের কাছে পৌঁছতেই পারিনি, কিচ্ছু করতে পারিনি, কিচ্ছু না।”’ (পৃঃ ১৪৬-৪৭) |
‘পদ্মনাভর এখন মনে হচ্ছে শতরূপার এই ঘরটা, যাকে ও অমোঘ জানবাড়ি বলছে … এই বাড়িটা আসলে একটা কৃষ্ণগহ্বর ছাড়া কিছু নয়। সব আলো শুষে নেয় … এমন একটা ব্ল্যাক হোল, যেখানে একবার ঢুকে পড়লে সময় স্থির হয়ে যায়। তাই বাইরের কোনো পরিবর্তনের আঁচ গায়ে লাগে না। এখানে এসে তাঁর ভাবতে ইচ্ছে করছে পরিবর্তন, বদলা, বদল, কিছুই হয়নি আসলে।’ (পৃঃ ৫৫-৫৬) |
| প্রদীপ্ত বারিক। অজিতকে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের চাকরি পাওয়া, কাউন্সিলে যাওয়া, অধ্যাপক; দোলনচাঁপার অযোগ্য অপ্রেমিক স্বামী। পরে দাম্পত্যশয্যা থেকে পলাতক। উৎকল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল নয়নতারা জেনার সঙ্গে যৌনবিহারের জন্য দোলনচাঁপার অবহেলায় দোষী।
১ (অসূচক), ৮, ১৩, ৫২। ১০, ৩৫-৩৯, ৬৪-৬৬, ৩২১-২৮, ৩৬৫ = ২৭। ৭.৫ শতাংশ। |
১। ‘প্রদীপ্ত কীরকম একটা ধাক্কা খেল। এতগুলো বছর দোলন কোনও চাকরি না করে একটা বুনো হাঁসের পেছনে ছুটে গেছে, যার জন্যে কোথাকার কে অর্ধশিক্ষিত পুলিশ দোলন ইমেল খুলতে পারে কিনা তার জন্য সন্দেহ প্রকাশ করছে। হায় কী মহতী বিনষ্টি। কেন সে এরকম হতে দিল? কেন সে দোলনকে ঠেলে দিল আত্মবিলোপের দিকে? কত কী, কত কী করার ছিল জীবনে। চাকরি তুচ্ছ, সন্তান তুচ্ছ…’ (পৃঃ ৩২৩)
২। ‘অফিসার একটু নাড়াচাড়া করেন মাউস। তাঁর চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে ওঠে। আপনি শিওর উনি এখান থেকে মেল করতেন?” … “এখান থেকে মেল পাঠানো অসম্ভব। কারণ এখানে কোনও নেট কানেকশনই নেই। ওয়াই ফাই রেজিস্টার করাই নেই। এক মোবাইল হট স্পট দিয়ে করা যেত, কিন্তু ওঁর তো কোনও স্মার্ট ফোন ছিল না।” … চমকে বসে পড়ে প্রদীপ্ত।’ (পৃঃ ৩২৪) |
‘সেই সময় ফোন বাজে। সেই অফিসার। “শুনুন আমরা খোঁজ নিয়েছি। ওই বছর দোলনচাঁপা বারিকের ব্যাচে কোনও মেয়েই ছিল না, বিদিশা তো দূরের কথা।’ (পৃঃ ৩২৮) |
| মনোজিত কুমার মাল। নিজে পিএইচডি ডিগ্রিহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ডিন; বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের পিএইচডির তথা ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক।
৯। ৩৯-৪৩। |
নেই | নেই |
| তাজমুল। সরল গ্রাম থেকে আসা মাতৃভক্ত দরিদ্র উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক; প্রাইভেট কোম্পানির কুরিয়ার হয়েও শহরের অভিজাত এলাকায় আবাসস্থল কেনার স্বপ্নে অমরনাথ বসু ও তাঁর স্ত্রীর ব্যঙ্গহাস্যে বাপিদার সুপারি কিলার বনে যাওয়া ভাগ্যহত মানুষ। অনেক খুন এবং ধর্ষণে দোষী তাজমুলও শতরূপার ‘electi’ বা নির্বাচিতদের একজন।
১০, ২৫, ৩৬, ৫০। ৪৩-৪৭, ১৩৮-৪৪, ২০৮-১৬, ৩০৯-১৩, ৩৬৫ = ২৭। ৭.৩৪ শতাংশ। |
১। স্যারের (অমরনাথ বসুর) স্ত্রীর ‘হাসিটা অনেকদিন পর্যন্ত কানে বাজত তাজমুলের। কানে বাজত বলেই ও খুব দ্রুত বুঝতে পেরেছিল, লোকের বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করে সে কোনোদিনই ওর স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছতে পারবে না। সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে বেশি উপরে ওঠা যায় না … এস্কেলেটর লাগে … একই এলাকার ছেলে, ওর সঙ্গে একই সময়ে কলকাতায় এসেছিল (সইদুল), এই সেদিন অবধি পিৎজা ডেলিভারি বয়ের কাজ করত, আজকাল গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়ায় … ফোন নম্বরটা বুদ্ধি করে নিয়েছিল তাজমুল।’ (পৃঃ ১৪০)
