চক্রব্যূহে ভারতের অর্থনীতি— গল্প যখন মধ্যবিত্ত

সুমন কল্যাণ মৌলিক

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: প্রস্তাবনা


বিশ্বায়নের সূচনাপর্বে বলা হয়েছিল, মধ্যবিত্তরা এক উজ্জ্বল জীবনের স্বপ্ন দেখে— যা তারা এতদিন এ-দেশে পায়নি। তিন দশক ধরে সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে আজ ভারতীয় মধ্যবিত্ত এক দেওয়ালের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। যদি মাইনে না বাড়ে, যদি কাজের সুযোগ না বাড়ে, কিংবা যদি কাজটাই চলে যায়— তবে হাতে টাকার জোগান থাকবে না। ফলত চাহিদা বাড়বে না, আর উৎপাদনও বাড়বে না। এইভাবে অর্থনীতি ঘুরপাক খাবে এক বিষচক্রে। আসলে, ইতিহাস বলে, ওই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়— সেটাই বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি

 

দৃশ্যটা এ-বছরের বাজেট বক্তৃতার শেষ পর্ব। খানিক বিরতি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা— ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ের মানুষদের কোনও আয়কর লাগবে না।[1] উল্লাসে ফেটে পড়ল সংসদ; সেই উল্লাস যেন শতগুণ হয়ে ধ্বনিত হল সরকারি ও কর্পোরেট অফিসে, স্কুল-কলেজ তথা বাণিজ্য মহলে।

এই ঘোষণার সময় মাননীয়া অর্থমন্ত্রীর একটা কথা কারও নজর এড়ায়নি। নির্মলা সীতারামণ বললেন, তাঁদের সরকার ‘মধ্যবিত্তদের উপর বিশ্বাস রাখছে’। এই ‘পরম বিশ্বাস’-এর মানে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, যদি অর্থনীতি সম্পর্কে সাধারণ ধারণা থাকে। মোদ্দা কথাটা হল, ১২ লক্ষ পর্যন্ত আয়কারী মানুষদের এই ঘোষণার ফলে যে কর-সাশ্রয় হবে[2], তা মধ্যবিত্তরা বাজারে খরচ করবেন। এই টাকা বাজারে এলে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, পণ্যের বিক্রি বাড়বে, শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন বাড়বে, আর শেয়ারবাজারে— বিশেষ করে এসআইপিতে (সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান)— মানুষ লগ্নি করবেন।

মধ্যবিত্ত মানুষ যদি নির্মলা সীতারামণের বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেন, তবে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা ভারতের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

গরিব মানুষদের জন্য প্রয়োজনীয় সামাজিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোর বাজেট কমিয়ে দিয়ে সরকারের আয়ের একটা অংশকে এইভাবে বাজারে জলাঞ্জলি দেওয়া কতখানি বাস্তবসম্মত ও নৈতিক— সে-প্রশ্ন আপাতত তোলা থাক। আমরা বরং ফিরে যাই আলোচনার প্রথম পর্বে উল্লিখিত কনফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ (CII)-এর সেই স্মারকলিপির কথায়।[3]

এবারের বাজেটে এটা পরিষ্কার, মধ্যবিত্তের আয়করের বোঝা কমিয়ে তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কর্পোরেট দাবিকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে মোদি সরকার। এই বাধ্যতা কোনও নতুন ঘটনা নয়। নব্বইয়ের দশকে সংস্কার অর্থনীতি চালু হওয়ার পর থেকে নয়া উদারনীতির যে কোনও অর্থনৈতিক ভরকেন্দ্রে রয়েছে এই মধ্যবিত্তদের স্বার্থ। উপর্যুপরি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য বেতন কমিশন, পরিষেবা ক্ষেত্রের প্রথম দুই দশকের বৃদ্ধি— সব মিলিয়ে দেশে এক নব-মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম দিয়েছে, যারা কর্পোরেট দুনিয়ার ভাষায় কনজিউমার। ভোগ্যপণ্য থেকে মোটরগাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট থেকে শেয়ারবাজার— সবখানেই এদের ভরসায় পসরার যাবতীয় আয়োজন।

