নারীর বোধ, প্রতিবাদ ও সত্তা: উনিশ ও বিশ শতকের বঙ্গনারীর কণ্ঠস্বর

মৌ চক্রবর্তী

 


এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়— মঞ্চনাটকে যুক্ত নারীশিল্পীদের অভিজ্ঞতা ও তাঁদের শিল্পীসত্তা থেকে উঠে আসা প্রতিবাদের একটি রূপরেখা। বিদেশে এইরকম প্রতিবাদ নারীবাদী তত্ত্ব হয়ে উঠেছে। কিন্তু এদেশে সে প্রতিবাদ একান্ত কয়েকজন মেয়ের কণ্ঠে সীমিত থেকেছে— বইয়ের পাতার ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়ার মতো। কারণ, ভারতীয় সমাজে নারীরা প্রকাশ্যে এসে সংগঠিত হয়ে নিজস্ব ব্যক্তি-স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি

 

সমাজে মেয়েদের পক্ষে যদি ‘একটু ভাল হতেও পারে’— এইরকম কোনও সম্ভাবনাও তৈরি হয়, তাতেই অনেকের চোখে তা ‘নারীবাদ’ হয়ে ওঠে। সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকে নারীবাদকে এমন সহজীকরণেই দেখা যায়। নারীবাদ নিয়ে নানারকম কড়চায়, কেউ হিংসায় টইটম্বুর হয়ে ব্যঙ্গ করে বলেছেন— নারী বুঝি বা বাদ! তাহলে সমাজে থাকে কে? নারী-পুরুষ— এই দুই ভাগেই কি সব মিটে যায়? অন্য কিছু আর থাকে না? থাকে তর্ক, থাকে দিনের দাবি মেটাতে নারীবাদের কিছু কথা, যা একসময় নারীনামক এক সত্তাকে বাদ রেখেই চলত। এই বক্তব্য উচ্চারিত হতেই অন্য এক পক্ষ প্রতিবাদ করে বলে— তাহলে কি তুমি বলছ নারী বাদ নয়? তা হলে নারীবাদ তো নিরর্থক!

এইমাত্র যেন বাতাসে নারীবাদের বারুদ ছড়িয়ে পড়ে, দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন। সেখানে নারীধর্ষণের পরিসংখ্যান উত্থাপন করা হয়, পাল্টা প্রশ্ন তোলা হয়— পুরুষ ধর্ষণ হয় না? নারী-মুক্তির আন্দোলনে নারী যেন ভ্রূণাবস্থায়ই ধর্ষিত হতে থাকে— জন্মের আগে থেকেই। “অর্ধেক নারী, তার অর্ধেক পুরুষ”— এই কথাটা চলতি হলেও আজ কানে নতুন সুর তোলে।

এইবার তাহলে ঢুকে পড়া যাক সমাজের ঘরে— দ্রুত কিছু প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে।

চলুন, কয়েকটা চালু প্রশ্ন তোলা যাক—

নারীর অধিকার ঠিক কবে থেকে স্বীকৃতি পেল? নারীশিক্ষা কবে শুরু হল? কবে থেকে নারীর দীক্ষা হল পেশায়? নারীর মানে কবে থেকে লড়াই করে নিজের জায়গা করে নেওয়ার কথা উঠল? আর কবে থেকে এই প্রশ্নটা উঠল— নারী কি কেবল দু-খণ্ড মাংসপিণ্ডের ঘুরপাক নয়?

তারিখ, সাল-সন কিছুই হাতে নেই। তবু একটা দিন ছিল— যেদিন নারী কলম ধরেছিল। সে-লেখা বেনামী চিঠিই হোক, বা নিজের নামে লেখা থিয়েটারের নাটক। যে-সমাজে নারীদের নিয়ে কাহিনি লেখা হত, সেই সমাজেই একদিন দেখা গেল— নারীরা মঞ্চে উঠছে, অভিনেত্রী হচ্ছে। মানে, অভিনয় করছে।

আজ এসব শুনে হয়তো হাসি পায়।

সেই সমাজে, সেই সময়েই, নারীর অবস্থান ঘিরে একদিন নারীমুক্তির আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। শুধু এই দেশেই নয়, গোটা পৃথিবী জুড়ে।

একদিন, যখন সমাজ নারীদের পরিবার-চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে চাকরির অধিকার দিল, তখন থেকেই শুরু হল পেশাগত জগতে নারীর নতুন লড়াই। সামনে এল আরও কিছু প্রশ্ন— শ্রমের স্বীকৃতি মিলবে কি? সংসারে তাঁর ভূমিকা ঠিক কতটা? সম্পত্তির ওপর থাকবে কি তাঁর দাবি? নিজের পদবি রাখার অধিকার কি থাকবে?

শুধু বেঁচে থাকার জৈবিক চাহিদা নয়, আত্মপ্রতিষ্ঠার তাগিদও এখানে জড়িয়ে আছে। সেখানে একদিকে কিছু উদাহরণস্বরূপ নারী— যাঁরা পথ দেখান। অন্যদিকে বিজ্ঞাপনের পর্দায় তৈরি হয় এক ধোঁয়াশা-ঢাকা নারী-প্রতিমা। এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই রচিত হয় সেই রসায়ন, যেখানে নারী হয়ে ওঠে কখনও যৌতুকের বস্তু, কখনও কৌতুকের উপাদান।

এই ঘরে-বাইরের ভ্রমণ-চারণা দেখে, একুশ শতকেও কি নারীর অবস্থান নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করা যায়? যদি যেত— তাহলে এই লেখা লিখতে হত না।

তাই এখনও লিখতে হয়— নারী কতটুকু করবে, কী কী বিষয় করবেন তিনি, কোথায় তাঁর অবস্থান থাকবে। কাকে আদর্শ নারী বলা হবে, সেই সংজ্ঞাও অমীমাংসিত থেকে যায়। এভাবেই সমাজ অদূর ভবিষ্যতেও নারীর মূল্যায়ন ও যাচাই করতে থাকে।

‘আদর্শ’, ‘লক্ষ্মী’, ‘ভাল’, ‘শান্ত’, ‘সুশীলা’, ‘ঘরোয়া’— এইসব ‘নারীগুণ’ সমাজ নিজেই নির্ধারণ করে রেখেছে। এক দশক থেকে আরেক দশকে তা চর্চিত ও পরিবাহিত হয়ে চলেছে। এই প্রসঙ্গে, আজকের একুশ শতকের তথাকথিত প্রগতির যুগেও নারীর পেশা বেছে নেওয়ার বিষয়টি সমাজে এক বিতর্কিত আলোচ্য বিষয় হয়ে আছে।

 

দুই.

নারীর পেশায় অভিনয় এখনও অনেকের কাছে সর্বশেষ পছন্দের তালিকায় পড়ে। এই তথ্য মূলত থিয়েটারের প্রেক্ষিতে সত্য— যেখানে উপার্জন না থাকলে পরিবার থেকে মেয়েদের অংশগ্রহণের অনুমতিই মেলে না। ‘অভিনেত্রী’ বলতে এখনও অনেকেই বোঝেন চলচ্চিত্র বা টেলিভিশনের ঝলমলে পর্দার কোনও মুখ— যিনি বিজ্ঞাপনের মুখ, সেলিব্রিটি। কিন্তু নাট্যশিল্প— বিশেষত মঞ্চনাটকের অভিনেত্রীরা— আজও উপেক্ষিত। অথচ, প্রসেনিয়াম থিয়েটার বা মঞ্চনাটকে অভিনয় করা থেকেই নারীশিল্পীদের পেশাগত লড়াই শুরু হয়েছিল।

‘অভিনেত্রী’ শব্দের মধ্যেই লিঙ্গভেদের ছাপ স্পষ্ট— এটি এক স্ত্রীলিঙ্গবাচক, এবং সমাজে অভিনয় নামক একটি নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত।

এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়— মঞ্চনাটকে যুক্ত নারীশিল্পীদের অভিজ্ঞতা ও তাঁদের শিল্পীসত্তা থেকে উঠে আসা প্রতিবাদের একটি রূপরেখা। বিদেশে এইরকম প্রতিবাদ নারীবাদী তত্ত্ব হয়ে উঠেছে। কিন্তু এদেশে সে প্রতিবাদ একান্ত কয়েকজন মেয়ের কণ্ঠে সীমিত থেকেছে— বইয়ের পাতার ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়ার মতো। কারণ, ভারতীয় সমাজে নারীরা প্রকাশ্যে এসে সংগঠিত হয়ে নিজস্ব ব্যক্তি-স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি।

ভারতীয় ইতিহাসে এটি বিস্ময়ের, তবুও উল্লেখযোগ্য— বিধবা বিবাহ নিয়ে চুঁচুড়ায় বসবাসকারী এক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতিকার চিঠি সরাসরি নারীর অধিকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। সনাতন সমাজের কড়া নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রামমোহন রায়ের ‘সম্বাদ কৌমুদী’ পত্রিকায় স্ত্রীজাতিকাদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এ যেন মরুভূমিতে এক ফোঁটা জল— মেয়েদের নিজস্ব কণ্ঠ প্রকাশের দুর্লভ সুযোগ।

যেহেতু উনিশ শতকে মেয়েদের অধিকার নিয়ে রামমোহন রায়-ই প্রথম বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাঁর আশ্রয়ে ও প্রেরণায় কিছু নারী সাহস করে কলম ধরতে পেরেছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘সোমপ্রকাশ’, ডিরোজিও সম্প্রদায়ের ‘জ্ঞানান্বেষণ’, মিশনারি পরিচালিত ‘সমাচার দর্পণ’— এই সব পত্রিকাও সমাজ ও নারীর আত্মপ্রকাশের এক একটি ক্ষুদ্র কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। তাদের পাতায় ভদ্রকুলবতী নারীদের লেখা চিঠি, আত্মজীবনী কিংবা প্রবন্ধ যেমন জায়গা পেয়েছে, তেমনই সমাজ-বহিষ্কৃত মেয়েদের লেখাও সেখানে প্রকাশিত হয়েছিল সাহসিকতার সঙ্গে। অর্থাৎ, জাতিকারাও সমাজ ও সংস্কারের বিরুদ্ধে একধরনের মৌন প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন, যা এখনও পর্যন্ত ইতিহাসের আড়ালে রয়ে গেছে— আলোকিত হয়নি, আলোচিত তো নয়ই।

তবু, এসব তথ্য আজও মূলত বইয়ের পাতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কিংবা গদ্যের গহ্বরে আবদ্ধ। এবং সেই চিঠি লেখা— যা একদিন নারীর অধিকারের প্রতীক ছিল— আজও তার ভূমিকাকে প্রশ্নচিহ্নের মধ্যেই থাকতে হয়।

