আগুন

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 

তারপর। আগুন।

তা সে আগুন, অবশ্য, অনেক রকমেই লাগানো যায়। লাগানোও হয়েছে অনেকবার। অনেক যুগ ধরে, অনেক সময়েই তেমন আগুনে পুড়ে ছারখার হয়েছে অনেকেই। তবু সেই আগুন, সেই একইরকমে, এসে পড়ে— আরেকবার।

গাড়িটা প্রচণ্ড গতিতে দিশেহারা হয়ে খ্যাপা ষাঁড়ের ক্ষিপ্রতায় যখন আর্কেডের সামনের দেওয়াল ভেঙে, কাচের দরজা গুঁড়িয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাজারের একেবারে ভিতরটায় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গিয়েছিল, শহরের মেজাজে তখন উত্তেজনা ছিল না। ভ্যাপসা গরমে ক্লান্ত, ঘেমো সময় কোনওভাবে কেটে যাচ্ছিল। গাড়িটা ঠিক সেই সময়েই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গেল একেবারে বাজারের ভিতর। চিৎকার, চেঁচামেচি, বিকট শব্দ। গাড়িতে আগুন না লাগলেও তোবড়ানো বনেটের নিচ থেকে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠতে শুরু করল। মানুষজনের ছোটাছুটি আর হতভম্ব ভাব কাটতেই সময় গেল কিছুক্ষণ। তারপর চাকার তলায় চাপা পড়ে থাকা মোচড়ানো দেহ, কাচের টুকরোয় ফালা হয়ে যাওয়া একাধিক শরীর, দু-হাত উপরে ছড়িয়ে চোখ ঠিকরে পড়ে থাকা মানুষ… একে একে বের করে আনা হল সেসব। তারপর এল পুলিশ, দমকল, খবরের কাগজ। গাড়ির ড্রাইভারকে নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল সাত। বেশিরভাগই তারা সাধারণ মধ্যবিত্ত অথবা নিম্নবিত্তের কোঠায়। এমন মানুষ যাদের মৃত্যুর খবর শহরের জনতার মনে করুণা ছাড়া আর কোনও কিছুরই উদ্রেক করে না। রোজকার খবরের কাগজে পাঁচ কি সাতের পাতায় নিচের দিক থেকে শেষের কলামে তাদের জায়গা হয়। হিসেবে তবু গরমিল হয় কোথাও।

কারণ, সরকারি হাসপাতালে মদন আর মৃদুলের শরীর মর্গে পাশাপাশি শুইয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতটুকুও দেরি না করে হাসপাতালের বাইরে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। মৃদুলের বাবা, মন্ত্রী শুভ্রাংশু শিকদার আর কিছুক্ষণেই হাসপাতালে এসে পৌঁছবেন। বোকা মদনের বাপ দুঃস্বপ্নেও কোনওদিন কল্পনা করেনি বোধহয় একই মর্গে মিনিস্টারের ছেলের পাশাপাশি তারও ছেলের লাশ একই সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেষি করে শুয়ে থাকবে। বাইরে লাঠি উঁচিয়ে ভিড় সামলাতে গিয়ে বুড়ো বীরসিংয়ের দফারফা হয়ে যাচ্ছিল। বীরসিংয়ের রিটায়ারমেন্ট হতে আর বেশি বাকি নেই। কোনও মতে আর কয়েকটা মাস কাটিয়ে দিতে পারলেই— লাঠি উঁচিয়ে ভিড় সামলাতে সামলাতে সে প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছিল। সঙ্গের কনস্টেবলগুলোরও হাল একইরকম। অথচ কিছুই করার নেই কারও। মিনিস্টার প্রায় এসে পড়েছেন। হয়তো সত্যিই আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা কেবল।

বীরসিং তাই বোকার মতো লাঠি উঁচিয়ে শাসাতে থাকে। কেউ বিশেষ পাত্তা দেয় না। গোলমাল, ধস্তাধস্তির অবস্থায় হাজারো মানুষের ভিড় লোহার ব্যারিকেডের গোড়ায় বিজবিজ, হুড়মুড় শব্দে কোনওমতে আটকিয়ে থাকে। জনসমুদ্র ঠেকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রের বড় একটা অসুবিধা হয় না। কোনওকালেই।

