স্রোতা দত্ত
যে-কোনও জিনিস ‘মেয়েলি’ বলে চিহ্নিত হলে কি তার গুরুত্ব বা তাৎপর্য কমে যায়? এতদিন যা কিছু— গ্রাফিক্স, পেন্টিং, স্কাল্পচার, সেরামিক্স ইত্যাদি— শিল্প বলে স্বীকৃত, সেখানে নারীর ভাগীদারি? আবার উল্টোদিক থেকে দেখতে গেলে শুধুমাত্র মেয়েদের কাজ বা ‘মেয়েলি’ বলেই কি কলাভবন বাদে অন্যান্য শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলপনা ব্রাত্য?
যে-কোনও নান্দনিক সৃষ্টির মতো আলপনার আদি সুরটা মনের গভীরে যে কাঁচা ভাব, মেকির প্রলেপহীন, সেইরকম আনকোরা, অক্ষত ‘দেখা’ থেকে। মনের ভাব ফুটিয়ে তুলতে সূর্যমুখী ফুলের মাপ, রং বা গড়নের অনুপুঙ্খের কাছে দাসখত লেখেনি শিল্পী। বরং প্রাধান্য দিয়েছে নিজের ‘দেখা’কে। একটা ফুল— সেটা দেখতে তিনকোণা নাকি গোল। গুরুত্বপূর্ণ সেই ‘form’-টা। তারপরে আসে তার বিশদ বর্ণনা।
আলপনা অনেকটা সেই রকম। অশ্বত্থপাতা বা পদ্মপাতার কাঁচা form আদিম যুগ থেকে মনে পুষে রেখেছে মানুষ। সভ্যতা যত এগিয়েছে, তা নান্দনিক হয়ে উঠলেও সেই form ও তার গোড়ার আদল রয়ে গেছে আনকোরা। সেভবে এগিয়েই আলপনা তার প্রতীক ও সঙ্কেতের মাধ্যমে আদিমতার ইতিহাস সঙ্গে নিয়েই নিয়মিত সমসাময়িকতার বার্তা দিয়েছে।
গোটা ভারতে অঞ্চলভেদে আলপনার চল বহু শতাব্দীর। সে-সব শৈলী, প্রথা এমনকি নামও আলাদা। তাই মূলত এপার বাংলার আলপনার গতিপথ নিয়ে আলোচনা সীমিত রাখাই শ্রেয়। এই রাজ্যের বহুলাংশ এখনও ফসলের ঋতুচক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বানভাসি বর্ষার পর শরতের আলোয় কমলবন হেসে উঠলে, নবীন ধান দুলে দুলে সারা হলে, কৃষিপ্রধান ভারত এখনও বাড়ির চালা, মাটির দেওয়াল মেরামত করে। উদ্বৃত্ত ফসল ও সার্বিক ও সামূহিক কল্যাণে নানা ব্রত, আচার পালন করে। বহু পার্বণ কালের গর্ভে বিলীন হলেও, কৃষিকে কেন্দ্র করে বহুকাল থেকেই আলপনা নানা মেয়েলি ব্রত, স্ত্রী-আচার, পরবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক শ্রীবৃদ্ধি-কামনায় আশীর্বাদ, প্রার্থনা, আকাঙ্ক্ষা এবং উচ্চাশার প্রতীক। সেইসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আলপনা সামাজিক, ব্যক্তিগত ও লিঙ্গভিত্তিক মানসিকতার এক আশ্চর্য প্রতিফলন।

প্রথার প্রকারভেদের মতোই আলপনারও পর্যায়ভেদ রয়েছে। কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর আলপনা আর দীপান্বিতার আলপনার সূক্ষ্ম পার্থক্য আজও দেখা চায়। ইতুপুজো, পুণ্যিপুকুরের আলপনায় কিছু সঙ্কেত বা প্রতীক আবশ্যক। অনুষঙ্গভেদে ধানের মরাই, পাখি, মাছ বা পদ্মলতা, শঙ্খলতা, শালুকলতা, ধানের ছড়া, আমকলকার মতো প্রকৃতি থেকে নেওয়া সাবেক সঙ্কেতের পাশাপাশি মোটরবাইক, শ্যালো পাম্প, এমনকি উড়োজাহাজ, মোবাইলও এখন গ্রামীণ আলপনায় ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত প্রাচুর্য, সম্ভারের প্রতীক।

