এর শেষ কোথায়?

খালিদা খানুম

 


"ঘরে ছেলে পুরে দেব" কিংবা "কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করব"— এই ধরনের কথা যখন দলের নেতাদের মুখে শোনা যায়, তখন ধর্ষণটাই যেন দলের অন্য সদস্যদের কাছে গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই লজ্জাজনক উক্তিগুলোর পরও সাধারণ মানুষ তাঁদের সমর্থন করে, ভোটে জেতায়। যারা এই কথাগুলোকে সমর্থন করে, তারা আমার আপনার মতোই এই দেশের নাগরিক

 

“আরজিকর হাসপাতালের ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিশাল এক জালে জড়িয়ে পড়া একটি মাছির গল্প কেবল।” কথাটা লিখেছিলাম আরজিকর ঘটনার প্রতিবাদের সময়। ল কলেজ আবার সেই মাছিটির কথাই মনে করিয়ে দেয়।

কলেজে যখন প্রথম এলাম, তখন কেবল কলেজই নতুন নয়— মানুষ, রাস্তাঘাট, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপন, পরিপার্শ্ব— সবই ছিল নতুন। হরিহরপাড়ার গ্রাম থেকে বেলগাছিয়ায় এসে ফার্স্ট ইয়ারে পড়া, যেন পুকুর থেকে সমুদ্রে আসার মতোই এক অভিজ্ঞতা। তবু বিশেষ অসুবিধা হয়নি— ভর্তির দিন থেকেই সিনিয়র দাদা-দিদিরা প্রতিটি পদক্ষেপে সাহায্য করেছে। র‍্যাগিং নামক বস্তুটির অস্তিত্ব ছিল না, এমন নয়; তবে সেই ধাপ পেরিয়ে অতি সহজেই স্নেহ-ভালোবাসার সিঁড়িতে উঠে এসেছিলাম। চাকরি পাওয়ার পরেও সেই সম্পর্ক আজও রয়ে গেছে।

কলেজের প্রথম দিন, প্রথম পরিচয়েই অনেকে প্রোপোজ করে ফেলত। মেয়েদের জন্য ‘না’ বলাটাই যেন ছিল দস্তুর— সবাই-ই ‘না’ বলত। সিনিয়র দিদিরা মজা করে জিজ্ঞেস করত, “কি রে, আজ কতজন প্রোপোজ করল?” তখন আমাদের কলেজে মেয়েদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তারপর চলত হাসাহাসি, ইয়ার্কি, মজা।

এসব গল্প শোনাচ্ছি কেন? কারণ আমি সেই পরিস্থিতিটা কল্পনা করার চেষ্টা করছি। আর ভাবছি— যদি ‘না’ বলাটা আমাদের জীবনে ল কলেজের মতো একটা ঘটনার পরিণতিতে নেমে আসত, তাহলে? কলেজ ক্যাম্পাস, ক্যান্টিন, ইউনিয়ন রুম— সবই তো ছিল নিজের বাড়ির মতো। সেখানে একজন ছাত্রীর ধর্ষণ, মানে যেন নিজের বাড়িরই কারও দ্বারা ধর্ষণের মতো এক অভিজ্ঞতা।

 

সুরক্ষার বর্ম কতটা মোটা হওয়া প্রয়োজন একটা মেয়েকে বাঁচাতে গেলে? আর একজন মেয়ে কেনই বা নিজের বাড়িতে, কিংবা বাড়ির মতো জায়গায়, সেই সুরক্ষার বর্ম পরে থাকবে? কেন কেবল ‘নারী নিরাপত্তা’ শব্দটাই প্রচলিত?

বৃষ্টির দিনে সন্ধ্যা সাতটায় বাড়ি ফেরাটা আতঙ্কের হবেই বা কেন? বাড়ি, স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র, রাস্তাঘাট— কোনও জায়গাতেই মেয়েরা মানসিক বা শারীরিকভাবে সুরক্ষিত নয়। এর দায় কার?

