আশিস গুপ্ত
ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় ও মহারাষ্ট্র— এই চারটি রাজ্য মিলে ভারতের খনিজ জোগান ব্যবস্থার মেরুদণ্ড গড়ে তুললেও, সেই জোগানের বিনিময়ে আদিবাসী সমাজ ও পরিবেশকে যে মূল্য চুকাতে হচ্ছে, তা গভীরভাবে অমানবিক। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদের এই একতরফা শোষণ শুধু বন ও জল নয়, দেশের নৈতিক ভিত্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যে রাষ্ট্র তার জনজাতিদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, সেই রাষ্ট্রই আজ কর্পোরেট স্বার্থে আদিবাসী অস্তিত্বকে মুছে দিতে উদগ্রীব। খনিজ আহরণ ও রপ্তানির এই অন্ধ, নীতিহীন সংস্কৃতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে ভারতের ভবিষ্যৎ কেবল পরিবেশগত সংকটে নয়— এক গভীর সামাজিক বিপর্যয়ের দিকেও ধাবিত হবে
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেন, ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে ভারতকে মাওবাদী-মুক্ত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে— যা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে। তাঁর ভাষ্যে, মাওবাদীদের নির্মূল করা গেলে “পাহাড়, জঙ্গল, নদী, খনিজ— সব আবার দেশের উন্নয়নের কাজে লাগানো যাবে।” এই বক্তব্য দেশের অভ্যন্তরে এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরে। তবে এই অভিযান কি সত্যিই জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে, নাকি এটি কর্পোরেট সংস্থাগুলোর হাতে খনিজ-সমৃদ্ধ আদিবাসী ভূমি তুলে দেওয়ার একটি সুকৌশলী রণনীতি— যা ‘উন্নয়ন’ ও ‘শান্তি’র আড়ালে লুকোনো?
এই প্রতিবেদনটি সেই দ্বৈত আখ্যানের গভীরে প্রবেশ করে, রাষ্ট্রীয় নীতির পেছনে থাকা অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর এর প্রভাব এবং পরিবেশগত পরিণতিগুলো বিশ্লেষণ করে। ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির শাসকীয় স্লোগান মাওবাদী বিদ্রোহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত— যেখানে রাষ্ট্র ও বিদ্রোহীরা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আনুগত্যের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এই প্রেক্ষাপটে, রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ উন্নয়নমূলক কর্মসূচিগুলোকে নিরাপত্তার মোড়কে উপস্থাপন করে— যা ‘উন্নয়নের নিরাপত্তায়ন’ (securitisation of development) নামে পরিচিত। এই কৌশল কর্পোরেট অর্থনৈতিক স্বার্থকে জাতীয় নিরাপত্তা ও অগ্রগতির অপরিহার্য অংশ হিসেবে তুলে ধরে, যার ফলে আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিবাদকে ‘দেশবিরোধী’ বা ‘মাওবাদী সহানুভূতিশীল’ বলে আখ্যায়িত করে দমন করা সহজ হয়।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে যে নিরাপত্তা অভিযান চলছে, তাকে রাষ্ট্র ‘সন্ত্রাস দমন’ ও ‘উন্নয়ন রক্ষা’র নামে বৈধতা দিয়ে এসেছে। ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ (২০১০-১২), অপারেশন ‘সমাধান’ (২০১৭–বর্তমান), অপারেশন ‘প্রহার’, অপারেশন ‘ডাবল বুল’ (২০২৩), অপারেশন ‘মনসুন’ (প্রতি বছর জুন-আগস্ট), অপারেশন ‘কাগার’ (যা ‘অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট’ নামেও পরিচিত; শুরু ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে)— নানা নামে মধ্যপন্থী ইউপিএ সরকার থেকে চরম দক্ষিণপন্থী এনডিএ সরকার পর্যন্ত মাওবাদী দমন অভিযানে যুক্ত থেকেছে। কিন্তু বাস্তবে, এই সব অভিযানে লক্ষ্য করা যাচ্ছে নির্বিচারে আদিবাসী হত্যার ঘটনা।
এই সব অভিযানের ক্ষেত্রে প্রায়শই ‘এরিয়া ডোমিনেশন’ বা এলাকার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কথা উঠে আসে। নিরাপত্তা বাহিনী বহু সময়ই কোনো ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বলে, তারা ‘এরিয়া ডোমিনেশন’ অভিযানে বেরিয়েছিল। গত দুই দশকে রাষ্ট্রের মাওবাদী-বিরোধী অভিযানের মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে— এলাকার উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। যে এলাকায় থাকবে না যুগের পর যুগ ধরে বসবাস করে আসা আদিবাসী জনগণের আধিপত্য। অধিকার, আধিপত্য থাকবে শুধু রাষ্ট্রের বকলমে কর্পোরেটের।
