সুন্দরবনের বিপন্নতা ও বঞ্চনার খতিয়ান— প্রসঙ্গ, ফ্লাই অ্যাশ

অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী

 


দুটো দেশের প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাবে সীমানার দুই দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামগ্রিক দক্ষিণবাংলার সুন্দরবন এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। সর্বাঙ্গীনভাবে বিপন্ন হচ্ছেন সেখানকার মানুষরাও। এই বিপন্নতার পেছনে দায়ী শুধুমাত্র ফ্লাই অ্যাশ ও ফ্লাই অ্যাশবাহী জাহাজের ডুবে যাওয়া নয়, পাশাপাশি কয়লা ও অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক কার্গোবাহী বড় জলযান, মাছ ধরার যান্ত্রিক ট্রলারগুলোর অবাধ ও বেলাগাম চলাচল, সে-সবের ফলে ঘটা ভূমিক্ষয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কয়লা-চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থনীতি ও আরও অসংখ্য বিষয়বস্তু ও প্রসঙ্গ

 

১৯৭৮ সালে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে এক নিদারুণ সত্য সামনে আসে। ‘ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি’র তরফ থেকে জেপি ম্যাকব্রাইড ও তাঁর সহকর্মীরা টেনেসি ও অ্যালাবামা অঞ্চলের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে নির্গত ‘ফ্লাই অ্যাশ’-এ কত পরিমাণ ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম রয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখছিলেন। গবেষণায় তাঁরা বুঝতে পারেন, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশে যাঁরা থাকেন, তাঁরা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের সমান, অথবা কখনও তাঁদের তুলনায় বেশি মাত্রায় রেডিওঅ্যাক্টিভিটির শিকার হচ্ছেন। এবং, যদি এই দুই ধরনের রেডিয়েশন-প্রবণ অঞ্চলে খাদ্য উৎপাদন হয়, তবে দেখা গেছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আশেপাশের বাসিন্দারা ফ্লাই অ্যাশ দুষণের কারণে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দাদের তুলনায় ৫০ থেকে ২০০ গুণ বেশি বিকিরণের শিকার হন।[1]

গত কয়েক দশকের গবেষণা দেখাচ্ছে, একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত বর্জ্য যত মাত্রায় বিকিরণ সৃষ্টি করে, সমান পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করতে কোনও একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ফ্লাই অ্যাশ প্রায় ১০০ গুণ বেশি রেডিওঅ্যাক্টিভিটি ছড়ায় প্রভাবিত অঞ্চলে।[2]

শুধু বিকিরণ-জনিত ক্ষতিই নয়— কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা জানাচ্ছে, কয়লা-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে যে ফ্লাই অ্যাশ নির্গত হয়, তাতে ইউরেনিয়ামের পাশাপাশি মিশে থাকে আর্সেনিক, পারা, ক্যাডমিয়াম ও সিসার মতো বিষাক্ত রাসায়নিক[3], যা মানুষের স্বাস্থ্য এবং প্রকৃতি-পরিবেশের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

এই কাজগুলো করা হয়েছে স্থলভাগের কথা মাথায় রেখে। অথচ জলের সঙ্গে, বিশেষত উপকূলবর্তী অথবা মোহনা অঞ্চলের প্রবহমান জলরাশির সঙ্গে মিশে সেই বিষ কতটা তীব্র আকার ধারণ করতে পারে, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন সাইমন এম মিউলার, ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন প্রেস, সিয়াটল থেকে ২০২৩ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ The Toxic Ship-এ। সারা দুনিয়ায় উপকূলবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দারা বর্জ্য নিষ্কাশন-সংক্রান্ত প্রশাসনিক অব্যবস্থার ফল ভুগে এসেছেন নির্মমভাবে।

 

সুন্দরবনে অহরহ ফ্লাই অ্যাশবাহী জাহাজ ডুবে যায়

সুন্দরবনের ব-দ্বীপাঞ্চলে জল ও স্থল মিলিয়ে যে স্বতন্ত্র ভূপ্রকৃতি গড়ে উঠেছে, সেখানে অহরহ ঘটে চলে লজঝরে, অতিরিক্ত বোঝাই ফ্লাই অ্যাশ-বাহী জলযান ডুবে যাওয়ার ঘটনা। খবরের কাগজের আনাচে-কানাচে এমন খবরে হামেশাই চোখ পড়ে।[4]

এই ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে ফ্লাই অ্যাশ জলে মিশে গেলে যে বিপদের সৃষ্টি হয়— তা শুধু জলের বা স্থলের জন্য নয়, ক্ষতি হয় জলজ ও স্থলজ প্রকৃতির, মাছ-কাঁকড়ার, সেগুলো যাঁরা ধরছেন তাঁদের, আড়তের কর্মচারীদের, বাজারের বিক্রেতা, ক্রেতা, রাঁধুনি এবং ভোক্তাদের— সবারই। তাঁদের পরিসর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিপন্নতা।

ফ্লাই অ্যাশের ভিজে মণ্ড (‘slurry’) এবং ভেঙে যাওয়া জাহাজের টুকরো জলে ছড়িয়ে পড়ে, চড়ায় আটকে বিঁধে গিয়ে করে মারাত্মক ক্ষতি। উপদ্রুত অঞ্চলের সাধারণ মৎস্যজীবীরা প্রশাসনিক চাপ ও জীবিকার পরিসরকে দূষণমুক্ত রাখার প্রয়োজনে বাধ্য হচ্ছেন এই বিষাক্ত বর্জ্য সংগ্রহ ও অপসারণে। অথচ, এতে তাঁদের স্বাস্থ্য ও জীবন ঠিক কীভাবে, কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তার কোনও পূর্ণাঙ্গ হিসাব আজও তৈরি হয়নি।

বিষয়টি নিয়ে অনলাইনে লেখালেখি, গবেষণা[5]— একেবারেই যে হয়নি, তা নয়। আদালতে কিংবা প্রশাসনিক স্তরেও কিছু ইতস্তত পদচারণার ধ্বনি শোনা গিয়েছে— কখনও কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তি আকারে, কখনও বিদ্যুৎ মন্ত্রকের প্রকাশিত গাইডলাইনের মাধ্যমে, আবার কখনও পরিবেশ আদালতের রায়ে।

ফ্লাই অ্যাশের চরম রেডিওঅ্যাক্টিভিটি সম্পর্কে জাতীয় পরিবেশ আদালত ২০১১ সালেই স্বীকৃতি দেয়।[6] নদী-খাঁড়ি অঞ্চলে ফ্লাই অ্যাশ কতটা ক্ষতিকর, তা নির্ধারণে ওই আদালত ২০১৬ সালে একটি কমিটিও গঠন করে।

