
বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
চড়ুইবেলা
চার.
—এই হীরু! হীরু!
বাইরে সন্ধ্যা নেমেছে বেশ খানিক আগে। তবে দিনের মরা আলো এখনও পুরোপুরি জায়গা ছাড়েনি রাস্তার ল্যাম্পপোস্টকে। সেই চোখসোহাগী অন্ধকারে জানলার গরাদের বাইরে সাইকেলে বসা শানুকে খুঁজে পেল হীরক।
মাধ্যমিকের আগে এখন তিনমাস স্কুল নেই। টিউশনে যাওয়া শুধু। আর পড়া। এই শীতে আর ক্রিকেট খেলা হচ্ছে না, অত সময় কোথায়! বিকেলে মাঝে মাঝে ব্যাডমিন্টন পেটায় হীরক। পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে। নাহলে শুধুই বই মুখে বসে থাকা। দম বন্ধ লাগে। পাড়ার বন্ধুত্বগুলো ছাড়া ছাড়া হয়ে গেছে, আগের আঠা আর নেই। স্কুলের বন্ধুরা তার মতোই সবাই গাঁতাচ্ছে। টিউশনে দেখা হয় কারও কারও সঙ্গে— যেমন মণীশ, পল্লব ওরা। কিন্তু বিষয় সেই একই— এবিটিএর টেস্ট পেপার, সাজেশান পেপার। একই কচকচি। শুধু চাপ বাড়ানো। রেখার সঙ্গেও আজকাল দেখা নেই আর। আসলে হীরক নিজেই লাটাই গুটিয়ে নিয়েছে। শানুর সঙ্গে রেখার মাখামাখির খবর কে না জানে। ভাবলেই এক তীব্র অভিমানে আক্রান্ত হয় হীরক।
শানুর সঙ্গেই তো দেখা হয়নি অনেকদিন। যে যার নিজের কক্ষপথে। হায়ার সেকেন্ডারির চাপ আছে ওর। নিজের ফাঁকা সময়ে রেখাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে হয়তো। শজারুর কাঁটার মতো টুকরো চিন্তাগুলো বিঁধছিল হীরককে। তাই মুখের হাসিটা বুঝি কিছু বাঁকাই হয়ে থাকবে। কথাটাও। আরেব্বাস সাতশো ষাট শানু আমার দোরগোড়ায়।
সাফল্য মানুষকে শক্ত মাটি দেয়। দুর্গাপুরে এসে অবধি নানা কারণে টিটকিরির মুখোমুখি হয়েছে শানু। স্কুলের ডাবল প্রমোশানটা একটা স্টিগমা হয়ে রয়ে গিয়েছিল বহুদিন। একসময় ওর আমেরিকান অ্যাক্সেন্ট নিয়েও কম পেছনে লাগেনি ছেলেরা। ওর স্বপ্নমাখা বিচরণ কোনও গভীর বন্ধুত্বের ভিত গড়তে দেয়নি। বাড়িতে বাবার টিক টিক, একটু এদিক-ওদিক হলেই আড়ং ধোলাই। কিন্তু স্কুল ফাইনালের পরে সব কিছু বদলে গেছিল শানুর জন্যে। স্কুলে এখন হিরো। বাড়িতে শিকল আগের চেয়ে খানিক আলগা। শানুর কথাতে তাই বয়সানুচিত বেপরোয়া হাওয়া। যদিও ওর মুখের ভাষার এতটা রকমফেরের জন্য তৈরি ছিল না হীরক।
—ধুর হীরু, তুইও সেই সাতশো ষাট কপচাচ্ছিস। জানিস তো কুলি আর স্লেভ— শুধু এদেরই এমন নাম্বারওলা তকমা থাকে।
—কুলি নাম্বার সাতশো তিন?
—দেখলি সিনেমাটা? বচ্চন এক্কেবারে এক নম্বর। উৎসাহে টগবগ করছিল শানু।
—তোর বেশ পাখনা গজিয়েছে রে শানু, হরদম সিনেমা দেখছিস মনে হয়। কাকু জানে?