২। বাচ্চুর উদ্দেশে ‘সে ব্যগ্রভাবে বলে— “শোন বাপিদা আমাদের একটা অ্যাকশনে পাঠাল … বলল এমন ভাব করতে হবে যে আমরা আসলে বাপিদার লোক নই, অন্য পার্টি পাঠিয়েছে … এখন বাপিদা যদি দল ছেড়ে দ্যায় তাহলে কি লাশগুলো নেই হয়ে যাবে? … আমি বলতে চাইছি, আমরা কারা? … আমি জানতে চাইছি, আমরা কি খুন করেছি? না আমরা খুন হয়েছি? আমরা শালা বেঁচে আছি না মরে গেছি?’ (পৃঃ ৪৬-৭) |
১। ‘আদিগন্ত সরষেখেত … যেদিকে তাকাও শুধু হলুদ আর হলুদ, যেন বসন্ত এসেছে। এই সরষেখেত দেখে তাজমুলের নিজের গ্রামের কথা মনে পড়েছিল নাকি কে জানে। তাদের গ্রামে কোনোদিন সরষে চাষ হয়নি তো … কিন্তু এবার দেখতে হল। এদিকেই কাজে পাঠিয়েছে বাপিদা। … সেদিন দুপুরে সরষেখেতের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিল তাজমুল … আজকের অ্যাকশন ঠিকঠাক হবে কিনা চিন্তা হচ্ছিল ওর … চারদিকে কেউ কোথাও নেই, … কি নিঝুম, হঠাৎ কে যেন ওর মুখ হাত বেঁধে ফেলল পেছন থেকে। তারপর বলল “চল”।’ (পৃঃ ৩০৯-১৩) |
| বিদিশা। দোলনচাঁপার ক্লাসের ছাত্রী (?), অভিন্নহৃদয় বন্ধু; কম্পিউটার সায়েন্স বা ইনফর্মেশন টেকনোলজিতে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থানাধিকারিণী, কর্পোরেট দুনিয়া থেকে অ্যাকাডেমিয়ায় এসেও ফিরে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল দমিত, নিষ্পেষিত ছাত্রী; হয়তো বা দোলনচাঁপার বিবেক হ্যালিউশিনেশন/স্কিৎসোফ্রেনিয়াজাত স্মৃতিবিভ্রম, বা অধিশাস্তা (super ego), অথবা আসলে দোলনের দ্বিতীয় সত্তা, দ্বিবিভক্ত সত্তা (alter ego)।
১১, ১৭, ৪৫। ৪৭-৫৪, ৮৫-৯২, ২৭৪-৮২, ৩৬৬ = ২১। ৫.৭১ শতাংশ। |
১। ‘কে একজন বলেছিল বিয়ে টিকিয়ে রাখতে গেলে প্রেম লাগে না, লাগে বাস্তববোধ। তেমনি পিএইচডি করতে গেলে জ্ঞান লাগে না, লাগে ঠিকঠাক লোক ধরার কৌশল। যাকে বলে বাবু ধরা। সাদা চুলওলা লোকটিকে [মনোজিতকুমার মাল] দেখে বোঝা যায় না, ইনি একজন উচ্চমার্গের বাবু। তাঁকে ধরলে খাওয়া পরার চিন্তা চলে যাবে। কিন্তু ওই যে বকুলতলায় পৌঁছতে হবে। বকুলতলায় পৌঁছনোর এত জটিলতা কিসের? বিদিশা ভেবেছিল।’ (পৃঃ ৪১)
২। ‘এই বকুলতলায় দাঁড়িয়ে মনোজিত একদিন বলেছিলেন— পিএইচডি মানে বুঝলি, কয়েকটা খোপ, তোকে কিছু ডেটা দিয়ে সেই খোপগুলো ভরতে হবে। বিদিশা শুনে চমকে গেছিল। গবেষণা মানে শুধু তাহলে খোপে কিছু ডেটা ভরে দেওয়া? কোনো উদ্ভাবন নয়, কোনো যুগান্তকারী চিন্তার উদ্দীপন নয়…’ (পৃঃ ৪১) |
‘বিদিশা অক্ষরের জীবনে পাশ ফিরে শোয়। আপাতত তাকে কারও দরকার নেই। আবার কেউ নিজেকে হারিয়ে ফেললে সে আসবে।’ (পৃঃ ৩৬৬) |
| পটা। সাহুদের, বিশেষ করে ছোড়দার ড্রাইভার; ছদ্মনামে হিন্দু বলে বিয়ে করা মুসলিম মেয়ে মনিয়ারার স্বামী; স্নেহময় বাবা। কলকাতার নিম্নগমনের বহু অভিজ্ঞতার সাক্ষী।
১৫, ২৮, ৩৯, ৫৬, ৫৭। ৭২-৭৯, ১৫৭-৬৪, ২৩০-৩৭, ৩৪৮-৫৫, ৩৫৫-৬৫, ৩৬৭ = ৪৪। ১১.৯৬ শতাংশ। |
‘কলকাতা তাকে শেষ করে দিয়েছে। আর তার মতো লোককেও কিনা হাজতবাস করতে হল। … মেয়ে যদি জানে। ওর চোখে তো বাবা হছে ভগবান।’ (পৃঃ ২৩৫) | ‘অনেকসময় দেখা যায় সে গত বছরের একটা কাগজ পড়ছে। ওকে নিয়ে হাসাহাসি করে ছোড়দা আর অন্য সব ড্রাইভার। তারপর ছোড়দা বলে “পটার আর দোষ কী? দশ কুড়ি বছর আগেও তো একই খবর বেরোত। নামগুলি শুধু বদলে গেছে।” পটা মাথা চুলকে ভাবে, সত্যি তো, সে তো পড়ে বুঝতেই পারেনি যে এটা পুরনো কাগজ।’ (পৃঃ ৩৫৩) |
| সুমন। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স করা, পার্টি না ধরে চাকরি পাওয়া পড়ুয়া করণিক; শতরূপার ‘স্কোয়াডে’ বা মিটিং মিছিলে না যোগ দেওয়া; আর হয়তো তার ফলেই শতরূপার পছন্দ হওয়া, ভবিষ্যৎ পুনরুজ্জীবনের জন্য তুলে নেওয়া, দলতন্ত্রবিরোধী দৃঢ়চেতা মানুষ।
১৮, ৪৬। ৯২-৯৯, ২৮২-৮৭ = ১৪। ৩.৮ শতাংশ। |
