সুমন কল্যাণ মৌলিক
পূর্ব-প্রসঙ্গ: গল্প যখন মধ্যবিত্ত
সমস্যা হল, বিশেষজ্ঞরা যে-সব কারণ দেখাচ্ছেন সেগুলো মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশলমাত্র। আজকের ভারতের অর্থনীতির প্রধান সংকট হল আমজনতার ক্রয়ক্ষমতা না থাকা। ২০০০ সালে ভারতের গৃহস্থ সঞ্চয়ের পরিমাণ যা ছিল, ২০২৩ সালে তা অর্ধেক হয়ে গেছে। এই ক্রয়ক্ষমতাহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেশ আজ তাই বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে না
নব্বইয়ের দশকে ‘উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-ভুবনায়ন’-এর স্লোগানকে বীজমন্ত্র ঠাউরে আমাদের দেশে যে নয়া অর্থনৈতিক সংস্কারের পর্ব শুরু হয়েছিল, তার একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল এফডিআই (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট/প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ)-এর স্বপ্ন ফেরি। এই স্বপ্নের মোদ্দা কথা ছিল— আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ যদি বাণিজ্য, শ্রম, উৎপাদন, কর সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলো তুলে দেয় (এগুলিই ছিল আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়ে ওঠার সহজপাঠ), তাহলে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো থেকে রাশি রাশি পুঁজি ভারতে আসবে। সেই টাকায় গড়ে উঠবে শিল্প, হবে কর্মসংস্থান, সর্বোপরি বিদেশিদের টাকায় ও উন্নত প্রযুক্তির জোরে আমরা আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠব।
সেই দিন থেকে তিন দশক অতিক্রান্ত। কেন্দ্রে ও রাজ্যে নানা রঙের সরকার এসেছে, কিন্তু এফডিআই নামক বীজমন্ত্রটির জপ থামেনি। প্রথমে আস্তে আস্তে, পরে রাজধানী এক্সপ্রেসের গতিতে শুরু হয়েছে দরজা খোলার পালা। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এফডিআইয়ের খোঁজে বারংবার বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন; প্রতিবছর রাজ্য সরকারগুলো বিজনেস সামিট আয়োজন করছে; নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভেসে যাচ্ছে আমার স্বদেশ। বাস্তবে, আজ আমাদের দেশে সামরিক, শিক্ষা, বিমা, কৃষি— এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে বিদেশি বিনিয়োগ স্বাগত নয়। ‘ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস’-এর নামে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে ভারতকে বিদেশি পুঁজির অবাধ চারণক্ষেত্রে পরিণত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রংবেরঙের শাসকদল।
এখনও পর্যন্ত এই গল্পে কোনও জটিলতা ছিল না। আর এই বিদেশি বিনিয়োগের অসীম কৃপায় আদৌ কর্মসংস্থান হয়েছে কি না, বা আমাদের দেশে বিদ্যমান অসাম্যের কোনও পরিবর্তন হয়েছে কি না, কিংবা সম্পদ আরও কজনের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়েছে কি না— তা নিয়ে তর্ক বৃথা। কারণ এই সাধারণতন্ত্রে শাসকের নীতিকে প্রশ্নহীন আনুগত্যে মেনে নেওয়াই প্রজার কর্তব্য!
