গোঁফ — ৫ম পর্ব

এস হরিশ

 

অনুবাদ: ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য

পূর্ব-প্রসঙ্গ: দুটো লোক

 

কুট্টত্থি

এট্টুমানুরস্থিত মাননীয় তহশিলদার-সমীপে কাইপুড়া মহকুমার প্রব্রুত্তিয়ার সাংকুন্নি মেনন-দ্বারা মীনম-এর দ্বাদশবিংশতিতম দিবসে পেশকৃত জরুরি খতিয়ান।

এতদ্বারা নিবেদন এই যে, এই খতিয়ানের সময়কালে কাইপুড়া মহকুমা কাইপুড়া, অরপুকারা এবং শ্রীকণ্ডমঙ্গলম অঞ্চলগুলি লইয়া গঠিত। কাইপুড়ার অধিবাসীদের অধিকাংশ দক্ষিণবাদী নাসরানি খ্রিস্টধর্মী মানুষ, এড়ভা এবং নায়ার, এবং মাত্র দুই ঘর মালয়ালি ব্রাহ্মণ। অসংখ্য নদীনালা এবং বহুধাবিস্তৃত ধান্যক্ষেত্র থাকিবার কারণে মৎস্যজীবী ভালন ও জমিচাষের নিমিত্ত পুলয়ন ও পারয়নদের সংখ্যাও এ অঞ্চলে নিতান্ত কম নহে। ১৯২৪ সনের অতিবর্ষা এবং নিলামের নিমিত্ত রক্ষিত একটি আম্রবৃক্ষ হইতে ফলসংগ্রহ করিবার কালে জনৈক রাজমিস্ত্রির মৃত্যুর সময় ব্যতীত এ স্থানে আইনলঙ্ঘনের ঘটনা প্রায় ঘটে নাই বলিলেই চলে। তথাপি, দুর্ভাগ্যবশত, বর্তমান অবস্থা ইহার সমূহ বিপরীত। অবস্থা এমনই গুরুতর আকার ধারণ করিয়াছে, যে ইহার ফলে এই মহকুমার আইনশৃঙ্খলা এবং ইত্যাকার খাদ্যসরবরাহব্যবস্থার সমূহ বিনষ্টিকরণ অসম্ভব নহে। অধীন জ্ঞাত হইয়াছে যে এই ভয়াবহ অবস্থার মূল কারণ জনৈক বাবচন, পিতা খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত পুলয়ন পাভিয়ন, সাকিন কাইপুড়া মহকুমার উত্তরপ্রান্ত ও ওনমথুরুট্টু মহকুমার সংযোগস্থলে অবস্থিত চোড়িয়াপ্পারা ক্ষেত্রের অন্তর্ভুক্ত জলপথের দক্ষিণে কলপ্পুরায়িল কোরামাপিল্লার ধান্যক্ষেত্রের পূর্বপ্রান্তের একটি কুটির। অধীন ইহাও জ্ঞাত হইয়াছে যে অঞ্চলের রীতিনীতির প্রতি সম্পূর্ণ অবজ্ঞা প্রদর্শন করিয়া ও পুলয়নদিগের বংশানুক্রমিক পেশার সহিত বিন্দুমাত্র সাযুজ্য বজায় না রাখিয়া এই বাবচন একখানি প্রকাণ্ড গুম্ফ রাখিয়াছে। যথাবিহিত অনুসন্ধানপূর্বক অধীন জ্ঞাত হইয়াছে যে অঞ্চলের পথেঘাটে এই ব্যক্তির যথেচ্ছ দাপাদাপির কারণে মহিলা ও শিশুগণ স্নান পর্যন্ত করিতে পারিতেছে না। বিগত মাসের উনিশ তারিখে অরপুকারা মন্দিরের পুরোহিত সুব্রহ্মণ্যম প্রতিদিনের ন্যায় প্রত্যুষ চার ঘটিকায় একটি জলভর্তি পাত্র লইয়া পূজার্চনা আরম্ভ করিবার নিমিত্ত মন্দিরের পথে গমন করিবার সময় ভিলুন্নির নিকটে একটি ভীষণদর্শন আকৃতি দেখিয়া ভয়ে মূর্ছা যান। ওই ভয়ঙ্কর আকার সম্ভবত পূর্বোল্লেখিত পুলয়ন খ্রিস্টানের ছিল। এই ঘটনার ফলে অঞ্চলের মানুষ ভীত হন, এমনকী মন্দিরের দেবতাও রুষ্ট হন। অন্যত্র, থারায়িলের সন্নিকটে মধ্যরাত্রে প্রস্রাব করিবার নিমিত্ত গৃহ হইতে বাহির হওয়া এক মাপ্পিলা রমণীও ভয়ে জ্ঞান হারান। মাসে দুইবার সংঘটিত হওয়া কাইপুড়ার গরুহাটায় ব্যাপারীরা যেন ভয়হীন হইয়া অংশ লইতে পারে, এই মর্মে আবেদন জানাইয়াছেন কুট্টিক্কল গির্জার যাজক। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী এই পুলয়ন খ্রিস্টান বাবচন নিখোঁজ, এবং সে যে-কোনও ক্ষেতে অথবা মনুষ্যবসতিহীন কোনও স্থানে আত্মগোপন করিয়া নাই তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যাইতেছে না। ইহার ফলে জনসাধারণ নিতান্ত উৎকণ্ঠা ও ভীতির বশবর্তী হইয়া দিনযাপন করিতেছেন। কৃষকেরা কৃষিকর্মে যাইতে সাহস পাইতেছে না, কারণ তাহারা শুনিয়াছে যে এই ব্যক্তি ইচ্ছাধারী, এবং বেশভূষা পরিবর্তন করিয়া ধানমাড়াইয়ের স্থান হইতে ধান চুরি করিবার লক্ষ্যে সে লোকজনকে হামেশাই আক্রমণ করিয়া থাকে। আশঙ্কা করা হইতেছে যে তত্ত্বাবধানহীন পুলয়নদের দ্বারা প্রদত্ত নিম্নমানের শ্রমের কারণে গ্রীষ্মকালীন ফসলের গুণমান গুরুতরভাবে প্রভাবিত হইবে। অঞ্চলে সত্বর পুলিশ উপস্থিতি এবং যথাবিহিত সরকারি পদক্ষেপের আবেদন জানাইয়া এবং যথাশীঘ্র প্রতিকারের আশায় এই তথ্য হুজুরের বিশেষ এবং জরুরি বিবেচনার নিমিত্ত সসম্মানে পেশ করা হইল।

