জনস্বাস্থ্যের আলোকে ওষুধের বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি (২০২৫)— পথের শেষ কোথায়?

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 


ভারতের প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় এখনও জিডিপি-র ২ শতাংশেরও কম। ফলে সহজেই বোঝা যায়, তার মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য কী নগণ্য অর্থ বরাদ্দ থাকে। মানুষ হিসেবে তাঁরা বেঁচে আছেন, অথচ স্বাস্থ্যের অধিকার তাঁদের নেই! এ এক বিচিত্র রাষ্ট্রীয় ছলনা— কে নেবে এর দায়? কে নেবে সমাধানের দায়িত্ব? তার ওপর আবার ওষুধের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি। কোথায় যাচ্ছি আমরা? কোন পথে হাঁটছি?

 

National Pharmaceutical Pricing Authority (NPPA) সরকারি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, ১ এপ্রিল ২০২৫ থেকে ৯০০-টির বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বাড়বে। তাদের ২৫ মার্চ ২০২৫-এর বিজ্ঞপ্তিতে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে—

The National Pharmaceutical Pricing Authority (NPPA) under the Department of Pharmaceuticals has fixed the ceiling prices of 928 scheduled formulations as on 25.3.2025. Further, as per provisions of the Drugs (Prices Control) Order, 2013 (DPCO, 2013), these ceiling prices of scheduled medicines are revised annually based on the Wholesale Price Index (WPI) (all commodities).[1]

বর্তমান পরিস্থিতিকে বোঝার জন্য আমরা খানিকটা অতীত ঘেঁটে দেখি।

 

অতীতচারণ-১

ভারতীয় সংবাদপত্রের সূত্র অনুযায়ী (১৪ অক্টোবর, ২০২৪), ১১টি অত্যাবশ্যক ওষুধের ওপরে যে মূল্যনিয়ন্ত্রণ থাকে, সেটা তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে, এ ওষুধগুলির ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ অবধি মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। এই ১১টি ওষুধের মধ্যে হাঁপানি, গ্লকোমা, থ্যালাসেমিয়া, টিবির মতো রোগের চিকিৎসার জন্য প্রথম ধাপের (ফার্স্ট লাইন ড্রাগস) ওষুধগুলো রয়েছে। এ-জন্য ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিকাল প্রাইসিং অথরিটিকে এদের নির্দেশিকার ১৯ নম্বর ধারার শরণ নিতে হয়েছে।

এছাড়াও বেনজাইল পেনিসিলিন, অ্যাট্রোপিন, স্ট্রেপ্টোমাইসিন (টিবি ও অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ), সালবিউটামল ট্যাবলেট এবং ইনহেলার (শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহৃত), অ্যান্টিবায়োটিক সেফাড্রক্সিল, থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত ডেসফিরক্সামিন ইনজেকশন, এবং মানসিক রোগের ওষুধ লিথিয়াম ইত্যাদি রয়েছে।

২০২১ সালে ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিকাল প্রাইসিং অথরিটি (এনপিপিএ) ‘এসেনশিয়াল’ ওষুধের তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম ১০.৭ শতাংশ বাড়িয়েছিল। ২০২৩ সালে আগেকার বর্ধিত দামের ‘এসেনশিয়াল’ ওষুধের দাম বাড়ল আরও ১২.১ শতাংশ। ২০২৪ সালে ইতিমধ্যেই বর্ধিত সেই ন্যাশনাল লিস্ট অফ এসেনশিয়াল মেডিসিন-এর তালিকাভুক্ত ওষুধের দাম বাড়ল আরও ৫০ শতাংশ। এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অভিঘাত পড়ছে শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপরে এবং গ্রামের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ওপরে।

কীভাবে? দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয়বৃদ্ধি ঘটেনি। ফলে আমার মতো যাঁরা জেলাশহর বা গ্রামাঞ্চলে প্র্যাকটিস করেন, সে-সব চিকিৎসকের অভিজ্ঞতাও একইরকম হওয়ার কথা। এর কয়েকটি ধাপ বা পর্যায় রয়েছে—

