নন্দীগ্রাম ও সমসাময়িক একপাতা কলকেতা বিপ্লব

অভ্রদীপ ঘটক

 

রাতের কলকাতা। অনেক রাত। অনেকটা এলাকা হলুদ আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে, আর তার পাশেই অন্ধকার গলিগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে কিছুদূর গিয়েই।

টুপটাপ করে এক ফোটা-দু-ফোটা বৃষ্টি নামল। আমাদের গাড়িটা বারবার বাঁক নিয়ে অলি-গলি পাকস্থলির ফাঁকে চলছে ভয়ে ভয়ে। আমি আর দেবশ্রী সামনের সিটে, পেছনে অয়নদা, পুষ্টি— আর কে যেন মনে নেই।

আমরা সবাই সাউথ কলকাতার এক গাড়িতে— যা হয় আর কী! কেউ সিগারেট খাচ্ছে না, কথাও বলছে না। চারদিকে থমথমে শহর। আমরা ঘরে ফিরছি।

বিপ্লব, ৩৪ বছর দীর্ঘজীবী হওয়ার ফল পাচ্ছি।

বামমনোভাবাপন্ন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাজ করি। আমাদের মধ্যে বিপ্লবের লেশমাত্র ছিল না। পুরো কর্পোরেট চ্যানেল। ভালো স্যালারি, মেডিক্লেম, পিএফ মিলে-মিশে পাকা চাকরি। উডল্যান্ড ছাড়া পরি না, হাতে সোনি এরিকসন!

বাংলা তখন অনেক স্থিতিশীল। সেক্টর ফাইভে নিত্যনতুন কোম্পানির আনাগোনা, বেসরকারি কলেজে জমজমাট ক্যাম্পাসিং।

মফস্বলীয় রাজনীতি যদিও অনেকটা “হেইল হিটলার” ধরনের ছিল। মানুষ জাতটাই বেইমান। আমার মনে হয়, জম্বি বলে আলাদা কিছু হয় না। সুস্থ-স্বাভাবিক সিরিয়াল দেখা, বাজার করা মানুষ এক নতুন দিনের স্বপ্ন ৩৪ বছর ধরে পুষে এসেছে। সেই পোষ্য স্বপ্নটাই ভোটব্যাঙ্কে রূপান্তরিত হয়েছিল। মহানাগরিক সন্ত্রাস ছিল না। নিউজ-মিডিয়া সবেতেই দেখানো লাল পতাকায় মোড়া বাইকবাহিনীকে আমি বারবার, অনেকবার দেখেছি আমাদের বাড়ি জলপাইগুড়ির রাস্তায়। তারাই অবশ্য পতাকার রং বদলাতে বদলাতে গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।

২০০৬ সালের শেষের দিকে বামফ্রন্ট সরকার তার শিল্পায়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নন্দীগ্রামে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ) গড়ে তোলার জন্য প্রায় ১০,০০০ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব আনে। প্রস্তাব ভালোই ছিল, প্রশ্ন নেই।

এই জমি সুদূর ইন্দোনেশিয়ার সালিম গ্রুপকে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল।

স্থানীয় কৃষকেরা, যাঁদের জমি জীবিকার একমাত্র উৎস, এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা শুরু করেন। এখন প্রশ্ন— জমি নিয়ে বিরোধিতা নন্দীগ্রামে আগেও হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক রং লাগেনি।

আন্দোলন টুকটাক চলতেই থাকে। বছর গড়িয়ে যায়। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি (BUPC) গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন মূলত স্থানীয় মানুষ এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি।

বছরের শুরু থেকেই নিউজ-মিডিয়া নন্দীগ্রাম কভার করতে শুরু করে। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়। প্রশাসনের প্রবেশ ঠেকাতে গ্রামবাসীরা রাস্তা কেটে ফেলে, বাঁশ-গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করে।

১৪ মার্চ ২০০৭। রাজ্য পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনী ব্যারিকেড সরিয়ে নন্দীগ্রামে প্রবেশ করে। বিরাট সংঘর্ষ শুরু হয়। আমরা অফিসের টিভিতে লাইভ দেখি। চায়ের কাপ হাতে বসে। আর হেডলাইন পাল্টাতে থাকি বারবার।

