দেবকুমার সোম
ফোটোকপি বলতে যেমন আমরা জেরক্স বুঝি, তেমন কমিউনিস্ট বলতে আমি বুঝি ইলা মিত্র। আমার কাছে ‘কমিউনিস্ট’ এই বিশেষণটির বিশেষ্য রূপ ইলা মিত্র। তাই তাঁকে জন্মশতবর্ষে পৃথকভাবে স্মরণ করার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক দায় আমার তরফে নেই
যে পদ্ধতিতে কোনও ডকুমেন্টের তাৎক্ষণিক প্রতিলিপি পাওয়া যায়, তাকে বলে ফোটোকপি। অথচ, জনচিত্তে জেরক্স কোম্পানির নামেই সকলে পদ্ধতিটাকে জানে, চেনে, মানে। জেরক্স কোম্পানি ফোটোকপিয়ার মেশিন যেমন তৈরি করে, তেমন আরও বহু কিছু। তেমনই জেরক্স ছাড়াও অন্য বহু কোম্পানি এমন মেশিন তৈরি করে। আমাদের দেশে যে ভেজিটেবল্ তেল তৈরি হয় তাকে সকলেই ডালডা বলে জানে, অথচ ডালডা কোম্পানির নাম। একইভবে এই মুহূর্তে ক্যাডবেরির কথা মনে আসছে। ইলা মিত্র (১৯২৫-২০০২) নামটিও তেমন বিশেষ্য নয়, বিশেষণের বিশেষ্য।
নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন ডেপুটি অ্যাকাউন্টস্ জেনারেল অফ বেঙ্গল। তাঁর আদি নিবাস ঝিনাইদহে। পরিবার নিয়ে কলকাতায় বাস। পরিবার বলতে স্ত্রী মনোরমা দেবী এবং তিন কন্যা, তিন পুত্র। সন্তানদের মধ্যে বড় ইলা সেন বাল্যকাল থেকেই খেলাধুলায় দক্ষ ছিলেন। সাঁতার, ভলিবল, বাস্কেটবল, দৌড়ে রাজ্য কিংবা জাতীয় পর্যায়ে চাম্পিয়ান হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল। ১৯৪০ সালে হেলসিঙ্কিতে অলিম্পিক্সের আসর বসার কথা ছিল। সেই আসরে ব্রিটিশ ভারতের মহিলা সাঁতার দলের প্রতিনিধি হওয়ার কথা ছিল তাঁর। যদিও বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেবার আর অলিম্পিক্স আসর বসেনি। ১৯৪০-এর অলিম্পিক্সে প্রতিনিধিত্ব করলে ইলা সেন হতেন প্রথম বাঙালি মহিলা অলিম্পিয়ান।

ইলার পড়াশোনা প্রথমে বেথুন স্কুল, পরে কলেজে। কলেজে পড়াকালীন যুদ্ধের সময় কলকাতায় মার্কিন এবং ব্রিটিশ ফৌজিদের ভিড় বাড়ে। তাদের যৌনক্ষুধা মেটানোর জন্য এক শ্রেণির দালাল আর আড়কাঠি দুঃস্থ যুবতীদের ভাগিয়ে নিয়ে এসে পতিতাপল্লিতে চালান করত। এই ঘৃণ্য অবস্থা থেকে মেয়েদের বাঁচাতে কমিউনিস্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেন ও অন্যান্যরা ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’ গড়ে তোলেন। এই সমিতির সঙ্গে লীলা রায় (নাগ), রানী মহলানবীশ, রানী দাশগুপ্ত, লীলা মজুমদারেরাও যুক্ত ছিলেন। ইলা এই সমিতির কর্মী হিসেবে সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ঠিক সেই সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল-সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে (যা পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে চিহ্নিত) ত্রাণশিবিরে কাজ করেন। তাঁর সমাজসেবায় অবদানে জন্য ছাত্রাবস্থাকালীন তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নির্বাচিতা হন।