—অত চেপে খেললে হয় না রে হীরু। শুধু বই মুখে করে বসে থাকলে, যে কেউ এসে পিছন মেরে দিয়ে চলে যাবে।
শানু বেশ বদলে গেছে। শুধু মুখের ভাষা না, কথাও সোজাসাপটা। কেন রে তোকে কেউ কিছু করল নাকি আবার।
—জোর যার মুলুক তার রে হীরু, নাহলে কোথাও কল্কে পাওয়া যায় না। আর কত পড়বি। আয় না আমার সঙ্গে, অনেকদিন কথা হয় না।
সারাদিন বই নিয়ে বসে থেকে হীরকেরও শিরদাঁড়া টাটাচ্ছিল। কিছুক্ষণ গ্যাঁজালে এমন কিছু ক্ষতি হয়ে যাবে না। কোথায় যেতে চাস?
—আমার বাড়ি খালি। মাকে নিয়ে বাবা কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে গেছে। ফিরতে দেরি হবে। চল, তোকে আমার কালেকশান দেখাব।
—স্ট্যাম্প?
চোখ টিপল শানু। না রে বাবা, আর কত বছর স্ট্যাম্প রগড়াবি?
শানুকে যত দেখছিল অবাক হচ্ছিল হীরক। বেশ বদলে গেছে কিন্তু ছেলেটা। গত এক-দুই বছরে ওর সঙ্গে যোগাযোগ কমই ছিল। কিন্ত এতটা পরিবর্তন আশা করেনি। শানুর বাড়িতে ঢুকে বসতে বসতে হীরক বলছিল সেটা।
—তোর কি মনে হয় রে হীরক? শুধু পড়াশোনা করলেই আমরা সবাই কেউকেটা হয়ে যাব? চাঁদ পেয়ে যাব হাতের ডগায়?
—সেটা তো কিছুটা সত্যি। অন্তত তোর বাপের অনেক টাকা আছে। তুই হড়কালে সামলে নেবে। কিন্তু আমাকে দ্যাখ। সব কিছুতে একটাই চান্স। যদি ভালো রেজাল্ট করতে পারি, নিজের জন্য বা ফ্যামিলির জন্য কিছু করতে পারব। কেউকেটা কি না জানি না, কিন্তু নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা জরুরি। হীরক জানে না শানু কেন এই প্রশ্নটা করেছিল, ওর নিজের জীবনেও কি এটা সত্যি নয়? কেন তুই নিজেকে দিয়ে দ্যাখ না। স্কুল ফাইনালে ভালো রেজাল্ট করেছিস, সবার কাছে তোল্লাই পাচ্ছিস। যারা তোকে পছন্দ করত না, তারাও এখন সমীহ করে। তোর পিছনে এ তল্লাটের মেয়েদের তো লম্বা লাইন লেগে যাওয়ার কথা। চাইলে একটা কেন, দশটা চাঁদ পেয়ে যাবি হাতে।
নিমেষে চুপসে গেল শানু। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া যায় হয়তো। কিন্তু রাখা যায় না। তার জন্য হিম্মত লাগে।
—তার মানে?
—দাঁড়া ছাদে আয়, একটা বিড়ি ধরাই। মুখে বিড়ি বলল বটে, কিন্তু শানু পকেট থেকে বের করল নাম্বার টেনের প্যাকেট।
—তুই সিগারেট খাস? ক্লাসের দুই একটা ছেলে খায় জানে, হীরক ধরেনি এখনও। সেরকম সুযোগ হয়নি। তবু শানুকে সিগারেট খেতে দেখবে ভাবেনি।
—কেন তুই ফুঁকিসনি কোনওদিন? আমি রোজই খাই, কিন্তু ঘরে খেলে পরমেশবাবু ঠিক গন্ধ পেয়ে যাবেন। তাহলেই ধরে ক্যালাবে। তাই বাড়িতে খেলে ছাদেই বসি।
শানুর নিজের বাবাকে নাম নিয়ে বলাটা চমকে দিয়েছিল হীরককে। অবশ্য বোঝা গেল ওর বাবার দাপট কমতে পারে, ধরনটা পাল্টায়নি। কিন্তু সে-কথায় না গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর মুখের গন্ধ?
