
অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত চিরসবুজ আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ‘ভিকাশ’-এর নামে আরেক মারণ-যজ্ঞের আয়োজন শুরু হতে চলেছে। ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের তরফে এই প্রকল্পকে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এই ছাড়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়াটি যাতে কোনওরকম বাধার সম্মুখীন না হয়, তার জন্যই ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রেট নিকোবর দ্বীপের অন্তর্গত গলাথিয়া মোহনা ও তৎসংলগ্ন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ অঞ্চল এবং এন্ডেমিক প্রজাতি মেগাপোড সংরক্ষণ অভয়ারণ্য— এই দুটিকেই কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রকের তরফে ডি-নোটিফাই করা হয়েছে। অর্থাৎ, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এলাকা বা অভয়ারণ্য হিসেবে এই দুটি অঞ্চলের আর কোনও সরকারি গুরুত্ব রইল না। এরই পাশাপাশি শুরু হয়ে গিয়েছে ওই এলাকার জনজাতি গোষ্ঠীগুলিকে ঠেকিয়ে রাখার প্রক্রিয়া
ধরিত্রী দিবস (২২ এপ্রিল) হোক কিংবা পরিবেশ দিবস (৫ জুন)— গড়পড়তা আনুষ্ঠানিক উদযাপনের মধ্যে দিয়েই তারা একে একে পেরিয়ে যায়। বছরের বাকি দিনগুলো পড়ে থাকে অবহেলায়। একসময় পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে আমাদের প্রজন্মের ভিতরেও যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা লক্ষ্য করেছিলাম, তা ক্রমশ দশক পালটাতে পালটাতে ভাটার দিকে যেতে দেখেছি। ইংরেজি অভিধানে নতুন একটি শব্দের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে— woke। এই ‘ওক প্রজন্ম’-এর নামে সচেতন পরিবেশবাদী আন্দোলনকে দাগিয়ে দেওয়ার এক অপচেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে, বিশ্বজুড়ে আমরা দেখেছি নয়া-ধনতন্ত্রের উত্থান। এই নতুন সময়ে, পরিবেশ পরিবর্তন বা বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো প্রতিষ্ঠিত সত্যকেও ‘উন্নয়ন-বিরোধী’দের প্রচার বলে দাগিয়ে দিয়ে পরিবেশ সচেতনতার কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। ধরিত্রী দিবস হোক কিংবা পরিবেশ দিবস— এখন সেগুলি যেন কেবল রচনা লেখার দিনমাত্র। সচেতনতার বার্তা বা প্রচার-আন্দোলন আজকের সোশাল প্রজন্মের কাছে কেবলই ভিউস, কমেন্টস আর কনটেন্টের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই মূলধারার বাংলা সংবাদমাধ্যমেও হাসদেও-আরন্দের মতো ঘটনার[1] গুরুত্ব পাওয়া হয় না। গুরুত্ব আসে তখনই, যখন আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠা কেউ হঠাৎ কোনও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হন। ওড়িশা থেকে ছত্তিশগড়— কোথাওই বেআইনি জমি দখল, অরণ্য ধ্বংস বা পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ খবর মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্তের সান্ধ্যকালীন আলোচনায় উঠে আসে না। তাই গ্রেট নিকোবর প্রকল্পের মতো চরম পরিবেশ-বিধ্বংসী প্রস্তাবও সকলের অগোচরে সরকারি অলিন্দে অবলীলায় পাশ হয়ে যায়। এই প্রকল্পের সূত্রপাত হয়েছিল ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর।