(১) কয়েকদিন ওষুধ খাওয়ার পরে পয়সার অভাবে ওষুধ বন্ধ করে দিচ্ছেন (যাঁদের পোশাকি নাম ‘ড্রাগ ডিফল্টার’), কয়েকমাস পরে যখন হাতে পয়সা আসছে, তখন আবার দেখাতে আসছেন। এতে অদৃশ্যভাবে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের অসুখের রোগীদের ক্ষেত্রে।

এখানে আরেকটি বিষয়ও লক্ষ্যণীয়— হাতে টাকা আসার ব্যাপারটি কখনও ফসল বিক্রির সঙ্গে যুক্ত, কখনও বা গ্রামীণ জনতার এক বিশাল অংশ দিল্লি, মুম্বই, রাজস্থান, কেরল বা পাঞ্জাবে তুলনায় অনেক বেশি আয়ের জন্য কাজ করতে যান। তাঁদের পাঠানো টাকা বাড়িতে এলে রোগীরা আবার চিকিৎসা করাতে আসেন। চিকিৎসার সঙ্গে শ্রমিকদের অভিবাসী হয়ে ওঠার সম্পর্কও জড়িয়ে যায়।

(২) প্রতিটি গ্রামে, এমনকি শহরেও, এক বা একাধিক “কোয়াক ডাক্তার” আছেন। ঝড়জলবৃষ্টির মধ্যে, দিনে রাতে, এঁরাই গ্রামের মানুষের সঙ্গী হন। কিন্তু চিকিৎসায় জ্ঞানের অভাবে দু-তিন দিনের ওষুধ দিয়ে রোগের উপসর্গ স্তিমিত হলেই (নিরাময় না করেই) রোগীকে ছেড়ে দেন। এরকম বহু রোগী, আবার রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে, আমাদের কাছে চিকিৎসা করাতে আসেন। তখন বাধ্য হয়ে অনেক সময় বেশ দামী ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হয়। একটু জটিল রোগের ক্ষেত্রে দুষ্টচক্রের মতোই প্রায়শই “ড্রাগ ডিফল্টার” তৈরি হন।

(৩) আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা তুলনায় গ্রামীণ জনতার মধ্যে অনেক কম চালু; বেশি চালু, অনেকক্ষেত্রেই, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা। সেক্ষেত্রেও চিত্র একইরকম।

জনস্বাস্থ্যের প্রাথমিক ভিত্তি হল প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলি, যেখানে রোগী ও চিকিৎসকের প্রথম সাক্ষাৎ হয় এবং যেখান থেকে রোগী বুঝতে পারেন, পরবর্তী চিকিৎসার জন্য কোথায় যেতে হবে। ১১ অক্টোবর ২০২৪-এ নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এ প্রকাশিত “দ্য ফেইলিং ইউএস হেলথ সিস্টেম” প্রবন্ধে বলা হয়েছে, যে-দুটি বিষয়ে আমেরিকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ, সেগুলি হল— (১) ব্যক্তিমানুষের স্বাস্থ্যসুরক্ষা দেওয়া এবং (২) সামাজিকভাবে সুস্থ থাকার পরিবেশ তৈরি করা।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকেও আলোকপাত করা হয়েছে— রোগীদের অপ্রয়োজনীয় কষ্ট এবং অবান্তর মৃত্যু এড়ানোর ক্ষেত্রেও এই স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুরোপুরি ব্যর্থ। অথচ জিডিপির ১৭-১৮ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হওয়া সত্ত্বেও, আমেরিকা স্বাস্থ্যের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে অসন্তুষ্ট দেশগুলির একটি।

