রাহুল পুরকায়স্থ: যেভাবে পেয়েছি

তন্ময় ভট্টাচার্য

 


তাঁর মতো কবিকে নিজের কোনও লেখা শোনাতে গেলেই তা দুর্বল মনে হত। মনে হত, অভিজ্ঞতা দিয়ে ধরে ফেলছেন প্রতিটা ফাঁকিবাজি। অথচ নিজে খুঁটিয়ে পড়তেন প্রত্যেক তরুণের লেখা। ফোনে জানাতেন বিভিন্ন কবির প্রতি তাঁর ভালোলাগার কথা। পাশাপাশি, সেই কবিদেরও ফোন বা মেসেজ করে জানাতেন ভালোলাগার খবর। তাঁরা হয়তো আমারই সমসাময়িক, অর্থাৎ তাঁর থেকে তিন দশক পরের। কিন্তু খুঁটিয়ে পড়া ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা দেখে টের পেতাম, আরও অনেকের মতো নিজের সিনিয়রিটিতে স্থাণু হয়ে থাকার মানুষ নন তিনি

 

বয়সের ফারাক ঠিক ৩০ বছর। তাঁর জন্ম ১৯৬৪-তে, আমার ’৯৪ সালে। তারপরও ঘনিষ্ঠতায় কোনও বাধা ছিল না। এক অর্থে বন্ধুই বলা চলে। বন্ধু, কিন্তু পোশাকি পরিচয় ‘মামা’— আমাদের এক বন্ধুর সূত্রে, রাহুল পুরকায়স্থ হয়ে উঠেছিলেন আমাদের রাহুলমামা। একই জনপদ অর্থাৎ বেলঘরিয়ায় বসবাস আরও ইন্ধন জুগিয়েছিল মামা-ভাগ্নের সম্পর্কে। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। বন্ধুবান্ধবরা যখন তাঁকে ‘রাহুলদা’ বলে ডাকছে, আমাদের গুটিকয়েক ছেলেপুলের মামা-ডাক। অন্যদের বাঁকা-চোখ। তা হোক, তারা কি আর ভেতরের খবর জানে!

একের দশকে লেখালেখি করতে আসা আমরাই বোধহয় শেষ প্রজন্ম, যারা রাহুল পুরকায়স্থকে কাছ থেকে পেয়েছি, তাঁর সঙ্গে আড্ডা মারতে পেরেছি দেদার। তবে আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় কবিতা নয়, ইতিহাসের সূত্রে। ২০১৫-র শেষ বা ২০১৬-র শুরুর দিক, আমার প্রথম বই ‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে’-র পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেলাম তাঁর বাড়িতে, সুবিমল বসাকের সঙ্গে। আবদার— এ-বইয়ের ভূমিকা লিখে দিতে হবে। আসলে বইটি আঞ্চলিক ইতিহাসের হলেও, একজন কবির ছোঁয়া থাকুক, চেয়েছিলাম। পাণ্ডুলিপি পড়ার পর, আবার বাড়িতে ডাকলেন। হাতে তুলে দিলেন দু-পাতার নাতিদীর্ঘ ভূমিকা। সংক্ষিপ্ত, অথচ কী প্রাণবন্ত! প্রথম লাইন এখনও মনে আছে— ‘স্মৃতিই সংস্কৃতি। যাঁর স্মৃতি নাই তার সংস্কৃতিও নাই।’ সে-ভূমিকায় আমার নাম লিখেছিলেন ‘শ্রীমান তন্ময়’ বলে। একুশ বছরের সেই সদ্য-যুবক ‘শ্রীমান’ পড়ে বিব্রত হয়েছিল খানিক। আজ ওই শব্দটিকেই আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। টের পাচ্ছি, কী স্নেহ লুকিয়ে তাতে!

