অভয়া আন্দোলন এবং ডাঃ পুণ্যব্রত গুণের সঙ্গে এক বছর

গোপা মুখোপাধ্যায়

 

এই লেখার শিরোনামের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই তমোনাশদা (ডাঃ তমোনাশ চৌধুরী)-কে। কয়েক মাস আগে শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েক বছর বইটা ওঁকে উপহার দিয়েছিলাম। তমোনাশদা দারুণ খুশি হয়ে বইটা উল্টেপাল্টে দেখেই বললেন আমরাও কয়েক বছর পর এইরকম লিখব— ‘পুণ্যব্রত গুণের সঙ্গে কয়েক বছর’। কয়েক বছর অপেক্ষা করতে পারলাম না, অভিজ্ঞতার ঝুলি এক বছরে কম ভরেনি…

 

২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে এক রবিবারের বিকেল। অ্যাকাডেমির কনফারেন্স হলে সদ্য-গঠিত অভয়া মঞ্চের মত-বিনিময় সভা। যৌথ লড়াইয়ের নতুন মঞ্চকে ঘিরে তুমুল উন্মাদনা। দ্রোহের কার্নিভাল-এর সাফল্য নিয়ে এসেছে নতুন উদ্যম। বিকেল চারটে থেকে প্রায় চার ঘণ্টা চলেছে জোরদার তর্ক-বিতর্ক, মতবিনিময়। মিটিং শেষ হলেও কথা শেষ হয় না।

ডাঃ গুণ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হলের বাইরে এসে একটা সিগারেট (না কি বিড়ি? মনে নেই) ধরিয়ে বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করেছেন। ছত্তিশগড় মুক্তিমোর্চার সংগ্রাম, শঙ্কর গুহ নিয়োগীর হত্যা, কানোরিয়ার আন্দোলন— সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ অনেকের কাছেই ছিল এক নতুন রূপকথার নির্মাণ; আর সেই স্বপ্নের আখ্যানের এক চরিত্র হিসেবেই পুণ্যব্রত গুণের নাম জানতাম। অভয়া আন্দোলনের সূত্রে ডাঃ গুণকে সামনে থেকে দেখা। তখনও আলাদা করে কোনও দিন কথা বলার সুযোগ হয়নি। দূর থেকে দেখলে বেশ রাশভারি মনে হয়; মিটিংয়ের মাঝে প্রায়শই নানা লোকজনকে ধমক-টমকও দেন। তাও সাহসে ভর করে কথা বলতে এগোলাম।

এক নামজাদা সমাজতাত্ত্বিক অভয়া আন্দোলনকে শাণিত ভাষায় তীব্র আক্রমণ করেছিলেন, তার জবাবে একটা নিবন্ধ লিখে পাঠিয়েছিলাম নামকরা এক বাজারি পত্রিকায়। স্বভাবতই সেটি ছাপা হয়নি। তাও মনে হচ্ছিল এর জবাবটা অন্তত কিছু লোকের কাছে পৌঁছানো দরকার। অপেক্ষায় ছিলাম— সামনের তিনজনের সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার পর পাশ থেকে বললাম, “ডাঃ গুণ, আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল।” খুব মন দিয়ে শুনলেন; শুনে বললেন, “লেখাটা আমাকে পাঠান, আমরা একটা ওয়েব ম্যাগাজিন চালাই— ডক্টরস ডায়লগ, সেখানে বের করব।”

এইভাবেই পুণ্যদার সঙ্গে আলাপের শুরু। একটা, দুটো, তিনটে— ডক্টরস ডায়লগে আমার লেখার সংখ্যা বাড়তে থাকল। কিছুদিন পর পর মেসেজ আসতে থাকল— “নতুন কিছু লিখলেন? একটা বড় লেখা দেবেন বলেছিলেন…”

ডক্টরস ডায়লগে প্রথম লেখা বেরোনোর পর ডাঃ অমিতাভ চক্রবর্তী ৮০-র দশকের চিকিৎসক আন্দোলনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে পরামর্শ দেন। এই বিষয়ে পড়াশোনা একেবারেই ছিল না। ওঁর কাছেই জানতে চাই। নিজের একটি লেখা পাঠিয়ে আমাকে বলেন, “পুণ্যদারও এই নিয়ে লেখা আছে।” মেসেজ করি ডাঃ গুণকে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে উত্তর আসে— “আমি মাথাভাঙ্গায়। পাঠানোর চেষ্টা করছি কিন্তু নেট কানেকশন ভালো নয়। কলকাতায় ফিরে পাঠিয়ে দেব।” এর ঠিক পনেরো মিনিট পর ৮০-র দশকের আন্দোলন নিয়ে দুটো পিডিএফ ফাইল পেয়ে যাই।