অথচ গতরাতেও মদনের বাপের সঙ্গে একই বেঞ্চিতে বসে চা খেয়েছিল বীরসিং। তারা-ভরা শহরের রাত, আর টিমটিমে কুপির আলোয় তখনও অবধি খোলা থাকা এ তল্লাটের একমাত্র চা-বিড়ি-পান-সিগারেটের দোকান। আর্কেড থেকে সামান্য দূর। বড় রাস্তার উপরেই। সামনেটায়। ওরা দুজনে বসে চা খাচ্ছিল। পদবি যাই হোক না কেন আজন্ম এই শহরের বাসিন্দা বীরসিংয়ের বাংলা কথাতেই বরং হিন্দির টান আসে। চা খেতে খেতে সে ফাঁকা শহরের দিকে তাকায়। মদনের বাপ কথা বলে না। এই চত্বরে মদনকে কোনওভাবে একটা দোকান জুটিয়ে দেওয়া গেলে খানিক সুবিধা হয়। কিন্তু পার্টির দালালেরা যত টাকা সেলামি চাইছে মদনের বাপের পক্ষে সেই টাকা জোগাড় করে ওঠা অসম্ভব। এই শহরে মুটেগিরি করে আর ক-পয়সাই বা সঞ্চয়? তবু মদনকে কোনওমতে সে গ্র্যাজুয়েট করিয়েছে। আর্কেডেরই একটা দোকানে আপাতত খাতা লেখা, জিনিসপত্র বিক্রির কাজ। রোজ সকালে ইস্ত্রি করা শার্টপ্যান্ট পরে মদন দোকানে যায়। বীরসিং মদনের বাপের পিঠে হাত রাখে। ইস্ত্রি করা শার্টের উপর রক্ত লেগে চটচটে হয়ে আছে। মদনের বাপ মদনের কাছে যেতে পারে না। মিনিস্টারের সামনেই মিনিস্টারের পুলিশ ওকে হাত বাড়িয়ে আটকে দেয়। এরপর তার আর শোকপ্রকাশের অধিকার থাকে না। সে থমকে যায়।

উত্তেজিত হলে মন্ত্রী শুভ্রাংশু শিকদারের কথার লাগাম থাকে না। তবু আজ তিনি মর্গের একপাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। পুত্রশোক। মন্ত্রীর অবস্থা দেখে কাছে যেতে ভয় পাচ্ছিল মদনের বাপ। একপাশে বসে একটু শব্দ করে কাঁদতে অবধি মদনের বাপের সাহস হয় না। আরও যারা এ্যাক্সিডেন্টে মরেছে তাদের পরিবার-পরিজনেরাও নিস্তব্ধ। এখানে এখন টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করার সাহস নেই কারও। স্থানীয় থানার ওসি একপাশে দাঁড়িয়ে আরও দুজন উর্দি-পরা এএসআইয়ের সঙ্গে বিড়বিড় করে লাগাতার কীসব আলোচনা করে চলেন। বড়কর্তারাও একে-একে এসে পড়বেন এবার। মন্ত্রীর এলাকাতেই কিনা র‍্যাশ ড্রাইভিংয়ের শিকার খোদ মন্ত্রীরই আপন পরিবারের কেউ! কিন্তু বিষয়টা চক্রান্তের দিকে যেতে সময় লাগে না। গাড়ির মালিক আর ড্রাইভারের নাম জানা যেতেই ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত অন্যখাতে গড়ায়।

ভিড় ঠেকিয়ে রাখতে আবারও কষ্ট হচ্ছে বীরসিংয়ের। ব্যারিকেড প্রায় খসে পড়ার জোগাড়। কোনওমতে একটা টুলের উপর দাঁড়িয়ে মন্ত্রী শুভ্রাংশু শিকদার হ্যান্ডমাইক হাতে তুলে নেন। তাঁর বক্তব্যে কোনও জড়তা নেই। সামনের ইলেকশনে এই ছেলের প্রশ্নেই নিজের আসনে মন্ত্রী শুভ্রাংশু কিঞ্চিৎ বেকায়দায় আছেন। ছেলের একাধিক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি-হুল্লোড়বাজির কারণে নিজেরই এলাকায় শুভ্রাংশুর দাপট বেশ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে। এমনকি কানাঘুষোয় তিনি আগামীবারের টিকিট নাও পেতে পারেন, এমনও শোনা যায়। তাই ছেলের মৃত্যুতে রাজনীতিগতভাবে শুভ্রাংশুর ক্ষতির চেয়ে লাভই হয়েছে বেশি। এ-কথা মানতে তাঁর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। উপরন্তু র‍্যাশ ড্রাইভিংয়ের গাড়ির মালিকের নাম…