—পেয়ারাপাতা চিবিয়ে নিলেই হল। খা, তোকেও দুটো পাতা চিবোতে দেব। বাড়িতে হদিশ করতে পারবে না।
হীরকের বাড়িতে অমন কেউ গন্ধ শুঁকে দেখবে না কক্ষনও, বুঝলে শুধু রূপা। কিন্তু ওর চুগলি কাটার অভ্যাস নেই। সিগারেট খাবে ভেবে কেমন উত্তেজনা হচ্ছিল হীরকের। হাত বাড়িয়ে নিয়েও নিল। শানু ফস করে বাঁ হাতে আড়াল করে ডান হাতে দেশলাই জ্বালিয়ে মুখে আগুন দিল তার। শানুর হাবভাবে বেশ বড় বড় লাগছিল আজ। হীরু এই শানুকে দেখেনি আগে। পদক্ষেপ অনেক বেশি নিশ্চিত, চোখের চাউনি সোজাসুজি। সিগারেটে একটা জোর টান দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়ল উপরে। পুরোপুরি রাত নেমেছে। আকাশে এখন অনেক তারা, চাঁদও দেখা দিয়েছে পশ্চিম কোণে।
—ছোটবেলায় তোকে খুঁজতে গিয়ে রেখার বাড়ি উঁকি দিয়েছিলাম সেটা মনে আছে তোর? আর সেই জন্যে তোদের পাড়ার বীরুটা কেমন হেনস্থা করেছিল?
—সেদিন থেকেই তোর রেখার জন্য ব্যথা ছিল, না রে শানু? মুখে ফট করে বলল বটে, কিন্তু হীরকের বুকটা চিনচিন করছিল প্রতিটা শব্দপতনে। বাইরে তার ছাপ যাতে না পড়ে তার জন্য পরপর দুটো টান দিল সিগারেটে। অভ্যাস নেই। তিতকুটে স্বাদ গলায় ঢুকে পাক মারতেই কাশির গমক।
—আমার ব্যথা আমি কোনওদিন লুকাতে চাইনি হীরু। দু-একবার তোকেও বলেছি। রেখার বাবার কাছে ইংরেজি পড়তে যাওয়াটা তো ওই জন্যেই। কিন্তু তোদের ওই পোঁদপাকা বীরুটাও যে খেপ খেলছে সেটা জানতাম না।
—শোন, আমার পাড়ার মেয়ে। আমি জানি রেখা বীরুকে কোনওদিন পাত্তাও দেয়নি। বীরু সবসময়েই ছোঁকছোঁক করত। রেখা যে ওর সেটা পইপই করে বলে আমাদের সবাইকে শাসাত। কিন্তু রেখা ওকে পোঁছেনি কোনওদিন।
—আমি সেটা ভাল করেই জানি হীরু। রেখা আমাকেই ভালোবাসে। কিন্তু তাতে কী এল গেল? এই শুয়োরের বাচ্চা বীরু আমাকে কী করেছে জানিস?
—কই, কী হয়েছে? কিছু শুনিনি তো।
—একদিন রেখার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম। ওকে সাইকেল থেকে নামিয়ে দিয়ে আলাদা আলাদা ফিরছি। রাস্তায় ধরল ওই ব্যাটা বীরু। সঙ্গে আরও কটা চ্যালাচামুন্ডা।
—তারপর?
—এসেই সোজা জামার কলারে হাত। কিরে গাঁড়ে খুব দম হয়েছে না? ওর এক সঙ্গীর হাতে খোলা ছুরি। সত্যি বলছি হীরক, ভয়ে আমার মুখ শুকিয়ে গেছিল। কী করব বুঝতে পারছি না। তুই বল, তখন আমার মাধ্যমিকে সাতশো ষাট কোন কাজে লাগবে? এসবের মোকাবিলা করার জন্যেও তালিম লাগে। আমি তবু কোনওমতে বললাম, কী হয়েছে বীরুদা? আমি কী করলাম? ওরা তিনটেতে মিলে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসি শুরু করল। দ্যাখ দ্যাখ চোদনাটাকে, এদিকে বিচির দোষ অথচ ভাবটা যেন কিচ্ছু জানে না। বলেই বাঁ হাতে খপ করে প্যান্টের উপর দিয়ে নুঙ্কুটা খাবলে ধরল বীরু। আর ডান হাতে পেটে একটা ঘুষি। আমি ব্যথায় পেট চেপে রাস্তায় বসে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে ওর এক ইয়ার এসে পাছায় এক লাথি। আমি ধুলোয় গড়িয়ে পড়লাম। শীতের সন্ধে, রাস্তা শুনশান। মার খেয়েও আমার