
বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
ছায়াপাখি
এক.
এবারের আসাটা একদম অন্যরকম।
দেশে আসবার থাকলে একটা সাজ সাজ রব ওঠে। অনেকদিন ধরে সবার কথা মনে করে জিনিস কেনা হয়। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে অনেক লোকের সঙ্গে দেখা করবার সদিচ্ছা। পুরনো পরিচিতিগুলো ঝালিয়ে নিয়ে স্মৃতি কুড়ানোর তাড়া। মনের মধ্যে দূরে থাকা প্রিয় মানুষগুলোর জন্য, নিজের শিকড়ের জন্য একটা টান গড়ে দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকে। তাই অনেক পরিকল্পনা থাকে একেকবার দেশে আসার আগে।
এবার সেসব কিছুই নেই। এ যাত্রায় হীরক একা। এই আসা নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার। নিজের আত্মাকে পুনরুদ্ধার করার প্রয়াস। এই ভাবনাগুলো ঠিক ঠিক শব্দ সাজিয়ে কাউকে বুঝিয়ে বলা তেমন সহজ নয়। হীরকও পারেনি জিনিকে বোঝাতে।
সুটকেস গুছিয়ে মাডরুমের পাশে বসে মাথা নিচু করে জুতোর ফিতে বাঁধছিল হীরক। জিনি পিঠের পিছনে হাত রেখে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো। তার চোখের দৃষ্টি হীরকের মনের ভিতরটা পড়বার চেষ্টায় স্থিরপ্রতিজ্ঞ। তুমি কিন্তু এখনও বললে না, হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই কেন তোমাকে দেশে ছুটতে হচ্ছে।
হীরকের মনে শব্দহীন বাক্যালাপ।
—গত চার সপ্তাহ ধরে প্রতি উইকেন্ডে কোথায় বেরিয়ে যাচ্ছ, একেবারে ফিরছ সোমবার সকালে। কোথায় গেছ, নিজের পরিবার ছেড়ে কার সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি ভাল লাগছে আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করোনি। আমি তোমার ডোরম্যাট নই। যখন ইচ্ছে যেভাবে খুশি ট্রিট করতে পারো না।
প্রতিটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে জিনির গলা চড়ছিল। অনেক সহ্য করেছে মুখ বুজে। এক ছাদের নিচে থাকতে হলে এর চেয়ে বেশি কমিটমেন্ট আশা করে জিনি।
জিনির গলায় উত্তেজনা থাকলে, হীরকের গলায় ক্লান্তি। তোমার কথাগুলো সব সত্যি। আসলে কী জানো, মানুষের যখন কোনও শারীরিক অসুখ হয়, তার অনেকরকম বহিঃপ্রকাশ থাকে। খুব জ্বর হলে মানুষ ভুল বকে। সবাই তার কারণ বুঝতে পারে। সমবেদনা জাগে। অন্তত যার অসুখ তাকে দোষ দেয় না। মনের অসুখে সেটা হয় না। যে অসুস্থ তাকেই মানুষ ইটপাটকেল ছোড়ে।
—তোমার মনের অসুখ হলে ডাক্তার দেখাও। কলকাতায় যাওয়ার কি প্রয়োজন? এখানে তো সাইকিয়াট্রিস্টের অভাব নেই বলেই জানি।
জিনির কথার তির হীরককে বিঁধল না। শান্ত গলায় বলল, তোমার সঙ্গে বিয়ের আগে আমার একটা অতীত ছিল।
—প্রেমিকা? জানতাম। জানতাম একদিন এই কথা উঠে আসবে।
—ওরকম সরলীকরণ কোরো না। আমার সেই অতীতে শানু ছিল, যাকে তুমি দেখেছ। আমার সেই জীবনে রেখাও ছিল, যাকে তুমি দেখোনি। একসময় ওদের জীবনের সঙ্গে আমার প্রতিদিনকার বেঁচে থাকা, শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া মিলে থাকত। সেই মিলে থাকাটা সুতোয় সুতো জড়িয়ে কাপড় বোনার মতো। একটা সুতো টান মেরে বের করে নিলে পুরো বাঁধুনিটাই আলগা হয়ে যায়। বলতে বলতে হীরকের কথা হোঁচট খেয়ে থেমে গেল। আমি বোধহয় বোঝাতে পারছি না ঠিক করে।
—না না বলো, আমি শুনছি। ডান হাঁটুটা তুলে পায়ের পাতা পিছনের দেওয়ালে ঠেকাল জিনি। কঠিন কিছু শোনার প্রস্তুতি।
—আমি অতীতের কিছু ভুল শোধরানোর চেষ্টা করছি জিনি। জুতোর ফিতে বাঁধা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছিল হীরক।
—আমাকে বিয়ে করার ভুল? ডিভোর্স চাও? মুখ ফুটে বলছ না কেন সেই কথাটা?