জঙ্গল-পাহাড় অধ্যুষিত অঞ্চলে রাষ্ট্রের এই আধিপত্য বিস্তারের অভিযান কেন? কেনই বা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পাহাড়-জঙ্গলে বসবাসকারী আদিবাসী মানুষদের উচ্ছেদের লক্ষ্যে ‘এরিয়া ডোমিনেশন’ অভিযান চালানো হচ্ছে? ভারতের যেসব অঞ্চলে মাওবাদী বা নকশালপন্থী কার্যকলাপ বেশি দেখা যায়— যেমন ছত্তিশগড়, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অংশ— তা মূলত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা, এবং সেগুলোই দেশের খনিজ সম্পদের প্রধান ভাণ্ডার।

জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (জিএসআই)-র তথ্য অনুযায়ী, ভারতের কয়লার ৮৩ শতাংশ, বক্সাইটের ৬৫ শতাংশ, লৌহ আকরের ৫০ শতাংশ এবং একটি বড় অংশ ম্যাঙ্গানিজ, ইউরেনিয়াম, সোনা ও লাইমস্টোন এই অঞ্চলগুলোতেই মজুত রয়েছে।[1] ছত্তিশগড়ের দক্ষিণ বস্তার, সুক্তি, দান্তেওয়াড়া ও নারায়ণপুর এলাকায় বিপুল পরিমাণ লৌহ আকর ও বক্সাইট মজুত রয়েছে, যেখানে বেদান্ত, আদানি, বালকো (বিড়লা গ্রুপ), এসার ও এনএমডিসির মতো বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলো খনিপ্রকল্প শুরু করতে আগ্রহী।[2]
এই খনিজ সম্পদ ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা দেশকে বৈশ্বিক শক্তিতে রূপান্তরের শাসকীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়ক হতে পারে। নীতি আয়োগের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে: “আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে খনিজ উত্তোলন ত্বরান্বিত করাই ভারতের ৫ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির লক্ষ্যে পৌঁছনোর মূল চাবিকাঠি।”[3] এই উচ্চাভিলাষী অর্থনৈতিক লক্ষ্য পূরণে রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে খনিজ আহরণকে সহজ করতে নীতিগত সংস্কার এনেছে। খনি বরাদ্দ প্রক্রিয়া সরলীকরণ করেছে, বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য অনুসন্ধান ও উত্তোলনকে আর্থিকভাবে আকর্ষণীয় করে তুলেছে এবং ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ খনিজের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে সরাসরি একচেটিয়া ভিত্তিতে খনি ইজারা নিলামের ক্ষমতা প্রদান করেছে।[4] এই পদক্ষেপগুলো কেবল অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে গতিশীল করছে না, বরং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ও পরিবেশগত সুরক্ষার বিনিময়ে কর্পোরেট খনিজ উত্তোলনের পক্ষে একটি অনুকূল পরিবেশও তৈরি করছে।
ফলে, যে প্রাকৃতিক সম্পদ যুগের পর যুগ ধরে স্থানীয় আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার উৎস ছিল, তাই আজ তাঁদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সম্পদগুলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সমৃদ্ধির বদলে সংঘাত, দুর্নীতি, দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়িয়ে তুলছে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আদিবাসীরা যখন আন্দোলনে সামিল হন, তখন অনেক ক্ষেত্রেই মাওবাদীদের সহায়তায় তাঁদের আন্দোলন কর্পোরেট জমি অধিগ্রহণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেই প্রেক্ষিতেই রাষ্ট্রের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় তথাকথিত ‘রেড করিডোর’কে ‘কর্পোরেট খনিজ করিডোর’-এ রূপান্তর করার এরিয়া ডোমিনেশন অভিযান।

আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের জমি ও বনের অধিকার রক্ষায় দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্র এই প্রতিরোধকেই মাওবাদী সহানুভূতি বা সক্রিয়তা হিসেবে চিহ্নিত করে নিরাপত্তা বাহিনী নামিয়ে দমন করছে। ২০০৯ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ নামে একটি সামরিক অভিযান শুরু করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল ছত্তিশগড়, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যে মাওবাদী কার্যকলাপ নির্মূল করা। তবে সমাজবিজ্ঞানী নন্দিনী সুন্দর[5], মানবাধিকার আইনজীবী বেলা ভাটিয়া এবং সাংবাদিক গৌতম নওলখার[6] মতো বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অভিযান মূলত একটি “সম্পদের জন্য যুদ্ধ”। বেলা ভাটিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, “মাওবাদী মোকাবেলার নামে প্রকৃতপক্ষে আদিবাসীদেরই টার্গেট করা হচ্ছে, যারা বৃহৎ খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ করছে।”[7]