আলপনা দিয়ে বাড়ির কোনও নির্দিষ্ট এলাকাকে অনুষ্ঠানের জন্য চিহ্নিত করা হয়। কখনও তা দিকনির্দেশ আবার কখনও তার উপর রাখা হয় আসন, কোশাকুশি, মঙ্গলঘট, নৈবেদ্যের থালি অথবা কন্যাদানের সামগ্রী, আলপনা দেওয়া বিয়ের পিঁড়ি, তৈজস, মঙ্গলদীপ, মালা। এই সব অনুষঙ্গের উপস্থিতিও চরিত্রগতভাবে অস্থায়ী আলপনার একান্ত বৈশিষ্ট্য এবং পরিচয়।
এখনও বহুলাংশে চারুকলা, সেলাই-ফোঁড়াইয়ের মতো ‘মেয়েলি’ কাজে পারদর্শী মহিলারাই ভেজানো চাল বাটা জলে গুলে, ছোট ন্যাকড়ার ফালি বা তুলো এক বিশেষ কায়দায় প্রধানত অনামিকা বা মধ্যমায় ধরে আলপনা দেন। বাড়ির বিয়েতে হরেক কাজের ফাঁকে টুক টুক করে শ্রী গড়েন, তত্ত্ব সাজান, পিঁড়ি আঁকেন। তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চার ডিগ্রিধারী নন, তবু এ-ধরনের সব কাজেই সৌকর্য ফুটে ওঠে।
ভারতের আলপনা
গ্রামীণ ভারত আর শহুরে ‘ইন্ডিয়া’-র মধ্যে অপরিচয়জনিত বিভাজনের খাদ বড়ই গভীর। পশ্চিমবঙ্গের স্ববর্ণ হিন্দুরা যখন কোজাগরী থেকে দীপান্বিতার আলপনায় ধানের ছড়া, কুলো, লক্ষ্মীপ্যাঁচা আঁকতে ব্যস্ত, এ রাজ্য-সহ পড়শি রাজ্যের নানা এলাকার আদিবাসীরা তখন অঞ্চলভেদে মাতেন বাঁধনা এবং সোহরাই পরবে।

এই সব পরব ঘিরে হিন্দু বর্ণবিভাজনে নিম্নবর্গের সঙ্গে আদিবাসীদের (বহু গোষ্ঠী থাকলেও শহুরে লব্জে তাঁদের একত্রে ‘আদিবাসী’ বা ‘জনজাতি’ বলে চিহ্নিত করা স্ববর্ণদের পক্ষে সুবিধাজনক) এক সহজ ধারায় সাবলীল আদানপ্রদান চলে আসছে বহুকাল। ফলে এই শ্রেণিবিভাজনে কোনটা জনজাতীয় আর কোনটা অন্ত্যজ, তার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। তবে, ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গীয় ‘ইন্ডিয়া’র আলপনার ভাষায় তফাত তো আছেই।
মনে রাখা দরকার, বর্ষার শেষে ভাদ্র থেকে মকর সংক্রান্তি— অর্থাৎ উত্তরায়ণ পর্যন্ত চরম ব্যস্ততার মাঝামাঝি সময়, আশ্বিন-কার্তিকের খানিক ফুরসতে আসন্ন সুফলনের স্বপ্নে গোটা উপমহাদেশ মেতে ওঠে। ইন্ডিয়া দুর্গাপুজো, দিওয়ালিতে নতুন পর্দা, টেবিল ম্যাট কিনে বাড়ি সাজায়। সেইমতো ভারতের আদিবাসিন্দা এবং অন্ত্যজ শ্রেণির কিছু অংশ এই পনেরো-কুড়ি বছর আগে পর্যন্ত প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে টিকটিকি, সাপ, ময়ূর, গাছ ইত্যাদিতে বাড়ির মাটির দেওয়াল সাজিয়ে তুলতেন।