—মুখে কথা বসিয়ে সমাধান হবে না জিনি। আমি শানু আর রেখার সঙ্গে ভুল করেছি, সেই কথা বলছি।
—সেই ভুলের শোক এতদিন বাদে উথলে উঠল কেন? গলায় কাঁপতে থাকা বিদ্রূপ চাপা দেওয়ার কোনও চেষ্টা জিনি করল না।
—সময় সব কিছু ভুলিয়ে দিতে পারল না জিনি।
—কী ভুল? তুমি কি ওদের কোনও ক্ষতি করেছ? তোমার ভুলে কি ওদের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে?
—আমার জন্য হয়েছিল কি না, সেটাই কি বড় কথা? শানু পিছিয়ে পড়ল, আমি কি দাঁড়িয়ে হাত ধরে টেনে তুলতে পারতাম না? রেখার জীবন নষ্ট হয়ে গেল একটা অমানুষের জন্য। আমি কি সেখানে দাঁড়িয়ে মানুষের প্রতি ওর বিশ্বাস ফেরাতে পারতাম না?
—নিজেকে বুদ্ধদেব মনে করো? জিনির কথার শ্লেষ গনগনে আগুনের মতো ঝলসে উঠল। সবার জীবনের সমস্যা মেটাতে নিজের পরিবার-পরিজন ছেড়ে কি এবার পথে নামবে?
—না, সেরকম হলে আমি অনেক আগেই ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। এখন যাচ্ছি, নিজের প্রয়োজনে। ওদের আর আমাকে দরকার নেই। কিন্তু আমার ভুল স্বীকার করার আছে। নিজেকে মিথ্যে বলা যায় না, জিনি। অনেক বছর চেষ্টা করে দেখলাম, কাজ হল না।
—তার মানে আমাদের এই সংসার, বিয়ে, আমাদের মেয়ে সব মিথ্যে ছিল?
—আমি জানতাম বোঝাতে পারব না। আমার কমিউনিকেশানে গলদ আছে।
শব্দে যা পাওয়া গেল না, জিনি হীরকের কণ্ঠস্বরের ওঠাপড়ায় সেটা পাওয়ার চেষ্টা করছিল। অনেকদিন ধরে হীরককে অস্থির দেখেছে। চোখের দৃষ্টির অস্বচ্ছতা তার নজর এড়ায়নি। আজ হীরক অনেক ধীরস্থির। গন্তব্য জানা নাবিকের মতো। এই যাত্রায় হীরক তাকে সঙ্গে নিতে চায় না। হয়তো এই পথ দুর্গম। এই পথ একা চলার। এই পথে পোশাক ছেড়ে এগিয়ে না গেলে নিজের আত্মার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করা যাবে না। এই পথের শেষে তারা আরও দূরে সরে যেতে পারে। যে ভিতের উপর জিনি আর হীরকের সম্পর্ক দাঁড়িয়ে আছে, সেটাই নড়বড়ে হয়ে গেল। সেই কঠিন সময়ের জন্য নিজেকে তৈরি করতে করতে জিনি হীরকের গাড়ি সাবডিভিশন ক্রস করে চলে যেতে দেখল।
হীরক যখন সুটকেস নিয়ে বাড়িতে ঢুকল নীলিমা রান্নাঘরে। এতদিন বাড়ি বন্ধ ছিল। এখনও যেন সেই গুমোট ভাব যায়নি। দুই ছেলের বাড়ি ঘুরে সবে কদিন বাড়ি ফিরেছে নীলিমা। মনটা ভারী। এবার আসার আগে হীরুর সঙ্গে একবার দেখা হল না পর্যন্ত। সেই যে হঠাৎ কিছু না বলে কয়ে চিনুর বাড়ি থেকে চলে গেল, তারপরে ভাল করে কথাও বলেনি। ফোন করে নীলিমা খুঁচিয়েছে, কিন্তু হ্যাঁ হুঁ ছাড়া সাড়া পায়নি। বিমল বরং তাকে বকা দিয়েছে। ছেলেরা বড় হয়ে গেছে। ওদের জীবনে কতরকমের নিজস্ব সমস্যা। সেসব কি আমরা জানি?
