আমরা দেখি, আমাদের দেখে হাজার চোখ

প্রতিভা সরকার

 


চরম দুঃখিত বোধ করি, মরমে মরে থাকি— কোনও আশার কথা উচ্চারণ করতে না পেরে। মুক্তি ঠিক কোন পথে আসবে, কেউ জানে না! তবু যে যেখানে যতটুকু লড়ে যায় তা আমাদেরই লড়া। সুহানা সফর অন্তহীন বা বসুধার মতো মেয়েরা এখনও সব মিটিং-মিছিলে যায়। স্লোগান তোলে। রণিতা চ্যাটার্জিরা সিলি পয়েন্টে বসে নিরন্তর লিখে যান ধর্ষণ-রাজনীতির বিরুদ্ধে। ওদের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়— হ্যাঁ, কিছু একটা হবে। এইভাবে তো চিরকাল চলতে পারে না

 

পলিটিক্যাল কমেন্টেটর বা টিয়াপাখি-শোভিত জ্যোতিষী— দুই বিপরীত মেরুর দুই ব্যক্তিত্বের কোনওটিই নই বলে নিজের মনে হওয়া-গুলোকে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করি। একজন অল্পবিস্তর রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন সাধারণ মানুষ বৈ তো কিছু নই— এরকম লক্ষ লক্ষ আছেন এই সমাজ-সংসারে। আমাদের প্রকাশিত মতামত কখনও যদি ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে মিলে যায়, তখন “আমি তো আগেই বলেছিলাম” বলে উল্লসিত হওয়া ছাড়া আমাদের আর কী-ই বা করার থাকে।

কিন্তু এই ক্ষেত্রে এই উল্লাস আমার সর্বতো বর্জনীয় মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমার যা মনে হচ্ছে, তা যেন ঠিক না হয়। বরং সেটি ভুল প্রমাণিত হলে আমি খুব খুশি হব।

অভয়া-আন্দোলন সাফল্য লাভ করলে আনন্দের সীমা-পরিসীমা থাকবে না আমার, অথচ এমন কিছু সিঁদুরে মেঘ তখনই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল দিকচক্রবালে, যে মনে হচ্ছিল— ফিকে হয়ে যাবে অভয়ার এই ভয়াবহ মৃত্যুর স্মৃতি। যে আশা জাগিয়ে শুরু হয়েছিল মেয়েদের রাত পুনর্দখল, তার সামান্য অংশ টিকিয়ে রাখাও মুশকিল হয়ে পড়বে। আজ এক বছর পুরতে চলল, সেই চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকেই যখন সেই বিষয় নিয়ে আবারও পর্যালোচনার অনুরোধ এল, সচকিত হয়ে দেখি— তৎকালীন আশঙ্কাগুলোর অনেকটাই আজ সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে।

এক বছর আগের কৃষ্ণ আগস্টে প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল এই রাজ্যের সর্বত্র। টানা ডিউটির পর কিছুক্ষণ বিশ্রামে থাকা এক তরুণী চিকিৎসককে তাঁরই কর্মস্থলে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছিল। এই ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন মেয়েটির সহকর্মীরা এবং সাধারণ মানুষ। শাসকের সসেমিরা অবস্থান ছিল দেখবার মতো— সে ধর্ষকের ফাঁসি চাই বলে মিছিল করেছিল, আবার সব প্রমাণ লোপাটে সক্রিয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল বলে অভিযোগ এনেছিল সবাই।

 

এই ঘটনার পর প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে ভেঙে ফেলা হয়েছিল খোদ ঘটনাস্থলের কিছু অংশ। বাবা-মায়ের উপস্থিতির তোয়াক্কা না করে শাসকদলের মাতব্বর শ্মশানে কত তাড়াতাড়ি মরদেহটি জ্বালিয়ে দেওয়া যায়, সে-বিষয়ে অভূতপূর্ব তৎপরতা দেখিয়েছিলেন। এক প্রাক্তন সিবিআই কর্মকর্তা টেলিভিশনের আলোচনায় বসে বলেছিলেন— যদি দেখা যায় সিবিআই প্রমাণ করার চেষ্টা করছে ধর্ষক একজনই এবং এটা গণধর্ষণ নয়, তাহলে বুঝে নিতে হবে সর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে আছে।

আজ আমরা সবাই জানি সিবিআইয়ের চার্জশিটে কী আছে। প্রশাসন, পুলিশ ও রাজনৈতিক দল— কোন সর্ষেয় ভূত লুকিয়ে নেই ভেবে আমরা দিশেহারা। এই অবস্থার মধ্যেই আবার ঘটে গেল আরও একটি “প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ষণ”— এবার কসবা ল কলেজে। একই ছকে, শাসকের প্রসাদপুষ্ট বাহুবলীরা একটি মেয়েকে সিকিউরিটির ঘরে আটকে রেখে মারধর এবং চূড়ান্ত শারীরিক নিগ্রহ করল। তফাত শুধু এই— মৃতবৎ মেয়েটিকে তারা মৃতই ভেবে নিয়েছিল। তাই আমরা মূল অপরাধীদের তৎপর গ্রেপ্তারি দেখেছি, কিন্তু তারা মহা মহা প্রভাবশালী হওয়ায় সুবিচার এখনও দূর অস্ত। যথাযথ চার্জশিট জমা হলে উৎকণ্ঠা কিছুটা কমবে। কিন্তু তারপর— এই নিগৃহীত তরুণীর সুবিচার পেতে কত সময় লাগবে, তা কেউই জানে না।