১৯৪৬ সালে অবিভক্ত মালদহ জেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের জমিদার (প্রয়াত) মহিমচন্দ্র মিত্র ও তাঁর বিধবা বিশ্বমায়া দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র রমেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে ইলা সেনের সম্বন্ধ হয়। রমেন্দ্রনাথ ছিলেন অর্থনীতিতে স্নাতক। জমিদার পরিবারের সন্তান হলেও তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত কৃষকসভার মালদহ জেলার সভাপতি। স্থানীয়ভাবে তিনি হাবুমাস্টার নামেই ছিলেন পরিচিত। প্রথম সাক্ষাতে রমেনকে দেখে নগেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল ‘জীবন্ত এনিসাইক্লোপিডিয়া’।
রামচন্দ্রপুর ছিল আক্ষরিক অর্থে অজ পাড়াগাঁ। বিয়ের পর এখানেই রমেন মিত্রের বাল্যবন্ধু আলতাফ হোসেনের বাড়িতে ইলা মেয়েদের জন্য স্কুল খুললেন। এই স্কুল ছিল শিক্ষিকা এবং ছাত্রী উভয়পক্ষের আত্মপ্রকাশের পরীক্ষা। রামচন্দ্রপুরের জমিদারবাড়ি, যাকে স্থানীয়ভাবে রাজবাড়ি বলা হত, সেই বাড়ির রেওয়াজ ছিল বধূরা প্রকাশ্যে আসতে পারবেন না। তাঁরা ছিলেন একরকম অসূর্যম্পশ্যা। ইলা মিত্র তাঁদের বাড়ি থেকে আলতাফ হোসেনের বাড়ি, যা মাত্র চারশো গজ দূর, সেখানে যাওয়ার অনুমতি আদায় করলেন, কিন্তু শাশুড়ি বিশ্বমায়া জানালেন ছই দেওয়া গরুর গাড়িতে বধূমাতাকে স্কুলে যেতে হবে। ওদিকে ছাত্রীরা প্রায়জন মুসলমান পরিবারের কন্যা অথবা বধূ। গ্রামের মোল্লারা হুকুম দিলেন পর্দাপ্রথা শরিয়তের নিয়ম; মেয়েরা স্কুলে যেতে পারেবে না। এই নিয়ে গ্রামে প্রবল এক আলোড়ন উঠল। মাত্র তিনজন ছাত্রী নিয়ে স্কুল শুরু হল। দেখতে দেখতে এক বছরের মধ্যে স্কুলের ছাত্রীসংখ্যা দাঁড়াল তিনশো। ইলা মিত্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া রাজমাতার নির্দেশও উবে গেল। গ্রামের সাধারণ বউ-ঝিদের মতো খাটো শাড়ি পরে, খালি পায়ে তিনি মাটির ওপর দাঁড়ালেন। হয়ে উঠলেন সকলের ‘রানিমা’।

তখন দেশভাগ নিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তুঙ্গে উঠেছে। ১৬ আগস্ট ১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হল। তারই প্রতিক্রিয়ায় ওই বছর অক্টোবর মাসে নোয়াখালিতে শুরু হল হিন্দুনিধন যজ্ঞ। নোয়াখালির প্রায় পঁচাত্তর শতাংশ জনসংখ্যা ছিল মুসলমান। বাকিদের মধ্যে কুড়ি শতাংশ হিন্দু। এই কুড়ি শতাংশের মধ্যে বেশিটাই নমঃশূদ্র। কিন্তু অর্থনীতির আশিভাগ ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে। রেল, পোস্ট অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ— সবকিছুর মাথায় ছিল হিন্দুরা। সেই সময় অবিভক্ত বাংলায় ছিল মুসলিম লিগের সরকার। প্রধানমন্ত্রী (আজকের দিনে মুখ্যমন্ত্রী) ছিলেন শহিদ সোহ্রাওয়ার্দি। সে-সময় নোয়াখালির বিধায়ক ছিলেন মুসলিম লিগের গোলাম সারওয়ার। তিনি ‘মিঞার ফৌজ’ আর ‘কাশেম ফৌজ’ তৈরি করেন। এরা হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাট করে। সম্পত্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। বিবাহিত হিন্দু মেয়েদের শাঁখা-পলা ভেঙে তাদের মাথার সিঁদুর মুছে দেয়। ব্যাপক ধর্ষণের শিকার হয় মেয়েরা। কুমারী মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে। পুরুষদের জোর করে গরুর মাংস খাওয়ায়, কলমা পড়ায়। এইসব অত্যাচার তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে নির্বিচারে করে। বাইরের দুনিয়া থেকে যাতে কোনও সাহায্য বা সহযোগিতা না