অনিন্দ্য শুভ্র দত্ত
২০১৪-র পর থেকে আজ পর্যন্ত বিজেপির হাত ধরে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আরএসএস-এর পরিকল্পনায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনের এক দীর্ঘ পর্ব চলছে। বিশেষ করে সম্প্রদায়গত ঘৃণা ছড়িয়ে এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্রমশ কোনঠাসা করা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেকার সংহতিকে নষ্ট করা, এবং এক ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণ আধিপত্যকেন্দ্রিক সমাজ তৈরি করা— এটাই এই সরকারের অন্তর্লীন পরিকল্পনা। মূলত মুসলিম সম্প্রদায়কে জাতিগত সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়ে তাদের প্রায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের অবস্থানে নামিয়ে আনার চেষ্টা আজও নানা আকারে দৃশ্যমান। এভাবেই আরএসএস চেয়েছিল সংবিধানের মূল ভিত্তিতে আঘাত হানতে। এইরকম এক টালমাটাল সময়ে উমরদের প্রতিবাদের সফর শুরু। এই প্রতিবাদের অভিনবত্ব ছিল— আরএসএস-এর নির্মাণপ্রক্রিয়ার ভেতরে থাকা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে সামনে এনে জনমত গঠন করা
২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হন উমর খালিদ। অর্থাৎ ঠিক পাঁচ বছর ধরে উমর খালিদ জেলে বন্দি হয়ে আছেন, এবং এখনও কোনও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়নি। উমরের এইভাবে জেলবন্দি জীবন কাটানো এক অর্থে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের অভিযোগ, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে যাওয়া দিল্লি দাঙ্গার একজন মূল ষড়যন্ত্রকারী তিনি। সেই অভিযোগেই তাঁকে ইউএপিএ আইনের আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়।
এই ষড়যন্ত্রের রূপরেখা হিসেবে দিল্লি পুলিশ উমরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগনামা দাখিল করেছে, তা হল— মহারাষ্ট্রের অমরাবতীতে উমর-কৃত একটি বক্তৃতা, Delhi Protest Support Group নামের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সদস্য হওয়া, এবং এমন কিছু ব্যক্তির সাক্ষ্য যাদের কোনওভাবেই প্রকাশ্যে আনতে দিল্লি পুলিশ রাজি নয়।
এই মুহূর্তে উমর খালিদের মামলাটি শুধু জাতীয় সংবাদমাধ্যমেই নয়, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও সমানভাবে আলোচিত। প্রত্যেকেরই কৌতূহল, এবং তার সঙ্গে উদ্বেগ— বিনা বিচারে কোনও নাগরিককে কতদিন কারাগারে রাখা যেতে পারে? বিশেষত, ভারতবর্ষ এবং সমগ্র পশ্চিমি দুনিয়া যে গণতন্ত্রের গর্বে গরীয়ান, সেই গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতর গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহার করে একজন নাগরিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার— অর্থাৎ মুক্তির অধিকার— ছিনিয়ে নেওয়া যেতে পারে, এই প্রদর্শন কোনওভাবেই গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে গৌরবজনক অধ্যায় নয়।
আজ থেকে এক বছর আগে, ললিত বাচানি নির্মিত একটি তথ্যচিত্র কয়েদি নাম্বার ৬২৬৭১০ হাজির হো দেখেছিলাম সুজাতা সদনে। ছবিটি প্রদর্শন করেছিল পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভস নামের একটি সংস্থা, যারা প্রতি মাসে পালা করে সামাজিক ও রাজনৈতিক অর্থবহ, এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার চলচ্চিত্র নিয়ে হাজির হন দর্শকের দরবারে।