চারধাম প্রকল্পের মাধ্যমে উত্তরাখণ্ডে যে দীর্ঘমেয়াদি বিপর্যয় ঘটে গিয়েছে, তার থেকে পরিত্রাণের কোনও সম্ভাবনা এ-যাবৎ দেখা যায়নি।[2] সাম্প্রতিক বালকোট-সিলকিয়ারা সুড়ঙ্গ বিপর্যয়ের প্রসঙ্গ এই পত্রিকাতেই আলোচনা করা হয়েছে।[3] তারও আগে, এই পত্রিকার একাধিক রচনায় তুলে ধরা হয়েছিল— কীভাবে বিরাট এই প্রকল্পটিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে ভেঙে পরিবেশবিজ্ঞানী গুরুদাস অগ্রবালের প্রস্তাব ও আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করে কেন্দ্রীয় সরকার গায়ের জোরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। এই বিষয়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন বারবার প্রকাশ পেয়েছে। এতদসত্ত্বেও ‘ভিকাশ’–এর জয়রথ থামানো যায়নি। তারই মাশুল গুনেছেন এবং এখনও গুনে চলেছেন উত্তরাখণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
একই ধাঁচে, বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত চিরসবুজ আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ‘ভিকাশ’-এর নামে আরেক মারণ-যজ্ঞের আয়োজন শুরু হতে চলেছে। ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর, কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের তরফে এই প্রকল্পকে চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এই ছাড়পত্র দেওয়ার প্রক্রিয়াটি যাতে কোনওরকম বাধার সম্মুখীন না হয়, তার জন্যই ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে গ্রেট নিকোবর দ্বীপের অন্তর্গত গলাথিয়া মোহনা ও তৎসংলগ্ন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ অঞ্চল এবং এন্ডেমিক প্রজাতি মেগাপোড সংরক্ষণ অভয়ারণ্য— এই দুটিকেই কেন্দ্রীয় বন মন্ত্রকের তরফে ডি-নোটিফাই করা হয়েছে। অর্থাৎ, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ এলাকা বা অভয়ারণ্য হিসেবে এই দুটি অঞ্চলের আর কোনও সরকারি গুরুত্ব রইল না। এরই পাশাপাশি শুরু হয়ে গিয়েছে ওই এলাকার জনজাতি গোষ্ঠীগুলিকে ঠেকিয়ে রাখার প্রক্রিয়া।
ঠিক কী প্রস্তাব রয়েছে এই গ্রেট নিকোবর প্রকল্পে? নীতি আয়োগের প্রস্তাব অনুযায়ী, ৭২,০০০ কোটি টাকার এই প্রকল্পে গ্রেট নিকোবর দ্বীপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে গড়ে তোলা হবে এক বিরাট সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও টাউনশিপ। এই প্রস্তাবের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ৪০,০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মীয়মাণ এক বিশাল সমুদ্রবন্দর, যা গলাথিয়া মোহনার উপরেই গড়ে তোলা হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, গলাথিয়া মোহনাই হল জায়ান্ট লেদারব্যাক কচ্ছপদের এক অন্যতম বিচরণক্ষেত্র ও প্রজননস্থল। এই কারণে, ১৯৯৭ সালে গলাথিয়াকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে বর্তমান সরকার এক বিশেষ নির্দেশিকার মাধ্যমে সেই ঘোষণাটি প্রত্যাহার করে নেয়। মনে রাখা প্রয়োজন, জায়ান্ট লেদারব্যাক কচ্ছপ ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী বিশেষ সংরক্ষিত একটি প্রজাতি। সারা পৃথিবীতে এমন কচ্ছপদের ব্যবহারে থাকা এত বড় প্রজননক্ষেত্রের নজির প্রায় নেই বললেই চলে। সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে, প্রজননের সময় এই উপকূলভূমিতে তারা ফিরে আসে। বহু শতাব্দী ধরে টিকে থাকা এক জটিল বাস্তুতন্ত্রের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকেই উপেক্ষা করে, সেই উপকূলের দখল নিতে চলেছে ‘ভিকাশ’–এর জয়রথ।