এই অভিযানে আধা-সামরিক বাহিনী, যেমন সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (সিআরপিএফ)-এর বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইউনিট CoBRA (Commando Battalion for Resolute Action)-কে ব্যাপকভাবে মোতায়েন করা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীকেও ‘প্রশিক্ষণ’-এর অজুহাতে এই অঞ্চলে নিযুক্ত রাখা হয়েছে। নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে স্যাটেলাইট ফোন, আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকেল (ইউএভি), এবং ইজরায়েলি ড্রোন। এই ধরনের সামরিকীকরণ এবং উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ইঙ্গিত করে যে অভিযানগুলো শুধু বিদ্রোহ দমন নয়, বরং আদিবাসী প্রতিরোধ নিঃশেষ করে খনিজ আহরণের লক্ষ্যে জমির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। আদিবাসী প্রতিবাদকারীদের ‘মাওবাদী’ বলে চিহ্নিত করা তাঁদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অবৈধ প্রমাণ করে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগকে ন্যায্যতা দেয়। এর ফলে জাতীয় নিরাপত্তা এবং কর্পোরেট স্বার্থের মধ্যে এক বিপজ্জনক বোঝাপড়া গড়ে ওঠে।
যদিও সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অপারেশন গ্রিন হান্ট’ বা ‘অপারেশন কাগার’ শব্দগুলি ব্যবহার করে না, এটি রাষ্ট্রের এক কৌশলগত পদক্ষেপ— যার মাধ্যমে সম্পদকেন্দ্রিক এই সংঘর্ষকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। এই ধরনের রাষ্ট্রীয় দমননীতি জনবিতর্ককে সীমিত করে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে জবাবদিহিতা ব্যাহত করে। ‘এরিয়া ডোমিনেশন’ অভিযান কার্যত বাস্তবায়িত হচ্ছে আদিবাসী মানুষের জীবনের বিনিময়ে।
২০১৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারতে অনুমোদিত নতুন মাইনিং প্রকল্পগুলোর প্রায় ৪৮ শতাংশই তথাকথিত মাওবাদী-প্রভাবিত অঞ্চলগুলোতে। কেন্দ্রীয় খনিজ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশেই ৯৮টি খনিজ ব্লক নিলামে দেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ প্রকল্পে পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের ছাড়পত্র দ্রুত মঞ্জুর করা হয়েছে— যেখানে গ্রামসভা ‘না’ বলেছে, সেখানেও অনুমতি দেওয়া হয়েছে।[8]
২০২২ সালে কেন্দ্রীয় জনজাতি বিষয়ক মন্ত্রকের এক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়: আদিবাসী অঞ্চলে আধা-সামরিক বাহিনীর মোতায়েন মৌলিক অবকাঠামোর তুলনায় অনেক দ্রুত বাড়ছে। যেখানে খনির স্বার্থে রাস্তা ও ক্যাম্প তৈরি হয়েছে, সেখানে মানুষের জন্য কোনও স্কুল বা হাসপাতাল নেই।
রাষ্ট্র, কর্পোরেট ও নিরাপত্তা বাহিনীর এই সমন্বয়ের পটভূমিতে একটি মৌলিক প্রশ্ন সামনে আসে: যদি মাওবাদী উপস্থিতি উন্নয়নের অন্তরায় হয়, তাহলে তথাকথিত এই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কি আদিবাসীদের দাবিতে গড়ে উঠছে, না কি কর্পোরেট স্বার্থে?

ছত্তিশগড়ের দান্তেওয়ারা জেলার বাইলাডিলা রেঞ্জে এনএমডিসি-র বড় লৌহ আকর খনিগুলিকে কেন্দ্র করে আদিবাসী প্রতিরোধ বহুদিনের। ২০১৫ সালে অন্ধ্র-ছত্তিশগড় সীমান্তে অবস্থিত বাইলাডিলা-১৩ নম্বর ব্লক আদানি গোষ্ঠীকে অপারেশনাল কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়। স্থানীয় গ্রামসভার অভিযোগ— তাদের সম্মতি ছাড়াই ছত্তিশগড় মাইনিং কর্পোরেশন একটি ‘জাল মিটিং’ দেখিয়ে প্রকল্প অনুমোদনের কাগজপত্র তৈরি করেছে।[9] ২০১৯ সালের জুনে অন্তত ১০টি গ্রাম একত্রিত হয়ে বাইলাডিলা পাহাড়ের পাদদেশে গণঅবস্থান শুরু করে। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনের জবাবে পুলিশ রাতের অন্ধকারে ১৯ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে মারধর করে। Scroll.in ও The Wire-এর অনুসন্ধানে প্রকাশ পায়— আন্দোলন দমন করতেই অতিরিক্ত বিএসএফ ক্যাম্প বসানো হয় এবং সিআরপিএফ ‘এরিয়া ডোমিনেশন অপারেশন’ চালায়, যার ফলে বহু পরিবার গ্রাম ছেড়ে অরণ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।[10]

ওড়িশায় দক্ষিণ কোরিয়ান স্টিল জায়ান্ট পসকোর সঙ্গে ২০০৫ সালে ভারতের অন্যতম বৃহৎ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ হিসেবে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত ছিল ৪০০০ একর জমি, যার বেশিরভাগটাই ছিল জগৎসিংপুর জেলার কৃষিজমি। প্রকল্প-বিরোধী গ্রামবাসীরা “পসকো প্রতিরোধ সংগ্রাম সমিতি” গড়ে তোলেন এবং আইনি লড়াই শুরু করেন। বহু বিক্ষোভে নারী-নেতৃত্বে হাজার হাজার গ্রামবাসী জমি রক্ষা করেন। এর জবাবে পুলিশ বারবার নির্বিচারে লাঠিচার্জ ও গ্রেপ্তার করে। ২০১৩ সালে বন অধিকার আইন অনুযায়ী স্থানীয় গ্রামসভাগুলোর অনুমতি না থাকায় প্রকল্পটি বাতিল করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় সরকার। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণ দেয়— “শিল্প উন্নয়নের নামে কোনওভাবেই সম্প্রদায়ের বনাধিকার অগ্রাহ্য করা যায় না।”[11]