দেরি হয়ে যাচ্ছে, এ কথা বোঝাবার জন্য পিওন রামা কুরুপ্পু দরজার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকলেও প্রব্রুত্তিয়ার সাংকুন্নি মেনন নিজের চেয়ারে যেমন বসেছিলেন তেমনই বসে রইলেন। ভালো কাগজে বারকয়েক কপি করা হয়ে গেলেও নিজের রিপোর্ট নিয়ে কিছুতেই তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। হাতের লেখা তাঁর ভালো হলেও রিপোর্টের দিকে তাকালেই মনে হচ্ছিল যেন একটা সুতোর ভয়ঙ্কর জট লাগা বান্ডিল। মেননের রিপোর্ট তালুক আপিসে খ্যাত ছিল তার মারপ্যাঁচের জন্য। মেনন যেসব রিপোর্ট পাঠাতেন, তা থেকে তার মোদ্দা বক্তব্যটা উদ্ধার করা যেমন অসম্ভব ছিল, তেমনই অসম্ভব ছিল প্রতিবেদিত বিষয়টা সত্য না অসত্য, ভালো না মন্দ, উচিত কী অনুচিত এ নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। বরিষ্ঠ সরকারি কর্মচারীরাও মেননকে একজন আদর্শ সিভিল সার্ভেন্ট আর তাঁর রিপোর্টশৈলীকে অফিসিয়াল রিপোর্টের সঠিক কাঠামো বলে মনে করতেন। মেনন যেন এক সুদক্ষ ছুতোর, যিনি নানান চোরা দরজার আনাচেকানাচে তথ্যকে এমনভাবে সাজিয়ে রাখতে পারেন, যাতে যে কোনওরকমের প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে তারা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারে। বছর দুই আগে ভিরিপ্পুকালাপ্পাডমের পূর্ব সীমান্তে খালের পাশে দেড় একর জমির মালিকানা এবং ফসল কাটার অধিকার নিয়ে একটা মতবিরোধ দেখা দেয়। সেই মতবিরোধ আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমাধান করা যেত। তা না করে মেনন অকুস্থল পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেন, এবং দর্শনপূর্বক একটি সুবিস্তৃত প্রতিবেদন লেখেন। ওই প্রতিবেদনের ফলস্বরূপ, ওই বছর ওই এলাকার প্রায় একশো একর জমিতে ফসল ফলেনি। আজও সেখানে চাষ-আবাদ হয় না। ঝামেলা যাদের মধ্যে, তারা মিটমাট করে নিয়েছে অনেকদিন আগেই। কিন্তু মেননসাহেবের হাতে শুরু হওয়া ফাইলের আকার এখন বিশাল, আর সে ফাইল এমন সব জটিল রিপোর্টে ঠাসা, যে তার ফলে যে সমস্যা ছিল মাত্র একটা জমির, তা এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে গোটা অঞ্চলের। অবস্থা এমন হয়েছে যে সেখানকার লোকে ওই জমিতে নিজেদের গরু-টরু চরানোও বন্ধ করে দিয়েছে। ভয়, যদি কোনও আইনি জটিলতায় ফেঁসে যায়।

এতকিছু সত্ত্বেও বাবচনকে নিয়ে করা রিপোর্ট মেননসাহেবকে শান্তি দিতে পারছিল না। কাইপুড়ার প্রব্রুত্তিয়ার হয়ে এতকাল যে সমস্ত ব্যাপার নিয়ে তিনি নাড়া-ঘাঁটা করেছেন, এই কেসটা ছিল তার চেয়ে আলাদা। এতদিন ছিল জমিজমার ব্যাপার, অথবা শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দিরের ষাট বছরের পুরনো ব্রাহ্মণ অনুষ্ঠান মুরজপম-এর জন্য খাবারদাবার জোগাড় করা এইসব। মেনন নিজেকে এবং নিজের কাজ নিয়ে এতাবৎ বেশ তুষ্টই ছিলেন। গত সন্ধেয় তাড়ি সংগ্রাহক আয়াপ্পানের বাড়িতে বর্তমান দুর্ঘটনার খবরটা পেয়ে তাঁর তুষ্টিতে ছেদ পড়ল।

রোজ সন্ধেয় আয়াপ্পানের বাড়ি যাওয়াটা ছিল প্রব্রুত্তিয়ার মেননের একটা দীর্ঘদিনের অভ্যেস। যদিও উনি আয়াপ্পানের বাড়ি যেতেন এলাকা পরিদর্শনের ভান করে, তবু সেটা যে ভানই তা বুঝতে কারও বাকি ছিল না। সাদা মুন্দু পরিপাটি করে বেঁধে কাঁধের ওপর গামছাখানা এমনভাবে রাখতেন, যেন এক টুকরো নরম কাঠ— বাঁকিয়ে পিঠের মাপে জড়ানো। দ্রুতপায়ে চলতেন মেননসাহেব। দৃষ্টি কিঞ্চিৎ ওপরের দিকে রেখে হাঁটা ছিল তাঁর বরাবরের অভ্যেস। তবু লোকে এর অন্য মানে করত। মনে করত, তিনি ওইভাবে হাঁটেন প্রব্রুত্তিয়ার বলেই। একে তো তাঁর কাজ সম্পত্তির কর নির্ণয় করা। অন্যদিকে নারকেল, আম আর কাঁঠালের ফলন কেমন হল কর আদায়ের জন্য সেটারও একটা হিসাব রাখতে হবে বলেই নাকি মেননের চোখ থাকত উপরের দিকে। মেননের দৃষ্টি উপরের থেকে নামানোর জন্য কেউ কেউ এটা-সেটা বলে তাঁকে ঘেঁটে দেওয়ার চেষ্টা করত। আর মেনন একটু দূরে গেলেই তাঁকে বলত ‘মেনোক্কি’— ওপরদেখিয়ে।