শুভ্রাংশু দাঁতে দাঁত চেপে বলতে শুরু করেন।

—আপনার সকলেই জানেন, এলাকার কুখ্যাত গুণ্ডা…

সঞ্জয় দাস এলাকারই কাউন্সিলর। শুভ্রাংশুরই দলের লোক। একদা তাঁরই ডানহাত হিসেবে সে কাজ করলেও এখন সেই সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। শুভ্রাংশু ভিড় ঠেলে সঞ্জয়ের স্ত্রী সোনিয়া, সঙ্গে আরও দু-তিনজন স্থানীয় বাসিন্দা, পার্টিকর্মীকে এগিয়ে আসতে দেখেন। বিরোধী-গোষ্ঠীর সঙ্গে এখানেই সরাসরি কোনওরকম সংঘাতে যাওয়ার তাঁর প্রবৃত্তি জাগে না। কিন্তু ততক্ষণে তাঁরই হাতের হ্যান্ড-মাইক পেরিয়ে তাঁরই অগ্নিবর্ষী শব্দেরা আগুনের অজস্র ফুলকির মতোই শুকনো খোলামকুচি-সদৃশ মানুষের গাদায় অদৃশ্য হয়েছে। সেই ভিড় থেকেই এবারে কেউ সজোরে চিৎকার করে ওঠে, জনগণের টাকা-লোটা প্রোমোটারের কালো হাত ভেঙে দাও! গুঁড়িয়ে দাও! সমস্বরে তার প্রত্যুত্তর শোনা যায়।

পরক্ষণেই আবারও স্লোগান শোনা যায়, কাউন্সিলরের দালাল-রাজ ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও! এবারের প্রত্যুত্তর যেন আগেরবারের চেয়েও জোরালো হয়। সঞ্জয় দাস এখন বিদেশে। কোনওমতে সঙ্গে থাকা তার অনুগামীরা দু-চারজন সোনিয়াকে মর্গের ভিতর ঢুকিয়ে নেয়। বীরসিংদের ব্যারিকেড ভেঙে হাসপাতাল চত্বর এখন পুরোপুরি জনতার দখলে। শুভ্রাংশু কোনও দিকে না তাকিয়ে হাসপাতালের পিছনে থাকা নিজের কনভয়ের দিকে রওনা দেন। মদনের বাপ দেখে লুঠপাট-ভাঙচুর শুরু হয়ে গেছে। পুলিশের বড়বাবুরা সদ্য এসে পৌঁছানোর কারণে একে-অপরের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। র‍্যাফের গাড়ি রওনা দিয়ে দিয়েছে— কারও ওয়াকিটকিতে স্বস্তির বার্তা শোনা যায়। হাসপাতাল চত্বরে দাপট দেখাতে থাকা মানুষেরা অধিকাংশেই তখন চত্বর থেকে বেরিয়ে আবারও আর্কেডের দিকে ছুটতে শুরু করে। কেবল মর্গের মূল অংশের পাশে কাচ-ঘেরা কিউবিকলটায় আটকে পড়ে কয়েকজন।

আগুন লাগাতে জনতার অসুবিধা হয় না, কিন্তু তাই বলে সাধারণ জনতাকেই হিংসাত্মক বলে ভাবার কোনও কারণ নেই। জনতা আগুন লাগায় তখনই, যখন সে আগুনের জোগান আগে থাকতেই অন্য কোনও উৎসের মাধ্যমে আয়োজন করা থাকে। এসব আয়োজনের প্রস্তুতিতেও তেমন সময় লাগে না। কেবল, ‘স্বতঃস্ফূর্ত গণবিক্ষোভে আগুন’— এমনটা পড়া যায় প্রধানত খবরের শিরোনামেই। শহরে বা দেশে, কোথাওই আগুন লাগে না। আগুন লাগানো হয়। মদনের বাপ তাই আগুনের খবর শুনে ছেলের লাশ ফেলে রেখেই হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যায়। আর্কেডের পিছনেই বস্তির গা বেয়ে একাধিক বেআইনি বহুতল। সেখানে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের অস্থায়ী আস্তানা। এবং খানিকদূরে খালপাড়ের গায়ে বেআইনি চোলাইয়ের ঠেক। ত্রিপল নয়। এখানে কালো পলিথিনের চাল। আগুন লাগতেই যা চড়চড় করে জ্বলে ওঠে।