ইন্টারনেটের কল্যাণে Exotic India-র খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকা এই সব বৈচিত্র্যকে নিজের স্বার্থে indigenous art বলে সংজ্ঞায়িত করে বিশ্ববাজারে বেচতেও ছাড়েনি ইন্ডিয়া। তবে ঠিক যে অবজ্ঞা থেকে অত্যাধুনিকতার প্রতীক শপিং মলে হেঁটো ধুতি, মাথায় গামছা ভারতকে ঢুকতে বাধা দেয় ইন্ডিয়া, ঠিক সেই অবহেলা থেকেই ইন্ডিয়া জানে না— সেইসব পশু-পাখির জায়গায় এখন দেওয়াল দখল করেছে আদ্যন্ত জ্যামিতিক ডিজাইন।

ফাইভ-জি-র গর্বিত আস্ফালনে ইন্ডিয়া দেখেনি গত দশ-বারো বছরে টু-জি থেকে ফাইভ-জি পথ বেয়ে মাটির দেওয়াল ইউটিউবায়িত হয়েছে। যদিও এই অলঙ্করণের জীবনকাল টেনেটুনে দেড় বছর। তবু সেই সাময়িকতার বন্ধনীতেও হয়তো আছে ইন্ডিয়ার সঙ্গে ভারতের একাত্ম হওয়ার আকাঙ্ক্ষারও সঙ্কেত। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, শ্রীবৃদ্ধির কামনায় আশপাশের প্রতীকে সোহরাই আজও অনন্য। তবে, জঙ্গল নিধনের ফলে সাবেক প্রতীকের বদলে সামাজিক উচ্চাশার প্রমাণ, ড্রেসিং টেবিলে রাখা প্লাস্টিকের সূর্যমুখী ফুলের প্রতিচ্ছায়া এখন মাটির দেওয়ালে অলঙ্কৃত করে।

আরও একটা বিষয় মনে রাখা দরকার। দেওয়ালের গায়ে যে-কোনও অলঙ্করণ, শিল্পকর্মকে পশ্চিমি শিক্ষাব্যবস্থা mural বলে চিহ্নিত করেছে। তবে মাটি বা মেঝেতে আঁকা অস্থায়ী আঁকিবুঁকির কোনও পশ্চিমি ধারণা নেই, তাই বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের প্রশ্নে সেই ভারতে এখনও ক্ষীণকায়া ফল্গুধারার মতো বিদ্যমান।
শান্তিনিকেতনের আলপনা
ব্রিটিশ সংস্কৃতির আগ্রাসনের প্রতিস্পর্ধী বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ঔপনিবেশিক শিল্পভাবনার আমূল সংস্কার ঘটিয়ে আলপনাকে পূজা–আচার–পার্বণের ঘেরাটোপ থেকে বের করে, তার মূল চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখে ‘সেকুলার’ করে তোলার কাজটি গত শতকের দ্বিতীয় দশকেই শান্তিনিকেতনে সেরে ফেলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আচার্য নন্দলাল বসু। সেখানেই ব্রতের আলপনার documentation (বিধিবদ্ধ নথিবদ্ধকরণ) এবং তার বিশ্লেষণ শুরু হয়েছিল। কালে কালে বসন্তোৎসব, হলকর্ষণ, বর্ষবরণ, সমাবর্তনের মতো অনুষ্ঠানে শান্তিনিকেতনী আলপনা গড়ে তুলেছে তার নিজস্ব শৈল্পিক পরিচয়। বোলপুরের আশপাশের নদী–নালা, খোয়াই, তালগাছ যেমন শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের কাজে প্রাধান্য পেয়েছে, তেমনই শান্তিনিকেতনি আলপনায় আলপনার আদি ধর্ম বজায় রেখে প্রাচীন ভারতীয় শিল্পের বিভিন্ন অলঙ্করণেরও আত্তীকরণ ঘটেছে।