নীতি আয়োগ ও পরিবেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, কচ্ছপদের জন্য “একটু জায়গা পাশে ছেড়ে রাখা হবে” এবং তারা যাতে সেই নির্ধারিত এলাকায় পৌঁছাতে পারে, তার জন্য সমুদ্রজলে বিশেষ আলো লাগানো বয়া ভাসিয়ে রাখার এক ‘একমেবদ্বিতীয়ম’ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ধরিত্রীর এই বিশাল বাস্তুতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে, একবিংশ শতাব্দীতে এসে কোনও দায়িত্বশীল সরকার ও তার প্রতিনিধিদল এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিতে পারে— তা যেন সত্যিই অবিশ্বাস্য ঠেকে।
এই বন্দরের পাশাপাশিই সেই সবুজ অরণ্যকে ধ্বংস করে আরও গড়ে উঠবে বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ও বিশাল টাউনশিপ। এর ফলে প্রায় ১৩০ বর্গকিলোমিটার ঘন সবুজ বনাঞ্চল কেটে ফেলা হবে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ১৮.৬৫ লক্ষ গাছ এই প্রকল্পের জন্য কাটা হবে। এসব গাছের মধ্যে অনেকের উচ্চতা ৪৫ মিটার বা তারও বেশি, এবং বহু শতাব্দী ধরে তারা এই বনাঞ্চলে অবস্থান করছে। বিজ্ঞানী, পক্ষীবিদ, পরিবেশকর্মী সকলেই এই ভয়াবহ প্রস্তাবের চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য দেখে কার্যত বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। বারংবার তাঁরা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের এই চিরসবুজ, বিস্তৃত বনাঞ্চল— সারা পৃথিবীতে এমন প্রাচীন ও কুমারী বনাঞ্চল খুবই বিরল। বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে এই বনাঞ্চল আমাজন অববাহিকার সুগভীর অরণ্যের সমতুল্য।
এই অরণ্য ধ্বংসের অর্থ একদিকে পরিবেশগত ভারসাম্যের বিনাশ, অন্যদিকে বহু স্থানীয় প্রাণী ও উদ্ভিদের চিরতরে বিলুপ্তি, বিশেষ করে যারা এন্ডেমিক (অর্থাৎ শুধুমাত্র এই অঞ্চলে পাওয়া যায়) প্রজাতি। স্বভাবতই সরকার বিজ্ঞানী কিংবা পরিবেশ-সংগঠনগুলোর এমন একাধিক আশঙ্কার প্রতি কোনওরকম কর্ণপাত করেনি।
আসা যাক জনজাতি কল্যাণের প্রশ্নে। আন্দামানের জারোয়াদের পাশাপাশি নিকোবরেও বিশেষ দুইটি জনজাতি গোষ্ঠীর বসতি রয়েছে। এর মধ্যে নিকোবরি জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষ সংখ্যার দিক থেকে অধিক এবং তুলনামূলকভাবে আমাদের মেকি ‘সভ্যতা’র কিছুটা হলেও কাছাকাছি এসেছে। অন্যদিকে শম্পেন জনজাতির মানুষ প্রায় ১০,০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নিকোবর দ্বীপের গভীর অরণ্যের বাসিন্দা, এবং ‘সভ্যতা’র সঙ্গে প্রায় সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন এক সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। এমন প্রাচীন এক জনগোষ্ঠীর উদাহরণ সারা পৃথিবীতেও বিরল।
২০০৪ সালের সুনামির পর সরকারি উদ্যোগে শম্পেনদের একাংশকে নিকোবর দ্বীপেরই সরকার-নিয়ন্ত্রিত অংশে আশ্রয়শিবিরে নিয়ে আসা হয়। নিকোবরি জনজাতি গোষ্ঠীর মানুষেরাও অধিক সংখ্যায় ওই শিবিরে আশ্রয় নেয়। সরকারের তরফে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, সুনামি-পরবর্তী অবস্থা অনুকূল হলে তাদের নির্দিষ্ট বসতি এলাকায় ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। দুই দশক পরেও সেই ‘ফিরে যাওয়া’র অনুমতি মেলেনি।