বর্তমান নিবন্ধ বরং একটি অন্য বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করতে চায়, যা ইতিমধ্যেই কর্পোরেট দুনিয়া তথা দেশের আর্থিক মহলে শোরগোল ফেলেছে। ২০২৫ সালের মে মাসে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক বুলেটিনে বলা হয়েছে, ভারতে নেট বিদেশি বিনিয়োগ বিগত আর্থিক বছরের তুলনায় ৯৬.৫ শতাংশ কমে গেছে।[1] অঙ্কের হিসাবে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে হয়েছে মাত্র ৩৫৩ মিলিয়ন ডলার।
এই তথ্যের তাৎপর্য হল— ভারতকে পৃথিবীর উন্নত দেশ ও কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলোর কাছে ‘বিনিয়োগের সেরা গন্তব্য’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার যে প্রক্রিয়া উপর্যুপরি শাসকদল, বিশেষ করে ২০১৪-পরবর্তী কর্পোরেট-বান্ধব মোদি সরকার চালিয়ে যাচ্ছে— তা আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে। আমাদের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন অর্থনীতি প্রসঙ্গে তাঁর বিভিন্ন ‘বুদ্ধিদীপ্ত’ মন্তব্যের জন্য বারবার শিরোনামে এসেছেন। এফডিআই হ্রাস প্রসঙ্গেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। ওয়াশিংটন শহরে আয়োজিত এক সভায় তিনি পরম সরলতায় প্রশ্ন করেন— কারা এই বিনিয়োগকারীদের ভারতে বিনিয়োগ করতে বাধা দিচ্ছেন? যে দেশ কোনও নীতিবৈকল্যে ভুগছে না, যেখানে সংস্কার পূর্ণ গতিতে চলছে, সেখানে কেন বিনিয়োগ আসবে না?[2] এরপর তিনি সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের তুলনা করেন রামায়ণের বীর হনুমানের সঙ্গে— যাঁরা নিজেদের অসীম ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন নন।[3] যদিও নির্মলাজিকে বোঝানো কঠিন যে রামের প্রতি হনুমানের আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একমাত্র দায়বদ্ধতা মুনাফার প্রতি; তাই পরিস্থিতি প্রতিকূল মনে হলে বা আরও লাভজনক বাজারের সন্ধান পেলে পুঁজি সরে যেতে সময় নেয় না।
পরিসংখ্যান অনেক সময় মূল আলোচনাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে, কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের সংখ্যার দিকেই নজর ফেরাতে হবে। প্রথমে আমরা কয়েকটি সাধারণ বিষয়ের দিকে তাকাব।
দেশের মধ্যে বাইরে থেকে যে বিনিয়োগ আসে, তাকে বলে Inward FDI inflows। এর মধ্যে কয়েকটি উপাদান থাকে। প্রথমটি হল নতুন এফডিআই, যা স্বয়ংক্রিয় এবং সরকারি পথ মেনে সংশ্লিষ্ট বছরে দেশে আসে। দ্বিতীয়টি হল Capital repatriation/disinvestments। এর অর্থ হল, কোনও বিদেশি বিনিয়োগকারী তার অংশীদারি (স্টেক) পুরোটা বা আংশিকভাবে কোনও দেশীয় বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করে দিল। তৃতীয় বিষয়টি হল retained/reinvested earnings। মানে, বিদেশি বিনিয়োগকারী তার আয়ের লভ্যাংশ দেশ থেকে না তুলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রেই তা পুনর্বিনিয়োগ করল।
এবার আরেকটি বিষয় হল Outward FDI। এর মানে, ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা একই প্রক্রিয়া মেনে অন্য দেশে বিনিয়োগ করছেন।
এই প্রেক্ষিতে ২০২৪–২৫ অর্থবর্ষের চিত্রটা দাঁড়াচ্ছে এইরকম:
দেশে আসা মোট বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১.০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু এই অঙ্কের মধ্যে থেকে repatriation ও outward FDI (অর্থাৎ বিদেশি বিনিয়োগকারীর স্টেক বিক্রি এবং ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের বিদেশে বিনিয়োগ) বাদ দিলে, নেট এফডিআই কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নেট এফডিআই-এর কমে যাওয়াটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দি অর্গানাইজেশন ফর ইকনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (OECD) ২০২৪ ক্যালেন্ডার বর্ষে ইনওয়ার্ড ও আউটওয়ার্ড এফডিআই সংক্রান্ত কিছু আন্তর্জাতিক তথ্য প্রকাশ করেছে।[4] এই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী—