তখন চিন্তা কেউ দেখে না ফেলে। আমাকে মাটিতে ফেলেই বীরু ওর ডান পাটা আমার বুকের উপর চেপে ধরল। যা বলছি কান খাড়া করে শোন। তোকে যেন আর কোনওদিন রেখার ধারেকাছে না দেখি। তাহলে দুটোকেই গুঁজে দেব। ভাবিস না, এটা আমার ফাঁকা আওয়াজ। ফালতু হুমকি বীরু চ্যাটার্জি দেয় না। তুলে নিয়ে কোথায় গাপ করে দেব সারাজীবন কেউ তোর টিকি খুঁজে পাবে না বুঝেছিস? তোর ওই রেখারও আর হদিস পাবে না কেউ। বলেই আবার এক লাথি। তারপর আমার জামার কলার ধরে মাথাটা উপরে তুলল আর চোখের উপর চোখ রেখে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, রেখা আমার। শুধু আমার। ছোটবেলা থেকে ওর চারপাশে গণ্ডি কেটে রেখেছি আমি। কোনও শালার হিম্মত হবে না সেটা পেরিয়ে রেখাকে ছোঁয়। যে ছোঁবে তার নলি কেটে দেব। কলারটা ছেড়ে দিতেই ধুম করে রাস্তায় পড়ে মাথা ঠুকে গেল। ওরা তিনজন চলে যাচ্ছিল। যেতে যেতে বীরু আবার ফিরে এল। এরপর আর কোনওদিন রেখার সঙ্গে দেখা করবি না। ওর বাপের কাছে পড়তে যেতে যেন না দেখি আর। রেখাকে কিচ্ছু বলবি না। কিছু বললে ঠিক জানতে পারব আমি। একেবারে লাশ ফেলে দেব।
মরা সিগারেটটা তখনো ওর হাতের কোনায়। আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না হীরু। আমাকে এরকমভাবে ধুলোয় চটকে দিয়ে গেল, আমি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। এমনকি ওরা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠেও দাঁড়াইনি, এত ভয় পেয়েছিলাম। সেদিনই বুঝে গেলাম। পড়াশোনা পড়াশোনার জায়গায়, কিন্তু এর শোধ না নিতে পারলে শান্তি নেই।
—রেখাকে বলেছিলি?
—না, আর দেখাই করিনি। সাহস পাইনি রে। শুধু আমাকে তো নয়, ওরও তো ক্ষতি করবে।
—সোজা কথা বীরুর ভয়ে পালিয়ে গেলি।
একটু আগের তেজিয়াল শানু কেমন ভেজানো ন্যাতার মতো পড়ে আছে।
—ওই মালটাকে আমি ছেড়ে দেব ভেবেছিস? গর্জে উঠল শানু। অন্ধকার না থাকলে ওর চোখের আগুনেরও কিছুটা আঁচ পেত হীরক। এর বদলা আমি নেবই।
—কী করবি? ব্যায়াম করে গুলি পাকাচ্ছিস বুঝি? না চাইতেও হীরকের কথায় বিদ্রূপের ধার। একদিক থেকে খুশির কারণ তার জন্য।
—ওইভাবে হয় নাকি? আমি চাইলেই সুপারম্যান হয়ে যেতে পারি? কিন্তু বীরুকে আমি ছাড়ব না।
—তুই?
কথাগুলো শানুর সঙ্গে একদম মেলে না যেন। তাছাড়া ও আর চেনেই বা কাকে, দল বানাবে কীসের? এইসব করতে গিয়ে নিজের বারোটা বাজাবে এইবার। মুখে বললও সেটা। হায়ার সেকেন্ডারি তোর সামনে। আইআইটি, জয়েন্ট এন্ট্রান্স কতকিছুর জন্য লড়তে হবে। তুই এখন এসব নিয়ে কেন পড়েছিস?
—তোকে রাস্তায় ফেলে কেউ ধুলোচাটা করিয়েছে কখনও?
হীরক শানুর চোখের রাগ আর যন্ত্রণা ধকধক করে জ্বলতে দেখল।
—দূরে সরিয়ে নিয়েছে তোর ভালোবাসার মানুষকে?
গেছে তো, সেটা জানে শুধু হীরকের মনের গভীর গোপন।
—আমি পড়তে বসলেও কন্সেন্ট্রেট করতে পারি না। বইয়ের অক্ষরগুলো আমার চোখের সামনে নাচে। চোখে ভাসে শুধু রেখার মুখ।
—কবে হয়েছে এটা?
—প্রায় মাস ছয়েক।
—রেখাকে বললি না কেন?