এই আলোচনার মুখ্য উপাদান হলেন অভিনেত্রী তথা সেই সমাজ-বহিষ্কৃত নারীরা, যাঁদের মঞ্চপরিক্রমা এমন এক ইতিহাস রচনা করেছে, যা শুধু গ্রুপ থিয়েটারের পূর্বপর্ব হিসেবে দেখা যায় না— বরং এটি নারীর অধিকারের সংগ্রামে একটি স্বতন্ত্র মূল্যায়নের দাবি রাখে। অভিনয়জীবী এই জাতিকাদের উৎস সন্ধানে গেলে দেখা যায়, তাঁদের অবস্থান সমাজের মূল কাঠামোর মধ্যেই নিহিত। অতএব, অভিনেত্রী প্রসঙ্গে মূল সমাজ এবং সেই সমাজের নারীদের কথাও যুক্তিসঙ্গতভাবে আলোচনায় আসবে। মঞ্চনাট্যের সূচনাকালে অভিনেত্রীদের উৎপত্তি ও স্বীকৃতি খুঁজতে গেলে সমাজের সনাতন গঠন এবং প্রাচীন কলাবিদ্যার কেন্দ্রস্থল থিয়েটারের দিকেই নজর দিতে হয়।

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই জাতিকার শারীরিক ভূমিকা— ধারণ ও জন্মদানের কাজ— একটি ‘প্রকৃতিবৃত্তীয় দায়িত্ব’ হিসেবে সমাজ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সংসারজীবনের দায়িত্ব, যেমন শিশুপালন, পশুপালন, গৃহপরিচর্যা, পরিবারসেবা ইত্যাদি। যদিও ভৌগোলিক অবস্থান অনুসারে সামান্য পার্থক্য থাকে, তবু নারী বা জাতিকার সামাজিক অবস্থান জগতজুড়েই মূলত এক: পরনির্ভর এবং প্রান্তিক। এই দীর্ঘ সময়ের বঞ্চনার অভিজ্ঞতাই নারীবাদী আন্দোলনের জন্ম দেয়। এবং আজ, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে এই আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আর নতুন করে প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না।

এই প্রেক্ষিতে থিয়েটারের অভিনেত্রীদের সমাজ-সংস্থানে অবস্থান ও তাঁদের সম্পৃক্ততা মূলত বৃহত্তর নারীসত্তারই একটি প্রকাশ। কারণ, লিঙ্গভেদের ভিত্তিতে তাঁরাও সেই একই সমাজের অংশ এবং তাঁরাও ভোগ করেন একইরকম বৈষম্যমূলক আচরণ। বিশ্ব রঙ্গালয় থেকে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ইতিহাস পর্যন্ত তথ্যসূত্রে দেখা যায়— মঞ্চাভিনেত্রীদের অবস্থান আরও করুণ ও দুর্দশাগ্রস্তভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। কারণ থিয়েটার নিজেই সমাজের একটি অঙ্গ। সমাজ থেকেই কলাকুশলীরা থিয়েটারে আসেন। এবং নান্দনিক প্রয়োজনে, নাট্যচর্চায়, জাতিকাদের যুক্ত করা হয়।

পশ্চিমে যেখানে ‘বয় অ্যাক্টর’-এর চল ছিল, সেখানে বঙ্গরঙ্গমঞ্চে দেখা গেছে ‘ছোকরা’ কিংবা ‘গোঁফ কামানো রাই’-দের অভিনয়। সমাজে যাঁরা নৃত্য ও সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন, তাঁরাই মূলত অভিনেত্রী হিসেবে বাছাই হতেন। উল্লেখযোগ্য বিষয় যে, থিয়েটার তথা পারফর্মিং আর্ট বা প্রায়োগিক নাট্যকলার কাঠামো একাধিক অনুষঙ্গে নির্মিত— যার মধ্যে কাহিনি ও চরিত্র অন্যতম প্রধান উপাদান।

উনিশ শতকের বঙ্গরঙ্গমঞ্চের ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত উপাদানের ভিত্তিতে বলা যায়— কাহিনির চরিত্র থেকে চরিত্রাভিনয়ের দিকে যাঁরা অগ্রসর হয়েছেন, সেই জাতিকাদের ভূমিকাও থিয়েটারের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এই সম্পর্ক এতটাই নিবিড় যে, অভিনয় করতে থাকা চরিত্রের মধ্যেও অভিনেত্রী-সত্তার প্রতিফলন ঘটে। এমনকি, অভিনয়ের প্রস্তুতি পর্যায়— যেমন মহলা বা রিহার্সালেও তা দৃশ্যমান হয়। কারণ, থিয়েটার কেবলমাত্র গ্রন্থভিত্তিক (text-based) মাধ্যম নয়, এটি একটি পারফর্মিং আর্ট। তাই থিয়েটারে যুক্ত অভিনেত্রীদের সমস্যা কিংবা অবস্থান বিশ্লেষণ করতে হলে সরাসরি অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ এবং অভিনয়-প্রক্রিয়ায় তাঁদের সম্পৃক্ততার দিকগুলো অনুধাবন করা প্রয়োজন। আবার পরোক্ষভাবে, দর্শকের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেও এই বিশ্লেষণ সম্ভব। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই অভিনেত্রীদের সাপেক্ষে সমাজের অবস্থানজনিত ধারণার উপস্থিতি অপরিহার্য।

এই আলোচ্য অধ্যায়ের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের অন্যতম দিক হল— অভিনেত্রীকে একটি গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করা। তাঁর মাধ্যমেই চরিত্র ও কাহিনি উভয়ের প্রতিফলন ঘটে নাট্যকলায়। এই প্রেক্ষিতেই অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন এক অনির্ধারিত, অনির্ণীত সত্তা, যিনি এখনও সমাজে কোনও সর্বজনীন ও স্বীকৃত পরিচয় নয়। অভিনেত্রী এক নির্বাচিত পেশাজীবী, যেখানে স্ত্রী, কন্যা বা জাতিকা— নানান রূপেই তাঁরা অভিনয় করে থাকেন। এই প্রবন্ধে মুখ্য আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছেন মঞ্চনাটকের সঙ্গে যুক্ত অভিনেত্রীরা।

থিয়েটার বা মঞ্চনাটক মানবসমাজের অন্যতম প্রাচীন ও শক্তিশালী গণমাধ্যম হলেও, এর ভিতরে অভিনেত্রীদের ভূমিকা একাংশ মাত্র। তবু বাস্তব হল এই যে, অভিনেত্রীদের মাধ্যমেই বহু জাতিকা আর্থিক উপার্জনের সুযোগ পান। আর সেই উপার্জন নারীর অধিকারের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হয়ে উঠে আসে।

 

তিন.

অভিনেত্রী তথা নটীদের সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও, তাঁরা বরাবরই নানা ধরনের অসুবিধা, আর্থ-সামাজিক শোষণ এবং সমাজজনিত সমস্যা ভোগ করেছেন। তবু তাঁদের অবস্থান মূলধারার সংস্কার-আন্দোলনের আলোচনায় সচরাচর উঠে আসে না। সমাজ তাঁদের ‘বহিষ্কৃত’ বলে চিহ্নিত করলেও, paradoxically, সেই সমাজই আবার তাঁদের মঞ্চনাটকে অংশগ্রহণ করায়। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে, একজন অভিনেত্রীর অভিনীত চরিত্রের মাধ্যমেই তিনি হয়ে ওঠেন গবেষণার উপাদান। যদিও সমাজ তাঁকে সেই মর্যাদা দেয় না, নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এই ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

যেমন, উনিশ শতকে গোলাপসুন্দরীর নাম উল্লেখযোগ্য— একজন নটী, যিনি শুধুমাত্র অভিনয় করেননি, নাট্যকার হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছেন। তিনি একদিকে অভিনেত্রী, অন্যদিকে সমাজে অবদমিত নারীদের প্রতিনিধি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তাঁর এই ভূমিকা নিছক তত্ত্বনির্ভর নয়, বরং জীবনের অভিজ্ঞতা ও কর্মকাণ্ড থেকে উৎসারিত। এটাই নারীবাদের প্রকৃত ক্ষেত্রভিত্তিক প্রয়োগ, যেখানে ব্যক্তিকে পৃথকভাবে তত্ত্ব পাঠ না করেও আন্দোলনের শরিক হতে হয়।

গোলাপসুন্দরী

থিয়েটার-বিষয়ক আলোচনায় অভিনেত্রীদের প্রসঙ্গ থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক স্পষ্ট হয়। প্রথমত, থিয়েটারের উপাদান হিসেবে টেক্সট, প্লট বা কাহিনি গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, এই কাহিনির ভিত্তিতে চরিত্রাভিনয়ের জন্যে অভিনেত্রীদের উপস্থিতি অপরিহার্য। তবে তৃতীয় যে দিকটি আরও গভীর, তা হল অভিনেত্রীদের সক্রিয় অবস্থান— তাঁদের ব্যক্তিসত্তা, চেতনা ও আত্মপরিচয়। যেহেতু একজন অভিনেত্রীর অবস্থান সমাজনির্ভর, তাই সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অভিনেত্রীসত্তারও রূপান্তর ঘটে। অর্থাৎ, সমাজে জাতিকাদের যে পরিবর্তন, আন্দোলন বা প্রতিবাদ সংঘটিত হয়, তারই প্রতিফলন ঘটে অভিনেত্রীদের অবস্থান ও অভিজ্ঞতায়।

এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে— অভিনেত্রী একাধারে জাতিকা, অভিনয়কর্মী, শিল্পী, স্ত্রীলোক এবং সমাজের একজন সদস্য। তাঁর ভূমিকা মঞ্চনাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে শুরু হলেও, সেখানেই শেষ হয় না। মঞ্চনাটকের পর তাঁকে বহুক্ষেত্রে সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত মাতৃকূলের পেশাভিত্তিক কাজে যুক্ত হতে হয়, যা তাঁকে ‘ভোগ্যা’ বা ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার মানসিকতাকে টিকিয়ে রাখে। ফলে, একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী বা নাগরিকসত্তা হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ তাঁকে দেওয়া হয় না।

এইভাবেই, অভিনেত্রীদের অবস্থান জোড়ায় জোড়ায় বিভক্ত থাকে— মঞ্চ ও সমাজ, অভিনয় ও বাস্তব, স্বীকৃতি ও অবমূল্যায়ন। বিশ শতকের পূর্বভাগে বঙ্গরঙ্গমঞ্চে তাঁদের এই দ্বৈত অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৮৭৩ সাল থেকে ১৮৯৯— এই ২৬ বছর জুড়ে, এবং বিশ শতকের ১৯৪৩ সালের আগপর্যন্ত প্রায় ৪৩ বছর, অভিনেত্রীরা থিয়েটারে সক্রিয় থেকেও সামাজিকভাবে নানা বাধা, অবমাননা ও বঞ্চনার শিকার হন। পত্রপত্রিকায় তাঁদের নিয়ে উপহাস, নিন্দা এবং তাঁদের সামাজিক ভূমিকা নিয়ে তীব্র প্রশ্ন তোলা হয়। এইসব প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা সমাজের অংশ হয়েই থাকেন— সমাজের বাইরে ঠেলে দেওয়া হলেও, সমাজের ভিতর থেকেই তাঁদের লড়াই ও শিল্পচর্চা চলতে থাকে।