নীলিমা শুনে খুশি হয়নি। কোলের থেকে এত বড়টা করলাম। এখন জানি না বলে হাল ছেড়ে দেব? ফেরার আগে একবার ছেলে-বউয়ের সঙ্গে দেখা করে আসবার ইচ্ছা ছিল নীলিমার। সামনাসামনি বসে কথা বলার। সে আর হল কই? বউকে ফোন করে জেনেছে হীরু কোথায় কোথায় নাকি ঘুরে বেরাচ্ছে। বাড়িতেও জানাচ্ছে না। এলেও দেখা হবে ওর সঙ্গে এমন স্থিরতা নেই। নিজের ছেলেমেয়ের জীবনে তার ভূমিকা এত ছোট হয়ে গেছে ভেবে চোখে আঁচল চাপা দিল নীলিমা। একলা নিজের ঘরে বসে কাঁদা ছাড়া তার বোধহয় আর কিছুই হাতে নেই।
গত চারমাসে বাড়ির একফালি বাগান আগাছায় ছেয়ে গেছে। লুঙ্গি পড়ে উবু হয়ে বসে বাগান ছানছিল বিমল। বাগান করার মধ্যে একটা নিবিড়তা থাকে। একটা একটা করে আগাছা উপড়ে নিজের ছোট্ট জমিটাকে যেন হেসে উঠতে দেখা যায়। সেই শান্তির মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছিল বিমল। শীতের জন্য কটা ধনেপাতা আর পালং লাগাবে ঠিক করেছে। জায়গা করতে পারলে ফুলকপি আর বেগুন। নীলিমা কিছু মরশুমি ফুল লাগাতে চায়। সেটাও রাখতে হবে। আমেরিকায় গিয়ে সবুজ ঘাসে ভরা লন দেখে, নীলিমারও খুব ইচ্ছে একফালি সবুজ থাকুক। ওরা দুজনে বেতের চেয়ার পেতে বসবে। কিন্তু অত জায়গা কোথায় তাদের। বারান্দায় চেয়ার পেতে বাগানের দিকে চেয়ে থাকবে না হয়।
এইরকম সময়ে হীরক ঢুকল। দিল্লি হয়ে এসেছে। রাত্রে ফ্লাইট ল্যান্ড করেছিল। সকাল সকাল ব্ল্যাক ডায়মন্ড ধরে দুর্গাপুর। শীত আসছে, রোদ এখন নরম। তাই বলে ঠান্ডা পড়েনি। বিমলের গায়ের ফতুয়াটায় ঘাম ববি প্রিন্টের মতো এখানে ওখানে জেগে উঠছে। বাগানের দরজার আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়েই চমক— হীরক।
—হীরু তুই?
—চমকে দিলাম কেমন তোমাদের? মুখে হাসি আনার চেষ্টা করল হীরক। আসলে সত্যি ভালো লাগছে। হঠাৎ মনে হচ্ছে যেন সেই যাদবপুরে হস্টেল থেকে ফেরার মতো। ছোট ব্যাগ, একা, চিন্তাহীন।
—দেখে যাও নীলিমা, কে এসেছে। লুঙ্গির কষি শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে উঠে দাঁড়াল বিমল। তার গলায় আনন্দ আর শঙ্কা একসঙ্গে বেজে উঠল।
—দাঁড়াও তোমার জন্য চা চাপিয়েছি, নামিয়ে আসছি।
—ধ্যাত্তেরি! রাখো তোমার চা। এদিকে এসে দেখো আগে। হীরু এসেছে।
শুনেই নীলিমা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দুদ্দাড় করে দৌড়ে এল। ও মা, কী কাণ্ড? বাড়িতে সবাই ভাল আছে তো রে? বলা নেই কওয়া নেই! এমন হঠাৎ করে এলি?