 

প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এখনও কিছু কিছু চলছে, কিন্তু সেই আশা-জাগানিয়া উদ্দীপনা সম্পূর্ণ অন্তর্হিত। অবদমন তো রয়েছেই, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চূড়ান্ত ভয় ও হতাশা— যা কাজ করছে এই নৈঃশব্দ্যের অন্তরালে। আর আছে অন্তর্ঘাত। আমাদের তরফেই।

এই বিষয়টি নিয়েই বরং যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করা যাক।

অভয়া-আন্দোলনের শুরু থেকেই খুব বেশি করে যে-ব্যাপারটি দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল, তা হচ্ছে— এই আন্দোলন অরাজনৈতিক। যখনই দেখা যাচ্ছিল বাঁদিকে ঈষৎ হেলে গেছে এর মাথা, তখনই কিছু তথাকথিত “বামপন্থী” তারস্বরে চিৎকার করে উঠছিলেন— “গেল গেল, বিজেপি সব দখল করে নিল!” মেসেজ ঘুরছিল হোয়াটসঅ্যাপে হোয়াটসঅ্যাপে— ডাক্তারদের সঙ্গ অবিলম্বে ত্যাগ করুন, কারণ এই আন্দোলন এখন বিজেপি পরিচালিত। অথচ তার কিছুদিন আগেই সেই ডাক্তাররাই অগ্নিমিত্রা পালকে খেদিয়ে দিয়েছেন। বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন গেরুয়াকে। তাহলে কার স্বার্থে এই আগুনখেকো বিপ্লবীরা এমন তত্ত্ব ছড়াচ্ছিলেন?

আমি যার কাছ থেকে এই মর্মে মেসেজ পেয়েছি, তিনি তো একটি মেজ বাম দলের মেম্বার, যারা কিনা অন্তত মুখে বাম ঐক্যের কথা বলে। তিনি কি এই মেসেজ চালাচালি করে নিজের পার্টির বিরুদ্ধাচরণ করেননি?

আসলে ওটা ছিল একটি সুচিন্তিত ষড়যন্ত্র। বিজেপিকে পাত্তা দেওয়া হলে বরং কলঙ্কছাপ লাগাতে সুবিধে হত, বামমনস্ক মানুষ নিজেরাই সরে যেত এই আন্দোলন থেকে। যখন দেখা গেল সেটাও হচ্ছে না, তখন এই প্রচার তো চালাও রে বাপু যে গোটা আন্দোলনটাই বিজেপির কোলে বসে করা হচ্ছে।

এই প্রচারের পেছনে স্থানীয় শাসকবর্গের মদত থাকলে একটুও আশ্চর্য হব না। অনৈক্যের সুযোগ শাসক সর্বত্র এবং সর্বসময় নিয়ে থাকে। এটা তার স্বভাব।

কিন্তু তখনও সবাই জানত, এখনও জানে— কেন্দ্রবাসী দলটি এই আন্দোলনের ধারেকাছেও ছিল না, এখনও নেই। বরং তাকে এই আন্দোলনে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, সেজন্যই কি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন অভয়ার বাবা-মা?

এক বছর আগে বলেছিলাম দিশাহীনতার কথা। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে— তা বলার মতো কোনও নেতৃত্ব তখনও ছিল না, এখনও নেই। ডাক্তারদের সামনে নানা প্রতিবন্ধকতা ছিল— পরীক্ষা, পোস্টিং, কোনও বিশেষ রাজনীতির মুখ না হয়ে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা। তাঁরা যে বাম দলগুলির সদস্য বা সমর্থক, তাদের মধ্যেকার অনৈক্য তাঁদের কর্মপদ্ধতিকে পদে পদে বিদ্ধ করেছে। যখন ডাক্তার সুবর্ণ গোস্বামীকে যোগ্যতার তুলনায় নীচু পদে বদলি করা হল, তখন চিকিৎসককুল একসঙ্গে গর্জে উঠতে পারল না। ফলে সহজেই এল পরবর্তী আঘাত— ডাক্তার আসফাকুল্লা ইত্যাদির পোস্টিং নিয়ে। যত দূরে সম্ভব ঠেলে দেওয়া হল এই আন্দোলনের সামনের সারির তরুণ চিকিৎসকদের।