ভারতের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির বরাদ্দ এখনও ২ শতাংশেরও কম। সহজেই অনুমেয়, এখানকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের অবস্থা কী হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যসাথী কিংবা কেন্দ্রীয় আয়ুষ্মান ভারত প্রকৃত অর্থে সরকারের তরফে চালু করা এক বিশেষ ধরনের বিমা ব্যবস্থা। যদি প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভঙ্গুর এবং মৃতপ্রায় থাকে, তাহলে যাঁরা এই বিমার সুযোগ পান, তাঁদের সিংহভাগই ঝুঁকবেন তৃতীয় স্তরের চিকিৎসাকেন্দ্র অথবা কর্পোরেট হাসপাতালের দিকে। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধের লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি যুক্ত হলে পরিস্থিতি কতটা সংকটজনক হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

২০২২ সালে ভারত সরকারের তরফে একটি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা (ন্যাশনাল লিস্ট অফ এসেনশিয়াল মেডিসিনস) প্রকাশ করা হয়। কিন্তু দ্য ল্যান্সেট-এর মতো আন্তর্জাতিক মান্য পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে[2] বলা হয়, এই নির্দেশিকায় যেভাবে ওষুধের ব্যবহার নির্দেশ করা হয়েছে, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকার থেকে অনেকটাই ভিন্ন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিবশকারী ওষুধ লিগনোকেইন-এর ক্ষেত্রে ১%, ২%, ৫%, ৭.৫% ইনজেকশনের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কোন ক্ষেত্রে কোন ইনজেকশন প্রয়োগ করতে হবে, সেই বিষয়ে কোনও সুস্পষ্ট গাইডলাইন দেওয়া হয়নি। আবার “ড্রপস” বলে কিছু ওষুধের উল্লেখ থাকলেও, কোনটি শিশুদের মুখে খাওয়ানোর জন্য, আর কোনটি চোখে দেওয়ার জন্য, তারও কোনও স্পষ্টতা নেই।

সেই হিসাবে আমাদের হাতে রয়েছে এক ধরনের অস্পষ্ট নির্দেশিকা। এই অস্পষ্টতার দায় কার? একটি কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার প্রকাশিত এমন গুরুত্বপূর্ণ তালিকায় এমন অস্পষ্টতা দেখা গেলে, সাধারণ বুদ্ধিতে বলা যায়— তার দায়ভার বর্তায় কেন্দ্রীয় সরকারের ওপরে। প্রশ্ন হল— এই দায় কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকার করবে কি? কোনও টাস্ক ফোর্স তৈরি করবে কি? ২০২৪ সাল পর্যন্ত তো হয়নি।

আর ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি?

 

অতীতচারণ-২

১ মার্চ, ২০২৪-এ ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের শিরোনাম ছিল— “Antibiotic costs rise 1100% as Big Pharma exits Nigeria”। আমাদের মতো আমজনতা বা দরিদ্রতর বহু মানুষের জন্য এই খবরটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক।

খানিকটা পেছনে ফিরে দেখা যাক। ৫ অক্টোবর, ২০২২-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র তরফে একটি “মেডিক্যাল প্রোডাক্ট অ্যালার্ট” জারি করা হয়। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ায় ভারতের হরিয়ানাভিত্তিক কোম্পানি Maiden Pharmaceuticals-এর তৈরি চারটি ওষুধ— Promethazine Oral Solution, Kofexmalin Baby Cough Syrup, Makoff Baby Cough Syrup এবং Magrip N Cold Syrup— চিহ্নিত হয় ৬৬ জন শিশুর অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরিতে মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ হিসেবে।

WHO-র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় পর্যন্ত উৎপাদক সংস্থার তরফে এই ওষুধগুলোর নিরাপত্তা ও গুণমান সংক্রান্ত কোনও তথ্য WHO-কে জানানো হয়নি। বরং WHO জানায়, ওই চারটি ওষুধের নমুনা পরীক্ষায় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে— এতে অগ্রহণযোগ্য মাত্রায় Diethylene Glycol এবং Ethylene Glycol রয়েছে। WHO-র আশঙ্কা, যদিও আপাতত এই প্রোডাক্টগুলো গাম্বিয়ায় পাওয়া গেছে, বিধিবহির্ভূত বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে এগুলো আরও বহু দেশ বা অঞ্চলেও পৌঁছে যেতে পারে।

