অভয়া এবং…

আইরিন শবনম

 


ধর্ষণ আমাদের সমাজে নতুন ঘটনা নয়। ধর্ষণের খাঁড়া মাথায় নিয়েই মেয়েদের বাঁচতে হয়। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয়ার্ধে এসে, যখন মেয়েরা সমাজের প্রায় সর্বস্তরে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে— এমনকি মহাকাশেও— তখনও তারা একটা শরীর হিসেবেই থেকে গেল, মানুষ হতে পারল না। কিন্তু সম্প্রতি দেশে যে ধর্ষণের ঘটনাগুলো সামনে আসছে, তার চরিত্র একটু ভিন্ন। সেখানে প্রধান হয়ে উঠছে ক্ষমতার প্রতাপ— কোথাও উঁচু জাতের, কোথাও শাসক দলের রাজনীতির। এক কথায়, রাজনৈতিক ধর্ষণ

 

অভয়ার আগে এবং পরে যে-কোনও মেয়ের নাম বসিয়ে নিন। অবস্থাটা এখন আমাদের দেশে এবং আমাদের রাজ্যেও ঠিক এমনই। দীর্ঘদিন ধরে মানুষ চুপচাপ সব সহ্য করছিল— ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই গজরাচ্ছিল— একেবারে ফেটে পড়ল আরজিকরের ঘটনায়। সারা দেশ রাস্তায় নেমে এল। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে সাধারণ গৃহবধূ— সকলেই এই প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন। একদিকে যেমন তাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল, অন্যদিকে তাঁদের মধ্যে প্রত্যয়ও জন্ম নিচ্ছিল— এই সর্বাত্মক প্রতিবাদ নিশ্চয়ই সুবিচার দেবে। বিশেষ করে যে-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একজন নারী, তখন তিনি নিশ্চয়ই এ-বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করবেন। বিশেষ করে, কর্মক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের ধর্ষণে মৃত্যুর দায় তো সরকার কোনওভাবেই এড়াতে পারে না! সামনের মাসে এই ঘটনার এক বছর পূর্ণ হবে। ইতিমধ্যে শহর, নগর ও গ্রামের রাস্তায় অনেক মিছিল বয়ে গেছে (এত দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ-লড়াই বাংলা আগে দেখেছে কি না সন্দেহ)। সিআইডি, সিবিআই, প্রশাসন-জনগণ, সর্বোপরি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত, হতাশ এবং মর্মাহত। সবার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়ে, এখন সবই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছে।

এই অবস্থার সুযোগ সবচেয়ে বেশি নিচ্ছে কারা? তার উত্তর মিলবে কসবা ল কলেজ, আইআইএম জোকা এবং আরও অসংখ্য নাম না-জানা কলেজের ইউনিয়ন রুমে উঁকি দিলেই। সংবাদমাধ্যমে আমরা সবই দেখছি। কিন্তু আর ঝাঁপিয়ে পড়ছি না। কারণ আমরা জানি, কিছু করেই কিছু হবে না। শাসকের হাত যাদের মাথার উপর— তারা যা খুশি করতে পারে। আরজিকরের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছে। না হলে এত সাহস তাদের আসে কোথা থেকে? তারা দেখেছে তাদের গুণধর দাদাদের, যারা এ-বেলা সাসপেন্ড হয়ে ও-বেলায় অন্য কলেজে জয়েন করে, যা কার্যত পদোন্নতির সামিল। নৈতিকতার প্রশ্ন তো ছেড়েই দিলাম, ভয়ই বা পাবে কেন! তাই যা ঘটার, তা ঘটছে— সব আমাদের শুধু দেখে যেতে হবে। এটাই আমাদের ভবিতব্য। একমাত্র ভরসা, পাপের ঘড়া পূর্ণ হলে একদিন নিশ্চয়ই তার ফল ফলবে। পাপের ঘড়া কি এখনও পূর্ণ হয়নি? মন্ত্রীদের বাড়ি থেকে কুবেরের ধন উদ্ধার, হাজার হাজার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছিনিমিনি, শিক্ষকদের লাঠিপেটা, সাত বছর চাকরি করার পর যোগ্য প্রার্থীদের চাকরিহারা করা, যে-অন্যায়ের জন্য তাঁদের চাকরি গেল, সেই অন্যায়কে ন্যায্যতা দিতে কোর্টে সওয়াল করা… আর কত?

