আজিজুল হক, ম্যাজিক করো, আমাদের আবার স্বপ্ন দাও…

অয়নেশ দাস

 


সময় এক বিষম বস্তু। সময়ই জানান দিচ্ছিল আজিজুল হক নামের মানুষটার কাছ থেকে এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ঠিক কী পাওয়ার ছিল। কেননা ততক্ষণে সমই জানান দিচ্ছিল যে নয়া-উদারবাদ থাবা গেঁড়ে বসেছে। সময়ই জানান দিচ্ছিল যে, এই গ্রহে ততদিনে বিদ্যুৎবেগে ঘটে চলেছে প্রযুক্তি বিপ্লব। এই সময়ই জানান দিচ্ছিল যে এমন এক সময়কালে আমরা প্রবেশ করে ফেলেছি, যেখানে স্বপ্নটুকু জাগিয়ে রাখাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন তথা সবচেয়ে শ্রেয় কাজ

 

সে এক যুগসন্ধিক্ষণের কাল।

কিছু আগেই এ-দেশের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে নয়া-উদারবাদ। পুরনো পৃথিবীটা, পুরনো কলকাতাটা অতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। সময়টা নব্বইয়ের দশকের শেষ নাগাদ।

একদিন রাত তখন বড়জোর ৮টা। এমজি রোড-আমহার্স্ট স্ট্রিটের ক্রসিং-এ টাউন বোর্ডিংয়ের সামনেটা তখনও বেশ অন্ধকার হয়ে থাকত। বোধহয় সময়ের ঝুল মেখে নগরীর ভেপার ল্যাম্পগুলো কেমন নিভু-নিভু হয়ে থাকত। বোর্ডিংয়ের ড্যাম্প ধরা দেওয়ালে তখন প্রবল প্রতাপান্বিত ‘ব্রিগেড চলো’র বিজ্ঞাপনের লাল রং বৃষ্টিতে ভিজে বিবর্ণ। আর তার দু-পা দূরেই গ্লোসাইন আর ঝকঝকে ইন্টিরিয়র নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে ‘হার্ট অফ দ্য সিটি’ আর্চিস গ্যালারি। তার কাচের দেওয়ালের ভেতরে আমার যাবতীয় দৃষ্টি টেনে নিচ্ছিল আধুনিক অফসেটে মুদ্রিত লাইফ-সাইজ পোস্টারে আলোকিত স্বল্পবাস বিশ্বসুন্দরী।

এমন সময় এক অদ্ভুত মায়াস্পর্শ নিয়ে আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন আজিজুলদা।

—কিরে, খুব খিদে পেয়েছে না?

চমকে উঠেই আমার চোখ পড়ল আর্চিস গ্যালারির ঝকমকে আলোর ঠিক পাশেই টিমটিমে বাল্বের আলোজ্বলা সিঙ্গারা-আলুর চপের দোকানটায়। লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে বলেছিলাম— না না।

আজন্ম বিপ্লবী আজিজুল হক কি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের হাতের ফাঁক দিয়ে গলে হারিয়ে যেতে চলেছে তাঁদের আগামী প্রজন্ম? কিংবা আমরা কি বুঝতে পারছিলাম, আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলতে চলেছি সেইসব মায়াস্পর্শ?

এক অদ্ভুত যুগসন্ধিক্ষণে পৌঁছে সেদিন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল পূর্ববর্তী ও আগামীর প্রজন্ম।

সেই কিছু বছর ধরে প্রায় প্রতিদিনই অগ্রজপ্রতিম চিন্তক নির্মাল্যদার (নির্মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়) অফিস ব্রাঞ্চ থেকে কফি হাউস হয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক কিংবদন্তি নকশাল নেতাকে সঙ্গে নিয়ে ২৪০ নম্বর বাসে যাদবপুর থানার উদ্দেশে উঠে পড়ত দুই সদ্য-যুবক— যাদের একজন এই আমি, আর আরেকজন ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু ময়ূখ (কবি ময়ূখময় অধিকারী)। কখনও বা সঙ্গী হত রাজনৈতিক কর্মী শংকরদা (শংকর দাস)। নিতান্তই কম জানা ও অনভিজ্ঞতার জন্য, কফি হাউসের টেবিলে যে সব অর্বাচীন প্রশ্ন পেটের ভিতরেই জমা রেখে দিতে হত, শিয়ালদা পেরিয়ে ভিড় একটু হালকা হয়ে খানিকটা ভালোভাবে দাঁড়ানোর জায়গা পেলেই সেই সব আটকে থাকা প্রশ্নরা হঠাৎ খাঁচাছাড়া পাখিদের মতো বেরিয়ে আসত। এক দেবতুল্য হাসিমাখানো মুখের দিকে ক্রমাগত ছুটে ছুটে যেত তারা।