বিশ্বভারতীর কলাভবনের প্রাক্তন কিউরেটর শ্রী সুশোভন অধিকারী বাংলার আলপনার গোটা ইতিহাস ও তার তাৎপর্য বুঝিয়েছেন ছোট একটা গল্পে। কোনওভাবে গৌরী ভঞ্জের (নন্দলাল বসুর কন্যা ও কলাভবনের প্রাক্তনী) এক জীর্ণ খাতা তাঁর এসেছিল। সেখানে তিনি দেখেন অশ্বত্থপাতা আলপনার রূপ পেয়েছে। শিল্পীর সঙ্গে কথোপকথনে তিনি জানতে পারেন, শান্তিনিকেতনে বুদ্ধপূর্ণিমায় বিশেষ উপাসনার উপলক্ষে এই খসড়া।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে, গোটা ভাবনার মধ্যে গৌতম বুদ্ধের মানবতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের সশ্রদ্ধ চিন্তার পথ বেয়ে, আলপনার আদি চরিত্র বজায় রেখেই শান্তিনিকেতনি আলপনা প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতার ভাবনাকে সম্মান জানিয়ে হয়ে উঠেছে ব্যাঞ্জনাময়।
এ-ছাড়াও, যা ছিল একান্ত মেয়েলি, গোড়া থেকেই অধ্যাপকদের পথনির্দেশে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা সমবেতভাবে আলপনায় হাত পাকানোয়, ধীরে ধীরে তা লিঙ্গনিরপেক্ষ হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বেড়া ডিঙিয়ে তা হয়ে উঠল গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড। মেয়েলি ব্রত-আচারের বন্ধনী থেকে আলপনাকে শান্তিনিকেতন ধর্মনিরপেক্ষ বেদিতে এনে ফেলায় বাঙালির আলপনায় তা নিঃসন্দেহে ছিল এক যুগান্তর।
সাতের দশকে নবনির্মিত বাংলাদেশও বুঝিয়েছিল— বাঙালির আলপনা কেবল নান্দনিক নয়, তা সাংস্কৃতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার এক উজ্জ্বল প্রকাশ।

ইন্ডিয়ার আলপনা
আটপৌরে উঠোন থেকে বেরিয়ে বহির্বিশ্বের নিরিখে, আটের দশক থেকেই কয়েকটি দেশে বিশ্বায়নের দরজা খুলছিল। নয়ের দশকে ভারতে উদার অর্থনীতি বহু সাবেকি ধারণায় ধাক্কা দিয়ে তাকে ‘আধুনিক’ হওয়ার পথে ছুটিয়ে দিল। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এ-সময়ের আশেপাশে কোনও কোনও সংবর্ধনা বা পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে আলপনার মতো নকশার চল দেখা যেতে লাগল।
পরাধীন ভারতে স্বদেশিয়ানাকে কেন্দ্র করে documentation, archiving-এর যে উদ্যোগ রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়, গুরুসদয় দত্তরা নিয়েছিলেন, এ-সহস্রাব্দের শুরুতে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের হিড়িকে তাতে বিশ্ববাজারে নতুন করে পণ্য হল ভারতীয় সংস্কৃতি। কোথাও দক্ষিণ, কোথাও বা উত্তর এবং বঙ্গজ নকশা-সঙ্কেত নিয়ে বাজারজাত হল স্বচ্ছ প্লাস্টিকের উপর কল্কাদার স্টিকার আলপনা।