উচ্ছেদ হয়ে আসা শম্পেন ও নিকোবরি মানুষেরা আজ অসহায়ভাবে প্রত্যক্ষ করছে কীভাবে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে ক্রমশ পরিবেশ ও অরণ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। অথচ আধুনিক শিক্ষার পরিবর্তে তাদের সমাজে ঢুকে পড়ছে সভ্যতার নানা বিষ। সবুজ অরণ্যভূমির আদি-বাসিন্দাদের উত্তরপ্রজন্ম আজ ক্রমশ নানাধরণের বদ-নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের অস্তিত্ব-পরিচয়, সমাজ— সবকিছু থেকে তারা মূলোৎপাটিত হয়ে এক অন্ধকার অবশেষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এর পাশাপাশি, জনজাতি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেন, আশ্রয়শিবিরে আটকিয়ে রেখে ক্রমশ নানা কৌশলের মাধ্যমে তাদের দিয়ে নিজেদের এলাকার উপর উত্তরাধিকার-স্বত্ব লিখিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ, জনজাতি আইন অনুসারে সরকারিভাবে জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে সেই জনজাতি গোষ্ঠীর সম্মতি থাকা বাধ্যতামূলক। এর আগে ছত্তিশগড় ও ওড়িশা-সহ বিস্তীর্ণ অংশে বেআইনি গ্রামসভার অধিবেশনের মাধ্যমে খনি কোম্পানিগুলোর জমির স্বত্ব আদায়ের প্রক্রিয়া আমরা দেখেছি। নিকোবরের অসহায়, বাস্তুচ্যুত জনজাতি গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদেরও সেই একই কায়দায় ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আইন? সে তো তামাশা মাত্র! নিকোবর প্রকল্পের নিরিখে আরও একবার সেই বাস্তব মন্তব্যই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের অধীনে পূর্বাঞ্চলীয় বেঞ্চের এজলাসে নিকোবর প্রকল্প সংক্রান্ত চারটি আবেদন জমা পড়ে। অবাক বিস্ময়ের বিষয় হল, প্রথম দিনে— প্রথামাফিক ওকালতনামা পেশ করার কথা থাকলেও বেঞ্চ বসার কিছু সময় আগে হঠাৎ বিচারপতিদের তরফে জানানো হয়, তাঁরা আজই এই মামলা শুনবেন এবং রায় দেবেন। বিশেষ যে ছয় বিচারপতির বেঞ্চ আবেদনগুলোর শুনানির জন্য তৈরি করা হয়েছিল, পূর্বাঞ্চলীয় জোনের একজনও বিচারপতি সেই বেঞ্চে ছিলেন না। এই ঘটনাও ন্যাশনাল গ্রিণ ট্রাইব্যুনালের প্রাথমিক নির্দেশাবলি ও গঠনতন্ত্রের পরিপন্থী।
যে পরিবেশ-বিষয়ক বিশেষজ্ঞ দল বিচারপতিদের সহায়তা করার জন্য গঠন করা হয়, দেখা যায়, সেটি কেবল সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়েই গঠিত। আইন-বিশেষজ্ঞদের মতে, ন্যাচারাল জাস্টিসের ক্ষেত্রে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের এর চেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ বিরল। আবেদনকারীরা এ-ও উল্লেখ করেন, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে যে সভায় কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক এই প্রকল্পটিকে ছাড়পত্র দিয়েছে, তার আগে পরিবেশ মন্ত্রকের কোনও সভায় বা পর্যালোচনা বৈঠকে প্রকল্পের বিষয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি। সরকারি মিটিং রেজল্যুশন উল্লেখ করে তাঁরা প্রমাণ করেন, সামান্যতম আলোচনা ব্যতিরেকেই বিরাট এই প্রকল্পকে একলপ্তে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
এতদসত্ত্বেও আদালত চারটি আবেদনই খারিজ করে। সান্ত্বনা হিসেবে একটি সমীক্ষার কথা আদালতের নির্দেশে উল্লেখ করা হয়, কিন্তু সেই সমীক্ষাও কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের আওতায় সম্পন্ন করা হবে— যারা ইতিমধ্যেই প্রকল্পটিকে ছাড়পত্র দিয়েছে। এমন ন্যায়বিচারের পর নিকোবর প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি এবং সার্বিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া ভিন্ন কোনও পথ থাকে না।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, পরিবেশ-বিষয়ক জনমত আদৌ কখনও গড়ে উঠবে কি? সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব আমরা বারবার প্রত্যক্ষ করেছি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ভিকাশ’ অথবা ‘উন্নয়ন’-এর সজীব প্রচার।