বাংলা রঙ্গমঞ্চের অভিনেত্রীদের উৎস যেহেতু মূল সমাজ-পরিকাঠামো থেকেই, তাই তাঁদের নিজের অবস্থান নিয়ে লড়াইও সমাজের কুসংস্কার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধেই। এই অভিনেত্রীদের অনেকেই সমাজ-কথিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পিছিয়ে, আর্থ-সামাজিকভাবে অসংরক্ষিত, মাতৃকূল-পরিচিত শিল্পীকন্যা। তাঁদের নটী হয়ে ওঠা শুধুমাত্র মঞ্চপরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং সমাজের প্রান্ত থেকে উঠে এসে এই অভিনেত্রী-জীবন এক বহুমাত্রিক বাস্তবতার অংশ হয়ে উঠেছে।

পেশাদার থিয়েটার যখন বিলীয়মান, সেই সময়েও তাঁদের অবদান উপেক্ষিত থেকেছে। গিরিশ, অর্ধেন্দু, শিশির, অমরেন্দ্র প্রমুখ নির্দেশক-পরিচালকদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক পরিসরেও তাঁদের অবস্থান কোনও স্বীকৃত বিন্যাসে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্তু এর বাইরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা তৈরি হয়— বিশ্বজুড়ে নারীবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে। সেখানে শরীর ও মনের ওপর আরোপিত অত্যাচার সত্ত্বেও অভিনেত্রীদের সক্রিয়তা নারীবাদের স্বরূপে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।

অভিনেত্রীদের উৎস যখন সনাতনী সমাজের অন্তর্গত, তখন নটীসত্তার আত্মপ্রকাশ হয়ে ওঠে একধরনের প্রতিবাদ— এই প্রশ্নের মাধ্যমে: “একজন স্ত্রীলোক কীভাবে একা নষ্ট হতে পারে?” এই প্রশ্ন সমাজের ভণ্ডামির কেন্দ্রবিন্দুতে আঘাত করে। ফলে, সমাজ-নির্ধারিত মূল্যবোধ ও অভিনেত্রীদের অবস্থান এক সংঘর্ষের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এমনকি, সমাজ-কথিত শিক্ষিত ও ভদ্রজনদের রচিত পত্রপত্রিকাতেও তাঁদের দুঃখ, বেদনা ও নিপীড়নের অভিজ্ঞতা লেখ্যরূপে প্রকাশ পায়।

 

চার.

উল্লেখযোগ্য যে, সময়ের প্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সমাজে নানা পরিবর্তন এলেও নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে সেই প্রগতি ঘটেনি। আগুন আবিষ্কারের মাধ্যমে যেমন মানবসভ্যতা একধরনের সাংস্কৃতিক সুফল লাভ করেছে, তেমনি সেই আগুনই যুগে যুগে বালিকাদের পুড়িয়ে মারার মতো নৃশংসতার সাক্ষী থেকেছে। আইন বদলেছে, কিন্তু মেয়েদের পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা আজও বিরল নয়।

আলোচনার সূত্রপাতের সময়কাল ছিল আরও ভয়াবহ। তখন বাংলার সমাজে নারীর ঐতিহ্য বলতে বোঝাত পুরুষের অধীনতায় এক পশুর মতো জীবনের অবস্থা। উনিশ শতকের সমাজসংস্কারকরা যে আন্দোলনের সূচনা করেন, তা মূলত শিক্ষিত সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারাই চালিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের বাঁচিয়ে রাখা, এবং তাঁদের এমন শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা যাতে তাঁরা ভবিষ্যতে পরিবার ও সমাজ পরিচালনায় অংশ নিতে পারেন।

এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, উনিশ শতকের সমাজসংস্কারের মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবর্ণের ঘরোয়া বা কুলীন কন্যাদের সুরক্ষা ও শিক্ষাদানের সুযোগ তৈরি করা। সেখানে থিয়েটার-সম্পৃক্ত জাতিকাদের জন্য কোনও প্রত্যক্ষ সংস্কার-আন্দোলন ছিল না। ফলে, অভিনেত্রীদের লড়াই হয়ে দাঁড়ায় দ্বিমুখী— একদিকে মঞ্চের স্বীকৃতি, অন্যদিকে সমাজের প্রত্যাখ্যান।

সাধারণ জাতিকাদের যে সকল আত্মজীবনী, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র পরবর্তীকালে প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলিই এখন এই শ্রেণিভুক্ত নারীদের বাস্তব অবস্থান বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র হয়ে উঠেছে। উত্তরকালের সমাজ-গবেষণায় এই প্রাথমিক উপাদানসমূহ নারীর অবস্থান বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

উনিশ শতকের আশির দশকে মঞ্চে নটীদের আনুষ্ঠানিক ইতিহাস শুরু হওয়ার আগেই সমাজে গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনীদের অস্তিত্ব ছিল— তাঁদের পরিচয়, পেশা ও সামাজিক অবস্থান ছিল স্পষ্ট। থিয়েটার তাঁদের এক নতুন পরিচিতি দেয়, আবার তাঁরাই হয়ে ওঠেন দীর্ঘ বাংলা থিয়েটার-ইতিহাসের এক অনস্বীকার্য অংশ।

উনিশ ও বিশ শতকে নির্দেশক, অভিনেতা, হল-মালিক, মুৎসুদ্দি, বেনিয়া শ্রেণির একাংশের দ্বারা থিয়েটারের মহিলারা নানা ছলনা, শোষণ ও অসম্মানের শিকার হয়েছেন— যা পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিশ্লেষিত। এই নিপীড়নের অভিজ্ঞতা কেবল থিয়েটারের নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সমাজের তথাকথিত ‘ভদ্র’ শ্রেণির নারীরাও অনুরূপ নিগ্রহের শিকার ছিলেন। সমকালীন এক লেখিকা আলিপুরের পশুশালার পশুদের খাদ্যের প্রসঙ্গে লিখেছেন, সমাজের অধিকাংশ মেয়ের অবস্থান সেই পশুগুলোর চেয়েও করুণ। এ থেকে স্পষ্ট, থিয়েটারের নটী এবং তথাকথিত ঘরের মেয়ে— এই দুই প্রান্তিক নারীগোষ্ঠী সমাজের ভিন্ন প্রেক্ষিতে অবস্থান করলেও, পুরুষ-শাসিত সমাজব্যবস্থা ও লিঙ্গভিত্তিক নিপীড়ন তাঁদের অভিজ্ঞতাকে একই তত্ত্বচিন্তার আওতায় নিয়ে আসে। সুতরাং, এই পরিস্থিতির মূল সূত্রভাগ হল— নারী হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা। এবং সেই অভিজ্ঞতাই নারীবাদী তত্ত্বের আলোচনায় এঁদের জীবন ও অবস্থানকে কেন্দ্র করে দেয়।

উনিশ শতকের সমাজবিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে থিয়েটারে স্ত্রীচরিত্রে বাস্তব নারীর আবির্ভাব একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও বাস্তব ঘটনা। এই প্রসঙ্গে সমাজে দ্বৈত মত প্রবলভাবে দেখা যায়। একদিকে, ছিলেন বিদ্যাসাগরের মতো বিশিষ্ট সমাজসংস্কারক, যিনি থিয়েটারে স্ত্রীলোক আনার বিরোধিতা করেছিলেন। অন্যদিকে, কবি ও নাট্যকার মাইকেল মধুসূদন দত্ত থিয়েটারে নারীর অংশগ্রহণের পক্ষে মত দেন এবং সে মত সাহস জুগিয়েছিল বাস্তব নারী-অভিনেত্রী নিয়োগের ক্ষেত্রে।

এই মতবিরোধ কেবল নীতিগত বা নান্দনিক ছিল না— বরং তা ছিল পুরুষশাসিত সমাজের ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও নারীর প্রতি অত্যাচারী আচরণের প্রতিফলন। বিশ্লেষণে দেখা যায়, নারীর প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গিই কেবল থিয়েটারের পরিসরে নয়, গোটা সমাজজুড়েই নারী আন্দোলন ও প্রতিবাদের ভিত্তি তৈরি করেছে।

অর্থাৎ, থিয়েটারজীবী নারী বা মঞ্চজাতিকাদের অবস্থান নারীবাদী ইতিহাসের কেন্দ্রীয় সমস্যাগুলির মধ্যেই পড়ে। তাঁরা কেবল নাট্যমঞ্চের চরিত্র ছিলেন না, বরং এক গভীর সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁদের অস্তিত্ব নারী-অধিকারের সংগ্রামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল।

 

পাঁচ.

এরই প্রেক্ষিতে জমে ওঠে অধিকার আদায়ের দাবি— অসাম্যে ও অসম্মানে। এই দাবি কেবল উনিশ বা বিশ শতকের প্রেক্ষিতেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা একুশ শতকের সমাজপ্রগতির আলোচনায়ও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। কারণ—

প্রথমত, গোলাপসুন্দরীর থিয়েটারজীবনের থেকেও অধিক আলোচিত হয়ে উঠেছে তাঁর থিয়েটারে আসার আগের জীবন। সেই জীবনের কেন্দ্রেও ছিলেন একজন পুরুষ— যিনি তাঁকে বিবাহ করার পর, সন্তান-সহ পরিত্যাগ করেন। এই ত্যাগের পেছনে রয়েছে সেই সমাজব্যবস্থা ও মানসিকতা, যা তথাকথিত ভদ্রঘরের মেয়েদের ক্ষেত্রেও প্রায় একইরকমভাবে কাজ করে। ফলে, গোলাপসুন্দরীর সমস্যাকে শুধু ‘নটী’ পরিচয়ের বিচ্ছিন্ন ফল বলা চলে না; বরং তা সমাজে নারীর সার্বিক অবস্থান ও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিফলন।

দ্বিতীয়ত, ‘বি-থিয়েটার’-এর নামকরণ থেকেই যে ইতিহাস গড়ে ওঠে, তা পুরুষের আধিপত্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির নিদর্শন। এই নামকরণে বিনোদিনী কেবলমাত্র একটি ‘ব্যবহৃত উপাদান’ হিসেবে পরিগণিত— ব্যক্তিসত্তা বা শিল্পীসত্তা হিসেবে নয়। পুরুষ-পরিচালিত থিয়েটার পরিসরে তাঁর এই অবমাননাকর অবস্থান তৎকালীন প্রাবন্ধিক লেখিকাদের লেখনীতে, চিন্তনে ও নারীবাদী দৃষ্টিকোণে স্পষ্ট প্রতিফলিত হয়।

তৃতীয়ত, সমাজ থেকেই জন্ম হয় ‘কুলটা’, ‘নষ্টা’, কিংবা ‘মন্দ’ মেয়েদের ধারণার। লেখিকা বিনোদিনী তাঁর আত্মকথায় উল্লেখ করেছেন, একটি স্ত্রীলোক কখনও নিজের ইচ্ছায় নষ্ট হয় না— তাকে নষ্ট করে সমাজ, সমাজেরই কোনও উচ্চবিত্ত, ক্ষমতাধর পুরুষ। সেই পুরুষ প্রেমের অভিনয় করে, অসহায়তার সুযোগ নেয়, নিষ্কৃতির স্বপ্ন দেখায়— অতঃপর নারীকে ভ্রষ্ট করে সমাজে নিজেই শিরোমণি হয়ে ওঠে।