আসে, তার জন্য সব যোগাযোগ ছিন্ন করে দেয়। এই অত্যাচার ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে পাশের জেলা কুমিল্লা ও ত্রিপুরাতে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সোহ্রাওয়ার্দি এবং গভর্নরের কাছে আর্জি জানায়; কিন্তু কোনও ফল হয় না। শেষে গান্ধিজি সিদ্ধান্ত নেন তিনি যাবেন নোয়াখালি। সরকার এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের বাধানিষেধ অগ্রাহ্য করে গান্ধিজি নোয়াখালি গেলেন। তার পর গান্ধিজির শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে বিভিন্ন নারী সমিতিও নোয়াখালির শরণার্থী শিবিরগুলোতে সেবামূলক কাজে যায়। সেইসময় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির কর্মী হিসেবে ইলা মিত্র নোয়াখালি-ত্রিপুরা সীমান্তের হাসনাবাদে ত্রাণের কাজ করেন।
লর্ড কর্নওয়ালিসের সময় বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্যে দিয়ে জমিদার-জোতদার নামের এক শ্রেণির মধ্যসত্ত্বভোগীর উদ্ভব ঘটে। যারা পরবর্তীকালে বিধাতাপুরুষ হয়ে ওঠে। এই ব্যবস্থায় বার্ষিক খাজনার বিনিময়ের জমির অধিকারী হয়ে ওঠে জমিদারেরা। ছোট জমিদারেরা নিজেই এবং বড় জমিদারেরা একাধিক জোতদারের মাধ্যমে জমি বণ্টন করত। কৃষকেরা বার্ষিক নবীকরণের মাধ্যমে জমিদার কিংবা তার অধস্তন জোতদারদের কাছ থেকে চাষের জন্য জমি পেত। গাণিতিক সূত্রটা ছিল এমন— কৃষক নিজের খরচে, হাল-বলদ নিয়ে জমিতে চাষ করবে। ফসল ফলার পর উৎপন্ন শস্য আধাআধি ভাগ হবে। এক ভাগ নেবে জমিদার/জোতাদার। বাকিটা কৃষক। তবে সেই প্রাপ্য থেকে যদি চাষের জন্য তাকে বীজধান দেওয়া হয়, কিংবা তার যদি কোনও ঋণ থাকে সেসব আদায় করে বাকিটা পাবে কৃষক। এই কৃষকদেরই অঞ্চলভেদে বলা হত আধিয়ার কিংবা বর্গাদার। কৃষক ছাড়া আর এক জাতের চাষি ছিল, তারা জনমজুর। আর কিছু মানুষ মজুরির বিনিময়ে ধান ঝাড়াই-বাছাই বা পরিবহণ ইত্যাদি কাজ করত। তাদের বলা হত কিষাণ, রাজশাহী অঞ্চলে আবার বলা হত দিনিয়ার। তাদের মজুরিও ছিল অর্ধেক। এছাড়া কিছু মানুষের ছিল জমিদারের কাছ থেকে নেওয়া সরাসরি সামান্য কিছু জমির মালিকানা। তাদের বলা হত তহশিলদার।
১৯২৯ সালে বিশ্বজোড়া যে অর্থনৈতিক মন্দা আসে, তার হাত থেকে রেহাই পায়নি বাংলার চাষিরা। সে সময় হঠাৎ করে ফসলের দাম কমে যায়। জমিদার-জোতদারেরা নিজেদের ক্ষতি পূরণ করতে চাষিদের ওপর নতুন ফরমান চাপাল। বলা হল, অর্ধেক নয়, তিন ভাগের দু-ভাগ পাবে জমিদার। এক ভাগ কৃষক। এই ব্যবস্থায় বাংলার কৃষক-কিষাণদের আর্থিক অবস্থা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। তারা ক্রমাগত ঋণ করেও জমিদারদের নাগপাশ থেকে নিজেদের ছিন্ন করতে পারত না। হয় তারা বেঘোরে মারা যেত, কিংবা ক্রীতদাসের জীবনযাপন করত। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে উঠল যে জমিদারি ব্যবস্থাটাই প্রশ্নচিহ্নের মুখে এসে দাঁড়াল।