পুণ্যদার সিরিয়াসনেসের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। গত এক বছরে এই জানা ক্রমশ বেড়েছে— কখনওই পুরোটা মাপা যাবে বলে মনে হচ্ছে না; পরিচিত, স্বল্পপরিচিত, অপরিচিত— সকলের ক্ষেত্রেই সমান সিরিয়াস।

এর মধ্যেই ৩ ডিসেম্বর অভীক দে এবং বিরূপাক্ষ বিশ্বাসকে স্বাস্থ্য দপ্তরে ফিরিয়ে আনার প্রতিবাদে West Bengal Medical Council অভিযান। কোনও একটা অসুবিধার কারণে যেতে পারিনি। গ্রুপে খবর পেলাম, রাতভর অবস্থান চলবে। খোলা আকাশের নিচে ঘাসের উপর ত্রিপল বিছিয়ে শোওয়ার ব্যবস্থা। পুণ্যদা বেশ কিছু চিকিৎসক ও অ-চিকিৎসক সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ওখানেই শুয়ে পড়লেন।

বাড়িতে বসে অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছি। নরম বিছানায় ঘুম আসছে না। পরদিন দুপুরে কিছু শুকনো বিস্কিট, কেক ইত্যাদি সহযোগে অমিতদা (অধ্যাপক অমিত ভট্টাচার্য)-কে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলাম। পুণ্যদার হাতে একটা সুগার-ফ্রি বিস্কিটের প্যাকেট ধরাতেই হেসে বললেন— “খাবার চাইনি তো, লেখা চেয়েছি আপনার কাছে। বড় লেখাটা কবে দিচ্ছেন?” পাঁচ মিনিট পর আবার এলেন— “অমিতদাকে কীভাবে চেনেন? আপনি যাদবপুরের ছাত্রী? অমিতদারা সব আগুনঝরানো বিপ্লবী, জানেন তো? আমাদের সংশোধনবাদী বলে পাত্তা দেন না। নিউ হরাইজন বুক স্টোরে আলাপ হয়েছিল অনেক বছর আগে, ভুলেই গেছেন, কিন্তু আমার মনে আছে!” অমিতদা মহা অপ্রস্তুত— “কী যে বলেন, আপনাকে ভোলা যায় নাকি…”— ইত্যাদি ইত্যাদি!

সেদিন স্বাস্থ্য ভবনে ডেপুটেশনের পর অবস্থান উঠে গেল। ৬ তারিখ মেডিকেল কাউন্সিল থেকে স্বাস্থ্য ভবন মিছিল। অভয়ার মা-বাবা এসেছিলেন এই মিছিলের শুরুতে। সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, মিছিল শুরু করা যাচ্ছে না। পুণ্যদা একা হাতে সাংবাদিকদের সামলে ওর মা-বাবাকে বেরোনোর রাস্তা করে দিলেন, মিছিল শুরু করলেন।

মিছিলে আলাপ হল ব্যারাকপুরের মিতা চক্রবর্তীর সঙ্গে— প্রথম আলাপেই খুব সাদরে কাছে টেনে নিলেন মিতাদি। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছু কথা হল পুণ্যদার সঙ্গে— ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিকের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানা হয়ে গেল। এই মিছিলেই ডাঃ গুণ পাকাপাকিভাবে পুণ্যদা হয়ে গেলেন।

এর মধ্যে ১৩ ডিসেম্বর খুনের মামলায় জামিন হয়ে গেল সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিত মণ্ডলের। ১৪ তারিখ রাসমণি রোডে, ১৮ তারিখ ওয়াই চ্যানেলে বিক্ষোভ সমাবেশ— কুশপুত্তলিকা দহন, মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ— সবকিছুর ভিতর দিয়ে দানা বাঁধতে থাকল ডোরিনা ক্রসিংয়ে জুনিয়র ডাক্তারদের অনশন মঞ্চের জায়গাতেই লাগাতার অবস্থানের কর্মসূচি। পুলিশের অনুমতি পাওয়া গেলে ২০ ডিসেম্বর শুরু হতে পারে— এমনই শোনা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য নিয়ে একটি শিক্ষাশিবির পূর্বঘোষিত ছিল। বুঝতে পারছিলাম না সেটা আর হবে কি না। মেসেজ করে জানতে চাইলাম। এবারেও পাঁচ মিনিটের মধ্যে উত্তর— “অবশ্যই হবে। চলে আসুন।” মহাবোধি সোসাইটিতে একটি চমৎকার শিক্ষাশিবিরে অংশ নিলাম। সর্বজনীন স্বাস্থ্য— ইউনিভার্সাল হেলথ কেয়ার— এই ধারণা সম্পর্কে প্রথম জানলাম। সরকারি স্বাস্থ্যনীতি এবং জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে অসাধারণ আলোচনা করলেন ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ, ডাঃ সুজয় বালা, ডাঃ রাহুল মুখোপাধ্যায় এবং ডাঃ নির্মাল্য দাস। সর্বজনীন স্বাস্থ্যপরিষেবা ও গণস্বাস্থ্যনীতি বনাম স্বাস্থ্যবিমা, স্বাস্থ্যের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন বনাম স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণ— এই ছিল শিক্ষাশিবিরের মূল আলোচ্য বিষয়।