পুলিশের গুলিচালনায় সরকারি হিসাবে অন্তত ১৪ জন নিহত হন, অগণিত মানুষ আহত হন।

স্থানীয় এবং বুদ্ধিজীবী বিপ্লবীদের দাবি, নিহতের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি, এবং সেই সময়ে সরকারি-বেসরকারি সূত্রে জানা যায়— অনেক নারীও নির্যাতনের শিকার হন। তা নিয়ে শাসকদলঘনিষ্ঠ এবং বর্তমান বুদ্ধিজীবী-বিপ্লবী এক চলচ্চিত্রকার ম্যাডাম নির্যাতিতা নারীকে দেহব্যবসায়ী দেখিয়ে এক দীর্ঘ, রগরগে চলচ্চিত্রও তৈরি করেন। মনে করা হয়, এই ছবিটি ছিল শাসকদলের কফিনে শেষ পেরেক। সেই পেরেকটি— অর্থাৎ প্রথম সিডিটি— আমাদের অফিসেই আসে। আমরা অফিসে বসে অনেকে মিলে সেই সিনেমাটি সিডি চালিয়ে দেখি।

যা হোক, ১৪ মার্চ ২০০৭-এর গুলিকাণ্ডের পর কলকাতার কলেজ স্ট্রিট, অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস, এসপ্ল্যানেড এলাকায় একের পর এক প্রতিবাদসভা ও মানববন্ধন শুরু হয়। মহাশ্বেতা দেবী সেই আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র হয়ে ওঠেন। তিনি সরাসরি নন্দীগ্রামে যান এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ান। শঙ্খ ঘোষ, সুবোধ সরকার, সুশোভন বসু, নবারুণ ভট্টাচার্য, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, কৌশিক সেন, অপর্ণা সেন-সহ বহু শিল্পী মিছিলে নামেন। এই মুখের সারির অনেকের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে যদিও প্রশ্ন উঠেছে বারবার। নাটক, কবিতাপাঠ, পোস্টার, কার্টুন, রাস্তার গান— সবই আন্দোলনের প্রচারে ব্যবহার হয়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন এবং অভিনেত্রী অপর্ণা সেন প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে তৎকালীন রাজ্য সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। কবি শঙ্খ ঘোষ তীব্র ভাষায় বলেন, এটি গণতন্ত্রে অগ্রহণযোগ্য।

আমাদের অনেক মিডিয়ার বন্ধু সে সময় নন্দীগ্রামে গিয়ে জমিরক্ষা কমিটির পাশে দাঁড়ান। তাঁদের একজন, বর্তমানে প্রবাসে থাকা জ্যোতিস্মিতা, সেদিনই আমায় বলেছিল—

“শোন, আমি টানা ১০–১২ দিন নন্দীগ্রামে ছিলাম, কভার করতে। আমাদের বাংলা নিউজের প্রতিটি স্টোরি মূলত গল্পই। ওখানে দিনে কী হত, আর রাতে কী কী ঘটত— সেসব আর না বলাই ভালো। পরিস্থিতি নিয়ে লাইভ হত, আমিই কভার করতাম, কিন্তু নেপথ্য কাহিনি প্রকাশের নির্দেশ ছিল না।”

সেই সময়েই একাধিক শিল্পী, লেখক, সিনেমা ও থিয়েটারকর্মী নন্দীগ্রামে গিয়ে আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়ান, তাঁদের সঙ্গে রাত কাটান, কলকাতা থেকে খাবার ও চিকিৎসা-সাহায্য পৌঁছে দেন। একটা মুভমেন্ট চলতে থাকে, যা গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে যায়।

অনেকেই পুলিশি বাধা ও ব্যারিকেড উপেক্ষা করে নন্দীগ্রামে প্রবেশ করেন, এবং তা সংবাদমাধ্যমে বড় খবর হয়। কলকাতার সাংস্কৃতিক মহলের প্রতিবাদ আন্দোলনকে শহুরে মধ্যবিত্তশ্রেণির মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলে। হ্যাঁ, জনপ্রিয়ই বলব। কেউই আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে নিজের বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন না, যে কোনও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে মধ্যবিত্তদের আদর্শ-ফাদর্শ কিছু আছে।

সেটা কি কোনওকালেই ছিল?