বিনোদিনী

এই সমাজব্যবস্থার নিরিখেই থিয়েটারকেন্দ্রিক জাতিকা তথা শিল্পী অভিনেত্রীদের ইতিহাস এক ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দেয়। তাঁদের মধ্যে দিয়েই রোজগেরে নারীর একটি পরিসর গড়ে ওঠে। এই থিয়েটার-জগতে নটীদের আর্থিক অবদান হয়ে ওঠে তাঁদের অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। নারী স্বাধীনতার প্রথম শর্ত— অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন— এই পর্বেই বাস্তবায়িত হতে শুরু করে। এই কারণে বর্তমান গবেষণায় এটি তৃতীয় অধ্যায় হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, থিয়েটারের অভিনেত্রীদের লড়াই ছিল শুধু অর্থনৈতিক নয়, ছিল সামাজিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ার দ্বন্দ্বে পরিপূর্ণ।

সাধারণ সমাজের নারীদের তুলনায় থিয়েটারের অভিনেত্রীদের অবস্থান কোনও নিরপেক্ষ স্তরে ছিল না। তাঁদের সমাজে দেখা হত ‘বহুভোগ্যা’ রূপে— যেখানে তাঁদের পেশা হয়ে ওঠে পুরুষের লাম্পট্য ও ইচ্ছাধীন ভোগের এক ক্ষেত্র। এই পেশা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার চেষ্টাকেও রুখে দিয়েছে পুরুষতন্ত্রের লেঠেল ও গুন্ডাসমাজ। এই উদাহরণেই গড়ে ওঠে নটীদের এক জটিল, প্রতিকূল ইতিহাস। এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, নারীবাদ কোনও বিচ্ছিন্ন মতবাদ নয়, যা থিয়েটারের অভিনেত্রীদের স্পর্শ করে না। বরং, নারীবাদের পুনঃপাঠ এবং সমাজতাত্ত্বিক অধ্যাপিকা বাসবী চক্রবর্তীর ভাষণ ও তাঁর রচনাগুলি— বিশেষত আন্তর্জালিক মাধ্যমে পাওয়া বক্তব্য ও গ্রন্থসমূহ— এই সত্যকে স্পষ্ট করে তোলে যে, অভিনেত্রীদের সমাজ-বহির্ভূত অবস্থান আসলে সমাজের সঙ্গেই এক নিরন্তর সংঘাত ও প্রতিরোধের সম্পর্ক তৈরি করে। ফলে, তাঁদের লড়াই একক নয়, বরং বৃহৎ নারীবাদী আন্দোলনেরই অংশ, যা সমাজবদলের দাবিকে বারবার সামনে নিয়ে আসে।

এবং সেই প্রয়াসেই আলোচ্য বিষয়টি— যেখানে থিয়েটার এগিয়ে চলেছে তার বহুমাত্রিক গতিপথে, সেখানেই অববাহিকায় অবস্থান করছেন অভিনেত্রী তথা নারী। বিশ্বজুড়ে যখন থিয়েটারের মঞ্চ, বিষয়ভাবনা ও শৈলী নিয়ে নিরীক্ষা চলছে, তখন অভিনয়জগতে নারীর অবস্থানকে পৃথকভাবে নির্ণয়ের প্রাসঙ্গিকতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কারণ একটাই— পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দীর্ঘ প্রভাব অভিনয়ের জগতে আজও বর্তমান। সেখানে “অ্যাক্টর” সবাই নন; লিঙ্গভেদ অনুসারে নারীদের এখনও “অ্যাকট্রেস” বলেই পরিচয় দেওয়া হয়। সাধারণ সমাজেও এই ভাষা-ব্যবহারের প্রভাব লক্ষণীয়— নারী এখনও ‘পারসন’ বা ব্যক্তি নন, বরং একটি লিঙ্গ-নির্ধারিত শ্রেণি। এই প্রেক্ষিতেই থিয়েটারে নারীর ইতিহাসকে— উনিশ ও বিশ শতকে থিয়েটারচর্চায় সমাজের প্রগতির দিক থেকে— পুনঃমূল্যায়নের প্রয়োজন দেখা দেয়।

 

ছয়.

এই সময়ের অভিনেত্রীদের অবস্থান ছিল দ্বৈত— একদিকে তাঁদের থিয়েটারে অবদান, অপরদিকে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা। তাঁদের বেড়ে ওঠা ঘটেছে দুই বিপরীতমুখী সমাজ-বাস্তবতায়। এই প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দেখা যায়, উনিশ শতকে থিয়েটারে আসা নারীদের পথটি ছিল মূলত জীবিকার তাগিদে, সমাজের প্রান্তিক অবস্থান থেকে একরকম ঠেলে দেওয়া বাস্তবতা। অন্যদিকে, বিশ শতকের ইতিহাস— বিশেষত আইপিটিএ-র আবির্ভাবের পর— একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি করে। সেখানে থিয়েটারে নারীর অংশগ্রহণ ঘটে দেশের স্বার্থে, জনজাগরণের লক্ষ্যে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার অঙ্গ হিসেবে।

এই দুই শতকের জাতিকাদের অভিনয়ে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য পৃথক হলেও, নাট্যশিল্প মাধ্যম হিসেবে অভিন্ন থাকায়, সমাজের পক্ষে তাঁদের ভিন্নতা অনুধাবন করা কঠিন হয়ে পড়ে। তথাপি, ধরা যেতে পারে যে সমাজ ততদিনে কিছুটা এগিয়েছে। কারণ, বিশ শতকে অভিনেত্রীদের অনেকেই পরিবারের দাদা-ভাইদের সঙ্গে দেশের উন্নয়নের উদ্দেশ্যে নাট্যকর্মে যুক্ত হন। এই পরিপ্রেক্ষিতে, তাঁদের আর কেবল ‘অভিনেত্রী’ বলে চিহ্নিত করা চলে না; বরং, তাঁরা পরিচিতি পান এক প্রগতিশীল সমাজ-নাট্যকর্মী হিসেবে।

যদিও তাঁদের অনেকের জীবনেও ছিল সাধারণ সমাজের নারীর মতো সমস্যা, তবু তাঁদের অধিকারের দাবিতে পৃথকভাবে পথে নামতে হয়নি। কারণ, সে সময় আন্দোলন ও প্রতিবাদের অভিমুখ হয়ে উঠেছিল দেশ ও দশের কল্যাণ। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, ইতিহাসকে সময়ের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করতে হলে প্রয়োজন একটি সুসংগঠিত, যুক্তিনির্ভর গবেষণা-পদ্ধতির। তৃতীয় অধ্যায়ে সেই প্রয়োজনেই আলোচনার সূচনা হবে উনিশ শতকের অভিনেত্রীদের ইতিহাস থেকে।

বিশ্বায়নের প্রভাবে সংস্কৃতির পারস্পরিক আদান-প্রদান ঘটুক বা না-ঘটুক, সংস্কৃতি গ্রহণের প্রবণতা নিরন্তর ঘটেই চলেছে। কিন্তু এই গ্রহণ প্রক্রিয়া একরৈখিক নয়— নারীদের ক্ষেত্রেও, তাঁদের সমাজে অবস্থান নির্ণয় করতে হলে, তা অবশ্যই শ্রেণি, পেশা ও ক্ষমতার কাঠামোর প্রেক্ষিতে দেখতে হয়।

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, বঙ্গ রঙ্গমঞ্চেই নারীবাদী চেতনার বীজ প্রথম বপিত হয়— যদিও সে সময় নারীবাদ শব্দটির চল ছিল না। এই সময়েই পিছিয়ে থাকা ও পেশাজীবী শিল্পী-নারীদের জীবন ও সংগ্রাম রঙ্গমঞ্চে এক নতুন মাত্রা পায়। একুশ শতকের সমাজ-সংস্কৃতির অভিধানে নারীবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। অথচ বঙ্গনাট্যের ক্ষেত্রে এই নারীবাদ যে উনিশ শতকেই কার্যত সূচিত হয়েছিল, তা এখনও যথাযথভাবে আলোচিত হয়নি। এই অনালোচিত দিকটি সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আলোয় পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

যদিও ‘অভিনেত্রী’ শব্দটি শুনলেই আজ সাধারণ মানুষের মনে সেলুলয়েড বা চলচ্চিত্র জগতের চিত্র ভেসে ওঠে, তার শিকড় আসলে মঞ্চনাট্যে। এখানে ‘সমাজ’ বলতে বোঝানো হচ্ছে বৃহত্তর জনসমষ্টিকে—যাঁদের ধারণা ও প্রতিক্রিয়া সমাজচর্চার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই সমাজের মধ্য থেকেই জন্ম ও বিকাশ ঘটে মঞ্চের নটী সম্প্রদায়ের, যাঁরা অভিনয়জগতের প্রাথমিক ধারক ও বাহক ছিলেন।

 

সাত.

সমাজ-বহিষ্কৃত নারীদের থিয়েটারে আনা হয়েছিল বটে, এবং তাঁদের অর্জিত ও চর্চিত শিল্প-বিদ্যা— যেমন ঝুমুর, যাত্রাপালা, কীর্তন, হাফ-আখরাই প্রভৃতি দেশজ কলারূপ— থিয়েটারে গীতনৃত্যভিত্তিক ধারায় সফলভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল। এই পারঙ্গমতা ছিল এমন এক বিশেষ গুণ, যা উনিশ শতকের থিয়েটারের প্রাথমিক চাহিদা পূরণে অপরিহার্য। কিন্তু এখানেই এক গভীর দ্বন্দ্ব তৈরি হয়— ‘স্ত্রীলোক’ ‘নিয়ে আসা’ ছিল বাংলা তথা ভারতীয় থিয়েটারে এক ঐতিহাসিক প্রথম, অথচ তাঁদের সাংস্কৃতিক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও, অধিকারের প্রশ্নে তাঁরা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। যেখানে সাধারণ ভদ্রসমাজের নারীদেরই তখন কোনও অধিকার ছিল না, সেখানে সমাজ-বহিষ্কৃতারা অধিকারের প্রশ্নে কোথা থেকে বা কী সূত্রে সেই দাবি জানাতে পারেন— এই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।

উনিশ শতকের সমাজ এমন এক সমাজ, যেখানে মেয়েদের জুতো পরার অধিকারও ছিল না। যেখানে শিক্ষার সূচনাপর্বেই মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হত— পাঁচ বছরের এক শিশুকন্যার কৌলীন্য রক্ষিত হত পঞ্চাশোর্ধ্ব কোনও পুরুষের সঙ্গে বিবাহের মাধ্যমে। তারপর যদি সে কন্যা বিধবা হত, তবে হয় সহমরণ, নয়তো সমাজের অত্যাচারে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে নির্জলা উপবাসে দিন কাটিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে উঠত। বঙ্গদেশের এই সমাজ-ইতিহাসে, এই বর্বরতা তথাকথিত ‘বংশজাত কৌলীন্য’ ও ‘সভ্যতার’ নামে বৈধতা পেত।