জিভে স্বাদ আনার জন্য তাড়ির সঙ্গে একটা চাখনা ছাড়া মেননের চলত না। কিন্তু সেই চাখনা তিনি কারও বাড়িতে খেতেন না। নিচু জাত তো নয়ই, এমনকি নায়ারদের বাড়িতেও না। এই কারণে মেননসাহেবের স্ত্রী চিংড়িশুঁটকি সেঁকে নারকেলের সঙ্গে বেটে, তাতে কান্দারি লঙ্কা আর নুন মিশিয়ে চম্মত্থি বানিয়ে সেটা কলাপাতায় মুড়ে স্বামীকে দিয়ে দিতেন। আয়াপ্পানের বাড়ির পিছনে নারকেলগাছের নিচে একটা সাফসুতরো জায়গা দেখে তাঁর জন্য রাখা বিশেষ একটা মোড়া পেতে বসতেন মেনন। সেখানে বসে বাড়ি থেকে আনা ছাঁদাটা খুলতেই জাতনির্বিশেষে তাঁর সহ-মদ্যপায়ীরা সেই চম্মত্থি একেবারে চেটেপুটে সাফ করে দিত। এই স্বাদের প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ হলে মনে মনে মেনন খুশি হতেন খুবই। একদিন কোর্ট থেকে ফেরার পথে এক কাঠচেরাইওলাকে দেখে মেননসাহেবের মাথায় এল এক দুষ্টুবুদ্ধি। তার থেকে এক খাবলা ভেজা-ভেজা কাঠের গুঁড়ো নিয়ে বাড়ি ফিরে গিন্নিকে বললেন— চিংড়ির বদলে ওই কাঠের গুঁড়ো দিয়ে চম্মত্থি বানিয়ে দিতে। যথা আজ্ঞা। মেননের পতিব্রতা গিন্নি সেদিনকার চাখনা সেইভাবেই বানিয়ে দিলেন। আয়াপ্পনের বাড়ির সেদিনকার সান্ধ্য আসরেও ছাঁদা খোলার পর ওই চম্মত্থি মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে গেছিল।

—বলো, তাঁরই জন্যে আলাদা করে রাখা নারকেলের মালা থেকে তাড়িটুকু গলায় ঢেলে মেনন বলেন, কেমন লাগল আজকের চম্মত্থি?
—ফাসকেলাস বড়বাবু! দড়িবিক্রেতা মথমাপ্পিলা বলে। আমার বউয়ের বানানো চম্মত্থি খেলে মনে হয় যেন পাখির গু।
—তবে আজকের টেস্ট যেন একটু স্পেশাল। মনে হয় নদীর সাদা চিংড়ি, না?

এই মালখোরগুলো করাতের গুঁড়ো পেলেও ছেড়ে কথা বলে না, মেনন মনে ভাবেন।

পাভিয়ন পুলয়নের ব্যাটা যে একজোড়া দামড়া গোঁফ রেখেছে, এ কথা মেননের বিলক্ষণ জানা ছিল। তবে আয়াপ্পানের চোভথির কথা শুনে তিনি এ-বিষয়ে একটা ব্যবস্থা নেবেন বলে স্থির করলেন।

—এই তোমার কাপড়চোপড় সামলাও। আমার বমি হয়ে যাবে, ছুতোর কুট্টানাসারিকে এক ধমক দিয়ে চোভথি বলে। লোকটা যথারীতি একটা ছোট্ট কাপড় কোনওমতে কোমরে জড়িয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তাড়ি খাচ্ছিল।

তারপর মেননকে উদ্দেশ্যে করে বলে, বড়বাবু জানেন কি না জানি না… ওই পুলয়নের ব্যাটা না একজোড়া তাগড়া গোঁফ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর সকলকে ভয় দেখাচ্ছে। কয়েকটা বাচ্চা গত রাতে ওই বাঁধের ওপর হাঁটছিল, তাদের এমন ভয় দেখিয়েছে নাআআ! তারপর তো শুনলুম মক্কোথরার মাঠে রাখা খড়বিচালিতেও নাকি আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

—ওর বাপ পুলয়ন কই? মেনন জিজ্ঞাসা করেন।
—কে জানে বড়বাবু! কুট্টানাসারি বলে ওঠে। পুলয়নের যা কাজ তাই করছে, বোঝেন তো!

চোভথির ধমক খেয়েও তার কোনও হেলদোল নেই। তার অতি ছোট মুন্দু পরে সে এমনভাবে বসে আছে যে তার উরুসন্ধি অবধি সাফ দেখা যায়। তার এই বদস্বভাবের জন্য, বা বদপোশাকের জন্য সমস্ত কাজের বাড়িতেই মহিলা বা শিশুরা তাকে দেখলে বিরক্ত হয়। একবার তো এক মহিলা— প্রলার কাছে তাঁর বাড়ি— জাঁতায় লঙ্কা পিষে সেই জাঁতা-ধোওয়া জল কুট্টানাসারির কোলে ঢেলে দেন।

—চাকাঘরের সামনে ঘেঁটিভাঙা হাঁসের ছানাগুলোর কথা জানেন তো বাবু? ওই ব্যাটারই কাজ, চোভথি বলে চলে।
—খুব শিগগির পুলিশ আসবে, কুট্টানাসারি জুড়ে দেয়, কংগ্রেসের লোকেরা খবর দিয়েছে।

নিজের পৃষ্ঠদেশ রক্ষা করতে সদা-তৎপর মেনন সেই রাতে কাগজ-কলম নিয়ে তাঁর উপরতলার সাহেবদের জন্য রিপোর্ট বানাতে বসে পড়েন।

—ওর গোঁফ দাড়ি যা পারে বাড়াক, রাতের খাবার বেড়ে গিন্নি ডাকতে এলে তাঁকে বলেন, পুলিশ আসার আগে তহশিলদারকে ব্যাপারটা জানানো দরকার।

অন্য সময় তাঁর কলম যতটা অনায়াসে চলে, তেমনটা যেন চলতেই চায় না। জটিল বাক্যবিন্যাসে রিপোর্ট লিখতে মেনন ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এমন রিপোর্ট যা পড়ে বাদী বিবাদী উভয়েই ভাবে লিখিয়ে আসলে তাদেরই পক্ষে। যদিও সে রিপোর্টে কারও কোনও সুরাহা হয় না। মেননের ছিল একটিমাত্র বাক্য দিয়ে দু-দুটো পাতা ভরে ফেলার ক্ষমতা, যে রচনা পড়ে সকলেরই একেবারে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত। কিন্তু এইবারে ব্যাপারটা একটু আলাদা। কোথাও কোনও নিয়মমাফিক অভিযোগ জমা পড়েনি। গোঁফওয়ালা অপরাধীর চোখে তাঁর রিপোর্ট পড়বে না। আর বিষয়টাও অন্যান্য জমিজিরেতসম্পত্তির মামলা থেকে অপেক্ষাকৃত সরল। এ সত্ত্বেও নিজের লেখা রিপোর্ট পড়ে মেনন একেবারেই খুশি হতে পারলেন না। বড্ড সহজ হয়ে গেছে লেখাটা। এমনকি একটা বোকাসোকা লোকও স্পষ্ট বুঝে ফেলবে।