- ২০২০ সালে ভারতের এফডিআই ছিল ৬৪.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার,
- ২০২১ সালে ৪৪.৭৩ বিলিয়ন ডলার,
- ২০২২ সালে ৪৯.৯৪ বিলিয়ন ডলার,
- ২০২৩ সালে ২৮.০৮ বিলিয়ন ডলার, এবং
- ২০২৪ সালে ২৭.৬১ বিলিয়ন ডলার।
অর্থাৎ, বিষয়টি ধারাবাহিক।

ভারতের প্রাক্তন অর্থসচিব সুভাষ চন্দ্র গর্গ খুব সহজভাবে এই পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেছেন। ২০২৩–২৪ অর্থবর্ষে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ভারতে এফডিআই এসেছে ৭০.৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে বিলগ্নীকরণ বা স্টেক বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৪.৪৭ বিলিয়ন ডলার। এই অঙ্ক বাদ দিলে নেট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ২৬.৪৭ বিলিয়ন ডলার। এই ২৬.৪৭ বিলিয়ন ডলারের মধ্যেই আবার পুনরায় লগ্নিকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ১৯.৭৭ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং, নতুন লগ্নি দাঁড়াল— (৭০.৯৪ – ৪৪.৪৭ – ১৯.৭৭) = ৬.৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মাত্র।[5]
একই ফর্মুলায় হিসেব করলে, ২০২২–২৩ অর্থবর্ষে নতুন এফডিআই ছিল ২২.৯০ বিলিয়ন ডলার, ২০২১–২২ অর্থবর্ষে ছিল ৩৬.৮৮ বিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে, উল্টোদিকের চিত্রটাও একইরকমের গণ্ডগোলের। ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে বিদেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
এই তথ্যগুলোকে যদি আর-একটু বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে স্থাপন করি, তাহলে ছবিটা আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
জিডিপির শতাংশের বিচারে ভারতের এফডিআই প্রবাহ ছিল—
- ২০২০ সালে ২.৪ শতাংশ,
- ২০২১ সালে ১.৪ শতাংশ,
- ২০২২ সালে ১.৫ শতাংশ, এবং
- ২০২৩ সালে ০.৮ শতাংশ।
ক্ষেত্রভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে—
- পরিষেবা খাত পেয়েছে ১৬ শতাংশ,
- কম্পিউটার সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ১৫ শতাংশ,
- ট্রেডিং ৬ শতাংশ এবং
- অটোমোবাইল খাত ৫ শতাংশ।
এই ক্ষেত্রবিশ্লেষণ স্পষ্ট করে দিচ্ছে— চিনকে হঠিয়ে পৃথিবীর ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হয়ে ওঠার স্বপ্ন এখনও কেবল দিবাস্বপ্ন।
অঞ্চলভিত্তিক বিচারে দেখা যায়, বিদেশি বিনিয়োগ দেশের অধিকাংশ রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলকে স্পর্শই করেনি। আজও মহারাষ্ট্র দেশের সিংহভাগ বিনিয়োগের (৩০ শতাংশ) গন্তব্য। তার পরে রয়েছে কর্নাটক (২২ শতাংশ), দিল্লি ক্যাপিটাল রিজিয়ন (১৩ শতাংশ), গুজরাত (৭ শতাংশ) এবং তামিলনাড়ু (৫ শতাংশ)।
অন্যদিকে, ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টর (FPI)-রাও এখন ধীরে ধীরে ভারত থেকে তাঁদের পুঁজি তুলে নিতে শুরু করেছেন। শুধু ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধেই FPI বিনিয়োগকারীরা তুলে নিয়েছেন ৩৩,৯২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে টেকনোলজি স্টক থেকে ১৩,৮২৮ কোটি, আর্থিক খাত থেকে ৪,৫০১ কোটি এবং ক্যাপিটাল গুডস থেকে ৩,০১৯ কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার পূর্বে উল্লিখিত মে মাসের বুলেটিন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এবারের স্টেক বিক্রির প্রধান কুশীলবরা হল— আলফা ওয়েভ গ্লোবাল পার্টনারস (যারা সুইগি ও বিশাল মেগা মার্ট-এর স্টেক বিক্রি করেছে), সিংটেল (এয়ারটেলের স্টেক বিক্রি) এবং হুন্ডাই মোটর কোম্পানির প্রোমোটাররা।
