আরজিকরের এক বছর: মেয়েদের রাখা দাবিগুলোর কী হল?

সায়নী ব্যানার্জি

 


কলেজ-ক্যাম্পাসে দাদাগিরি, নাগরিকত্বের পরীক্ষা, দেশে দেশে যুদ্ধ কিংবা বিশ্ব উষ্ণায়ন— সবচেয়ে বেশি বিপন্নতার তালিকার শুরুতেই থাকে মেয়েদের নাম। আমরা ভুলে যাই না, এ-দেশে আমার চেয়েও অনেক বেশি বিপন্ন এক দলিত মেয়ে, কোনও লিঙ্গনির্মাণের ধারায় নিজেকে না রাখা ক্যুয়ার মানুষরা, অন্যের বাড়িতে কাজ করা, রাস্তা দিয়ে ঘরে ফেরা মেয়েটা— যার ঘরে হয়তো একটা আলোও নেই। পিতৃতন্ত্রের শিকল ছিঁড়ে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসা আমাদের সকলের অবশ্যকর্তব্য, কিন্তু কঠিন। তার চেয়েও কঠিন আজাদি বা স্বাধীনতার পথ নির্মাণ। সেই নির্মাণের দায়িত্ব এই সময় আমাদের কাঁধে তুলে দিয়েছে

 

ঐতিহাসিকভাবেই মানুষ যা কিছু তেমন ভালো বুঝতে পারেনি, তাকেই বলেছে ‘অদ্ভুত’। প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানচর্চা থেকে সমাজবিজ্ঞান— সবার ক্ষেত্রেই এ-কথা সত্যি। জানা নেই, আরজিকর আন্দোলন থেকে আমাদের প্রত্যাশা ও আমাদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিও কি তাহলে তেমনই এক আঁধারে ঢাকা— যে তার আলোচনার নাম রাখা হল অদ্ভুত আঁধার’।

যদি তাই হয়, তবে এই আঁধারকে চেনার চেষ্টা করা এই সময়ের আশু কর্তব্য। অন্ধকার নামা সময়কে প্রথমে ভালো করে চিনেছিলেন আমাদের পূর্বসূরিরাই। সেই কারণেই তাঁরা আলোর পথ নির্মাণে আগ্রহী হয়েছিলেন— কিছু ক্ষেত্রে সফলও। রোকেয়া, কোলোন্তাই, সুকুমারী ভট্টাচার্য, হয়তো ফ্রিডাও— এই গুটিকয়েক নাম ছাড়াও চারিপাশে থাকা মানুষজন, বন্ধু-স্বজনেরাও যে আলোয় আলোকিত করেছেন আমাদের, সেই আলোতেই তাই চিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি এই আঁধারকে। নিজের জন্য, সকলের জন্য— যাতে গড়ে তুলতে পারি নির্মল আলোয় আলোকিত পথঘাট, মনের মতো ঘর, কাজ আর নিবিড় সম্পর্ক।

তৃণমূল সরকারের আমলে হওয়া যে-সব ধর্ষণের ঘটনা সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ কয়েক দিন বা কয়েক মাসের জন্য আলোড়ন তুলেছিল, সে-রকম কিছু ঘটনা দিয়েই শুরু করা যায় আঁধারমুখী এ-যাত্রা। মনে পড়ে না, পার্কস্ট্রিটের ‘ছোট/সাজানো ঘটনা’ নিয়ে আমাদের মতো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের তেমন কোনও আবেগ ছিল বলে। যে মেয়ে ডিভোর্সি, সিঙ্গল মাদার, রাত্রে ছোট পোশাক পরে একা বেরোয়, পার্টি করে— তার আবার ধর্ষণ! সেই ঘটনাকে আজ মনে হয় সাহসিকতার প্রতীক— “আমি একজন মানুষ… আমি সুজেট জর্ডন, পার্কস্ট্রিটের রেপ ভিকটিম নই।”

 

