মনোজ কুমার গোস্বামী
মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ: বাসুদেব দাস
১৯৬২ সালে আসামের নগাঁও জেলায় গল্পকার, লেখক, সাংবাদিক মনোজ গোস্বামীর জন্ম। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র শ্রীগোস্বামী অসমের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র ‘নতুন দৈনিক’, ‘আজির বাতরি’, ‘আমার অসম’, ‘দৈনিক জনসাধারণ’ ইত্যাদি পত্রপত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে ‘আমার অসম’ পত্রিকার মুখ্য সম্পাদক। ‘সমীরণ বরুয়া আহি আছে’, ‘মই রাজেন বরুয়াক সমর্থন করো’, ’এলুমিনিয়ামর আঙ্গুলি’ লেখকের অন্যতম গল্প সঙ্কলন। ‘ভুল সত্য’ গল্পগ্রন্থের জন্য ২০২২ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
এক.
স্থান: চড়াইমারি থানা
সময়: দুপুরবেলা
এসআই গগৈ: নাম কী?
আরিজ: স্যার আরিজ।
—সম্পূর্ণ নাম?
—আরিজ আলম স্যার!
—হুঁ, ঘড়িটা কোথায়? মারাদোনার ঘড়িটা কোথায়? শোন, উল্টাপাল্টা কথা বলবি না। আমার মুড ভালো নয়। নানারকম ঝামেলার মধ্যে আছি। সোজাসুজি বলে দে ঘড়ি কোথায় রেখেছিস?
—স্যার, কতবার বলেছি মিছামিছি আমাকে ধরে এনেছেন। স্যার, আমি দুবাইতে কাজ করছিলাম। বাড়িতে ফিরে এসে সেদিন গলির মাথায় আড্ডা দিচ্ছিলাম। সঙ্গে্র ছেলেরা জিজ্ঞেস করছিল দুবাইতে কী করছিলি, কী এনেছিস। আমি এমনি বাহাদুরি মেরে বললাম, আমার সঙ্গে মারাদোনার দেখা হয়েছিল, একদিন তিনি আমার কাজ পছন্দ হওয়ায় নিজের ঘড়িটা গিফট দিলেন। সেই কথাটাকেই স্যার আমি ঘড়ি চুরি করে এনেছি বলে…
—চুপ, এই সমস্ত আজেবাজে কথা বাপকে গিয়ে শোনাবি। এই যে মিডিয়াতে বেরিয়ে গেল, হাহাকার লেগে গেল যে তুই মারাদোনার ঘড়ি চুরি করে এনেছিস? হীরা লাগানো তিন কোটি টাকার ঘড়ি? এইসব কি এমনিতে বেরিয়েছে? শালা, দুবাই কেন গিয়েছিলি? কী লিঙ্ক? আমি শালা মুম্বাই দেখিনি, তুই দুবাই পৌছে গেলি?
—স্যার, আমাকে এজেন্ট নিয়ে গিয়েছিল, ওয়েল কোম্পানিতে চাকরি দেবে বলে। সেখানে গিয়ে দেখি লেবারের কাজে লাগিয়ে দিল। প্রথম দুই বছর আমার হাত থেকে পাসপোর্ট নিয়ে রেখে দিয়েছিল…
—ফালতু কথা বন্ধ কর, ঘড়ির কথা বল। কোথায় রেখেছিস ঘড়ি? মারাদোনার ঘড়িটা কোথায়? জলদি মুখ খোল ব্যাটা, নাহলে এনকাউন্টার হয়ে যাবি।
—স্যার আপনি আমার রেকর্ড দেখুন। আমার পরিবার দাদু-ঠাকুরমার দিন থেকে চড়াইমারিতে আছে, অনেক মানুষ আমাদের পরিবারকে চেনে জানে। স্যার কেউ ভুল খবর দিয়েছে।
—দুবাই কন্টাক্ট দে, এজেন্টের কন্টাক্ট দে। তুই শালা মরবি।
দুই.
স্থান: ডিএসপির অফিস
সময়: সকালবেলা
ডিএসপি পাঠক: কনগ্রাচুলেশন বৈশ্য। আপনার থানার নাম ন্যাশনাল মিডিয়ায় বেরিয়ে গেছে! চারদিকে হাহাকার। ঘড়িটা কোথায়?