উপরিউক্ত তথ্যগুলো এফডিআই-র ক্ষেত্রে যে ধারাবাহিক অবনতির ছবি স্পষ্ট করে, তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি তথ্য হল— পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে বিজ্ঞাপিত ভারতের বিনিয়োগ-পছন্দের তালিকায় বর্তমান স্থান ১৫তম।
অবশ্যই, এ-কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে কোভিড-পরবর্তী বিশ্ব-বাস্তবতা এবং ক্রমাগত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এফডিআই হ্রাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এই প্রেক্ষাপটে, যাঁরা ভারত ও চিনের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ক্রমাগত প্রতিতুলনায় বিশ্বাসী, তাঁরা চিনের উদাহরণ তুলে ধরছেন। তাঁদের বক্তব্য— চিনের ক্ষেত্রেও এফডিআই কমছে। OECD-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২১ সালে চিনের ইনওয়ার্ড এফডিআই ছিল ৩৪৪.০৮ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২২ সালে ১৯০.২০ বিলিয়ন ডলার, ২০২৩ সালে ৫১.৩৪ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালে মাত্র ১৮.৫৬ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। এটা সত্য, কোভিড-পরবর্তী সময়ে মার্কিন পুঁজি চিন থেকে সরে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু এর ফলে চিনে কোনও সংকট দেখা দেয়নি, কারণ চিন আজ তার আর্থিক শক্তির জোরে আউটওয়ার্ড এফডিআই অর্থাৎ বিদেশে বিনিয়োগের দিকে আরও বেশি আগ্রহী। ২০২৪ সালে সারা বিশ্বের আউটওয়ার্ড এফডিআই-এর মোট পরিমাণ ছিল ১.৬১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে চিনের অংশীদারিত্ব ছিল ১৭২.২৪ বিলিয়ন ডলার, বিশ্বে দ্বিতীয়। প্রথম স্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যার অঙ্ক ২৯৮.৯৮ বিলিয়ন ডলার। সত্যি কথা বলতে, আজ ভারতের এফডিআই প্রয়োজন, চিনের নয়।
বরং, আমাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত সেই দেশগুলোর দিকে, যাদের অভ্যন্তরীণ বাজার তুলনায় অনেক ছোট হলেও তারা আমাদের থেকে অনেক বেশি এফডিআই আকর্ষণ করছে। এই দেশগুলো হল— ব্রাজিল: ৫৯.১৮ বিলিয়ন ডলার, ইন্দোনেশিয়া: ২৪.২১ বিলিয়ন ডলার, অস্ট্রেলিয়া: ৬৪.০৬৭ বিলিয়ন ডলার, এবং ছোট্ট দেশ ভিয়েতনাম: ২৫.৩৫ বিলিয়ন ডলার।
এখন প্রশ্ন হল— কর্পোরেট দুনিয়ার চাহিদা মেনে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ‘দ্বার খোলো’ নীতি নেওয়া সত্ত্বেও ভারত কেন এফডিআই আকর্ষণ করতে পারছে না? এই প্রশ্নের উত্তরে নয়া উদারবাদী অর্থনীতির প্রবক্তারা কয়েকটি গৎবাঁধা ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন।
প্রথমত, তাঁদের মতে, এর জন্য দায়ী লালফিতের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। অনেকে দাবি করেন— বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভারতে বিনিয়োগ করতে গেলে ১৫৩৬টি আইন ও বিধি, ৬৯,২৩৩টি নিদর্শ, এবং ৬,৬১৮টি বার্ষিক ফাইলিং সম্পন্ন করতে হয়। কিন্তু বাস্তবে এটা সত্যের অপলাপ মাত্র, কারণ আজকের দিনে অধিকাংশ শিল্পক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ‘সিঙ্গল উইন্ডো ব্যবস্থা’ চালু করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, অনেকে শ্রম আইনের কথা বলেন। কিন্তু বাস্তবতা হল— আজ সারা দেশে শ্রমিকরা তাঁদের অর্জিত অধিকার হারাচ্ছেন, যার চূড়ান্ত পরিণতি নয়া শ্রমকোড। ফলে, বিনিয়োগে বাধা নয়, বরং শ্রমিকস্বার্থেই রক্ষাহীনতা প্রকট।