যাই হোক, বেলার দিকে রিপোর্টটাকে একটা কাগজে মুড়ে সাবধানে বগলদাবা করে পিওন রামা কুরুপ্পুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি তালুক কোর্টের দিকে রওনা হলেন। রামা কুরুপ্পুর হাতে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁধা একগোছা রেজিস্টার— তাতে বছরভরের কর আদায়ের হিসাবনিকাশ। ভিলুন্নির ক্ষেত থেকে নেমে কুট্টম্বুরম আর মান্নানমে দুবার ফেরিবদল, তারপর নলপথি পাহাড়ির শুনশান ঢাল ছাড়ালে তবে এট্টুমানুর। দুপুরের খাওয়াটা বাদ পড়ে যাওয়ায় খুবই মৃদুস্বরে গজগজ করতে করতে আর বারেবারে থুতু ফেলতে ফেলতে মেননের পিছু পিছু চলছে কুরুপ্পু। কুরুপ্পুর সঙ্গে নিতান্ত কোথাও যেতে হলে একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলা মেননের অভ্যাস। লোকজন কুরুপ্পুকে একেবারেই সুনজরে দেখত না। কুরুপ্পুর কাছাকাছি গেলে সে সেই মানুষটার অন্তর্লীন আত্মাটাকেই যেন গিলে ফেলে, কাঠে উই ধরলে যেমন হয়— কুরুপ্পু সম্বন্ধে প্রচলিত ধারণা ছিল এরকমই। তা ছাড়া ওকে দেখতেও ছিল খানিকটা উইপোকার মতন— রোগা, কিন্তু বের করা পেট আর আঁধারি পোকামাকড়ের মতন ফ্যাকাশে গায়ের রং। এজন্যেই লোকে ওকে বলত উই কুরুপ্পু। পরে, মানে তার অবসর গ্রহণের বছর পাঁচ-ছয় পর, একটা ভোলাভালা সাধারণ লোককে ঠকিয়ে ফেরবার পথে সে একটা হাতির সামনে পড়ে। মাহুত যে তার শান্তশিষ্ট, বাধ্য হাতিটাকে ছাড়া রেখে তার কানের পাশে লম্বা লাঠিটা রেখে জল আনতে গেছে, সেটা কুরুপ্পু খেয়াল করেনি। কাউকে দেখলেই জ্বালাতন করার প্রবল ইচ্ছেটা তার মনে জেগে ওঠে। একটা কলা নিয়ে সে হাতিটার দিকে বাড়ায়। হাতিটা মহা আগ্রহে সেই কলাটা নিতে শুঁড় বাড়ালেই কুরুপ্পু সেটা আবার সরিয়ে নেয়। বেশ কয়েকবার এই কাণ্ডটা করার পর হাতিটার চোখে চোখ রেখে সে কলাটাকে ছাড়িয়ে খেয়ে নেয় আর খোসাটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মানুষের সঙ্গে তার কাটানো সময়ে প্রথমবার মানুষের ওপর যারপরনাই বিরক্ত হয়ে হাতিটা একটা বেড়ার গায়ে কুরুপ্পুকে ঠেসে ধরে দাঁতের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও এই ঘটনার পর থেকে কুরুপ্পুর নাম হয় ‘হাতিতে-কাটা’ এবং ‘হাতিক্ষেপানে’ কুরুপ্পু।

সুতরাং, মেনন যে কুরুপ্পুর সঙ্গে একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে চাইতেন এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। তবে কুরুপ্পুর চেয়েও মন্দ এবং ঘৃণ্য কোনও মনুষ্যপ্রজাতিভুক্ত জীবের সঙ্গেও যে অচিরেই তাঁর সম্যক পরিচয় হবে, আর তার ফলে কোন কোন জঘন্য কাজ বাধ্য হয়ে তাঁকে করতে হবে, তা তখনও মেনন জানতেন না।

মেনন যখন তহশিলদার সুব্রহ্মণ্যআইয়ারের দেখা পেলেন, ততক্ষণে কোর্ট বন্ধ হয়ে কয়েকঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। সুব্রহ্মণ্যআইয়ার আবার কার্যনির্বাহী হাকিমসাহেব এবং করদপ্তরের কর্মকর্তাও বটেন। পেশকার, যিনি তহশিলদারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং গোটা উত্তর থিরুভিথমকুরের প্রশাসক, তিনি আজ হঠাৎ কোর্টে হাজির হওয়ায় অবস্থা একেবারে টালমাটাল। মেনন দেখলেন, পেশকার কোর্টে এসে পৌঁছতেই সবকটা কেরানি আর পিওন ফাইল আর রিপোর্ট নিয়ে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিল। রাজস্ব পরিদর্শকেরা কোনায় দাঁড়িয়ে কাঁপছে। নিজের নিজের জায়গায় প্রায় কেউই বসে নেই। একটা ফর্সামতন ছেলে, চাকরিতে মনে হয় নতুন, সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সর্বসমক্ষে ভেউভেউ করে কাঁদছে, আর তার পাশে দাঁড়ানো একটা হাবিলদার হতভম্ব হয়ে এদিক-সেদিক দেখছে। ওদিকে তহশিলদারের ঘর থেকে কড়া গলার ধমক আর ফাইলের ইতিউতি ছুঁড়ে ফেলার শব্দ ভেসে আসছে। শববাহী মিছিলে যেমন বাজে, তেমনই মুহুর্মুহু ঘণ্টি বেজে উঠছে, আর একজন পিওন ঘরে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে। বেরিয়ে পুনর্বার ঢোকার পথে কোনও এক হতভাগ্য কেরানিকে ভেতরে যাওয়ার শমন দিয়ে যাচ্ছে। এরপর সেই কেরানির জবাবদিহি, এবং অবধারিতভাবে তার মাসমাইনেতে হাত।