প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর আমাদের জানা নেই। কিংবা আছে, কিন্তু আমাদের অবস্থা এখন ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির। তাই অসহায় মানুষের শেষ ভরসা— ঈশ্বর কিংবা ভাগ্য— তার উপরই সব ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু তাতেও কি আমাদের রক্ষা আছে? না, নেই।

 

ধর্ষণ আমাদের সমাজে নতুন ঘটনা নয়। ধর্ষণের খাঁড়া মাথায় নিয়েই মেয়েদের বাঁচতে হয়। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয়ার্ধে এসে, যখন মেয়েরা সমাজের প্রায় সর্বস্তরে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে— এমনকি মহাকাশেও— তখনও তারা একটা শরীর হিসেবেই থেকে গেল, মানুষ হতে পারল না। মানবসমাজের জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে! তবে সাধারণভাবে অবস্থাটা পাল্টাচ্ছে। মেয়েদের এখন আর ঠিক আগের চোখে দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু সম্প্রতি দেশে যে ধর্ষণের ঘটনাগুলো সামনে আসছে, তার চরিত্র একটু ভিন্ন। সেখানে প্রধান হয়ে উঠছে ক্ষমতার প্রতাপ— কোথাও উঁচু জাতের, কোথাও শাসক দলের রাজনীতির। এক কথায়, রাজনৈতিক ধর্ষণ। মেয়েদের চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য কিংবা কিছু পাইয়ে দেওয়ার লোভে যৌন হেনস্থা, ধর্ষণ এমনকি খুন।

ব্যাপারটা যে কতখানি রাজনৈতিক, তার প্রমাণ— কাউকে প্রকাশ্যেই হুমকি দেওয়া হচ্ছে এই বলে, “বেশি বাড়াবাড়ি করলে আরজিকর করে দেব।” ধর্ষণ এখন দাবিয়ে দেওয়ার খোলাখুলি একটা অস্ত্র। এ এক ভয়ঙ্কর অবস্থা।

আমরা, যারা বাংলা নিয়ে গর্ব করি, আমাদের এক ধরনের উন্নাসিকতা আছে (দুঃখিত, ছিল)— যেসব প্রদেশে এসব হয়, তারা সংস্কৃতিগত ভাবে খুব পিছিয়ে পড়া, বাংলায় এসব ভাবাই যায় না! কিন্তু পরপর যে সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তাতে আমাদের মাথা মাটিতে লুটিয়ে গেছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না— কারণ রাজ্যের প্রধান একজন মহিলা।

আমরা তো ধরেই নিই, একজন মহিলা যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন জাতি, ধর্ম, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে তিনি একজন নারী প্রতিনিধি। নারীর স্বর। এই নারীকণ্ঠকে শক্তিশালী করতে আমরা বিধানসভা-লোকসভায় নারীর আসন বৃদ্ধির দাবিতে লড়াই করি। কিন্তু যদি ‘যে যায় লঙ্কায়, সে রাবণ’-ই হয়, তাহলে নারীবাদীদের ভাবতে হবে। জন্মগতভাবে নারী হওয়াটাই সব নয়; নারীজাতির প্রতিনিধি হওয়া অত সহজও নয়। একজন পুরুষও তা হতে পারেন। বিদ্যাসাগরের কথা আমরা ভুলি কী করে!