শহুরে বাঙালি সংস্কৃতিতে আলপনার ভূমিকা যে বর্তমানে কেবলমাত্র আলঙ্কারিক নকশা, তার সফল উদাহরণ টিভি-বিজ্ঞাপন, সিনেমার দুর্গাপুজো এবং অভিজাত বিয়েবাড়ি। আদতে এখনও যে কোনও বাড়ির পুজোয় ঠাকুরদালানে পুজোস্থল চিহ্নিত করতে আলপনা থাকে। বিপরীতে, বিজ্ঞাপন বা সিনেমায়, বাঙালি সংস্কৃতির অবিসংবাদিত প্রতিনিধি, বনেদি বাড়ির পুজোতে দেখা যায়, নাটমন্দির থেকে বাড়ির দালানে নেমে এসে আলপনা পড়ে আছে নিজের মতো, আশেপাশে পুজোর কর্মব্যস্ততা।
প্রায় একই ভবিতব্য আজকাল অভিজাত বিয়েবাড়ির আলপনারও। মফস্বল বা গ্রামে তো বটেই, নয়ের দশকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত শহর-নগরে, নিজের বাড়ির ছাদে বা চৌহদ্দিতে বিয়ের আয়োজন হত। খোলা বাজারে বিবাহমণ্ডপই বা বাকি থাকে কেন? তাই বহুকাল হল, লাল কার্পেটে মোড়া, দারুণ ঝকঝকে tiled floor-সহ ভাড়া করা marriage hall-এ শুভ পরিণয়ই এখন custom। সেখানে আলপনা custom তো নয়ই— বরং আলপনা দিলে দিকে দিকে বিজ্ঞাপিত নির্দেশাবলি লঙ্ঘনের ভয়। তবু মঙ্গল–অমঙ্গলের সঙ্গে জড়িত, আলপনাকে এক কথায় ঝেড়ে ফেলা ততটাও সহজ নয়। ফলে রুচি-রেস্ত থাকলে, ভাড়া নেওয়া বাড়ির কোনও আকর্ষণীয় ও সুবিধাজনক জায়গায় পেশাদার শিল্পী দিয়ে আলপনা আঁকিয়ে নিলে, ইজ্জত, আচার, সবই বজায় থাকে।
আর প্রাসঙ্গিকতা খুইয়ে, শোভাবর্ধনের দায় কাঁধে এলিয়ে পড়ে থাকে আলপনা।
মঙ্গলানুষ্ঠানের প্রতীক আলপনা অলঙ্করণে পর্যবসিত হয়ে ক্রমশ ছবি আঁকা, গান, আবৃত্তির প্রতিযোগিতার মতো কোথাও কোথাও এখন প্রতিযোগিতারও বিষয়। আলপনার উপযোগিতা এক শ্রীপূর্ণ অনুষ্ঠানের সুচারু সীমানা নির্ধারণ। তবে তা ইঞ্চি-বন্ধনীতে সীমাবদ্ধ নয়। চোখের আন্দাজে, উঠোন ভরে, সদর দরজা জুড়ে দেওয়ার মধ্যে কেমন জানি সীমাবদ্ধতার মধ্যে একটা সীমাহীনতার আভাস থাকে। সেখানে লতা, মণ্ডলী, কলকার পুনরাবৃত্তি একটি বৈশিষ্ট্য।

সেই পুনরাবৃত্তির একঘেয়েমি কাটাতে ভিন্নতর কোনও প্রতীক যোগ করেন, তারও পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে এক বৃহত্তর হিসেবি পুনরাবৃত্তি আলপনার সামঞ্জস্য ও সৌকর্য ধরে রাখে। কিন্তু প্রতিযোগিতার আঙিনায় পা রেখে আলপনা কালো পিচের রাস্তার উপরে ইঞ্চি-ফুটের চৌহদ্দিতে বাঁধা পড়েছে। পুনরাবৃত্তি দূরে থাক, গাছ-পাতা-ফুল-লতার প্রতীক ছেড়ে অনেকেই বাঁকুড়ার ঘোড়া, পেখম মেলা ময়ূর বা নকশাদার ফ্রেমের মধ্যে একটি প্রজাপতি, এমনকি, আলপনার নামে মধুবনী ঘরানার অনুকরণে ফিগারেটিভ ড্রয়িং–ও সুলভ।
শুধু এটুকুই নয়। ন্যাকড়া বা তুলো ছেড়ে এখন তুলির প্রাধান্য। ফলে আঙুলের নমনীয়তায় ফুটে ওঠা ঈষৎ ‘নরম’ রেখার বদলে তুলির টানে সুঠাম, ঋজু রেখা এখন আলপনার বৈশিষ্ট্য। আর একটি দিকও গুরুত্বপূর্ণ। আলপনার ক্ষেত্রে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে দেহ ছিল এক সরাসরি মাধ্যম। এই সব শহুরে আয়োজনে তুলির আমদানি আলপনার সেই performative চরিত্রের অভিমুখ এবং প্রকৃতির সঙ্গে নৈকট্য ঘুচিয়ে তার চরিত্র ও ধর্ম পরিবর্তন করেনি তো? বাংলাদেশের অনুসরণে আজকাল প্রতিবাদে, বিশ্ব চারুকলা দিবসে মোটা ব্রাশস্ট্রোকে রাস্তায় প্রাসঙ্গিক সঙ্কেতহীন ‘আলপনা’ আঁকা হয়।