কাগজের বিধান কাগুজেই রয়ে যায়। জমিন স্তরে তার যে কোনওই প্রভাব পড়ে না তা স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন দেখা যায় লকডাউনের প্রথম মাসগুলোয় গাঙ্গেয় দক্ষিণবাংলার ব-দ্বীপ অঞ্চল জুড়ে বারবার ফ্লাই অ্যাশ বোঝাই বরজ উলটে যাচ্ছে। মার্চ থেকে মে, ২০২০— এই সময়কালের মধ্যেই শুধু ভারতীয় সুন্দরবন অঞ্চলে এমন ঘটনা ঘটে পাঁচবার।

 

অর্থনীতি–কূটনীতি–প্রশাসননীতি

ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রোটোকল র‍্যুটে কার্গো চলাচল: মে-ডিসেম্বর, ২০২১। সূত্র: বিশেষ কমিটি রিপোর্ট, পরিবেশ আদালত, পূর্বাঞ্চল বেঞ্চ, ৩০/০১/২০২৩

উল্লেখ্য, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট অনেকটাই কম; উৎপন্ন শক্তি ও ফ্লাই অ্যাশের পরিমাণও তুলনায় কম। উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, বাংলাদেশে মোট পাঁচটি কয়লা-নির্ভর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে এক পশ্চিমবঙ্গেই রয়েছে ১৬টি কয়লা-নির্ভর থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট। ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের ২০১৯–২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ১৭টি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ফ্লাই অ্যাশ নির্গমনের নিরিখে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে।[7]

ফ্লাই অ্যাশ তুলনায় কম উৎপন্ন হওয়ায় বাংলাদেশে তা ডাম্প করা কিংবা তা দিয়ে ইট ও সিমেন্ট বানানোর বিষয়ে আইনি ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষাকৃত শিথিল।[8] এই ঘাটতি পূরণে ভারত থেকে বাংলাদেশে ‘যৌথ প্রোটোকল’[9] অনুসারে নির্দিষ্ট জলপথ ধরে ফ্লাই অ্যাশবাহী জাহাজ যাতায়াত করে। সেই যাত্রাপথেই, কিছু জাহাজ মাঝেমধ্যে ডুবে যায়।

প্লেটের আরেকদিকে রয়েছে বাণিজ্যিক অতিরেক, যা মূলধারায় ‘প্রয়োজন’ হিসাবে চিহ্নিত। ২০০৯ সালের পর, ২০২০ সালের মে মাসে দুই দেশ আবার আন্তর্দেশীয় চুক্তিতে সই করে। এর ফলে আরও বিস্তৃত হয় যৌথ প্রোটোকলের অন্তর্গত অভ্যন্তরীণ জলপথের পরিসর। ১ ও ৯৭ নম্বর জাতীয় জলপথ ছাড়াও যুক্ত হয় ইছামতী নদী বরাবর দুই দেশের সীমান্ত সংলগ্ন ৪৪ নম্বর জাতীয় জলপথ।

এই সম্প্রসারণ ঘটে ২০২০ সালের শুরুর তিন মাসে যৌথ প্রোটোকলের আওতায় ভারতের জলপথে পাঁচটি ফ্লাই অ্যাশবাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনার পরেও।

আবার, সেই একই বছরের একই মাসে, কেন্দ্রীয় সরকার কয়লাখনি সংস্থাগুলোর উপর থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত বাধ্যকতা তুলে দেয়— খনি থেকে ৫০০ কিলোমিটারের বেশি দূরে অবস্থিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে কয়লা পাঠানোর আগে ‘কোল ওয়াশিং’ প্রক্রিয়া আর বাধ্যতামূলক থাকল না।[10] পাশাপাশি, যেসব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালায়, তাদের উপরও কোনও অতিরিক্ত পরিবেশবিধি চাপানো হয়নি। ফলে, কয়লা ধোলাইয়ের অভাবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে যে ফ্লাই অ্যাশ উৎপন্ন হতে শুরু করে, তাতে বিষাক্ত রাসায়নিকের মাত্রা হয় আরও বেশি তীব্র।

কলকাতা বন্দর (শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি পোর্ট) থেকে একই দিনে (১৩/০৫/২০২৪ তারিখে) ছাড়া ফ্লাই অ্যাশ-বাহী জাহাজের তালিকা ও বাহিত ফ্লাই অ্যাশ-এর পরিমাণ। সূত্র: নৃতত্বের গবেষক মেগনা মেহতা, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন

 

আইনে পথচলা

আইনের প্রসঙ্গ যখন উঠলই, তখন আলোচনাকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে নেওয়া যায়। তবে সবার আগে বলা প্রয়োজন, আইন সবসময় গবেষণালব্ধ সত্যের পথ অনুসরণ করেছে— এমনটা নয়। ২০০০ সালের আগে পর্যন্ত ভারতের আইনে ফ্লাই অ্যাশ ‘বিপজ্জনক বর্জ্য’ (‘Hazardous Waste’) হিসেবে চিহ্নিত ছিল। সেই বছর থেকেই এটি সাধারণ বর্জ্য (‘Waste’) হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে।[11] ফলে নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয় এবং ফ্লাই অ্যাশ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ আরও প্রশস্ত হয়।

এই বাণিজ্যকে আরও আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে আইন ক্রমশই সহায়ক ভূমিকা নেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভারতের কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক একটি গেজেট নোটিফিকেশন জারি করে।[12] ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল— দেশে যত ফ্লাই অ্যাশ উৎপন্ন হচ্ছে, তার ১০০ শতাংশ ব্যবহার নিশ্চিত করা। ব্যবহারের খাতে অন্তর্ভুক্ত হয়: ইট, ব্লক, টাইল, সিমেন্ট, ফাইবার সিমেন্ট পাত, কংক্রিট, রাস্তা, বাঁধ নির্মাণ; নিচু জমি ভরাট; খননক্ষেত্রে নিঃশেষিত গহ্বর পূরণ; এমনকি রপ্তানি পর্যন্ত। এই বিজ্ঞপ্তিতে ‘Polluter Pays Principle’, অর্থাৎ “দূষণকারীই ক্ষতিপূরণ দেবে”— এই নীতির উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে অন্তত পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রোটোকলের আওতায় চলা জলপথে ফ্লাই অ্যাশ-বাহী জাহাজ ডুবে যাওয়ার ক্ষতির কোনও প্রতিকার— সরকারি বা বেসরকারি— পাবলিক ডোমেইনে চোখে পড়েনি।

এদিকে[13], এই ‘১০০ শতাংশ ব্যবহারের’ ঘোষণাকে ভিত্তি করে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক একের পর এক গাইডলাইন জারি করেছে, করে চলেছে— যেমন ‘ইউজার এজেন্সি’ গঠন, নিলামের পদ্ধতি প্রণয়ন ইত্যাদি ফ্লাই অ্যাশ ব্যবসায়ের বিভিন্ন পর্বকে নিয়ন্ত্রণ ও সম্প্রসারণের জন্য।[14]