এখনও এই বাড়িতে এলে জীবনের যত টেনশন, দুশ্চিন্তা বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে দেওয়া যায়। কিছুক্ষণের জন্যে। সেই খুশিটাই হীরকের মুখে ছড়িয়ে পড়ে নীলিমাকে আশ্বস্ত করল। হঠাৎ চলে যাস, আবার হঠাৎ হাজির। ভালো আছিস তো রে হীরু? নীলিমার হাতের আঙুলগুলো হীরকের গালে অনভ্যস্ত স্পর্শে বুঝতে চাইল।
—দাঁড়াও মা দাঁড়াও। দুদিন দাড়ি কামাইনি, তোমার হাত ছড়ে যাবে।
—দাড়িটা শুধু দু-দিনের নয় মোটেই। এর মধ্যে অনেকগুলো চুল আবার সাদা। কী করেছিস বল তো? তোর বাবার দ্যাখ, এই বয়সেও কটা চুল ওর সাদা হয়েছে? তোর চল্লিশ না হতেই এমন দশা কেন?
—তোমার ধাত পেয়েছি মা। কলপ লাগাতে হবে।
নীলিমার মাথায় ছেলেকে খাওয়ানোর চিন্তা ঘুরছে। ইস বাড়িতে দুটো মিষ্টিও এনে রাখতে পারিনি এবার। একবার ফোন করে বলবি তো। শুনছ, একটু বাজারটা ঘুরে এসো। এখুনি গেলেও কটা মাছ পেতে পারো। পাঁঠার মাংস। এর পরে গেলে নাড়িভুঁড়ি ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকবে না।
—খাওয়া নিয়ে এত হট্টগোল করো না মা। আমি তো আছি কদিন। যা খাওয়াতে চাও সব করার সময় পাবে। তোমার সর্ষেমাছও খাব।
—কদিন আছিস তুই হীরু?
—দেখি, এখনও ফেরার দিন ঠিক করিনি। হাওয়ায় মিশে যায় হীরকের উত্তর।
প্রতিবার হীরকরা আসে। দম দেওয়া পুতুলের মতো এখানে ওখানে দৌড়ায়। আসার দিন থেকেই ওদের বিদায়ের সময়টা নীলিমার মাথায় খাঁড়ার মতো ঝুলতে থাকে। বারবার জিজ্ঞেস করে, কটা দিন আরও থেকে যা না রে তোরা। দু-তিন বছর বাদে বাদে একবার আসিস, আর একটু সময় নিয়ে আসা যায় না? এবার ফেরার দিন ঠিক নেই শুনে কিন্তু সেরকম আনন্দ হল না। বরং চিন্তাটা বেড়ে গেল আরও। ছেলে-বউয়ের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে। তার আঁচ পেয়েছে একটু-আধটু। কিন্তু কারণ হদিশ করতে পারেনি নীলিমা। জোর করে সেই চিন্তাটা মন থেকে সরিয়ে দিল। আগে একটু স্নান খাওয়াদাওয়া করে জুড়াক। এসব কথা ফট করে বলার নয়, সবুরে বলা যাবে।
বিমল বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। হীরক বারবার না করলেও কে শুনছে? চা অবধি খেল না। নীলিমা সেই চা হীরকের হাতে ধরিয়ে দিল। চা খেয়ে আগে স্নান কর দেখি। প্লেনে নিশ্চয় ঘুম হয়নি। স্নান করে একটু জিরিয়ে নে।