বাজারের দাবি
ভাবতে আশ্চর্য লাগে, যতদিন আলপনা ছিল শুধুমাত্র ‘মেয়েলি’ আচার, ততদিন শেষ গানেরই রেশ-এর মতো বাসি আলপনার উপরে পড়ত ভোরে ট্রেন ধরতে যাওয়া সাইকেল বা মোটরবাইকের প্রাত্যহিকতার ছাপ। কখনও তাতে উছলে পড়ত জল। ঘরসাফাইয়ের তাড়ায় কেউ ন্যাতা বুলিয়ে দিত, কিছু নাছোড় বাচ্চা কাঠি দিয়ে খোঁটাখুঁটি করত। মোটের উপর, যে অংশগ্রহণের অংশীদারি আলপনার তাৎপর্য, অন্যরকম অংশগ্রহণের শরিকি ভাগে তা বিলীনও হয়।
কিন্তু গত শতকের শেষ দুই দশক থেকে এ-সহস্রাব্দের সিকিভাগ অবধি বিশ্বায়ন, উদার অর্থনীতি, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ফোরণের প্রভাব এবং যোগাযোগব্যবস্থার তুলকালাম অগ্রগতির ফলে প্রায় সব বিষয়েই ধারণার মূলগত পরিবর্তন ঘটেছে। ঔপনিবেশিক শিক্ষার পেষাইযন্ত্রে ভারতীয় শিল্পশিক্ষা জেনেছিল অঙ্কনশিল্প, ভাস্কর্য, মৃৎশিল্প দর্শনীয়। বিশ্বায়নের ধাক্কায় আবার পট বদলে গেল। গ্রামে গঞ্জে উচ্চগ্রামে ‘ডিজে’ অজানা নয়। বিদেশি বাদ্যযন্ত্র সঙ্গতে বাউলগানও জলসা মাতায়। Calendar art, সিনেমার পোস্টারের বিশেষ ব্রাশস্ট্রোক-এর মতো ‘নাগরিক লোকায়ত শিল্প’-র নতুনতর ব্যবহার, গ্যালারিতে ঝোলানো ক্যানভাসে সেলাইয়ের ফোঁড়, চুল, স্যানিটারি ন্যাপকিনের সঙ্গে চিরায়ত শঙ্খলতা বা শালুকলতার সহাবস্থান এখন চোখে সয়ে গেছে। পশ্চিমি অনুপ্রেরণায় ভারতীয় শিল্পসমাজ ফিরে বুঝল শিল্প শুধু গ্যালারিতে দেখার নয়। নদীর পাড়ে, মাঠের ধারে, পাড়ার মোড়ে তাকে রীতিমতো ছুঁয়ে, নেড়েচেড়ে, ঘেঁটে দেখা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চায় শিক্ষিত বঙ্গীয় শিল্পে রমরম করে ঢুকে পড়ল installation, site-specific installation, performance art/live art, community art।
অথচ কী কারণে কে জানে, পটচিত্র আজও performance art নয়, বরং ‘folk art’ বলেই আন্তর্জাতিক স্তরে বেশি পরিচিত। সোহরাইয়ের দশাও প্রায় সেই।
আলপনার রাজনীতি
যে-কোনও জিনিস ‘মেয়েলি’ বলে চিহ্নিত হলে কি তার গুরুত্ব বা তাৎপর্য কমে যায়? এতদিন যা কিছু— গ্রাফিক্স, পেন্টিং, স্কাল্পচার, সেরামিক্স ইত্যাদি— শিল্প বলে স্বীকৃত, সেখানে নারীর ভাগীদারি? আবার উল্টোদিক থেকে দেখতে গেলে শুধুমাত্র মেয়েদের কাজ বা ‘মেয়েলি’ বলেই কি কলাভবন বাদে অন্যান্য শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলপনা ব্রাত্য?
