উপমা নির্ঝরণী
করদাতার টাকায় পরিচালিত সরকার যদি নাগরিকদের সুস্থ জীবন ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে না চায়, বরং দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের ভয় ও অসহায়তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগায়, তখন প্রতিবাদের দায়ও করদাতাদের ওপরই বর্তায়। জনগণের এই উচ্চারণকে জোরালো করে তোলার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের। অথচ মূলধারার অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম সংবাদ নয়, বরং টিআরপি-র প্রতি বেশি দায়বদ্ধ
তিলোত্তমা হত্যার এক বছরও পূর্ণ হয়নি। তার মধ্যেই, গত ২৩ জুন কালীগঞ্জে বিজয়োৎসবে মাতোয়ারা তৃণমূল সমর্থকদের ছোড়া বোমায় নিহত হয়েছে শিশুকন্যা তমন্না। ঠিক দু-দিন পর, কসবা আইন কলেজে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন চব্বিশ বছর বয়সি এক ছাত্রী। আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাগুলি আলাদা প্রকৃতির মনে হলেও, আসলে এগুলি এক সূত্রে গাঁথা— প্রতিটির পিছনেই প্রত্যক্ষভাবে শাসকদলের ভূমিকা রয়েছে।
তিলোত্তমার মৃত্যুর পর বহু মানুষ পথে নেমেছিলেন। বাংলার শহর-মফস্বলের রাজপথে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগানে মুখর হয়েছিল জনতা। যথার্থ কারণেই তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন— বা বলা ভালো, আমরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। অনেকেই মিছিল ও প্রতিবাদসভায় অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু সবার উদ্দেশ্য যে এক ছিল, তা নয়— এটা বুঝেছিলাম। তিলোত্তমা-পরবর্তী আন্দোলন নিয়ে ইতিমধ্যেই বিস্তর আলোচনা ও বিশ্লেষণ হয়েছে, এই লেখার উদ্দেশ্য সেই আন্দোলনের সমালোচনা নয়। তবুও, কিছু বিষয় পুনরায় উল্লেখ করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কসবা আইন কলেজের গণধর্ষণকাণ্ডে অন্যতম অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্র গত বছর আরজিকর হাসপাতালের ঘটনার ‘প্রতিবাদে’ লিখেছিলেন— “হ্যাং দ্য রেপিস্ট” (ধর্ষককে ফাঁসিতে ঝোলাও)। ইতিহাস বলে, নির্যাতনের প্রতিবাদে কেউ কেউ মুখোশ পরে থাকে— অতীতেও এমন নজির আছে। কিন্তু মনোজিতের সেই পোস্ট আদৌ প্রতিবাদী উচ্চারণ ছিল কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রভাবশালী মহলের অনেকে হয়তো ভাবেন, বড় অপরাধকে আড়াল করে একজনকে চিহ্নিত করে শাস্তি দিলেই জনরোষ প্রশমিত হয়, অপরাধচক্রও নির্বিঘ্নে চলতে থাকে। এই ছলনাতেই আরও ভয়াবহ অন্যায়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এবং সেই কারণেই হয়তো মনোজিৎ ও তাঁর সঙ্গীদের অপরাধ সামনে আসার পর, বহু তৃণমূল সমর্থকও প্রতিবাদ শুরু করেছেন। কেউ বলছেন, আগে থেকেই জানতেন; কেউ আবার অবাক হচ্ছেন— অথচ এটাই মনোজিতের প্রথম অপরাধ নয়। সাংবাদিক মোনালিসা চৌধুরী ও শুভঙ্কর চৌধুরী ২৯ জুন দ্য টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া-তে ‘Harassment, assault, theft: ‘History-sheeter’ Monojit Mishra’s record of offences’ শিরোনামের প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, ২০১৭ সালে কালীঘাটে হিংসা ও হেনস্থার অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে, ওই কলেজেই এক মহিলার পোশাক ছিঁড়ে দেওয়ার অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট গঠিত হয়। সেই বছরই তিনি এক বন্ধুর বাড়ি থেকে সোনার হার, মিউজিক সিস্টেম, সুগন্ধি ইত্যাদি চুরি করেন। এরপরও তাঁর অপরাধ থামেনি।
বর্তমানে বিভিন্ন মাধ্যমের সূত্রে জানা যাচ্ছে, অন্যান্য নির্যাতিতারাও তাঁদের অভিজ্ঞতা প্রকাশ করছেন। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী, বহু বছর ধরে মনোজিৎ ও তাঁর সঙ্গীরা কলেজজুড়ে প্রকাশ্যে গুণ্ডামি ও তোলাবাজি করে এসেছে, এমনকি ইউনিয়ন কক্ষে মহিলাদের ওপর চালিয়েছে নানারকম নির্যাতন। শুধু ছাত্রীরাই নয়, অধ্যাপক ও সাধারণ পড়ুয়াদের অভিভাবকরাও তাঁকে ভয় পেতেন।