—বললাম যে, ওর সঙ্গে দেখাও করিনি আর। কিচ্ছু বলিনি। ও দুই-একবার কথা বলতে এসেছিল, কিন্তু দূর দূর করে ভাগিয়ে দিয়েছি আমি। বীরুর চেলারা চারদিকে ঘুরে বেরাচ্ছে, যদি দেখে ফেলে। বুঝতে পারছিস হীরু ভয় কীভাবে একটা মানুষকে দাবিয়ে দিতে পারে?
শানু কী করতে চায় সেটা হীরকের বোধগম্য হচ্ছে না মোটেই। দল পাকাবি, ওকে ঠ্যাঙাবি। এ তো গ্যাংওয়্যারের মতো বলছিস একেবারে। এরকম কিছু হলে তুইও তো শেষ হয়ে যাবি। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সব চুলোয় যাবে।
—দ্যাখ, আমার গায়ে জোর কম হতে পারে কিন্তু মাথায় না। ধর তক্তা মার পেরেক করে কিছু হবে না। আমি সব ভেবে রেখেছি। হায়ার সেকেন্ডারির পরে আমি তো আর দু্র্গাপুরে থাকব না। আমি আমেরিকার সিটিজেন। দরকার হলে বিদেশে পড়তে চলে যাব। যাওয়ার আগে ওকে এমন শায়েস্তা করব!
—আর রেখা?
—যাওয়ার আগে ওকেও বলে যাব। তখন ঠিক বুঝতে পারবে কেন আমি দূরে সরে গেছিলাম।
হীরকের কেন জানি মনে হচ্ছিল এসব শানুর নিষ্ফল কল্পনা। বীরু উঠতি নেতা। কলেজে যায় নামেই, মাঝেমাঝেই ওর গুন্ডামির খবর পায়। তার চাইতেও বড় কথা ওর অনেকরকমের শাগরেদ জুটেছে। শানুর ওর টিকি ছোঁয়ার ক্ষমতা হবে না।
শানু হীরকের মনের কথাটা আঁচ করতে পেরে বলল, তুই কোনওদিন দেশবন্ধু কলোনিতে গেছিস?
—ওখানে তো যত চোরচাক্কা বদমাশের আড্ডা। আমাদের বাড়ির কাজের মাসি ওখানেই থাকে।
—ওখানেই কয়েকজনের সঙ্গে দোস্তি পাকিয়েছি আমি।
—দেশবন্ধু কলোনিতে? তুই? বিশ্বাস করতে পারছিল না হীরক। শানুর কথায় কথায় গালাগালি ব্যবহারের উৎসটা এবার বোঝা যাচ্ছে যদিও। কী করতে গেছিলি ওখানে?
—স্বপন বলে একটা ছেলে আছে। ওর বাপ রিকশা চালায়। আমি ওর সঙ্গে জমিয়ে নিয়েছি। ছুরি-টুরি চালানো ওদের একহাতের খেল। স্বপনের সঙ্গে কলোনিতে গেছি অনেকবার। সুবল বলে একটা ছেলে আছে, ওর কাছে বন্দুকও আছে।
—তুই ওদের সঙ্গে গিয়ে কী করছিস শানু? তুই বলেছিস বীরুকে মারবি?
—আমাকে ল্যাবা ভাবিস নাকি রে। এখন তো শুধু প্যালি করছি, যথাসময়ে ফিল্ডে নামাব। নিশ্চিত বিশ্বাসের সঙ্গে বলল শানু। হীরক কী বলবে বুঝতে পারল না। ছাদে মশা কামরাচ্ছিল এবার। বাড়িতেও ফিরতে হবে। কিন্তু বাড়ি ফেরার কথায় শানু হাঁ হাঁ করে উঠল। আরে, আরে এখন কি যাবি। আমি তো এখনও আমার কালেকশানটাই দেখাইনি।
—কীসের কালেকশান রে শানু?
—পানুর। পড়েছিস কখনও? অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা হীরকের দু-চোখের সামনে হাত নাড়ল শানু। চোদাচুদির ছবি। তুই তো এখনও দুধ পিতা বাচ্চা রয়ে গেছিস হীরু।
সত্যিই তাই। আনন্দলোক আর নবকল্লোল হাটকে কিছু অর্ধনগ্ন ছবি দেখে থাকতে পারে, এর বেশি কখনওই নয়। ভেবেই কান গরম হয়ে গেল হীরকের। ভয় চেপে ধরল। শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, এসব পাস কোথায় তুই?