বাচানির এই ছবি ছিল সময়টাকে ফিরে দেখার প্রয়াস। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপ একত্র করে, এবং বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে, তিনি তুলে ধরেছিলেন ভারতবর্ষকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বানানোর বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের এক খণ্ডচিত্র।
২০১৬ সালে জেএনইউ প্রাঙ্গণে আফজল গুরু-সম্পর্কিত একটি কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানের কয়েকটি ভিডিও ক্লিপিং ও স্লোগান বিকৃত করে প্রচার করা হয় মিডিয়ায়। মিডিয়ার এই বিকৃত বিচারের ফলেই কিছু ছাত্র-যুবককে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া হয় এবং সারা দেশজুড়ে সেই প্রচার শুরু হয়। এই ছাত্র-যুবকদের মধ্যে একটি নাম হল উমর খালিদ। শুধু তাই নয়, সিডিশন বা দেশদ্রোহিতার অভিযোগে উমরকে গ্রেপ্তার করে দিল্লি পুলিশ। এভাবেই শুরু হয় উমরের ছাত্র-রাজনীতির এক নতুন অধ্যায়।
উমরকে ঘিরে নির্মিত হলেও, এই তথ্যচিত্রের অন্যতম একটি বিষয় ছিল শাহিনবাগ। কেন্দ্রে আসীন এই সরকারের হিন্দুত্ববাদী মনোভাব এবং একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের (মুসলমানদের) বিরুদ্ধে নানা ক্রিয়াকলাপের প্রতিবাদের পথ ধরেই উমরের উত্থান। সেই ক্রিয়াকলাপেরই একটি সুচিন্তিত ও বিভেদমূলক পদক্ষেপ ছিল সিএএ আইন প্রণয়ন। এই আইনটি সংবিধানের মূল নীতি ও লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত।
ভারতবর্ষের মানুষের সহজাত মননশীলতা— যার দীর্ঘ ইতিহাস ‘বিবিধের মাঝে ঐক্য’-র চর্চায়— এই বিভেদকামী প্রয়াসকে কোনওভাবেই সহজে মেনে নেবে না, এটাই স্বাভাবিক। এই মেনে না নেওয়া এবং তাকে প্রতিরোধের রূপ দেওয়ার অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী ছিলেন উমর। তাই শাহিনবাগের আন্দোলন যখন ঘটল, তখন সেখানকার প্রতিবাদী প্রতিটি মানুষের সঙ্গে উমরের আত্মিক সংযুক্তি খুব স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব হয়েছিল।
২০১৪-র পর থেকে আজ পর্যন্ত বিজেপির হাত ধরে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে আরএসএস-এর পরিকল্পনায় ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পুনর্গঠনের এক দীর্ঘ পর্ব চলছে। বিশেষ করে সম্প্রদায়গত ঘৃণা ছড়িয়ে এবং প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়কে ক্রমশ কোনঠাসা করা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেকার সংহতিকে নষ্ট করা, এবং এক ব্রাহ্মণ্যবাদী উচ্চবর্ণ আধিপত্যকেন্দ্রিক সমাজ তৈরি করা— এটাই এই সরকারের অন্তর্লীন পরিকল্পনা। মূলত মুসলিম সম্প্রদায়কে জাতিগত সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়ে তাদের প্রায় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের অবস্থানে নামিয়ে আনার চেষ্টা— এবং সেই পরিকল্পনার রূপায়ণকে সচল রাখার প্রয়াস— আজও নানা আকারে দৃশ্যমান। এভাবেই আরএসএস চেয়েছিল সংবিধানের মূল ভিত্তিতে আঘাত হানতে।
এইরকম এক টালমাটাল সময়ে উমরদের প্রতিবাদের সফর শুরু। এই প্রতিবাদের অভিনবত্ব ছিল— আরএসএস-এর নির্মাণপ্রক্রিয়ার ভেতরে থাকা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বকে সামনে এনে জনমত গঠন করা। খুব স্বাভাবিকভাবেই, আরএসএস-এর নির্মাণে প্রধান প্রতিবন্ধকতা ছিল ভারতের সংবিধান।
