ইলা মিত্রের ঠিকানা

দিলীপ চক্রবর্তী

 


বিপ্লবীদের কি নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকে? রোজা লুক্সেমবার্গের ঠিকানা কী? তিনি পোলিশ বা জার্মান? রোজার ঠিকানা তো বিপ্লবীর মনে। ডলারেস ইবারুরি? তাঁর দেশ কোনটা? তাঁর উচ্চারিত ‘নো-পাসারান’ সারা পৃথিবীর দৃঢ়চিত্ত বিপ্লবীদের প্রত্যয়সিদ্ধ প্রতিজ্ঞায় উচ্চারিত হয়। ক্রুপস্কায়া, লেনিনের স্ত্রী, রুশ বিপ্লবী— শুধু এটুকুই কি তাঁর পরিচয়? আর আমাদের দেশে লক্ষ্মীবাই থেকে মাতঙ্গিনী হাজরা, কিংবা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত থেকে অহল্যা— তাঁদের ঠিকানা? তাঁদের ঠিকানাও তো দেশের স্বাধীনতার লড়াই, সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রাম আর কমিউনিস্ট আন্দোলনে। ইলাদির ঠিকানাও তো তাই

 

ভারতের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়েছিল ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর। সেই অর্থে ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বয়স এই ২০২৫ সালে একশো হচ্ছে। কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্র ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রায় সমবয়স্ক। তাঁরও জন্ম ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর, এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর।

যশোহর জেলার নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন অবিভক্ত বাংলার ডেপুটি অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল। তাঁর বড় মেয়ে ইলার জন্ম কলকাতায়। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত রাজ্য জুনিয়র অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়ন ইলা সেন। অ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, বাস্কেটবল, ব্যাডমিন্টন সবকিছুতেই ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ছিলেন বাংলার ক্রীড়াজগতের অনন্যা। ১৯৪০ সালে বিশ্ব-অলিম্পিকের জন্য ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিতা তরুণী ইলা মানবমুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন মার্কসবাদী দর্শনে। কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর ১৯৪৩ সাল অর্থাৎ বাংলা ১৩৫০ সালের মন্বন্তরের ঝড়ের দিনগুলিতে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতিতে সামিল হন ইলা সেন। ১৯৪৬ সালে দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালিতে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে গিয়েছিলেন তরুণী ইলা। কলেজে ছাত্রী থাকার সময়েই সেই ১৯৪৩ সালে ১৮ বছর বয়সে হাতে তুলে নিয়েছিলেন লাল পতাকা। এই পতাকা বহন করেছেন ৫৯ বছর। অবশেষে এই পতাকা বুকে নিয়ে শায়িত অবস্থায় বিপ্লবী ইলা মিত্রের মরদেহ গিয়েছে কলকাতার মেডিকেল কলেজে, ২০০২ সালের ১৪ অক্টোবর। ইলা মিত্রের ইচ্ছানুযায়ী তাঁর শবদেহ আর অস্থি কাজে লেগেছে বিজ্ঞান আর সভ্যতার বিকাশে মানবকল্যাণে।

ভারতের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন, সামন্তবাদ-বিরোধী আন্দোলন, পুঁজিবাদ-বিরোধী সংগ্রাম ও সমাজপ্রগতির জন্য সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গর্ব করার মতন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভূমিকা, আর এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়ানো আছে ইলা মিত্রের জীবন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সংগ্রামী নেত্রী ইলা মিত্রকে নিয়ে লিখতে গেলে এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই তাঁর জীবনকথা লিখতে হবে। একটি রচনায় তা সম্ভব নয়। তাঁর সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন পর্যায় উভয় বাংলার স্বনাম-খ্যাত কবি ও সাহিত্যিকদের লেখায় স্থান পেয়েছে। তাঁকে নিয়ে যেমন লিখেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, গোলাম কুদ্দুস, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নুরুন্নবী চৌধুরী, শহীদ সাবের তেমনি তাঁকে নিয়ে লিখেছেন আলাউদ্দীন, আল আজাদ, ফয়েজ আহমেদ, সত্যেন সেন। তাঁর জীবনকথা নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন সেলিনা হোসেন। পূর্ণাঙ্গ জীবনীগ্রন্থ লিখেছেন মালেকা বেগম।