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক ২০১৯ সালেই একদিকে সুন্দরবনকে ‘ক্রিটিকালি ভালনারেবল’ উপকূলীয় অঞ্চল এবং অন্যদিকে ফ্লাই অ্যাশকে উপকূলীয় অঞ্চলে একটি গুরুত্বপূর্ণ দূষণ-উৎপাদক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।[15]

এই প্রসঙ্গে আরও বলা যায় যে, যেহেতু যৌথ প্রোটোকলের অন্তর্ভুক্ত ভারতের অভ্যন্তরীণ জলপথ বরাবর উপদ্রুত অঞ্চলটি ১ নম্বর, ৯৭ নম্বর জাতীয় জলপথ এবং কিছু অংশ ৪৪ নম্বর জাতীয় জলপথ জুড়ে বিস্তৃত, সেহেতু এই বিষয়ে দায়বদ্ধতা সরাসরি ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি অব ইন্ডিয়া (আইডব্লিউএআই)-র উপর অনেকটাই বর্তায়।

২ জুন ২০২০ তারিখে উক্ত কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত সার্কুলার[16] থেকে জানা যায়, জাতীয় জলমার্গের এই পথগুলোতে বার্ষিক কার্গো মুভমেন্টের পরিমাণ ‘মিলিয়ন টন’ ওজন অনুসারে ‘টার্গেট’ হিসাবে ধার্য করা রয়েছে, যদিও কোনও সর্বোচ্চ বা সর্বনিম্ন পরিমাণ বেঁধে দেওয়া হয়নি।

দক্ষিণবঙ্গের মানচিত্রে কলকাতা বন্দর (এসপি মুখার্জি পোর্ট) ও হলদিয়া বন্দর— হাতনকশা। সূত্র: ক্যাপ্টেন অভিজিৎ ঘোষ, ডায়রেক্টর, মেরিন ডিপার্টমেন্ট, (আই/সি), এসপি মুখার্জি পোর্ট ট্রাস্ট

 

ফ্লাই অ্যাশই ভারত থেকে বাংলাদেশে জলপথে যাওয়ার মূল ‘কার্গো

এদিকে, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে একই কর্তৃপক্ষের প্রকাশিত Annual Report on Traffic on National Waterways অনুযায়ী, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রোটোকলভুক্ত জলপথ ধরে যে কার্গো চলাচল করে, তার ৯৭ শতাংশই ফ্লাই অ্যাশ![17] সেই বছরেই বছরে গড়ে ৩ মিলিয়ন টন পর্যন্ত ফ্লাই অ্যাশ ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রোটোকলের অন্তর্গত ভারতের অভ্যন্তরীণ জলপথ ধরে বাংলাদেশের পথে যাত্রা করত।[18] তারপর, যেমন উপরে বলা হয়েছে, যৌথ প্রোটোকলের পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং সেইসঙ্গে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে ফ্লাই অ্যাশবাহী জাহাজের চলাচলও।

 

ফ্লাই অ্যাশবাহী জাহাজডুবি, সেই নিয়ে মামলা

২০২০ সালে, মাত্র তিন মাসের (মার্চ থেকে মে) মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রোটোকল জলপথে পাঁচটি ফ্লাই অ্যাশবাহী জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। এর পর, সাধারণ মৎস্যজীবীদের গঠিত একটি ট্রেড ইউনিয়ন এই ঘটনা নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলা করে। উল্লেখযোগ্য যে, মামলা করার আগে সেই ইউনিয়ন ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ফ্লাই অ্যাশজনিত সমস্যার বিষয়ে একটি চিঠিও লেখে।

মামলা চলাকালীন, জাতীয় পরিবেশ আদালতের ১৯/১০/২০২০ তারিখের নির্দেশ অনুযায়ী একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির সদস্যরা হলেন: ১) দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক; ২) প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ), পশ্চিমবঙ্গ বন বিভাগ; ৩) কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একজন প্রতিনিধি; এবং ৪) রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সংশ্লিষ্ট আধিকারিক।

১২ মার্চ ২০২০ থেকে ২৫ মে ২০২০— এই ৮১ দিনে যে পাঁচটি স্থানে ফ্লাই-অ্যাশ-বাহী জাহাজ ডুবে গিয়েছিল, সেগুলির গুগল আর্থ সংগৃহীত জিপিএস কো-অর্ডিনেট, তারিখ-সহ। সূত্র: দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম

 

পরিবেশ আদালতের নির্দেশ অনুসারে, ৮ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে এই বিষয়ে একটি প্রশাসনিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন: দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার উপ-ভূমি ও ভূমিসংস্কার আধিকারিক; প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) তথা চিফ ওয়াইল্ডলাইফ ওয়ার্ডেন, পশ্চিমবঙ্গ বন বিভাগ; কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রতিনিধি হিসেবে কলকাতায় কর্মরত ‘সায়েন্টিস্ট সি’ পদাধিকারী একজন বৈজ্ঞানিক; এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একজন পরিবেশ প্রকৌশলী (এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ার)। বৈঠকের পর কমিটির তরফে আইডব্লিউএআই-এর কর্মাধ্যক্ষকে একটি চিঠি পাঠানো হয়, যাতে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রোটোকলভুক্ত ভারতের অভ্যন্তরীণ জলপথে জাহাজ দুর্ঘটনাগুলির সম্পর্কে তথ্য, বিস্তারিত বিবরণ, অনুসন্ধানপদ্ধতি এবং ওই দুর্ঘটনাগুলির ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়।

তারপর, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে আইডব্লিউএআই-এর তরফ থেকে আদালতে একটি খসড়া স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিওর (এসওপি) জমা দেওয়া হয়। তার শিরোনাম: Document for Enquiry into Accidents/Incidents Involving Inland Vessels on National Waterways & Indo-Bangladesh Protocol Routes (Indian Side)। অর্থাৎ, ভারতের জাতীয় জলপথ এবং ভারত-বাংলাদেশ প্রোটোকল রুটের (ভারতীয় অংশে) অভ্যন্তরীণ জাহাজ দুর্ঘটনা বা ঘটনার তদন্ত সংক্রান্ত একটি নীতিপত্র।

এই খসড়ায় শুধু ক্ষয়ক্ষতির প্রতিরোধই নয়, দুর্ঘটনায় বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বিষয়গুলোও বিশদে আলোচিত হয়েছিল। মোট পনেরোটি মূল বিন্দু এবং একাধিক উপবিন্দুর মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়েছিল যে, এই ধরনের দুর্ঘটনার খবর এলে সরকারিভাবে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