ওড়িশার নিয়ামগিরি পাহাড়ে বক্সাইট খননের বিরুদ্ধে ডোংরিয়া কোন্ড জনগোষ্ঠীর লড়াইও একটি মডেল হয়ে উঠেছে। ব্রিটিশ বহুজাতিক সংস্থা বেদান্ত রিসোর্সেস-এর খনির বিরোধিতায় ১২টি গ্রামসভার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত প্রকল্পটিকে আইনি বাধার মুখে ফেলে। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট এক ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণে জানায়: “গ্রামসভাই তাদের বন ও ধর্মীয় অধিকারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ।” তৎকালীন বিচারপতি এফএম ইব্রাহিম কালিফুল্লা বলেন, ভারতের খনিজ সম্পদ দিল্লিতে নয়, বরং তার বনবাসীদের কণ্ঠে নিহিত।[12]

অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনম জেলার আরাকু ও চিত্তাগুডা অঞ্চলেও বক্সাইট উত্তোলনের পরিকল্পনা করা হয়। প্রকল্পটি হাতে নেয় AnRAK Aluminium নামের এক যৌথ সংস্থা, যার মালিকানা ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নালকো এবং দুবাই-ভিত্তিক রস আল খাইমা কোম্পানির। বন অধিকার আইনের বিধান উপেক্ষা করে ২০১২ সালে এই সংস্থাকে খননের অনুমতি দেওয়া হয়— স্থানীয় আদিবাসী গ্রামসভাগুলোর অনুমতি না নিয়েই।[13] এই খনির বিরোধিতায় বিশাখা স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ছাত্রনেতা ভানুজয় ডোরা ২০১৩ সালে পুলিশি হেফাজতে মারধরের শিকার হন, কারণ তিনি স্থানীয় জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। তাঁর পরিবার পরে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ জমা দেয়। স্থানীয় প্রতিবাদীদের ‘আরবান নকশাল’ হিসেবে চিহ্নিত করে পুলিশ ৪ জন শিক্ষক ও ৩ জন কৃষি আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে। বক্সাইট-সমৃদ্ধ অঞ্চলজুড়ে তথাকথিত ‘মাওবাদী দমন’ অভিযানের অংশ হিসেবে মোতায়েন করা হয় বিশেষ কমান্ডো বাহিনী ‘গ্রেহাউন্ড’। তবে People’s Union for Civil Liberties (PUCL)-এর অনুসন্ধান অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিহত ৩৭ জনের মধ্যে অন্তত ২২ জনই ছিলেন স্থানীয় গ্রামবাসী, যাঁদের মাওবাদীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলেনি।[14]

গত দুই দশকে জল, জঙ্গল ও পাহাড়ের উপর রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের যৌথ ‘এরিয়া ডোমিনেশন’ প্রয়াস বারবার প্রতিহত হয়েছে আদিবাসী জনগণের প্রতিরোধে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতের রায় আন্দোলনকে সহায়তা করেছে। তবে সেগুলি ঘটেছে মূলত ২০১৪ সালের আগে, যখন এনডিএ সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসেনি। গত ১১ বছরে ভারতের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চালচিত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই বন অধিকার আইন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ দমনে কেন্দ্র ও রাজ্যে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
আজ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিরাপত্তা বাহিনীর ‘এরিয়া ডোমিনেশন’ অভিযান শুধু মাওবাদী দমন নয়— এটি এক রাষ্ট্রীয় প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য সাংবিধানিক অধিকার, পঞ্চম তফসিল, বন আইন এবং গণতান্ত্রিক প্রতিরোধকে পিষ্ট করে কর্পোরেট মুনাফার পথ সুগম করা। আদিবাসী সম্প্রদায়ের কণ্ঠরোধে রাষ্ট্র যে সহিংসতা চালাচ্ছে, তা বহুক্ষেত্রেই তথ্য ও যুক্তির নিরিখে অবৈধ, অগণতান্ত্রিক এবং অমানবিক।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে: যদি এই যুদ্ধ খনিজ সম্পদ দখলের জন্য হয়, তবে কি ভারতের গণতন্ত্র ক্রমশ সেই খনির গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে? আর যদি শান্তি ও উন্নয়নই প্রকৃত লক্ষ্য হয়, তবে তা কখনও আদিবাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে নয়— তাঁদের অধিকার স্বীকার করে, তাঁদের সঙ্গে সহাবস্থান গড়েই অর্জন সম্ভব।

রাষ্ট্র ও কর্পোরেটের এই আগ্রাসী ভূমিকা কেবল আদিবাসী জীবনের উপরই নয়, বরং দেশের জলবায়ু ও পরিবেশের উপরও এক ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনছে।