মোট জনসংখ্যার ঠিক কতটা এই শ্রেণি এবং এই শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতার উপর ভর করে ভারতের মতো সুবিশাল দেশের অর্থনীতি টিঁকে থাকতে পারে কি না— তা নিয়ে বিতর্ক যথেষ্ট। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সরকার প্রথমদিন থেকেই এই মধ্যবিত্তকে তাদের গ্রোথ ইঞ্জিন হিসেবে দেখে এসেছে, এবং দেশি ও বিদেশি লগ্নিকারীদের কাছে এই মধ্যবিত্তদের সোনার খনি রূপে উপস্থাপন করেছে।

এ-বছরের বাজেট আরেকবার দেখিয়ে দিল, সেই মধ্যবিত্তরাই আজ সংকটে।

এখন এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি কাদের বলা হয় এবং আমাদের দেশে তাঁদের সংখ্যা কত, তা নিয়ে একটি প্রাথমিক আলোচনা জরুরি। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (OECD)-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, যেসব ব্যক্তি দিনে ১০ থেকে ১০০ মার্কিন ডলার আয় করেন, তাঁদের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে গণ্য করা যেতে পারে।[4] আবার পিপল রিসার্চ অন ইন্ডিয়া’জ কনজিউমার ইকনমি (PRICE)-র মতে, ভারতে যে ব্যক্তির বার্ষিক আয় ৫ লক্ষ থেকে ৩০ লক্ষ টাকার মধ্যে, তাঁকে মধ্যবিত্ত হিসেবে ধরা যেতে পারে।[5] এই ব্যক্তিরা সেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর অন্তর্গত, যাঁদের জীবনে একধরনের আর্থিক স্থিতি রয়েছে— যাঁরা আকস্মিক আর্থিক বিপর্যয়ে সহজে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যান না।

দেশভেদে মধ্যবিত্তের আয় ও সংখ্যায় তারতম্য দেখা যায়। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী চিনে জনসংখ্যার প্রায় ৬১ শতাংশ দৈনিক ১০ মার্কিন ডলার বা তার বেশি আয় করেন। ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডিরেক্ট ট্যাক্সেস-এর পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩-২৪ আর্থিক বর্ষে প্রায় ৮ কোটি মানুষ আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন। তাঁদের মধ্যে ৪ কোটির সামান্য বেশি মানুষের বার্ষিক আয় ছিল ৫ লক্ষ টাকার কিছুটা বেশি।[6] রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ওই বছর ২.৩৫ কোটির বেশি মানুষ আয়কর দিয়েছেন, কিন্তু রিটার্ন দাখিল করেননি। যদি ধরে নেওয়া হয় তাঁদের প্রত্যেকের বার্ষিক আয় ৫ লক্ষ টাকার বেশি, তবে মোট সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে আনুমানিক ৬.৩৫ কোটি। আমরা যদি আরেকটু প্রসারিত করে ভারতের বর্তমান প্রেক্ষিতে বার্ষিক ৫ লক্ষ টাকার বেশি আয় করা নাগরিকের সংখ্যা ১০ কোটির মতো ধরি, তাহলে বলা যায়, এঁরাই নির্মলা সীতারামণের ‘প্রাণভোমরা’— যাঁদের উপর তাঁর এবং তাঁর সরকারের ‘বিশ্বাস’ ভর করে রয়েছে। আর যদি কেউ বার্ষিক আয়ের সীমারেখাটি ৪ লক্ষ টাকায় নামিয়ে ধরেন, তাহলেও সংখ্যাটি ১৪-১৫ কোটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