 

লেনিন একবার বলেছিলেন, মানুষ একবারই জীবন পায়। সে যেন মৃত্যুর আগে বলতে পারে— আমি জীবনকে ব্যর্থ করিনি, আমি জীবনকে মানবজাতির মুক্তির জন্য ব্যয় করেছি। বাংলার ডাকসাইটে অ্যাথলিট ইলা মিত্র তো তাঁর জীবন এইভাবেই প্রবাহিত করেছেন। মৃত্যুর পরেও তিনি তাঁর মরদেহ কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন মানবজাতির কল্যাণে।

ইলাদির মৃত্যুর কিছুদিন পরে একদিন কলকাতা মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে আসছিলাম। হঠাতই ইলাদির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। ইলাদির মরদেহ, অস্থি, কঙ্কাল সব তখন সেখানে। ইলা মিত্রের ঠিকানা তখন অ্যানাটমি বিভাগ, কলকাতা মেডিকেল কলেজ।

ঠিকানা! ঠিকানা! বিপ্লবীদের কি নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকে? সুকান্ত ভট্টাচার্যের ঠিকানা নামে একটি কবিতা পড়েছিলাম। তারই কয়েকটি লাইন মনে এল— “আমার হদিশ জীবনের পথে/মন্বন্তর ঘুরে/ঘুরে গিয়েছে যে কিছুদূর গিয়ে/মুক্তির পথে বেঁকে…” ইলাদির জীবনও যেন তাই। এই কবিতাতেই আছে “আমার ঠিকানা খোঁজ করো শুধু সূর্যোদয়ের পথে।” শুধু ইলাদির নয়। সমস্ত বিপ্লবীদেরই তো এই কথা। বিপ্লবীদের কি কোনও ঠিকানা আছে?

রোজা লুক্সেমবার্গের ঠিকানা কী? তিনি পোলিশ বা জার্মান? ১৯১৯-এ মৃত্যুর দুই দিন আগে রোজা লিখেছিলেন, “I was, I am, I shall be.” আমি ছিলাম, আমি আছি, আমি থাকব। এ-কথা তো বিপ্লবের। রোজার ঠিকানা তো বিপ্লবীর মনে। তেমনি ডলারেস ইবারুরি। তাঁর দেশ কোনটা? তাঁর উচ্চারিত ‘নো-পাসারান’ সারা পৃথিবীর দৃঢ়চিত্ত বিপ্লবীদের প্রত্যয়সিদ্ধ প্রতিজ্ঞায় উচ্চারিত হয়। ক্রুপস্কায়া, লেনিনের স্ত্রী, রুশ বিপ্লবী— শুধু এটুকুই কি তাঁর পরিচয়? পৃথিবীর দেশে দেশে অগণিত কমিউনিস্ট তরুণী তো আবেগদৃপ্তভাবে জীবনে একটি সময়ের জন্য হলেও মনে মনে নিজেকে ওই ক্রুপস্কায়ার মতো ভাবতে চান। আর আমাদের দেশে লক্ষ্মীবাই থেকে মাতঙ্গিনী হাজরা, কিংবা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত থেকে অহল্যা— তাঁদের ঠিকানা? তাঁদের ঠিকানাও তো দেশের স্বাধীনতার লড়াই, সামন্তবাদ-বিরোধী সংগ্রাম আর কমিউনিস্ট আন্দোলনে। ইলাদির ঠিকানাও তো তাই।

 