একই সতর্কীকরণে Diethylene Glycol এবং Ethylene Glycol-এর বিষয়ে উল্লেখ করে WHO জানিয়েছে, এই পদার্থদ্বয় মনুষ্যদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এদের বিষক্রিয়ার ফলে পেটে ব্যথা, বমি, ডায়ারিয়া, প্রস্রাব না হওয়া, মাথাব্যথা, মানসিক বিভ্রান্তি এবং অ্যাকিউট কিডনি ইনজুরির মতো মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিতে পারে— যার পরিণতিতে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, অধিকাংশ তরল কাফ সিরাপে দ্রাবক হিসেবে গ্লিসারিন (বা গ্লিসারল) ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। কিন্তু কিছু অসাধু ওষুধ-উৎপাদক অধিক মুনাফার লোভে গ্লিসারিনের পরিবর্তে উপরের এই বিষাক্ত রাসায়নিকগুলি ব্যবহার করে থাকে। মানুষের প্রাণ, তাদের স্বাস্থ্য— সবকিছুই এদের লোভের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।

এছাড়াও আফ্রিকায় ৬৬ জন শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একাধিক গুরুতর প্রশ্ন উঠে আসে।

প্রথমত, সামাজিকভাবে সুষম স্বাস্থ্যসেবা সবার নাগালে থাকবে— সামাজিক ন্যায়ের এই মৌলিক ধারণা এখানে ভেঙে পড়েছে।
দ্বিতীয়ত, ভারত জেনেরিক ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রে “বিশ্বের ঔষধাগার”— এই সম্মানজনক ধারণাটিই আজ কলঙ্কিত।
তৃতীয়ত, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক কী হওয়া উচিত, সেই মৌলিক প্রশ্নটিও নতুন করে সামনে এসেছে।
চতুর্থত, ভারতের Drug Control Authority অর্থাৎ DCGI জানিয়েছে, যতক্ষণ না WHO প্রমাণ করতে পারছে যে উল্লিখিত ওষুধগুলিই এতগুলি শিশুমৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। এই অবস্থানের নির্গলিতার্থ হল, প্রমাণের দায় WHO-র, আর অভিযুক্ত সংস্থার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখার DCGI-র কোনও দায় নেই।

আমরা কি ভবিষ্যতেও রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর তরফে এমন উত্তরই শুনতে থাকব? মনে রাখতে হবে, মেইডেন ফার্মাসিউটিক্যালস-এর একজন ডিরেক্টর হলেন প্রভূত বিত্তশালী ব্যক্তি, একসময় জেট এয়ারওয়েজের মালিক নরেশ গোয়েল। আমরা তো জানি— অর্থ ও ক্ষমতা হাত ধরাধরি করেই চলে।

ভিন্ন প্রসঙ্গে বলা যায়— ১৯৯১ সালের ১২ ডিসেম্বর, বিশ্বব্যাঙ্কের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ লরেন্স সামার্স একটি গোপন নোট তৈরি করে সহকর্মীদের মধ্যে বিতরণ করেন, মতামত চান। ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্য ইকনমিস্ট পত্রিকা সেই নোটটি প্রকাশ করে দেয়, শিরোনাম দেয়— “Let Them Eat Pollution”।

নোটটির মূল বক্তব্য ছিল, ধনী বিশ্বের সমস্ত দূষিত বর্জ্য আফ্রিকা বা অন্যান্য কম-উন্নত দেশগুলিতে রপ্তানি করা হোক। সামার্সের যুক্তি ছিল স্বাস্থ্যসংক্রান্ত: আমেরিকার মতো দেশে যদি দূষিত বর্জ্যের কারণে প্রতি এক লক্ষে একজন প্রোস্টেট ক্যানসারে মারা যান, তাহলেও তার ‘মূল্য’ আফ্রিকার মতো দেশে যেখানে প্রতি হাজারে পাঁচজন শিশু পাঁচ বছরের আগেই মারা যায়— তার চেয়ে বেশি।

