তোমায় গান শোনাব

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

দোতলা বাড়িটার একতলার ঘরে তাক তৈরি করে বানানো দেওয়াল আলমারি। তার কাচের পাল্লার ভেতর দিয়ে দেখা যেত যন্ত্রটাকে। কারণ নিচের তাকগুলো কাঠের পাল্লায় ঢাকা। ওপরটা কাচের। সুতরাং তাকের বাইরে থেকে সেটিকে সটান চোখে না পড়ে উপায় নেই। তাতে কী? এই দেখাতে তো কোনও লজ্জা নেই। কারণ সেটা একটা ট্রানজিস্টার রেডিও। আইভরি সাদা শরীরের চারপাশে শেওলা রঙের বর্ডার। ডানদিকের ওপরে তিনটে কালো রঙের নব। মাথায় চারটি চৌকো আকৃতির বোতাম আর একপাশে গুটিয়ে থাকা দীর্ঘ অ্যান্টেনা। জ্যা-মুক্ত তিরের মতো সেটাকে খুলে দিলে অনেকটা উঁচুতে উঠে যায় সেটা। আর চৌকো বোতামগুলোর মধ্যে এসডব্লিউ (sw) লেখা, অর্থাৎ শর্ট ওয়েভ— ওগুলোর একটা টিপে দিলেই কোন সুদূর হতে ভেসে আসে কথা আর সুর। তবে সেই সুরের পরশ পেলেও তার ভাষা বুঝি না।

আমাদের শৈশব থেকে কিশোরবেলা পর্যন্ত গান শোনার যেসব উথালপাথাল ইতিকথা তার মধ্যে উত্তমকুমারের মতো হিরো হয়ে আছে হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানির ওই ট্রানজিস্টার রেডিও। সেটা বৃহদাকার ভাল্ভ রেডিও থেকে সদ্য ট্রানজিস্টরে উত্তীর্ণ হওয়ার যুগ। অথচ ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবাড়ির মতোই প্রবল আভিজাত্য নিয়ে ভাল্ভ রেডিও তখনও তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। প্রচারিত শব্দের স্পষ্টতা বা গাম্ভীর্যে ট্রানজিস্টার যে নেহাতই অপাংক্তেয় এ কথা ইতিউতি শোনা যেত। যদিও আমাদের ছা-পোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে মানানসই ছিল ওই ট্রানজিস্টার আর সেটাই ছিল গান শোনার একমাত্র অবিকল্প মাধ্যম। তবে রেডিওর গান শোনা তো আর ঠিক নিজেদের ইচ্ছাধীন নয়। তাই আকাশবাণী কলকাতার প্রভাতী অধিবেশন থেকে রাত পর্যন্ত বিভিন্ন কিস্তিতে বেজে উঠত প্রিয় যন্ত্রটা। সকালের ‘সঙ্গীতাঞ্জলি’ থেকে দুপুরের ‘অনুরোধের আসর’ বা ‘ছায়াছবির গান’ হয়ে রাত্তির অবধি সব অনুষ্ঠানের নানা শিরোনাম। কিন্তু যেগুলো যেমনভাবেই শুনি না কেন গান শোনার তৃষ্ণা কিন্তু অনায়াসে মিটে যেত, মনে হত না কিছু বাদ পড়ে গেল। সত্যিই যারা আকাশবাণীর অনুষ্ঠানগুলি পরিকল্পনা করতেন তারা বাঙালি শ্রোতার গান শোনার খুঁটিনাটির খবর রাখতেন। যদিও তখন ‘ফিডব্যাক’ জাতীয় কোনও ধারণা আদৌ ছিল না, বড়জোর, কোনও একটি গান বাজানোর আগে ঘোষক বা ঘোষিকা বলতেন এই গানটি শুনতে চেয়েছেন হাওড়া থেকে ঈশিতা ও দেবযানী, বারাসাত থেকে মন্টু, সুধাংশু ও আরতি কিংবা চন্দননগর থেকে খোকন, স্বপ্না ও আরও অনেকে। একটা কথা বোঝা যেত নানান প্রান্তের এইসব অদেখা মানুষগুলি কিন্তু সত্যিই গান শুনতে চাইছেন।