পেশকার, সহস্রনামাইয়ার, এসে প্রথমেই দেওয়ালে টাঙানো মহারাজার বাঁধানো প্রতিকৃতিটি পরীক্ষা করলেন। ফ্রেমের এক কোণে একটি কুমোরে পোকার বাসা তাঁর নজরে এল, যা দেখে তিনি রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। সেই তখনই এক দুর্ভাগা পিওন— বেচারার দোষ সে পেশকারের কাছাকাছি এসে পড়েছিল— বরখাস্ত হয়ে গেল। তহশিলদার এসেছিলেন মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থাদি তাঁকে জানাতে। তাঁকেও যারপরনাই গালিগালাজ শুনতে হল। পদস্থ আধিকারিকেরা, যাঁরা এতকাল মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে সম্মান অর্জনের পথ দয়া ও বিনয় নয়, বরং নিষ্ঠুরতা ও ক্রোধ, তাঁদের মুখগুলো হল দেখার মতো। যেন আকস্মিক আগুনের সামনে পড়া হতভম্ব পশু। সাময়িক স্বস্তির আশায় তাঁরা সেইসব নিম্নপদস্থ কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষজনের দিকে ইতিউতি চাইছিলেন, যাদের অন্য সময়ে তাঁরা অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। জেরাঘরের দায়িত্বে থাকা পিওনটির প্রতি তাঁরা এক অভূতপূর্ব সম্মানবোধ করতে শুরু করলেন। সে যেন মৃত্যুর দেবতা যমধর্মনের সেবক চিত্রগুপ্ত, যার কাজ ছিল মৃত্যুর জাবেদাখাতা থেকে একের পর এক নাম ধরে ডাকা।

জিজ্ঞাসাবাদের ফলে বেতনবৃদ্ধি আটকে গিয়েছে, এমন একজন রাজস্ব পরিদর্শক মেননকে বলেন, সহস্রনামন না ছাই! উনি আসলে সহস্রভাগন। হাজার নাম নয়, যাঁর হাজার লিঙ্গ। এসব দেখে বিচলিত হবেন না। ওঁর ধান্দা অন্য। সেটা আদায় না করে ছাড়বেন না!

ব্যাপারটা খুব জটিল কিছু ছিল না। পেশকার জানতে পেরেছিলেন— স্ত্রীর মৃত্যুর পর তহশিলদার আবার বিয়ে করেছেন। তাঁর নতুন স্ত্রী ছিলেন বামুনঘরের যুবতী, যাঁর সৌন্দর্যের গল্প যাকে বলে রটে যেত আগমনের পূর্বেই। মন্দিরের পুবদিকে ছিল তহশিলদারের বাড়ি। রাতের ডিউটিতে থাকা এক পিওন, যার কাজ ছিল তহশিলদারের বাড়িতে ফাইল আনা-নেওয়া করা, নিজের চোখে সেই নববধূকে দেখে। একদিন সকাল সকাল ফাইল আনতে গিয়ে পিওন দেখে, বাড়ির প্রবেশদ্বারে সুন্দর কোলম আলপনা দেওয়া শেষ করে মহিলা উঠোনে একটি গন্ধরাজ ফুলের সুগন্ধ উপভোগ করছেন।

—যেন কুমারানেল্লুর মন্দিরের গর্ভগৃহে সাক্ষাৎ দেবীমূর্তি, পিওনটি যাকে পেত, তাকেই বলে বেড়াত। গায়ের রং তো নয়, যেন নতুন পাকা ধান। আর শাড়ি পরার ভঙ্গিটি! আহা, যা অপরূপ!

তহশিলদারের নতুন বৌয়ের রূপ দেখে আর পাঁচজনের মতো ওই পিওনও একেবারে থ বনে যায়। যদিচ দুনিয়ার হালচাল সম্বন্ধে এই সুন্দরী ছিলেন কিঞ্চিৎ অনভিজ্ঞ, তবু চারপাশের মানুষজনের প্রতি তাঁর ছিল আন্তরিক আগ্রহ আর প্রীতির ভাব। চোখাচোখি হলে পিওনের দিকে তাকিয়ে তিনি হাসেন ও তামিলে তিনি কিছু জানতে চান। আর সম্ভবত পিওনের হয়ে তহশিলদারকে কিছু বলেও থাকবেন; কারণ তারপর থেকে পিওনের প্রতি তহশিলদারের ব্যবহারেও কিছু উন্নতি দেখা দেয়।

মেয়েছেলের ব্যাপারে পেশকারের দুর্বলতার কথা শুধু তাঁর নিজের এলাকা নেইয়াত্তিনকারাতেই নয়, আগের কর্মস্থল থোভালাই, শুচিন্দ্রম বা নাগেরকোয়েলেও কারও অজানা ছিল না। আর তিনি নিজে এতটাই বিকৃত রুচির ছিলেন যে, নিজের মুখে নিজের এইসব নারীঘটিত কীর্তিকলাপের গল্প রটিয়ে বেড়াতেও ছাড়তেন না। স্বামীদের ঘরের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে শোওয়ার মধ্যে তিনি এক বিশেষ বিকৃত আনন্দ খুঁজে পেতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এতে নাকি তাঁর যৌনক্ষমতা বাড়ে। একবার এক আবগারি অফিসারের স্ত্রীর সঙ্গে রাত কাটানোর পর সকালে তিনি পরিতৃপ্ত মুখে বেরিয়ে এসে দেখলেন, স্বামী বেচারা বারান্দার এক কোণে বসে ঝিমোচ্ছে।

তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, এই! ওঠ্‌ বলছি। পাছায় যে রোদ এসে পড়ল!

হতভম্ব স্বামীটি উঠে দাঁড়াতেই পেশকার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন: কিরে, দিনের আলোয় নিজের বউকে কখনও ন্যাংটো দেখেছিস?

