স্মৃতিপরব: পর্ব ৯

নীহারকান্তি হাজরা

 

সানুদেশের দিন

পর্ব ১পর্ব ২পর্ব ৩পর্ব ৪
পর্ব ৫পর্ব ৬পর্ব ৭পর্ব ৮

হাঁড়িদের ঘোড়া পরব

কেবল সাড়ম্বরে দুর্গাপূজা দেখেছি। কালীপুজোর কথা আমার মনে পড়ে না। তবে হাঁড়িদের ঘোড়া পরব দেখেছি। বুকে ঝোলানো চিতল বাজনা নিয়ে একদল লোকের মাঝে একটা ঘোড়া নেচে চলেছে। ব্যাপারটা এরকম— বাঁশের বাতার ওপর কাপড় দিয়ে একটা হুবহু ঘোড়ার আদল। ঘাড়ের কেশর মোরগের পালক। লেজটা কাপড়ের ডগায় গরুর লেজের লোম। ঘোড়াটার পিঠের মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গা। তার ভিতর দিয়ে সওয়ার উঠে দাঁড়ালে ঘোড়ার পিঠ তার কোমরে পড়ে। পায়ে ঘুঙুর বাঁধা। কিন্তু পা দেখা যায় না। হাতে চাবুক। নাচের তালে তালে ঘোড়ার মাথা আর লেজ দুলতে থাকে। এটা দেখার জন্য খুব ভিড় জমত।

এতদিন পরে ভাবি হাঁড়িদের মধ্যে এই ঘোড়া পরব এল কী করে? হাঁড়িরা তো মলগ্রাহী। এই জনপদেও ভদ্রবাড়ির শৌচাগার ওই সম্প্রদায়ের লোকেরাই পরিষ্কার করত। ধর্মমঙ্গলের— ‘আগে ডোম, বাগে ডোম, ঘোড়া ডোম সাজে’— ডোম ঘোড়সওয়ারের ছবি। আবার মনে পড়ে ওই জনপদের থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা জায়গার নাম ঘোড়া ধরার হাট।

আজ এতকাল পরে সেদিনের সেই জনপদটিকে চোখ বন্ধ করে দেখছি, এটির উপরি-কাঠামো তৈরি হয়েছিল একজন আমলাকে ঘিরে: মুনসেফ। একটা বিশাল বড় মাঠের মাঝখানে একটা টিলা। এর মাথাটা কেবল সমতল করে এর উপরেই ওই ব্রিটিশ ঘরানার সৌধ। গাঢ় খয়েরি। ইংরেজি বড় অক্ষরের E-এর মাঝখানটুকু নেই। কাঠের চৌকো ফ্রেমে কাচ লাগানো দরোজা জানালা। তার বাইরে আর একপ্রস্থ খড়খড়ি দেওয়া কাঠের যথাক্রমে হলুদ এবং সবুজ। বিরাট উচ্চতার এই ঘরগুলির পিছনের বড় স্থানটিতে সাহেব বসেন একটা উঁচু তক্তার উপর। নীচে সামনে পেশকার। সাহেবের পিছনের দিকে তাঁর খাস কামরা। তাঁর মাথার উপরে পালিশ করা কাঠের সঙ্গে আড়াআড়ি ঝোলানো একটা মাদুর লাল শালুর বনাতে মোড়া। নীচে একটা চওড়া ঝালর। এটার সঙ্গে একটা দড়ি বাঁধা। এটা ধরে টান দিলেই ঝালর দুলে সাহেবের মাথা ঠান্ডা রাখে। আর যে টানে সে থাকে বারান্দায়। তার নাম পাঙ্খাপুলার। পদটা নাম হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ না আসা পর্যন্ত দেশের বৃহত্তর মফস্বলের সমস্ত প্রশাসনিক ভবনে এরা ছিল অপরিহার্য। মাইনে ছিল ছ-টাকা।