সংবিধানকে সরাসরি আক্রমণ করার প্রয়াস আরএসএস-এর শুরু সংবিধানের জন্মলগ্ন থেকেই। দীর্ঘ সময় ধরে তাদের এই প্রচেষ্টা লোকচক্ষুর আড়ালে, বা বলা যায় প্রচারের আড়ালে, নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে অন্তঃসলিলা প্রবাহের মতো চলেছিল। বর্তমানে বিজেপির উত্থানের সুযোগে সেই অন্তঃসলিলা প্রবাহই বিধ্বংসী বহিঃপ্রকাশ পেয়েছে।
এই বিধ্বংসী প্রকাশের প্রেক্ষাপটে উমর ও তাঁর মতো আরও অনেকে— যাঁরা প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছেন— তাঁদের অবস্থান আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। যে সংবিধান দীর্ঘদিন ধরে জনমানসে এক প্রাচীন বিগ্রহের মতো স্থবির হয়ে ছিল, উমররা সেই সংবিধানকেই জনতার কাছে এক প্রাণবন্ত পাথেয় হিসেবে হাজির করেছেন। স্বাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে এর আগে এই বইটি কখনও এত ব্যাপকভাবে চর্চিত হয়নি।
যে বেগবান জলধারা ক্রমে ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠছিল, তা মুখ থুবড়ে এক বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হতে বাধ্য হল। আর এরই মাশুল হয়তো আজও উমরকে দিতে হচ্ছে।
অনুষ্ঠানের পরের পর্বে ছিল উমরের সাথী বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে কথোপকথন। কথোপকথনটি পরিচালনা করেন কস্তুরী বসু। উমরের মতো প্রাণবন্ত এক ব্যক্তির বিনা বিচারে বছরের পর বছর কারাবন্দি থাকা যেমন দুঃখজনক ও যন্ত্রণাদায়ক, তেমনই তাঁর প্রিয় সাথীর ভবিষ্যৎ মিলনের আশায় বুক বেঁধে এক অনন্ত প্রতীক্ষায় দিন কাটানোও গভীরভাবে বেদনাদায়ক। এ যেন বীরেন চট্টোপাধ্যায়ের সেই কবিতার কথা মনে করায়—
এক জোনাকি, দুই জোনাকি, তিন জোনাকি ওড়ে,
তোমার লাগি বন্ধু, আমার মন যে কেমন করে।
এক প্রহর, দুই প্রহর, তিন প্রহর রাতি,
তোমার লাগি বন্ধু, আমার ঘরে জ্বলছে বাতি।
***
প্রেক্ষাগৃহের প্রতিটি দর্শক দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে ধরে শুনতে চাইছিল সেই কাহিনি, দেখতে চাইছিল আশার আলো, আর খুঁজতে চাইছিল এমন এক রাস্তা, যাতে বুকের ভেতর চেপে বসে থাকা হতাশার জগদ্দল পাথরটাকে সরিয়ে দেওয়া যায়। কয়েদি নং ৬২৬৭১০ হাজির হো দেখে আমরা সবাই ততক্ষণে জেনে গিয়েছিলাম উমরের গ্রেপ্তারের নেপথ্যের খুঁটিনাটি।
কিন্তু যে প্রশ্ন নিয়ে দর্শকরা বসেছিলেন এই কথোপকথন শোনার জন্য, সেটি ছিল বিচারপ্রক্রিয়া সংক্রান্ত। খবরের কাগজে যতটুকু সংবাদ পাওয়া গেছে, তাতে খুব একটা স্পষ্ট হয়নি— উমরের বিচার নিয়ে আসলে চলছেটা কী? সত্যিই কি এটি এতটাই জটিল প্রক্রিয়া? যাঁরা নিরন্তর এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকেন— অর্থাৎ উকিলরা— তাঁদের বক্তব্য ও ভাষা সাধারণ মানুষের কাছে বোঝাও প্রায় অসম্ভব। অথচ বিনা দোষে একজন মানুষকে বছরের পর বছর কারাগারে আটকে রাখা— এ কেমন বিচারব্যবস্থা? সেটা সাধারণ মানুষের কাছে সত্যিই এক গভীর ধোঁয়াশা। বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে কথোপকথনের সারমর্ম এবং পুরনো ঘটনার সূত্র ধরে বিষয়টিকে কতটা স্পষ্ট করে বোঝা সম্ভব, নিম্নলিখিত অংশ তারই এক প্রচেষ্টা।
এই বিচারপ্রক্রিয়ায় যে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হল আইন এবং বিচারব্যবস্থা বা জুডিশিয়ারি। যে আইনে উমর গ্রেপ্তার হয়েছেন, অর্থাৎ ইউএপিএ— বাংলায় যাকে বলা যেতে পারে সন্ত্রাস দমন আইন— তার উদ্ভবের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা পৌঁছে যাব ১৯৬৩ সালে। ওই সময়ে ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন কাউন্সিল-এর অধীনে ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন অ্যান্ড রিজিওনালাইজেশন কমিটি-র সুপারিশে সংবিধানের ১৯ নম্বর পরিচ্ছেদে কিছু সংশোধন করা হয়। সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা।