এরপর অবধারিতভাবেই, মনে পড়ল কামদুনিকে। ঘটনার নৃশংসতা, শাসক দলের অসংবেদনশীলতা, আর গুটিকয়েক সাহসী মেয়ের প্রতিরোধের জন্যই। মনে পড়ে হাঁসখালিকে— ধর্ষিত হয়ে মারা যাওয়ার পরে একটি ১৪ বছরের নাবালিকা মেয়ে সম্পর্কে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী, যিনি ঘটনাচক্রে তখন দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীও ছিলেন, তাঁর সেই মন্তব্যে— “মেয়েটা প্রেগনেন্ট ছিল, … লাভ অ্যাফেয়ারস তো ছিলই।” ঝাঁটা-লাঠি হাতে গ্রামের মেয়েদের প্রতিরোধ মনে পড়ে সন্দেশখালির কথা ভাবলে।

এইসব দেখে-শুনে আমরা রেগে গিয়েছি, অসহায় বোধ করেছি। ফাঁকা রাস্তা, ফাঁকা বাস— কোনও-কোনও দিন এড়িয়ে এড়িয়ে চলেছি। তবে ‘যা হবে দেখা যাবে’ ভেবে বেশিরভাগ দিনই আবার বুক ফুলিয়ে একলা একলা হেঁটেছি কত দূরের রাস্তায়, অন্য শহরে, অন্য দেশেও।

এরপর আসে, ৯ আগস্ট ২০২৪। প্রত্যেক ষোলো মিনিটে একজন ধর্ষিতার দেশে, খাতায় নাম উঠল অভয়ার। “কী করছিল মেয়েটা রাতে?”— এই প্রশ্ন সম্ভবত তৎক্ষণাৎই প্রিন্সিপাল করেন, কারণ অপ্রিয় সত্য ঢাকার ‘দায়ভার’ ছিল তাঁর।

তবে এবার আর সাধারণ মানুষ এমন প্রশ্ন তোলেনি, গণপরিসরে আগের ঘটনার মতো তুলনীয় কোনও ‘ভিকটিম ব্লেমিং’-ও দেখা যায়নি। পেশা-পরিচয়টি ডাক্তার— প্রাণ বাঁচানো যার কাজ— হয়তো সেই কারণেই। টানা ৩৬ ঘণ্টার ডিউটির পর ডাক্তার মেয়ে রাতে সেমিনার রুমে বিশ্রাম নিতে পারে। এরপর, শোকে পাথর মা যখন বললেন, “মেয়ে কলেজে গিয়ে ফোন করে জানাত, এই পৌঁছে গেছি, আমরা নিশ্চিন্ত হতাম,” তখন আমাদের, যাদের কাছে শিক্ষাক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র সুরক্ষিত থেকেছে জীবনভর, একই কথা যারা বলেছি, শুনেছি, তাদের— তাদের মায়েদের সেদিন বুক কেঁপে উঠেছিল।

সেই সময়েই, সোশাল মিডিয়া ভরে যাচ্ছিল, মূলত বিভিন্ন জায়গায় পাঠরত ডাক্তার মেয়েদের দৈনন্দিন জীবনের শ্রম ও কর্মক্ষেত্রে চরম নিরাপত্তাহীনতার নানা ঘটনার বিবরণীতে। সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছিল ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’ নামক এক শ্রেণির প্রতি আপামর মানুষের ঘৃণা। মনে পড়ে, অসংবেদনশীলতা চরমে পৌঁছেছিল ঘটনাটা কীভাবে ঘটেছিল, তা নিয়ে চারপাশের আলোচনায়।

কলকাতার প্রায় প্রাণকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাকে ঘিরে বহুমুখী চর্চায় আমরা ভয় পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল— এত উজ্জ্বল জীবনের এমন পরিণতি কেন? এই একই পরিণতি কি তবে আমাদেরও?

এমন সময়েই আমাদের জগদ্বিখ্যাত মুখ্যমন্ত্রীর মুখে সেই ‘আশ্বাসবাণী’ এসেছিল— “মেয়েদের রাত্রে ডিউটি বন্ধ করে দেওয়া হোক।” সম্ভবত এরই প্রতিক্রিয়ায় ১৪ আগস্টের দিন ডাক এসেছিল মেয়েদের ‘রাত দখল’-এর ডাক। বছরের পর বছর, প্রেম-ভালোবাসা-সংবেদনশীলতা-রহিত, বলপূর্বক যৌন সঙ্গমে অভ্যস্ত হতে হতে, ঘা হয়ে যাওয়া যোনিপ্রদেশ নিয়ে হাজার হাজার মেয়েকে যে সমাজে বাঁচতে হয়, কেবলমাত্র স্বাবলম্বী হওয়ার অপরাধেই যেখানে মেয়েকে খুন হয়ে যেতে হয় বাবার হাতে, যে সমাজে মেয়েকে অচেনা পথযাত্রীর বিকৃত যৌন কামনার নিদর্শনের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকতে হয়, সেই পচা-গলা সমাজে প্রতীকী হলেও একদিনের মেয়েদের রাত দখল-এর ডাক দেওয়া, সত্তরের দশকে লন্ডনের প্রথম সেই ডাকের মতোই এক বৈপ্লবিক ঘটনা।