কিন্তু বিদ্যাসাগরের যে লড়াই, তা বোধহয় ব্যর্থ হতে চলেছে। এই যে ধারাবাহিক দুর্নীতির আখ্যান রচিত হয়ে চলেছে, তার উপজাত ফল হিসেবে আবার মেয়েদের ঘরে বন্দি করে রাখার বা নিদেনপক্ষে স্কুল-কলেজে না যেতে দেওয়ার একটা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি কলেজই ছাত্রভর্তির অভাবে ভুগছে। অথচ কয়েক বছর আগেও এমনটা ছিল না। শিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারির পর থেকেই ছাত্রসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান। হ্যাঁ, ছাত্রসংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কমছে— বিশেষ করে মফস্বল বা গ্রামীণ কলেজগুলোতে। ক্লাসে যতটুকু মুখ দেখা যায়, তার প্রায় সবই ছাত্রী। ছাত্ররা এই সময় থেকেই যেকোনওভাবে উপার্জনের রাস্তা খুঁজছে। ছাত্রীরা ক্লাসে আসে অন্য কিছু করার নেই বলে। গ্র্যাজুয়েট না হলে বিয়েতে সমস্যা হবে বলে। কারও কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই, পড়াশোনা করে কিছু হবে— এই বিশ্বাসটুকুও নেই। না হলে গ্র্যাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে কোনও মেধাবী ছাত্র বলে না— “এই পরীক্ষাটা খুব ভালো হয়নি। পড়িনি ভালোভাবে। কী হবে ভালো রেজাল্ট করে? বাড়ি থেকে এমএ পড়াবে না।” অভিবাসী শ্রমিক বাবা বলছেন— “এমএ পড়ে কী করবি? আমাদের কী অত টাকা আছে যে, টাকা দিয়ে চাকরি কিনব! বরং একটা হাতের কাজ শেখ— মোবাইল বা কম্পিউটার মেকানিক হতে পারলে অন্তত খাওয়া-পরাটা চলবে।”

এর কী জবাব আছে আমাদের কাছে? বড় অপরাধী লাগে।

বাকি থাকল মেয়েরা। গ্রামের কলেজে যে মেয়েরা পড়তে আসে, তারা প্রায় সবাই প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী। কতটা পিছিয়ে-পড়া সমাজ থেকে তারা উঠে আসছে! এই পরিবারগুলো যদি জানতে পারে যে কলেজ আর নিরাপদ জায়গা নয়, তাহলে কি মেয়েদের পক্ষে কলেজে পা রাখা সম্ভব হবে?

 

এমনিতেই দুনিয়াজুড়ে একটা ধর্মীয় মৌলবাদের প্রবাহ চলছে। তার সঙ্গে যদি এই নিরাপত্তাহীনতার বোধও যুক্ত হয়, তাহলে তার সবচেয়ে বড় ভিকটিম হবে মেয়েরাই।

অদ্ভুত ব্যাপার— মেয়েদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন, অথচ তার দায় নিতে হবে মেয়েদেরই; কুফলও ভোগ করতে হবে তাদেরই! এমনটাই চলে আসছে। তবু ভালো, মেয়েরা এখন অন্তত অত্যাচারের— এমনকি যৌন অত্যাচারের কথাও সর্বসমক্ষে বলছে, সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে।

কিন্তু এখানেই থেমে গেলে চলবে না। মেয়েদের উপর হওয়া অত্যাচারের হিসেব মেয়েদেরই নিতে হবে। সঙ্গে যদি সংবেদনশীল পুরুষেরা এগিয়ে আসেন, নিশ্চয়ই তাঁদের স্বাগত। আজ আমরা সাফল্য পাইনি, কিন্তু একদিন নিশ্চয়ই পাব। যেদিন সমাজের সর্বস্তর থেকে প্রতিকারের স্বর উঠবে।

আপাতত সেই ক্ষীণ স্বরটিকে উচ্চকিত করে তোলাই এখন আমাদের কাজ। জয় একদিন হবেই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...