সালটা একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে— এর ঠিক এক বছর আগে, ১৯৬২ সালে, ঘটে গিয়েছিল ভারত-চিন যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে ভারতের সুরক্ষা ও সার্বভৌমত্ব— দুই-ই ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। শুধু তাই নয়, দেশের মধ্যেই চিনপন্থী কমিউনিস্টরা সরকারবিরোধী অবস্থান নিয়ে চিনের পক্ষে আওয়াজ তুলেছিলেন। এই সব ঘটনার প্রেক্ষিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই সংবিধানের ১৯ নম্বর পরিচ্ছেদের ২ নম্বর ধারায় সংশোধন আনা হয়। “দেশের সুরক্ষার স্বার্থে” এই বাক্যাংশটির পরিবর্তে লেখা হয় “দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বের স্বার্থে”। সাধারণভাবে দেখলে এটি খুবই সামান্য একটি পরিবর্তন— যাকে সংশোধন না বলে পরিমার্জনও বলা যেতে পারে। কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যাবে, এটি ছিল এক বড় ধরনের সংশোধন। পূর্ববর্তী বাক্যবন্ধের মধ্যে যে স্পষ্টতা ছিল, তা অনেকাংশেই অনুপস্থিত এই নতুন বাক্যবন্ধে। এককথায় বলা যায়— ‘সুরক্ষা’ শব্দটির মধ্যে ছিল এক ধরনের বস্তুগত অর্থ; কিন্তু ‘সংহতি’ ও ‘সার্বভৌমত্ব’ অনেকটাই বিষয়গত বা ব্যাখ্যাভিত্তিক ধারণা। ফলে এই দুটি শব্দের ব্যাখ্যায় বিভিন্নতা থাকা অবশ্যম্ভাবী। কোন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হবে, তা রাষ্ট্রই নির্ধারণ করবে— এবং নাগরিককে সেই ব্যাখ্যাই মেনে নিতে হবে।
এরই ভিত্তিতে ১৯৬৭ সালে তৈরি হল ইউএপিএ আইনটি। এরপর ধীরে ধীরে এই আইনটির নানা সংশোধন ঘটেছে— ১৯৬৯, ১৯৭২, ১৯৮৬, ২০০৪, ২০০৮, ২০১২ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে।
২০১৯ সালের আগে পর্যন্ত এই আইনে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ কেবলমাত্র কোনও অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের সংশোধনে যুক্ত হল নতুন ধারা— এমনকি কোনও সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন এমন একজন ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করা যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই, তিনিও এই আইনের আওতায় চলে আসবেন।
এক অর্থে এই সংশোধন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আরও বড় সম্ভাবনা তৈরি করে দিল। এর সঙ্গে যুক্ত হল ইউএপিএ-র এমন কিছু ধারা, যেমন ৪৩(ডি), যার প্রয়োগে ইউএপিএ-তে অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। যার ফলস্বরূপ, বহু মানুষ— যাঁরা সরকারের নানা নীতি বা পদক্ষেপের প্রতিবাদ করেছেন এবং জনমত গঠনে সক্রিয় ছিলেন— আজ কারাগারে বন্দি। অনেকের জামিন পেতে লেগে যাচ্ছে দীর্ঘ সময়। বিশেষ করে ভীমা কোরেগাঁও মামলার অভিযুক্তদের মধ্যে প্রায় সকলেই অবশেষে জামিন পেয়েছেন। হয়তো বিচারে তাঁরা প্রত্যেকেই নির্দোষ প্রমাণ হবেন, কিন্তু জীবনের যে অমূল্য সময় তাঁরা বন্দিদশায় কাটিয়ে ফেলেছেন— সেই সময় আর কোনওদিন ফিরে পাবেন না।