এখন প্রশ্ন হল, মধ্যবিত্ত নামক এই ‘গ্রোথ ইঞ্জিন’-কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অক্সিজেন জোগানোর প্রয়োজন কেন পড়ছে? সহজ উত্তর— মধ্যবিত্তশ্রেণি আজ দ্রুত তাদের ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে। এই বিষয়ে কর্পোরেট দুনিয়ায় প্রথম বিপদসঙ্কেত তোলেন ম্যাগি, নেসক্যাফে, কিটক্যাট-এর মতো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের মালিক নেসলে ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান সুরেশ নারায়ণ। তিনি প্রথম দেখান যে, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ সেক্টরে সাধারণভাবে যেখানে দুই অঙ্কের বৃদ্ধি দেখা যেত, সেখানে ২০২৪ সালের তিনটি আর্থিক ত্রৈমাসিকে সেই বৃদ্ধি মারাত্মকভাবে কমে গিয়ে ১.৫-২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।[7]

এরপর থেকেই ব্রিটানিয়া, এশিয়ান পেইন্টস, ডাবর, পার্লে-র মতো একাধিক কোম্পানি মধ্যবিত্তের সংকট নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ায় আলোচনা শুরু করে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত হল শহুরে চাহিদার হ্রাস, কারণ চাকরিজীবী এই মধ্যবিত্তশ্রেণির বেশিরভাগই শহরে বাস করে। বিভিন্ন সমীক্ষাও জানাচ্ছে যে ক্রেতাদের জিনিস কেনার ধরনে এমন কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে যা কর্পোরেট মহলে নতুন করে চিন্তার উদ্রেক করেছে। দেখা যাচ্ছে, পরিবর্তিত আর্থিক পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে মধ্যবিত্তরা তাঁদের পছন্দের কর্পোরেট ব্র্যান্ডগুলির পরিবর্তে সস্তা ও স্থানীয় ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকছেন।

এই চাহিদা-হ্রাসের প্রভাব কেবল এফএমসিজি (Fast Moving Consumer Goods) খাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, তা ধীরে ধীরে অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ছে। ২০২৪ সালের দুর্গাপুজো থেকে দীপাবলি পর্যন্ত সময়, যা ভারতে ‘উৎসবের মাস’ হিসেবে পরিচিত, সেই সময়েও অটোমোবাইল সেক্টরে দেখা যাচ্ছে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি— ৭ লক্ষ মিডল ও লোয়ার সেগমেন্টের গাড়ি বিক্রি না হয়ে স্টোরে পড়ে রয়েছে, যার সম্মিলিত বাজারমূল্য প্রায় ৭৯,০০০ কোটি টাকা।[8]

সরকারি পরিসংখ্যানে মধ্যবিত্তের এই সংকট স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। অর্থমন্ত্রকের ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী, এফএমসিজি সেক্টরে চাহিদা দ্রুত কমছে এবং অটোমোবাইল খাতের সার্বিক বৃদ্ধি মাত্র ২.৩ শতাংশে সীমিত হয়ে পড়েছে। ২০২৩-২৪ সালের গৃহস্থালির ব্যয় সংক্রান্ত ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিস (NSSO)-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, মধ্যবিত্ত পরিবারের গড়পড়তা আয়ের প্রায় ৬৫ শতাংশ খরচ হয়ে যাচ্ছে খাবার, বাড়িভাড়া, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো অত্যাবশ্যকীয় খাতে। ফলে খরচ করার মতো অতিরিক্ত টাকা তাদের হাতে থাকছে না।[9]

একই সঙ্গে আরেকটি গুরুতর দিক হল পরিবারপিছু ঋণের হার বৃদ্ধি। দেশের নমিনাল জিডিপির অনুপাতে এই ঋণ মার্চ ২০২৪-এ দাঁড়িয়েছে ১৭.৪ শতাংশ, ২০২৩ সালের মার্চে যা ছিল ১৪.৮ শতাংশ এবং ২০২২ সালের মার্চে ১৪.১৭ শতাংশ।[10] এই ঊর্ধ্বমুখী ঋণের প্রবণতা মধ্যবিত্তের আর্থিক চাপে থাকার একটি বড় ইঙ্গিত।