কেবল অরণ্য ধ্বংস, প্রজাতির বিলুপ্তি অথবা জনজাতি গোষ্ঠীগুলির চিরতরে হারিয়ে যাওয়া— এই কি তবে নিকোবর প্রকল্পের একমাত্র অন্তিম ফলাফল? তাও বোধহয় নয়। একদিকে যেমন পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হবে, তেমনই অন্যদিকে যদি আমরা ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষার দিকে চোখ ফেরাই, দেখা যাবে— আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ পৃথিবীর অন্যতম ভূকম্পপ্রবণ অঞ্চল। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বরের সুনামির পর ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী এই সমগ্র অঞ্চল প্রায় ৫ মিটার পর্যন্ত বসে গিয়েছে। এমন অস্থিতিশীল এলাকায় বন্দর, বিমানবন্দর অথবা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো ভারী প্রকল্প গড়ে তোলা— সেগুলির প্রাথমিক নিরাপত্তার দিক দিয়েও কতটা বাস্তবসম্মত হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট অনুসন্ধান ও আশঙ্কার অবকাশ রয়েছে।
‘ভিকাশ’-দৌড়ে অন্ধ এই সরকার আদৌ কোনওদিন এমন আশঙ্কাগুলিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখবে কিনা— এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আজ লুকিয়ে আছে আন্দামান সাগরের গভীরে। আশার কথা বলতে পারছি না, তবু অন্তত এইটুকু আজ বলা দরকার—ব্য ক্তিগত পরিসরেও পক্ষ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে যেন আমাদের কোনওদিন ভুল না হয়।
ঋণস্বীকার: The Great Nicobar Betrayal, Curated by: Pankaj Sekhsaria, A FRONTLINE Publication, March, 2024.
[1] হাসদেও-আরন্দ ছত্তিশগড় রাজ্যের উত্তরাংশে অবস্থিত একটি বিস্তীর্ণ ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল, যা গোন্ড, ওরাঁও-সহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। এই বনাঞ্চল প্রায় ১,৭০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এবং এটি কেন্দ্রীয় ভারতের অন্যতম বৃহত্তম অবিচ্ছিন্ন বনভূমি হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলের নিচে বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুত রয়েছে, যা খননের জন্য বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিগত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে, পিপলস ইস্ট ও কান্তা বসান (PEKB) খনি সম্প্রসারণ প্রকল্পের জন্য বনাঞ্চলে গাছ কাটার কাজ শুরু হলে স্থানীয় আদিবাসীরা তীব্র প্রতিবাদে নামেন। এই প্রতিবাদে পুলিশি হস্তক্ষেপ হয় এবং কয়েকজন আদিবাসীকে গ্রেফতার করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, খননের জন্য গ্রামসভার সম্মতি নেওয়ার প্রক্রিয়ায় জালিয়াতি হয়েছে।
এই আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র অলোক শুক্লা, যিনি ছত্তিশগড় বাঁচাও আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, ২০২৪ সালে গোল্ডম্যান এনভায়রনমেন্টাল প্রাইজে ভূষিত হন তাঁর পরিবেশ সংরক্ষণে অবদানের জন্য।
আগ্রহী পাঠক আরও পড়তে পারেন:
- ভট্টাচার্য, অনির্বাণ। হাসদেও অরণ্য, অলোক শুক্লা এবং গোল্ডম্যান পুরস্কার। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। মে ১৫, ২০২৪।
- Naidu, Jayprakash S. What is the Hasdeo Arand mining issue, and why villagers clashed. The Indian Express. Oct 28, 2024.