ওড়িশা, ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ড— এই রাজ্যগুলো দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের খনিজ-অর্থনীতির স্তম্ভ বলে বিবেচিত। বিস্তৃত বনাঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ, এবং একইসঙ্গে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জৈববৈচিত্র্যের আধার।
কিন্তু গত দুই দশকে রাষ্ট্র এবং দেশি-বিদেশি কর্পোরেট সংস্থার সক্রিয় মদতে যে খনিজ আহরণের অভিযান শুরু হয়েছে, তা আজ প্রকৃতির উপর এক চরম আক্রমণে পরিণত হয়েছে। বন উজাড়, জলসম্পদের বিনাশ, আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও বাস্তুচ্যুতি, জৈববৈচিত্র্যের ধ্বংস এবং জলবায়ুর চরম অবনতি— এই সব মিলিয়ে এই অঞ্চল আজ ভারতের অন্যতম পরিবেশগত সংকটাঞ্চল। সরকার যেখানে এই খনন ও অবকাঠামো নির্মাণকে ‘উন্নয়ন’ বলে তুলে ধরছে, সেখানে মাটির মানুষ হারাচ্ছেন তাঁদের জীবন, জীবিকা, ভূখণ্ড— সব কিছু।
ওড়িশা ভারতের অন্যতম খনিজসমৃদ্ধ রাজ্য— যার প্রায় ৫২ শতাংশ এলাকা বনভূমি এবং বহু শতাব্দী ধরে আদিবাসী জনগণের বাসভূমি। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (GSI)-র হিসাব অনুযায়ী, এই রাজ্যে দেশের ৫০ শতাংশ বক্সাইট, ৩৩ শতাংশ লৌহ আকর, ২৮ শতাংশ ম্যাঙ্গানিজ এবং ৯৮ শতাংশ ক্রোমাইট মজুত রয়েছে।[15]
২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ওড়িশা সরকার ১৬০টিরও বেশি বড় মাইনিং প্রকল্প অনুমোদন করেছে, যার ৭০ শতাংশই পড়েছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে। ন্যাশনাল বোর্ড ফর ওয়াইল্ডলাইফ-এর তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে অন্তত ৯,৮৫০ হেক্টর সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হয়েছে।[16] কোরাপুট, কলাহান্ডি, রায়গড়, সুন্দরগড় ও কেওনঝর জেলার পাহাড়, নদী ও জঙ্গল আজ শিল্পাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। এর ফলে ডোংরিয়া কন্ধ, কুই, ভূইয়া, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠীর জীবিকা ও পরিবেশগত নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হয়েছে। নিয়ামগিরি পাহাড়ে বেদান্ত গোষ্ঠীর বক্সাইট খনির পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আদিবাসীদের প্রতিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট স্থানীয় গ্রামসভার সম্মতিকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার রায় দিলেও, ২০১৯ সালে সেই প্রকল্প আবারও পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চলে। একইভাবে কন্ধাধর জলপ্রপাত অঞ্চলে জিন্দাল ও জেএসডব্লিউ-কে খনি বরাদ্দ দেওয়ার সময়েও স্থানীয় জনগণের সম্মতি নেওয়া হয়নি। ওড়িশা বন বিভাগের হিসাব বলছে, এসব প্রকল্পের কারণে অন্তত ১,৫০,০০০ পরিবার সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং প্রায় ৭৫,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
২০২০ সালের ফরেস্ট ক্লিয়ারেন্স মনিটরিং রিপোর্টে বলা হয়েছে, খনিজ পরিবহণের জন্য নির্মিত রাস্তা ও রেললাইনের ফলে বন্যপ্রাণীর চলাচলের করিডোর সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে হাতি ও চিতাবাঘের গুরুত্বপূর্ণ চলাচলপথ নষ্ট হয়ে গেছে।[17]
এছাড়া জিন্দাল ও জেএসডব্লিউ-র খনি-সংলগ্ন এলাকায় পরীক্ষিত ভূগর্ভস্থ জলে আয়রন ও আর্সেনিকের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত সীমার তুলনায় গড়ে তিন গুণ বেশি পাওয়া গেছে।

ছত্তিশগড়, বিশেষত তার দক্ষিণাঞ্চল, গত এক দশকে কয়লা ও লৌহ আকর খননের কারণে ভারতের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। হাঁসদেও আরান্দ নামে পরিচিত প্রায় ১,৭০,০০০ হেক্টর জঙ্গল একদিকে দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল, অন্যদিকে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী বসতি। ২০১০ সালে কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক হাঁসদেওকে ‘নো-গো জোন’ হিসেবে ঘোষণা করলেও, পরে একে একে পাঁচটি কয়লা ব্লকের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে প্রায় ১,৯৫০ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়েছে। আদানি গোষ্ঠী পরিচালিত পারসা ইস্ট কান্তা বসন (PEKB) ও পারসা কয়লা ব্লক ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়দের প্রতিবাদ চলেছে। তবুও ছত্তিশগড় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের চাপে একাধিকবার Forest Clearance দিয়েছে। Central Empowered Committee-র রিপোর্ট অনুযায়ী, হাঁসদেও অঞ্চলে বনভূমি উচ্ছেদের ক্ষেত্রে একাধিক আইন লঙ্ঘিত হয়েছে। বিশেষ করে, গ্রামসভাগুলোর জাল নথি ব্যবহার করে ‘সম্মতি’ দেখানোর ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। ‘হাঁসদেও বাঁচাও’ আন্দোলনের সময় ৩২টি গ্রাম একত্রিত হয়ে জঙ্গল রক্ষার দাবিতে সনদ দেয়। তা সত্ত্বেও ফালুনি, হরিৎ প্রহরী ও সাঁওতালবাহাল এলাকায় খনন কাজ শুরু হয়েছে।[18]