ল কলেজের অভিযুক্ত ছেলেটি একজন প্রাক্তন ছাত্র এবং অস্থায়ী কর্মী। না বললেও বোঝা যায়— এই ‘অস্থায়ী কর্মী’র ট্যাগটা দাদাগিরি করেই পাওয়া, আর সেটা মূলত দাদাগিরি করার সুবিধার জন্যই তাকে পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। কলেজে যারা পড়ে, তাদের লেজ বাঁধা থাকে কলেজ প্রশাসনের হাতে। কিন্তু যারা পড়ে না, তাদের বাঁধার সুযোগ থাকে না। ফলে, নির্দিষ্ট কোনও পার্টির (সে যে রঙেরই হোক না কেন) হয়ে দাদাগিরি করাটা কেউ কেউ যেন জন্মগত অধিকার বলেই ধরে নেয়।

এই অধিকারবোধ থেকেই জন্ম নেয় এক তীব্র আগ্রাসী মনোভাব— যেখানে প্রত্যাখ্যান সহ্য করার ক্ষমতাটুকুও থাকে না। ‘হয় আমার হবে, না হয় কারও হবে না’— এই মানসিকতা থেকে জন্ম নেয় প্রেমে প্রত্যাখ্যানের মতো একেবারে সাধারণ ঘটনাকে ঘিরে ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি কিংবা অ্যাসিড হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনাগুলো।

কেন এই মনোভাব? এর কারণ কি শুধু ক্ষমতার দম্ভ? না, এর শিকড় আরও গভীরে প্রোথিত।

যখন কোনও ছেলের জন্ম হয়, বাড়িতে খুশির বন্যা বয়ে যায়। সেখান থেকেই শুরু হয় এই বিকৃত মানসিকতার বীজবপন। ভুল বললাম— এরও আগে থেকে, যখন ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’ বলা হয়, বা ছেলের আশায় দোয়া-তাবিজ ধারণ করা হয়, তখনই যেন জন্মের আগেই এক ছেলেকে জিতিয়ে দেওয়া হয়। জন্মের পর সংসারের সবচেয়ে ‘ভালো’ জিনিসটাই তার জন্য তোলা থাকে। এখান থেকেই গড়ে ওঠে আগ্রাসী মানসিকতা— ‘আমি যা চাই, তা আমাকে পেতেই হবে।’

মানুষের জীবনে প্রত্যাখ্যান বা রিজেকশন সুস্থভাবে মেনে নেওয়ার জন্য যে চারিত্রিক দৃঢ়তা থাকা দরকার, সেটা তৈরি হওয়ার সুযোগই পায় না।

ধর্ষণ, অ্যাসিড হামলা, শ্লীলতাহানি— এইসব ঘটনাগুলো নিয়ে যেন আমরা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। সবার মধ্যে একটা গা-ছাড়া ভাব— যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। যাঁরা সত্যিকারের ‘মানুষ’, তাঁরা ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে যাচ্ছেন। মোমবাতি মিছিল, রাত জাগরণ, প্রতিবাদ— এই সব পেরিয়ে আসা খুব বেশিদিন হয়নি; তবু সেই কেসই চলে গেছে অন্য এক পথে। সরকার নির্লজ্জের মতো বলেছে, “উৎসবে মেতে উঠুন।”

প্রশ্ন তো ওঠেই— কীসের উৎসব? ফিতে কাটা থেকে কার্নিভাল— সব যেন এক অবিবেচিত ঢাকঢোল।

 

আবারও একই ঘটনা। এর শেষ কোথায়? আদৌ কি কোনও শেষ আছে?

“ঘরে ছেলে পুরে দেব” কিংবা “কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করব”— এই ধরনের কথা যখন দলের নেতাদের মুখে শোনা যায়, তখন ধর্ষণটাই যেন দলের অন্য সদস্যদের কাছে গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

এই লজ্জাজনক উক্তিগুলোর পরও সাধারণ মানুষ তাঁদের সমর্থন করে, ভোটে জেতায়। যারা এই কথাগুলোকে সমর্থন করে, তারা আমার আপনার মতোই এই দেশের নাগরিক।

মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে— এই দেশ কি ধর্ষকের দেশ হয়ে গেল?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...