কলের গান লুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন ধরনের আটাত্তর আরপিএমের রেকর্ডগুলির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেল। উন্নততর প্রযুক্তির রেকর্ড প্লেয়ার বা পরে স্টিরিও সিস্টেম মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসতে আরম্ভ করে। নিজেদের পছন্দের গান কিনে শোনার এটা একটা বিকল্প ছিল ঠিকই, যদিও দামের বিচারে রেকর্ডের দাম খুব যে একটা কম ছিল তা নয়। খুব ভুল না করলে সাতের দশকের শেষে একটা লং প্লেয়িং রেকর্ডের দাম ছিল পঞ্চাশ টাকার আশেপাশে। এটা সেকালে অনেক টাকা। তবে এর একটা ভালো দিক ছিল বোধহয় এইটাও যে দাম বেশি থাকার কারণে সপ্তাহে সপ্তাহে মাসে মাসে মানুষ রেকর্ড কিনতে পারতেন না। আমাদের বাড়িতেও তখন মাঝে মাঝে রেকর্ড কেনা হত— রেকর্ড কেনাকে মাসের কেনাকাটার অন্তর্গত করিয়ে নিতে বাবা-মায়ের কাছে বেশ আবদার করতে হত আমাদের। আবদার মিটিয়ে কেনাও হত। কারণ ততদিনে ওই সনাতনী রেডিও-র পাশে একটা ছোটখাটো বাহারি রেকর্ড-প্লেয়ার যন্ত্র আমাদের ওই কাচের আলমারিতে ঢুকে পড়েছে। এটাও হিজ মাস্টার্স ভয়েসের সবচেয়ে বিক্রীত মডেল ‘ফিয়েস্টা পপুলার’। এদের বাইরে তখন দামী স্টিরিও সেট তৈরি করত ‘ফিলিপস’। আর ছিল কান জুড়িয়ে দেওয়া আওয়াজের বাঙালি কোম্পানি ‘সোনোডাইন’— তাঁদের তৈরি কাঠের বক্সের স্টিরিও প্লেয়ার্স ছিল রীতিমত আভিজাত্যের সৌরভ মাখানো। আজকের আইফোনের মতোই স্ট্যাটাস সিম্বল।