যে সমাজ থেকে দূরত্বে যাপন করা নারীকে সমাজ তকমা দেয় ‘ভ্রষ্টা’, ‘নষ্ট মেয়ে’— এই শব্দগুলি একেকটি জাতিকার জীবনে অভিশাপের মতো। সেই ‘নষ্টা’, ‘মন্দ মেয়েরা’— অর্থাৎ সমাজ-বহিষ্কৃত নারীরা— বেঁচে থাকার তাগিদে কলাবিদ্যা গ্রহণ করেছিলেন; ঝুমুর, যাত্রাপালা, কীর্তন, হাফ-আখরাই প্রভৃতি দেশজ শিল্পে তাঁরা পারদর্শিতা অর্জন করেন। তাঁরা বাগানবাড়ি বা নিজস্ব উঠোনে প্রমোদবিলাসীদের মনোরঞ্জনের জন্য গীত-নৃত্য পরিবেশন করতেন। কিন্তু সমাজের চোখে তাঁদের ও তাঁদের শিল্পের কোনও মর্যাদা ছিল না।

এই সেই সমাজ যেখানে ‘সতীদাহ’ প্রথা চালু ছিল, যার বিরুদ্ধে প্রথম স্পষ্ট ও প্রভাবশালী প্রতিবাদ এসেছিল রামমোহন রায়ের নেতৃত্বে। সেই সময় শিশুকন্যাদের বাল্যবিবাহ, বিধবা হওয়া এবং বৈধব্যের নিষ্ঠুর নিয়ম থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল শিক্ষা। যাঁরা সেই সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই গদ্য লিখতে পেরেছেন, চিঠি লিখেছেন, দেশে-বিদেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের লেখা কেবল বঙ্গনারীকে ঘিরেই আবর্তিত। অথচ, একই সময় সমাজ-বহিষ্কৃতাদের নিয়েও চিঠি, প্রবন্ধ প্রকাশ পাচ্ছিল একই পত্রিকায়।

তখনও থিয়েটারে জাতিকাদের প্রবেশ ঘটেনি। সেই সমাজ-বহিষ্কৃত নারীদের স্বতন্ত্র চেতনা, তাঁদের আত্মসম্মানবোধ, তাঁদের অস্তিত্বের লড়াই— এসব সমাজ সংস্কারের মূলধারায় গুরুত্ব পায়নি। সাধারণ শিক্ষিত শ্রেণির নারীদের নিয়ে গবেষণা হয়েছে, কিন্তু ‘দেহপসারিণী’ বা ‘জাতিকা’দের নিয়ে যতটুকু গবেষণা হয়েছে, তা নারীবাদের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অথচ, তাঁরাই তো ছিলেন সেই অভিনেত্রী-সম্প্রদায়ের প্রবর্তক, যাঁরা প্রথম অর্থ উপার্জন করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন— মাত্র তিন-চার টাকা মাইনে থেকে শুরু করে। এই লড়াই, এই আত্মনির্ভরতার ইতিহাস নারীবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে যায় কী করে?

নটী হতে আসা নারীদের নিয়ে আলোচনা আজও, গত শতকের মতোই, প্রায় অনালোকিত— এবং পক্ষপাতদুষ্ট। শ্রেণি, বর্ণ, পরিবার ও আর্থিক শ্রেণিকাঠামোর চাপে, সমাজের কর্তাব্যক্তিরা যেভাবে সংস্কারাচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন, তেমনভাবেই অনেক গবেষকও সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তাঁদের আলোচনা করেছেন। এমনই এক গবেষক অমিত মৈত্র; তাঁর সুবাদে আমরা থিয়েটারের নটীদের একটি দীর্ঘ তালিকা, তাঁদের অভিনয়ের স্থান ও কাল-সংক্রান্ত বহু তথ্য জানতে পারি।

তবে এই তথ্যভাণ্ডারের অন্তরালে রয়ে গেছে কিছু অব্যক্ত অথচ গুরুত্বপূর্ণ দিক। সেই সময় থিয়েটারের মহলাকক্ষে যেসব আলোচনা চলত, তার মধ্যে ছিল বিদেশি অভিনেত্রীদের কথা— তাঁরা কীভাবে গড়ে উঠেছেন, কীভাবে অভিনয়চর্চা করছেন, তাঁদের প্রস্তুতির পদ্ধতি কী ইত্যাদি। এই সব আলোচনা কেবল অভিনয়-চরিত্র নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত না; বরং এর সঙ্গে যুক্ত হত সাংস্কৃতিক আধুনিকতার বিভিন্ন ধারাও।

কারণ, যে বা যিনি নিজে থেকেই অভিনয়-মার্গের উচ্চতম স্থান থেকে সরে যান বা নির্বাসনে যান, তিনিও প্রতিবাদের ধারক। যদিও প্রতিবাদের ভাষা ব্যক্তি-ভেদে ভিন্ন হয়। সমাজ-বহিষ্কৃতাদের ক্ষেত্রে সেই প্রতিবাদ প্রথমে ব্যক্তিগত স্তরে হলেও, পরবর্তী সময়ে তা দলবদ্ধ রূপ নেয়। যখন তাঁদের মধ্যে এই বোধ জাগ্রত হয়— যে একা লড়াইয়ের চেয়ে সম্মিলিত প্রতিবাদই অধিক কার্যকর— তখনই শুরু হয় এক ধরনের সংগঠিত প্রতিরোধ।

থিয়েটারের অভিনেত্রীদের সাধারণ সমাজের ‘বাইরের’ বলে গণ্য করা হলেও, আসলে সমাজ তাঁদের কতটা বাইরে রাখতে পারছিল, তা নিয়ে একুশ শতকের গবেষণাপত্রগুলিতে প্রশ্ন উঠেছে। বরং বলা যায়, সমাজ নিজের সুবিধামতো তাঁদের ব্যবহার করে এসেছে। কখনও ভোগ্যবস্তু রূপে, কখনও কীর্তনের বা যাত্রাপালার শিল্পী হিসেবে, কখনও শ্রেষ্ঠ চরিত্রে নৃত্যগীত পরিবেশনকারী হিসেবে, কখনও উপপত্নী রূপে, আবার কখনও সমাজবহিষ্কৃতাকে ‘ঔরসজাত’ সন্তানের জননী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে। কখনও তাঁদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পরে ত্যাগ করা হয়েছে। কখনও তাঁদের মাধ্যমেই নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস গড়েছে সমাজ।

আর হ্যাঁ, সেটাও কি কম ইতিহাস? আজকের স্টার থিয়েটার— তা-ও তো এই ইতিহাসকেই ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে।

সাধারণ শ্রেণির কন্যা না হওয়ায়, সমাজের মূল স্রোতের বাইরে অবস্থান করায়, নটীদের অধিকারের লড়াই দীর্ঘদিন ধরে ‘মুষ্টিমেয় শিল্পনিপুণাদের ব্যক্তিগত সংগ্রাম’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। তাঁদের দাবি কখনওই সাধারণ সমাজের ‘ভদ্র’ নারীদের অধিকারের দাবির সমতুল হিসেবে বিবেচিত হয়নি। অথচ এই নটীরাই বৃহত্তর সমাজ কাঠামোর কুসংস্কার ও পশ্চাৎপদতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাঁদের জন্ম ও জীবনকথা থেকেই প্রকাশ পায় সমাজের লুকোনো নির্মমতা।

নটীদের অন্যতমা বিনোদিনী নিজেই তাঁর আত্মজীবনীতে প্রশ্ন তুলেছিলেন— এই সমাজ কীভাবে ‘ভ্রষ্টা’ বলে চিহ্নিত এক শ্রেণির নারীর জন্ম দেয়। এই প্রশ্নের উত্তর আজ আমরা গবেষকদের বিশ্লেষণে খুঁজে পাই। সেই সময়েও কেউ কেউ পারিবারিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়ে আত্মপরিচয় গোপন রেখে পত্রিকায় লিখতেন। কিন্তু সমাজ-বহিষ্কৃতাদের, বিশেষত দেহপসারিণী ও অভিনেত্রীদের, আত্মপরিচয় লুকিয়ে লেখার প্রয়োজন ছিল না। তাঁদের অনেকেই সাহস করে নিজেদের প্রকৃত নাম প্রকাশ করে লেখালিখি করতেন। যেমন তাঁরা নাম গোপন না করেই তাঁদের লেখা সম্পাদকদের কাছে পাঠিয়েছিলেন, তেমনিভাবে সম্পাদকরাও সামাজিক চাপ উপেক্ষা করে সেই লেখাগুলি অবিকৃতভাবে ও পূর্ণনামে প্রকাশ করেছিলেন।

 

আট.

বিশ্ব-মানচিত্রে সমাজতত্ত্বের ইতিহাস অনুসারে দেখা যায়, ‘ফেমিনিজম’ শব্দটির উৎপত্তি ঘটে উনিশ শতকের মধ্যভাগেই। ১৮৩৭ সালে ফরাসি দার্শনিক চার্লস ফুরিয়ে সর্বপ্রথম ‘ফেমিনিজম’ শব্দটি ব্যবহার করেন। পরে, অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী ‘ফেমিনিস্ট’ (নারীবাদী) শব্দের উদ্ভব ঘটে ১৮৫২ সালে এবং ‘ফেমিনিজম’ (নারীবাদ) শব্দটি গৃহীত হয় ১৮৯৫ সালে।

এই সালগুলো আমাদের জানায়, তখনই বিশ্বজুড়ে নারীর অধিকারের প্রশ্নে আন্দোলন ও ভাষা গঠনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হচ্ছিল। বিভিন্ন সমাজে নিজস্ব প্রেক্ষিতে নারীর অধিকারের লড়াই শুরু হয়েছিল, এবং সেই প্রয়োজনেই শব্দগুলিও সমাজের বৃহত্তর পরিসরে স্থান পেয়েছিল।

এই প্রেক্ষিতে অধ্যাপিকা বাসবী চক্রবর্তীর মতও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মনে করান, সমাজবিদ্যা যাঁরা গড়ে তুলেছেন— অগাস্ত কোঁত, এমিল দ্যুখাইম, ম্যাক্স হেব্বার প্রমুখ— তাঁরা তাঁদের তত্ত্বচর্চায় নারীর অভিজ্ঞতা বা অবস্থানকে অন্তর্ভুক্ত করেননি। ফলে সমাজতত্ত্বের মূলধারায় নারীবিষয়ক ভাবনার স্থান হয়নি, এবং বিশ্বায়ন-তত্ত্বেও নারীর প্রসঙ্গ প্রায় অগ্রাহ্য রয়ে গেছে। তবুও, চক্রবর্তী নিজেই উল্লেখ করেন যে উনিশ শতকেই নারীবাদীদের অস্তিত্ব ছিল এবং বৃহত্তর পরিসরে তাঁদের লড়াইও ছিল।