তবে মামলা চলাকালীন, ১৩ অক্টোবর ২০২২ তারিখে পরিবেশ আদালত সেই কমিটির রিপোর্টকে ‘half baked report’ বলে আখ্যায়িত করে। তবু দমে না গিয়ে, ৩০ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে সেই কমিটি ফের একটি রিপোর্ট পেশ করে। সেই রিপোর্টে বর্ণনা করা হয়— সুন্দরবনের কুলপি অঞ্চল থেকে কীভাবে ডুবে যাওয়া জলযান থেকে জলে ভিজে কাই বা ক্যাৎক্যাতে মণ্ডে পরিণত হওয়া ফ্লাই অ্যাশ গাধাবোটে চাপিয়ে, ত্রিপল দিয়ে ঢেকে, দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়। তারপর সেই গাধাবোট এক খাল ধরে নদীপথে এসে ভেড়ে ১ নং নিশ্চিন্তপুর হাটের ঘাটে। এই ধরনের নিদারুণ বাস্তব কাহিনি তুলে ধরা হলেও, যাঁরা এই বিপজ্জনক কাজগুলো করেছিলেন, তাঁদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা বা সুন্দরবনের ভূপ্রকৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব— এসব বিষয়ে রিপোর্টে কোনও উল্লেখ ছিল না।

এই রিপোর্ট আদালতে জমা পড়ার এক মাসও অতিবাহিত হয়নি। এরই মধ্যে, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এর ভোরবেলা আবারও কুলপি-নিশ্চিন্তপুর অঞ্চলেই ডুবে যায় ফ্লাই অ্যাশ-বাহী জলযান ‘এমভি রফসান’।

সাগর রোডস থেকে হলদিয়া বন্দর নদীপথ। সূত্র: ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া

 

মামলা বন্ধ হয়ে গেল

২০ মার্চ ২০২৩ তারিখে এই মামলা বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে, বাস্তবিকতার নিরিখে, আদালতের গঠিত কমিটিও কার্যত বিলীন হয়ে পড়ে। আদালত জানায়, নির্দিষ্টভাবে কোন ব্যক্তি কী পরিমাণে এবং কী ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন, সেই বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় আদালত কোনও অবস্থানে পৌঁছাতে অক্ষম। ক্ষতিপূরণ-সংক্রান্ত বিষয়টি আদালত রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অধ্যক্ষের উপর ন্যস্ত করে— কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ না করেই। পাশাপাশি, আইডব্লিউএআই-কে উদ্দেশ্য করে আদালত নির্দেশ দেয় যে, তারা যেন সেই স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিওর (এসওপি) পুনর্মূল্যায়ন বা ‘রিভিজিট’ করে। এ-ক্ষেত্রেও আদালত কোনও সময়সীমা নির্ধারণ করেনি।[19]

এই মামলাটি রুজু করেছিল সাধারণ মৎস্যজীবীদের ট্রেড ইউনিয়ন ‘দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম’।[20] মামলার পাশাপাশি এই সংগঠন আজও এই বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। মামলায় তারা ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরে। আদালত সেই সূত্রেই কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে নির্দেশ দেয়, এমন ধরনের ঘটনায় ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কীভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে, তার একটি পদ্ধতি আদালতকে জানাতে। কিন্তু কেন্দ্রীয় পর্ষদ এ-বিষয়ে আদালতকে কিছুই জানায়নি। তার আগেই, মামলাটি বন্ধ হয়ে যায়।

এই মামলার প্রেক্ষিতে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে আইডব্লিউএআই যে খসড়া স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিওর (এসওপি) পরিবেশ আদালতে জমা দেয়, তার নানা গলদ হলফনামা মারফত আদালতের সামনে তুলে ধরে দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম। ফোরামের পক্ষ থেকে আদালতকে স্পষ্ট জানানো হয়— ওই এসওপি-তে ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যজীবীদের জীবিকায় হওয়া ক্ষতির বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত। তদুপরি, দুর্ঘটনায় জলে মিশে যাওয়া কোন ধরনের রাসায়নিক অনুমান করা হবে, তা নির্ধারণ না করে এসওপি-তে সেই দায় রাজ্য সরকারের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

আদালতের ভিতরে ও বাইরে, সাধারণ মৎস্যজীবীদের এই সংগঠন বারবার দাবি জানিয়েছে— এই ধরনের কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে সরকারের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের জনশুনানির মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষয়ক্ষতির দিকগুলি জানতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

কিন্তু এই সমস্ত সঙ্গত দাবির কোনও নিষ্পত্তি হয়নি। মামলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এমনকি ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম প্রোটোকলের আওতায় পরিবেশ সুরক্ষার যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি এই মামলার মাধ্যমে আদালতের নজরে আনার চেষ্টা হয়েছিল, সেগুলিও প্রশাসনিকভাবে উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে।[21]

 

আইনে-বাস্তবে অসামঞ্জস্য

তবে, কাগজে লেখা ন্যারেটিভ আর বাস্তবের পথ একই থাকে না। ফ্লাই অ্যাশ-বোঝাই যে জলযানগুলো পশ্চিমবঙ্গের জলরাশিতে, বিশেষত যৌথ প্রোটোকলভুক্ত অঞ্চলে ডুবে যাচ্ছে, সেগুলোর উৎস বাংলাদেশ।[22] পশ্চিমবঙ্গ থেকে, বিশেষ করে কলকাতা ও হলদিয়া বন্দরের থেকে ফ্লাই অ্যাশ বোঝাই হয়ে বাংলাদেশে পাড়ি দেওয়ার পথে এই দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে।[23] বাস্তব জানান দিচ্ছে, সেই বিশাল জলযানগুলোর চলাচলে সুন্দরবনের চড়া অঞ্চল জুড়ে ভূমিক্ষয় হচ্ছে।[24]

বাস্তব আরও জানান দিচ্ছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে মে— মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রোটোকলভুক্ত জলপথে পাঁচটি ফ্লাই অ্যাশ-বোঝাই জলযান ডুবে যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রে গড়ে ৭ থেকে ১৩ জন কর্মীকে উদ্ধার করেছেন স্থানীয় সাধারণ মৎস্যজীবীরা।[25] ডুবে যাওয়া ভেসেল থেকে ভেসে ওঠা ফ্লাই অ্যাশে দূষিত জল গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের মৎস্যজীবীদের জীবিকাকে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবু, তাঁরা ফ্লাই অ্যাশ-দূষিত জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুবন্ত জলযানের কর্মীদের বাঁচাতে পিছপা হননি।

বাস্তব আরও বলে, ৩ নভেম্বর ২০২১ তারিখে ডুবে যাওয়া ‘এমভি বাংলার শান্তি–১’ নামের একটি ফ্লাই অ্যাশ-বোঝাই জলযানের অবশিষ্টাংশ জানুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়নি।[26] কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট, পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও কেন্দ্রীয় আইডব্লিউএআই একে অপরের দিকে দায় চাপিয়ে পরিবেশ আদালতে একের পর এক হলফনামা জমা দিয়েছে। ক্রমশ ন্যায়পীঠও নিজেদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে।