কিন্তু এখন ঘুমানোর কোনও ইচ্ছা নেই হীরকের। চাকরি তো ছেড়ে আসেনি। মাকে যাই বলুক, কদিনের মাত্র ছুটি তার হাতে। রেখার ঠিকানা তার কাছে আছে। কলকাতায় গিয়ে দেখা করতে হবে। একবার ভেবেছিল এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ওর ওখানে গেলেই হয়। কিন্তু সেটা বড় নাটকীয় হয়ে যেত। হোটেলে উঠে ফ্রেশ হয়েও যাওয়া যেত। ভেবেওছিল একবার। কিন্তু পরে মনে হল সোজা আমেরিকা থেকে এসে ওর সঙ্গে দেখা করতে না গিয়ে নিজের বাড়িতে কদিন কাটিয়ে গেলেই ভালো। নিজেকে বর্তমান থেকে অতীতে ফেরাতে সুবিধা হবে। সেই অতীতে শানুও আছে। ওর খবরটাও নেওয়া দরকার। সেটা কীভাবে হবে এখনও ভাবেনি হীরক। স্নান করে এসে যখন বারান্দায় মোড়া টেনে বসল। নীলিমা আর এক কাপ চা নিয়ে এসে হাজির। তোরা তো ওখানে কফি খাস। আমাদের এখানে ওটার চল কম। এমন মাথা, আমি তোর বাবাকে যে একটা নেসকাফে আনতে বলব সেটাও ভুলে গেলাম।
—থাক না মা। ওখানে তো এমন চা খাওয়া হয় না, তোমার হাতে চা-টাই বেশি ভাল লাগবে।
—দুটো থিন অ্যারারুট দিই? চায়ে ভিজিয়ে খা? আমি লুচি করব এখুনি। সকাল থেকে কিছুই হয়তো খাসনি।
—না, না লুচি-টুচি কোরো না আজ। আমি হাওড়া স্টেশান থেকে একটা স্যান্ডুইচ তুলে নিয়েছিলাম, সেটাই খেয়েছি।
—এসেই কেন বাইরের খাবার খেলি বল তো। তোদের অভ্যাস বদলে গেছে, এদেশের রাস্তাঘাটের খাবার কি পেটে সয়?
—আমার তো কিছু হয় না মা। তুমি দুটো বিস্কুটই দাও। চায়ের মধ্যে খসে পড়া বিস্কুট গুলে টেস্ট বাড়ে।
নীলিমার হাত থেকে বিস্কুট নিয়ে হীরক জিজ্ঞেস করল, শানুর কথা কিছু জানো মা?
—শুনেছি তো মায়ে-ছেলেতে মিটমাট হয়ে গেছে। আইন-আদালত হয়নি আর। ছেলে আর মা একসঙ্গেই থাকে বোধহয় এখন।
—শানু তাহলে নিজেদের বাড়িতেই আছে?
—বোধহয় না। কে যেন বলছিল, দরজায় তালা ঝুলছে বহুদিন। কেউ থাকে না ও বাড়িতে।
—তাহলে কোথায় থাকে?
—সেসব তো জানি না। আগেকার চেনা লোকগুলো সব দূরে সরে যাচ্ছে রে। রিটায়ার করে কতজনা তো দুর্গাপুর ছেড়ে চলেই গেল। তোর অমরকাকুকে মনে আছে? কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে। যারা আছে তারাও আমাদের মতো ছেলেমেয়েদের কাছে ঘুরে বেড়ায়। আজকালকার ছেলেরা কেউ তো আর এই রাজ্যে চাকরি করে না।
—করতে চায় না এমন নয়, পায় না।
হীরক ভাবছিল কীভাবে শানুর খোঁজ নেবে। নীলিমার হঠাৎ মনে পড়ল, তোতনের কাছে কিছু যেন শুনেছিল শানুর কথা। রান্নাঘরে যেতে যেতে আবার ফিরে এল। ও হীরু, তুই তোতনের সঙ্গে কথা বল। ও বোধহয় শানুর খবর জানতে পারে।
—তোতনরা ওই বাড়িতেই আছে তো?