এই আলোচনার প্রেক্ষিতে ‘নারীবাদ’ শব্দটির বঙ্গীয় অনুবাদ ‘নারীবাদ’ শব্দেই রূপান্তর করা হচ্ছে ভাষার সাযুজ্য রেখে। কিন্তু তার আগে জরুরি হয়ে দাঁড়ায়— উনিশ শতকের বঙ্গসমাজে নারীবাদের প্রয়োজন কেন দেখা দিয়েছিল, সেই প্রেক্ষাপট বোঝা। বিশেষ করে সেই সময় সাধারণ স্ত্রীজাতির সামাজিক অবস্থান, অভিনেত্রী পেশার সূচনা, এবং নটীদের সম্মানের দাবি— এই সবকিছু নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়নের দাবি রাখে। বিনোদিনীর আত্মজীবনীতে উঠে আসে বি-থিয়েটার দ্বারা প্রতারণার অভিজ্ঞতা। অন্যদিকে, সুশীলাবালার ‘সাধারণ সভায়’ প্রবেশাধিকার চাওয়াও একই অধিকারের আন্দোলনের অংশ। অর্থাৎ, উনিশ শতকের ‘সমাজ-বহিষ্কৃতা’, তথাকথিত ‘মন্দ মেয়েরা’ শুধু সমাজের প্রান্তে থাকা নিছক একক চরিত্র নয়, বরং তাঁরা বিশ্ব থিয়েটার ইতিহাসে ‘অংশগ্রহণকারী’ হয়ে গবেষণায় স্থান পাচ্ছেন।

প্রত্যেক সমাজেই একটি নির্দিষ্ট সময়ের লড়াই থাকে, যা সেই সময় পেরিয়ে গেলে আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, তা তখন আর পরিবর্তনশীল থাকে না, বরং এক ধরনের ঐতিহাসিক রূপ নেয়— গবেষণার উপাদান হয়ে ওঠে। সময়ের প্রবাহে সেই লড়াইয়ের বৈশিষ্ট্যও প্রতিষ্ঠা পায়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের ভেতর থেকে উঠে আসা কিছু নারীর অবস্থান ও ভাবনা বিশেষভাবে মনোযোগ দাবি করে।

বিশ্ব-ইতিহাসে নারীর অধিকারের দাবিতে যিনি সরব হয়েছিলেন, বই লিখেছিলেন— সেই একটিমাত্র নারীর নামই আজ উচ্চারিত হয় বহু তাত্ত্বিক আলোচনায়। সেই যুক্তিতেই প্রশ্ন ওঠে— আমাদের বঙ্গসমাজে যাঁরা কলম ধরেছিলেন, চিন্তা প্রকাশ করেছিলেন, যাঁদের লেখায় কিংবা কর্মকাণ্ডে উঠে এসেছে নারীজীবনের অসাম্য ও দুর্দশা— তাঁদের কেন ‘নারীবাদী’ বলে চিহ্নিত করা হবে না? নারীর সমস্যা থেকেই নারীবাদের উৎস। আর সেই সূত্রে নারীবাদী ভাবনার অস্তিত্ব প্রমাণে বিশেষ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না।

উল্লেখযোগ্য যে, উনিশ শতকের তৃতীয় অধ্যায়ের সমাজবিশ্লেষণে অভিনেত্রীদের অবস্থান বোঝার মূল সূত্র ছিল সমাজ নিজেই। অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে থিয়েটারের অভিনেত্রীদের প্রসঙ্গ। সেই সূত্র ধরেই, না-দেখা উনিশ শতকের নারীজীবনের অবস্থান জানতে গেলে তাঁদের লেখা প্রবন্ধ পাঠ করা জরুরি হয়ে ওঠে। সে পাঠে সমাজের প্রতি পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ধারণা যে যথার্থ ছিল, তা প্রতীয়মান হয়।

বিদ্যাসাগর কেন থিয়েটারে অভিনেত্রী আনার বিরোধিতা করেছিলেন, তা আমরা অনুমান করতে পারি সমাজ-বহিষ্কৃত নটীদের ইতিহাস দেখে। যদিও সেই বিরোধিতার কারণে তিনি প্রগতিশীল কিনা, তা নিয়েও বিতর্ক দেখা দেয়, তবু অভিনেত্রীদের প্রতি সমাজের যে অবজ্ঞা ও অসম্মান ছিল, তা বিদ্যাসাগরের আশঙ্কার যথার্থতা নির্দেশ করে।

তবে এই সমাজদৃষ্টিভঙ্গি শুধু অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রেই নয়, তা প্রতিফলিত হয় সাধারণ শিক্ষিত নারীদের প্রতিও। যাঁরা উনিশ শতকে সমাজসংক্রান্ত প্রবন্ধ লিখেছিলেন— তাঁদের লেখা পড়ে অনেক শিক্ষিত পাঠক সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, যে এগুলো আদৌ কোনও নারীর লেখা কিনা। কারণ, সেই লেখাগুলির ভাষা ছিল যুক্তিনির্ভর, চিন্তায় পরিণত, এবং আবেগবর্জিত। এক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক তাই মন্তব্য করেন, লেখার ভাবনা এতই যুক্তিপূর্ণ ও পরিণত যে তা কোনও নারীর লেখা বলে বিশ্বাস করতে সমাজ প্রস্তুত ছিল না।

এই প্রবণতা থেকেই বোঝা যায়, সমাজ মেয়েদের বুদ্ধি বা যুক্তিচর্চার উপযুক্ত বলে মনে করত না। মেয়েদের বিদ্যাচর্চা দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় বিধিনিষেধের দোহাই দিয়ে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। অথচ, যখন কোনও বিদুষী নারী যুক্তিপূর্ণ গদ্য লেখেন, তখন তা বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় সমাজের চোখে। এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন সনাতনী সমাজে স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন শুরু হয় ধর্মীয় কুপ্রথা দূর করার চেষ্টার পাশাপাশি। মিশনারি প্রতিষ্ঠান ও উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কারক পুরুষদের মিলিত উদ্যোগে স্ত্রীশিক্ষার যে বিস্তার ঘটে, তা-ই ছিল এই সময়কার সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তি।

তবুও, সমাজে অধিকাংশ জাতিকা এখনও ধর্ম ও সমাজের প্রচলিত আচার-বিচারের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থেকে যান। চোখে পড়ে কিছু ব্যতিক্রম, মূলত আর্থিকভাবে স্বচ্ছল উচ্চবর্ণ ও উচ্চবর্গীয় মহিলাদের মধ্যে। এক লেখিকার গদ্যে সেই বৈষম্যের চিত্র বিশেষভাবে উঠে এসেছে। তিনি প্রতিটি গ্রামীণ জাতিকার জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন, যাঁদের তিনি বলেছেন— “শতশত … অরক্ষিতা, অশিক্ষিতা, বাকশক্তিহীনা”, আবার “কতশত নির্দোষী পবিত্র বালিকা … পশুহস্তে অকালে নিধনপ্রাপ্ত”। প্রবন্ধের নাম ‘ঊষাচিন্তা (সমাজ)’।

স্বর্ণময়ী গুপ্তার ‘ঊষাচিন্তা (সমাজ)’ প্রবন্ধটির শব্দচয়ন স্পষ্টতই একুশ শতকের পাঠক ও গবেষণায় নারীর অবস্থান নিয়ে আগ্রহী পাঠক-গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণের উপযুক্ত। যেমন— ‘সমোন্নতি’, ‘সমানাধিকার’, ‘স্ত্রীজাতির দুরবস্থার স্থায়িত্ব’, ‘নব্য সম্প্রদায়ের অসহিষ্ণুতা’, ‘মানসিক অঙ্গ চালনা করিতে দিলে মন সবল ও সহিষ্ণু হইতে পারে’, ‘দেশহিতৈষী সামাজিকগণের নিকট মহিলাগণের এই প্রার্থনা’…

 

নয়.

তাই, এদেশের থিয়েটারের ইতিহাসে নারীর অবস্থান নিয়ে চিন্তার আগে, প্রয়োজন হয়ে পড়ে সমাজে নারীর স্থান ও তাঁর অবস্থান নিয়ে গভীরভাবে ভাবার। কারণ, এদেশের সামাজিক গঠনে নারীর বৌদ্ধিক বিকাশ বা অধিকারচেতনার যে ধারা, তা এমন ছিল না যে তাঁরা সক্রিয়ভাবে কোনও আন্দোলনের কথা ভাবতে পারেন। ফলে, যখন পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে নারীরা অধিকারের দাবিতে সরব, প্রতিবাদী, তখন ভারতীয় সমাজে নারীদের পক্ষে সেই ধরনের সমষ্টিগত প্রতিবাদ সম্ভব হয়নি। কারণ, অধিকাংশ নারী নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতনই ছিলেন না।

এই পরিস্থিতিতে কিছু প্রগতিশীল, শিক্ষিত, কুসংস্কারমুক্ত পুরুষই নারীর সামাজিক অবস্থান ও অধিকার নিয়ে ভাবতে শুরু করেন এবং সমাজ-সংস্কারের ভার কাঁধে তুলে নেন। যদিও তাঁদের সংখ্যা তুলনায় কম ছিল, তবু তাঁদের উদ্যোগে সমাজে পরিবর্তনের বীজ রোপিত হয়।

ইতিহাসের নিরিখে দেখলে বোঝা যায়, ইউরোপের— বিশেষ করে ইংল্যান্ডের— নারীরা তাঁদের অধিকারের প্রশ্নে নিজেরাই সংগঠিতভাবে প্রতিবাদে অংশ নেন। নারী-শিক্ষা ও আর্থিক সামর্থ্য ছিল এই প্রতিবাদের দুই ভিত্তি। তাত্ত্বিকদের মতে, শিক্ষার মাধ্যমে যুক্তিবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিসর প্রসারিত হয়, যা একজন নারীকে আর্থিকভাবে সাবলম্বী ও সচেতন নাগরিকে পরিণত করে। তখনই তাঁর পক্ষে সমাজের সঙ্গে আন্দোলন করা সহজ হয়।

এই প্রেক্ষিতেই বোঝা যায়, থিয়েটার বা নাটকের বিষয়বস্তু, ভাষা, কাঠামো সমাজ থেকে উপাদান গ্রহণ করে। ভারতীয় সমাজও তার ব্যতিক্রম নয়। এবং, এই সমাজের নারীদের কলমে উঠে আসে প্রতিবাদ। যদিও তা যৌথ প্রয়াস ছিল না, বরং একা একা— নারীরা তাঁদের লেখা প্রবন্ধে সমাজে নারীর বৈষম্য ও দুর্দশার কথা প্রকাশ করেছেন।