সাবেক পূর্ব পাকিস্তান থেকে অসুস্থ ইলা মিত্রকে নিয়ে আসা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে। এরপর তিনি আর ওই দেশে ফিরে যেতে পারেননি। পূর্ব পাকিস্তান রূপান্তরিত হয়েছে এখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে। কিন্তু সেই দেশের বহু মানুষের কাছে ইলা মিত্র এখনও তাঁদের। তাঁদের ঘর আর মন এখনও ইলাদির ঠিকানা। ঢাকা, যশোহর, বগুড়া, রাজশাহী, নবাবগঞ্জ-চাপাই, নাচোলের মানুষ তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তাঁর নামে উদ্বেল হয়েছিলেন। প্রিয়জনকে দেয় উপহার পাঠিয়েছিলেন, সংগ্রামের সাথী হিসেবে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন— এই সব ক্ষেত্রে সংগ্রামী মানুষের মধ্যে উচ্চারিত হয়েছে ইলা মিত্রের নাম। তাঁর নাম সংগ্রামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের অন্যতমা শ্রেষ্ঠ নারী হিসেবে ইলা মিত্রকে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন স্মরণ করেছে। এই সমস্তরই চিহ্ন রয়েছে কলকাতার সিআইটি রোডের এ-৩ হাউজিং এস্টেটে। ইলাদির ছেলে আর ছেলের বউ, নাতি এই চিহ্নগুলিকে সযত্নে রেখেছে। ইলাদির মৃত্যুর কিছুদিন আগেই ওই দেশের সংবাদপত্র জনসমীক্ষা করে বাংলাদেশে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ২০ জন বাঙালির তালিকা প্রকাশ করেছে। এই বিশজনের মধ্যে ইলা মিত্র ছিলেন।

ইলাদির সঙ্গে রুশ বিপ্লবী জয়া-শুরার চেহারার কোনও মিল নেই। মিল নেই পোশাক অথবা ভাষার কিংবা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটের। জয়া-শুরার জীবনগাথা শুনেছি আমার কৈশোরে। নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের কথা শুনেছি বাবা-মায়ের কাছে। পরে বোধহয় তাঁদের হাত ধরে এ-বিষয়ে একটি রুশ সিনেমাও দেখেছিলাম। তখনও ইলাদির কথা জানতাম না। স্কুলজীবনে স্বাধীনতা পত্রিকার পাতায় যখন ইলা মিত্রর কথা পড়ি, কিংবা আমার বাবা ক্ষিতীশ চক্রবর্তী বা মামা শশীন চক্রবর্তীর মুখে ইলা মিত্রের কথা শুনি তখন কেন যেন জয়া-শুরার কথা মনে হত। কিন্তু তাঁকে জীবনে প্রথম দেখি ১৯৬২ সালে বিধানসভা নির্বাচনে মানিকতলা কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে। তখন আমি বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র। তাঁদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ হওয়া শুরু করি ১৯৬৬ সাল থেকে। দৈনিক কালান্তর তখন সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে। সিআইটি রোডে পি-৪৩ ডাঃ সুন্দরীমোহন এভিনিউ-এ এর দপ্তর। দৈনিক পত্রিকার প্রথম পর্যায়ে তখনও ওই দপ্তরে টেলিফোন আসেনি। অথচ দৈনিক পত্রিকা দপ্তরে টেলিফোন খুব জরুরি। কথা হল, যে-পর্যন্ত টেলিফোন যোগাযোগ না হয় সে-পর্যন্ত ইলাদির বাড়িতে গিয়ে ফোন করব। ওই সময়ে দৈনিক কালান্তরের প্রধান সম্পাদক এবং সিপিআই রাজ্য পরিষদের সম্পাদক ভবানী সেনও ওই বাড়িতেই থাকেন। তিনি তা-ই নির্দেশ দিলেন। ওই প্রথম তাঁর বাড়িতে যাওয়া। আমাকে বাড়ির কেউ চিনবেন কিনা ভাবছি। ওই বাড়িতে গিয়ে দেখি ইলা মিত্র নেই। দরজা খুলে দিলেন রমেন মিত্র। তারপর বললেন, দিলীপ আয়, ফোন ভেতরের ঘরে। আমি অনুভব করলাম, রমেনদা শুধু আমাকে নয়, আমার বাড়ির সকলকেই চেনেন। তাদের কুশল জিজ্ঞেস করলেন। এটি শুধু আমার ক্ষেত্রে নয়, কালান্তরের সাংবাদিক এবং অ-সাংবাদিক কর্মীদের প্রায় সকলকেই তিনি জানতেন। ক্রমশ শুধু ইলাদি নয়, ভক্ত হয়ে পড়লাম রমেনদারও। শেক্সপীয়র এবং রবীন্দ্রনাথ তাঁর গলায়। ধীর, অসীম সাহসী, আত্মপ্রচার-বিমুখ। যিনি নিজে স্বপ্ন দেখেন, অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে জানেন। মানুষকে ভালোবাসেন। রমেনদাকে আমার সব সময়েই মনে হত স্বপ্নের নায়ক। তাঁর চলায়, বলায় এমনকি একদা তাঁর ক্রমাগত সিগ্রেট খাওয়ার মধ্যেও আমি একজন রোমান্টিক ‘হিরো’কে দেখতে পেতাম। আর বিপ্লবীদের চাইতে ‘রোমান্টিক’ আর কে আছে? আমার মাঝেমাঝেই মনে হত, একদা নামী অ্যাথলিট ইলা মিত্রের মধ্যে সংগ্রামী প্রত্যয়, সাহস, মানুষের জন্য ভালোবাসা আর মার্কসবাদী দর্শনে আস্থা অর্জনের বিষয়ে রমেনদার প্রেরণা আর রোমান্টিসিজম অনেকবারই প্রভাব ফেলেছে।