—সে আর কোথায় যাবে? ওর বাবা তো বিছানায় পড়ে গেছে। শুনেছি বাড়ি নিয়ে ভাইদের মধ্যে তুমুল চলছে। কিন্তু সব ভাই এখনও মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে, কেউ বাড়ি ছাড়েনি।
এসব কূটকচালিতে জড়াতে মন চাইছিল না হীরকের। মোড়া ছেড়ে উঠে বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করল। এই বাড়িতে কিছুই বদলায় না। পুরনো জিনিস ফেলে দেওয়ার অভ্যাস নীলিমার নেই। হীরক নতুন সোফা কিনে দিলেও পুরনো স্প্রিংভাঙা বেড কাম সোফা এই বাড়ি থেকে তার ঠাঁই হারায়নি, শুধু ঠাঁইবদল হয়েছে।
—কেউ এলে পেতে দিই রাতে শোওয়ার জন্য, তখন কি অন্য কারও বাড়িতে গদি ধার করতে যাব? নীলিমার চেনা সাফাই। কে যে এত আসে হীরক জানে না। অনন্তদারা আসে মাসে একবার। কিন্তু ওরা তিনটে তো মাত্র প্রাণী। হীরকেরা দেশে এলে তখন একটু গাদাগাদি হয়, না হলে বাড়ি তো ফাঁকা।
—মা আমার ছোটবেলার আঁকা ছবিগুলো আছে?
—ভালোগুলো সব তো তোর হাতে তুলে দিয়ে এলাম। এখনও খুঁজলে দু-চারটে পাওয়া যাবে।
নীলিমা কিছুই ফেলে না। ওদের ছোটবেলার খেলার জিনিস, বানের জলে ডুবে ফুলে যাওয়া ক্যারাম বোর্ড, ছোটবেলার জামাকাপড়— কিছুই ফেলা যায়নি।
—তোমার মনে আছে মা আমার একটা লাল জামা ছিল?
হঠাৎ লাল জামার কথায় নীলিমা অবাক। কোনটা বল তো? তুই আবার লাল জামা কবে পরিস। বলিস যে পার্টির ঝান্ডা লাগে নাকি।
লাল রঙের জামাটা স্পষ্ট মনে আছে হীরকের। কালো রঙের চেককাটা। মোটা কালো চেক, তারপর একটু সরু, তারপর আর একটু সরু। ঠিক আয়নার মধ্যে আয়না দেখলে যেভাবে দেখায় সেইরকম চেকগুলো। লাল রংটা রক্তের মতো লাল নয়, বরং মেটে সিঁদুরের মতো। এই জামাটা বিশেষ করে মনে আছে কারণ এটাই হীরকের প্রথম দোকান থেকে কেনা পোশাক। তার আগে মিটারে কাপড় কিনে পাড়ার টেলারিং শপেই শুধু বানানো হত। তার পরেও। সেটা বড় বড় থান থেকে বাড়ির সব ছেলেদের একরকমের জামাপ্যান্ট বানানোর যুগ। রেডিমেড বলে কিছু ছিল না। চাপা প্যান্টের প্রশ্নই নেই। সেই সব প্যান্ট হত ঢলঢলে, ছিরি-ছাঁদহীন। হীরকরা বলত হাফপ্যান্ট বেলবটস। নামটা ঝন্টুর দেওয়া। হারাধনদা কেন যে শুধু কোমরের মাপ নিয়ে ছেড়ে দিত না! ঝন্টুর প্যান্টটা তার মধ্যে আরও সরেস। ওর পায়ের মতো চারটে পা ঢুকে যাবে অনায়াসে। ছেলেটা উদাস মুখে বলত, অনেক সুবিধাও আছে রে। কল ছাড়তে বোতাম খুলতে হয় না। হাওয়া-বাতাসও ভালো খেলে।