মৌলালির পর থেকেই দুপাশে এক আশ্চর্য জাদুস্পর্শে একে একে ক্রমশ জেগে উঠত নকশালবাড়ির শহিদস্তম্ভগুলো। ছুটন্ত ২৪০-এর জানলা দিয়ে ক্রমান্বয়ে উঁকি দিয়ে যেতেন চারু মজুমদার, সরোজ দত্ত, লেনিন, মাও সে-তুং। সে যেন ছিল এক জাদুপাঠ। বেতের লাঠি হাতে এক বিশীর্ণ জাদুকরের হাত ধরে শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন একের পর এক জাদুবাস্তব মাইলস্টোনের মতো গেঁথে যেতে থাকত শিয়ালদা থেকে যাদবপুর থানা রুটে।

যে-মানুষটির অনেক আগেই বিপ্লবের সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়ে, বারবার ব্যর্থ হয়ে, যাবতীয় বিশ্বাস চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার কথা; রাষ্ট্রীয় বুলেটে অথবা জেলখানার ভয়ঙ্কর অত্যাচারে যার জীবন অনেক আগেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা— সেই অশক্ত, শীর্ণ, অসুস্থ মানুষটি তবুও আমৃত্যু বিপ্লবী স্বপ্নসন্ধানে অটুট থেকেছেন। যিনি জাদুকরের মতো, ভালোবাসার শিকড়বাকড়ের মতো ছড়িয়ে দিতে পারতেন বিপ্লবের অনিঃশেষ স্বপ্ন!

কীভাবে? নাৎসি জার্মানি থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত চিন্তাবিদ এরিক ফ্রম আশ্রয় নিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেও, প্রবল পুঁজিবাদী বিচ্ছিন্নতায় একান্ত নিঃসঙ্গ ফ্রম সমাজ ও মানবমুক্তি সম্পর্কিত তাঁর চিন্তা ও দর্শনকে সংস্থিত করেন এক বিশ্ব-ব্যাপী শিল্পিত ভালোবাসার দর্শনে। The Art of Loving— মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অমোঘ অস্ত্র মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান— মানুষের ভালোবাসার ক্ষমতা।

আর সেই অবিকল্প ভালোবাসার প্রবল ক্ষমতা নিয়ে জন্মে, আমৃত্যু স্মিত জ্যোৎস্নার মতো ভালোবাসার উদাত্ত বিকিরণ করে গেলেন প্রাচ্যের সন্তান আজিজুল হক— হয়তো বা তাঁর নিজের অজান্তেই। তা-ই ছিল আজিজুলদার সত্তা; তা-ই ছিল তাঁর শক্তি।

এই পৃথিবী বহু বহুকাল আগেই ভালোবাসাহীন পথের পথিক। কী এককে, কী সমবায়ে। কোনওরকম আবেগ সরিয়ে রাখাই যেখানে রাজনীতির দস্তুর, সেখানে আজিজুল হক ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ওই ভালোবাসার ক্ষমতাবলেই এক অকৃত্রিম সারল্যের অধিকারী ছিলেন আজিজুলদা।

একবার নির্মাল্যদা জিজ্ঞেস করেছিল— “এই যে অনায়াসে গ্রামে গিয়ে অবর্ণনীয় পরিশ্রম করতে, বুলেটের সামনে অকাতরে বুক পেতে দিতে, জেলের অকথ্য অত্যাচারেও মাথা উঁচু করে থাকতে— এত সাহস আর শক্তি কোথা থেকে পেতে?” খৈনি ডলতে ডলতে সেই মায়াময় হাসিটা হেসে বলেছিলেন— “ওরে, পতঙ্গ রে পতঙ্গ। তখন তো চারিদিকে আগুন। আমরা ছিলাম পতঙ্গ।”

এই সর্বগ্রাসী আমি-আমির ক্লেদাক্ত যুগে নিজের গৌরবময় অতীতের এরকম সৎ বিনির্মাণ একমাত্র আজিজুলদাই করতে পারতেন। না— আর কাউকে দেখিনি। কারণ, তাঁদের কাছে আজিজুলদার মতো ভালোবাসার পুঁজি ছিল না।

ত্রুটিহীন কেউ নয়, তিনিও নন। সোনায় মোড়া হলেও ভুল তো ভুলই। পাঠে ভুল হয়ে যায়, তত্ত্বে ভুল হয়ে যায়, প্রয়োগে ভুল হয়ে যায়, প্রক্রিয়ায় ভুল হয়ে যায়। কিন্তু এত ভুল, এত ব্যর্থতার পরেও যে মানুষ স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে, জাগিয়ে রাখতে পারে, শিকড়ে শিকড়ে ছড়িয়ে দিতে পারে সে-ই তো ম্যাজিশিয়ান। যাঁর সামান্য উপস্থিতি যে-কোনও বিমর্ষ, পরাজিতের মনে নতুন করে আলো ভরে দিতে পারে— সে-ই তো ম্যাজিশিয়ান।