‘মার্কসবাদ মানে মুক্ত চিন্তা এই ধারণাটা ভুল প্রমাণ করেছিলেন বাঙালি বামপন্থীরা, মূলত সিপিএমরা, তাঁদের মতো মৌলবাদী দল কমই হয় … তাঁদের ছেঁড়া চটিতে পা গলিয়ে যারা ক্ষমতায় এল, তাদের দেখা গেল অত ছুঁৎমার্গ নেই। পার্টির আনুগত্যের থেকেও বেশি গুরুত্ব পায় কে কত টাকা আনতে পারবে। কত দ্রুত টাকা তুলে নিতে পারবে। … পরিবর্তন পরিবর্তন শোর মচিয়ে যারা এল তারা আবার উলটো। তাদের বালাই নেই। সব ‘বাদ’ই বাদ। তারা বোঝে মাল্লু। … টাকা দেওয়া নেওয়াকে এরা একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।’ (পৃঃ ৯৩-৯৪) | ‘গাড়ির ভেতরে কে যেন বোরখায় ঢাকা বসে … যেন বলছে “বহু বছর আগে এই গলি থেকেই আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হিস্ট্রি রিপিটস। উঠে এসো সুমন … নিজেই এসেছি তোমাকে নিতে … শোনো সুমন, ক্ষমতাবানদের সময় মুছে দিতে হবে। সময় এসে গেছে।” ‘সময় এসে গেছে!’ মাত্র তিনটি শব্দ, তাতেই চমকে যায় সে। … সে এবার সোজা হয়ে বসে শতরূপার হাত ধরে ঝাঁকাল “হ্যাঁ, শতরূপা সময় এসে গেছে।”’ (পৃঃ ২৮৬-৮৭)। |
| কিঞ্জলকিনি ধর-শাস্ত্রী। মোহরমালা ও ভবানীর কন্যা; ভবানীর তরফে তান্ত্রিক অজাচারের জন্য জিইয়ে রাখা ভাবী ভৈরবী।
১৯, ৩১, ৪২। ৯৯-১০৫, ১৭৭-৮৩, ২৫৪-৬০ = ২১। |
‘পিসিঠাকুমা বলেছিল “একই নামে হয়তো পাবি, কিন্তু জিনিস আলাদা। এই যে তুই ভবানী, নাম একই আছে, কিন্তু ওখানে যা ছিলি আর এখানে যা হয়েছিস, মানুষটাই আমূল বদলে গেছে যেন।” … এখন মনে হচ্ছে পিসিঠাকুমার কথার মধ্যে কোনো ভয়ঙ্কর সত্য লুকিয়ে আছে, এমন কোনো গোপন অতীত আছে ভবানী শাস্ত্রীর, গোপন সুড়ঙ্গের মতো, যা বুজিয়ে তাদের বর্তমান জীবনটা গড়ে উঠেছে, জলাজমি বুজিয়ে বহুতলের মতো। হয়তো মাও সেই অতীতের অংশ, আর তাই কি মা কোনোদিন ভবানী শাস্ত্রীকে ছেড়ে যেতে পারেনি?’ (পৃঃ ১৭৯) | ‘সময় কী ভাবছিল কিঞ্জল। কোথায় যে যেন পড়েছিল। পূর্ব আর পশ্চিমের সময়ের বোধ আলাদা। … পশ্চিমে সময় সব সময় সামনের দিকে ছোটে। তাই সময়ের সঙ্গে সবাই দৌড়তে থাকে … কিন্তু পূর্বে সময় ঘোরে গোল হয়ে। সকল ঘটনাই পুনরাবৃত্ত হয়, তাই মানুষের তাড়া থাকে না এত, সবাই জানে সুযোগ আবার আসবে। … পিছনের বাঁকে যাকে ফেলে এলাম এক পাক ঘুরে এলেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। সময়ের নদীতে এক জল দ্বিতীয়বার তোলা যাবে না, এ কথা পূর্বের ধারণায় ভুল। পূর্ব ভাবে [সময়] অনন্ত এক আদি প্রবাহ বারবার বয়ে চলেছে, নতুন হয়ে আবার ফিরে আসছে। কিঞ্জল চমকে উঠে ভাবল তাহলে কি নতুন কিছু ঘটছে না? যা ঘটে গেছে তাই বারবার ঘটছে? সেদিন বিঘ্নেশের ফ্ল্যাটে যা ঘটেছে, তা কি আগেই হয়ে গেছে? ছায়া ছায়া কী যেন ভেসে ওঠে অতল জলের থেকে, যার নাগাল সে পায় না পুরো।’ (পৃঃ ১৭৮)
এখানে তৃষ্ণা ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ‘Messianic’, time’, বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের “homogeneous” or “empty time”, “simultaneity-along-time” ইত্যাদির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন, যা আধুনিক পশ্চিমের ‘calendrical time’-এর বিপ্রতীপ, এবং পূর্বের ‘transversal time’ এবং ‘cylindrical time’-এর অনুরূপ।[34] |
| কুন্তল। অসন্তুষ্ট কর্মচ্যুত, প্রতিভাবান ফোটোগ্রাফার/ক্যামেরাম্যান; যুগপুনরুজ্জীবনের জন্য সংগ্রহ করা মানুষদের ছবি নেওয়ার জন্য শতরূপার তুলে নেওয়া মানুষ।
২১, ৩২, ৪৩, ৩৬৫। ১১২-১৮, ১৮৩-৮৯, ২৬১-৬৮ = ২২। |