ট্র্যাকটরের সঙ্গে ‘বালকার’ (bulker) লাগিয়ে তাপবিদ্যুৎ ইত্যাদি কারখানা থেকে জাহাজের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফ্লাই অ্যাশ। কলকাতা বন্দরের দৃশ্য। সূত্র: মেগনা মেহতা

 

ফ্লাই অ্যাশ ও ঘোড়ামারা-লোহাচড়ার বিপন্নতা

সাগরদ্বীপের কাছেই অবস্থিত ঘোড়ামারা দ্বীপ। এখানে ভূপ্রকৃতি ও মানুষের জীবন ক্রমাগত ভূমিক্ষয়ের শিকার হয়েছে। গত একশো বছর ধরে এই দ্বীপের ৮৪ শতাংশ জমি সমুদ্রে বিলীন হয়েছে। এখন মাত্র চার বর্গকিলোমিটার স্থলভাগ অবশিষ্ট রয়েছে সেখানে। এই ব্যাপারে সাম্প্রতিক সময়ে বহু গবেষণাও[27] হয়েছে।[28]

দুই দশক আগে নিকটবর্তী লোহাচড়া দ্বীপ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়, ফলে সেখানকার ছয় হাজার বাসিন্দা ঘরহারা হন।[29] অন্যদিকে, কোথাও আবার নতুন চর গজিয়ে উঠছে। তবে এই পরিবর্তনের পেছনে শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নামক বিমূর্ত ধারণাটি দায়ী নয়। বরং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীবর্গের নানা কার্যকলাপ— বাস্তুতন্ত্রের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে উপকূলীয় এলাকায় নদীবাঁধ ও গার্ড-ওয়াল নির্মাণ, ফ্লাই অ্যাশ বোঝাই বিশাল জলযানের চলাচল ও ডুবি— এসবই এই গঠন-বিগঠনের জন্য দায়ী।

প্রকাণ্ড ফ্লাই অ্যাশবাহী জলযানের অবাধ চলাচলে সুন্দরবনের সাধারণ মৎস্যজীবীদের ডিঙি-নৌকা ও মাছ ধরার জাল বিপন্ন। সূত্র: মেগনা মেহতা

 

২০২৩ সালে ভূমিক্ষয়ে ফ্লাই অ্যাশ-বাহী জলযানের বেলাগাম চলাচলের ভূমিকা কলকাতা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে প্রকাশ্যে তুলে ধরেন পশ্চিমবঙ্গের ডিজ্যাস্টার ম্যানেজমেন্ট মন্ত্রী জাভেদ খান।[30] বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বারংবার সেই অঞ্চলে ফ্লাই অ্যাশে বোঝাই জাহাজ ডুবে যাচ্ছে। ৩ নভেম্বর ২০২১ তারিখে ঘোড়ামারার কাছাকাছি খাসিমারা গ্রামের পার্শ্ববর্তী হুগলি নদীর জলরাশিতে একটি ফ্লাই অ্যাশ বোঝাই জাহাজ ডুবে যায়। সেই জাহাজের অবশিষ্টাংশ, যেমন পূর্বে বলা হয়েছিল, ২০২৩ অবধি জল থেকে উদ্ধার করা হয়নি। ২০২২ সালের মার্চ মাসের গোড়ার দিকে আবার ঘোড়ামারার কাছে ‘এমভি ওয়ানি-২’ নামের একটি ফ্লাই অ্যাশ বোঝাই জাহাজ ডুবে যায়। পরিবেশ আদালতে সরকারের পক্ষ থেকে জমা হওয়া একটি অ্যাফিডেভিটে বলা হয়, দুর্ঘটনার সময় ওই জাহাজে ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটির আইন অনুযায়ী অনুমোদিত কোনও ‘মাস্টার’ নাবিক ছিলেন না এবং জাহাজটি আইনসিদ্ধ রুট থেকে সরে দুর্ঘটনার শিকার হয়।[31] সেই একই বছর, সেই একই মাসের ৩০ তারিখ ভোরবেলায় ‘এমভি সি প্রাইড’ নামের একটি জলযান বজবজ থেকে ফ্লাই অ্যাশ বোঝাই হয়ে বাংলাদেশ যাওয়ার পথে ঘোড়ামারা দ্বীপের কাছাকাছি এমনভাবে ডুবে যায়, যে দুর্ঘটনার ফলে স্থানীয় মৎস্যজীবীদের জাল ফেঁসে যায় এবং তাদের নৌকা ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[32]

ফ্লাই অ্যাশবাহী জলযানের অবাধ আনাগোনায় নদীবাঁধ ভেঙে গেছে। বালি-২, গোসাবা ব্লক। সূত্র: মেগনা মেহতা

 

আইনের স্পষ্ট নিদান সত্ত্বেও কেউ ক্ষতিপূরণ পাননি

মার্চ থেকে মে ২০২০ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া পাঁচটি ফ্লাই অ্যাশ-বাহী জাহাজডুবির ঘটনা-সহ উপরে বর্ণিত প্রায় সব দুর্ঘটনা পরিবেশ আদালতের সামনে উঠে এসেছে। মামলাকারী ট্রেড ইউনিয়ন ন্যায্য ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছিল। তবে, ২০২৩ সালের মার্চে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অধ্যক্ষের উপর ক্ষতিপূরণের বিষয়টি চাপিয়ে শুনানি শেষ করে আদালত। এরপরও আজ পর্যন্ত কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। মামলাটি বেসরকারিভাবে বন্ধ হয়ে গেলেও, ঘোড়ামারা, কুলপি এবং ভারতীয় সুন্দরবন ব-দ্বীপ অঞ্চলে, বিশেষ করে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রোটোকলভুক্ত জলপথে ফ্লাই অ্যাশ বোঝাই জাহাজের চলাচল এবং মাঝেমাঝে জাহাজ ডুবে যাওয়ার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।

নদীজলে মিশে যাচ্ছে ফ্লাই অ্যাশ। সূত্র: “Report of the Comptroller and Auditor General of India on Economic Sector For the year ended March 2016”, Government of West Bengal, Report No. I of the year 2017

 

২০২৫ সালে আবার জাহাজডুবি, আবার মামলা

চলতি ২০২৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, ঘোড়ামারা দ্বীপের কাছে কাকদ্বীপ ৮ নম্বর লট অঞ্চলের একটি বালুচরে আটকে পড়ে ফ্লাই অ্যাশ বোঝাই ‘এমভি সি ওয়ার্ল্ড’ নামের জাহাজটি।[33] বজবজ থেকে ফ্লাই অ্যাশ বোঝাই হয়ে বাংলাদেশে যাচ্ছিল ওই জলযানটি। তিন-চারদিন ধরে ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ভেঙেচুরে মুড়িগঙ্গা নদীর জলে মিশে যায় সেটি, সাথে বোঝাই ফ্লাই অ্যাশ। ওই এলাকায় তোপসে, ভোলা, ভেটকি, চিংড়ি, ফরসা প্রভৃতি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন ঘোড়ামারা, সাগর, কাকদ্বীপ ও হলদিয়ার মতো অঞ্চলের বহু সাধারণ মৎস্যজীবী। এই দুর্ঘটনার ফলে তাঁদের জীবন-জীবিকা আবারও কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে।