 

কালান্তরে সাংবাদিক থাকাকালীন সময়েই ইলাদি আর রমেনদার ঘনিষ্ঠ হই আমি। আমার বাড়ি দমদম, কাজের জন্য বেরিয়ে আসতাম সকালে। আর ফিরতাম রাত ১১টা ৪০-এর ট্রেনে। রাতে নিয়মিতই ইলাদির সঙ্গে একটু খেয়ে নিতে হত। রমেন মিত্র, ইলা মিত্রকে ‘দাদা’ অথবা ‘দিদি’ বললেও তাঁরা বলতেন দিলীপ আমাদের ছেলে। তরুণ সান্যালকে বলতেন তাঁদের ছোট ভাই। এই সুবাদে তাঁদের জীবনের অনেক গল্প এবং বিপ্লবী রোমান্টিসিজমের কথাও আমি শুনেছি।

রমেন মিত্রের সঙ্গে ইলাদির বিয়ে হয় ১৯৪৫ সালের দোলপূর্ণিমায়। দুজনেই কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন। রমেনদা ছিলেন রাজশাহীর নবাবগঞ্জের জমিদারবাড়ির ছেলে। বিয়ের পর কলকাতার স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে উভয়ে চলে যান রাজশাহীতে, এই জেলার গ্রামাঞ্চলকেই কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। কমিউনিস্ট পার্টি তেভাগা আন্দোলন শুরু করলে রমেন মিত্র ইলা মিত্র তাঁদের জমিদারিতে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে তেভাগা জারি করেন। তেভাগা আন্দোলন ছড়িয়ে দেন নাচোল, চাপাই-সহ রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যান। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লিগ সরকারের প্রশাসনযন্ত্র আর আনসার বাহিনী সংগ্রামী কৃষক আর তার নেতাদের আক্রমণ করেছিল। নেতাদের বিরুদ্ধে জারি হয়েছিল পুলিশি হুলিয়া। রমেন মিত্র গ্রেপ্তার হওয়া এড়াতে পারলেও ইলা মিত্র পারেননি। তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সেটা ১৯৫০ সালের জানুয়ারি। তাঁকে করা হয় ফাঁসির আসামি। অকথ্য নির্যাতন হয় তাঁর উপরে। পাকিস্তান এবং ভারতবর্ষ উভয় দেশেই তখন কমিউনিস্ট আন্দোলন বিপর্যস্ত। রমেন মিত্র এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতৃবর্গ আত্মগোপন অবস্থাতেই গণতান্ত্রিক শক্তিকে সংগঠিত করার কাজে নামেন। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে তাঁরা আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।