এসব চোলাইয়ের ঠেক অথবা বেআইনি বহুতলের কারবার, তাতে লাভের অঙ্কে অনেকেরই ভাগ থাকত। এ অবশ্য কখনওই নতুন নয়। তবে পরিচয়ে সঞ্জয় এলাকার কাউন্সিলর-মাত্র হলেও, ইদানীং শুভ্রাংশু অবধি সঞ্জয়ের চোলাইয়ের ঠেক অথবা তার প্রোমোটারি-লভ্যাংশের ভাগ সঠিকমতো পৌঁছচ্ছিল না। এমন অবস্থা এখানে বেশ অনেকদিন। মন্ত্রী-গোষ্ঠীর লোকেরা তাই প্রথমেই শ্রমিকদের ছাউনি আর বেআইনি ঠেকগুলোয় আগুন লাগিয়ে দেয়। এদিকে মদের ভাটিগুলো ভাঙতে এলাকার মেয়ে-পুরুষেরা বেরিয়ে এলেও তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখা হয়। আগুনেরই ভয় দেখিয়ে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয় না তাদের। এ যেন এক অদ্ভুৎ সার্কাসে খালপাড় মেতে ওঠে। দমকা হাওয়ায় পলিথিন-ছাউনি থেকে আগুনের ফুলকি উড়ে যায়। মদনের বাপের ঘর জ্বলছে। জ্বলছে আরও বেশ কয়েকটা ঘর। খালপাড় আরও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। ছোটাছুটি, জল আনা শুরু হয়। মদনের বাপ বুকে হাত চেপে বসে পড়ে হঠাৎ। হইহই করে ছুটে আসে কয়েকজন। পুলিশের লোকও এসে পড়েছে। কাদের সঙ্গে কাদের মারামারি লেগেছে কেউ বলতে পারে না। কিন্তু মুহুর্মুহু ইট পড়তে দেখা যায়। মদনের বাপকে সেই সময় কয়েকজন ধরাধরি করে সরিয়ে নিয়ে যায়। কারও মাথার উপরে ইট পড়ল। খাকি পোশাক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কাচের কিউবিকলের ভিতর আটকা পড়ে হাঁসফাঁস করেন শুভ্রাংশু শিকদার। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারকে ডেকে তিনি রীতিমতো ধমক দেন।

—এবারে এই অবস্থায় আপনারা এটা কী নতুন নাটক শুরু করলেন বলুন দেখি মশাই? একজন মিনিস্টারকে আপনারা এভাবে আটকে রাখতে পারেন না! আপনারা আমায় সিকিউরিটি দিতে পারছেন না? সেটা স্পষ্ট করে বলুন! এই অবস্থা আপনাদের? মন্ত্রীর গলার স্বর ক্রমশ ঝাঁঝালো হয়ে ওঠে।

সহকারী কমিশনার মাথা ঠান্ডা রাখেন। আমাদের সত্যিই সেই সিকিউরিটি দেওয়ার মতো ফোর্স নেই স্যর। আপনি প্লিজ একটু কো-অপারেট করুন। সমস্ত ফোর্সই এখন মব সামলাতে ব্যস্ত। ইটস এ মেস, ইট রিয়লি ইজ।

শুভ্রাংশু তবু হাল ছাড়েন না। হাত নেড়ে আবারও কিছু বোঝাতে যান। ঠিক সে-সময়েই বাইরে কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ শোনা যায়। একটা ফুলের টব এসে আছড়ে পড়ে কাচের দরজাটারও উপর। ড্যাম ইট, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দাঁতে দাঁত চেপে বলেন। ঘরের ভিতর আরও কিছু পুলিশ ঢুকে এসেছে। তারা শুভ্রাংশু, সোনিয়া-সহ বাকি কজনকে ঘিরে কর্ডন করে দাঁড়ায়। একজন কনস্টেবল বলে ওঠে, আপনারা মাটিতে বসে পড়ুন। মাথায় হাত চেপে রাখুন। আবারও একটা ফুলের টব ঠিক সেসময়েই আবারও কাচের দরজাটার উপর এসে প্রচণ্ড শব্দ করে আছড়িয়ে পড়ায় কর্ডনের ভিতরে থাকা কাউকেই আর দ্বিতীয়বার সেই হুকুম দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। হুড়মুড়িয়ে সকলেই মাটিতে আশ্রয় নেয়। বাঁশের ঢালগুলো কর্ডনের কনস্টেবলেরা উঁচু করে ধরে রাখে।