লোকটি বলল, আজ্ঞে না, হুজুর।

—বেশ, তাহলে ভিতরে যা। গিয়ে দেখে আয়।

লোকটি বাধ্য ছেলের মতো ভিতরে চলে গেল।

একটু পরেই চাকর তাঁর তাম্বুলসেবনের জন্য তামাক আর পানপাতা নিয়ে হাজির হল। পেশকার তাকে ডাকলেন।

—এই ছোঁড়া, কখনও দেখেছিস, বউ অন্য পুরুষের সঙ্গে রাত কাটানোর পর স্বামী তার ন্যাংটো শরীর কেমন করে দেখে?
—আজ্ঞে না, হুজুর, ছেলেটা বলল; এত বড় একজন মানুষ যে তার সঙ্গে কথা বলছেন, এই ভেবেই সে অবাক।
—তাহলে তাড়াতাড়ি ভিতরে যা আর দেখে আয়, হুকুম দিলেন পেশকার।

দেবস্বম সরাইখানায়, যেখানে পেশকার রাত কাটাচ্ছিলেন, সেখানে ঢোকার মুখে তহশিলদার মেননকে আটকালেন। তাঁদের পিছন পিছন কুরুপ্পু।

—হয় আমার চাকরি যাবে, নয় বউ, তহশিলদার বলেন মেননকে।

মেনন আর তহশিলদার দীর্ঘদিনের বন্ধু। তাঁদের বন্ধুত্ব সামাজিক পদমর্যাদা, প্রতিপত্তি আর জাতপাতের বেড়াজাল অতিক্রম করে কোনওভাবে টিকে গিয়েছিল। তহশিলদার সুব্রহ্মণ্যআইয়ারের বাবা রামাইয়ান মহারাজা মূলম তিরুনালের শাসনকালে এট্টুমানুরে এসেছিলেন এবং তিনিও তহশিলদার হিসাবেই অবসর নেন। সাংকুন্নি মেননের কাকা সঙ্করণ রামন, যিনি তখন প্রব্রুত্তিয়ার ছিলেন, তিনিই প্রতি বছর চিঙ্গম মাসে অবসরপ্রাপ্ত তহশিলদারের বাড়িতে এক গরুর গাড়ি ধান পাঠিয়ে দেওয়ার প্রথা চালু করেন, যে প্রথা মেনন আজও অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলেন। নিন্দুরে গেলে সুব্রহ্মণ্যআইয়ার আর অন্য কোথাও খেতেন না, বরং মেননের স্ত্রীর হাতের সুস্বাদু ঘরোয়া রান্নার জন্য অপেক্ষা করতেন; এমনকি নিজের কট্টর নিরামিষ খাওয়ার অভ্যেস ভেঙে লুকিয়েচুরিয়ে কাজুবাদাম দেওয়া চিংড়ির থিয়াল পর্যন্ত খেয়ে নিতেন।

—হুজুর যদি রাগ না করেন, তবে আমার একটা বুদ্ধি আছে, উইপোকা কুরুপ্পু সরাসরি তহশিলদারকে উদ্দেশ্য করে বলে।

কুরুপ্পুর এই আগ বাড়িয়ে কথা বলায় মেনন বিরক্ত হলেও, তহশিলদারের আশান্বিত মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আর কিছু বলতে পারেন না। কে জানে, এমন অবস্থায় একটা উড়ে যাওয়া কাকও হয়তো কোনও সাহায্যে লেগে যেতে পারে।

—ওঁকে বলুন যে ঠাকরুণের শরীর ভালো নেই, মাসিকের অশৌচ চলছে। তাহলে আগামী এক হপ্তার মতো আপনি নিশ্চিন্ত।

কুরুপ্পু লোকটা হাড়বজ্জাত হলেও, তার কথায় কিছুটা সারবত্তা আছে বলে মেনন আর তহশিলদারের মনে হল। পেশকারের সঙ্গে আসা দফেদারের (এক ধরনের সিভিল সার্জেন্ট) কাছে গিয়ে তাঁরা যথাযথ সম্ভ্রমের সঙ্গে কথাটা পাড়লেন। তিনি যতটা সম্ভব ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথাটা পেশকারকে জানাবেন বলে রাজিও হলেন। কিন্তু পেশকারের কাছ থেকে ফিরে এসে এমন হাবভাব করতে লাগলেন যেন এক্ষুণি একটা মহাপ্রলয় ঘটে যাবে।

—হুজুর তো রেগে আগুন, তাঁর ধূর্ত চোখদুটো যেন জ্বলে ওঠে। অত সহজে ঠান্ডা হওয়ার পাত্র নন আমাদের হুজুর। অন্য কোনও উপায় দেখুন। নইলে কাল কী তুলকালাম কাণ্ড হবে, কে জানে!

সাদা হাফপ্যান্ট আর শার্ট, তার ওপর বুক জুড়ে লাল ফেট্টি বাঁধা— দফেদার যেন সাক্ষাৎ পেশকারের ক্ষমতারই প্রতিমূর্তি।

মেনন তহশিলদারকে একপাশে ডেকে নিলেন।

—আরে, যে বানিয়ান নারায়ণন গাই গরুকে পাল দেওয়ানোর জন্য ষাঁড় নিয়ে ঘোরে, সে-ও তো দেখি এর চেয়ে ভালো!
—একটা উপায় ঠিক হয়ে যাবে, কুরুপ্পু আবার ফোড়ন কাটে।

তহশিলদারের মৌন সম্মতিতে মেনন আর কুরুপ্পু কানাক্কারির পথে রওনা দেয়। তারা চলেছে কুট্টত্থিকে খুঁজতে।

মন্দিরের সামনে থেকে কোয়িপ্পাডম পার হয়ে তারা কানাক্কারির দিকে হাঁটা দিল। মিশমিশে অন্ধকারে ডুবে থাকা সীমানা-কাটা একটা নালার ধার ঘেঁষে আর অন্যপাশের গর্তে পড়ে যাওয়া থেকে নিজেদের সাবধানে বাঁচিয়ে, কোনওমতে হাতড়ে হাতড়ে তারা যখন গন্তব্যে পৌঁছল, তখন নিজের বাড়িতে কুট্টত্থি আর তার স্বামী হাঁটু গেড়ে বসে সান্ধ্য প্রার্থনায় মগ্ন। প্রভু যিশুর নাম ধরে আকুল কান্নার ফাঁকে ফাঁকে মহিলার উচ্চণ্ড চিৎকার শোনা যাচ্ছে। মেনন ভাবে, এ বেটি ভগবানকে স্বর্গ থেকে টেনে না নামিয়ে থামবে না। প্রার্থনা চলতেই থাকল, যেন কোনওকালে তা শেষ হওয়ার নয়। নিজেদের উপস্থিতি জানান দেবার জন্য কুরুপ্পু একটু খুকখুক করে কাশে। ফল হল এই, যে লোকটা তার খোঁড়া পা খানা টেনে টেনে বেরিয়ে এসে একটা খিস্তি দিয়ে আবার ভিতরে ঢুকে গেল। প্রার্থনার জোরও যেন আরও বেড়ে গেল।