ছত্তিশগড়ের কোরবা, রায়গড় ও সরগুজা জেলাগুলিতে খনির কারণে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর গত ১২ বছরে গড়ে ৩.৪ মিটার নিচে নেমেছে। বর্তমানে অন্তত ১৮টি গ্রামে জল সরবরাহ ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে করা হচ্ছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তথ্য অনুসারে, কোরবা জেলার পাঁচটি নদীতে বিপজ্জনক মাত্রায় সালফার ও নাইট্রেট পাওয়া গেছে। আদানি পাওয়ার-এর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বারবার সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনও আইনানুগ ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি।[19] প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ-র মতো কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়েছে, যার ফলে প্রশাসন আন্দোলনের কণ্ঠরোধে সফল হয়েছে।[20]

অন্ধ্রপ্রদেশে খনিজ সম্পদের সদ্ব্যবহারের বদলে একাধিপত্যমূলক মডেলে খনন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যার ফলে আরাকু, গালিকোন্ডা, বিশাখা এজেন্সি অঞ্চল, অনন্তপুর ও কুর্নুল জেলার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল প্রাকৃতিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। বক্সাইট, গ্রানাইট, লাইমস্টোন এবং কোয়ার্টজের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২০১০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে রাজ্যে ৬৮টি নতুন খনিপ্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। Eastern Ghats Alliance-এর তথ্য অনুযায়ী, এই বক্সাইট প্রকল্পগুলোর ৮০ শতাংশই সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে এবং অনেক ক্ষেত্রেই পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই খনন চলছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল AnRAK Aluminium প্রকল্পটি, যা UAE এবং Ras-al-Khaimah-এর বিনিয়োগে পরিচালিত। এই প্রকল্প আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণ এবং বনের অধিকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এগোচ্ছে।[21]
বিশাখাপত্তনম জেলার পদ্মাপুরাম, চিন্তাপল্লী এবং সিলেরো অঞ্চলে অন্তত ১৪টি জলপ্রপাত সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে— যেগুলো আগে স্থানীয় জনগণের পানীয় জল ও সেচের উৎস ছিল। রাজ্য ভূগর্ভস্থ জল পর্ষদের রিপোর্ট অনুযায়ী, চিত্তোর ও অনন্তপুর জেলার ২১টি গ্রামে ভূগর্ভস্থ জল এতটাই দূষিত হয়েছে যে তা কিডনির রোগের এক প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপুষ্টি এবং সংক্রামক রোগের প্রকোপ বেড়েছে, আর স্থানীয় চিকিৎসাব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে।
জল, জঙ্গল ও জমির উপর ঐতিহাসিকভাবে গ্রামসভাগুলোর যে অধিকার ছিল, বনাধিকার আইনকে উপেক্ষা করে আজ সেই ভূমিকা কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে।

মহারাষ্ট্রে খনিজ আহরণের ফলে যে পরিবেশগত ও সামাজিক বিপর্যয় ঘটছে, তা তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত হলেও বাস্তবে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। গড়চিরোলি, গোঁদিয়া, চন্দ্রপুর ও ভান্ডারা জেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলে গড়ে ওঠা খনিগুলি হাতি, চিতাবাঘ, বাঘ এবং ময়ূরের প্রাকৃতিক আবাসস্থলে সরাসরি আঘাত করছে। ২০২৩ সালের পরিবেশ মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী, শুধু গড়চিরোলি জেলাতেই প্রায় ৩,৮৪০ হেক্টর বনভূমি খনিজ অনুসন্ধান ও রাস্তা নির্মাণের জন্য উজাড় হয়েছে। লয়েড মেটালস, জিন্দাল ও সেসা গোয়া গোষ্ঠীর খনিগুলোর বিরুদ্ধে বহুবার পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।[22]