স্বাস্থ্য-শিক্ষাশিবির থেকে ধর্মতলায় ডোরিনা ক্রসিং। অবস্থানের প্রস্তুতি চলছে। শিক্ষাশিবির থেকে এসে প্রবল উদ্যমে অবস্থানের প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন পুণ্যদা। বাড়ি ফিরতে মন চাইছে না, তাও ফিরতে হবে— সামনে মেয়েদের বোর্ডের পরীক্ষা। বেরিয়ে আসার ঠিক আগে পুণ্যদা অনুরোধ করলেন— “আজকের স্বাস্থ্য-শিক্ষাশিবিরের রিপোর্টটা একটু লিখে দেবেন? কাল ডক্টরস ডায়লগে বার করব।” সেই প্রথম ইভেন্ট-রিপোর্ট লেখার ফরমায়েশ। মনের মধ্যে কোথাও একটা আনন্দ অনুভব করলাম— সেই প্রথম এই আন্দোলনে ‘ইনসাইডার’ হিসেবে স্বীকৃতি…

ডিসেম্বরের ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিংয়ে টানা ১২ দিনের অবস্থান অভয়া মঞ্চের আন্দোলনে এক বড় মাইলস্টোন। তিন মাস আগে অনশনমঞ্চে মানুষের যে ঢল নেমেছিল, সেই জনতা ক্রমে গৃহমুখী এবং কর্মক্ষেত্রমুখী হয়েছে সময়ের স্বাভাবিক নিয়মেই। এই ভাঁটার সময়ে শক্ত বোল্ডার হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অভয়া মঞ্চ— জলের টানে পিছু হটল না। ১২টা দিন, ১১টা রাত ধরে ডোরিনা ক্রসিংয়ে প্রতিবাদী জনসমাগম, বক্তৃতা, নাচ, গান, নাটক— ডিসেম্বরে শীতের রাতে টানা গান-স্লোগানে কর্মী-সংগঠকদের মনোবল বহুগুণ বেড়ে গেল। কলেজ করে সোজা চলে যাচ্ছি অবস্থানে; কোনওদিন বাড়ি ফিরছি, কোনওদিন ফিরছি না— থেকে যাচ্ছি। ভোররাতে উবের ধরে বাড়ি ফিরছি। ভুলব না সেই অবাঙালি উবের-চালককে, যিনি বলেছিলেন— “সবাই যখন ঘুমোচ্ছে, আপনারা জেগে রাত কাটাচ্ছেন, জাগিয়ে রাখছেন সকলকে। আপনারাই পারবেন এই অন্যায়ের বিচার আনতে।”

এই অবস্থান চলার সময়ে পুণ্যদার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় আরও বাড়ল। পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে পুণ্যদাই কিছুটা এগোলেন। অবস্থানের দ্বিতীয় দিন বিকেল— মঞ্চের পিছনের অস্থায়ী ঘরটায় ঢুকে কোণার দিকে একটা চেয়ারে একটু কুণ্ঠিত হয়েই বসেছিলাম; সকলের সঙ্গে তখনও তেমন আলাপ হয়নি। পুণ্যদা উলটোদিকের চৌকিতে সপারিষদ আড্ডা দিচ্ছিলেন। আমাকে হাত দিয়ে পাশে ডেকে নিলেন। খুব সহজেই ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এলেন। পুণ্যদার সামনেই বসে ছিলেন ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের ডাঃ দেবাশিস হালদার। আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন— “গোপাকে চেনো? ও আমাদের আন্দোলন নিয়ে ভালো লিখছে ডক্টরস ডায়ালগে।” দেবাশিসকে দেখিয়ে বললেন— “ওকে তো জানোই। WBJDF-এর নেতা— আমার দলের ছেলে।”