সেদিন মশাল বা মোমবাতি হাতে, সারা পশ্চিমবঙ্গের অন্তত দেড়শোটি জায়গায়, ভারতের কিছু রাজ্যে, এমনকি বিশ্বের নানা প্রান্তেও— এ-দেশের স্বাধীনতা দিবসের রাতে— এত মেয়ের পথে নামা, চিৎকার, আসলে এই সমাজকে জানিয়ে বলতে চেয়েছিল— এই লড়াই কেবল অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি বা একটু-আধটু সুবিধা আদায়ের লড়াই নয়— এই লড়াই স্বাধীনতার লড়াই। আমরা শাসক দলের মিছিলের মতো “ধর্ষকের ফাঁসি চাই”— এমন অসংবেদনশীল স্লোগান দিইনি, বরং বহু সাধারণ মেয়ে সেদিন জীবনে প্রথমবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে পেরেছিল—

“স্বাধীনতার মানে কী? একলা মেয়ের আজাদি!”

১৪ অগস্টের সেই রাতের পরেও, ধারাবাহিকভাবে, মেয়েদের দাবিকে সামনে রেখে পশ্চিমবঙ্গ দিকে দিকে মিছিল-মুখর থেকেছিল। বিভিন্ন মিছিল, পথসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মানববন্ধন— এই সব ধারাবাহিক কর্মসূচিতে মানুষের কথায় প্রকাশ পেয়েছিল ক্ষোভ, হতাশা, একই সঙ্গে পথে নামতে পারার, জোট বাঁধতে পারার, বহুদিনের জমিয়ে রাখা কথা চিৎকার করে বলতে পারার সাহস। বহুদিনের সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠে, অতীতের যৌন হেনস্থার অভিজ্ঞতা কিংবা তার পরবর্তী বিপন্নতা ভাগ করে নিচ্ছে কোনও মেয়ে— আমাদের ব্যক্তিগত পরিসরে এমন ঘটনাও ঘটেছে।

এই সময়ের নানা কর্মসূচিতে বিশেষভাবে এগিয়ে আসতে পেরেছিলেন ট্রান্স-ক্যুয়ার মানুষেরা, তাঁদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত হয়ে চলা যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে কথা বলবারও মাধ্যম হয়ে উঠছিল প্রাথমিক পর্যায়ের আন্দোলন।

 

এবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা-অনুভবের জায়গায় ফিরি।

৯ আগস্টের যে-রাতে সে ঘটনা ঘটল, তখন সবে কলকাতা ছেড়েছি। ১৪ আগস্টের ‘রাত দখল’-এর ঘোষণা যখন প্রথমবার সোশাল মিডিয়ায় দেখলাম, এমন অস্থির সময়ে কলকাতা থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে ভেবে মন খারাপ হয়েছিল। কল্যাণীতে এসে নতুন কাজে যোগ দেওয়ার তখনও ১৫ দিন হয়নি, থাকতে শুরু করার সবে হয়তো সপ্তাহখানেক। কিন্তু সেদিন থেকেই এখানকার মানুষের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া আর কলকাতার বন্ধুদের কাছ থেকে আরজিকর আন্দোলনে তাঁদের জুড়ে থাকার নানা ভালো-খারাপ অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল, ভাগ্যিস শুধু কলকাতায় বসেই এই আন্দোলন দেখতে হয়নি আমাকে।