ওসি (চড়াইমারি): আরিজ বলছে সে নাকি ঘড়ি-টড়ির কথা কিছুই জানে না। সে নাকি মারাদোনার থাকা গেস্ট হাউসে গার্ডেনার মানে মালির কাজ করত। মাঝেমধ্যে দূর থেকে মারাদোনাকে দেখেছিল। পেছনদিকের লনে নাকি মারাদোনা কখনও কখনও জগিং করে, সিকিউরিটি কাউকে কাছে যেতে দেয় না।…
—কিন্তু এই যে মিডিয়ায় বেরিয়ে গেছে আরিজ দুবাইর জুমেরিয়া ভিলার হাউসকিপিঙের সঙ্গে জড়িত ছিল। সেখান থেকেই সে মারাদোনার ঘড়ি চুরি করে পালিয়ে এসেছে?
—স্যার এত ডিটেলস কিছুই পাওয়া যায়নি। আরিজ তার এজেন্টের নাম্বার দিয়েছে। আউট অফ সার্ভিস। আরিজ বলেছে এজেন্টের সঙ্গে দুবাই গিয়ে পৌঁছানোর দুই-তিন বছর পরে নাকি সমস্ত ধরনের যোগাযোগ নাই হয়ে গেছে। এজেন্টের প্রোফাইলটা ট্র্যাক করছি স্যার।
—হুঁ, থার্ড ডিগ্রি দিয়ে দেখুন কিছু কথা বের হতে পারে।
—করা হয়েছে স্যার। একই কথা বলে।
ডিএসপির ফোন বাজে। ওপাশে এসপি।
ডিএসপি পাঠক: গুড মর্নিং স্যার। স্যার… স্যার… স্যার হ্যাঁ স্যার। দুবাই পুলিশ? হ্যাঁ স্যার। দেখছি স্যার, ন্যাশনাল মিডিয়া, টিভিনিউজ, পেপার সবগুলিতে বেরিয়েছে। হ্যাঁ স্যার চুরি তো আমাদের এখানে হয়নি, আর আমরা তো অলরেডি কালপ্রিটকে অ্যারেস্ট করেছি। স্যার… স্যার… স্যার…
ফোন রেখে দেয় ডিএসপি।
ওসি: কী বললেন এসপি স্যার?
ডিএসপি পাঠক: স্যার দুবাই পুলিশকে কন্টাক্ট করতে বলেছে। কী যে ঝামেলা।
—স্যার দুবাইতে কী ভাষা চলে? উর্দু না আরবি?
—দাঁড়ান, আরিজের কাছ থেকে জুমেরিয়া ভিলার কেয়ারটেকার ইনচার্জের নাম্বার নিন। সেখান থেকে দুবাই পুলিশের নাম্বার নিন।
—স্যার ইনচার্জের নাম্বার আছে। আরিজ দিয়েছে। এই নিন স্যার!
—আপনি নিজে কেন এতদিন করেননি?
—স্যার আমার নাম্বার থেকে লাগে না। স্যার আমার ফোনে ইন্টারনেসনাল সিস্টেম নেই।
—আপনাকে দিয়ে আর হবে না… (ফোন লাগায়) নাহারক সাইড, নাহারক সাইড… ওকে, থ্যাঙ্ক ইউ!
—কী হল স্যার?
—কী বলল বুঝতেই পারলাম না হে। করছি নাহারক সাইড, নাহারক সাইড বলে কী অদ্ভুত ভাষায় কথা বলছে। আমি থ্যাঙ্ক ইউ বলে রেখে দিলাম…
—স্যার আপনার ইনশাল্লাহ মাশাল্লাহ বলা উচিত ছিল।
—কেন?
—স্যার ইনশাল্লাহ মাশাল্লাহ সব জায়গায় চলে।
—এই রাখুন তো আপনার ইনশাল্লাহ-মাশাল্লাহ! মানুষ ধরেছেন, ঘড়ি নয়। সারা দেশ এখন আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যান ঘড়ির খোঁজ নিয়ে আসুন এবং প্রমোশন নিন।
—না হলে স্যার?
—না হলে আরিজ আমাদের জিম্মা থেকে পালিয়ে যেতে চাইবে, পুলিশের কাছ থেকে পিস্তল কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে, আমরা বাধা দিতে চেষ্টা করে নিরুপায় হয়ে গুলি করতে বাধ্য হব।
—জাস্ট অ্যানাদার এনকাউন্টার স্যার।
—হুম।
তিন.
স্থান: চড়াইমারি থানার ওসির রুম
সময়: দুপুরবেলা
এসআই গগৈ— স্যার, ওকে একটা লাস্ট চান্স দেওয়া ভালো হবে।
ওসি— আমাদের ওপরওয়ালা চান্স দেয় না, আমরা অন্যকে কী চান্স দেব! আচ্ছা আরিজের ঘর সার্চ করার সময় কী কী সন্দেহজনক জিনিস পাওয়া গিয়েছিল?