সেই শুরু, তারপর থেকে নিয়মিত যাতায়াত, যোগাযোগ। রাহুলমামার নীলগঞ্জ রোডের ফ্ল্যাটে কতবার যে গিয়েছি, গুনে শেষ করতে পারব না। আমার বাড়ি থেকে তাঁর বাড়ি হেঁটে বড়জোর পনেরো মিনিট, সাইকেলে বা টোটোয় আরও কম। ফলে কখনও আমি ফোন করে হাজির হতাম, কখনও উনিই হাঁক দিতেন। কখনও আবার সুবিমল বসাকের বাড়িতে তিনজনের আড্ডা। এছাড়াও একসঙ্গে এদিক-সেদিক যাওয়া, বিভিন্ন মেলার মাঠে দেখা হওয়া— সেসব তো আছেই! তবে তাঁর বাড়িই ছিল মুখ্য আড্ডাস্থল। বিশেষ করে তাঁর বইয়ের ঘর— চারদিকের দেওয়ালে ঠাসা বই, এমনকি মেঝে ও টেবিল উপচে-পড়া, তার মধ্যে চেয়ারে বসে রাহুলমামা— এ আমাদের অতিপরিচিত দৃশ্য। কবিতা, সাহিত্যজগতের পাশাপাশি বেলঘরিয়া নিয়েও দেদার আলোচনা। খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতাম তাঁকে, জেনে নিতাম এ-জনপদের সত্তর-আশির দশকের গল্প। কবিদের কথা। নেশাতুর অবস্থায় কিঞ্চিৎ সংযম হারাতেও যেমন দেখেছি তাঁকে, তেমন ছেড়ে দেওয়ার পর দুর্দান্ত স্বাভাবিক— কে বলবে, এককালে মদ ছাড়া চলতই না তাঁর!

মনে পড়ছে, প্রায় দশ বছরের আলাপে মাত্র দু-বারের বেশি নিজের কবিতা শোনাইনি তাঁকে। সে-সাহসই হয়নি। তাঁর মতো কবিকে নিজের কোনও লেখা শোনাতে গেলেই তা দুর্বল মনে হত। মনে হত, অভিজ্ঞতা দিয়ে ধরে ফেলছেন প্রতিটা ফাঁকিবাজি। অথচ নিজে খুঁটিয়ে পড়তেন প্রত্যেক তরুণের লেখা। জানুয়ারি থেকে মার্চ-এপ্রিল— এই সময়টায় তাঁর ফোন আসা বেড়ে যেত অস্বাভাবিকভাবে। কারণ, নতুন কবিতার বইগুলি পড়ছেন একে-একে। ফোনে জানাতেন বিভিন্ন কবির প্রতি তাঁর ভালোলাগার কথা। পাশাপাশি, সেই কবিদেরও ফোন বা মেসেজ করে জানাতেন ভালোলাগার খবর। তাঁরা হয়তো আমারই সমসাময়িক, অর্থাৎ তাঁর থেকে তিন দশক পরের। কিন্তু খুঁটিয়ে পড়া ও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা দেখে টের পেতাম, আরও অনেকের মতো নিজের সিনিয়রিটিতে স্থাণু হয়ে থাকার মানুষ নন তিনি। দিলখোলা এই স্বভাবই-বা কজনের! এছাড়াও তাঁর বাড়িতে গেলেই টেবিল থেকে একেকটা বই হাতে তুলে দিয়ে বলতেন— ‘এটা পড়।’ তারপর সেই বই নিয়ে আলোচনা। তাঁর সঙ্গে কথোপকথন অনেক দ্বন্দ্ব দূর করেছে, অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়েছে। মনে পড়ছে, একবার একটি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছি আমি, নেওয়া উচিত কিনা, তা নিয়ে কিঞ্চিৎ গুঞ্জন চারপাশে। কথাও শুনতে হচ্ছে দু-চারজনের থেকে। রাহুলমামাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম— ‘এই-এই ব্যাপার, নেওয়া কি উচিত?’ রাহুলমামার সটান উত্তর— ‘নিবি না কেন? উপযুক্ত বলেই তো পাচ্ছিস! টাকা দিচ্ছে তো? নিয়ে নে। টাকাটা জরুরি জীবনে।’ এই সরল ও সটান কথাটা অনেক কবিই বলে উঠতে পারেন না, ভান করেন। রাহুল পুরকায়স্থর সেসব ভান ছিল না। ঠিক তেমনই, গত এপ্রিলে, যখন তিনি হাসপাতালে ভর্তি, সেখান থেকেই ফোন করলেন একদিন— ‘এবার আমায় মধুসূদন পুরস্কার দিচ্ছে বুঝলি!’ আনন্দিত হয়েও সংশয় জানালাম— ‘রাজ্য সরকারের কাজকর্মের জন্য তাদের প্রতি যা মনোভাব সকলের, তুমি যদি এই পুরস্কার নাও, সমালোচিত হতে হবে কিন্তু!’ রাহুলমামার জবাব— ‘দ্যাখ, ওরা নিজে থেকেই দিচ্ছে, আমি কোনও চ্যানেল করে পাইনি। যোগ্যতার জন্যেই দিচ্ছে। আর টাকাটাও দরকার আমার।’ এই উত্তরের পর আর-কিছু বলতে পারিনি। অমন স্বচ্ছ দৃষ্টি আমার হল কই!