- Inamdar, Nikhil. Adani Group: Chhattisgarh tribes’ year-long protest against tycoon’s coal mine. BBC. Mar 21, 2023.
- Adivasis against coal. Survival International.
- Paliwal, Ankur. The coal mine that ate an Indian village. The Guardian. Dec 20, 2022.
এই প্রতিবাদ ও আন্দোলনগুলি ভারতের পরিবেশ সংরক্ষণ ও আদিবাসী অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে।
[2] চারধাম প্রকল্পের আওতায় গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ ও বদ্রিনাথ এই চারটি তীর্থস্থানকে সংযুক্ত করতে প্রায় ৮৮৯ কিমি দীর্ঘ জাতীয় সড়ক সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য প্রায় ৬০০ হেক্টর বনভূমি উজাড় করা হয়েছে এবং ৫৬,০০০-এরও বেশি গাছ কাটা হয়েছে, যা পাহাড়ি ঢালের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে ।
সড়ক সম্প্রসারণের ফলে ঢালের কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে, যার ফলে ভূমিধসের সংখ্যা বেড়েছে। প্রকল্পের আওতায় ১৬১টিরও বেশি বড় ঢাল ধসের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। উত্তরাখণ্ডের জোশিমঠ শহরে ভূমিক্ষয়ের ফলে শতাধিক বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে এবং বহু পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পটি ৫৩টি ছোট অংশে ভাগ করে প্রতিটি অংশকে ১০০ কিমির নিচে রাখা হয়েছে, যাতে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) এড়ানো যায়। এই কৌশলটি পরিবেশগত নিয়মাবলির অপব্যবহারের একটি নগ্ন উদাহরণ।
চারধাম রেল প্রকল্পের অধীনে বহু সুড়ঙ্গ নির্মাণ করা হচ্ছে, যা হিমালয়ের ভঙ্গুর ভূতাত্ত্বিক গঠনের জন্য বিপজ্জনক। ২০২৩ সালে সিলক্যারা-বারকোট সুড়ঙ্গ ধসে ৪১ শ্রমিক আটকে পড়েন; পরে তাঁদের উদ্ধার করা হয়।
ভাগীরথী ও অলকানন্দা নদীতে নির্মাণবর্জ্য ফেলা হচ্ছে, যা নদীর প্রবাহ ব্যাহত করছে এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আগ্রহী পাঠক আরও পড়তে পারেন:
- ভট্টাচার্য, চন্দ্রশেখর। হিমবাহ ফেটে মহাবিপর্যয়ের দায় কার? চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। মার্চ, ২০২১।
- Yousuf, Parvaiz. Balancing progress and preservation: Environmental crisis in the Himalayas and Char Dham project. JK Policy Institute. Dec 9, 2023.
- Prasad, Sunil. Char Dham project: Is development equal to disaster? Down to Earth. Feb 16, 2021.
- Rajendran, CP; Bhanot, Mallika. The road to a Himalayan blunder. The Hindu. Nov 24, 2021.
- Mudur, GS. Char Dham widens road to disaster: Scientists caution over highway building. The Telegraph online. Oct 7, 2024.
[3] বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর্ত্য। সুড়ঙ্গ-বিপর্যয় চোখে আঙুল দিয়ে আবারও দেখাল চারধাম প্রকল্পের বিপদ। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। নভেম্বর ২৩, ২০২৩।