—সেরকম কিছুই না স্যার! দুবাই-দিল্লি ফ্লাইটের বোর্ডিং পাস, একজোড়া দামি স্পোর্টস শু, একটা টাইটান ঘড়ি, ডুপ্লিকেট রেব্যানের একজোড়া গগলস, দুই-তিন প্যাকেট বিদেশি সিগারেট এবং একটা মারাদোনার টি-শার্ট…
—মারাদোনার টি-শার্ট?
—না স্যার, মারাদোনার ছবি আর নাম লেখা টি-শার্ট।
—শুনুন গগৈ, আপনি কেসটার আইও। আর কেসটা এখন ইন্টারনেশনেল পর্যায়ে পৌছে গেছে। কেসটা দ্রুত মীমাংসা করতে পারলে আপনার ক্রেডিট, আমাদের সবার জন্যই ভালো। আর না পারলে এনকাউন্টারের পাপের ভাগী আপনাকেও হতে হবে। সঙ্গে আমাকেও।
—স্যার, আমার মনে হচ্ছে আমাদের ইনফর্মার ভুল খবর দিয়েছেন। নাহলে এত চড় লাথি খেয়ে আরিজ ঘড়িটার কথা বলে দিত। ঘড়ি চুরি করার জন্য তো আর ফাঁসি বা লাইফটাইম হয় না, সে এটা ভালো করেই জানে!
—মারাদোনা দুবাইতে কী করছিল? আর্জেন্টিনা না ব্রাজিলের প্লেয়ার ছিল যেন?
—আর্জেন্টিনার স্যার। বিশ্বকাপ জিতেছিল তার ক্যাপ্টেনশিপে!
—বাঃ আপনার জিকে ভালো! আরিজকে নিয়ে আসুন।
দুজন কনস্টেবল হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে আরিজকে নিয়ে আসে।
ওসি— বাবা আরিজ। ঘড়িটা বের করে দে, নাহলে তোর সময় শেষ।
আরিজ— স্যার, মারাদোনার ঘড়ি চুরি করার মতো আমার সুযোগ কোথায়? আমি গার্ডেনে কাজ করি। ছয়-সাতজন সিকিউরিটি অনবরত মারাদোনার সঙ্গে। হাউসকিপিঙের লোকদের একা ছেড়ে দেয় না। আর স্যার, দুবাইর আইন আমাদের এখানকার মতো নয়, চুরি করলে স্যার ঝুলিয়েও দিতে পারে, কিছুই ঠিক নেই— ইসলামিক ল স্যার। আমি মিছামিছি মরতে কেন যাব?
—মরা না-মরাটা আমি দেখে নেব। বল তো, এই মারাদোনা ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা থেকে দুবাই কেন এসেছিল? নিজের জায়গায় কীসের অভাব ছিল?
—স্যার, মারাদোনা দুবাই স্পোর্টসের ব্রেন্ড আম্বাসাডার হয়ে এসেছিলেন। কোটি কোটি ডিরহামের চুক্তিতে। মাঝে মাঝে ফুটবল প্লেয়ারদের ট্রেনিং দিত। জুমেরিয়া ভিলায় শেখরা তার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেখানে আমি গার্ডেনারের কাজ করতাম। আমি কাছ থেকে তাকে ভালো করে দেখিইনি, মিছামিছি আপনারা আমাকে মারধর করছেন।
—ডিরহাম মানে কত?
—এক ডিরহাম ভারতীয় কুড়ি-একুশ টাকার সমান!
—আমাদের এত কম? হু, গগৈ আপনি কি বুঝতে পারলেন? ও দুবাইয়ে লেবারের কাজ করে, আর দামি দামি জিনিসপত্র কিনছে। ওর ফরেন ফান্ডিং আছে…
এসআই গগৈ— স্যার ভুলেই গিয়েছিলাম। ওর বাড়িতে দুবাইর চারটে কারেন্সিও পেয়েছিলাম। আমি সিজার লিস্টে দিয়েছিলাম।
আরিজ— স্যার, চারটে নোট মিলিয়ে আমার এক হাজার টাকাও হবে না! সেগুলি এনেছিলাম বাড়ির সবাইকে দেখানোর জন্য!
ওসি— এই চুপ! এখন আমার মাথাটা গরম করবি না। তুই নিজে তো মরবি, আমাদেরও মারবি। গগৈ, ওর সঙ্গীদের ধরে নিয়ে আসুন, সবাইকে আলাদাভাবে ইন্টেরোগেট করুন!