‘ও লেন্স-টেন্স গুছোচ্ছে, তখন একটি ছেলে এসে ঢুকল। “এবার সময় হয়ে গেছে, কাজ শুরু করতে হবে। … আপনাকে আমি পরপর কয়েকটা ঘরে নিয়ে যাব, সেই ঘরে কয়েকজন মানুষ আছেন। তাঁরা যা খুশি করতে পারেন, কেউ হয়ত ঘুমোচ্ছেন, কেউ কাজ করছেন, কেউ কিছুই করছেন না। আপনাকে তাঁদের ছবি তুলতে হবে। … এঁরা কিছু বলবেন না। এঁরা সব হারিয়ে যাওয়া লোক। কেউ নিজের বাড়ি থেকে, কেউ পার্টি থেকে, কেউ বা নিজের সময় থেকে হারিয়ে গিয়েছেন। … জানতে চান ম্যাডাম। এঁরা কি বেঁচে আছেন? এঁরা কি বেঁচে আছেন? থাকলে কীভাবে বেঁচে আছেন? এঁরা কি ফিরে আসার স্বপ্ন দেখেন? সেই স্বপ্ন দিয়ে কি কোনও আগুন জ্বালানো যায়?’ (পৃঃ ২৬৭-৬৮) | ‘আরও চমকে যায় কুন্তল। এই অদ্ভুত পরিকল্পনার পেছনে যে এক নারী রয়েছেন এটা তার ঠিক হজম হতে চায় না। তার মনে হয় এটা একরকম নৈরাজ্য তৈরি করবে। হারিয়ে যাওয়া মানুষ ধরে নিয়ে আসা, তাদের দিয়ে আগুন জ্বালানো মানে? বিপ্লব কী? যে বিপ্লব শুধু মানুষ মারে, পেটে এক মুঠো ভাত দিতে পারে না তেমন বিপ্লবে কোনও আস্থা নেই কুন্তলের। কিন্তু এটাও ঠিক, বহু বছর পর সে বিপ্লবের নাম শুনল। যেন এটা একটা অস্পৃশ্য শব্দ, কেউ উচ্চারণ করে না, যেন বাড়ির বখে যাওয়া ছেলে, কেউ বলে না তার কথা।’ (পৃঃ ২৬৮) |
| মীরা কাপুর। বলিউডের চলচ্চিত্র- নায়িকা; সম্যক মিল জয়া ভাদুড়ী (বচ্চন)-র সঙ্গে; মারণ-উচাটন যজ্ঞের জন্য ভবানীর নতুন ক্লায়েন্ট।
২২, ৪৪। ১১৯-২৫, ২৬৮-৭৪ = ১৪। |
তেমন কিছু নেই, প্রক্ষিপ্ত চরিত্র। | তেমন কিছু নেই, প্রক্ষিপ্ত চরিত্র। |
| মার্কেজ-জগা। ‘হাইকম্যান্ড’ তথা অজিতের কোম্পানির মননশীল, মার্কেজ-প্রাণ সুপারি কিলার।
২৩, ৩৪, ৪৮। ১২৫-৩২, ১৯৬-২০২, ২৯৩-৯৯, ৩৬৫ = ২৩। |
‘এই যে বস শনিবার দেবী দেবী টাইপ মহিলা নিয়ে একটু ফুর্তিফার্তা করে, ওরাও কেউ জ্যান্ত না, সব মরে হেজে গেছে কবে। এই রাজ্যটাও মরে গেছে। অনন্তকাল অশৌচ চলছে যেন।’ (পৃঃ ১২৯-৩০) | ১। ‘এই গ্রামে তার নয় নয় করে এক মাস তো হয়েই গেল, কোনোদিন উলটোদিকের দেওয়ালে এমন গাছ হতে দেখেনি তো! একটা কারণ অবশ্য, এবছর কেবলই ঘ্যানঘ্যান বৃষ্টি, দিনরাত বৃষ্টি। মার্কেজ ঘুম ভাঙলেই দেখত বৃষ্টি পড়ছে, ঘুমিয়ে পড়ত বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে।’ (পৃঃ ২০০)— Gabriel García Márquez-এর One Hundred Years of Solitude থেকে পশ্চিমবঙ্গের যৌথ স্মৃতিভ্রংশের amnesia-র প্রতীকিতা।— এর বিপ্রতীপে আসছে মার্কেজের স্মৃতিপ্রিয়তা।
২। ‘সে জানে জীবন মাঝেমাঝেই অভাবনীয়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আর সেই অভাবনীয় একবার ঘটে গেলে সেটা আরেকবার ঘটতে পারে। একেই বলে প্রবাবিলিটি। … পৃথিবীতে, খেয়াল করে দেখলে একই ঘটনা রোজ ঘটতে থাকে। লোকে বলে হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। এই হিস্ট্রি মানে কী? চেসেস্কু, রুশ বিপ্লব, জার্মানির দেওয়াল, মণিকা, ক্লিন্টন, লাদেন, ছাপ্পান্ন ইঞ্চি— এসবই কি হিস্ট্রি? ইতিহাস তো মানুষের যাপনের প্রতিটি মুহূর্ত, তার ইচ্ছে, সাধ, অপূর্ণতা, রাগ, হিংসা, প্রেম সব কিছু মিলেই। এমনকি স্মৃতিরও ইতিহাস থাকে। আজকাল মার্কেজের মনে হয় … গার্সিয়া মার্কেজের আত্মজীবনীর প্রস্তাবনায় তিনি যা বলেছিলেন জীবন যতটা বাঁচা হয়, তার বেশিরভাগটাই বাঁচা হয় স্মৃতিতে।’ (পৃঃ ২৯৫) |
| শতরূপা ব্যানার্জি। একটি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের (সম্ভবত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) বাম নেতৃত্বের অতি ঘনিষ্ঠ নিরুদ্দিষ্ট মহিলা প্রশাসনিক অফিসার (ঘোর মিল বাস্তব মনীষা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে)।
২৬, ৩৭, ৫১। ১৪৫-৫১, ২১৭-২৩, ৩১৩-২১, ৩৬৫ = ২৪। |
১। ‘ছেলেটি … একটা কথা ও ঠিকই বলেছিল। বিচিত্র রকমের মানুষ জমাচ্ছেন শতরূপা, পুরনো কয়েন বা স্ট্যাম্পের মতো। আর স্ট্যাম্প বা কয়েনের মতো এই মানুষগুলোরও অদ্ভুত ইতিহাস আছে। মানুষ নয়, শতরূপা আসলে জমাচ্ছেন সেই সময়টা। একদিন এই জোর করে, ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা ইতিহাসই কথা বলে উঠবে। সেই স্বরগুলোকে এক জায়গায় করাই তাঁর কাজ।’ (পৃঃ ১৪৬)— এই কথাগুলো মনে করিয়ে দেয় ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের ‘Excavation as Memory’ লেখাটির কথা।