এই “চমৎকার” ও “অভিনব” চিন্তার পুরস্কারস্বরূপ সামার্স পরে ক্লিন্টন প্রশাসনে সাত বছর ট্রেজারি সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারপর হন হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট।

গাম্বিয়ার মতো দরিদ্র দেশে, যেখানে ওষুধের গুণমান যাচাই করার মতো ল্যাবরেটরিও নেই, সেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরে এ-ধরনের আঘাতকে পল ফার্মার চিহ্নিত করেছেন “কাঠামোগত হিংসা” (structural violence) হিসেবে। যদি না হু (WHO)-এর মাধ্যমে ঘটনাটি বিশ্বের সামনে উন্মোচিত হত, তবে এটি— অন্যান্য বহু ঘটনার মতোই— অদৃশ্য ও অশ্রুতই থেকে যেত।

অমর্ত্য সেন, পল ফার্মারের বিখ্যাত গ্রন্থ Pathologies of Power-এর ভূমিকায় লিখেছেন—

প্রতিরোধযোগ্য রোগকে যথার্থভাবে প্রতিরোধ করা যায়, নিরাময়যোগ্য রোগকে নিরাময় করা যায়, এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য ব্যাধিগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য চিৎকার করে। প্রকৃতির বিরুদ্ধতার জন্য আক্ষেপ করার পরিবর্তে আমাদের সামাজিক অবস্থার কারণগুলো ভালো করে বোঝা দরকার।

বোঝা দরকার, “বিশ্বগুরু” হওয়ার স্বপ্নের পাশাপাশি যেন আমরা শিশু-হন্তারক হয়ে না উঠি।

 

প্রাত্যহিক বর্তমানে— কোথায় যাব, আমরা?

ভারতে ৩০,০০,০০০-এর বেশি মানুষ মারাত্মক ও মারণান্তক সিলিকোসিস রোগে ভুগছেন। অথচ এই রোগ সম্পর্কে আমাদের প্রায় কিছুই পড়ানো হয় না। এ রোগ ‘দারিদ্র্যের রোগ’— পেটের দায়ে কৃষিতে টান পড়লে যে মানুষ খনিতে, পাথর-চূর্ণকারী ক্রাশারে কিংবা নির্মাণক্ষেত্রে কাজ করতে যান, মূলত তাঁরাই এই রোগে আক্রান্ত হন।

ক্লিনিকাল হেলথের শিক্ষা আমাদের কাছে এ রোগকে অদৃশ্য ও অশ্রুত করে রেখেছে। একে দৃষ্টির সীমায় এবং শ্রুতির পরিসরে নিয়ে আসার চেষ্টায় আমরা কি এগোব না?

২০১৮ সালে ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থা পরিদর্শনে আসেন বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রাক্তন মহাসচিব গ্রো হারলেম ব্রান্টল্যান্ড এবং রাষ্ট্রসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব বান কি মুন। পরে The Lancet-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ব্রান্টল্যান্ড সতর্ক করেন—

ভারতের নতুন স্বাস্থ্যসংস্কারের নানা কর্মসূচির ক্ষেত্রে একটি বড় ঝুঁকি হল, এগুলো টার্শিয়ারি কেয়ারের দিকে অতিরিক্ত ঝুঁকে যেতে পারে। ফলে সরকার যে ঘোষণা করেছিল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় মোট স্বাস্থ্যবাজেটের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় করা হবে, সেই নীতিই গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারে।

এই প্রসঙ্গে ব্রান্টল্যান্ড আমেরিকার উদাহরণ দিয়েছেন— যেখানে জিডিপি-র ১৮ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হলেও এখনও পর্যন্ত সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা নেই। ভারতের ক্ষেত্রে ২০২৪-২৫-এর বাজেটেও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপি-র ২ শতাংশেরও কম। অথচ এক সময় প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর ভিত্তি গড়ে উঠেছিল এই ধারণায়— “স্বাস্থ্যের গোড়ার পরিষেবায় ন্যায্য ও সার্বিক প্রবেশাধিকার থাকবে”, যার ব্যয় বহন করবে রাষ্ট্র; রোগী নয়। একবার যদি স্বাস্থ্যসুরক্ষার এই রাষ্ট্রীয় কবচ সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সরকার যতই ঢাকঢোল পিটিয়ে সরকারি ইনসিউরেন্সের কথা বলুক, বাস্তবে তা গিয়ে ঠেকবে বেসরকারি ইন্সিউরেন্স সংস্থার হাতে।