মেকআপ করে আন্দোলনে নামতে আমরা দেখেছি। দেখেছি— গান, নাচ, কবিতা, স্লোগান— সব মিলেমিশে একটা ‘জোশ’-এর বহিঃপ্রকাশ চলতে থাকে। হিউম্যান সাইকোলজি বলে, অ্যাড্রিনালিন রাশ না হলে মানুষের কোনও কাজই করার ইচ্ছে হয় না।

আজ আগস্টে আমি আরজিকরের মেয়েটির জন্য জমায়েত, প্রতিবাদ, রাতদখলে আছি— আবার সেপ্টেম্বরে গোয়া ট্রিপে বিকিনি পরে বিচে সেলফি তুলছি। আজ আমি চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে গান গাইছি, মশাল হাতে গরম গরম স্পিচ নামাচ্ছি— আর সেই আমিই ঠিক পরের দিন ফ্যাশন শোয়ের জাজমেন্ট দিচ্ছি।

এটাই লাইফ, কালীদা।

এটাই বর্তমান বাংলার বিপ্লবের রিয়েল ফেস।

বাঙালির বিশ্বায়ন ঘটে গেছে, মেসোমশাই। গোটা জাতটাই এখন রিল আর ভিউয়ের ছকে বন্দি।

যা হোক, আবার ফিরে যাই নন্দীগ্রামের দিনে।

রাতের গাড়ি আমায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। মধ্যরাতের ঢাকুরিয়া বাসস্ট্যান্ড। আমি একলা রাস্তায় হাঁটছি, বাড়ি ফিরছি। আশেপাশে প্রচুর লোকজন, মোড়ে মোড়ে জমায়েত। আমার এক চেনা রিকশাচালক ছিলেন— বোবা মানুষ।

রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ঈষৎ টলছিলেন। আমায় দেখে ঝলমলিয়ে হেসে উঠলেন। হাতের ডানদিকে উঁচুতে উড়তে থাকা ভেজা লাল পতাকার দিকে তাকিয়ে অশ্লীল ইশারা করলেন।

অর্থাৎ— এদের ইয়ে মারা গেছে, আর কী!

আমি প্রায় মাথা নিচু করে, খানিক ভয়েই রেললাইন পার হয়ে অন্ধকার গলিতে ঢুকে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম, একটা বড়সড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। আমাদের ছোটবেলার অনেক মিথ ভেঙে দাঁত-নখ বের করে সামনে চলে আসছে।

তখনও বুঝিনি, আমার মফস্বলের সরকারি লালে মোড়া রবীন্দ্রভবন বইমেলা প্রাঙ্গণে ‘যখন সময় থমকে দাঁড়ায়’-এর পরিবর্তে একদিন নীল-সাদায় মোড়া, ফুডস্টল-সর্বস্ব প্রাঙ্গণে ‘মা আম্মি মাদার’ বাজবে!

বিপ্লব শুরু হল অন্যদিকে।

ঢাকুরিয়া ব্রিজের মুখে আমি আর মাম চা খাচ্ছি। লাল পতাকায় মোড়া এক টোটোচালককে এক ছোকরা-ধরনের ছেলে আমাদের সামনেই হাত দেখাল— গড়িয়ার দিকে যাবে।

টোটোওয়ালা দাঁড়াল না, অর্থাৎ যাবে না।

ছেলেটি এক দৌড়ে গিয়ে টোটোওয়ালাকে কলার ধরে হিড়হিড় করে নামিয়ে টেনে এক চড় মারল। ওর কলারটা ধরে সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “অনেক হয়েছে, আর না! অনেক দাদাগিরি মাড়িয়েছ! এবার থেকে এরকমই হবে— আমাদের নতুন যুগ শুরু।”

সেই “ওদের” যুগ এখনও চলছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...