—এ ওর আসল স্বামী নয় কিন্তু, কুরুপ্পু বলল। গত বছর থেকে সবে একসঙ্গে আছে।

দুটো মরশুম আগে মারাংগাট্টুপল্লী থেকে এক বুড়িকে সাহায্য করতে পুলিক্কুট্টিসেরি এসেছিল কুট্টত্থি। তার ফর্সা রং আর ডাগরডোগর গতরের জন্য কেউই তাকে বেশিক্ষণ গনগনে রোদে কাজ করাতে চাইত না, তাই সে খেতের আলে বসে বসেও পুরো মজুরি পেত। এমনটাই চলছিল, যতদিন না সে বুড়িকে ছেড়ে ধানবোঝাই নৌকায় আসা এক খোঁড়া লোকের সঙ্গে চলে গেল।

তাদের কারবারের ধরনটা ছিল বেশ অদ্ভুত। খদ্দেররা দিনে রাতে যে-কোনও সময়ে তাদের কাছে আসতে পারত, যদি মূল্য চোকানোর মতো একটা পয়সা বা মাপমতো ধান থাকত তাদের জিম্মায়; যদিও পয়সার চেয়ে ধানই বেশি পছন্দ ছিল কুট্টত্থির। খদ্দেরকে সেই পয়সা বা ধানটা তার স্বামীর হাতে তুলে দিতে হত। সে বসে থাকত দাওয়ায়, সামনে নুড়িপাথরের ছোট্ট একটা স্তূপ নিয়ে। এরপর সেই খদ্দের কুট্টত্থির সঙ্গে এক কামরার কুঁড়েটায় ঢুকে দোরের নারকেল পাতার ঝাঁপটা টেনে বন্ধ করে দিত। স্বামী খুব ধীরে ধীরে তার স্তূপ থেকে একটা একটা করে নুড়ি বাইরে ফেলত, আর পঞ্চাশটা নুড়ি ফেলা হয়ে গেলে দরজায় আঁচড় কেটে সময়ের জানান দিত। আরও দশটা পাথর ফেলার পর সময় শেষ হত। খদ্দের যদি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে না আসত, সে চেঁচামেচি আর বাপবাপান্ত শুরু করত।

হেঁটে হেঁটে সেই এট্টুমানুর যেতে হবে আর সারারাত থাকতে হবে, এবং সেখানকার খদ্দেরটি তার সঙ্গে আসা প্রব্রুতিয়ারের চেয়েও বেশি সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি— এ-কথা কুরুপ্পু কুট্টত্থিকে বোঝাতে সে দাম হিসেবে পুরো এক পারা মাপের ধান দাবি করল। রাজি হয়ে কুরুপ্পু বলল সে নিজের থেকেই ভেদগিরি পাহাড় পেরিয়ে নিন্দুর গিয়ে রাতের মধ্যে ধান নিয়ে আসবে।

—সাবধানে যেও, রাস্তায় শেয়াল আর সাপখোপের ভয়, মেনন বলে।

তবু মনে ভাবে— কোনও শেয়াল, এমনকি চিতাবাঘও, কুরুপ্পুকে চেখে দেখতে চাইবে না। ভুল করে কামড় বসালেও সঙ্গে সঙ্গেই থু থু করে ফেলে দেবে।

কুরুপ্পু চলে গেল, উঠোনে মেনন আর কুট্টত্থির স্বামীকে রেখে।

—মাগী এক্ষুনি বেরুবে, স্বামী মেননকে জানায়।

আধখানা মারোট্টি ফলের খোলে জ্বালানো আগুনটা খোঁচা দিয়ে উস্কে দিচ্ছে কুট্টত্থির স্বামী। পোলিওতে পা দুটো শুকিয়ে কাঠ। ভুঁড়িটা বেরিয়ে, আর মুখটাও ফোলা ফোলা। দেখলেই বোঝা যায় পাঁড় মাতাল।

দাওয়ার মেঝের দিকে চোখ গেল প্রব্রুত্তিয়ার মেননের। নিয়মিত গোবর লেপা না হওয়ায় মেঝেটা এবড়োখেবড়ো হয়ে আছে। সারা উঠোন মাটির ঢেলায় ভর্তি। ভিতের তলা থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে ধেড়ে ইঁদুরগুলো মাটি তুলেছে। এদিকেও নজর দেয় না কেউ। বাড়ির চালটা তালপাতায় ছাওয়া বটে, কিন্তু ঠিকমতো কাটা হয়নি বলে জায়গায় জায়গায় ছোট-বড় হয়ে আছে।

—স্নান করে আসতে বলো, মেনন বলেন।

স্নান করে বেরোতে রাজি হয় না কুট্টত্থি। কিন্তু সরাইখানায় পৌঁছলে সে মত বদলায়। সরাইয়ের পিছনের পুকুরটা দেখিয়ে দেন মেনন।

—আমার একটা উপকার করো বাবু। পিঠটা ঘষে দাও না! মেয়ে বলে।

তহশিলদারের স্ত্রী কুট্টত্থির জন্য তেল, বেসন, গা ঘষার জন্য ইঞ্চাগাছের থেঁতো করা ছাল আর স্নানের পর মাখার জন্য চন্দন পাঠালেন।

—আমাকে বামুনঘরের মেয়ে বানাতে চাইছ না কি গো, ও বাবু, কুট্টত্থি জিজ্ঞেস করে।

মেনন, যিনি সাধারণত মেয়েদের স্নানের জায়গায় উঁকি পর্যন্ত দেন না, জলে নেমে কুট্টত্থির পিঠ ঘষতে শুরু করলেন।

ইঞ্চার সুবাস মেখে গা থেকে খ্রিস্টান-মাপ্পিলা গন্ধ দূর করে, কপালে চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে আর এক বুড়ির সাহায্যে তামিল ধরনে শাড়ি পরে কুট্টত্থি পুরোদস্তুর তামিল ব্রাহ্মণ যুবতী বনে গেল। তহশিলদারের স্ত্রী তাকে পরতে দিলেন একটা দু-পবন সোনার হার, এই কথা আদায় করে যে সকালে ওটা ফেরত দিতে হবে।