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে টাইমস অফ ইন্ডিয়া পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চ এই ঘটনার বিষয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মামলা গ্রহণ করে। আইনের পরিভাষায় একে বলে ‘স্যুয়ো মোটো কগনিজ্যান্স’। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে এই সংক্রান্ত মামলাটি Original Application No. 30/2025/EZ নামে নথিভুক্ত হয়। আদালতের আদেশ অনুযায়ী দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক এই বিষয়ে প্রশাসনিকভাবে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেই সংক্রান্ত একটি ‘কমপ্লায়েন্স রিপোর্ট’[34] জমা দিয়েছেন।

মামলার পরবর্তী শুনানি হয় ৭ মার্চ ২০২৫ তারিখে। সরকারি পক্ষে দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক পরিবেশ আদালতকে একটি এফিডেভিটে জানান যে, কাকদ্বীপ ৮ নম্বর লটে আটকে থাকা ‘আজবেলা নেভিগেশন’-এর জলযানটির ভগ্নাবশেষ সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট স্থানটি পরিষ্কার করা হয়েছে। সেই সরকারি হলফনামায় স্পষ্টভাবে স্বীকার করা হয় যে, পরিষ্কারের সময়ে জলযানের কিছু পরিমাণ ফ্লাই অ্যাশ নদীর জলে মিশে গেছে। অবশিষ্ট ফ্লাই অ্যাশ সংগ্রহ করে সাগর ব্লকের ঘোড়ামারা গ্রাম পঞ্চায়েতের খেয়াঘাটে— বিশালাক্ষি মন্দিরের কাছে— জমা করে রাখা হয়েছে। এই শুনানির পর ১৮ মার্চ ২০২৫ তারিখে পরিবেশ আদালতের ওয়েবসাইটে আপলোড হওয়া আদেশনামায় ফ্লাই অ্যাশ থেকে সৃষ্ট জলদূষণের দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া হয়।

চলমান মামলাটির পরবর্তী শুনানি হয় ২৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে। সেই শুনানিতে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ আদালতে একটি হলফনামা পেশ করে জানায় যে, তাঁরা ইনল্যান্ড ওয়াটারওয়েজ অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (IWAI)-এর ডায়রেক্টরের উদ্দেশে ৫ মার্চ ২০২৫ তারিখে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। জবাবে জানা যায়, বাংলাদেশের জলযান ‘এমভি সি ওয়ার্ল্ড’ বজবজ ৪ নম্বর জেটি থেকে ১১৯০ মেট্রিক টন ফ্লাই অ্যাশ নিয়ে যাত্রা শুরু করার পর ডুবে যায়। এর মধ্যে ৬০০ মেট্রিক টন ফ্লাই অ্যাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। উল্লেখ্য, পর্ষদের পেশ করা এই হলফনামা পরিবেশ আদালতের ওয়েবসাইটে ১ মে ২০২৫ তারিখে আপলোড হওয়া আদেশনামায় প্রতিফলিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, পর্ষদ ৫ মার্চ তারিখের চিঠিতে ডুবে যাওয়া জলযান থেকে সংগৃহীত ফ্লাই অ্যাশ সিমেন্ট, কংক্রিট, ইট, ব্লক ইত্যাদি তৈরিতে এবং উপযুক্ত লাইনিং-সহ ল্যান্ডফিল উপাদান হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে, যাতে জল চুইয়ে পড়া বা লিচিং প্রতিহত করা যায়।

আদালত পর্ষদকে এই বিষয়ে আরও বিশদ একটি হলফনামা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে ৭ আগস্ট ২০২৫— অর্থাৎ, ঘোড়ামারা দ্বীপের ফ্লাই অ্যাশ-বাহী জাহাজডুবির ঘটনার প্রায় ছয় মাস পর। হলফনামা, আদেশনামা এবং সরকারি পত্রাচার প্রক্রিয়া চালু রয়েছে। পাশাপাশি, গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের নদী-মোহনা-সমুদ্রের জলরাশিতে বিষাক্ত ফ্লাই অ্যাশের ছড়িয়ে পড়াও বহাল রয়েছে।

কোনও মামলার রুজু হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে তার নিষ্পত্তির জন্য সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণের নির্দেশ জাতীয় পরিবেশ আদালতের সরকারি ওয়েবসাইটেই জাজ্বল্যমান।[35] অথচ বাস্তবে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার বহু পুরনো একটি বৈশিষ্ট্য— দীর্ঘসূত্রিতা— এই বিশেষ আদালতকেও ক্রমশ গ্রাস করেছে।

 

সুন্দরবনে বিপন্নতার বিবিধতা ও পারস্পরিক সম্পৃক্ততা

বাস্তবতার নিরিখে এ-কথা বলা কখনওই সঙ্গত নয় যে ফ্লাই অ্যাশ ও তা বহনকারী জলযানের চলাচল ও ডুবে যাওয়াই সুন্দরবনের ভূমিক্ষয়, প্রকৃতিনাশ কিংবা সেখানকার মানুষের জীবন-জীবিকার বিপন্নতার একমাত্র কারণ। এই বহুধা-বিস্তৃত গাঙ্গেয় ও উপকূলীয় জল-স্থলজ জটিলতায়, নদী-খাঁড়ি-জঙ্গলঘেরা ভূপ্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের অস্তিত্ব— সবই পরস্পরসংযুক্ত। এই বিপন্নতার কারণও নানা স্তরে বিস্তৃত ও বহুস্তরীয়। এ-বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও আলাপ-আলোচনার চেষ্টা করব। এখানে ফ্লাই অ্যাশ প্রসঙ্গেই আরও কিছু কথা বলা যাক।

এটা একেবারেই বলা বা ভাবা সঙ্গত নয় যে সুন্দরবনে কেবল হুগলি নদীর পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চল— যেমন কুলতলি, কুলপি, কাকদ্বীপ, নামখানা, ডায়মন্ড হারবার কিংবা সাগরদ্বীপের নিকটবর্তী ঘোড়ামারা ও লোহাচড়া— এই ধরনের জলযান চলাচল ও জাহাজডুবির ঘটনায় বিপন্ন।

লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স অ্যান্ড পলিটিকাল সায়েন্স থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত নৃতত্ত্ববিদ মেগনা মেহতার গবেষণাপত্র Conserving Life: Forest Imaginaries and Competing Values in the Sundarbans Forests of India-তে তুলে ধরা হয়েছে, কীভাবে ফ্লাই অ্যাশ-বাহী জাহাজের অবিরাম চলাচল গোসাবা ব্লকের বালিদ্বীপে বিদ্যানদীর তীরবর্তী অঞ্চলকে ভূমিক্ষয়ের শিকার করেছে।[36] এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নদীবাঁধ, সংলগ্ন চাষের জমি এবং বহু মানুষের ভিটেবাড়ি।