কিন্তু রেকর্ডের মহার্ঘ্যতার কারণেই হোক বা যে-কারণেই হোক রেডিওর গুরুত্ব কিছুমাত্র কমেনি। বরং রেডিও আর রেকর্ডের যুগলবন্দিতে আমাদের গান শোনার বহুদিনের অভ্যাসটা একটা অন্য তারেই বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। এই চেহারাটা অন্য একটা মাত্রা পেল ক্যাসেট চালু হওয়ার পর। সাবেকি ভাল্ভ রেডিওর নীল রক্তকে পরাস্ত করে একসময় ট্রানজিস্টার রেডিও আমজনতার ঘরে ঘরে গান শোনার অভ্যাসকে ঢুকিয়ে দেয়। রেকর্ডের মরা গাঙে ঠিক তেমনি বন্যার উদ্দামতা জাগিয়ে দিল ক্যাসেট। হয়ে উঠল জনতার গান শোনার আরেক সহজ মাধ্যম। দাম অনেক কম, অথচ ক্যাসেটে গান মেলে অনেক বেশি। অর্থনীতির সাধারণ নিয়মে রেকর্ড ও রেকর্ড প্লেয়ারকে ডোডোপাখির মতো লুপ্ত করে দিয়ে গানের মাধ্যম হিসেবে মস্ত পাখা মেলে দাঁড়িয়ে গেল ক্যাসেট। দামের নাগালে চলে এল ক্যাসেট প্লেয়ার বা পরে টু-ইন-ওয়ান, যাতে রেডিও আর ক্যাসেট একসঙ্গে বাজানো যায়। আকাশবাণীর সাজানো বাগানের শুকিয়ে যাওয়ার সূত্রপাতও এইখান থেকে। কালের নিয়মে এই ক্যাসেট-প্লেয়ার ঢুকে পড়েছিল আমাদেরও ঘরে। কিন্তু হাতের কাছে চাইলেই গান, এত এত গান! সাবেকি এইচএমভি, ইএমআই কোম্পানির পাশেপাশে তৈরি হল ক্যাসেট প্রকাশনার অনেক নতুন কোম্পানি। আর যাকে প্রায় প্রতিবিপ্লবের মতো পেড়ে ফেলল ‘জাল’ ক্যাসেট যার ভালো নাম পাইরেটেড ক্যাসেট। হাওড়া স্টেশনে সাবওয়ের মুখে কলা, মুসুম্বিলেবু, পেয়ারার পাশে ঢেলে বিক্রি হতে দেখা গেল দশ টাকার ক্যাসেট। নামী শিল্পীদের গান, ফিল্মের গান যার যেমন চাই। এই লে-লে-বাবু ছ-আনায় সঙ্গত করল ধর্মতলা মেট্রো গলি, চাঁদনি চক। ভূতের রাজার দেওয়া বরে যদি হাতের তালি দিলেই ভালো-মন্দ খাবার পাওয়া যায় তাহলে আর আলাদা করে রসনা অতৃপ্ত থাকে কি?

প্রযুক্তির হাত ধরে গান শোনার নিত্যনতুন মাধ্যম আবিষ্কৃত হয়েছে আরও পরের জমানায়। আর এই প্রশ্নটাই আরও চওড়া হয়ে দেখা দিয়েছে আমাদের সামনে। একসময় আধুনিকতর প্রযুক্তির সহযোগিতায় আড়াই ইঞ্চি ব্যাসার্ধের কমপ্যাক্ট ডিস্কে অনায়াসে দুশো-আড়াইশো গানকে ধরে রাখা গেল। সংখ্যাটা অনায়াসে দু-আড়াই হাজার হয়ে গেল ডিভিডির দৌলতে— খোলা বাজারে এইসব গানের ডিভিডির সর্বোচ্চ দাম দাঁড়াল সত্তর-আশি টাকা। এসে পড়ল পরের আমলের এমপি-থ্রি (mp3) প্লেয়ার, আইপড। আর তারপর সিডি-ডিভিডিকে পথে বসিয়ে মোবাইল ফোনের মাইক্রোচিপে ঢুকে পড়ল গান। অবশেষে স্মার্টফোনের ‘সব পেয়েছির দেশে’ গান-ছবি-ভিডিও সমেত গোটা সঙ্গীত দুনিয়া এসে পড়ল মুঠোয়। এর সঙ্গে কম্পিউটার বা ল্যাপটপ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবকিছুর জন্য তো তৈরি আছেই। ফলে হাটে-মাঠে-ঘাটে রাস্তায় শপিংমলে-বাসে-অ্যাপক্যাবে-রেস্তোরাঁয় আমরা দেখতে পাই কিছু মানুষ কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে (ইদানিং ব্লুটুথ হেডফোন বা…) গান শুনছেন। এই দৃশ্য আমাদের ছোটবেলায় আমরা দেখিনি। আভিজাত্যের চৌকাঠ পেরিয়ে গানের আগুন সবখানে ছড়িয়ে যাওয়া দৃশ্যটি অভিনব কিন্তু এর ঝরনাতলায় যারা স্নাত হচ্ছেন তাঁরা কি ঠিক ঠিক গান শুনছেন? কোথাও যেন মনে হয় রোদে রাঙা ইটের পাঁজার উপর বসে থাকা রাজার মতো হাতে ঠোঙা ভরা বাদামভাজা (পড়ুন গান) নিয়ে আমরা বসে আছি— খাচ্ছি কিন্তু গিলছি কি?