বেশিরভাগ নারীপ্রণীত প্রবন্ধেই উঠে এসেছে সমাজে নারীদের প্রতি দুর্ব্যবহার ও নিপীড়নের চিত্র। ফলে, অনেক সময় এই ধরনের প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও, কিছু লেখা প্রকাশের সুযোগই পায়নি। অর্থাৎ, নারীর ভাবনা এবং তাঁর কলম— দুটোই সমাজ রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। এই বাস্তবতায় থিয়েটারে নারীদের অবস্থান কতটা, তা-ও সমাজের মনোভাবের উপরই নির্ভর করে। এই বিষয়টি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার আশ্রয় না নিয়েও, অভিনেত্রীদের লেখা আত্মজীবনী ও প্রবন্ধ পর্যবেক্ষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নাট্যজগতের আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ তুলে ধরার আগে, আমাদের স্বদেশে সমাজের মূল স্রোতের নারী ও সমাজ-বহিষ্কৃত নটীদের অবস্থান, তাঁদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা জরুরি। কারণ, তাঁদের অবস্থানগত বাস্তবতা থেকেই বোঝা যায়, তাঁরা ঠিক কোন পরিস্থিতিতে সমাজের মধ্যে বা প্রান্তে অবস্থান করেছেন, এবং তাঁদের কতটা নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা জন্মেছিল।

এই বিষয়টি পাঠ-প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত আলোচনায় দেখা যায়, সমাজের সাধারণ নারীদের জীবনের অভিজ্ঞতা জানার আগ্রহ ক্রমশ বেড়েছে। এই তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকেই স্পষ্ট হয়, নারীপ্রণীত প্রতিবাদ-লেখা কেবল আত্মপ্রকাশ নয়, বরং সমাজের প্রতিচ্ছবি এবং প্রতিরোধের ভাষা হয়ে উঠছে।

উনিশ শতকের অভিমুখ ছিল সংস্কার আন্দোলনের। সেই সময়কার সমাজবাস্তবতার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রবন্ধের শিরোনাম নিচে তুলে ধরা হল—

  • ভারতবর্ষীয় রমণীগণের দুরবস্থা মোচনের উপায় কী?’ – বামাসুন্দরী
  • বঙ্গদেশীয় মহিলাগণের স্বাধীনতার বিষয়’ – বোয়ালিয়ার এক ভদ্রমহিলা
  • জ্ঞান ও ধর্মে স্ত্রী-পুরুষের সমান অধিকার’ – মধুমতী গঙ্গোপাধ্যায়
  • পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব’ – স্বর্ণকুমারী দেবী
  • স্ত্রীলোক ও পুরুষ’ – কৃষ্ণভাবিনী দাস
  • অলংকার না Badge of Slavery’ – রোকেয়া শেখাওয়াত হোসেন
  • স্ত্রীলোকের অধিকার’ – শান্তা দেবী
  • হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা (জাতিভেদ)’ – কৈলাসবাসিনী দেবী
  • বঙ্গদেশীয় লোকেদের কী কী বিষয়ে কুসংস্কার আছে?’ – শ্রীমতী সারদা
  • সমাজ সংস্কার ও কুসংস্কার’ – জ্ঞানদানন্দিনী দেবী
  • কন্যাদায়’ – শরৎকুমারী চৌধুরানী
  • প্রয়োজনীয় প্রার্থনা’ – নগেন্দ্রবালা মুস্তোফী
  • মহিলার পরিচ্ছদ’ – হেমন্তকুমারী চৌধুরী
  • হিন্দু গৃহে বধূ-যন্ত্রণা’ – জ. সান্যাল
  • সঙ্গীতবাদ্য স্ত্রীলোকের পক্ষে আবশ্যক’ – নগেন্দ্রবালা মুস্তোফী
  • দেশ-কাল-জাতি-চেতনা: বিগত শতাব্দীতে ভারত রমণীদের অবস্থা’ – মানকুমারী বসু
  • স্ত্রীর স্বামী কী পদার্থ’ – লক্ষ্মীমণি দেবী

প্রাবন্ধিকদের সূত্রে জানা যায় যে, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের অনেক আগেই সমাজে কিছু নারী তাঁদের লেখায় অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেছিলেন। এই প্রসঙ্গে রাজা রামমোহন রায়ের অবদানও উল্লেখযোগ্য। যদিও তিনি নারীদের ‘অল্পবুদ্ধি’ নিয়ে তর্ক জুড়েছিলেন। আসলে, সমাজের যিনি শিক্ষার সুযোগ পেয়ে এগিয়ে, তিনি শুভচিন্তক হলে, সমাজের সব অংশের জন্যেই কাজ করে থাকেন। তাঁর ১৮১৮ সালের গ্রন্থ সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক-নিবর্তকের সম্বাদ-এ তিনি সতীপ্রথার বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন।

 

দশ.

এই প্রেক্ষিতে উনিশ শতক নারীর ইতিহাসে এক জরুরি সময় হয়ে ওঠে। জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে মন্তব্য করা হয়েছিল যে, শাস্ত্রের শাসন বিশেষভাবে স্ত্রীলোক ও শূদ্র সম্প্রদায়ের ওপরই কঠোর। এই সময়ের এক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক কৃষ্ণভাবিনী দাস তাঁর লেখার শুরুতেই আমেরিকার নারীদের উচ্চশিক্ষা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে দেখিয়েছেন, কিভাবে ‘নারীর বুদ্ধি সীমিত’— এই ধারণা আদতে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার নির্মাণ। ৫ আউন্স কম মস্তিষ্ক নারীর বুদ্ধি নির্ধারণের মাপকাঠি হতে পারে না— এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই তিনি নারীর শারীরিক গঠনের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে খণ্ডন করেছেন।

কৃষ্ণভাবিনী দাস

তাঁর দীর্ঘ প্রবন্ধে আমেরিকার নারীশিক্ষা ব্যবস্থা, স্কুলগুলির পাঠক্রম, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের লিঙ্গভিত্তিক সংখ্যা, এবং নারী অধ্যাপকদের অংশগ্রহণের বিষয়টি গুরুত্বসহ তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ইংল্যান্ডের এক হাজার উচ্চশ্রেণির স্কুলে নারী অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর ভর্তি, ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রীদের সংখ্যা— সবই তিনি তথ্যভিত্তিকভাবে উপস্থাপন করেছেন।

এই বিশ্লেষণের পরবর্তী অংশে তিনি নারীর উপার্জনের প্রসঙ্গও এনেছেন— যেমন আমেরিকার নারী ডাক্তার, আইনজীবী ও ইংল্যান্ডের লেখিকাদের আয় ও সামাজিক অবস্থান। সব মিলিয়ে প্রবন্ধটি উনিশ শতকের বাঙালি সমাজে নারীশিক্ষা ও আত্মনির্ভরতার প্রশ্নে এক দৃষ্টান্তমূলক কাজ হয়ে ওঠে।

নারীর অবস্থান নির্ধারণের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক প্রাবন্ধিক জগদীশ্বরী দেবীর লেখায় উঠে আসে— নারীর জুতো পরার অধিকার। তৎকালীন সমাজে নারীদের প্রকাশ্যে জুতো পরার অধিকার ছিল না। এই সামাজিক সংকোচ ও নিয়ন্ত্রণের দিকটি তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তাঁর লেখায় জানা যায়, জুতোর শুদ্ধ সংস্কৃত নাম ‘উপানদ’। শিক্ষার অর্থ যে কেবল বই পড়া নয়, বরং চোখে দেখে চিনতে শেখাও তার অংশ— এই বক্তব্য থেকেই তাঁর বিষয় নির্বাচন। এটি নারীর দৈনন্দিন জীবনে সমাজ কর্তৃক আরোপিত সীমাবদ্ধতার এক প্রতীকী বিশ্লেষণ।

একুশ শতকের এক গবেষকের কাছে বিস্ময়কর ঠেকে, যে জাতি মেয়েদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মারে, সেই জাতিই আবার মেয়েদের জুতো পরা নিয়ে অনুশাসন জারি করে। যেন নারীর জীবনে কোনওরকম সুবিধার সুযোগ না থাকে।

প্রাবন্ধিক নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন। পুজোয় দেবীকে দানসামগ্রীর সঙ্গে জুতো দিতে দেখে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে— দেবী তো স্ত্রীলোক, তিনিও একজন নারী, তবে দেবী জুতো পরতে পারলে, তিনি বা অন্যান্য নারী কেন নয়? লেখিকার বিদ্যাবত্তা নিয়ে বিচার না করেও বলা যায়, তাঁর ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং বিশ্লেষণের ক্ষমতা। অর্থাৎ, রামমোহন রায়ের কথা আবারও ভুল হল— মেয়েরা বুদ্ধির নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ। মেয়েটি আবারও, পুরীর মন্দিরের গায়ের খোদাই করা স্ত্রী-মূর্তিগুলি দেখে লেখিকার মনে প্রশ্ন জাগে। তিনি সঙ্গের পুরুষকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। পুরুষটি বলেন, সত্যযুগে জুতো পরার চল ছিল, কিন্তু কলিযুগে তা নিষিদ্ধ হয়। প্রাবন্ধিক একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন, যার ভাষ্য অনুসারে সংশ্লিষ্ট মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ৫৮৮ শতকে (সম্ভবত ‘শকাব্দে’ বোঝাতে চাওয়া হয়েছে)।

অর্থাৎ সময়ের বিচারে উনিশ শতক থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কতটা পিছিয়ে— ১৩১২ বছরের ব্যবধান! একুশ শতকের একজন গবেষকের কাছে প্রশ্ন উঠতেই পারে— সমাজে নারীর জুতো পরার নিয়ম ছিল না কেন? কিন্তু এর কোনও সুস্পষ্ট উত্তর মেলেনি, না সমাজের শাসনকর্তাদের কাছে, না পরিবারের নিয়ন্ত্রকদের কাছে। প্রাবন্ধিক উত্তর পেয়েছিলেন নিজের সঙ্গীর কাছে যে— এই বিষয়ে তর্কের কিছু নেই। চাইলে তিনি নিজে জুতো পরতে পারেন, তাঁর সঙ্গীর তাতে আপত্তি নেই। তা থেকেই স্পষ্ট হয়, নারী জুতো পরতে পারবেন কি না, তা নির্ভর করে পুরুষের অনুমতির উপর, যুক্তির উপর নয়।

পরে, কার্শিয়াং বেড়াতে গিয়ে প্রাবন্ধিক তাঁর সঙ্গীর কাছ থেকে জুতো উপহার পান। তবে, তা শুধুই পাহাড়ে পরার জন্য। শহরে ফিরে সেটি পরা মানে জাতিচ্যুত হওয়ার ভয়।

এই ঘটনার সূত্র ধরে প্রাবন্ধিক আরও পেছনে গিয়ে গবেষণা করেছেন ভারতীয় ইতিহাসে নারীর জুতো পরিধানের উল্লেখ কতটা পুরনো। তপস্বিনী থেকে রাজার মহিষী সকলেরই জুতো সংক্রান্ত বিবরণ খুঁজে পান এবং তা প্রবন্ধে সূত্র-সহ উল্লেখ করেন।

নারীর অধিকার নিরূপণের প্রেক্ষিতে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ভারত মহিলা পত্রিকা-য়, চৈত্র ১৩১৬ বঙ্গাব্দে। ১১৩ বছর আগের ঘটনা।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে নারীর জুতো ছাড়া চলার কথা ভাবা যেমন বিস্ময়কর, তেমনি এই প্রাবন্ধিকের বিশ্লেষণ ও আত্মসাহসিকতার প্রশংসা না করে পারা যায় না। নিজের জীবনের এমন একটি অভিজ্ঞতা, যা তাঁর পরিবার ও জীবনসঙ্গীর দৃষ্টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে, তা তিনি অকপটে বর্ণনা করেছেন।