২। ‘পদ্মনাভ ফিরে এসেছে শুধু নয়। … এই প্রথম এমন হাসি ওর মুখে ফুটে উঠতে দেখলেন শতরূপা। … বিদ্রূপ করে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই, হঠাৎ একটা নতুন মানুষ সেখানে হাজির হল। তার হাতে, কী আশ্চর্য, একটা টেস্টটিউব। মেয়েটা তার দেবীপ্রতিমার মতো মুখটি তুলে বলল “এটা কী?” “তুমি যে চারজনের কথা বলেছিলে দেখো এর মধ্যে। ওরা আস্তে আস্তে ছোট হয়ে গেছে। আর দেখো ওরা যে এত ছোট, ওরা বুঝতেই পারছে না। দেখো দেখো, এর মধ্যেও ওরা আটভাট বকে যাচ্ছে। কাকে লেকচারার পোস্টে নেবে, কাকে হুড়ো দেবে, কার প্রোমোশন আটকাতে হবে, কাকে নিয়ে জোকার রিসর্টে যেতে হবে, সব, সব ঠিক করে যাচ্ছে।” মেয়েটা অস্ফুটে বলল “কেয়ার অফ বকুলতলা। এতদিন সেখানেই সব ঠিক হয়ে এসেছে।” লোকটা টেস্টটিউবটা নাচাতে নাচাতে বলল, “আর হবে না” “না, ওটা রেখে দাও। জিন নিয়ে কাজ করা মানুষটাও হারিয়ে গিয়ে এখানে চলে আসবে। জিনের কোন প্রবণতা মানুষকে এত দলদাস করে তোলে, সেটা দেখতে হবে।” (পৃঃ ৩২০) |
‘শতরূপা আশ্চর্য হয়ে দেখল পদ্মনাভর কথা ওরা কেউ শুনতে পেল না। … কী অদ্ভুত, ওর দিকেও তাকাল না কেউ, শুনতেই পেল না। যেন মাঝখানে একটা পর্দা দেওয়া, তিনি ওদের দেখতে, শুনতে পাচ্ছেন, কিন্তু ওরা তাঁকে পাচ্ছে না, যেমন ওরা পাচ্ছে না, পদ্মনাভকে। রাগে দুঃখে তাঁর কান্না পেল। তিনি, শতরূপা ব্যানার্জি, তিলতিল করে এই জায়গাটা গড়ে তুলেছেন, বছরের পর বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে লুকিয়ে থেকে প্রতীক্ষা করছেন আজকের দিনটার, তাঁর জন্যে এই সমাজের ব্রাত্য মানুষগুলো এখানে আশ্রয় পেয়েছে, আর তাঁর কথা কেউ শুনতেই পাচ্ছে না? তিনি ছাদের রেলিংএ থুতনি ঠেকিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। … এই ছাদ কি তাঁর ছোটবেলার কমিউনের ছাদ থেকে আলাদা? … তিনি কোন সময়ে আছেন? নাকি হারিয়েই গেছেন সময়ের মানচির থেকে?’ (পৃঃ ২৯৫) |
| অমরনাথ বসু। অবসরপ্রাপ্ত বামপন্থী, পার্টিজান, আর্থিকভাবে সৎ কিন্তু মুরুব্বিতেলানো এবং মক্কেলসেবক (‘clientelist’) অধ্যাপক/এক্সপার্ট; পড়ুয়া, প্র্যাক্সিস-বিমুখ, গৃহকর্মবিমুখ আরামকেদারা তাত্ত্বিক; দোলনচাঁপার বৌদ্ধিক ধর্ষক-ধ্বংসকদের একজন; যুগপুনরুজ্জীবনের জন্য শতরূপার তুলে নেওয়া পতিত মানুষ।
২৭, ৩৮, ৪৭। ১৫১-৫৭, ২২৩-২৯, ২৮৭-৯২ = ২০। |
১। ‘ওরা স্নান করে উঠে আসছে … একটু থমকে দেখল, … তারপর জলের ধারের বেঞ্চের দিনে ইশারা করল। … বেঞ্চে কে যেন বসে আছে না? … মেয়েটা আচমকা পেছন ফিরে সোজা তাঁর দিকে তাকাল আর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। আই নো হার। বহুবছর আগে বিশাল ওভাল টেবিলে এর উলটোদিকে বসে বলেছিলেন। তাঁর পা দুটো মাটিতে গেঁথে গেল।’ (পৃঃ ১৫৭)
২। ‘বহুবছর আগে এইরকম একটা ছেলে চিঠি দিতে আসত। কুরিয়ার কোম্পানিতে কাজ করে। … একদিন জিজ্ঞেস করেছিল এখানে জমির দাম কেমন যাচ্ছে। হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন তিনি। পরে মনে হয়েছিল ছেলেটার মুখটা কেমন হয়ে গিয়েছিল যেন। … কেন, কেন হাসি পেয়েছিল তাঁর? যারা গরিব তারা গরিবই থাকবে চিরকাল, এটাই কি তাঁর মনের গহনে লুকিয়ে নেই? তাই অত হাস্যকর মনে হয়েছিল তার কথা?’ (পৃঃ ২৯২) |
১। ‘ওদের মধ্যে একজন বলল “আপনাকে যেতে হবে। বাধা দিয়ে কোনো লাভ নেই। এটা আমাদের এলাকা” … তিনি বললেন “এখনই যেতে হবে?” “এখনই যেতে হবে?” “এখনই?” “সময় হয়ে গেছে?”