সংশয়ের এই প্রান্তটাকে আরও চওড়া করে দেয় আমাদের গান শোনার চেনা অভ্যাসের মধ্যে টেলিভিশনের খেলতে নামা। সত্তরের দশকে মাঝামাঝি যখন কলকাতায় টেলিভিশন চালু হয় আমাদের গান শোনার নির্জন জগতে সে ছিল এক অবাক আলোর লিপি। এতদিন ধরে যে জর্জ বিশ্বাসের গান আমরা রেডিওতে শুনে মুগ্ধ ছিলাম, টিভির পর্দায় সেই তাঁকেই যখন দেখলাম খোলা গলায় ‘কেন তোমরা আমায় ডাকো’ গাইতে শুরু করলেন, নিশ্চয়ই সেটা নতুন অভিজ্ঞতা। হাতা-গোটানো শার্টে হেমন্তবাবু যখন ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে গেয়ে’ ওঠেন— ক্যামেরা ক্লোজআপ করে ধরে নেয় তার মুখের ছবি— অচেনা আনন্দে আমরা শিহরিত হই। কারণ তারপর যতবার ওই গান শুনব রেডিও-রেকর্ডে বা ক্যাসেটে ওই ছবিটাই স্থির হয়ে ভেসে থাকবে আমাদের মনের মধ্যে। হ্যাঁ, এটা একরকমভাবে গানকে দেখা। আমার দৃশ্য-অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে তার গায়ক বা গায়িকাকে দেখা, দেখতে দেখতে শোনা। টিভির অনুষ্ঠান তো তখন মাঝেমধ্যে হয়। তার বাইরে যে পড়ে থাকা সময় সেটা তো গান শোনারই সময়। এটা স্বীকার করা প্রয়োজন, অনেকদিন পর্যন্ত টিভির এইসব অনুষ্ঠান দেখার সঙ্গে শোনার এই নিবিষ্টতাকে ছিঁড়ে দু-টুকরো করতে পারেনি।