তৃতীয়ত, অর্থনীতিবিদদের একটি অংশের মতে— ২০১৮-১৯ সাল থেকে চালু হওয়া ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ ও ‘প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ (PLI)’ প্রকল্প— যার উদ্দেশ্য ছিল চিনের পরিবর্তে ভারতকে বিনিয়োগের প্রথম পছন্দ করে তোলা— তা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে, ব্যাটারি, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ, সোলার সেল প্রভৃতি উদীয়মান শিল্পে ভারতের বদলে ভিয়েতনামই হয়ে উঠেছে বিনিয়োগকারীদের অধিক পছন্দের দেশ।
চতুর্থত, ২০২১-২২-পরবর্তী সময়ে পরিকাঠামো খাতে সরকারি বিনিয়োগ, যা বিদেশি লগ্নি টানার আকর্ষণ করতেই করা হয়েছিল, তা প্রত্যাশিত ফল দেয়নি।
পঞ্চমত, ‘আত্মনির্ভর ভারত’ ও ‘ভোকাল ফর লোকাল’ নীতিকে রক্ষা করতে গিয়ে সরকার যে কর কাঠামো তৈরি করেছে, তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিতে ভারতকে বিনিয়োগবান্ধব দেশ হিসেবে মান্যতা দেয়নি।
ষষ্ঠত, অনেকের মতে ভারতীয় শ্রমশক্তির উৎপাদনক্ষমতা কম, তাই তা আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
সমস্যা হল— উল্লিখিত কারণগুলো মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশলমাত্র। আজকের ভারতের অর্থনীতির প্রধান সংকট হল আমজনতার ক্রয়ক্ষমতা না থাকা। ব্লুম রিসার্চের সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০০০ সালে ভারতের গৃহস্থ সঞ্চয়ের পরিমাণ যা ছিল, ২০২৩ সালে তা অর্ধেক হয়ে গেছে। অন্যদিকে, ২০০০ সালে আর্থিক দায় ছিল জিডিপির ২ শতাংশ, যা ২০২৪ সালে বেড়ে হয়েছে ৫.৮ শতাংশ।[6]
এই ক্রয়ক্ষমতাহীন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেশ আজ তাই বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করছে না। যদি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা থাকত, তাহলে দেশীয় বিনিয়োগকারীরাই উৎসাহী হতেন, দেশের বদলে বিদেশকে তাঁদের বিনিয়োগের গন্তব্য ভাবতেন না।
আরেকটি বড় সমস্যা হল— বিদেশি বিনিয়োগ টানার জন্য বিগত কয়েক বছরে ভারত একের পর এক দেশের সঙ্গে ‘ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট’ (FTA) করেছে। তাতে বিদেশিরা এ-দেশে সরাসরি বিনিয়োগ না করে কেবল পণ্য রপ্তানির মাধ্যমেই ভারতীয় বাজার দখলে নিতে আগ্রহী হচ্ছে। পরিসংখ্যান বলছে— ২০২০-২২ পর্বে, আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ৩০০ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে ১৬১ শতাংশ এবং জাপানের সঙ্গে ১৩৮ শতাংশ।
এই পরিস্থিতি আসলে আমাদের সামনে একটি বিকল্প পথের ডাক দিচ্ছে— একটি অভ্যন্তরীণ বাজারনির্ভর দেশীয় অর্থনীতির বিকাশের পথ। এই পথ না নিয়ে, কেবল এফডিআই-নির্ভর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির স্বপ্নে ভরসা রাখলে, ‘দিন বদল’ কেবল স্লোগানই থেকে যাবে— বাস্তবে তার কোনও প্রতিফলন ঘটবে না।
তথ্যসূত্র:
- Arun, MG. India’s FDI Squeeze. India Today. Dec 2, 2024.
- Zeeshan, Mohammad. India suffering a quiet decline in foreign direct investment. The Diplomat. Mar 18, 2024.
- FPIs withdraw Rs 33,927 crore from Indian market in April, IT and finance hit hardest. The Wire. Apr 19, 2025.
- FDI slump: should India reboot its FDI strategy? Policy Circle. Jun 27, 2024.
[1] India’s Net Foreign Direct Investment Plummets by 96.5% to Reach Record Low. The Wire. May 23, 2025.
[2] Bhatia, Ruchi. ‘What Is Holding Investors Back?’ India’s Sitharaman Asks. Bloomberg. Oct 26, 2024.
[3] FM Sitharaman in US: Nothing stops investments from coming to India… no red tapes, only red carpets. ET Online. Oct 26, 2024.
[4] Measuring foreign direct investment. OECD.
[5] Garg, Subhash Chandra. Why FDI investors are turning away from India. The Tribune. May 13, 2025.
[6] India’s declining household savings amid reduced FDI is big concern: Report. Economic Times. Mar 1, 2025.
[ক্রমশ]