তবে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের সবচেয়ে ভালো দিকটি এ-ই, মনের যা-কিছু প্রশ্ন-দ্বিধা-সংশয়, নিঃসঙ্কোচে মুখের ওপর বলা যেত, জিজ্ঞেস করা যেত। ২০২২ সালে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তাঁর, তাতে এমন কিছু প্রশ্ন করেছিলাম, অন্য-কেউ হলে যা শুনে গোঁসা করতেন। রাহুলমামা সেসব স্পোর্টিংলি নিয়েছিলেন, জবাবও দিয়েছিলেন সেভাবেই। সাক্ষাৎকারের বাইরে, গতবছর, ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম— ‘এই যে তোমার কবিতায় এত ভারী ও তৎসম শব্দ, এর জন্য সমালোচিত হওনি কোনওদিন?’ এই প্রশ্নের নেপথ্য-কারণ ছিল বুঝে নিতে চাওয়া, কেননা একই অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছি আমিও। রাহুলমামার জবাব— ‘হ্যাঁ, কেউ-কেউ বলেছে। কিন্তু বেশি কেউ বলেনি। বললেই বা কী করব! এটাই আমার কবিতা।’ এতটাই স্পষ্টতা ছিল তাঁর। তা থেকেই বোধকরি চলতি বছরের মার্চ মাসে বলছিলেন, ‘এখন সঙ্কেত নয়, কাহিনিধর্মী কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। মণিভূষণ ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো।’ শুনে অবাক হয়েছিলাম। যিনি সারাজীবন সঙ্কেতধর্মী কবিতার চর্চা করে এলেন, তাঁর এমন ইচ্ছা বিস্ময়কর। সেই ধারা তাঁর কলমে কেমন রূপ পেত, দু-একটা আভাসের বাইরে স্পষ্ট হল না, এই খেদ থেকে যাবে।

তাঁর বইসংগ্রহ ঘাঁটাঘাঁটির সুযোগ পেয়েছি অবারিত। বসে-বসে পড়েছি প্রচুর কবিতা, পত্রিকা। এমনকি, দেশভাগ এবং সঙ্কলনের জন্য যখন সর্বত্র তোলপাড় করে কবিতা খুঁজছি, আমার অন্যতম ভরসা ছিল রাহুলমামার বইগুলি। শেষে, গতবছর সেপ্টেম্বরে যখন নীলগঞ্জ রোডের ফ্ল্যাট ছেড়ে বিটি রোডের হাউজিং কমপ্লেক্সে স্থানান্তরিত হবেন, তার আগে দু-ধাপে নিজের সংগ্রহ থেকে অনেকগুলি বই দিয়েছিলেন আমায়। একটা ফোন— “অনেকগুলো বই বের করে রেখেছি, এগুলো আর নিয়ে যাব না। তুই নিবি?” বড়-বড় দুটো ব্যাগ নিয়ে আমি হাজির। এ-আমার গর্ব যে, রাহুল পুরকায়স্থর সংগ্রহের প্রায় শ-খানেক বই এখন আমার জিম্মায়। তাতে যেমন বহু কবির কবিতার বই রয়েছে, রয়েছে গদ্যের বই, তেমনই সত্তর-আশির দশকের বিরল পত্রিকা ও সঙ্কলনও। সে-তালিকায় ১৯৭০-এ প্রকাশিত লেনিনের উদ্দেশে নিবেদিত কবিতা সঙ্কলন লেনিন শতাব্দী, নকশাল আন্দোলনকালীন ‘নান্দীমুখ’ পত্রিকার ১৯৭২ সালের একাধিক সংখ্যা, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ‘কবিকণ্ঠ’ পত্রিকার বিশেষ বাংলাদেশ সংখ্যা, দু-খণ্ড বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান এমনকি ১৯৩২-এ প্রকাশিত সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের লেখা মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র-ও রয়েছে।