তার একটা অন্য কারণও ছিল। রেডিও বা রেকর্ডে গান শোনার পাশাপাশি অনেকদিন ধরেই আমরা মঞ্চে বা প্রেক্ষাগৃহে গান শুনতে অভ্যস্ত। এককালের কিংবদন্তি শিল্পীরা নিয়মিত জলসায় গান গাইতেন, প্রচুর শ্রোতা পেতেন, পেতেন জনসমাদর। টিভির প্রথমদিকের অনুষ্ঠানগুলো জলসা ঘরানারই এক-একটা খণ্ডচিত্র যেন তুলে আনত আমাদের ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে। সেকালের সরকারি টিভি তার ভূমিকাকে এর চেয়ে বেশি বাড়ায়নি, বাড়াতে চায়ওনি। কিন্তু সত্যিই একটা সময় টিভি তার জটাজাল বিস্তার করে তছনছ করে দিল আমাদের গান শোনার যাবতীয় নিভৃতি। দেখা আর শোনার নিবিড় মিলনগ্রন্থি ছিঁড়ে ফেলে গান আর শোনার ব্যাপার রইল না, হয়ে উঠল শুধুই দেখার। সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত করতে গেলে নব্বই দশকের গোড়ার পর্বে এই ভাঙচুরের সূত্রপাত। হরেক কিসিমের টিভি চ্যানেলের গোলকধাঁধায় আজ যার ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে বলে ধরা যায়। যে-কোনও টিভি চ্যানেল খুললেই আজ গানের এক আলাদা চেহারা। কোথাও গান নিয়ে শ্বাসরোধকারী প্রতিযোগিতা, এক-আধ কলি গান গাইলেই কেল্লা ফতে করে দিতে পারেন যে কেউ! কোথাও দেখা যাবে গানের সাড়ম্বর প্রতিযোগিতা। গান গাইবার সময় মঞ্চ জুড়ে বাহারি আলোর কেরামতি, টিভির পর্দায় গায়কের পাশে পাশে মাল্টিমিডিয়ার প্রকৌশলী উপস্থাপনা, নানান কোণ থেকে আলো এসে পড়ছে গায়ক-গায়িকার শরীরের ওপর, তার পোশাকের ওপর— যেসব পোশাকের বিন্যাস নাকি ঠিক করে দেন এসব অনুষ্ঠানের আয়োজকরাই! এসব দেখতে দেখতে দর্শকরা হাঁ হয়ে যাচ্ছেন, চ্যানেলের টিআরপি বেড়ে যাচ্ছে। অথচ শ্রোতাদের মগজে কারফিউ। গায়ক আসলে কী গান গাইলেন, কেমন গাইলেন সেসব অপ্রাসঙ্গিক— এই গান শোনার নয়, দেখার। নিজের ঘরের আধো-আধো বুলি ফোটা ছেলেমেয়েকে মঞ্চে নামিয়ে দেওয়ার ক্ষ্যাপামি। নিজেদের প্রতিযোগিতার আগুনে উস্কে দেয় এই গান। উস্কে দেয় বলেই কোনও এক টিভি চ্যানেলের সঙ্গীত প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাইপর্বের অনুষ্ঠান ঘিরে সায়েন্স সিটি প্রেক্ষাগৃহের সামনে পুলিশকে বেধড়ক লাঠি চালাতে হয় কয়েক বছর আগে। বিচারকদের সামনে এক লাইন গান গাইলেন প্রতিযোগী আর আমরা টানটান উত্তেজনায় অপেক্ষা করছি ছেলেটা বা মেয়েটা পারবে তো পরের লাইনগুলো ঠিক ঠিক গাইতে? যেন কেবিসির হটসিটে বসে আছেন অমিতাভ বচ্চন তার সামনে এক প্রতিযোগী— আসমুদ্রহিমালয় থর থর করে কাঁপছে! হাতে মাত্র এক ওভার, এখনও কুড়ি রান করলে জয়— চার-ছয় হাঁকড়িয়ে ওই রান তুলে নিতে পারবেন তো বিরাট কোহলি বা রবীন্দ্র জাদেজা? গান মানে এখন সেই উত্তেজনার চটজলদি পুরস্কার। গান মানে আরও অনেক কিছু। গান মানে সেভাবে বোধহয় আর নয় গান শোনা। নিভৃতি। একান্তের উত্তরণ।

 

দুই.

গানের এই দেখনদারি পেরিয়ে এলে শেষ পর্যন্ত গানের আবেদন তো আমাদের শ্রুতির কাছে। সুরের আঁচল বিছিয়ে আসলে সে তো আমাদের শরীর মনকে স্নিগ্ধ করায়। বিশ্ব যখন নিদ্রামগন গগন অন্ধকার তখন একলা মানুষের মনের বীণায় যে ঝঙ্কার ওঠে গানই তো তাকে শরীর পেতে দেয়। আবার ‘সুর শোনায়ে যে ঘুম ভাঙে’ সেই পরম রমণীয় সত্যিই কখনও আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে ডাক দেয় বাইরের দিকে। সলিল চৌধুরী যখন লেখেন ‘মানব না এই বন্ধনে/মানব না এই শৃঙ্খলে’ তখন কোথাও সেই শেকল ছেঁড়ার ডাক যেমন শুনি তেমনি যখন কোনও হা-ক্লান্ত কারখানা শ্রমিক, ইদানিংকার কল সেন্টার বা গিগ কর্মী ঘরে ফিরে লঘু গানের সুরে ডুবে থাকে— এই অবগাহনে তার ক্লান্তি ঝরে যায় বলেই তো পরের দিনটার জন্য সে প্রস্তুত হতে পারে। প্রতিযোগিতার তীব্রতায় মার খেতে খেতে ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে আরও আরও প্রাণের’ আর্তির কথা গানে শুনে কারও মন যখন উদ্দীপ্তির খড়কুটো আঁকড়ে ধরে সেটা তো পুরোটাই তার অনুভবের। এসবই সেই গান শোনার অভিজ্ঞতা। একালের গায়ক আবার যখন বিশ্বসংসারের উপর অভিমান করে বলেন ‘শুনব না গান/গান শুনব না’, তখন সেই অভিমান কিন্তু বেয়ে আসে গানেরই শরীর বেয়ে। ঠিক তখনই কেউ গানওয়ালার কাছে নামিয়ে রাখে তার বিপন্নতার নিবেদন: ‘ও গানওলা, আরেকটা গান গাও/আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই, কিচ্ছু করার নেই’। স্থাণুতার সেই ভারি পাথরটা গানের টানেই যেন সরে আসে তখন। গান শোনার ভিতর দিয়ে স্মৃতির আকাশে আমাদের অনেককালের মনের কথা জেগে ওঠে— গানের ভুবন হয়ে উঠতে থাকে কাঙাল।