২। ‘এত কাজ করাও সহ্য হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যখন প্রতিদিন সন্ধের সময় একরাশ ছবি এনে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয় “দেখুন তো এঁদের চেনেন কিনা” সেটা একেবারেই নিতে পারেন না তিনি। কিন্তু তবু ওরা ছবিগুলো দেখাবেই। একেবারে ডিসফিগারড ছবি সব। বমি উঠে আসে তাঁর। তবু দেখতে হয়। একদিন একটা চেহারা দেখে সত্যি সত্যি চেনা লাগল। বহুবছর আগে এইরকম একটা ছেলে চিঠি দিতে আসত।’ (পৃঃ ২৯২) |
| গগন। ভবানী ও মন্দিরসেবিকা গোলাপির অবৈধ, মানসিকভাবে অপরিপক্ব পুত্র; শেষত ভবানী নামক ব্যাধির ধ্বংসক।
৫৪। ৩৩৬-৪১, ৩৬৫ = ৭। |
১। ‘এই তোর জন্যে আমি এখানে পড়ে আছি গগন। … আমি চলে গেলে তুইও থাকিস না মোটে। আমি বলেছি তোকে দেখতে। কিন্তু দেখবে না মোটে। … কিন্তু তোকে কেন দেখবে না বল? কেন? রক্ত কি কিছু না? রক্ত? এই সরিলটা বুঝলি গগন, এই সরিলটা।’ (পৃঃ ৩৩৭)
২। হঠাৎ মায়ের একটা কথা মনে পড়ল। … “তোকে আর কী বলব গগন? হাবাগোবা ছেলে তুই। … আর দেখ তোকে নিয়েই ঝলসাপোড়া হয়ে যাচ্ছি। চোখের সামনে বাপ ঘুরছে, ছেলে তবু বাপ ডাকতে পারবে না। তাহলেই মা বেটার গলা টিপে দেবে।” (পৃঃ ৩৩৯) ৩। ‘আবার একটা ছবি … শাস্ত্রীজির পায়ে তেল বুলিয়ে দিচ্ছে মা, গোলাপি। খিদে পেয়েছে … দরজা ঠেলে খুলে দেয় গগন, ওকে দেখে বিরক্ত গলায় শাস্ত্রী বলে “তোর পাগলাচোদা ছেলেকে এবার জুতোব, বেমক্কা এসে হাজির হয় খালি” মা আস্তব্যস্ত হয়ে বলছে শাড়ি পরে নিচ্ছে, আর বলছে ‘অমন করে বলুনি, পাপ হবে, তোমারও কি ছেলে নয়?” (পৃঃ ৩৪০) |
১। ‘নরকের আগুন কেমন হয়? ভাবছিল গগন। সে ভেবে ভেবে একটা নরকের ছবি আঁকল। মাঝখানে যজ্ঞবেদি যেমন আছে থাক, ও চারদিক ঘিরে ঘিরে আগুনের বেড়া আঁকল। আগুন নাচতে নাচতে এগিয়ে যাবে মাঝখানে, যেন রাসমঞ্চ ঘিরে ষোলোহাজার গোপিনীর নাচ। বাবার আদর, বাবার আদর। ছেলেও তো বাবাকে আদর করতে পারে, নাকি?’ (পৃঃ ৩৪০)
২। ‘তার চোখে পড়ে তক্তপোশের নীচে একটা কেরোসিনের বোতল … খাটের তলাতেই একটা অগুরুর শিশি পায়। … একটা ছোট্ট পেপসির বোতলে মাপ করে মেশাল দুটো, তার পর কোঁচড়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল।’ (পৃঃ ৩৪০) … ‘মাথায় বাঁধা লাল পাগড়ি দুলিয়ে হাসেন তিনি। ধীরে ধীরে মারণ উচাটন মন্ত্রের মধ্যে ডুবে যায় তাঁর চেতনা। গগন কখন দরজা আলতো খুলে কী ছুঁড়ে দেয় খেয়াল করেন না তিনি। (পৃঃ ৩৪১) |
যদি পাঠক এই বই সম্পর্কে আমার সাংস্থানিক বিশ্লেষণ পড়ে থাকেন, তাহলে লক্ষ করবেন যে মূলত একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে তৃষ্ণা বাম থেকে তৃণমূল আমল পর্যন্ত বাঙালি জীবনে এক ধরনের হ্বেবারীয় ‘disenchantment’-এর ছবি এঁকেছেন। তাঁর মনে সংশয় হতে পারে, এটা করা আদৌ সম্ভব কিনা। আমার মতে, যায়।
প্রথমত, উর্দু সাহিত্যিক হরচরণ চাওলার ভাটকে হুয়ে লোগ উপন্যাসে একটি চড়ুই তাঁর পড়ার টেবিলে রাখা আয়নায় মুখ দেখে দেখে আত্মরতিতে ক্লান্ত হয়ে একদিন আয়নার পেছনে গিয়ে অস্বচ্ছ লালের পোঁচে ঢেকে থাকা বাস্তবতাকে ধরে ফেলে। আর চাওলা তখন প্রশ্ন করেন— কবে আমরা এই বিভ্রম এবং মিথ্যে মানের ছায়াচ্ছন্ন জগৎ থেকে মুক্তি পাব?[35] এখানে তৃষ্ণা একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পাঁচতারা মানকে ‘deconstruct’ করে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙালির এই আত্মরতিকে ভেঙে দিতে চেয়েছেন। তাঁর মনে ছিল বোধহয় সুধীন্দ্রনাথ দত্তর ‘উটপাখি’ কবিতার ওই দুটি লাইন—
তাই অসহ্য লাগে এ আত্মরতি,
অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