এই সৌধের দক্ষিণে ঢালু বড় হাতার সীমায় সাহেবের আবাস। বাংলো। ছিমছাম। সুউচ্চ। সামনে বাগান। পিছনে সব্জিবাগান। একটা আউটহাউস। সামনে ঢুকেই প্রশস্ত হলঘর। আয়না দেওয়া টুপি রাখার স্ট্যান্ড। এ-পর্যন্ত স্মৃতি সাহায্যে আসে। এবার আর একটা তার ছিট। কোনও এক সাহেবের বোন লিলিদি আমাদের সঙ্গে খেলত আর নিয়ে যেত একতলার ছাদের উপর থেকে উঠে যাওয়া একটা রেলিংবিহীন সিঁড়ি বেয়ে চিলে-ছাদের উপরে। আবার কোনও উৎসাহী মুনসেফ খেলা শুরু করলেন ক্রিকেট। খেলাটা হত তাঁর আবাসের সামনের বিশাল মাঠের একটা টুকরোয়। মাঠের কিনারায় দক্ষিণে সারি সারি উকিলদের নিজেদের বানানো ঘর। মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোণায় সত্যময়রার বাড়ি আর তার তারপরেই বিস্তৃত জায়গা জুড়ে রামকৃষ্ণ আশ্রম। মাঠের পূর্বের সীমারেখা থেকে একটু ভিতরে ডিসপেনসারি। এখানে একজন ডাক্তার বসেন। একজন কম্পাউন্ডার। একজন মেল নার্স। আর দুজন মহিলা। মাঠের উত্তরে খড়ের ছাউনি। ব্যারাকের মতো আবাসন। মনে আছে ওই মেল নার্সটি ছিলেন বিহারি। ডিউটির বাইরে হাফপ্যান্ট পরতেন। ফর্সা। গোঁফটি ছিল দেখার মতো। তাঁর নাম আজ আর মনে নেই। সকলেই তাঁকে দাদা বলতেন। কিশোরদের সকল খেলার, আমোদের, বনভোজনের যাবতীয় বন্দোবস্তের তিনিই ছিলেন কাণ্ডারী।

 

বড় ইস্কুল

রজনী পণ্ডিতের পাঠশালার প্রসারিত চালার পাঠ একদিন শেষ হয়ে গেল। আমার শুরু হল ‘বড় ইস্কুলে’ যাওয়া— ১৯৪৮। এ হেন উত্তরণে আনন্দ বয়ে আনার কোনও ছবি আমার কাছে নেই। ভালো ছাত্র হওয়ারও তেমন কোনও গৌরব আমার ছিল না।

এই পর্বটি শুরু হওয়ার আগেই আমরা চন্দ্রময়রার ঘর ছেড়ে আমাদের নিজেদের ঘরে এসে গেছি। ঘরটি জনপদের পূর্বদিকের শেষ প্রান্তে। মাটির কোঠাবাড়ি। বড় উঠোন। জনপদের বড় রাস্তাটা আমাদের বাড়ির পিছন দিক দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে আমার বিদ্যালয়ে। চারপাশ খোলা একটা বড় মাঠের উপর বিদ্যালয়টি। ঢোকার আগেই বিশাল আকারের তিন-চারটে নিকষকালো পাথর সামনে রেখে আকাশ ছুঁয়েছে এমন তিনটে তেঁতুলগাছ। এর পর লালরঙের টালি মাথায় উঁচু বারান্দার কিনারায় পর পর মোটা থাম-সহ খুব উঁচু এক সারি ঘর। টালির মাঝখানে লেখা BURNPUR। ঠিক এর পিছনে একটি পাঁচিলঘেরা ছোট আবাস, যেখানে কখনও কেউ ছিলেন না। একটু এগিয়ে বিশাল মাঠের বাঁদিকে অনুরূপ একসারি ঘর। এরই পূর্বদিকে একটু এগিয়ে এরকম আরও একটি। এই কক্ষগুলির একটিতে বসতেন হেডমাস্টারমশাই, একটিতে শিক্ষকেরা আর একটিতে কয়েকটি আলমারি ভর্তি বই। লাইব্রেরি। এর পিছনে মাঠ ক্রমশ নীচু, সবুজ, আরও গাঢ় সবুজ, তারপর ঘন উড়িধানের হলুদ-সবুজ চারাগুলির ভিতর দিয়ে একটি জলাশয়, থমকে আছে মাথায় একটা বড় চাকলতা গাছ ধরে থাকা খুব উঁচু পাড়ের গায়ে: ছোট বাঁধ। এটিই রাজাধিরাজ, সুকুমার ধবল সাহাজাদা দেবের আনন্দে লেজ দুলিয়ে চলা ঘোড়াটির চারণভূমি। বিদ্যালয়ের মাঠটির দক্ষিণ-পূর্বপ্রান্তে একটিই বাঁধানো কুয়ো। এটিতে সংলগ্ন থাকত পাটের মোটা দড়িতে বাঁধা একটি বালতি। ছাত্রদের স্বাবলম্বনই ছিল জল তুলে তৃষ্ণা নিবারণের উপায়। কুয়োটির পাশ দিয়ে একটি পায়ে চলার পথ ডাঙা-মাঠের উপর দিয়ে চলে গেছে পূর্বে। আধ মাইল গেলেই বনভূমি এবং মশক পাহাড়কে পূর্ব-মাথায় রেখে খুবই উঁচু পাড় ঘেরা একটি গভীর জলাশয়: অসংখ্য পানকৌড়ির ডুব-সাঁতার খেলার বড় বাঁধ। আর কুয়োটির কাছে দাঁড়ালেই যে দৃ্শ্য স্পষ্ট— পূর্ব-দক্ষিণে পা আর দেহের মাঝখান এলিয়ে দিয়ে মনোরম নানারং হরিয়ালি ঢাকা লেদি পাহাড়। আর তার দক্ষিণ কোল জুড়ে নানা আকারের পাথরের ঢালু কিনারা ধরে চাকবন্দি ঘন সবুজ ঘেরা সাঁওতালি গ্রাম। এ-হেন সঘন নির্জনতায় শ্রেণিকক্ষে দেওয়া শিক্ষকদের পাঠদান আলাদা হয়ে জেগে থাকত।