আমার ভিতরের সেই ছেলেবেলার কিশোরটিকে আজ বারবার বলতে ইচ্ছে হয় তার বড় হয়ে ওঠার রঙিন গল্পগুলো। গান শোনার এই ছবি বিছিয়ে ধরতে ইচ্ছে করে পৃথিবীর প্রত্যেকটি সবুজ কিশোর-কিশোরীকে যারা এখনও বহুদিন শুনতে পাবে গান। এই গান কি হতে পারে না তাদেরও মাধুকরী? যত মানুষ নিজেরা গান গাইতে জানেন, গান শোনেন তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ। কারণ গান মানে বিনোদনও তো বটে। কিন্তু নিছক বিনোদনের খেলো অস্তিত্বের বাইরে গান এমন কিছুর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নেওয়া এমন কিছু, যাকে এড়িয়ে থাকা যায় না। জীবনের সঞ্চারপথের প্রত্যেকটা মুহূর্তে যে সংকট আর অস্থিরতা এসে পথ আগলে দাঁড়ায়, গানের স্পর্শ কোথাও তার দিকে হাত বাড়ায় শুশ্রূষার। এই সংকটে নবীন কৈশোরের সামনে আছে গান শোনার এক চিরকালীন খোলা আকাশ।

তবু গান ঘিরে বাণিজ্য বিস্তারের মন্থনে উঠে আসে গানকে নিয়ে শুধু দেখার সমূহ আয়োজন। তার নাম কখনও গানের লড়াই, কখনও মিউজিক ভিডিও। আশ্চর্য কিছু বেরসিক নির্বোধ গানকে বন্দি করতে চায় ক্যামেরার ফ্রেমে। যেন শিশির পতনের গান ক্যামেরার ফ্রেমে আটকে রাখা যায়, ধরা যায় পাহাড়ি পথে একলা চলা ঝরনার গান, অরণ্যের গভীর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের কাঁপন, পাখির ডানার শব্দ! কিন্তু এই নির্বুদ্ধিতার অন্তরালে সেই ব্যথাময় কৈশোরের মুখ অপেক্ষা করছে গানের মধ্যে দিয়ে ঘটে যাওয়া কোনও ম্যাজিকের। সে প্রত্যাশা করছে একটা গান শোনার পর সে নতুন করে গানের ভিতর দিয়ে দেখতে পাবে বদলে যাওয়া পৃথিবীর আদল। ঠিক যেন ‘পান্থ পাখির রিক্ত কুলায় বনের গোপন ডালে/কান পেতে ওই তাকিয়ে আছে পাতার অন্তরালে’। বিপন্ন কৈশোরের এই কান পেতে থাকা আসলে সেই গান শোনারই অপেক্ষা।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...