শেষ পর্যন্ত কিছুদিনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে লিগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। কিছুদিনের জন্য ক্ষমতায় আসেন আতাউর রহমান-ফজলুল হক। ইলা মিত্রকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় ভারতবর্ষে। আবার লিগ সরকার ক্ষমতায়। ইলা মিত্র পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারেননি।

১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তান রূপান্তরিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। ওই দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রথম আসেন কলকাতায়। ১৯৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি। আবেগে কাঁপছে কলকাতা। সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গ দমদম বিমানবন্দরে উপস্থিত তাঁকে স্বাগত জানাতে। ইলা মিত্রও দমদম বিমানবন্দরে উপস্থিত। সিদ্ধার্থ রায় সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

ইলদিকে দেখিয়ে সিদ্ধার্থ রায় বললেন, ইনি ইলা মিত্র। বঙ্গবন্ধু তাঁর সামনে দাঁড়ালেন। ইলা মিত্র! রাজশাহীর ইলা মিত্র! আমাদের ইলা মিত্র! তারপরে ইলাদিকে বললেন, ‘আপনি তো আমাদের দেশের। এবার দেশে চলেন।’ ইলাদি তো তখন ভারতবর্ষের নাগরিক। ভারতের সংগ্রামী আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ। তিনি তো ভারতেরও। ইলাদির তো ওই দেশে এখন যাওয়া চলে না। এখানেও তো তাঁর অনেক দায়িত্ব। ১৯৫৪ সালে ইলাদি পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে এলেও তাঁর নামে হুলিয়া ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সেই হুলিয়া প্রত্যাহার করেন।

 

রোমান্টিসিজমের কথা উল্লেখ করেছি এর আগে। এই বিষয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করতেই হয়। পুলিশি অত্যাচারের গুরুতর অসুস্থ ইলাদি তখন ঢাকা হাসপাতালে। ওই হাসপাতলে আরও কিছু বিপ্লবী তখন অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসাধীন। অতএব পুরো হাসপাতাল ঘিরেই সরকারি প্রহরা। পুলিশ ২৪ ঘন্টা সজাগ রয়েছে বিপ্লবী বন্দিদের প্রতি। রমেন মিত্রের নামে পুলিশি হুলিয়া। সংবাদপত্রে পুলিশ তাঁর ছবি বের করেছে, তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। ‘ইনামে’রও কথা বলা হয়েছে। রমেনদা অ-বাঙালি মুসলমান সেজে ছদ্মবেশে ঢাকায় আছেন। সেদিন দোলপূর্ণিমা। রমেনদা-ইলাদির বিয়ের দিন। ঢাকায় কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্বে তখন জ্ঞান চক্রবর্তী আর গোপাল নাগ। তাঁরা এই তারিখটির কথা জানতেন। জ্ঞান চক্রবর্তী রমেনদাকে বললেন, হাসপাতালে গিয়ে ইলাকে দেখে এসো। রমেনদা খুশি হলেন এই সিদ্ধান্তে। কথানুযায়ী কাজ। হাসপাতালে ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলা হল, এরপরে পুরো সাহেবি পোশাক পরে, গলায় স্টেথো নিয়ে ডাক্তারদের সঙ্গে মিশে তিনি হাসপাতালে গেলেন। অন্যান্য রোগী এবং অসুস্থ রাজবন্দিদের কাছেও তাঁরা গেলেন। ময়মনসিংহের কমিউনিস্ট নেতা জলধর পালও তখন বন্দি অবস্থায় হাসপাতালে। তিনি তাঁকে দেখে চিনে ফেললেও কোনও অভিব্যক্তি প্রকাশ না করে চুপ করে থাকলেন। কিন্তু খুশি হলেন। এরপরে এলেন ইলাদির সামনে। ইলাদি তখন একেবারেই শয্যাশায়ী। চোখ বুজে শুয়ে আছেন। রমেনদা তাঁর চোখে মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন। ইলাদি তাকিয়ে দেখেন রমেনদা। কথা বলতে ইলাদির কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন। রমেনদা বারণ করলেন। তারপর খুব আস্তে বললেন, ‘আজকে দোলপূর্ণিমা।’ এরপর ডাক্তাররা যেভাবে রোগীকে পরামর্শ দেয়, সেভাবেই জোরে কথা বললেন, মনে সাহস আর জোর রাখুন। এতেই অনেকটা ভালো হবেন। মানসিক সাহসের কাছে অনেক সময়ই রোগ পরাস্ত হয়। অন্যান্য রোগীরা রমেনদা যে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তাতে নিঃসন্দেহ হলেন। নিঃসন্দেহ হল প্রহরারত পুলিশও। পরবর্তীকালে ইলাদি এ বিষয়ে কথা বলতে গেলেই বলতেন, তোদের রমেনদার সেদিনের উপস্থিতি আমার চোখে এখনও ভাসে। তাঁর উপস্থিতি আমাকে আরও শক্তি জুগিয়েছিল।