এদিকে এই লোকটাকে দেখলেই আজকাল শুভ্রাংশুর গা-পিত্তি জ্বলতে শুরু করে। মিনিস্ট্রিতে অভিজ্ঞতার নিরিখে শুভ্রাংশুর চেয়ে লোকটা পাক্কা দু-টার্মের জুনিয়র। তবু কীসের যোগ্যতায় সে যে উপরমহলের এতখানি প্রিয়পাত্র হয়ে উঠতে পেরেছে, শুভ্রাংশুর রাগে গা চুলকোয়। অনেকক্ষণ তিনি হাঁটু মুড়ে বসে আছেন। বাইরের গণ্ডগোল খানিক কমেছে বলে মনে হয়। তবু অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার এখনও সবাইকে ঠায় মাটিতে বসিয়ে রেখেছেন। ভিতরে ভিতরে এই লোকটার উপরেও রাগ হয় শুভ্রাংশুর। কী অবস্থা পুলিশের এখন! পরের ক্যাবিনেট মিটিংয়েই এই নিয়ে একটা জোরালো বক্তব্য, উফফ! সেই অসহ্য লোকটা আবারও টিভিতে আরেকটা নতুন চ্যানেলে বক্তব্য রাখছে। হাতের মোবাইলে সাউন্ড অফ করে শুভ্রাংশু দেখেন। সেই জুনিয়র মিনিস্টার। রোলিং রিবনের কথাগুলো শুভ্রাংশুর মস্তিষ্কে গিয়ে ছুঁচের মতো ফুটতে শুরু করে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দমনে কড়া হবে দল, পুলিশকে কড়া ব্যবস্থার নির্দেশ, কাউকে রেয়াত করা হবে না, এমনকি মন্ত্রী হলেও নয়— লাইনগুলো পড়তে পড়তে চমকে ওঠেন শুভ্রাংশু। এত বড় বড় কথা বলার সাহস সামান্য এই জুনিয়র ছোকরাটার আজ হয় কীভাবে? যদি না সে— নাঃ! সে অসম্ভব। এতখানি অসহায় অবস্থা নিশ্চয়ই শুভ্রাংশুর নয়। হতে পারে না কোনওভাবেই। ফোন বাজছে। শুভ্রাংশু প্রায় শিউরে উঠেই ফোনটা ধরেন। নিশ্চয়ই সমবেদনা— গলাটা একটু ভারি করে নিতে হবে। শুভ্রাংশুর মাথায় হিসেবনিকেশ চলে নিরন্তর। অথচ ঘরের ওপাশ থেকে একই সময়ে কাউন্সিলর সঞ্জয় দাসের স্ত্রী সোনিয়া, মেয়েটার চোখ। শুভ্রাংশু আর চোখ সরাতে পারেন না। তাঁর চোখ স্থির হয়ে থাকে। অপলক বিস্ময়ে। আশঙ্কায়।

শুভ্রাংশু ভাবতে পারেন না, তাঁরও আগে দুবাই থেকে ওই সঞ্জয় দাস কীভাবে দলের কাছে এতখানি গুরুত্বের হয়ে উঠতে পারল। ফোনের ওপাশ থেকে আসা সমস্ত ধাতড়ানিটুকুই তাঁকে বিনা-মন্তব্যে হজম করতে হয়।