২০১৭ সালে, নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত কবিতা সঙ্কলন বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। সেই কাজেরই দ্বিতীয় পর্বের জন্য ২০২১-২২ থেকে আমাকে উসকেছেন। কাজটি ছিল, নকশাল আন্দোলনের গান সঙ্কলিত করা। একদিকে গানের কথা, অন্যদিকে স্বরলিপি থাকবে— পরিকল্পনা হয়েছিল এমনই। বারবার আমার মাথায় গেঁথে দিতে চেয়েছেন কাজটি সম্পাদনা করার চিন্তা। সেই উদ্দেশে প্রতুল মুখোপাধ্যায়, বিপুল চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রাথমিক কথাও বলেছিলাম। তালেগোলে হয়ে উঠল না আর। প্রতুলদা চলে গেলেন, শেষে রাহুলমামাও। উৎসাহ দেওয়ার লোক আর রইল কই!

রাহুল পুরকায়স্থর আরেক রূপ দেখেছি তাঁর শেষ বই লেখাগুলি আমাকেই বলে-র পাণ্ডুলিপি গোছানোর সময়। এটি তাঁর কুড়িতম কবিতার বই, অথচ তিনি প্রথম বইয়ের মতোই ভীরু, উৎসাহী ও চঞ্চল। প্রায় রোজই সকালে ফোন করছেন, “দ্যাখ তো কবিতাগুলো রাখা যাবে কিনা”, শুনিয়ে চলেছেন একের পর এক লেখা। কখনও আবার তাঁর বাড়িতে, পড়তে-পড়তে ফুরিয়ে এল পুরো পাণ্ডুলিপিই। সবচেয়ে বিব্রত লাগত, যখন মতামত জানতে চাইতেন। দ্বিধা সহকারে বলেছি দু-চারটি কবিতা বাদ দেওয়ার কথা, কখনও কোনও শব্দ বদলের কথা। আশ্চর্য হয়ে দেখেছি, মেনে নিয়েছেন প্রায় সবগুলিই। শেষ পাণ্ডুলিপি থেকে বাদ পড়েছে সেসব। পাণ্ডুলিপি হাতে নিয়ে একদিন বললাম— “বাক্যের শেষে এত কমা কেন? এগুলো বাদ দিলেও তো কোনও ক্ষতি হবে না!” আশ্চর্য, অনায়াসেই সম্মত হলেন, বললেন, “ফেলে দে!” এই সহজতা, স্থিতিস্থাপকতা কি আমাদের মধ্যেও এসেছে! অন্য-কেউ কবিতা নিয়ে কোনও পরামর্শ দিলে, আমরা কি এত সহজে মেনে নিতে পারি, নিঃসঙ্কোচে? রাহুল পুরকায়স্থ পারতেন। এ-ও এক শিক্ষা। জানুয়ারির সকালে ফোনে নির্দেশ— “ব্লার্ব লিখে দে তো বইটার!” দুদিন পরেই— “কবি-পরিচিতিটাও লিখে দে, বুঝলি!” এইসব ছোট-ছোট আবদার দ্বিধাহীনভাবে করতে পারতেন তিনি। আবার বইয়ের কাজ শুরু হতে দেরি হওয়ায় দেখেছি শিশুর মতো অভিমান। গজগজ করছেন ফোনে। কাজ শেষ হতে, বই বেরোতে আবার সরল আনন্দ। “এটাই আমার শেষ বড় বই (চার ফর্মার), আর বড় বই করব না।” শোনামাত্র আপত্তি জানিয়েছিলাম। কিন্তু পাকেচক্রে শেষতম বই হয়ে থেকে যাবে— আমরা কি জানতাম!