 

দরকারি বিষয় জেনে নিতে পুণ্যদা কালক্ষেপ করেন না। সেদিনই ফুরসৎ পেয়ে পড়াশোনা ও চাকরির সব ডিটেইলস জেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন— যাদবপুরে কোন ছাত্র সংগঠনে করতে? উত্তর শুনে বললেন— অমিতদার সঙ্গে তোমাকে আসতে দেখেই অনুমান করেছিলাম তুমি আমারই দলের! ক্রমশ বুঝেছি পুণ্যদার এই ‘দলীয়’ ধারণাটি ব্যষ্টিবাচক বা exclusive নয়— সমষ্টিবাচক বা inclusive। কত মানুষ যে পুণ্যদার দলে আছেন! প্রায়ই বিরোধী রাজনৈতিক মতের মানুষেরাও নিজেদের পুণ্যদার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোক বলে ভাবতে পছন্দ করেন। পুণ্যদাও সাদর আলিঙ্গনে সবাইকে কাছে টেনে নিয়ে মজা করে বলেন— একদিন ঘুম থেকে উঠে সবাই দেখবে আমার দলের লোক হয়ে গেছ!

‘সঙ্কীর্ণতা’ শব্দটা পুণ্যব্রত গুণের অভিধানে নেই।

অবস্থানমঞ্চেই জানলাম— আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাদবপুরের সহপাঠী, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায় গণস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণার সুবাদে বহুদিন ধরেই পুণ্যদার পরিচিত। ওর ছাত্র নটরাজ মালাকার পিএইচডি-র গবেষণার সময়ে পুণ্যদার সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করেছে। এই সময় থেকেই একটু একটু করে গণস্বাস্থ্যের আলোচনা শুরু হল।

অবস্থানমঞ্চে পুণ্যদা রাতে থাকতে পারতেন না। WBMC অভিযানে খোলা আকাশের নিচে ঘাসের উপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে মারাত্মক ঠান্ডা লেগেছিল। প্রতিদিন বিকেলের দিকে ক্লিনিক থেকে এসে থাকতেন রাত পর্যন্ত। বাড়ি ফিরে প্রতিদিন কাউকে না কাউকে ফোন করতেন— খাবার ঠিক সময়ে এল কি না, সবাই খেয়েছে কি না, কত জন রাতে থাকছে— ইত্যাদি।

২৬ ডিসেম্বর বিশেষ পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হল, সবাই থাকব রাতে। পুণ্যদা প্রস্তুত ছিলেন না। জিজ্ঞেস করলাম, “পারবেন? এখনও খুব কাশি হচ্ছে তো!” হাসলেন— “পারতেই হবে। যৌথ সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত।”

রাতে সবাই মিলে অবস্থানমঞ্চে। সেদিন স্লোগান হচ্ছিল না। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ প্রয়াত হয়েছেন। মঞ্চে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নীরবতা পালন করে সেদিন মঞ্চের আলো ও স্লোগান বন্ধ। মাইক ছাড়া গান-কবিতা হচ্ছে— ইলোরাদি, মিতাদি, শতাব্দী, মাঝে মাঝে ধরতাই দিচ্ছি আমি। দুটো প্লাস্টিক চেয়ারকে ড্রাম বানিয়ে বাজাতে বসেছে দেবাশিসদা।

পুণ্যদাকে একটু ঘুমোতেই হবে— পরের দিন সকালে নৈহাটিতে ক্লিনিক, ভোরে বেরোতে হবে। এই সব কলরবের মধ্যেই তিনি কিছুক্ষণ চোখ বুজে নিয়ে রাত দুটো নাগাদ উঠে পড়লেন। দুটো থেকে প্রায় ভোর চারটে পর্যন্ত চলল নানা বিষয়ে আলাপ— শঙ্কর গুহ নিয়োগী ও ছত্তিশগড় আন্দোলন, শহিদ হাসপাতাল, ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণ’। পাঁচটায় উবের ডেকে বাড়ি ফিরছি, মাথায় শুধু ঘুরছে শেষ দু-ঘণ্টার আলোচনা— “বিপ্লবের পরে নির্মাণ করলে তো চলবে না। নিয়োগী বলতেন, সংঘর্ষের পাশাপাশি ক্রমাগত নির্মাণ করে যেতে হবে— ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও, আবার বোধের জগতেও। এই simultaneous reconstruction না থাকলে নতুন সমাজ জন্ম নেবে না।”