ভারতে জনস্বাস্থ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায়-মৃত, ভঙ্গুর। এই শূন্যতার মধ্যে “আয়ুষ্মান ভারত”-এর মতো সরকারি ইন্সিউরেন্স প্রকল্পে যত বরাদ্দই হোক না কেন, বাস্তবে সাধারণ মানুষকে পাড়ি দিতে হয় শহরের টারশিয়ারি কেয়ার কেন্দ্রগুলোতে— অথবা নিজের ঘটিবাটি বিক্রি করে কর্পোরেট হাসপাতালে। নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন-এর একটি প্রবন্ধ জানাচ্ছে, কর্পোরেট বিনিয়োগকারীরা এখন প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রসারিত পরিসরেও প্রবেশ করেছে। ২০০৫ সালে প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থার চাপ সামলাতে গিয়ে ব্রাজিলকে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হয়েছিল।

সাম্প্রতিক হিসেব বলছে, বিশ্বের বৃহত্তম আটটি স্বাস্থ্য-কর্পোরেশনের মোট রেভেন্যু দাঁড়িয়েছে ৬৬৮ বিলিয়ন ডলার— ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৫৬,৩৫৯.১৬ হাজার কোটি টাকা।

ঐতিহাসিকভাবে, ১৯৭৮ সালে হু এবং ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে ঘোষিত আলমা-আটার “সর্বাঙ্গীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা”-র দলিলটি বিশ্ব-স্বাস্থ্যচর্চার ইতিহাসে মাইলফলক। হু-র তৎকালীন মহাপরিচালক হ্যাফডান ম্যালার-এর নেতৃত্বে সেখানে “নতুন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা”-র ধারণা উচ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮০-র দশকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে মন্দা এবং নিওলিবারাল অর্থনীতির উত্থান হু-কে ক্রমে কোণঠাসা করে তোলে। ব্রিটেনের থ্যাচার সরকার এবং আমেরিকার রেগান প্রশাসন হু-কে অনুদান প্রায় বন্ধ করে দেয়। এর পেছনে ছিল ১৯৭৭ সালের হু-র একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত— “এসেনশিয়াল মেডিসিনস প্রোগ্রাম”, যেখানে ব্যয়বহুল ব্র্যান্ডের বদলে জেনেরিক ওষুধ ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়। প্রত্যাশিতভাবেই, এই পদক্ষেপের প্রবল বিরোধিতা করে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো, যাদের মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।

ভারতের প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় এখনও জিডিপি-র ২ শতাংশেরও কম। ফলে সহজেই বোঝা যায়, তার মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য কী নগণ্য অর্থ বরাদ্দ থাকে। মানুষ হিসেবে তাঁরা বেঁচে আছেন, অথচ স্বাস্থ্যের অধিকার তাঁদের নেই!

এ এক বিচিত্র রাষ্ট্রীয় ছলনা— কে নেবে এর দায়? কে নেবে সমাধানের দায়িত্ব?

প্রতি বছর কয়েক কোটি মানুষ যখন শুধুমাত্র স্বাস্থ্যব্যয়ের চাপে নিজেদের পকেট থেকে খরচ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যান, তখন প্রশ্ন জাগে— এই সংখ্যা কি আরও বাড়বে?

তার ওপর আবার ওষুধের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি।

কোথায় যাচ্ছি আমরা? কোন পথে হাঁটছি?


[1] Press Release. Ministry of Chemicals and Fertilizers. Mar 28, 2025.
[2] Manikandan, S. The National List of Essential Medicines of India 2022 (NLEM 2022): Tommy, Toe the Line. The Lancet. June, 2023.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...