আরজিকরকে ঘিরে সাধারণ মানুষের যে প্রতিক্রিয়া, তা আগের এইপ্রকার ঘটনার তুলনায় স্বতন্ত্র ছিল, ছিল বেশি জোরালোও। শাসক দলের যা কিছু কাজে মানুষের গত কয়েক বছরের ক্ষোভ-বিরক্তি, সে-সবেরই প্রতিফলন দেখতে পেয়েছিলাম এই আন্দোলনে। মূলত কলকাতা, তবে অন্যান্য জেলাতেও— এমনকি উত্তরবঙ্গেও— বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের পড়ুয়া এবং কর্মরত চিকিৎসকেরা সেইসময়ে সোচ্চার স্বরে বলতে পেরেছিলেন স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা। খবরের কাগজ খুললেই সেই সময়ে চোখে পড়ত জাল ওষুধ, জাল ইঞ্জেকশন-চক্রের ভয়াবহ সব বিবরণ।

আবার এ-কথাও সত্যি, মেয়েদের দাবিগুলো এই সময়েই ক্রমশ পিছনে চলে গিয়ে, আরজিকর আন্দোলন ধীরে ধীরে মেয়েদের আন্দোলন থেকে পরিণত হয় ডাক্তারদের আন্দোলনে। তবে সেই সময়েও ডাক্তারদের প্রতি সম্পূর্ণ সংহতি জানিয়েছিল নারীবাদী সংগঠনগুলি। ডাক্তারদের অনশনমঞ্চে আমরা নিয়মিত দেখতে পেয়েছি লিঙ্গ-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের। নানা দিক থেকে আসা হেনস্থা, মিথ্যাচার, এবং পুজোর উদযাপন-কার্নিভালের মধ্যেই প্রবল যন্ত্রণাদায়ক অনশন সহ্য করতে করতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ডাক্তারদের বেশিরভাগ দাবিই কিন্তু রাজ্য সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়।

কিন্তু, এ-প্রশ্ন আমরা কেউ ভুলব না— মেয়েদের রাখা দাবিগুলোর কী হল?

২০১২ সালের নির্ভয়া-কাণ্ডের পর সারা ভারতজুড়ে যে ঝড় উঠেছিল, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল মানুষের মনে, বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিসরে, এবং সর্বোপরি এ-দেশের আইনব্যবস্থায়। ২০১৩ সালের বিচারপতি জেএস ভার্মা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে নানা পরিবর্তন আসে— স্টকিং, ভয়্যারিজম, যৌন হেনস্থা, অ্যাসিড হামলাকে ক্রিমিনাল ল (অ্যামেন্ডমেন্ট) ২০১৩-র মধ্যে যুক্ত করা, দেশজুড়ে ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট, ওয়ান-স্টপ সেন্টার চালু করা, এবং কেবলমাত্র পুরুষ লিঙ্গ নয়, যে-কোনও অঙ্গের বলপূর্বক অনুপ্রবেশকেই ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা, ইত্যাদি।

এই সূত্র ধরেই, হয়তো, আরজিকর আন্দোলনের পক্ষ থেকেও নারীবাদী সংগঠনগুলির কাছ থেকে কিছু সুস্পষ্ট দাবি সরকারের কাছে রাখা হয়েছিল। যেমন— অভয়ার সুবিচারের সঙ্গে সঙ্গে, আগের সমস্ত ধর্ষণের যথাযথ তদন্ত, ভিকটিম ব্লেমিংকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, সমস্ত কর্মক্ষেত্রে আইসিসি-কে সক্রিয় করা এবং আজও ওয়ান স্টপ সেন্টার কেন বাস্তবায়িত হয়নি, সেই দাবি তোলা। এই দাবিগুলি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়সাপেক্ষে যথেষ্ট উপযুক্ত হলেও, আমরা এগুলিকে সর্বসাধারণের দাবি করে তুলতে পারিনি। সামগ্রিকভাবেই, এই সময়ের চরিত্রই বিচ্ছিন্নতা; পুঁজিবাদ যাকে পণ্যও করেছে। বিচ্ছিন্নভাবে নিজেকে বড় করতে করতে, তত্ত্ব পড়তে পড়তে জগৎকে চিনতে গিয়ে মানুষের থেকে দূরে সরে যাওয়া— এসবই এই সময়ের আন্দোলনকে দুর্বল করেছে।