আবার, ২০২৫ সালে প্রমেয় ফাউন্ডেশন প্রযোজিত একটি সংক্ষিপ্ত ভিডিওচিত্রে ঝড়খালি গ্রাম পঞ্চায়েতের নদীপ্রান্তবর্তী ত্রিদিবনগরের এক মৎস্যজীবীর বয়ানে উঠে এসেছে— ফ্লাই অ্যাশ-বাহী জাহাজের চলাচল কীভাবে তাঁদের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবন-জীবিকার উপর নিত্যনৈমিত্তিকভাবে অপ্রমেয় সংকট ডেকে আনছে।

 

সুন্দরবনের বাংলাদেশ-অংশেও একই সংকট

সুন্দরবন তথা গাঙ্গেয় দক্ষিণবঙ্গের এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের প্রকৃতি ও মানুষকে ঘিরে আইন ও প্রশাসনিক গঠনের প্রয়োগ কিংবা অপ্রয়োগ, পালনের আন্তরিকতা বা অবহেলা— এইসব বিষয়ের একটি সর্বাঙ্গীন বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও, সেখানে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনিবার্য প্রসঙ্গ উঠে আসে, যেটি সর্বতোভাবে প্রাসঙ্গিক। এই ব-দ্বীপ বিস্তীর্ণ এক ভূখণ্ড, যা দুটি দেশে বিভক্ত— ভারত ও বাংলাদেশ। দুই দেশের রয়েছে নিজস্ব আইন-কানুন, প্রশাসনিক কাঠামো ও নীতি-পরিকল্পনার আলাদা হিসাবনিকাশ। কিন্তু প্রকৃতি পাসপোর্ট বা ভিসার তোয়াক্কা করে না।

ফ্লাই অ্যাশের প্রসঙ্গে এ-কথা স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায় যে এর চাহিদা মূলত আসছে বাংলাদেশ থেকে, আর জোগান যাচ্ছে ভারতের পক্ষ থেকে। কিন্তু এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশ নিজেও ফ্লাই অ্যাশজনিত বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে। এই বিষয়ে ২০১৪ সালের জুন মাসে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র উল্লেখযোগ্য। খণ্ড ৪, ইস্যু ৪-এ প্রকাশিত Fly Ash in Bangladesh – An Overview শীর্ষক ওই প্রবন্ধে গবেষক মির মহম্মদ তামিম, অরিন্দম ধর এবং মহম্মদ শাহদৎ হোসেন বাংলাদেশের ফ্লাই অ্যাশ সংকটের একটি বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশের প্রসঙ্গ এলে অনিবার্যভাবে উঠে আসে রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রসঙ্গ।[37] এই প্রকল্প থেকে উৎপন্ন ফ্লাই অ্যাশ এবং তার যথেচ্ছ ও বেআইনি ডাম্পিং-এর আশঙ্কা গোটা সুন্দরবন অঞ্চলের উপর এক স্থায়ী পরিবেশগত ছায়া বিস্তার করেছে।[38]

২০১৪ সালে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত সুন্দরবনের শেলা নদীতে তেলবাহী জলযান ‘ওটি সাদার্ন স্টার-৭’ ডুবে যায়। এতে ৯৪,০০০ গ্যালন ভারি ফুয়েল জলে মিশে বিপুল ক্ষতি হয় শেলা নদী ও এর সঙ্গে যুক্ত পাশুর নদীর জৈববৈচিত্র্যে।[39] দুর্ঘটনার স্থান থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরত্বে শেলা-পাশুর নদীর সঙ্গমস্থল অবস্থিত। এই দুর্ঘটনার ফলে ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাতে নির্ভরশীল মৎস্যজীবীদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ে। নদীর পানিতে প্রবল হেভি-মেটাল দূষণের কারণে গাঙ্গেয় ও ইরাবতীয় শুশুক-সহ অন্যান্য প্রাণীর জীবনসংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে ওঠে।

 

সুন্দরবনে কার্গোবাহী জাহাজডুবি— একটি অসম্পূর্ণ ক্রোনোলজি

২০২৫ সালে মিল্কউইড এডিশনস থেকে প্রকাশিত আরতি কুমার রাও-এর গবেষণা ও অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক গ্রন্থ মার্জিনল্যান্ডস – এ জার্নি থ্রু ইন্ডিয়া’স ভ্যানিশিং ল্যান্ডস্কেপ-এ প্রসঙ্গক্রমে বাংলাদেশের কথাও উঠে এসেছে। তিনি জানাচ্ছেন,

এপ্রিল ২০১৩ থেকে মার্চ ২০১৮ পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এই অঞ্চলের জলপথে আটবার মালবাহী জলযান ডুবে গিয়েছে। কার্গো হিসেবে ছিল সিমেন্ট, তেল, পটাশিয়াম-ভিত্তিক রাসায়নিক সার, ফ্লাই অ্যাশ, কয়লা ইত্যাদি। এরপরও এই ঘটনা বহুবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। ২০২০ সালের প্রথম সাত মাসের মধ্যে হুগলি নদীতে আটটি ফ্লাই অ্যাশ-বাহী জাহাজ ডুবে গিয়েছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশে তিনটি কয়লাবাহী জাহাজ ডুবে গিয়েছে। আবার ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসেই সুন্দরবনের জলে আরও তিনটি জাহাজ ডুবে গিয়েছে।

খুলনা জেলায় মোংলা পোর্ট থেকে বেরিয়ে বা সেই বন্দরে প্রবেশের সময় জলযানগুলো সুন্দরবনের ঘাসিয়াখালি চ্যানেল ধরে চলাচল করে,[40] আবার কখনও আইনি অনুমতির অভাবে পার্শ্ববর্তী সরু খাল-খাঁড়ি দিয়ে চলাচল করতে হয়।[41] এতে ব-দ্বীপের বিপন্নতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই দেশ মিলে গড়ে তোলা একটা নয়, দু-দুটো পৃথক কয়লা-চালিত থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের তথাকথিত উন্নয়নের নামে সামগ্রিক সুন্দরবনের ভূ-প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে সেখানকার গ্রামবাসী ও সাধারণ মৎস্যজীবীদের জীবনধারণের পথ খুবই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে।