এ দেশে গরিব মানুষের আর্থিক বিপর্যয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সেভাবে আলোচিত না হলেও মধ্যবিত্তের সংকট বেশ গুরুত্ব দিয়ে জায়গা পায়। যেমন বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা–র ১৪ নভেম্বর, ২০২৪ সংখ্যার এক প্রতিবেদনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সারণী প্রকাশিত হয়, যেখানে তুলে ধরা হয়েছে মধ্যবিত্তের খরচ কমিয়ে দেওয়ার প্রেক্ষাপট:

খরচ কমাচ্ছে মধ্যবিত্ত

অক্টোবরে মূল্যবৃদ্ধির হার: ৬.২১%
খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার: ১০.৮৭%
এক বছরে গড় মূল্যবৃদ্ধি: ৫%, খাদ্যপণ্যে গড় বৃদ্ধি: ৮%
সিটি ব্যাঙ্কের সমীক্ষা বলছে শহরের চাহিদা গত দু-বছরে তলানিতে, উৎসবেও বাড়েনি চাহিদা
৭.২ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধি এখন দূর অস্ত
ব্যাঙ্ক অব আমেরিকার অনুমান বৃদ্ধি আটকাবে ৬.৮ শতাংশে
নথিভুক্ত সংস্থাগুলির মূল্যবৃদ্ধির নিরিখে বেতনবৃদ্ধির হার মাত্র ২%
গত দশ বছরে বেতনবৃদ্ধির গড় মাত্র ৪.৪%

এছাড়াও আরও এক চিন্তার বিষয় হল সঞ্চয়ের হার। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, জিডিপির শতাংশ হিসাবে ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের পরিমাণ গত পঞ্চাশ বছরে এই প্রথম সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে।[11]

এখন প্রশ্ন হল, মধ্যবিত্ত সমাজের এই সংকটের কারণ কী? সাম্প্রতিক সময়ে কর্পোরেট মিডিয়ায় একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, যা বিশ্লেষণ করলে তাদের দিক থেকে এই সংকটের চিত্র পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সৌরভ মুখার্জির প্রতিষ্ঠান মার্সেলাস ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার্স একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যেখানে এই সংকটের পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে।[12]

প্রথমত, মূল্যবৃদ্ধি। বর্তমানে গড়পড়তা মূল্যবৃদ্ধি প্রায় ৬.২ শতাংশ এবং খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে ১০.৯ শতাংশ। যদিও বিভিন্ন আর্থিক ত্রৈমাসিকে মূল্যবৃদ্ধির হার কিছুটা কমবেশি হয়েছে, তবুও জীবনযাত্রার খরচ এখন ঊর্ধ্বমুখী। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড-পরবর্তী সময়ে চিকিৎসার খরচ শুধু বেড়েই যায়নি, উপরন্তু এর উপর ১৮ শতাংশ জিএসটি যোগ হয়েছে। একইভাবে, প্রাইভেট স্কুল, কোচিং ক্লাস, অনলাইন ট্রেনিং— সবই ১৮ শতাংশ জিএসটির আওতায় এসেছে। আর মধ্যবিত্তের নিত্যদিনের যাপনে বাহন, বিশেষত টু-হুইলারে, ট্যাক্সের পরিমাণ ২৮ শতাংশ।

বলবার বিষয়, মধ্যবিত্তের বেশিরভাগ খরচই হয়ে থাকে ইএমআই (ইকুয়াল মান্থলি ইনস্টলমেন্ট)-নির্ভর। তাই এই বাড়তি খরচ সামলানোর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন আয়বৃদ্ধি। আর এখানেই দ্বিতীয় ফ্যাক্টরটি আসে। অর্থনৈতিক সমীক্ষাগুলি (বিশেষ করে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি দ্বারা প্রদত্ত তথ্য) অনুযায়ী, প্রকৃত বেতনবৃদ্ধি গড়পড়তা মাত্র ০.০১ শতাংশ। এখানে ‘প্রকৃত বেতন’ বলতে মুদ্রাস্ফীতির হার হিসাব করে বেতন বৃদ্ধি বোঝানো হচ্ছে। আবার, ফিকি-কিউস কপ সমীক্ষা বলছে যে ২০১৯-২৩-এর মধ্যে বার্ষিক বেতনবৃদ্ধি মূল ক্ষেত্রগুলোতে (এফএমসিজি, আইটি, বিএফএস) ০.৮-৫.৪ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে মধ্যবিত্তশ্রেণি বাধ্য হচ্ছে তাদের চাহিদার কাটছাঁট করতে।[13]