তবে কেবল সাংগঠনিক দুর্বলতাই নয়, এই সিস্টেম এবং তার থেকে উঠে আসা সিংহভাগ দর্শন, আদর্শ, রুচি, শিল্প— সবই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে কায়েম রাখার পক্ষেই অনড়। তাই শুধুই লিঙ্গ-রাজনীতির প্রশ্ন তোলাকে আজও তেমন রাজনৈতিক চোখে দেখা হয় না। কেবল এই প্রশ্নেই গণআন্দোলন চালিয়ে যাওয়া তাই এক দুরূহ কাজ বলেই মনে হয়।

সেই সময়ে বারবার রাস্তায় নেমে আমরা বুঝছিলাম— আসলে আমাদের যা দাবি, তাকে সরকার এবং তারও আগে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার লড়াইও দীর্ঘ। এই লড়াই আমাদের পূর্বসূরিরা লড়েছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ-দেশে, এবং প্রায় গোটা বিশ্বেই, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রাধান্যে সেই ইতিহাস আর বর্তমানের লিঙ্গ-রাজনীতি, দুইই গভীর সংকটে।

এই রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও, স্বাধীনতা নয়, বরং ঘেরাটোপে রেখেই মেয়েদের রক্ষক হয়ে ওঠার হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা নিয়েই এই আন্দোলনে থেকেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মূলধারার বামদলগুলিকেও রাজনৈতিক ব্যানার ছাড়াই লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথে নামাতে হয়েছে, যা আসলে বর্তমান রাজ্য-রাজনীতির পক্ষে নিঃসন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক।

এই মুহূর্তের রাজনৈতিক পরিবেশ এমনই যে, মাত্র কিছুদিন আগেই ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামটি ঘিরে যখন আমাদের চোখে পড়ছিল আসলে দক্ষিণপন্থা বনাম অতি-দক্ষিণপন্থার সংঘাত, সেই সময়ে, দুই প্রতিবেশী দেশের যুদ্ধের নামকরণে পিতৃতন্ত্র ও অসাম্যের প্রতীক (পড়ুন, সিঁদুর) কেন ব্যবহার করা হবে, সে-কথা জনসমক্ষে বলবার আমরাও করে উঠতে পারিনি।

আরজিকর আন্দোলনের একটি অন্যতম স্লোগান ছিল, ‘শাসক, তোমার কীসের ভয়? ধর্ষক তোমার কে হয়?’ আর এই কয়েকদিন আগেই আমাদের দেখতে হল, শুধু শাসকের পৃষ্ঠপোষক নয়— তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্রদলের অন্যতম মুখের বিরুদ্ধেই উঠল ধর্ষণের অভিযোগ, তাও কলকাতা শহরের কলেজের ইউনিয়ন রুমেই। কোনও যৌনবিকৃতি বা মানসিক রোগ নয়— ‘পুরুষতন্ত্রের রুলবুক’ না মানার শাস্তিই যে ধর্ষণ— সে-কথাই আমরা মিটিং-মিছিলে বারবার বলেছি। থ্রেট কালচার-রেপ কালচার বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলাম, এই ঘটনা এবং ঘটনার পরে অভিযুক্তের ধারাবাহিক কার্যকলাপ ঠিক তারই সাক্ষ্যপ্রমাণ দেয়। তবে আরজিকর আন্দোলন যে শাসককে চাপে ফেলতে পেরেছিল, তা আমরা এই ঘটনায় তাদের প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা বুঝেছি।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই বলা কর্তব্য, পিতৃতন্ত্রকে জিইয়ে রাখার ক্ষেত্রে মূলধারার মিডিয়ার ‘অ-সাধারণ’ ভূমিকার কথা। প্রায় সমস্ত হিন্দি টিভি চ্যানেলে যখন ‘হানিমুন হরর’ থেকে ‘মেন ইন ডেঞ্জার’ চলছে, তখন বাংলার জি-২৪ ঘণ্টা দেখাল— ‘বারবার আর্তনাদ তরুণীর, কিন্তু, দেখুন এক্সক্লুসিভ ভিডিও।’ হয়তো যন্ত্রণায় কাতর কোনও নারী আর তার ওপরে চড়াও হওয়া পুরুষকে দেখার চিরাচরিত কামনায় সেই ভিডিও উপভোগ করলেন কিছু মানুষ। কিছু বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদ ছাড়া এমন গা-ঘিনঘিনে অপরাধের বিরুদ্ধে খুব সংগঠিত ক্ষোভ-রাগও চোখে পড়েনি। হয়তো এর চেয়েও বড় সমস্যা আছে!