গড়চিরোলির নারোত্তম ও পেরপাল গ্রামে ২০২৪ সালের গ্রীষ্মে তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রিতে পৌঁছেছে। ওই বছর সাতটি জঙ্গলসংলগ্ন গ্রামে ব্যাপক দাবানল ছড়িয়ে পড়ে, যা বনভূমি ও কৃষিজমিকে ভস্ম করে দেয়। বন অধিকার আইনের বিধান অনুযায়ী, গ্রামের সম্মতি ছাড়া কোনও খনি প্রকল্প অনুমোদিত হতে পারে না। কিন্তু ২০২১ সালের সরকারি অডিট রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে, অন্তত ৩৬টি খনির ক্ষেত্রে কোনও গ্রামসভা গঠনই করা হয়নি। পরিবেশ আইনজীবীদের অভিযোগ, মহারাষ্ট্র সরকার ও জেলা প্রশাসন একাধিকবার Forest Clearance পাওয়ার জন্য জাল নথি ব্যবহার করেছে। হিউম্যান রাইটস ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে খনি-সংলগ্ন অঞ্চলে ১৪৮ জন আদিবাসী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন, যাঁদের অনেকেই ছিলেন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারী।

এই চারটি রাজ্য মিলে ভারতের খনিজ জোগান ব্যবস্থার মেরুদণ্ড গড়ে তুললেও, সেই জোগানের বিনিময়ে আদিবাসী সমাজ ও পরিবেশকে যে মূল্য চুকাতে হচ্ছে, তা গভীরভাবে অমানবিক। উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক সম্পদের এই একতরফা শোষণ শুধু বন ও জল নয়, দেশের নৈতিক ভিত্তিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যে রাষ্ট্র তার জনজাতিদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, সেই রাষ্ট্রই আজ কর্পোরেট স্বার্থে আদিবাসী অস্তিত্বকে মুছে দিতে উদগ্রীব। খনিজ আহরণ ও রপ্তানির এই অন্ধ, নীতিহীন সংস্কৃতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে ভারতের ভবিষ্যৎ কেবল পরিবেশগত সংকটে নয়— এক গভীর সামাজিক বিপর্যয়ের দিকেও ধাবিত হবে।

[1] ভারতের মাওবাদী এলাকা ও খনিজ ভাণ্ডার:
- Central Mineral Belt (চোটা নাগপুর-ওড়িশা প্ল্যাটো): মহারাষ্ট্র, চোটা নাগপুর (ঝাড়খণ্ড), ওড়িশা এবং ছত্তিশগড়— এই অঞ্চলে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ: কয়লা, লৌহ আকর, বক্সাইট, ম্যাঙ্গানিজ, ইউরেনিয়াম, সোনা, লাইমস্টোন ইত্যাদি।
- কয়লা: ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ছত্তিশগড় একত্রে ভারতীয় কয়লার প্রায় ৭০% সংরক্ষণ করে।
- লৌহ আকরিক: ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড়েই “হেমাটাইট ওর বেল্ট” ভারতের হেমাটাইট আকরের প্রায় ৭৯% কেন্দ্র করে।
- বক্সাইট: ওড়িশা সবচেয়ে বড়, এছাড়া ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ডে আছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বক্সাইট।
- অন্য খনিজ যেমন ক্রোমাইট, অভ্র, চুনাপাথর, গ্রাফাইটের উপস্থিতিও এই বেল্টে ভরপুর।
আগ্রহী পাঠকরা জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র ওয়েবসাইট দেখতে পারেন।
[2] Das, R Krishna. Balco to boost bauxite production in Chhattisgarh mines. Business Standard. Dec 7, 2016; Adani sets up contract mining arm to extract iron ore at Bailadila for NMDC joint venture. IM. Sep 24, 2018.
[3] Annual Report, 2019-20. NITI Aayog.
[4] Initiatives to Promote Exploration and Processing of critical minerals. Ministry of Mines.
[5] Sundar, Nandini. At War With Oneself: Constructing Naxalism as India’s Biggest Security Threat, India’s contemporary security challenges. ed. Kugelman, Michael. Woodrow Wilson Centre for Scholars, Asia Programme. p 46.
[6] Navlakha, Gautam. ‘Days and Nights in the Maoist Heartland’. Economic and Political Weekly, Vol.XLV, no.16. Apr 17, 2010. pp.38-47.
[7] Chourasia, Srishti. Years of oppression in the name of “development:” A tale of ongoing human rights violations in Bastar. The Polis Project. Sep 2, 2021.
[8] পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের ছাড়পত্র দ্রুত মঞ্জুর হয়েছে, গ্রামসভার আপত্তিও উপেক্ষিত— উদাহরণ: Niyamgiri Bauxite Mining প্রকল্প। পড়ুন: Niyamgiri. wikipedia.org.
PESA ও FRA অনুযায়ী গ্রামসভার সম্মতি বাধ্যতামূলক হলেও, ঝাড়খণ্ড-সহ বিভিন্ন রাজ্যে তা উপেক্ষিত হয়েছে। পড়ুন: Sarma, AS. How can the Ministry of Mines force Jharkhand State to auction valuable mineral blocks to private companies, violating the letter and the spirit of PESA/FRA Act? Countercurrents.org. Jul 15, 2024.