আমি এখানে তিন বছর পড়েছি। ছাত্র হিসেবে গৌরব করার আমার কিছুই ছিল না। তবে প্রথম বেঞ্চে বসার অধিকার পেয়েছিলাম। স্কুল ছিল সহ-শিক্ষার। বালিকারা শিক্ষকের পাশে আড়াআড়ি বেঞ্চে বসত। ছাত্রদের জন্য একটা মাটির বোর্ডিং-মেস ছিলে। স্কুল থেকে বেশ খানিকটা দূরে, একটা বেশ বড় মাঠ আর কয়েকটা গোডাউনের পাশে। এখানে কয়েকটা ঘরে শিক্ষকেরাও থাকতেন। তাঁরা এখানে সকালবেলা সামান্য অর্থে কোচিং দিতেন।

আমাদের ইংরেজি পড়াতেন প্রফুল্লবাবু। তিনি ছিলেন উৎকল শ্রেণির ব্রাহ্মণ। স্কুলের কাছেই ছিল তাঁর বাড়ি, আর তার সঙ্গে ছিল বেশ বড় গোয়াল। তাতে ছিল তাঁর তিনটে মোষ, একটা গরু আর ক-টা বাছুর। ছুটির দিন সকালবেলা আর অন্যদিন স্কুলছুটির পর তিনি স্কুলের পিছনের মাঠে এগুলি চরাতেন। তাঁর সকালবেলার আহার ছিল এক সের দুধ, কিছু চিঁড়ে আর তার সঙ্গে পোস্তর তরকারি। চেহারাটা আজও মনে আছে। খাটো ধুতিপরা, গায়ের রং গোলাপী, আর বেশ বলশালী, দীর্ঘকায়। চরানোর কালে মোষগুলোকে মারধর করার পর ছাত্রদের জন্য আর কিছু হাতে থাকত না।