আলোচনার এই পর্যায়ে দেখা যাচ্ছে, দুটো দেশের প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাবে কীভাবে বর্ডারের দুই দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামগ্রিক দক্ষিণবাংলার সুন্দরবন এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। সর্বাঙ্গীনভাবে বিপন্ন হচ্ছেন সেখানকার মানুষরাও। এই বিপন্নতার পেছনে দায়ী শুধুমাত্র ফ্লাই অ্যাশ ও ফ্লাই অ্যাশবাহী জাহাজের ডুবে যাওয়া নয়, পাশাপাশি কয়লা ও অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক কার্গোবাহী বড় জলযান, মাছ ধরার যান্ত্রিক ট্রলারগুলোর অবাধ ও বেলাগাম চলাচল, সে-সবের ফলে ঘটা ভূমিক্ষয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কয়লা-চালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থনীতি ও আরও অসংখ্য বিষয়বস্তু ও প্রসঙ্গ।

সুন্দরবনের বিপন্নতা এবং সেখানে বসবাসকারীদের বঞ্চনার বাস্তব আলেখ্যগুলো সুন্দরবনের জল, জঙ্গল, জমিনের মতোই নিবিড়ভাবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই গভীরতার আবডালে এই বিপন্নতা ও বঞ্চনার হিসেব-নিকেশ মূলধারার নজর থেকে প্রায় অগোচর থেকে গেছে।

আগামীতে এই আলোচনা ও চর্চা আরও এগিয়ে চলুক। যদিও পথ কঠিন, তবু এই দুঃখ, কষ্ট ও ক্ষতগুলো থেকে আমরা যেন চোখ সরিয়ে না নিই।


[1] McBride, JP et al. Radiological impact of airborne effluents of coal and nuclear plants. Science. Dec 8, 1978.
[2] Hvistendahl, Mara. Coal Ash Is More Radioactive Than Nuclear Waste. Sci Am. Dec 13, 2007.
[3] Fly Ash. Energy Education.
[4] মণ্ডল, সমরেশ। নদীতে ‘ফ্লাই অ্যাশ’, স্বতঃপ্রণোদিত মামলা জাতীয় পরিবেশ আদালতের। আনন্দবাজার.কম। ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৫।
[5] Kumar-Rao, Arati. Marginlands: A journey into India’s vanishing landscapes. Milkweed Editions.
[6] BEFORE THE NATIONAL GREEN TRIBUNAL, NEW DELHI. Sep 20, 2011.
[7] REPORT ON FLY ASH GENERATION AT COAL/LIGNITE BASED THERMAL POWER STATIONS AND ITS UTILIZATION IN THE COUNTRY FOR THE YEAR 2020-21. Ministry of Power, Govt. of India. Aug, 2021.
[8] Tamim, Mir Md; Dhar, Arindam; Hossain, Md. Shahadat. Fly ash in Bangladesh – an Overview. Researchgate. Apr, 2013.
[9] অন্তর্দেশীয় জল পরিবহণ ও বাণিজ্য প্রোটোকল, ২০০৯ ও ২০২০।
[10] The MoEF&CC Notification on Coal Washing, 2020 and CSE’s Comments. Centre for Science and Environment.
[11] Acharya, Namrata. Fly ash in India: A free movement of toxicity to Bangladesh. Mongabay. Oct 23, 2020.
[12] Fly Ash Notification. CPCB. Dec 31, 2021.
[13] Letter of Ministry of Power. Nov 8, 2021.
[14] Letter of Ministry of Power. Feb 28, 2023.
[15] Notification. Ministry of Environment, Forest and Climate Change. Jan 18, 2019.
[16] IWAI/Cargo/39/2020-21/Part.
[17] Development of Logistics Infrastructure: Inland Waterways. IWAI. Nov 22, 2019.
[18] দ্রষ্টব্য, টীকা ১১।
[19] জাতীয় পরিবেশ আদালত, আদেশ তারিখ: ১৯/১০/২০২০, ১৩/১০/২০২২, ১৩/০৩/২০২৩ ও ২০/০৩/২০২৩, অরিজিনাল অ্যাপ্লিকেশন নং ৬৪/২০২০/ইস্ট জোন।
[20] Order of the National Green Tribunal regarding fly ash barge capsizing incidents in river Hooghly in West Bengal, 19/10/2020. India Environmental Forum. Oct 19, 2020.
[21] ভার্মা, আভলি। মতামত: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ নদী ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তার দিকগুলো জরুরী ভিত্তিতে পর্যালোচনা প্রয়োজন। ডায়লগ আর্থ। জুন ২, ২০২৩।
[22] Bangladeshi cargo vessel sinks in Hooghly. The Hindu. Mar 13, 2020.
[23] Chakraborty, Monotosh. Sinking Bangladeshi vessel dumps toxic fly ash in river near Ghoramara, shows video shared by panchayat member. TOI. Feb 17, 2025.
[24] Barges carrying fly ash to Bangladesh trigger erosion in Sunderbans: Minister Javed Khan. The Telegraph Online. Jul 19, 2023.
[25] Verma, Avli. Fly ash trade via India-Bangladesh water routes points to need for transboundary river safety rules. Scroll.in. Jun 23, 2023.
[26] পূর্বোক্ত।
[27] Biswas, Arkoprovo. et al. Morphological Change Study of Ghoramara Island, Eastern India Using Multi Temporal Satellite Data. Researchgate.net. Aug 31, 2012.
[28] Mondal, Biraj Kanti. et al. Analysis of the shoreline changes using geoinformatics in Ghoramara Island of Hugli Estuary, West Bengal in India. Journal of King Saud University – Science, Vol 36, Issue 1. Jan 2024.
[29] Srinivasan, Piya. On Islands Swallowed By Water, There Is Nowhere Else to Go. The Wire. Jan 30, 2024.
[30] Barges carrying fly ash to Bangladesh trigger erosion in Sunderbans, says West Bengal minister. The Business Standard.
[31] দ্রষ্টব্য, টীকা ২৫।
[32] Bangladeshi ship stuck in fishing net. TOI. Mar 31, 2022.
[33] দ্রষ্টব্য, টীকা ২৩।
[34] Compliance Report, 6 Mar 2025.
[35] About Us. National Green Tribunal.
[36] Mehta, Megnaa. Conserving Life: Forest Imaginaries and Competing Values in the Sundarbans Forests of India.
[37] Islam, Kazi Faisal. Impact of Coal based Power Plant of Rampal on the Sundarbans and Surrounding Areas. Researchgate.net. Jan 5, 2018.
[38] Rahman, Mowdud. Sundarbans: World’s Largest Mangrove Forest At Stake. Greenpeace. Jun 25, 2017.
[39] Choudhury, Tasrina Rabia. et al. Heavy metals contamination of river water and sediments in the mangrove forest ecosystems in Bangladesh: A consequence of oil spill incident. Environmental Nanotechnology, Monitoring & Management, Vol. 16. Dec, 2021.
[40] Arju, Mohammad. As Ghasiakhali channel reopens, hope flickers for Sundarban. Daily Sun. May 30, 2025.
[41] Mongla-Ghasiakhali channel reopens for bigger vessels. প্রথম আলো। Oct 6, 2016.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5088 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...