এখানেই আসছে তৃতীয় ফ্যাক্টরটি— নতুন কর্মসংস্থানের অভাব। ছবিটা পাল্টাতে পারত নতুন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে মধ্যবিত্তশ্রেণির পরিধি বৃদ্ধির মধ্যে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল ক্রমবর্ধমান কর্মহীনতা ও নতুন কর্মসংস্থানের অভাব। আমরা পরবর্তী সময়ে এ-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। তবে মার্সেলাসের রিপোর্ট আরেকটি অশনিসঙ্কেত বয়ে আনে মধ্যবিত্তদের জন্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) কারণে যে চাকরিগুলো এখনও আছে, সেগুলোরও বিলুপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে সুপারভাইজার, ক্ল্যারিক্যাল ক্যাডার এবং ব্যাকলাইন স্টাফদের মতো চাকরিগুলো। সম্প্রতি উইপ্রো চেয়ারম্যান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমরা বুঝতে পারছি, একটি বিশেষ ধরনের চাকরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।[14] সৌরভ মুখার্জি সখেদে মন্তব্য করেছেন: “I think the defining flavour of this decade will be effectively, the gradual demise of salary employment as a worthwhile avenue for educated, determined, hardworking people.”[15]

বিশ্বায়নের সূচনাপর্বে বলা হয়েছিল, এই মধ্যবিত্তরা এক উজ্জ্বল জীবনের স্বপ্ন দেখে— একটি এমন জীবন, যা তারা এতদিন এ-দেশে পায়নি। এই কথার মূল অনুপ্রেরণা আসলে জেমস ট্রাসলো অ্যাডামসের বহু-আলোচিত ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর ভারতীয়করণ। ১৯৩১ সালে অ্যাডামস বলেছিলেন: “…that dream of a land in which life should be better and richer and fuller for everyone, with opportunity for each according to ability or achievement.”[16] তিন দশক ধরে সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটতে ছুটতে আজ ভারতীয় মধ্যবিত্ত এক দেওয়ালের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। সোজা কথায়, যদি মাইনে না বাড়ে, যদি কাজের সুযোগ না বাড়ে, কিংবা যদি কাজটাই চলে যায়— তবে হাতে টাকার জোগান থাকবে না। ফলত চাহিদা বাড়বে না, আর উৎপাদনও বাড়বে না। এইভাবে অর্থনীতি ঘুরপাক খাবে এক বিষচক্রে।

নির্মলা সীতারামন আয়করে ছাড় দিয়ে এই দেওয়াল ভাঙার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়— এটাই বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি।

 

সহায়ক নিবন্ধ ও প্রতিবেদন:

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]


[1] বাস্তবে স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন ধরলে পরিমাণটা হবে ১২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা। আয়কর বিভাগের ঘোষিত নতুন কর কাঠামো অনুযায়ী, নতুন রেজিমে ৭ লক্ষ টাকার নিচে কর ছাড় এবং স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন ৫০,০০০ টাকা ধরে কিছু নির্দিষ্ট ধাপে ১২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকার অবধি ছাড় পাওয়া সম্ভব। সূত্র: কেন্দ্রীয় বাজেট বক্তৃতা, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫।
[2] পরিমাণটা গড়পড়তা হিসেবে মাথাপিছু ৬৫-৭০ হাজার টাকা ধরা যেতে পারে।
[3] মৌলিক, সুমন কল্যাণ। চক্রব্যূহে ভারতের অর্থনীতি— প্রস্তাবনা। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। এপ্রিল, ২০২৫।
[4] Under Pressure: The Squeezed Middle Class. OECD.
[5] Gearing Up for a Billion-Plus Middle Class by 2047. PRICE.
[6] Only 6.68% of population filed income tax return in 2023-24 fiscal. The Economic Times. Dec 17, 2024.
[7] FMCG sector facing sluggish demand, F&B growth declines to 1.5-2%: Nestle India CMD. ET Retail.com. Oct 23, 2024.
[8] Car sales in festive season low, vehicles worth ₹79,000 crore lying unsold: Report. Hindustan Times. Oct 30, 2024.
[9] Survey on Household Consumption Expenditure: 2023-24. NSSO.
[10] Agrawal, Ashish. The Great Indian Household Debt Bubble: Fact or Fiction? Financial Express. Apr 15, 2025.
[11] ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের নিম্নমুখী প্রবণতা:

  • ২০২২-২৩ অর্থবছরে, নেট হাউসহোল্ড ফিনান্সিয়াল সেভিংস জিডিপির মাত্র ৫% ছিল, যা গত ৪৭ বছরে সর্বনিম্ন।
  • ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, এই হার সামান্য বেড়ে ৫.৩% হয়েছে, তবে এটি এখনও ঐতিহাসিকভাবে নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
  • এই হ্রাসের পেছনে প্রধান কারণগুলির মধ্যে রয়েছে বাড়তি ঋণের বোঝা এবং ঋণ পরিশোধের জন্য সঞ্চয় ব্যবহারের প্রবণতা।

এই তথ্যগুলি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের “Handbook of Statistics on the Indian Economy” এবং অন্যান্য প্রকাশনায় পাওয়া যায়।
[12] Why is the Indian Middle-Class Suffering? Nov 24, 2024; India’s Middle Class is Losing Ground to the Rich & the Poor. Jan 23, 2025; The Most Indebted People in the World. Mar 5, 2025.
[13] প্রকৃত বেতনবৃদ্ধি মাত্র ০.০১%— India Ratings & Research (Ind-Ra)-এর একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিক থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিক পর্যন্ত ভারতের জাতীয় স্তরে প্রকৃত বেতনবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ০.০১%। এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে প্রকৃত বেতন হ্রাস পেয়েছে। বিস্তারিত পড়ুন: Raghavan, TCA Sharad. Real wages grew just 0.01% over the last 5 years and contracted in Haryana & UP, Ind-Ra report finds. The Print. Nov 28, 2024.

২০১৯-২৩: বিভিন্ন খাতে বেতন বৃদ্ধির হার— FICCI-Quess Corp-এর একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিভিন্ন খাতে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির হার ছিল নিম্নরূপ:

  • FMCG: ৫.৪%
  • IT: ৪.০%
  • BFSI (ব্যাঙ্কিং, ফিনান্স, ইনস্যুরেন্স): ২.৮%
  • রিটেইল: ৩.৭%
  • লজিস্টিকস: ৪.২%
  • EMPI (ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানুফ্যাকচারিং, প্রসেস, ইনফ্রাস্ট্রাকচার): ০.৮%

বিস্তারিত পড়ুন: Das, Yudhajit Shankar. How big corporates are choking middle class, hurting India growth story. India Today. Dec 19, 2024.

এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ২০১৯-২৩ সময়কালে ভারতের কর্পোরেট মুনাফা চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু বেতনবৃদ্ধি স্থবির ছিল। এই বৈষম্য অর্থনীতিতে চাহিদা হ্রাস এবং মধ্যবিত্তশ্রেণির উপর চাপ সৃষ্টি করছে। বিস্তারিত পড়ুন: Brij, Arjun. Corporate Profits Quadruple As Wage Growth Stalls, Raising Concerns For India’s Economy: Report. Swarajya. Dec 12, 2024.
[14] Bakshi, Sameer Ranjan. Former Wipro CEO Thierry Delaporte recaps his four-year stint in email to staff. Economic Times. Apr 8, 2024.
[15] Mukherjee, Anubhav. ‘Death of salaried employment’: Saurabh Mukherjea predicts grim outlook for India’s middle class in this decade. The Mint. Apr 20, 2025.
[16] Adams, James Truslow. The Epic of America, 1931.

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...