এ-সময় একজন নতুন হেডমাস্টার এলেন। তিনি এমএ। আজ আর তাঁর নাম মনে নেই। চেহারাটা মনে আছে। বেশ লম্বা। স্বাস্থ্যবান। শ্যামলা রং। প্যান্ট-শার্ট আর কালো রঙের বুট পরতেন। কথায় ছিল আনকোরা পূর্ববঙ্গের টান। আর রেগে থাকতেন সবসময়। এতদিনের চলে আসা ছাত্রদের কোলাহলকে তিনি মনে করতেন ষড়যন্ত্র। লতিয়ে যাওয়া পিচ্ছিল শব্দের একটানা তিরস্কার আর বেত্রদণ্ডই ছিল তাঁর শাসনব্যবস্থা অনুশীলনের হাতিয়ার। ছাত্ররা তাঁর উচ্চারণ নকল করত। আর এমন করার কালে উঁচু ক্লাসের এক ছাত্র তাঁর সামনে এসে পড়ে। ছাত্রটির নামও আমার মনে আছে— করালী হালদার। চক্ষু গোলাকার করে হেডমাস্টারমশাই তার পিঠে বেত্রদণ্ডটি ভাঙলেন। এর মধ্যে সবগুলি ক্লাসের ছাত্ররা এই দ্বৈরথকে কেন্দ্রে রেখে একটি বৃত্ত রচনা করে ফেলেছে। এটাতে তাঁর সম্মান হারাবার আশঙ্কায় তিনি করালীর চুল ধরে শূন্যে তুলে ধরার চেষ্টায় বিফল হয়ে তার জামাটা ছিঁড়ে ফেললেন। করালী তখনও তাঁকে তাঁরই ভাষা ফিরিয়ে দিয়ে চলেছে। এবার তিনি তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে টেনে নিয়ে চললেন তাঁর অফিসঘরে। জয়ের সাফল্যে করালীর উন্মুক্ত পিঠে সবুট পা রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেক অনেক পরে বাঘের পিঠে পা রেখে শিকারিদের ছবি দেখলেই এই ঘটনা মনে পড়ে যেত।

ঘিরে ফেলা ছাত্রদের বৃত্তের মধ্যে মাথাটা কোনওরকমে গলিয়ে এ-দৃশ্য দেখার সুযোগ ঘটেছিল। পরের ঘটনাও ঘটল আশ্বিনের ঝড়ের মতো। হেডমাস্টারের শাস্তি চাই। এই প্রথম আমার স্লোগান শোনার অভিজ্ঞতা হল। স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। কতদিন বন্ধ ছিল আজ আর মনে নেই। কিন্তু হেডমাস্টারমশাই চাকরি খুইয়ে চলে গেলেন।

স্কুলে শীতকালে স্পোর্টস হত। এটির দায়িত্বে ছিলেন সুদর্শনবাবু। তিনি ড্রয়িংয়ের ক্লাসও করাতেন। আর নিত্য একটা মোটা ডালের উপরে একটা ফুল এঁকে বলতেন কাঁটালিচাঁপা। বহু পরে সবুজ পাপড়ির আঙুল গোঁটানে কাঁটালিচাঁপা আর তার গাছ দেখে মাস্টারমশাইয়ের জন্য আমার মন কেমন করত! তাঁর উপর একটা বাড়তি দায়িত্বও ছিল— ‘স্বাস্থ্য-সাধনা’ বইটি পড়ানো। তিনি নিয়মিত ছাত্রদের নখ পরীক্ষা করতেন। আর ক্লাসে গভীর শব্দ তুলে লম্বা নিঃশ্বাস টানতেন আর তারপর গুম হয়ে যেতেন। এটা দু-চারবার করলেই ঘন্টা পড়ে যেত। একবার স্পোর্টসে থ্রি-লেগড রেস-এ নাম দিয়েছিলুম। যে সহপাঠীর ডান পায়ের সঙ্গে আমার বাঁ পা বেঁধে দৌড়নো অভ্যাস করতুম তার পদবীটি মনে আছে— শূর। সে বলেছিল তার বাবার কাছে শোনা যে তারা একদিন বাংলাদেশের রাজা ছিল। আর সে রোজ ফেনাভাত খেত। ঠিক কার্যকালে হুইসল পড়ার সঙ্গে দৌড় দেওয়ার শুরুটুকু মনে আছে। আমার চিৎপাত অবস্থায় শূর আমাকে চুনের দাগের সীমা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছে। চোখ খুলে দেখি রাধুবাবু লাঠি হাতে তেড়ে আসছেন। পালাবার উপায় নাই। পা-বাঁধা। আর ঠিক সে-সময়টিতে শূর যদি ‘বাবা গো মাগো, মেরে ফেললে গো’ বলে গগনভেদী আর্তনাদ না করত তাহলে রাধুবাবু গোঁটানো কোঁচা আর নামাতেন না। যতদিন এক শ্রেণিতে ছিলাম শূরের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলাম। শূর আমাকে বলেছিল ‘তুই কী রে, বিশুদার শিক্ষাটা তোর মনে নেই?’ আজ লিখতে গিয়ে চোখে জল আসে, এতদিনের আকাশের নীচে সেই শূর এখনও হাঁটছে কিনা জানার কোনও উপায় নেই।