দ্বিতীয়ত, রমাপদ চৌধুরী তাঁর ভারতবর্ষ গল্পে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কেবল সেনা-গমনাগমনের সুবিধার জন্য সৃষ্ট একটি ফৌজি স্টেশন ‘বি এফ থ্রি-থার্টিটু’ বা ‘আণ্ডাহল্ট’-এর পাশের অনামা মাহাতোদের গ্রামের অধঃপতনের মধ্যে গোটা ভারতবর্ষের মূল্যবোধের অবনমনের ছবি এঁকেছিলেন।[36] আর মালয়ালি লেখক সঞ্চারিয়া এক যীশুপুরম পাবলিক লাইব্রেরির মধ্যে নিজের এবং সমগ্র ভারতবাসীর অস্তিত্বকে দেখতে পেয়েছিলেন। ‘এই লাইব্রেরির ভবিষ্যতের ওপর’ তাঁর ‘অস্তিত্ব নির্ভর করছে’। তিনি জানেন, ‘লাইব্রেরির একজন আজীবন সভ্য হওয়ার সময় থেকেই আমার আয়ু আর এই লাইব্রেরি এক অচ্ছেদ্য বন্ধনে বাঁধা পড়েছে।’ আর ‘লাইফ মেম্বারদের এক সভায়’ বলা এক ‘প্রবীণ আর অভিজ্ঞ ব্যক্তি’র এই আপ্তবাক্য তিনি হৃদয়ে রেখেছেন— ‘এই লাইব্রেরি যদি চিরদিনের জন্য বেঁচে থাকে, [তবে] আজীবন সভ্য হিসেবে আমরাও যে এই লাইব্রেরির সঙ্গে বেঁচে থাকব, সে কথা কি কেউ বলতে পারে? … আমরা আজীবন সভ্যরা [যদি] শারীরিক আর মানসিক প্রস্তুতির [সঙ্গে] চেষ্টা করি, তাহলে এই লাইব্রেরির সঙ্গে আমরাও যে চিরকালের জন্য থাকব না, তা কে দেখতে যাচ্ছে?’ সেটা যে ঘটেনি, তার কারণ অগোছালো, এলোমেলো এই লাইব্রেরি, যার ‘পাগল করা বইয়ের পাহাড়’-এ একটি আলমারিতে পাশাপাশি রাখা পারস্পরিক সম্পর্কবিহীন বিভিন্ন বইয়ের প্রাপনীয়তা নির্ভর করে কেবল ‘ওই স্থানে থাকা বেয়ারার’ উপর। সেখানে ‘এক একটা আলমারি এক একটা “প্রপঞ্চ”’, এমনকি যেখানে হাজির ‘বহির্বিশ্বের সবরকম বৈচিত্র্য নিয়ে কাগজ আর শেলফের প্রপঞ্চ’। তার ‘রেফারেন্স বিভাগ’-এর ‘বৃহৎ কামরা’টি ‘বছরের পর বছর বইয়ের পাহাড় এবং অন্ধকার জমে এখন একটি ছোট্ট ঘরে রূপান্তরিত’, আর ‘আজ সকালে’ সেখানে ‘রেফারেন্স বিভাগের সেই কেরানিটি গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে।’[37]
একটু বেশি বলে ফেললাম। আসল কথাটাই বলা হয়নি—
পাঠক, নিজেকে সমৃদ্ধ করতে মায়াবাস্তব আর বাস্তবতায় মেশা এই বইটি অবশ্যই পড়ুন।
বাহবা হে মহান লেখক।

[1] Sen Gupta, Bhabani. ‘The Political Novel in Bengal’, in Yogendra K. Malik (Ed.), Politics and the Novel in India. New Delhi. Orient Longman. 1978. Originally Leiden: EJ Brill. 1975. pp. 86-93.
[2] শাস্ত্রী, আচার্য চতুর্সেন। বগুলে কা পঙ্খ। দিল্লি: রাজপাল অ্যান্ড সন্স। ১৯৬০।
[3] Shevade, Anant Gopal. भगण मंदिर (Bhagna Mandir, 1960); Prabhu, Jaideep A. 5 Hindi Books Nehruvians Pretend Weren’t Written. Swrajya, May 09, 2015. Updated Feb 11, 2016. Accessed Jan 22, 2025.
[4] বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকুমার। সাহিত্যকোষ ও কথা সাহিত্য। (সঃ) অলোক রায়। প্রথম সংস্করণ: ১৯৬৭। পৃঃ ১৯৬-৯৭।
[5] রায়, সাবিত্রী। স্বরলিপি। কলিকাতা: বেঙ্গল পাবলিশার্স। ১৯৫২। পরে, সাবিত্রী রায় রচনাবলি ১। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং। ২০২৪।
[6] দাশ, জীবনানন্দ। জলপাইহাটি। কলকাতা: ঐতিহ্য। ২০১৭।
[7] সান্যাল, নারায়ণ। বকুলতলা পি.এল. ক্যাম্প। কলকাতা: করুণা প্রকাশনী। ১৯৫৫; সান্যাল, নারায়ণ। বল্মীক। কলকাতা: বেঙ্গল পাবলিশার্স। ১৯৫৮।
[8] বন্দ্যোপাধ্যায়, অতীন। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে। কলকাতা: করুণা প্রকাশনী। ১৯৭১।
[9] গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল। অর্জুন। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স। ১৯৭১; গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল। পূর্ব-পশ্চিম। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স। ১৩৯৫/১৯৮৮।
[10] ঘোষ, শঙ্খ। সুপুরিবনের সারি। কলকাতা: অরুণা। ১৩৯৭/১৯৯০।
[11] Ghosh, Amitav. The Shadow Lines. London: Bloomsbury. 1988.