ইলাদির জীবনাবসান হয়েছে ৭৭ বছর বয়সে। রমেনদা তখনও জীবিত ছিলেন। তাঁর বয়স তখন ৮৮। ইলাদির মৃত্যুর পর রমেনদার কাছে গিয়েছি। তখনও তাঁর আশ্রয় শেক্সপীয়র আর রবীন্দ্রনাথ। কথা তখন অস্পষ্ট হয়ে গেছে। বয়সের ভারে কানেও কিছুটা কম শোনেন, কিন্তু সে-বয়সেও আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন রোমিও জুলিয়েট থেকে, হ্যামলেট থেকে। বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে। জড়ানো কণ্ঠে তাঁর মুখে উচ্চারিত হল রবীন্দ্রনাথের সেই লাইন— ‘মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ, আমি আছি।’ যেমনটি আগে বলতেন রমেনদা। রমেনদাই একদা হাসতে হাসতে বলেছেন— বুঝলি রে, রোমান্টিক না হলে কি ভালোবাসা যায়? আর ভালোবাসতে না পারলে কি মানুষকে ভালোবাসা যায়? সাহসী হওয়া যায়? বিপ্লবের জন্য কাজ করা যায়? রবীন্দ্রনাথ পড়। ভালো করে পড়। শেক্সপীয়র পড়। দেখবি জীবনটা কী! ইলাদির জীবনেও ছিল এর প্রভাব। ডাকসাইটে অ্যাথলিট, অসাধারণ সংগ্রামী, তুখোড় বাগ্মী অধ্যাপিকা সময় পেলেই আশ্রয় নিতেন রবীন্দ্রনাথে। গান শুনতেন। গান গাইতেন।

 

সিআইটি রোডে রমেনদা-ইলাদির এ-৩ গভঃ হাউজিং এস্টেটের আস্তানায় এলে আমার আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এটি যেন পরিণত হয়েছিল ওয়ার ক্যাম্পে। মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা আর পরিচালনার শিবির। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হলে মুক্তিযোদ্ধারা এবং তাঁদের অনেকেই ছত্রভঙ্গ অবস্থায় কলকাতায় এসে হাজির হন। তাঁরা জানতেন কলকাতায় তাঁদের ঠিকানা হল এই বাড়ি। রাজশাহী জেল ভেঙে এলেন মণি সিংহ। এলেন ন্যাপের সৈয়দ আলতাফ হোসেন, মোজাফফর আহমেদ। এলেন আওয়ামি লিগের কামরুজুমান মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদ। এলেন মোহাম্মদ ফারহাদ, বারীন দত্ত, রণেশ দাশগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, বজলুর রহমান, অধ্যাপক হালিম, মালেকা বেগম, মোনায়েম সরকার। এলেন ছাত্রলিগ, ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবর্গ, এলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীরা। রমেনদা-ইলাদির ঘরের দরজা তাঁদের জন্য ২৪ ঘন্টা খোলা। তাঁরা আসার পর প্রথমে তাঁদের স্নান-খাওয়ার ব্যবস্থা, পরবর্তী সময়ে আশ্রয়ের ব্যবস্থা। এর সবটাতে রমেনদা-ইলাদি। ইলাদিকে তখন দেখেছি বহু মানুষের জন্য রান্না করছেন, এত মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা। প্রয়োজনে তার জন্য টাকা ধার করেছেন। অসুস্থদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার ব্যবস্থা করছেন, মুক্তিযুদ্ধের শরিক বিভিন্ন অংশগুলির ভুল বোঝাবুঝি কাটিয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছেন।