হা হা করে হাসল শানু। এটা পরমেশবাবু আনেন না। কোথায় আছে জানেও না যে পোড়াবে। চিলেকোঠার ঘর হাতড়ে দু-তিনটে বই তুলে নিল শানু। বইগুলোকে হীরকের চোখের সামনে দোলাতে দোলাতে বলল, সব ওই স্বপন জোগাড় করে দেয় আমাকে। দেখবি তো বল।
এ এক অমোঘ আকর্ষণ। না বলার শক্তি হীরকের ছিল না। দেখবে এটা ভাবতেই ওর শিশ্ন দৃঢ় হচ্ছিল। পাড়ায় সরস্বতীপুজোর রাত জাগায় সবাই এসব বই দেখেছে জানে। কিন্তু হীরকের রাত্রিবেলায় প্যান্ডেল পাহাড়ায় যাওয়ার পারমিশান নেই। তাই এসব দেখেনি কিছুই। এখন হাতের সামনে এমন সুযোগ এসেছে, ছাড়ে কী করে! ঠোঁট চাটতে চাটতে বলল, নীচে চল। চট করে একবার দেখে এবার বাড়ি যেতে হবে।
শানু নিজের ঘরের বিছানায় ছড়িয়ে দিল বইগুলো। ডেবোনিয়ার, অন্য দুটো বিদেশি বই। শানু বলল, ডেবোনিয়ার দিয়ে শুরু কর। এক ধাক্কায় সইতে পারবি না নাহলে। বলতে বলতে খুলে দিল ডেবোনিয়ারের সেন্টার স্প্রেডটা। সারা পাতা জুড়ে একটা মেয়ে, পরনে কোনও পোশাক নেই। মেয়েদের বুক কোনওদিন দেখেনি হীরক। শরীরের মধ্যে কেমন করছিল। শানু হীরকের থাইতে হাত রাখল। এই দেখেই এমন করছিস, তাহলে এই বইগুলো দেখলে কী করবি? শানুর বোধহয় পাতাও মুখস্থ। টপ করে একটা পাতা খুলে দিল। এক সোনালীচুল মেয়ে একটা লোকের উপর বসে আছে। এদের বাঁড়াগুলো দেখেছিস? কানের কাছে ফিসফিস করে বলল শানু। ওর হাতটা থাই থেকে কোমরে, কোমর থেকে আরও নীচে খেলতে শুরু করল। তোর ভালো না লাগলে করব না, ও ফিসফিস করে বলছিল। হীরক কিচ্ছু বলতে পারছিল না। ওর শিশ্ন থরথর করে কাঁপছিল শানুর স্পর্শে। মাস্টারবেট করেছে কিন্তু অন্য কারও স্পর্শ এই প্রথম। হাফপ্যান্টের বোতাম খুলে নিজেরটাও পটাং করে বের করে আনল শানু। আমারটাও ধরতে পারিস। হীরক বুঝতে পারছিল না, এসব ঠিক হচ্ছে, না ভুল। কিন্তু ভালো লাগছে করতে সেটা তো সত্যি। হীরক যেন না-ঘুম, না-জাগা অবস্থার মধ্যে দুলছিল। ফ্যানের হাওয়ায় ফরফর করে উড়ছিল বইয়ের পাতা। দুজনেরই হয়ে গেল। ধপাস করে শুয়ে পড়ল হীরক বিছানায়। শানুর মাথা তখনও ওর থাইয়ের উপর। শানু জিজ্ঞেস করল, কীরে কেমন লাগল। একটা পাপবোধে আচ্ছন্ন হয়ে ছিল হীরক। কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল না। চোখ বন্ধ করে ভাবছিল এটা কী হল। সে কি বাজে ছেলে হয়ে গেল? আর শানু? ও কি দেশবন্ধু কলোনিতে গিয়ে এইসবই করে? বীরুর প্রতিশোধ নেওয়াটা শুধুই বাহানা ওর, নোংরা জগতের স্বাদ পেয়ে গেছে আসলে! ভাবনা ছুটছিল, চোখ বন্ধই ছিল। হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে শানু লাফিয়ে উঠল। হীরক তাড়াহুড়ো করে জিপ টানতে গিয়ে নুঙ্কুটাকে প্রায় উড়িয়ে দিয়েছিল। শানু ঠেলতে ঠেলতে ওকে নিয়ে চলল। ফিসফিস করে বলল, বাবা-মা চাবি খুলে ঢুকে আসছে। তুই আমাদের জমাদার আসার দরজা দিয়ে পালা। খুট করে ছিটকিনি খুলে হীরককে প্রায় ঘাড় ধরে বের করে দিল শানু। পিছনে দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আওয়াজ পেতে পেতে হীরক ভাবল, শানুর কাছ থেকে একটু দূরে থাকতে হবে। এখন কেমন গা ঘিনঘিন করছে, প্যান্ট পুরো চটচটে। কিচ্ছু ভাল লাগছিল না হীরকের। রাস্তায় নেমে সাইকেলে উঠে সাঁই সাঁই করে অন্ধকার কেটে এগিয়ে গেল।
শানু দৌড়ে ফিরে বইগুলো বিছানার চাদরের তলায় চালান করে যতটা সম্ভব চাদর টানটান করে দিল। তোয়ালেতে হাত মুছে চৌকির তলায় ঠেলে দিতে দিতেই শানু শানু বলতে বলতে পরমেশ ঘরে ঢুকল।
—কী রে তোকে ডাকছি সাড়া নেই কেন?