এই লালা জামাটার স্থান হীরকের জীবনে তাই বিশেষ। সেবার পূজায় দিল্লির মামা দিয়েছিল। বহুদিন বাদে পূজায় কলকাতা এসেছিল, সবার জন্য জামাকাপড় নিয়ে। সেবারের পুজোয় ভালোবাসার লালচে রং লেগেছিল। নীলিমা একটু বেশি বেশি খুশি ছিল। মার এত চঞ্চল উচ্ছল চেহারা বহুদিন দেখেনি হীরক। বৌদি আর ননদ মিলে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল, একসঙ্গে উত্তমের সিনেমা দেখতে যাওয়া— শুধু দুজন। মা আর মাইমা দুজনেরই চোখে কালো সানগ্লাস। কীরকম অচেনা লাগছিল সেই কদিন মাকে। ওই সানগ্লাস পরা ছবি অনেকবার দেখেছে, তাই স্পষ্ট মনে আছে। লাল জামাটাও। মামার ইয়াশিকা ক্যামেরায় কয়েক রিল ছবি তোলা হয়েছিল সেবার। তাদের বাড়ির অ্যালবামের অনেক পাতা ওই কদিনের ছবিতেই ভরা। তখন তো আর রোজ রোজ অত ফটো তোলার রেওয়াজ ছিল না। মামা রোল থেকে দুটো করে প্রিন্ট করে এক কপি বোনকে দিয়ে গিয়েছিল।
তখনকার ছবিগুলো সাদাকালো হত। তবু জামাটা যে লাল ছিল, মেটে সিঁদুর-লাল, সেটা স্পষ্ট মনে আছে হীরকের। শুধু রং নয়, তার স্পর্শও। তখন টেরিলিনের জামার চল হয়েছিল। অনলি বিমল অ্যাডে টিভি ছেয়ে থাকত। জামাটা টেরিলিনের ছিল, কিরকম সড়সড় করে গা থেকে সরে সরে যেত। গরমে ঘামে চটচট করত, কিন্তু পুজোর সময় অত গরম কোথায়। হাওয়ায় ঠান্ডা শিরশিরে ভাব, খুব পরেছিল জামাটা। কোথাও যাওয়ার থাকলেই ওই জামাটা। রূপাটা এত পিছনে লাগত ওর, পিছনে গান গাইত— লাল জামা গায়, খোকাবাবু যায়। নীলিমা বকা দিত। রূপা! কেন শুধু শুধু ছেলেটার পিছনে লেগেছিস? এই জামাটায় ওকে কত সুন্দর লাগে। অন্য সব জামাই তো হারাধনের দোকানের। কোনও ছিরিছাঁদ নেই।
কিন্তু তখন বাড়ন্ত বয়েস, এক বছরের মধ্যেই এঁটে বসেছিল গায়ে। তারপর কোথায় যে হারিয়ে গেল!
গত বছর টার্গেটে জিনির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে ঠিক ওইরকম প্রিন্টের একটা জামা দেখেছিল। অন্য মেটেরিয়াল, কিন্তু প্রিন্টটা একদম এক। টিশার্ট কিনতে গেছিল, কিন্তু হীরক জেদ করল ওইটাই কিনবে। জিনির মোটেই পছন্দ হয়নি। এটা কেমন প্রিন্ট বলো তো? একদম মানাচ্ছে না তোমায়। তার চাইতেও বড় কথা এইরকম প্রিন্ট তোমার হাইটকে কম দেখাবে। Doesn’t really suit you.
জামাকাপড়ের ব্যাপারে জিনি খুব খুঁতখুঁতে। রঙের চোখ খুব ভালো। ও যা পছন্দ করে, হীরক তাই তো বরাবর কেনে। কিন্তু সেদিন গোঁ ধরল ওটাই কিনবে।
—কোথায় পরবে? অফিসে? না কি পার্টিতে?