টাকা অথবা চেয়ারের হাতবদল কখন কীভাবে হয়, ক্ষমতার বারান্দা থেকে খসে পড়তে পড়তে শুভ্রাংশু শিকদার উপলব্ধি করেন। বাইরের আকাশ তাঁর কাছে অসহ্য বোধ হয়। মর্গে পড়ে থাকা ঠান্ডা দেহটারও তখন তাঁর কাছে আর কোনও অস্তিত্ব থাকে না। বাইরের স্ট্রেচারে শোয়ানো আরও দুখানা লাশ। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার কপালের ঘাম মোছেন। নিস্তব্ধতা ভেঙে অ্যাম্বুলেন্সের চড়া সাইরেন শোনা যায়। আহতের সংখ্যা আরও বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। শুভ্রাংশু শিকদার নিজের গাড়িতে উঠে পুলিশি প্রহরায় বেরিয়ে যান। বীরসিংকে একবার দেখারও সৌজন্য জাগে না তাঁর।

বীরসিংয়েরও ঘর পুড়েছিল। সেই অনেককাল আগেই। গ্রামে তার পরদাদা করত পলিটিক্স। সেই আগুনেই ঘর পুড়েছিল তাদের। সেই ঘর পোড়ানোর সময়েও, বীরসিংয়ের মনে আছে, তার মতো পুলিশেরাই এসে তার পরদাদাকে মারধর করেছিল। বীরসিংয়ের বাপও সেই দিনই মরেছিল বোধহয়। বাড়িতে নাকি হাসপাতালে? সেদিন, নাকি তার পরের দিন? স্কুল-ছুটির সময় কলকাতায় ট্যাক্সি চালানো বাপ তার, ক্লাস সেভেনে পড়া বীরসিং আর তার মাকে নিয়ে দেশ-গাঁয়ে পাড়ি দিয়েছিল। সেই যাওয়াটাই হল তার কাল। আরাম-আয়েশের বদলে গাঁয়ে বাধল গণ্ডগোল। চাল থেকে চালে আগুন ছড়াল। জ্বলন্ত খড়ের চাল শোওয়ার ঘরের উপর ভেঙে পড়ে বীরসিংয়ের পরদাদা ঘরের ভিতর আটকিয়ে থাকল। পুলিশের লাঠি পড়ল তার বাপের মাথায়। নাকি সড়কি চালিয়েছিল কেউ? বীরসিংয়ের পরদাদার ঘরের ভিতর থেকে টেনে টেনে বের করে এনে জ্বালিয়ে দেওয়া হল কত বইপত্তর, কাগজ। চড়চড় করে পুড়েছিল সেসব। সে আগুন বীরসিং এতদিনেও ভোলে কীভাবে? তারপরেও মার হাত ধরে কলকাতায়। কনস্টেবলের চাকরি। দু-মুঠো খেতে পেত বীরসিং এখন।

শুয়ে শুয়ে বীরসিং ভাবে। অনেককাল আগের কোনও এক বর্ষার রাত। ক্লাস সিক্স বীরসিং তখন। তার পরদাদা তাকে গল্প বলে বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। কী সেই গল্পের নাম, কী-ই বা সেই গল্প, বীরসিংয়ের মনে পড়ে না। কেবল বীরসিং জানে মন্ত্রীর বাচ্চা ওই শুভ্রাংশু শিকদার আবারও কোনওদিন ভোটে দাঁড়াবে। হয়তো সঞ্জয় আর সঞ্জয়ের বউই আবারও কোনওদিন তার হয়ে প্রচার করবে। আবারও এদের মিলমিশ হয়ে যাবে। এদের কোনও চুরি-জোচ্চুরি-দুর্নীতিরই কোনওদিন বিচার হবে না। আর বীরসিং, সঙ্গে মদনের বাপ এভাবেই পাশাপাশি মর্গের স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে শুয়ে থাকবে।

বীরসিংয়ের পরদাদার গলার স্বর তাদের কানের কাছে ফিসফিস-বিজবিজ করে,

—ইয়াদ রখিয়েগা বেটা! উসকে বাদ বেঞ্জামিন নে কেয়া পড়া? উনহোনে রুক রুক কে পড়া, সবহি পশু বরাবর হ্যায়। লেকিন কুছ পশু দুসরে পশুয়াঁ সে জাদা হি বরাবর হ্যায়!

সর্বজনীন খামারের নিয়ম সার্বিক ও অপরিবর্তনশীল।

বীরসিং আর মদনের বাপ পাশাপাশি শুয়ে থাকে। তাদের হাতে হাত ঠেকে যায়। মর্গের পুরনো ছাদ। লিক হওয়া কোনও পাইপ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে। টিপটিপ শব্দ হয়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...