ওসির ফোন বাজে।
ওসি— হ্যাঁ স্যার, আছি স্যার, থানায় স্যার। ইয়েস স্যার, চিন্তা করবেন না স্যার! (ফোন রাখে)। গগৈ এটাকে লকআপে ঢুকিয়ে দিন।
আরিজকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হল।
এসআই গগৈ— কী হল স্যার?
ওসি— এনকাউন্টার হবে না। মিডিয়া এসপি স্যারের কাছে ভিড় করেছে। আরিজের ইন্টারভিউ চাই। মারাদোনার ঘড়ির ডিটেলস চাই। একজন বাইরের সাংবাদিক নাকি জিজ্ঞেস করছে, ঘড়িটার আসল তথ্য না জানিয়েই আরিজের এনকাউন্টার হয়ে যাবে না তো? তাই এই কয়েকদিন এসব কিছু হবে না। লকআপে তাকে খাইয়েদাইয়ে রাখুন আর কি!
চার.
স্থান: এসপি বাংলো
সময়: সন্ধ্যাবেলা
এসপি— এক মাস হতে চলল আপনারা একটা ব্রেক থ্রু করতে পারলেন না। এদিকে সব সময় মিডিয়ার মানুষ আমার অবস্থা খারাপ করে তুলছে। আপনি তো মারাদোনার ঘড়ি চুরি করা আরিজকে ধরা হল বলে খুব ক্রেডিট নিলেন, এখন বলুন ঘড়িটা কোথায়? দিল্লি থেকে মিডিয়ার কয়েকজন নাকি দুবাই যাচ্ছে, কী যে হবে ঠিক নেই আর আপনারা তো নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন!
ডিএসপি পাঠক— স্যার, কোনও কিছুই করতে বাকি রাখিনি। আজিজের সঙ্গের ছেলেদের ধরে এনেছি। বাড়ির কোনও মানুষই বাদ যায়নি। কিন্তু কোনও ক্লু নেই।
ওসি— আর স্যার, আরিজকে এমন থার্ড ডিগ্রি দেওয়া হয়েছে যে বড় বড় অপরাধীরাও স্বীকারোক্তি করতে বাধ্য হবে। কিন্তু আরিজ তো একই কথার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে!
এসপি— এই সমস্ত ছেলেমানুষি বাদ দিন, কাল বস ফোন করে আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করল। এখন একটাই রাস্তা— এনকাউন্টার। না হলে আমাদের মান-সম্মান সব যাবে।
ডিএসপি পাঠক— স্যার আমরাও সেটাই ভাবছি, শুধুমাত্র আপনার গ্রিন সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করছি। শুভস্য শীঘ্রম স্যার। আজ রাতেই…
এসপির ফোন বাজে, ঘরে খানিক নীরবতা।
এসপি— হ্যাঁ স্যার, ঠিক আছে স্যার। না না স্যার, আমি ম্যানেজ করে নেব (ফোন রাখে)।
ডিএসপি পাঠক/ওসি— কী হল স্যার?
এসপি— প্রাইম মিনিস্টার মিডলইস্ট ভ্রমণে গিয়েছে। বস ফোন করেছে, পিএম মিডল ইস্টে থাকার সময় কোনও এনকাউন্টার হবে না। ভারতের ইমেজ খারাপ হবে, এই সময় এরকম কোনও স্টেপ নেওয়া যাবে না। যান এখন অন্য চোর-ডাকাতদের ধরুন গিয়ে। আমি মিডিয়ার লোকদের সামলে নিচ্ছি।
ডিএসপি পাঠক/ওসি— গুডনাইট স্যার!
এসপি— আর শুনুন। আইও চেঞ্জ করুন! গুড নাইট!!!
পাঁচ.
স্থান: চড়াইমারি থানার লকআপ
সময়: দুপুরবেলা
আরিজ— ও স্যার! স্যার একটু দেখুন।
এসআই গগৈ— হু! (নড়বড়ে পদক্ষেপ থেকে দাঁড়িয়ে) কিছু মনে পড়েছে কি?
—কী আর মনে পড়বে! মার খেয়ে খেয়ে যা মনে ছিল সেগুলোও ভুলে গেছি। কিছু একটা করে আমাকে বের করে দিন স্যার! আমি মরে যাব স্যার!
—এমনিতেও তুই মরবি। এইবার প্রাইম মিনিস্টার বাঁচিয়েছে, একবার তোকে মিডিয়া বাঁচিয়েছে, একবার আমাদের ফরেন পলিসি বাঁচিয়েছে… কিন্তু কতদিন? গুলি তো তোকে খেতেই হবে। আমি আইও থাকা পর্যন্ত বেঁচেছিলি, এখন তোকে এনকাউন্টার থেকে কে বাঁচাবে?