 

সানুদেশের দিন শেষ

এর আগে মুসলমানদের কথা বলতে গিয়ে আমি একটা ইঙ্গিত রেখে গিয়েছিলাম— আমাদের জনপদে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে নিত্যনৈমিত্তিক আদানপ্রদান ছিল, সে-সময়ে দেশভাগের দাঙ্গার কোনও ছাপ আমাদের জনপদে পড়েনি। তা সত্ত্বেও কখনও একদিন তাল কেটে যাওয়ার বীজ তার ভিতরেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। আমার অজান্তেই আমার মনের মধ্যে এরকম একটা অতি আবছা, তখনও তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে-না-পারা একটা ভাব গড়ে উঠেছিল। সেটা গড়ে উঠেছিল আমাদের বাড়ির দাওয়ায় মোড়ার উপর বসা একটি লোকের উপস্থিতি: অমূল্যরতন ঘোষ। বাবা অফিসে, কথা চলছিল মা-র সঙ্গে। মা লোকটিকে মামা বলছিল। আমাকে বললে, আমার দাদু হন। দাদু ধুতির উপর কোট পরে ছিলেন। উলটানো চুল। পান খান। কৌটো আছে হাতে, বইয়ের মতো দেখতে। আর দেখেছিলাম সোনার দাঁত। আজও ওই উজ্বল দাঁতটি আমার স্মৃতিতে। আর কিছুদিন পরে দেখব আমাদের স্কুলের দেওয়ালে তাঁর নাম ছাপা কাগজ। ভোট দিন। হিন্দু মহাসভা। এঁর ছোটভাই ছিলেন জনপদের নামী উকিল। অরবিন্দ ঘোষ। আমার সহপাঠিনী লতিকা ঘোষের বাবা। বহু বছর পরে জানব তিনি অনুশীলণ সমিতি করতেন। দেখব আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের ছাপ মারা তাঁর লেখা একটি পোস্টকার্ড। আমার বন্ধুর বাবা শ্রী শ্রীদামচন্দ্র দাশগুপ্তের কাছে একটি বইয়ের তালিকা দিয়ে বইগুলি পাঠানোর আবেদন জানানো হয়েছে। তাঁর আর এক ভাই স্বামী প্রভানন্দ। তিনি স্বামীজীর তৈরি বেদান্ত সোসাইটির সম্পাদক। থাকেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। সবচেয়ে বড় ভাই বিষ্ণুপুরের হাইস্কুলের বিখ্যাত হেডমাস্টার— গোকুলচন্দ্র ঘোষ। তাঁর লেখা স্কুলপাঠ্য একটি বিখ্যাত ইংরেজি গ্রামারের বই ছিল। এঁরা সকলে আমার মাতামহীর পিসতুতো ভাই।

অমূল্যরতন বাঁকুড়া আদালতের উকিল ছিলেন। ১৯৫২ সালে খাতড়া নির্বাচন ক্ষেত্র থেকে তিনি বিধানসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর ওই কেন্দ্রের আর একজন প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছিলেন পশুপতি মল্লিক। তিনি পরে বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার হয়েছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিল কাঁসাই নদীর ওপারে রাইপুরে।

স্বামী প্রভানন্দজী মহারাজ একবার ওই জনপদে তাঁর দুই আমেরিকান শিষ্যা— ছায়া এবং প্রভাকে নিয়ে এসেছিলেন। একটা সভা হয়েছিল রঙ্কিনীতড়া পার হয়ে সরকারি ডাক-বাংলোয়। লালপাড় শাড়ি পরে ছিলেন আমেরিকান মেম সাধ্বীরা। লাল ধুলো মাড়িয়ে একটা ছোটখাটো জনতার পিছনে আমিও হেঁটেছিলাম। একটা সভা হয়েছিল ডাকবাংলোর বারান্দায়। এই প্রথম আমার সাহেব বা মেমসাহেব দেখা।