জীবন মানুষকে অনেকরকম আফশোস দেয়। তার মধ্যে কিছু আফশোস থাকে, যা মেটানোর উপায় থাকে না আর। রাহুলমামার সঙ্গে তাঁর বাড়িতে শেষ দেখা মার্চ মাসে। তার কিছুদিন পরেই হাসপাতালে ভর্তি হলেন তিনি। মার্চের শেষে, সেই হাসপাতালে দেখতে গেছিলাম তাঁকে, সচেতন রাহুল পুরকায়স্থকে সেই শেষ দেখা আমার। তারপর এপ্রিলে বাড়ি ফিরলেন, শরীর দুর্বল, ঝিমভাব ফিরে-ফিরে আসছে প্রায়ই। তেমন পরিস্থিতিতে গিয়ে বিব্রত করতে চাইনি। ফোনে কথাও হল, শরীর সতেজ হয়ে উঠুক, তারপর যাওয়া যাবে। সেই যাওয়া হল একেবারে হাসপাতালে, জুলাই মাসে, যখন তিনি আচ্ছন্ন, জ্ঞানহীন। শেষ যে-দেখা, ওঁর চলে যাওয়ার দিন, মানুষটির জীবন টের পাওয়া যাচ্ছে শুধু যন্ত্রে ফুটে-ওঠা সংখ্যায়। দুপুর দুটোর আশেপাশে সেই সংখ্যাগুলোও শূন্য হয়ে গেল। নীল চাদরে ঢাকা শরীর, রাহুল পুরকায়স্থ, চলে গেলেন। ওই যে আফশোসের কথা বলছিলাম, শেষযাত্রা এমনকি শ্মশানেও ঘিরে রইল তা। একান্তই ব্যক্তিগত ভাবনা সেসব। যদি একবার বেলঘরিয়ায় আসতেন! যদি কাশীপুর নয়, আড়িয়াদহ শ্মশান হত তাঁর দেহকাঠামো বিলীন হওয়ার ঠিকানা!

সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার না-থাকলেও, ভাবার অধিকার আমায় দিয়েছিলেন রাহুল পুরকায়স্থই। সেই অধিকারবোধই তাঁকে আমার আত্মীয় করে তুলেছিল। ‘মামা’ শুধু পোশাকি ডাক নয়, সত্যিকারের অভিভাবক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এই সাহিত্যজগতে আমার একমাত্র অভিভাবক। যে-কোনও দ্বন্দ্বে, সমস্যায় যাঁর কাছে গেলেই মুশকিল আসান। অভিভাবক হারানোর বেদনা তাই আর-সবকিছুর চেয়ে বেশি। এখনও কানে বাজে বাড়িতে গেলেই তাঁর দেশজ উচ্চারণ— ‘বয়, বয়’, অর্থাৎ বোস। তারপর, চালাও পানসি বেলঘরিয়া!

স্মৃতির নদীতে পানসি বেয়ে, মাঝেমধ্যে জাল ফেলে উঠে এল এই লেখা। যতটুকু বলা গেল, না-বলা রইল তার চাইতে ঢের বেশি। সব কথা বলাও যায় না। তারপরও, এই তো, এখনও ভেসে আসছে তাঁর কণ্ঠস্বর। গতবছর নভেম্বরে, যখন ফোনে পাণ্ডুলিপির কবিতা শোনাচ্ছিলেন একের পর এক, রেকর্ড করে রেখেছিলাম। তিনি পড়ছেন— ‘ফুরায় না আর ফুরায় না এই/ নিজের সঙ্গে খেলা’। সেই পাঠ, উচ্চারণ আমার হয়ে থেকে গেল সারাজীবনের জন্য। যখন ইচ্ছে শুনতে পারি, পেতে পারি তাঁকে। এই খেলা সহজে ফুরোনোর নয়।


*লেখাটি ভাষালিপি পত্রিকায় গত সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এ প্রকাশিত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...