তথ্য অনুযায়ী, এতসব সত্ত্বেও শাসকদলের উচ্চপদস্থ নেতাদের সঙ্গে মনোজিতের সম্পর্ক কমেনি। ধর্ষণের অভিযোগ সামনে আসার পর ফিরহাদ হাকিম, অশোক দেব প্রমুখ নেতারা তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করেন বটে, কিন্তু তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমত, অভিযোগকারী নিজেই তৃণমূল কর্মী ছিলেন। তাঁর এফআইআরের ভাষা স্পষ্টভাবে জানায়, মনোজিৎ কলেজের তৃণমূল ইউনিটের মাথা ছিলেন এবং তাঁকে কেউ সহজে চ্যালেঞ্জ করতেন না। দ্বিতীয়ত, কলেজ কর্তৃপক্ষ ও শাসকদলের অনুমতি ছাড়া প্রতি পঁয়তাল্লিশ দিন অন্তর তাঁর অস্থায়ী সাফাইকর্মীর চাকরি পুনর্নবীকরণ সম্ভব হত না।[1] অর্থাৎ, মনোজিৎ শাসকদলের ছত্রচ্ছায়ায় গুণ্ডামি ও অত্যাচার চালিয়ে গিয়েছেন।
ঘটনার পরে, বিধ্বস্ত নির্যাতিতা একজন অধ্যাপককে ফোন করেন। একটি মূলধারার সংবাদমাধ্যমে তাঁর সাক্ষাৎকার সম্প্রচারিত হয়। সেখানে তিনি মনোজিতের শাস্তির দাবি জানান ও নির্যাতিতার পাশে থাকার কথা বলেন। তাঁর কথায় ছিল রাগ, ঘৃণা, অসহায়তা— এবং স্পষ্টতই এই আশঙ্কা, কেউ যেন তাঁকে তৃণমূল-বিরোধী না ভাবে। তিনি বলছিলেন, কারও ভয় পান না, প্রয়োজনে মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত— অথচ বারবার অভিষেক ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশস্তি করে নিজের আনুগত্যের বার্তা দিচ্ছিলেন।
উল্লেখযোগ্য, তিনি আইন বিষয়ে পড়েছেন, পড়ানও। অতীতে পার্ক স্ট্রিট বা কামদুনির ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রীর করা কুরুচিকর মন্তব্যগুলি তাঁর অজানা হওয়ার কথা নয়। সেক্ষেত্রে তাঁর এই আচরণ ভয়, ভক্তি— অথবা দুইয়েরই মিশ্রণ হতে পারে। এবং সেই মিশ্রণই সাধারণ মানুষের পক্ষেও গভীর উদ্বেগের বিষয়।

প্রথমেই উল্লেখ করেছিলাম, আরজিকর ও কসবা কলেজের ঘটনার প্রকৃতি এক নয়। গত বছরের আন্দোলনের সূচনাপর্বে অনেক প্রতিবাদীই একধরনের ‘অরাজনৈতিক’ আবরণ ধারণ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শাসকদের ধারাবাহিক অন্যায়ের ‘খেলা’র বিরুদ্ধে এখন অনেক বেশি মানুষ সরব হচ্ছেন।
করদাতার টাকায় পরিচালিত সরকার যদি নাগরিকদের সুস্থ জীবন ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে না চায়, বরং দিনের পর দিন সাধারণ মানুষের ভয় ও অসহায়তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগায়, তখন প্রতিবাদের দায়ও করদাতাদের ওপরই বর্তায়। জনগণের এই উচ্চারণকে জোরালো করে তোলার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের। অথচ মূলধারার অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম সংবাদ নয়, বরং টিআরপি-র প্রতি বেশি দায়বদ্ধ।
এই কারণেই একটি টেলিভিশন চ্যানেল ধর্ষণের ভিডিও সম্প্রচার করে এবং বহু মানুষের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেই ভিডিও তাদের ওয়েবসাইট থেকে সরানো হয়নি। আরও ভয়াবহ বিষয় হল, হাজার হাজার মানুষ সেই ভিডিও দেখেছেন। প্রায় প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনার পরে পর্নোগ্রাফির সাইটে বহু মানুষ সেই সংক্রান্ত বিষয়বস্তু খুঁজতে যান— এ এক গোপন অথচ পরিচিত সহিংস অভ্যাস।
বর্তমান সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঘটে চলা অত্যাচার ও সন্ত্রাস, এবং সংবাদমাধ্যমের এমন ভূমিকা— সব মিলিয়ে বিকৃতি ও অপরাধকে ক্রমাগত প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই সমস্যা ও সংকটের শিকড় অনেক গভীরে, যা সমাজের সর্বস্তরে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে আছে। যৌথভাবে সেই বিস্তারকে চিহ্নিত করে অবিলম্বে প্রতিরোধ শুরু না করলে সংকট আরও গভীরতর হবে। এমনিতেই অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।

[1] কীভাবে নিয়োগ হয়েছিল মনোজিত মিশ্রর। আনন্দবাজার অনলাইন। জুলাই ৪, ২০২৫।