১৯৩৮ সালে ফজলুল হক মন্ত্রিসভা ফ্লাউড কমিশন গঠন করে। সেই কমিশন সুপারিশ করে উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ কৃষকদের প্রাপ্য। এছাড়া কমিশন আরও সুপারিশ করে জমির মালিকানা জমিদারদের হাত থেকে সরকারের হাতে যাওয়া উচিত এবং অবিলম্বে জমিদারি প্রথা বিলোপ হওয়া উচিত। এই নিয়ে বাংলায়, বিশেষ করে দিনাজপুর, রংপুর, যশোর প্রভৃতি জেলায় কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলন শুরু করে। স্লোগান ওঠে— আধি নয়, তেভাগা চাই; নিজ খোলানে ধান তোলো; কজ্জা ধানের সুদ নাই। আন্দোলন ঠেকাতে সরকার পুলিশবাহিনী নিয়োগ করলে প্রচুর কৃষকনেতা শহিদ হন। দেশভাগের ঠিক মুখ এই আন্দোলন জ্বলে উঠলেও ভাগ-বাঁটোয়ারার কারণে থেমে যায়।
সাতচল্লিশে ভারত ভাগ হলেও কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়নি। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পিসি জোশির মধ্যপন্থা ত্যাগ করে সিপিআই বিটি রনদিভের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের লাইন গ্রহণ করে। স্লোগান ওঠে ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়—।’ সেই অধিবেশনে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করা হয়। এবং ভারতের মতো সেখানেও বিটিআর লাইন গৃহীত হয়।
দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গ থেকে প্রায় সব জমিদার পশ্চিমবাংলায় চলে এলেও রামচন্দ্রপুরের মিত্ররা পূর্ববাংলায় থেকে যান। কারণ তাঁদের জমিদারিতে কখনও সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়নি। মিত্ররা তাঁদের প্রজাদের মধ্যে ধর্মীয় ভেদাভেদ করতেন না। পাকিস্তান সৃষ্টিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল অস্পষ্ট। পার্টির শীর্ষনেতৃত্বের সিংহভাগ হিন্দুবংশীয় হলেও তাঁরা জিন্নাহ-বিরোধিতার রাস্তায় যাননি। এর দরুন দেশভাগের পরবর্তী কিছু সময় মুসলিম লিগের কাছে সিপিআই অস্পৃশ্য ছিল না। এর সুবাদে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ সালে রামচন্দ্রপুরে প্রথম পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনের গৌরব দেওয়া হয় রমেন মিত্রকে। কিন্তু, পাকিস্তান নিয়ে কমিউনিস্টদের আশা এক বছরের মধ্যেই ভঙ্গ হল। তাঁরা দেখলেন মুসলিম লিগ মূলত জমিদার আর দাঙ্গাকারী গুন্ডাদের প্রশয় দিয়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছে। এর পাশাপাশি লাহোর থেকে চাপিয়ে দেওয়া উর্দু সংস্কৃতিও বঙালির কাছে আত্মহত্যার সামিল মনে হয়েছিল।
এই আবহাওয়ায় কৃষকসভার সভাপতি রমেন মিত্রের (হাবুমাস্টার) নেতৃত্বে রাজশাহীর নাচোল থানার বিভিন্ন গ্রামে তেভাগা কার্যকর করার আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের প্রধানতম মুখ হয়ে ওঠেন ইলা মিত্র। তাঁর নতুন নামকরণ হয় ‘নাচোলের রানিমা’। মিত্রদম্পতি আন্দোলনের জন্য জমিদারাবাড়ির সব অলঙ্কার দান করে দেন। নিজেদের পাঁচশো বিঘে জমিতে তেভাগা কর্যকর করেন। ইলা তাঁর সদ্যোজাত পুত্রকে শাশুড়িমায়ের কাছে রেখে নাচোলের সাঁওতালদের মধ্যে চলে যান। তাঁদের মতো জীবনযাপনের পাশাপাশি জমিদার-জোতদারদের সঙ্গে লড়াই জারি রাখেন। স্লোগান ওঠে, ‘ইলা মিত্র নারী/আইন করল জারি/আধি জমিন তেকুটি ধান/জিন হল সাত আড়ি ভাই/জিন হল সাত আড়ি।’ ইলা মিত্র তাঁর সাথীদের নিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে ছুটলেন। কৃষক-কিষাণদের এককাট্টা করলেন। সংঘর্ষ শুরু হল। গ্রামে পুলিশ এল, জমিদার-জোতদারদের পক্ষ নিয়ে। সেই সময় ঘেসুড়া গ্রামে একটি ঘটনা ঘটে যায়। এঈ ঘটনার কোনও প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা যেমন নির্বাক ছিলেন, তেমন গোয়ান্দাদের অনুমানের ভিত্তিতে দুটি পরস্পরবিরোধী বিবরণ উঠে আসে। জমিদারের আবেদনে সাড়া দিয়ে নাচোল থানার একজন এসআই তিনজন কনস্টেবল নিয়ে ঘেসুড়ায় আসেন। তাঁদের সঙ্গে কৃষকসভার সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে এসআই-সহ সব পুলিশ খুন হন। কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁদের লাশ উদ্ধার করা যায়নি।

পুলিশ খুনের কথা নাচোল থানায় পৌঁছালে সরকার সশস্ত্র পুলিশ, আনসার বাহিনী আর ইস্টবেঙ্গল আর্মিকে নাচোলের গ্রামগুলোতে কৃষক আন্দোলন দমন করতে পাঠায়। সশস্ত্র বাহিনী বারোখানা গ্রাম সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে। আনুমানিক দেড়শোজন আদিবাসী কৃষককে খুন করে। এছাড়া ফসল লুট, গবাদি পশু হত্যা, ব্যাপক ধরপাকড় হয়। সরকারের এমন সহিংসতায় কমিউনিস্টরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। অধিকাংশ শীর্ষনেতা পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন। ইলা মিত্র সাঁওতালদের একটি বড় দল নিয়ে পালানোর সময় রোহনপুর রেলস্টেশনে গ্রেপ্তার হন। প্রায় সকলে ধরা পড়লেও রমেন মিত্র ফেরার হয়ে যান।
ইলা মিত্র এবং তাঁর দলকে পুলিশ প্রথমে নিয়ে আসে রোহনপুর ফাঁড়িতে। সেখানে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে চলে অমানুষিক অত্যাচার। পুলিশের একটা চেষ্টা ছিল, গ্রেপ্তার হওয়া মহিলা যে ইলা মিত্র তা চিহ্নিতকরণ। কিন্তু অত্যাচারে মৃত্যু হলেও একজন সাঁওতাল কৃষকও ইলা মিত্রকে চিনিয়ে দেননি। ফলে সেই রাতে প্রায় সত্তর থেকে একশো জন কৃষককে পুলিশ ফাঁড়ির মধ্যেই মেরে ফেলা হয়। এর পর বাকিদের নিয়ে যাওয়া হয় নাচোল থানায়। সেখানে ইলাকে অন্যদের থেকে পৃথক করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা চলে। পুলিশের একটা জিজ্ঞাস্য, কার নির্দেশে খুন করা হয়েছে। ইলা মিত্র নীরব থাকেন। তাঁর ওপর চলে অবর্ণনীয় শারীরিক অত্যাচার। তাঁর হাঁটুর নিচ থেকে পা দুটোকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। মাথার চুল উপড়ে নেওয়া হয়। যৌনাঙ্গে সেদ্ধ ডিম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তারপরও তাঁকে নত করতে না পেরে গণধর্ষণ করা হয়।
নাচোলের পুলিশ খুনের কেস ওঠে রাজশাহী জেলা জজ কোর্টে। ইলা মিত্রকে তাঁর অন্যান্য সাথীদের মতো চালান করা হয় রাজশাহী জেলে। সে সময় তিনি নিউমোনিয়া আর টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। নাচোলের বিদ্রোহী কৃষকদের জানে মেরে ফেলার জন্য জেলের ভেতরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানোর চেষ্টা করে জেল-কর্তৃপক্ষ। তবে ব্যর্থ হয়। এর গায়ে গায়ে উর্দু ভাষা-সংস্কৃতি বিরোধী ছাত্র-যুবকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সংঘর্ষ হলে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর গুলি চলানো হয়। ঘটনায় সাতজন ছাত্র মারা যান। গুরুতর আহত হন অনেকে। রাজশাহী