—স্যার, এনকাউন্টার করে ফেলছেন না কেন? এভাবে বাঁচার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।
—তোর অ্যাডভাইস-মতো আমরা এনকাউন্টার করব নাকি শুয়োরের বাচ্চা?
—স্যার আমার দোষটা কোথায়? কেন এখানে মার খাচ্ছি, কেন লকআপে ঢুকিয়ে রেখেছেন, কেন হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে বারবার কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কেন বাড়ির মানুষগুলোকে এভাবে হয়রানি করা হচ্ছে? কেন বারবার জামিন নাকচ হয়ে যাচ্ছে? স্যার আমাকে এর চেয়ে এনকাউন্টার করে দিন।
—বাবা আরিজ, শোন। শুধু তোর মারাদোনাই নয়, আমরাও একদিন ফুটবল খেলেছি। ডিফেন্সে ছিলাম, বুঝেছিস। গোল দিতে এলে মেরে পা ভেঙে দিতাম। সেই ফুটবল খেলার জন্যই একদিন পুলিশে চাকরি পেলাম। তাই মারাদোনা ফুটবল খেলতে জানত, অ্যাটাক করতে জানত, আমি ফুটবল খেলি এবং পুলিশে থেকে অ্যাটাক ডিফেন্স সব শিখে গেলাম। তোর মতো পুঁটি, খলসে পুঁটি আঙুল দিয়ে পিষে ফেলতে পারি। বেশি স্মার্টনেস দেখাবি…
ছয়.
স্থান: ডিএসপির অফিস
সময়: সন্ধ্যাবেলা
ওসি— স্যার, ডেকেছিলেন?
ডিএসপি পাঠক— হুঁ (ফোন বাজে, ফোনে কথা বলেন) হ্যাঁ স্যার, আমি সামলে নেব স্যার। নো প্রবলেম স্যার (ফোন রাখে)।
—স্যার!
—বলুন, নতুন কী শোনাবেন এবার!
—স্যার, আরিজ মোটামুটি মেনে নিয়েছে।
—কী মেনে নিয়েছে?
—সে মেনে নিয়েছে যে মারাদোনার ঘড়িটা সে চুরি করেছে। ভারতে ফিরে আসার আগেই সে ঘড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে। জানেন স্যার, মানুষ মরতে ভয় করতে না পারে, কিন্তু এই মরব মরব করে বেঁচে থাকাটার ভয় কেউ সহ্য করতে পারে না।
—আর?
—আর স্যার, আপনার এনকাউন্টার থিউরির জয় হল। এনকাউন্টারের ভয়েই আরিজ কনফেস করে দিয়েছে। এখন ওকে স্যার এনকাউন্টার করে দিই, আর পাপ হবে না…
—হুঁ!
—কী হল স্যার?
—শুনুন ওসি সাহেব, আজ দুবাই পুলিশ একটা স্টেটমেন্ট রিলিজ করেছে। সমস্ত মিডিয়ার হাতে হাতে ইতিমধ্যেই দুবাই পুলিশের বিবৃতি। দুবাই পুলিশ ক্লিয়ার করে দিয়েছে, মারাদোনার কোনও ঘড়ি চুরি হয়নি। সেরকম কোনও রিপোর্ট নেই। এটা একটি ভুয়ো প্রচার, ফেইক ক্যাম্পেইন। যাক এসপি বারবার ফোন করেছে আরিজের জামিনের ব্যবস্থা করার জন্য। ইন্টারন্যাশনাল কেস করতে গিয়ে এখন ইন্টারন্যাশনাল বেইজ্জতি না হলেই হল। আর শুনুন…
—স্যার!
—দেখবেন যাতে আরিজ মিডিয়ার সামনে মুখ না খোলে। তাকে বুঝিয়ে বলবেন। পুনরায় বিশৃঙ্খলা না হয় যেন।
—স্যার!
শেষ দৃশ্য
স্থান: রাজপথ
সময়: সন্ধ্যাবেলা
আরিজ আলম ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে। সমস্ত শরীরে দাগ, সমস্ত শরীরে ব্যথা। চোখেও যেন ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। গাড়ি মটরের হেডলাইট চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। অন্ধকার নেমে এসেছে, এখন সময় কত ঠিক বুঝতে পারছে না। ঘড়ির কাঁটা হয়তো তার জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বুকে, মস্তিষ্কে ক্ষয় হওয়া সময়ের কাঁটার মতো কিছু একটা অস্পষ্ট শব্দ— টিক টক, টিক টক, টিক টক…।