এই সাজগোজ করা কুট্টত্থিকে নিয়ে তহশিলদার চললেন পেশকারের ঘরে। পেশকার তখন এলাহি খাওয়াদাওয়া সেরে জিরোচ্ছেন। খাওয়া বলতে ঘি-ভাত, কালান, এরিসেরি, ওলান ইত্যাদি রকমারি তরকারি, ঘোল আর সব শেষে মন্দিরের মিষ্টি পায়েস। তাঁর চোখেমুখে দিনের বেলার সেই অগ্নিশর্মা মেজাজের লেশমাত্রও নেই। এত বিশাল চেহারার পুরুষ তার জীবনে কুট্টত্থি দেখেনি। কিছুদিন আগে মন্দিরে ন্যাড়া হওয়া মাথায় অল্প অল্প চুল, হাতির মতো বড় বড় কান, তার থেকে বেরিয়ে আসা চুলের মধ্যে তুলসিপাতা গোঁজা, আর চওড়া বুক জুড়ে চন্দনের তিনখানা মোটা মোটা দাগ। আর কোমরটাই বা কী চওড়া, বাপরে— কুট্টত্থি অবাক বিস্ময়ে দেখে। বয়স বছর পঞ্চাশেক হবে, কিন্তু এত বিশাল শরীরটাকে ধরার জন্যে ছোট্ট দুটো পা! চলাফেরায় বরং একটু কষ্টই হচ্ছে লোকটার। এদিকে ঘরে ভুরভুর করছে চন্দনের গন্ধ, আর লোকটার গা থেকেও কেমন মন্দিরের প্রসাদী খাবারের গন্ধ আসছে।

—বোসো, সুব্রহ্মণ্যন, একটা চেয়ার দেখিয়ে পেশকার বলেন। কিন্তু তহশিলদার দাঁড়িয়েই থাকেন। বরং তাড়াতাড়ি কিছু জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনা সেরে নিয়ে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে যান, দরজাটা টেনে বন্ধ করে। দফেদারের সঙ্গে সকালের খাওয়াদাওয়া নিয়ে আলোচনাটা সেরে ফেলা দরকার।

কুট্টত্থির আচরণে আর ক্রিয়াকলাপে একেবারে মোহিত হয়ে গেলেন পেশকার। এর আগে কখনও এমন কোনও মহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি তাঁর। কুট্টত্থির হরেক দাবি মেটাতে গিয়ে মাঝরাত হতে না হতেই পেশকার ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। এবার নিতান্তই স্বভাববিরুদ্ধভাবে তিনি মহিলার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। কিছুটা অবাক হয়ে পেশকার দেখলেন যে এই মেয়েটা তাঁকে একটুও ভয় পায়নি। এই অনুভূতি পেশকারের একেবারেই অচেনা। তিনি মেয়েটার কাছে মন উজাড় করে দিলেন, আর প্রায় স্বীকারোক্তির মতো এলোমেলোভাবে এটা-সেটা নানান কথা বকবক করতে লাগলেন। কথা বলতে বলতে একসময় তাঁর স্ত্রীর কথা উঠতেই তাঁর চোখে জল চলে এল।

—আমি ওর কাছে সাক্ষাৎ ভগবান, জানিস! একটা বুভুক্ষু শিশুর মতো তার দুটো নগ্ন স্তনের মধ্যে মুখ গুঁজে বলেন পেশকার। যা ভালো মিষ্টি বানাতে পারে! এই আমার প্রথম কোনও খ্রিস্টান মেয়ের সঙ্গে… জানিস তো, বিভিন্ন জাতের মেয়েরা হয় বিভিন্নরকম। একজন নায়ার মেয়ে একজন শারাস্যারের মতো নয়। আর তামিল মেয়েরা তো একেবারেই অন্যরকম।
—কিন্তু সব পুরুষই একরকম, কুট্টত্থি তাঁকে বলে। মেয়েদের জীবনটা বিপরীত লিঙ্গের মনের সন্ধানে পাগলের মতো দৌড়ে বেড়ানো বই আর কী!

কুট্টত্থিকে চুমুতে ভরিয়ে দিতে দিতে পেশকার তাকে রকমারি প্রতিশ্রুতি দিতে থাকেন।

—যে লোকটা আমাকে এখানে আনল, সে হুজুরকে এক গুঁফোকে নিয়ে কিছু বলছিল। ব্যাপারটা কী গো হুজুর? কুট্টত্থি জানতে চায়।
—ওহ্, হ্যাঁ। এক শালা পুলয়ন একটা পেল্লায় গোঁফ রেখে নাকি চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
—পেল্লায় গোঁফ?
—হ্যাঁ। লোকজনকে ভয় দেখাচ্ছে ব্যাটা। আর এ ছাড়াও নানা বদমায়েশি করছে।
—আমি ওকে দেখতে চাই হুজুর। আমি দেখব! আমি কক্ষনও গোঁফওয়ালা পুরুষমানুষ দেখিনি।
—গোঁফ-টোফ কেমন একটা নোংরা ব্যাপার, না? কী, তোর মনে হয় না?
—না না একদমই না। আমার তো মনে হয়, গোঁফ রাখলে একজন পুরুষমানুষ সিংহ হয়ে ওঠে।

অতঃপর পেশকারের মাথার নতুন গজানো ছোট ছোট চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে সে জিজ্ঞেস করে, তা আমার হুজুরের ছেলেমেয়ে ক-জন?

—নেই। কোনও বংশধর নেই রে আমার। ভগবানের এই আশীর্বাদ আমার আর পাওয়া হল না রে।
—হুজুর রোজ মাসকলাই আর ছোলা খান, সে পরামর্শ দিল। রাতভর জলে ভিজিয়ে রাখবেন। পরের দিন সকালে দেখবেন অল্প অল্প অঙ্কুর বেরিয়েছে। ওইটা খাবেন। শরীরে যে একটু দুর্বলতামতো আছে, এতে সেরে যাবে।

পেশকার পরের দিন খুব ভোরে উঠে, স্নান-টান সেরে মন্দিরে গেলেন, এবং তারপরেই ফিরতি পথে রওনা দিলেন। না জলখাবারের জন্য অপেক্ষা, না তালুক আদালতে আর কোনও তদন্ত। কুট্টথিও চলে গেল— পাওনা ধান ভালো করে গুছিয়ে নিয়ে, এবং তহশিলদারের বউয়ের থেকে ধার নেওয়া সোনার হারটা ফেরত দেওয়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...