জেলা জজ কোর্টে ইলা মিত্র এবং স্টিফেন মাদ্রির জবানবন্দি পুলিশ পেশ করে। যা তাঁরা দুজনেই মিথ্যে বলে অস্বীকার করেন। জেলা আদালতে পাকিস্তান পেনাল কোডের ৩০২ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। এই ধারা খুনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। যার সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি। রায়ে বিচাপতি জানান, যেহেতু এই খুনের মামলায় কোনও সাক্ষী পাওয়া যায়নি, তাই গ্রেপ্তার হওয়া একত্রিশজনকে যাবজ্জীবন দেওয়া হল।
এই রায়ের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টি ঢাকা হাইকোর্টে আপিল করে। নতুন করে বিচার হয়। সেই বিচারে আসামিদের দশ বছরের কারাদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হয়। এদিকে ইলা মিত্রের শারীরিক অবস্থার ক্রমাগত অবনতি হতে থাকায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। ঢাকায় ছাত্র-যুবরা ইলা মিত্রের মুক্তির জন্য আন্দোলন শুরু করেন। ততদিনে নুরুল আমিনের সরকার ভোটে হেরে ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রিত্ব পেয়েছেন। বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ইলা মিত্রের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াইয়ের পর ইলা মিত্রকে পাকিস্তান সরকার চিকিৎসার জন্য প্যারোলে মুক্তি দিলে তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কলকাতায় তাঁকে নিয়ে উন্মাদনায় যেন নতুন জীবন পেলেন ইলা মিত্র। তাঁর স্বামী রমেন মিত্র ফেরার হয়ে কলকাতা-ঢাকা করে ইলা মিত্রের মুক্তির জন্য অলক্ষ্যে থেকে আন্দোলন করে গেছেন। ইলা মিত্রকে নিয়ে ‘পারুল বোন’ কবিতা লিখলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। গোলাম কুদ্দুস ‘স্তালিন নন্দিনী’। সুচিত্রা মিত্র তাঁকে হসপিটালে গান শুনিয়ে উদ্বুদ্ধ করলেন। ক্রমে ইলা সুস্থ হলেন। পাকিস্তান সরকার তাদের বন্দিকে চেয়ে পাঠাল। জ্যোতি বসু, হীরেন মুখোপাধ্যায়েরা নেহরুকে জানালেন সেটা সম্ভব নয়। দুই দেশের মধ্যে ইলা মিত্রকে নিয়ে টানপোড়েন ১৯৭১ সাল অবধি জারি ছিল।
সুস্থ হতে তিনি তাঁর পুত্রকে ফিরে পেলেন যখন, তখন তার বয়স সাত বছর। জন্ম থেকে ইলা মিত্রের পুত্র সাত বছর অবধি মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। ইলা সুস্থ হলেন বটে, তবে কোমর থেকে নিচের অংশটা আর স্বাভাবিক হল না। তখন তাঁর সংসারে প্রবল আর্ধিক কষ্ট। স্বামী রমেন মিত্র চাকরি করবেন না। তিনি খাঁটি কমিউনিস্ট, পার্টির দেয় সামান্য ভাতায় কি আর সংসার চলে। একসময়ের রানিমা টালিগঞ্জের এক বস্তিতে তাঁর সন্তানকে মানুষ করার পাশাপাশি এমএ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। সে সময় শঙ্ঘ ঘোষ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়েরা তাঁকে নোট তৈরি করে দিতেন। ইলা এমএ পাশ করলেন, কিন্তু কলেজের চাকরি? আবেদন করলেন রামমোহন (সিটি) কলেজে। কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্রাহ্ম, তাঁরা একজন কমিউনিস্টকে কেন চাকরি দেবেন? বহু কাঠখড় পুড়িয়ে সেই চাকরি জুটল। এদিকে কলকাতায় সুস্থ হতেই রাজনীতিতে নেমে পড়েছেন তিনি। ১৯৬৫ সালে কলকাতার দাঙ্গায় পার্কসার্কাস অঞ্চলে দাঙ্গাবাজদের নিরস্ত্র করতে গেলে তাঁর মাথায় লাঠির বাড়ি পড়ে। কংগ্রেস সরকারের সময় দু-বার হাজতবাসও করতে হয়। ১৯৬২ এবং ৬৭ সালে পর পর দু-বার তিনি মানিকতলা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সিপিআই প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন।