গত এক বছরের আন্দোলন ও তার পরবর্তী ঘটনাচক্র থেকে বারবার আমাদের এই কথাই মনে রাখতে হবে— বিচ্ছিন্নভাবে আমরা কিছুই পেরে উঠব না। আজকের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা অধিকাংশ মানুষকে এমন এক মোহে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, যেখানে মনে হয়েছে, একটি মেয়ে পড়াশোনা করে বড় চাকরি পেলেই যেন সেটাই তার একমাত্র ক্ষমতায়ন। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা তা বলে না। সুযোগের অভাবে অথবা কর্মসংস্থানের অভাবে একদিকে যেমন শ্রমজীবী নারীকে পিতৃতন্ত্রেই সমর্পিত হতে হয়, বারবারই ফিরে যেতে হয় মারধর করা বরের কাছেই, তেমনই অন্যদিকে শিক্ষিতা, আলোকপ্রাপ্তা নারীকেও যৌন হেনস্থা, মর্যাদাহানি সইতে সইতে ফিরে যেতে হয় তার কর্মক্ষেত্রে— অনেক ক্ষেত্রে ঘরেও। এটাই যে বাস্তব, তা আরও স্পষ্ট হয় গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইন্ডেক্সে ভারতের অবস্থান ১৩১ নম্বরে দেখতে পেয়ে।

 

এমন আঁধারকালেও আমি পুরোপুরি হতাশ নই, চিৎকার করতে করতে এখনও ক্লান্ত হয়ে পড়ছি না— তার কারণ এই আন্দোলনের সময়েই ব্যক্তিগতভাবে জুড়ে যেতে পেরেছি অসংখ্য মানুষের সঙ্গে। কল্যাণীতে নানারকম মানুষকে নিয়ে কাজ করা, দীর্ঘদিন ধরে কমিউনের মধ্যে বাঁচতে চাওয়া মানুষদের সঙ্গে। মূলত এই আন্দোলন থেকেই উঠে আসা প্রশ্নগুলিকে সামনে রেখেই নতুন করে জোট বেঁধেছি আমরা। এই জোট মেয়েদের, ট্রান্স-ক্যুয়ার মানুষদের এবং সচেতন পুরুষদেরও।

ধারাবাহিক নানা কার্যকলাপের মধ্যেই গত জুনে, প্রাইড মাসকে মনে রেখে, আমরা আয়োজন করেছিলাম ‘রামধনু সংলাপ’। শুধুই সংকট নয়, সবাই মিলে আসলে নতুন করে জানলাম— ভালোবাসা কী ভীষণ স্বতঃস্ফূর্ত, সর্বজনীন। প্রাইড, ক্যুয়ার— এই শব্দগুলো হয়তো কোনওদিন শোনেনি, এমন সব গ্রামেও সমলিঙ্গের মানুষের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক মোটেও বিরল নয়, এবং তাঁদের উপর হওয়া আক্রমণগুলিও ব্যতিক্রমী নয়। কসবার ঘটনার পর আমরা যেদিন ‘সম্মতি’ নিয়ে আলোচনা করতে বসলাম, অপ্রত্যাশিতভাবেই জানা হল, এই চারপাশেই বৈবাহিক ধর্ষণ কী ভীষণ বাস্তব ঘটনা। কর্মসংস্থানের অভাব এই এলাকার— হয়তো সারা দেশেরই অন্যতম বড় সমস্যা। শুধু কাজ নেই বলেই বহু মেয়েকে পুরুষতান্ত্রিক এই ব্যবস্থার মধ্যেই বাধ্য হয়ে বাঁচতে হচ্ছে।