[12] সেন, অভিজিৎ। স্বপ্ন ও অন্যান্য নীলিমা। কলকাতা: দে’জ। ২০০২।
[13] পিতামহী-র জন্য দেখুন শান্তা সেন-এর জন্ম জন্মান্তর, কলকাতা: গাঙচিল, ২০০৯, যেখানে এই উপন্যাসটি ‘জন্মের মাটি’ উপন্যাসের সঙ্গে এক মলাটে বেরিয়েছিল।
[14] এই বক্তব্যটি ও প্রকাশনাকাল ও বিষয়োল্লেখ ব্যতীত সঙ্গের বইগুলি উল্লেখিত আছে এই বইটিতে— শিকদার, অশ্রুকুমার। ভাঙা বাংলা ও বাংলা সাহিত্য। কলকাতা: সাহিত্যলোক। ২০০০। পৃঃ ৯৪-৯৭।
[15] প্রফুল্ল রায় রচনা সমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড। কলকাতা: দে’জ। ২০০৩।
[16] সান্যাল, নারায়ণ। অরণ্যদণ্ডক। কলিকাতা: গ্রন্থপ্রকাশ। ১৯৬১।
[17] Ghosh, Amitav. Hungry Tide: A Novel. New York: HarperCollins. 2004.
[18] টীকা ১৫, পৃঃ ১৮, ২০, ৪৭।
[19] বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক। ফেরিওলা। কলকাতা: ক্যালকাটা পাবলিশার্স। ১৩৬০, ১৩৬২, ১৯৫৩/১৯৫৫।
[20] বসু, সমরেশ। যুগ যুগ জিয়ে। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স। ১৯৮১।
[21] বসু, সমরেশ। শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে। কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স। ১৯৮৪।
[22] Rudolph, Lloyd I. & Rudolph, Susanne Hoeber. In Pursuit of Lakshmi: The Political Economy of the Indian State. Paperback Edition. Chicago: University of Chicago Press. 1987. pp. 225-246.
[23] রায়, অসীম। গল্পসমগ্র। কলকাতা: দে’জ। ২০১৭।
[24] মিশ্র, সুবিমল। ‘হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া অথবা সোনার গান্ধীমূর্তি’, বইসংগ্রহ—১ (অ্যাণ্টি-গল্পসংগ্রহ)। কলকাতা: গাঙচিল। ২০১২। পৃঃ ১৭-১৯।
[25] ঘোষ, গৌরকিশোর। পশ্চিমবঙ্গ এক প্রমোদ তরণী, হা হা, গল্পসমগ্র। কলকাতা: আনন্দ। ২০০৩। পৃঃ ৩২৪, ৩৪৩-৩৭০, ৪০১-৪১৬। ভদ্র, গৌতম। রূপদর্শী: সংগ্রহ ১। ভূমিকা।
[26] ভাদুড়ী, সতীনাথ। ঢোঁড়াই চরিত মানস, প্রথম ও দ্বিতীয় চরণ একত্রে। নতুন সংস্করণ, পঞ্চম মুদ্রণ। কলকাতা: বেঙ্গল পাবলিশার্স। ১৪০৩/১৯৯৬। পৃঃ ২৬-২৮।
[27] Kothari, Rajni. ‘The Congress ‘System’ in India’. Asian Survey 4:12. December 1964. pp.1161-1173; Kothari, Rajni. Politics in India. Hyderabad: Orient Longman. 1970. pp.191-97.
[28] দ্রষ্টব্য, Chakravarti, Sudeep. Bengalis: A Portrait of a Community. New Delhi: Aleph. 2017. এছাড়াও Chakraborty, Mridula Nath (ed.). Being Bengali: At Home and in the World. London and New York: Routledge. 2017.
[29] বাইবেলীয় বা জয়েসীয় অর্থে নয়, [দ্রষ্টব্য, MacDuff, Sangam. Panepiphanal World: James Joyce’s Epiphanies. University Press of Florida. 2020. আর Sramkova, Barbora. Epiphany as a Mode of Perception: The Origin of Joyce’s “Ulysses”. Bavaria: GRIN Verlag. 2006.] এর গোদা বাংলা অর্থে— অর্থাৎ কোনও জিনিসের, যেমন অজিতের ক্ষেত্রে বাঙালির আদি মহত্বের অবনমনের বা বিপ্লবের আদর্শ থেকে পতনের— বোধের আত্যন্তিক ঝলকানি।
[30] এটিও বাইবেলীয় বা ভগবদগীতা-র ‘বিশ্বরূপ’ অর্থে নয়, বরং কোনও জিনিসকে prophetic revelation হিসেবে দেখার অর্থে।
[31] এই শব্দদ্বয় আমি নিয়েছি Nandy, Ashis “The Making and Unmaking of Political Cultures in India”, in Nandy, At the Edge of Psychology: Essays in Politics and Culture, Delhi: Oxford University Press, 1993, pp.57-62 থেকে।
[32] দেখুন To Carlo Linati, Sep 21, 1920. [In Italian]. Paris. in The Writing of Ulysses: Letters of The Atlantic. Apr 1957 issue. accessed Sep 7, 2024.
[33] দেখুন ‘Introduction’, by Catherine Flynn, in (ed.) Flynn, Catherine. The Cambridge Centenary Ulysses: The 1922 Text with Essays and Notes. Cambridge: Cambridge University Press. 2022. pp. 12-14.
[34] Anderson, Benedict. Imagined Communities: Reflections on the Origins and Spread of Nationalism, fourth impression. London: Verso. 1983. pp. 28-31.
[35] Chawla, Harcharan. Adrift (1999). [tr] Ratan, Jai. New Delhi: National Book Trust, India. 2003. pp. ix-x.
[36] চৌধুরী, রমাপদ। ‘ভারতবর্ষ’, যত্র (সঃ) বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র। আধুনিক ভারতীয় গল্প ৪। কলকাতা: ভূর্জপত্র। ১৯৯১। পৃঃ ৬৮-৭৭।
[37] সঞ্চারিয়া। ‘যীশুপুরম পাবলিক লাইব্রেরির বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ’। (সঃ) মুকুন্দন, এম.। একালের মালয়ালম গল্পগুচ্ছ। নয়াদিল্লি: ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, ১৯৯৩। পৃঃ ১২৬-৩৩, অত্র ১২৬-২৮।