আর ‘রাতদখল’ ইত্যাদির নামে যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তাতে আন্দোলনবিমুখতা ক্রমেই বাড়ছে। রাতের পর রাত জেগেছেন যে নাগরিকরা, মিটিং-মিছিলে ছুটে গেছেন, তাঁদের সুদূর কল্পনাতেও এই চিন্তা ছিল না যে এই আন্দোলনের নেতৃত্বদান চাকরির বাজারে যোগ্যতার মানদণ্ড হবে কিংবা পুরস্কারপ্রাপ্তির আলোকিত মঞ্চে উঠতে সহায়ক হবে, তা নিয়ে প্রবল কাড়াকাড়ি হবে, তুই বেড়াল না মুই বেড়ালের কুনাট্য অনুষ্ঠিত হবে, বর্ষীয়সী নেত্রী টিভি বাইট দিতে থাকলে তাঁরই সঙ্গে থাকা অন্য নেত্রীর অস্বস্তি ক্যামেরার চোখ এড়াবে না।

আমরা দেখি দুই চোখে, কিন্তু আমাদের দেখে হাজার চোখ।

আসলে যেরকম ব্যক্তিত্ব বা রাজনৈতিক দলের হাতে আন্দোলনের রাশ থাকলে উজ্জীবিত বোধ করা যায়, এই রাজ্যে এখন তার বড়ই অভাব। ত্যাগ কাকে বলে, এই মুক্ত অর্থনৈতিক জমানায় আমরা যেন ভুলে গেছি। আমাদের প্রায় প্রতিটি কাজের পেছনে সঙ্গোপনে মুখ লুকিয়ে থাকে ব্যক্তিস্বার্থ, নামের সুতীব্র মোহ, মুখে আলো পড়ার ঐকান্তিক ইচ্ছা।

যাঁরা পারতেন, যাঁদের মধ্যে সম্ভাবনা ছিল, তাঁদের সংগঠনগুলি নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়িতে প্রবল ব্যস্ত। সেগুলির মধ্যে এখন দুই ধরনের লড়াই চলছে— এক তো এক দলের সঙ্গে অন্য দলের, আবার প্রত্যেকের নিজের সঙ্গে নিজেরও। আত্মশুদ্ধি কথাটার অভিঘাত অনেক বেশি, তাই বরং হোঁশে ফেরার চেষ্টাই বলা যাক।

অথচ জনসমর্থন ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে এই দুই বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে তবেই।

আবার ভোট আসছে। আবার সময় এসেছে লেসার ইভিল, গ্রেটার ইভিল ঠিক করবার। স্বীকার করি বা না করি, রাজনীতি সর্বত্র আছে। চালাকি দিয়ে তাকে আড়াল করা যায় না। অরাজনৈতিক থাকার অছিলাও এক ধরনের রাজনীতি। দেখা গেল, কায়দা করে লেসার ইভিলকে মদত দেওয়ার পর নিজের পিঠ চাপড়ানোর সময়টুকু অবধি মিলল না, অবস্থা এমন ঘোরালো হয়ে দাঁড়াল যে গ্রেটার-লেসারের তকমাই গুলিয়ে গেল।

যে-কোনও আন্দোলনের পেছনে যে রাজনীতি থাকে, তার সঠিক অভিমুখ নির্ধারণ না করতে পারলে— অভয়া-কাণ্ড ঘটতেই থাকবে। স্কুলে কলেজে অফিসে হাসপাতালে, ট্রামে বাসে— সর্বত্র নিপীড়নের সবচেয়ে সহজ শিকার মেয়েরা। তাই তাদেরই জীবন এখন সবচেয়ে বেশি দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

চরম দুঃখিত বোধ করি, মরমে মরে থাকি— কোনও আশার কথা উচ্চারণ করতে না পেরে। মুক্তি ঠিক কোন পথে আসবে, কেউ জানে না! তবু যে যেখানে যতটুকু লড়ে যায় তা আমাদেরই লড়া। সুহানা সফর অন্তহীন বা বসুধার মতো মেয়েরা এখনও সব মিটিং-মিছিলে যায়। স্লোগান তোলে। রণিতা চ্যাটার্জিরা সিলি পয়েন্টে বসে নিরন্তর লিখে যান ধর্ষণ-রাজনীতির বিরুদ্ধে।

ওদের মুখের দিকে তাকালে মনে হয়— হ্যাঁ, কিছু একটা হবে। এইভাবে তো চিরকাল চলতে পারে না।

স্তম্ভিত হয়ে দেখি, সল্টলেকের যে পার্কে রোজ রাতে হাঁটতে যাই, সেখানে বৃষ্টিভেজা আলো-আঁধারিতে গাছের গোড়ায় গোড়ায় কেউ বা কারা লাগিয়ে রেখে গেছে ছোট ছোট বোর্ড। তাতে লেখা— “অভয়া অরণ্য।”

 

সব লড়াইতেই মুখে আলো ফেলার কাড়াকাড়ি থাকে না। নৈঃশব্দ্যে, প্রতীক্ষায় থাকাটাও এক ধরনের লড়াই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...