কল্যাণীর এই নানাবিধ কাজকর্ম আমার মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে ধাক্কা দিতে দিতে এগিয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘কল্যাণী পরিচারিকা সমিতি’র কথা— যার পরিকল্পনা, জোট বাঁধার চেষ্টা গত কয়েক বছর ধরে, এবং আত্মপ্রকাশ আরজিকরের ঘটনার আশপাশেই। যেখানে সংগঠিত, অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মর্যাদা-অধিকারের প্রশ্নেই ভয়াবহ এক্সপ্লয়টেশন, সেখানে এই বছরের ১ মে, আমরা হেঁটেছি, শ্রমিকের অধিকার পেতে চাওয়ার লড়াইয়ে, গৃহপরিচারিকাদের সঙ্গে। বোনাস না দিয়ে পুজোর আগে কাজ ছাড়িয়ে দেওয়া, জোর করে সেই মাইনে-বোনাস আদায়কে কেন্দ্র করে সদ্য ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা, তৎপরবর্তী সোশাল মিডিয়া পোস্ট, আর তার কমেন্ট বক্সে ঝরে পড়া আসলে আমাদেরই শ্রেণির মানুষের যে শ্রেণি-বিদ্বেষ— আমাদের লজ্জা দেয়।

এই কারণেই, আসলে যেটুকু আন্দোলন অভয়াকে কেন্দ্র করে দানা বাঁধে, তা বাঁধেনি হাঁসখালির নাবালিকা মেয়েটির জন্য। দলিত হলে ধর্ষণ, মরে যাওয়া, আর সেই পরিবারের বিপন্নতা ঠিক কতখানি হতে পারে, তার সামান্য ধারণা আমরা পেয়েছিলাম হাথরাসের ঘটনায়।

কলেজ-ক্যাম্পাসে দাদাগিরি, নাগরিকত্বের পরীক্ষা, দেশে দেশে যুদ্ধ কিংবা বিশ্ব উষ্ণায়ন— সবচেয়ে বেশি বিপন্নতার তালিকার শুরুতেই থাকে মেয়েদের নাম। আমরা ভুলে যাই না, এ-দেশে আমার চেয়েও অনেক বেশি বিপন্ন এক দলিত মেয়ে, কোনও লিঙ্গনির্মাণের ধারায় নিজেকে না রাখা ক্যুয়ার মানুষরা, অন্যের বাড়িতে কাজ করা, রাস্তা দিয়ে ঘরে ফেরা মেয়েটা— যার ঘরে হয়তো একটা আলোও নেই। পিতৃতন্ত্রের শিকল ছিঁড়ে সম্পূর্ণ বেরিয়ে আসা আমাদের সকলের অবশ্যকর্তব্য, কিন্তু কঠিন। তার চেয়েও কঠিন আজাদি বা স্বাধীনতার পথ নির্মাণ। সেই নির্মাণের দায়িত্ব এই সময় আমাদের কাঁধে তুলে দিয়েছে।

 

১৪ অগস্ট, কল্যাণীর ‘রাত দখল’-এর মূল ব্যানারে লেখা ছিল— ‘পুরুষতন্ত্র নিপাত যাক, সমাজ মেয়েদের মুক্তাঙ্গন হোক’। রোকেয়ার প্রতি গভীর সংহতি রেখেও এ-কথা বলতে পারি, আমাদের স্বপ্নের সেই ইউটোপিয়ান মুক্তাঙ্গন ‘সুলতানা’জ ড্রিম’-এর মতো দেখতে নয়। বরং তা কোলোন্তাইয়ের কল্পনার কমিউনের মতো দেখতে হতে পারে, যেখানে সকলের জন্য ক্রেশ থাকবে, থাকবে কমিউনিটি কিচেন, কমিউনিটি লন্ড্রি। সেখানে নতুন করে সংজ্ঞায়িত হবে পরিবার।

পিতৃতন্ত্র আর ব্রাহ্মণ্যবাদের সামান্য স্পর্শ থেকেও নিজেদের মুক্ত রাখব বলে আমরা যারা প্রতিদিনের জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করছি, বারবার বলছি— আমরা কেবল যোনি নই, কবির কল্পনার ডালপালা-ফুলও নই, আমরা রক্ত-মাংস, অনুভব-অনুভূতি দিয়ে গড়া মানুষ। যে মানুষ রাতে কোনওদিন একলা, কোনওদিন বা বন্ধুর হাত ধরে হাঁটতে চায়; কাজ করতে চায় সমান সম্মান-মর্যাদার পরিবেশে; চায় এমন ঘর, যেখানে কলরোল উঠবে না তার হাবভাব নিয়ে, গুঞ্জন হবে না তার পোশাক নিয়ে…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...