সেদিন আর একটা জিনিস দেখেছিলাম। ডাকবাংলোর পাঁচিল ঘেরা ছোট সবুজ মাঠটির একপাশে একটি অদ্ভুত বস্তু ছিল— একটা মার্বল পাথরের লম্বা স্কেল, যাতে বিভিন্ন সংখ্যা-সহ দাগ কাটা থাকত। সেই স্কেল থাকত একটা কাচের টিউবের মধ্যে, যার ওপরটা ছিল ছুঁচলো। সেই ছুঁচলো মাথার ওপরে একটা ছিদ্র, যা ছিল ঠিক গড়পড়তা একটি বৃষ্টিফোঁটার মাপের। সেই ছিদ্র দিয়ে বৃষ্টির জল কাচের টিউবে প্রবেশ করত। পরে শুনেছিলাম এটাকেই বলে ‘বেঞ্চমার্ক’।

আমার এখানকার স্কুলজীবন একদিন অকস্মাৎ শেষ হয়ে এল। পিতৃদেব অফিস থেকে ফিরে মাকে বললেন তিনি জেলাসদরে বদলি হয়েছেন। পদোন্নতিও ঘটেছে। তিনি তাঁর দেশে ফিরবেন পরিবার সঙ্গে নিয়ে। কিছুদিন তিনি তাঁর ছোটভাইয়ের বাড়িতে থেকে অফিস করলেন। এটার কারণ ওখানে থেকে তিনি তাঁর বহুদিন পরিত্যক্ত দেশের বাড়িটার যেমন সংস্কার করছিলেন তেমনি আমার ক্লাস সেভেনের পরীক্ষাটারও শেষ হওয়ার প্রয়োজন। ডিসেম্বর মাসে বড়দিনের ছুটির আগে আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। জানুয়ারির দু-তারিখে বেরোবে পরীক্ষার ফল। দেওয়া হবে নতুন বুকলিস্ট। সে পর্যন্ত আমরা এখানে। আজন্ম আমার স্মৃতি তৈরি হয়েছে এই জনপদে। কিন্তু কোথাও তার বাঁধন আমার বুকে বাজল না। কেবল কয়েক দিন আমাকে আচ্ছন্ন করল জনপদের প্রকৃতি। তার গাছ, লতা পাতা। আর পাহাড়গুলি। শীতকালে এদের কোল ধরে ধোঁয়া আর কুয়াশা হামাগুড়ি দেওয়া বা অন্ধকার রাতে এদের কোল বেয়ে এখানে-ওখানে আগুনের মালা। এ-সবের নীরব আকর্ষণ। তার পর একদিন পরীক্ষার ফল, আমার ট্রান্সফার সার্টিফিকেট। আর একদিন জানুয়ারির সকালবেলা রোহিণী চৌধুরির বাস এসে থামল আমাদের কোঠাবাড়ির সামনে। আমরা ছাড়া বাসে আর কোনও যাত্রী নেই। কীভাবে এটা ঘটেছিল এটা জানা নেই, তবে জানতুম রোহিণীবাবু বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। তাঁর আর এক ভাই অবলা চৌধুরি জেলার ক্রিশ্চান কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি এককালে বাঁকুড়ার মিশনারি স্কুলে ছিলেন বাবার সহপাঠী। আবার তিনি কলকাতায় সায়ান্স কলেজে ছিলেন মেঘনাদ সাহার সহপাঠী। স্নাতকোত্তর পদার্থবিদ্যায় তিনি ছিলেন প্রথম শ্রেণির।

বাস জনপদ পার হয়ে সদরে যাওয়ার রাস্তায় এসে যখন অতিকায় কর্মকারের কামারশালার পাশে সেই বিখ্যাত তালাও পার হয়ে গেল, আমি দু-হাত দিয়ে মুখ ঢাকলাম। আজন্ম আমার স্মৃতিটা পাক খেয়ে গেল। তারপর মিশে গেল গাড়ির গতিবেগে। প্রায় দুপুরবেলা আমরা পৌঁছলাম রাজগ্রাম। তারপরে দ্বারকেশ্বর নদী। সেই সময়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি এর উপরের নড়বড়ে সেতু দিয়ে নদী পার হয়ে লালবাজার। তারপর একটা ছায়াঘন লাল রাস্তার উপর দিয়ে একটা বিরাট ইটভাটার ভিতরে। লটবহর নামিয়ে বাসটা ফিরে গেল। সঙ্গে চিরকালের মতো নিয়ে গেল আমার আজন্মলালিত পরিসর। সেটা ১৯৫২।

 

[প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত। পরবর্তী পর্বে দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা]

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. স্মৃতিপরব: অধ্যায় ২, পর্ব ১ – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...