এগুলির ভিত্তিতে ২০১৫–২১ পর্যন্ত ১০৮টি, ২০২১ থেকে বর্তমান পর্যন্ত ৩৩৩টি, মোট ৪৪১টি খনিজ ব্লক নিলামে আনা হয়েছে; ২৪টি ক্রিটিক্যাল ব্লক‑এর নিলাম-ক্ষমতা কেন্দ্র পেয়েছে ২০২৩ সালের MMDR সংশোধনের পর। পড়ুন: Auction for Critical Mineral Blocks. Ministry of Mines. Jul 31, 2024.
[9] Sinha, Rabindra Nath. Bailadila Iron Ore Mining: Why Adivasis Prefer NMDC Over Adani. Newsclick. Jun 17, 2019.
[10] বিস্তারিত জানতে পড়ুন:
- IN THE NAME OF DEVELOPMENT: INDIGENOUS RIGHTS VIOLATIONS AND SHRINKING SPACE IN CHHATTISGARH. ECCHR.
- Violation of Civil and Political Rights of Indigenous Peoples in India. A submission to the UN Human Rights Committee for India’s forthcoming ICCPR review (2024).
- Subramaniam, Malini. To clear way for mining, did Dantewada administration fake approval from a village council? Jun 24, 2019.
- Drolia, Rashmi. Chattisgarh tribals launch massive protest to protect ‘sacred hill’ from mining. TOI. Jun 8, 2019.
[11] পসকো-বিরোধী আন্দোলন নিয়ে আগ্রহী পাঠক আর একবার ঝালিয়ে নিতে পারেন:
- Orissa police shoot POSCO protesters. MAC. May 20, 2010.
- Vijayalakshmi, TN. Pre-dawn police crackdown on village at POSCO site. Down to Earth. Feb 4, 2013.
- Sahu, Priya Ranjan. Between Two Steel Projects: Why Conflict Is Brewing In A Quiet Odisha Village’s Betel Groves. Article 14. Jan 31, 2022.
- Heightened tensions in Posco Project Area : A fact finding report. Sanhati. May 1, 2013.
[12] পাঠক, পড়ুন:
- সরকার, প্রতিভা। নিয়মগিরির গান। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। মার্চ ২৩, ২০১৯।
- Indigenous Political Assertion on Niyamgiri Hills.
- Battle for Niyamgiri. Down to Earth.
- Anand, Utkarsh. Supreme Court tells Vedanta to get gram sabha nod for Niyamgiri mining. The Indian Express. Apr 18, 2013.
[13] Suchitra, M. Cheated for Bauxite. Down to Earth. Jun 13, 2012.
[14] PUCL Condemns Vizag Police for illegally detaining Civil Liberties Activists. Sanhati. Oct 10, 2014; Spilling Innocent blood: A fact-finding report by PUCL Odisha on Nisanguda killing. Dec 15, 2015.
[15] Renaud, Karine M. The Mineral Industry of India. 2019 Minerals Yearbook: USGS.
[16] Nodal: Diversion of Forest Land. Odisha State Forest Headquarters.
[17] Sharma, Tanvi. ANALYSIS OF FOREST CLEARANCES IN INDIA, 2020 (January-December). LIFE: Clearance Trends Series, Vol IV, No 1. July, 2021.
[18] ভট্টাচার্য, অনির্বাণ। হাসদেও অরণ্য, অলোক শুক্লা এবং গোল্ডম্যান পুরস্কার। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। মে ১৫, ২০২৪।
[19] Das, Ayaskant. Fearing toxic residues, locals fight an Adani coal-power project. Adani Watch. Aug 8, 2024; Khan, Shefali. Forest Cleared Without Consent, Chhattisgarh Adivasis Protest. Newsreel Asia. Jun 29, 2025.
[20] Sharma, Ashutosh. Chhattisgarh’s new BJP government restarts controversial coal mining in Adivasi areas. Frontline. Dec 29, 2023.
[21] Mishra, Prajna Paramita & Reddy, M Gopinath. Bauxite Mining in Eastern Ghats: Mapping the Livelihoods of Affected Communities. CESS Monograph-10. March 2010.
[22] Gadchiroli is bleeding: Stop the mining invasion. Jhatkaa.org. Jun 28, 2025; Green Light To Devastation: Over 1 Lakh Trees To Be Felled In Gadchiroli For Iron Mining, Tribal Displacement Feared. Pune Pulse. Jun 10, 2025; Shaikh, Ashraf. Tuskers in tiger country: Sightings of wild elephants in tiger-dominated Chandrapur signal an ecological shift. Down to Earth. Jul 1, 2025; Anjali & Shubha. Gadchiroli: Police Arrest 21 After ‘Brutal Crackdown’ on 8-Month Adivasi Protest Against Mining. The Wire. Nov 22, 2023.