বনজ্যোৎস্নার সঙ্গে আলোচনার একটি প্রধান দিক ছিল— এই আইন এবং বিচারপদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্র যেভাবে ব্যক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধারাটি কেমন হবে। একদিকে গণতন্ত্র নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে নানান কাঁটাছেঁড়া; ফলে তার প্রসূপ্ত দিকগুলি ক্রমশ প্রকাশ্যে আসছে। যেগুলি অধিকারের নানা বেড়াজাল ভাঙতে ভাঙতে ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসরকে আরও বিস্তৃত করে তুলছে। ঠিক তখন, ভারতবর্ষের মতো বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে নানা আইনি বিধিনিষেধ তৈরি করে ব্যক্তিস্বাধীনতা— বিশেষ করে বাকস্বাধীনতার— কণ্ঠরোধ করার জন্য চলছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
আবার এটাও ঘটনা, যে বিরোধী দলটি— যারা এই মুহূর্তে ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে সতত মুখর— ২০০৮ সালে তারাই যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনই ইউএপিএ আইনটিতে জামিন-সংক্রান্ত ৪৩ নং ধারাটি যুক্ত করা হয়। এর প্রেক্ষাপট সম্ভবত ছিল মুম্বাই শহরে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসবাদী হানা। প্রেক্ষাপট যাই থাকুক না কেন, আজকের পরিস্থিতিতে এই আইনের প্রয়োগের ধরন থেকে বর্তমান সরকারের অভিসন্ধি স্পষ্টভাবে উঠে আসছে। তা হল— যে-কোনও গণআন্দোলনকে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত করার প্রবণতা, এবং আন্দোলনকর্মীদের গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ সময় ধরে বিনা বিচারে জেলে বন্দি করে রাখা।
এর পাশাপাশি আইন ও বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে এই প্রক্রিয়াকে ন্যায়সিদ্ধ করে তোলারও চেষ্টা চলছে। এভাবে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বিচারকরাও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে নিম্ন আদালতের বিচারকরা এখনও জামিনের সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নানান মন্তব্য ও সমালোচনা সত্ত্বেও, নিম্ন আদালতের বিচারকরা এখনও যথেষ্ট সাহস অর্জন করে উঠতে পারেননি। ফলে বিচারপ্রার্থীরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছেন।
শুধু গণআন্দোলনকারী নয়, অনেক সময় এই আইন ব্যবহৃত হচ্ছে মূলধারার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধেও। কিন্তু এই বিষয়গুলি নিয়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে মূলধারার যে বিরোধী দলগুলি আছে, তারা যদি প্রতিবাদ না জানায় বা জনমত তৈরি করার উদ্যোগ না নেয়, তবে এই সন্ত্রস্ত পরিবেশ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়বে এবং এক ফ্যাসিস্ট পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা প্রগাঢ় হবে। এখনও পর্যন্ত মূলধারার বিরোধী দলগুলির মধ্যে এসব নিয়ে বিশেষ কোনও নড়াচড়া চোখে পড়েনি। যেটুকু প্রতিবাদ হচ্ছে, তা মূলত এনজিও বা নাগরিক সমাজের তরফে, যারা অধিকার নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলির চর্চার মধ্যে বিষয়টি এখনও যথার্থ গুরুত্ব পায়নি। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে বিরোধী দলগুলি এই বিষয়ে মুখর হবে এবং বিষয়টি মূলধারার রাজনৈতিক আলোচনার অংশ হবে। কিন্তু যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন সাধারণ মানুষ— যাঁরা সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী কর্মসূচির বিরোধিতা করে জনমত গঠনের চেষ্টা করছেন— তাঁদের একটি অংশকে এর মাশুল গুনে যেতে হবে। এটাই ভবিতব্য।