যে-ম্যাজিশিয়ানের আলখাল্লা ভরে থাকে মাটি, মায়া, ঘাম, রক্ত, স্পর্শ, প্রেম, ব্যর্থতা, চোখের জলে; যে-ম্যাজিশিয়ানের আলখাল্লা ভরে থাকে যাবতীয় মানুষী আবেগের অনিন্দ্য কারুশিল্পে। আজিজুল হক ছিলেন এক ভালোবাসার ম্যাজিশিয়ান। কেজো বস্তুবাদের নিরিখে তাঁকে বিচার করলে সে বড় ভুল হয়ে যাবে।

কিন্তু সময় এক বিষম বস্তু। সময়ই জানান দিচ্ছিল আজিজুল হক নামের মানুষটার কাছ থেকে এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ঠিক কী পাওয়ার ছিল। কেননা ততক্ষণে সমই জানান দিচ্ছিল যে নয়া-উদারবাদ থাবা গেঁড়ে বসেছে। সময়ই জানান দিচ্ছিল যে, এই গ্রহে ততদিনে বিদ্যুৎবেগে ঘটে চলেছে প্রযুক্তি বিপ্লব। এই সময়ই জানান দিচ্ছিল যে এমন এক সময়কালে আমরা প্রবেশ করে ফেলেছি, যেখানে স্বপ্নটুকু জাগিয়ে রাখাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন তথা সবচেয়ে শ্রেয় কাজ।

সত্যিই এক যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছিল আমাদের যৌবনের প্রথম ভাগ। একদিকে সোভিয়েত ব্লক ভেঙে টুকরো টুকরো। নয়া-ঔপনিবেশিক চক্রের থাবায় হতভাগ্য গ্লোবাল সাউথের যাবতীয় প্রতিস্পর্ধা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামারা ‘ইতিহাসের শেষ’ ঘোষণা করে দিয়েছে। পোস্ট-ট্রুথ আমাদের গিলে খেয়ে নিচ্ছে। নির্নিমেষ ব্যাথাতুর চোখের সামনে স্ক্রিনে ঘটে চলেছে গুডবাই লেনিন। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠিত বামপন্থার নিদারুণ যান্ত্রিকতা আর প্রকৃতি, আত্মা ও উপলব্ধি-বিচ্ছিন্ন স্ট্রাকচারের বোধহীন নিগড়ে ক্রমশ দিশাহীন শূন্যতায় একমাত্র পুঁজি স্বপ্নটুকুও হারিয়ে ফেলেছি আমরা।

আশ্চর্য, আজও একই রুটে একইভাবে ছুটে চলে ২৪০ নম্বর বাস। কিন্তু হায়, অনেক আগে থেকেই ২৪০-এর জানলা থেকে ফিকে হতে শুরু করেছিল বুকে আগুন জ্বালানো সেইসব মুখগুলি। ঝলসানো চাবুকের মতো উদ্ধত গ্লোসাইনেরা ঠিকরে পড়তে শুরু করেছিল সেইসব জানলায়। শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন-মাইলস্টোনগুলি যাবতীয় জাদুবাস্তবতা হারিয়ে পরিণত হতে থাকল শপিং মল আর বিচ্ছিন্ন এককের আত্মসর্বস্বতার পথনির্দেশিকায়। চেতনাহীন জোম্বির মতো লুটে যেতে ও লুটে নিতে শিখলাম আমরা— পরবর্তী প্রজন্ম; এক প্রবল বৈষম্যের ভবিষ্যতে।

আর এক প্রত্নমানবের মতো, ক্রমশ নিঃসঙ্গ হতে হতে শেষে এই দুনিয়ার মায়া কাটিয়েই চলে গেলেন আজিজুলদা।

কেন কিছুতেই মনে করতে পারি না সেই ঊষা কারখানার অন্ধকারটা? এখন যেখানে সাউথ সিটি মলের এমন চোখজ্বালানো দাপট!

তবু যদি কোনওক্রমে মনে করতে পারি ঊষার সেই দেওয়ালের ধার, চার-পাঁচ পোঁচ পলেস্তারা খসিয়ে দিতে পারলে আজও হয়তো সে-দেওয়াল থেকে বের করে আনা যেতে পারে একটা ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ স্লোগান; হয়তো দেখব, তার সামনে প্রিন্স আনোয়ার শা রোডের ফুটপাথে ২৪০ স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আজও খৈনি ডলছে শরীরে অশক্ত, কিন্তু ভালোবাসায় প্রবল, মায়াময় হাসিমুখের এক ম্যাজিশিয়ান। ঝুলিতে তাঁর একঝাঁক স্বপ্ন।

জানি না, আজ সেই ম্যাজিশিয়ানের দৃষ্টিগোচর হবে কিনা— সামনেই কিলবিল করে চলেছি মেরুদণ্ড হারানো আমরা— স্বপ্নহীন, হাল ছেড়ে দেওয়ার দিশাহীন দল। চিৎকার করে বলতে চাইছিআজিজুল হক, ম্যাজিক করো, আমাদের আবার স্বপ্ন দাও… অন্তত স্বপ্নটুকু দাও…

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...