রাসসুন্দরী দেবীর আমার কথা থেকে একটি লাইন এখানে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। একজন গৃহবধূর সারাদিনের কাজ শেষ হওয়ার পরে, সামান্য যে সময়টুকু হাতে থাকত, সেই সময়টিও তাঁকে— লেখকের ভাষায়— ‘অতিশয় নম্রভাবে দণ্ডায়মান’ থেকে অপেক্ষা করতে হত। এই আত্মজীবনীতে তিনি মেয়েদের লেখাপড়া না শেখা, বৌদের বুক পর্যন্ত ঘোমটা, মায়ের মৃত্যুকালে শেষবার দেখতে না পাওয়ার বেদনা, জন্মকে ধিক্কার জানানো, পিঞ্জরাবদ্ধ বিহঙ্গী প্রভৃতি শব্দ লিখে তাঁর আত্মজীবনীতে ভবিষ্যতের জন্য একটি গভীর তর্কের সূত্রপাত করেছেন।

রাসসুন্দরী দেবী

সমাজের স্ত্রীজাতির প্রতি বৈষম্যমূলক মনোভাব বোঝাতে আরেকটি প্রবন্ধের উল্লেখ প্রাসঙ্গিক। প্রবন্ধটি লিখেছেন মনোমোহিনী দাসী, যেখানে তিনি বঙ্গসমাজের রোগনির্ণয়-এর একপেশে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন— “যাঁহাদিগের বেশ্যালয়ে গমনের বিলক্ষণ ইচ্ছা আছে এবং কেবল পীড়ার ভয়ে যান না, তাহাদিগের বিলক্ষণ সুবিধা হইবে।” এবং আরও জিজ্ঞাসা করেছেন— এই আইনটি পক্ষপাতদুষ্ট নয় কি? “কারণ, যাহারা ভালো আছে, তাহাদিগকে দুই রোগাক্রান্ত পুরুষ আসিয়ে নষ্ট করিবে?” তিনি যুক্তি দিয়েছেন, “আইনের নিয়ামক স্থানে যদি স্ত্রীলোক ব্যবস্থাপকদলে থাকতেন, তবে বিশেষ করে স্ত্রীলোকদের দিকটিও দেখতেন।” এই লেখাটি আসলে সমাজের সেই ‘অরক্ষণীয়া’ নারীদের পক্ষেই লেখা, যাঁদের সমাজ ‘মন্দ মেয়ে’, ‘ভ্রষ্টা’ বলে অবহেলা করেছে। মনোমোহিনী দাসীর এই নিবন্ধের ভাষা, যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি সত্যিই বিস্ময় জাগায়। এটি বাংলা ১২৭৫ সনে লেখা হয়েছিল, অর্থাৎ একুশ শতকের ইংরেজি হিসেব ধরলে ১৫৭ বছর আগের ঘটনা।

সোমপ্রকাশ পত্রিকায় প্রকাশিত বামাসুন্দরী দেবীর একটি লেখার প্রেক্ষিতে সম্পাদকমশাইকে একটি নোট দিতে হয়েছিল। কারণ, লেখাটির একটি অংশে তিনি লিখেছিলেন— “আমরা এত পরাধীন যে আশা যাহাকে বলে তাহাও করিয়ে পারি না।” লেখিকার ভাষায় এক ধরনের ব্যতিক্রমী আত্মসচেতনতা দেখা যায়— তিনি তাঁর জন্মদাতার কাছে ‘আশা’, ‘অবলা’ ইত্যাদি শব্দে নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। একটি কবিতার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘অসুখের শেষ চাকরি’, অর্থাৎ পড়া-লেখার মধ্যেও তিনি বিষাদ খুঁজে পান। কারণ, শিক্ষালাভের ফলে তাঁর তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে, যা তাঁকে বোঝায়— নিজেদের অবস্থা পশুর থেকেও হীন।

এই সময়ের অনেক মহিলা প্রাবন্ধিকই নিজেদের অবস্থান পশুর সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারও ভাষায় স্ত্রীজাতিকে বলা হচ্ছে হীন, হতভাগিনী, দুঃখিনী, আবার কারও লেখায় “জীবনব্যাপী যন্ত্রণা” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই বিলাপ বা স্ববিচার শুধু মধ্যবিত্ত গৃহস্থঘরের মহিলাদের নয়— বিনোদিনী দাসীর আত্মজীবনী পড়লেও আমরা দেখি, একই ভাষায় নিজের পরিচয়কে তিনি পাপিষ্ঠা, অধর্মী বলে উল্লেখ করেছেন। দু-ক্ষেত্রেই লিঙ্গভেদ, স্ত্রীজন্ম ও পুরুষপ্রধান সমাজের নিগ্রহ— এই তিনটি উপাদান একত্রে কাজ করেছে।

 

এগারো.

একুশ শতকের থিয়েটার গবেষক ও অভিনেত্রী অধ্যাপক বিষ্ণুপ্রিয়া দত্তর মতেও এই বিষয়টি প্রতিধ্বনিত হয়। তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি নিঃসন্দেহে বোধ ও বুদ্ধির বিকাশ ঘটায়, কিন্তু সেটিই একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। বোধ অনেকাংশেই একটি সহজাত প্রবণতা— যা নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশ পায় বা প্রকাশ পায় না।

এই প্রসঙ্গে তিনি প্রাথমিক উদাহরণ হিসেবে অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসী-কে উল্লেখ করেছেন। তাঁর স্কুলশিক্ষার সুযোগ হয়নি, কিন্তু তবু তিনি নিজস্ব চেতনা ও উপলব্ধিকে অবলম্বন করে থিয়েটারের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। এই বোধ থেকে পরিণতিতে পৌঁছনোর পথ— এই চর্চাই একজন ব্যক্তির সত্তা তৈরি করে। এই সত্তা একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, যার প্রকাশ ঘটে তাঁর নিজস্ব কর্মকাণ্ডে। যেমন বিনোদিনীর ক্ষেত্রে তা অভিনয়ে চরিত্র রূপায়ণের মাধ্যমে এবং নাট্যচর্চায় আত্মনিবেশের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি নাট্যগৃহ নির্মাণের জন্য নিজের জীবন বাবুর হাতে অর্পণ করাও ছিল এই সত্তারই বিস্তার। এই সত্তা যা গাণিতিক পরিমাপের নয়। কোনও সূচক-বীক্ষণ দ্বারাও এর শতাংশ মেপে ফেলা যায় না।

এই যুক্তিতেই নারীবাদ ও নারীবাদী তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে বঙ্গীয় সমাজের তথাকথিত সাধারণ নারীদের মূল্যায়ন জরুরি। যাঁরা সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে, সীমিত শিক্ষালাভের সুযোগ সত্ত্বেও নিজেদের লেখা পত্রিকা অফিসে পাঠিয়েছেন— তাঁদের প্রতিবাদও এক ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান। অতএব, গবেষণাভিত্তিক পাঠে একুশ শতকে দাঁড়িয়ে উনিশ শতকের এই ‘সাধারণ’, বরং বলা উচিত ‘অসাধারণ’ নারীদের ভূমিকাকেই ভারতের নারী আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি। তাঁদের সাহসিকতা ও প্রশ্ন উত্থাপনই ভবিষ্যতের নারীবাদের জন্য মাটি প্রস্তুত করেছে।

বিশ শতকের অন্যতম শিক্ষাব্রতী ও সমাজচিন্তক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী-পুরুষের বিভাজন, নারীজীবনের দুর্দশা ও অধীনতার প্রশ্নে প্রবন্ধগুলি লিখতে গিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ‘আমরা কি দাসী?’ তিনি স্পষ্টভাবেই অবহিত ছিলেন যে পৃথিবী থেকে আইনত দাসব্যবসা উঠে গেছে। অর্থাৎ তিনি সমসাময়িক বিশ্বের— বিশেষত পশ্চিমের— সামাজিক আন্দোলন সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। এই প্রেক্ষিতে তিনি ‘অলংকার না Badge of Slavery’ নামক লেখায় সোনারুপোর গহনার সঙ্গে দাসের লোহার শিকলের তুলনা টেনে নারীর দাসত্বকে চিহ্নিত করেন। তাঁর এই তুলনা নিছক অলংকারের প্রসঙ্গ নয়; বরং তা নারীর আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে এক তীব্র প্রতিবাদ।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

রোকেয়া দেখাতে চেয়েছেন, পুরুষের অধীনে বসবাস করতে করতে নারী নিজ অস্তিত্বকেই ‘দাস’-সুলভ বলে ভাবতে শুরু করেছে। ‘স্বামী’ শব্দটির মধ্যেই তিনি পুরুষ কর্তৃত্ব ও নারী অধীনতার একটি সাংস্কৃতিক গাঁথা দেখতে পান, যা নারী স্বাধীনতার পথে বড় বাধা। এই বিশ্লেষণ শুধু তাঁর সময়েই প্রাসঙ্গিক ছিল না, বরং একুশ শতকের নারীবাদী আলোচনাতেও তা সমান প্রযোজ্য— কারণ আজও নারীর ‘অভ্যন্তরীণ দাসত্ব’ ও সামাজিক শৃঙ্খল সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়নি। তিনি নারীর গৃহশ্রমের স্বীকৃতিহীনতা ও অর্থনৈতিক অসমতার দিকটিও বিশ্লেষণ করেছেন। যেসব শ্রমে নারী ১ টাকা মজুরি পান, সেই একই শ্রমে পুরুষ পান ২ টাকা। এমনকি চাকর ও চাকরানির খোরাকি ভাতার মধ্যেও তিনি তফাৎ দেখান— পুরুষ পায় ৩ টাকা, আর নারী পায় ২ টাকা। এই তুলনার মাধ্যমে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে শ্রেণি ও লিঙ্গের দ্বৈত বৈষম্য নারীর জীবনে প্রভাব ফেলে। এইসব যুক্তি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে রোকেয়া কেবল নারীজীবনের দুঃখবোধ নয়, বরং একটি দর্শন রচনা করেন— যা নারীবাদের প্রসঙ্গে তুলনীয়।

এই প্রসঙ্গে কেউ হয়তো আবারও প্রশ্ন তুলতে পারেন: নারী থিয়েটারে প্রবেশ করছেন, সংগ্রামী হচ্ছেন— এই ঘটনাগুলিই কি নারীবাদের সূচনাতারিখ নির্ধারণ করবে? উত্তর আসতে পারে, তা নয়। বরং এইসব ছোট ছোট ঘটনার পেছনে যে প্রতিবাদী সত্তা সক্রিয় থেকেছে, যে বোধের জন্ম হয়েছে— সেই প্রেক্ষিতেই নারীবাদের পথরেখা নির্মিত হচ্ছে। রোকেয়ার মতো চিন্তকদের লেখনী সেই পথের ভিত্তি রচনা করেছে— সময়ের সীমানা পেরিয়ে আজও যা প্রাসঙ্গিক।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...