এ-প্রসঙ্গে নবনীতা দেবসেন সাহিত্য প্রসঙ্গে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন সামাজিক অনুশাসনের কল্যাণে মেয়েদের কলমে কী ধরনের বেড়ি থাকে। আলপনার ভাগ্যও কি সেরকম? আলপনাকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক থেকে গোষ্ঠীকেন্দ্রিক করেছে শান্তিনিকেতন। পাশাপাশি মেয়েলি পরিচয়ের ছাল ছাড়িয়ে তাকে ungendered করে তুলতেও শান্তিনিকেতনের ভূমিকা কম নয়। যতদিন আলপনা ছিল মেয়েদের একান্ত ‘হস্তগত’, ততদিন চারুকলার নন্দিত অলিন্দে তার ডাক পড়েনি। ক্ষণিকতার আলপনাও শিল্পের এক মাধ্যম— এমন দাবিও ওঠেনি। তবে যেই আলপনা তার লিঙ্গপরিচয় ছেড়ে সর্বজনীন হল, শিল্পজগতের তরঙ্গস্রোতে সম্ভাবনাময় পণ্যায়নের দিকে হাঁটা শুরু হল।

নবতর শিল্প সংজ্ঞা মেনে স্থান এবং কাল (space and time)-ভিত্তিক শিল্পের ছকে ফেললে দেখা যাবে, আলপনা সমসাময়িক ও উত্তর-আধুনিক শিল্প সংজ্ঞার ভ্রূণ ধারণ করেছে বহুদিন আগেই, তবে তা ছিল অনুচ্চারিত উপচারের মোড়কে আচ্ছাদনে বাঁধা। এ-প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন হয়তো বাতুলতা নয় যে, ভারতীয় শিল্প কি কখনও জীবনধারা আর শিল্পধারাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেছে? অজন্তার গুহাচিত্র বা খাজুরাহো কি শুধুই অর্চনাস্থল? নাকি বিশ্বের বিশিষ্ট গ্যালারি?
তবে বাজারের হাতে হাত রেখে, নিত্যনতুন শিল্প সংজ্ঞার ঠেলাঠেলিতে, আলপনা তার পৃথক সত্তার দাবি নিয়ে এখন সোচ্চার। অনেক শিল্পীই মনে করেন, site-specific installation–এর মতো ভারী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আলপনাকে যুক্ত করার রাজনৈতিক প্রক্রিয়া প্রয়োজন।
অন্তত শহরে আলপনার বর্তমান অনুশীলনী ফারাকটা হল, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক মোটিফ ক্রমশ বিলীন। কলকাতা জুড়ে Durga Art–এ একটি-দুটি মণ্ডপে আনুভূমিক আলপনার পাশাপাশি ধাতব নকশায় উল্লম্ব আলপনা নবরূপে প্রকাশিত। চালের গুঁড়ো, ন্যাকড়া বা তুলো নয়, কালো পিচের উপর মোটা ব্রাশের সুঠাম স্ট্রোকে কড়া রঙের পদ্মপাপড়ি, আমকল্কা থাকলেও এই আলপনা চারপাশ জড়িয়ে দৈনন্দিন যাপনের সঙ্গে কতটা সম্পৃক্ত— সে তাত্ত্বিক প্রশ্ন ওঠা অসঙ্গত নয়। সে-কারণেই কলাভবনের প্রাক্তন কিউরেটর শ্রী সুশোভন অধিকারী এগুলোকে আলপনার মর্যাদা দিতে অপারগ। তাঁর মতে, এগুলো নকশা মাত্র।
পণ্যায়নের দৌড়ে আলপনার কর্মশালা আয়োজন হচ্ছে এবং আলপনার ক্লাসের দাবিও উঠছে। সামাজিক মাধ্যমে আলপনা দেওয়ার কায়দা-কেতাও সহজলভ্য। আদিমতায় পথ চলা শুরু করে আলপনা এখন নতুন পথের চৌমাথায়। নাম হয়তো অঞ্চলভেদে একই থাকবে তবু সংজ্ঞায়নের উড়ুনি আলপনা বলে উঠতে পারে—
‘নতুন নামে ডাকবে মোরে…’

কৃতজ্ঞতা স্বীকার
- স্বাতী ঘোষ, শান্তিনিকেতনের আলপনা
- শ্রী সুশোভন অধিকারী, প্রাক্তন কিউরেটর, কলাভবন, বিশ্বভারতী
- আদিত্য সেন, শিল্পী