—যেখানেই পরি, আমার পছন্দ… ব্যস।
কেন পছন্দ সেটা অবশ্য জিনিকে বলা যায় না। আসলে এইসব কথা কাউকেই ঠিক বুঝিয়ে বলা যায় না। মুখ থেকে বেরোলেই কিরকম খেলো খেলো লাগে। হীরক একদম ওই পথে যায়নি।
—মনে নেই মা দিল্লির মামা দিয়েছিল? লালের উপর কালো চেক চেক। আমি তখন সেভেন কি এইটে পড়ি।
—ও কাকলি দিয়েছিল যেটা। বলবি তো। ঠিক কোথাও তুলে রাখা আছে। পরে দেখব-খন। বলতে বলতেই নীলিমার চোখে কুয়াশা ভিড় করে। জানিস তো কাকলির শরীর ভাল নেই, ক্যান্সার ধরা পড়েছে। একবার দেখতে গেলে হয়। তোদের খুব ভালোবাসত।
—যাব না হয় মা।
হীরক অন্যমনস্ক হল অন্য স্মৃতিতে। মনে পড়ল ওই জামা পড়ে রেখাদের বাড়িতে গেছিল। রেখা চোখ বড় বড় করে বলেছিল, খুব চমকাচ্ছিস হীরু। আমার সঙ্গে বেরোবার সময় এটাই পড়বি কিন্তু। অষ্টমীর দিন সকালবেলা ওটা পরেই রেখার সঙ্গে অঞ্জলি দিতে গেছিল। এই সব অদরকারি ছোটখাটো কথা কীভাবে মনের দেওয়ালে আটকে থাকে কে জানে। এমনিতে মনেই পড়ে না। কিন্তু হঠাৎ একটা সকাল কিংবা বিকেলের পড়ন্ত আলোর মতো জেগে ওঠে।
নীলিমা মুখে পরে দেখব বললেও তখনই খাটের তলা থেকে ট্রাঙ্ক টেনে বের করেছে। ন্যাতা দিয়ে ট্রাঙ্কের উপর জমা পুরু ধুলো মুছে ঢাকা খুলল। পরতে পরতে হীরু আর চিনুর ছোটবেলার জামাকাপড় সাজিয়ে রাখা। ওরা বারবার বলেছে, এগুলো জমিয়ে কী করবে মা? তোমার নাতি-নাতনিরা তো আর এসব পরবে না। বরং গরিব-দুঃখীদের বিলিয়ে দিলে কাজ হয়। নীলিমা প্রাণে ধরে পারবে না। বরং মাঝেমধ্যে ট্রাঙ্ক খুলে ন্যাপথালিন ছড়ানোর বাহানায় একেকটা জামা নাকের কাছে এনে শুঁকে শুঁকে ছেলেদের গায়ের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করে। বিমল বলে ন্যাপথালিনের গন্ধ শুঁকতে এত ভালো লাগে তোমার?
মায়ের মন কে বুঝতে পারে? গুছিয়ে রাখা থাকে ভাগ্যিস। তাই না এত সহজে পেয়ে গেল। হামাগুড়ি দিয়ে জামা হাতে উঠে দাঁড়াল নীলিমা। মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। এই দ্যাখ, তোর সেই জামা। মা যখন গুছিয়ে তুলে রাখে, তখন তোদের কত কথা। আমি নাকি সব যক্ষের ধনের মতো আগলাচ্ছি। না আগলালে টূপ বলতেই এমন হাজির করতে পারতাম?
জামাটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল হীরক। জামাটার সঙ্গে বেঁচে থাকা স্মৃতি এত জীবন্ত ছিল। এই জামা পরে সাইকেল চালিয়ে বুকে হাওয়া নিতে নিতে বেনাচিতির রাস্তায় প্যাডেল করে চলে যাওয়া, নিজেকে যেন হিরো মনে হত। জামাটা হাতে পেতেই কেমন সেই স্মৃতির বুনোট আলগা হয়ে খসে পড়ল হেমন্তের ঝরা পাতার মতো। এর উপর দিয়ে তার জলজ্যান্ত বর্তমান এরপর হেঁটে চলে যাবে আর মুড় মুড় করে গুঁড়িয়ে যাবে সব। জামাটা হাতে না পেলেই বোধহয় ভালো হত।
—মেটে সিঁদুর তো নয়, বরং তামাটে লাল এটা। তুই রং চিনিস নাকি? এমনভাবে লাল বললি যেন সিঁদুররঙা, আমি ভাবলাম কোনটা আবার।
জামাটা মুঠো করে হীরক ভাবছিল। এই জামাটা যখন পড়েছিল তার বুকের খাঁচাটা কত ছোট ছিল, কাঁধও অত চওড়া নয়। কেমন ম্যাড়মেড়ে লাগছে এখনকার চোখে। প্রিয় জিনিস হারিয়ে গেলেই সঙ্গে থাকে, বুকের ওমের মধ্যে। কোনও কোনও জিনিস চোখের আড়ালে থাকে বলেই হারায় না।
[আবার আগামী সংখ্যায়]