পূর্ববাংলায় যখন মুক্তিযুদ্ধের ডাক উঠল, তখন ইলা মিত্র বিধায়ক। তাঁদের বাসগৃহ হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের আস্তানা। সীমান্তের এপার থেকে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম রমেন মিত্র এবং ইলা মিত্র। ইলা মিত্র একমাত্র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যাঁকে ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রই স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে সম্মানিত করেছে।
পরবর্তী জীবনে রাজনীতির পাশাপাশি শুরু করেন লেখকজীবন। মূল্যবান মৌলিক এবং অনুবাদ সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। ‘হিরোশিমার মেয়ে’ বইটির জন্য তাঁকে ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু’ পুরস্কৃত করা হয়। বিধায়কের জীবন থেকে সরে ক্রমে তিনি ফের খেলাধুলোর জগতে ফিরে যান। পশ্চিমবঙ্গের মহিলা সাঁতার সংস্থার অন্যতম সংগঠক হিসেবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন সক্রিয়।
বাংলাদেশে ইলা মিত্র একজন কাল্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবেই বিবেচিত। তাঁকে নিয়ে ডায়মড পরিচালিত সিনেমা ‘নাচোলের রানিমা’ জনপ্রিয়তা পায়। সেলিনা হোসেন ইলা মিত্রকে নিয়ে লিখেছেন উপন্যাস ‘কাঁটাতারের প্রজাপতি’। তাঁকে নিয়ে যাত্রা, পালাগান ইত্যাদি আজও নাচোল অঞ্চলে জনপ্রিয়। তাঁর সম্মানে নাচোলে ‘ইলা মিত্র স্তম্ভ’, মিউজিয়াম ইত্যাদি তৈরি করে হয়েছে। বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকেও তাঁকে নিয়ে বীরগাথা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানো হয়।

পশ্চিমবাংলায় সেসব কিছুই হয়নি। কারণ এখানে দীর্ঘমেয়াদে বামপন্থীরাই ক্ষমতায় থেকেছেন। এই দীর্ঘ সময় (প্রায় অর্ধশত বছর) তাঁরা ক্ষমতার শীর্ষে উঠতে চেয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সেমিনার রুমে বসে আন্দোলনের হাতিঘোড়া মেরেছেন। ক্ষমতায় থেকে তো আন্দোলন হয় না। ফলে তাঁরা যেমন আন্দোলনবিমুখ হয়েছেন, তেমনই চতুরভাবে ইলা মিত্রের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জনমানসের স্মৃতি থেকে মুছে দিয়েছেন। দক্ষিণপন্থী দলগুলো যা করতে পারেনি, তাই করে দেখিয়েছেন এই রাজ্যের কমিউনিস্টরা, তারই ফল আজ তাঁরা ভোটের অঙ্ক পরীক্ষায় শূন্য।

যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম এই লেখা, আবার সেখানে যদি ফিরে যাই, তাহলে বলি, ফোটোকপি বলতে যেমন আমরা জেরক্স বুঝি, তেমন কমিউনিস্ট বলতে আমি বুঝি ইলা মিত্র। আমার কাছে ‘কমিউনিস্ট’ এই বিশেষণটির বিশেষ্য রূপ ইলা মিত্র। তাই তাঁকে জন্মশতবর্ষে পৃথকভাবে স্মরণ করার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক দায় আমার তরফে নেই।