পড়ার টেবিলে খুলে রাখা কেমিস্ট্রির বই দেখাল শানু। পড়ছিলাম বাবা। একদম শুনতে পাইনি।
—বই তো টেবিলে খোলা, তাহলে তুই ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কী পড়ছিস? সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করে পরমেশ।
—অর্গানিক কেমিস্ট্রি বাবা, মনে রাখার জন্য ঘুরে ঘুরে মাথায় সাজিয়ে নিচ্ছিলাম। তোমরা এত তাড়াতাড়ি আজ?
ততক্ষণে সুতপা ঘরে ঢুকেছে। আর বলিস না, যা ভোগান্তি। কোনও কাজ হল না। অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। কোন স্কুলের দুটো বাচ্চাকে বাস চাপা দিয়েছে, সেই রোষে সব ভাঙচুর, রাস্তা বন্ধ। ডাক্তারের কাছে আর যাওয়াই হল না। আমার আবার চিন্তা তুই একা বাড়িতে আছিস, যদি ফিরতে না পারি রাতে তখন কী হবে। তাই উল্টো রাস্তা ধরে আবার হাওড়া এসে লোকাল ট্রেনে বর্ধমান, সেখান থেকে…
সুতপা যতক্ষণ এতসব বৃত্তান্ত দিচ্ছে পরমেশ এগিয়ে গেছে খাটের কাছে। চাদরের নিচে কী আছে ওগুলো উঁচু হয়ে? একটানে চাদর সরাতেই ডেবোনিয়ারের খুলে রাখা মাঝের পাতার মেয়েটা সারা শরীর নিয়ে তাকাল পরমেশের দিকে। এগুলো কী শানু? ঘরে বাজ পড়লেও বোধহয় এত আওয়াজ হত না। শানু কিছু বলার আগেই টান মেরে পরমেশ বইটা তুলে ছুড়ে মারল শানুর মুখে। আমরা বাড়ি নেই আর এইসব করছিস তুই? আর কে ছিল? বাইরে সাইকেল দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। বলছিলাম না সুতপা আমরা নেই, তোমার গুণধর ছেলে বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে ফুর্তি করছে।
এতক্ষণে পরমেশ শানুর গলা ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছিল। শানুর মুখ এখন একদম ফ্যাকাশে সাদা। ঠোঁটটা থরথর করে কাঁপছে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে চাইল, কেউ ছিল না বাবা, কেউ ছিল না তো। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না। তার আগেই ঠাস করে চড়। একটা নয়, অনেকগুলো। এলোপাথাড়ি চড় মারছিল পরমেশ। এইসব করছিস তুই আজকাল। যত ছেড়ে দিয়েছি তোর পাখনা গজিয়ে গেছে একেবারে। সুতপা থামাতে গিয়েও থামাতে পারছিল না। পরমেশ পাগলের মতো হয়ে গেছে একদম। এক ধাক্কায় সুতপাকে সরিয়ে দিয়ে শানুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এত জোরে একটা চড় পড়ল শানুর কান আর ঘাড়ের উপর দিয়ে যে শানু চোখে অন্ধকার দেখে ছিটকে গিয়ে বাড়ি খেল টেবিলের কোনায়। তারপর ওর আর কিছু মনে নেই।
[আবার আগামী সংখ্যায়]