বাংলাদেশের সংগ্রাম স্বাধীনতার জন্য না স্বায়ত্তশাসনের জন্য? এ নিয়ে বামপন্থী ও প্রগতিশীল মহলে প্রথমে কিছু দোলাচল ছিল। তা কাটাতে বিতর্ক অথবা আলোচনা সবই হতে দেখেছি আমি সেই আস্তানায়।

রমেনদা আর ইলাদির এই ভূমিকা হয়তো তখন আমাদেরও কিছু সাহসী করতে সাহায্য করেছে। আমার বন্ধু দীপ্তেন্দু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চলে গিয়েছিল দিনাজপুরে। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন জিয়ার ছবি জোগাড় করে এনেছিল। দারুণ রিপোর্ট করেছিল। আমি দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, যশোহর, কুষ্টিয়া, খুলনায় গিয়েছিলাম যুদ্ধের মধ্যে রিপোর্ট সংগ্রহ করতে। সেখানকার মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের খোঁজ নিতে। খোকন চৌধুরী নাম নিয়ে যুদ্ধের মধ্যে কিংবা ক্রস ফায়ারিং-এর মধ্যে ওই সমস্ত অঞ্চলে যেতে আমার কখনও দুর্বলতা আসেনি। একবার তো বগুড়ায় গিয়ে জামায়েত, রাজাকার আর পাকবাহিনীর তাঁবেদারদের মধ্যে আটকে পড়েছিলাম।

নেহাত উপস্থিত বুদ্ধি আর বরাতজোরে বেঁচেছি। এই সময়ের কথা ভাবতে এখনও অবাক লাগে। আমার জীবনে এটা এখনও একটা থ্রিলিং মুহূর্ত।

কিন্তু ওই সময়ে আমি ঘাবড়াইনি। মনকে শান্ত রেখেছিলাম। রমেনদার উপদেশে মনকে শান্ত রাখতে আশ্রয় নিয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথে। জানতাম কিছুক্ষণ পরেই আমাকে গুলি করা হবে। ওই মুহূর্তে মনে মনে যাঁদের প্রণাম জানিয়ে বিদায় চেয়েছিলাম, তাঁরা হলেন আমার মামা, বাবা, মা, ভবানী সেন আর রমেনদা এবং ইলাদি।

 

আমার মা মারা গিয়েছেন ২০০০ সালের এপ্রিলে। তিনিও লালপতাকা বুকে নিয়ে শেষযাত্রায় গিয়েছিলেন। আমার মা বীণা চক্রবর্তীও ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সমবয়সী। ইলা মিত্রকে মা ভাবতাম। তাঁর মৃত্যুতে দ্বিতীয়বার মা হারিয়েছিলাম। আমার মায়ের সমবয়স্কা ইলা মিত্র লালপতাকা বুকে নিয়েই শেষযাত্রায় গিয়েছিলেন। তাঁর মরদেহ গিয়েছিল কলকাতার মেডিক্যাল কলেজে। তাঁর দেহ, অস্থি বিজ্ঞান গবেষণার কাজে লেগেছে।

আমার মনে সর্বদাই প্রশ্ন বিপ্লবের কি মৃত্যু আছে? বিপ্লবীর কি মৃত্যু আছে? বিপ্লবীর কি কোনও ঠিকানা থাকে?


*প্রবীণ কমিউনিস্ট কর্মী এবং সপ্তাহ পত্রিকার সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তীর লেখাটি সপ্তাহ পত্রিকায় ইলা মিত্রের মৃত্যুর পর ২০০২ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয়। লেখকের অনুমতিক্রমে লেখাটিকে সামান্য কিছু হালনাগাদ করে পুনঃপ্রকাশ করা হল

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. ইলা মিত্র ও তেভাগা— নবম বর্ষ, চতুর্থ যাত্রা – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...