গুহ নিয়োগীর ‘সংঘর্ষ-নির্মাণ’ তত্ত্ব অজানা ছিল না, কিন্তু কখনও গভীর পড়াশুনো বা আলোচনার সুযোগ হয়নি। সেদিনের আলোচনা নতুন করে ভাবার পথ খুলে দিল। মনে হচ্ছিল— সামাজিক সাম্য ও লিঙ্গসাম্য প্রতিষ্ঠার মধ্যে যে আপাত বিরোধের জায়গাগুলো আছে, সেইসব সমাধানের দিশা দেখাতে পারে এই নিরন্তর সংঘর্ষ ও নির্মাণের তত্ত্ব। পূর্ব-নির্ধারিত কোনও অভ্রান্ত লক্ষ্য না রেখে নির্মাণের পথটাও যদি সংঘর্ষের মধ্যে দিয়েই তৈরি হয়, তবে নতুন সমাজে সমানাধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠা সত্যিই অর্থবহ হবে।

সেদিনই বুঝলাম— পুণ্যদা খুব ভালো শিক্ষক। ভালো শিক্ষক পেলে জানার ইচ্ছা বেড়ে যায়। অভয়া আন্দোলনের সূচনা, প্রকৃতি, মঞ্চের গঠন— এর পাশাপাশি শহিদ হাসপাতাল, কানোরিয়া, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ— এই সব নানা বিষয়ে প্রশ্ন জমা হয়েই চলেছে। লিখলাম পুণ্যদাকে— “অনেক প্রশ্ন আছে। একদিন সময় দিতে পারবেন?” উত্তর এল একটু পরেই— “অবশ্যই, কথা তো বলতেই হবে। এক দিনে হবে না।”

প্রতীক্ষায় থাকলাম।

৩১ ডিসেম্বর দ্রোহের বর্ষবরণ দিয়ে শেষ হয়েছিল অবস্থান কর্মসূচি। তার পর কয়েক দিন কোনও কর্মসূচি ছিল না। পুণ্যদাকে মেসেজ করে কুশল জানতে চেয়েছিলাম। লিখেছিলেন— “অবস্থানে নিয়মিত যাওয়ার অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। এখন সেটা নেই। অনেক দিন কোনও কর্মসূচিও হচ্ছে না। কিছু না থাকলে মাথার মধ্যে চাপ অনুভব করি, কষ্ট হয়।”

বিস্মিত হয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম এই অন্যতর জীবনবোধ, এক অন্যতর জীবনযাপন।

 

উত্তাল সময়। তাই কর্মসূচিহীন দিনগুলি দ্রুত শেষ হল। ১৬ জানুয়ারি ভোররাতে WBJDF-এর আস্ফাকুল্লা নাইয়ার বাড়িতে পুলিশি জুলুমবাজি। ওই দিন সহযোগী সংগঠন ‘রাতদখল নারী-ট্রান্সকুইয়ার ঐক্যমঞ্চ’-এর ডাকে অভয়া মঞ্চের অনেকেই ধর্মতলা থেকে কলেজ স্কোয়ারের মিছিলে যোগ দিয়েছিলাম। পুণ্যদা ছিলেন না, উত্তরবঙ্গে ক্লিনিক করছেন। সেখান থেকে নির্দেশ দিলেন— যত জন পারবে কলেজ স্কোয়ার থেকে আরজিকর চলে গিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে যোগ দাও।

আরজিকর পৌঁছানোর ঠিক আগে পুণ্যদার ফোন— “পৌঁছালে? কতজন আসতে পারলে?”

১৭ জানুয়ারি বিধাননগর কমিশনারেট অভিযান। কলেজ থেকে বেরিয়েছি, পুণ্যদার উদ্বিগ্ন ফোন— “পৌঁছালে? বিক্ষোভে কতজন এসেছে? অভিজিৎ (দাস)‌কে ফোনে পেলাম না।”

বুঝতে পারছিলাম— এত কর্মসূচি চলছে এখানে, জলপাইগুড়ি আর মাথাভাঙায় বসে অস্থির হয়ে উঠেছেন। জমায়েত ভালো হচ্ছে, বহু প্রতিবাদী মানুষ আসছেন— শুনে নিশ্চিন্ত হলেন।

বিধাননগর কমিশনারেটের জমায়েতেই আলাপ হল ইন্দ্রাণীদির সঙ্গে— প্রয়াত পঙ্কজ দত্তের স্ত্রী ইন্দ্রাণী দত্ত। মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলেন। আমরা সাদরে গ্রহণ করলাম ওঁকে।

পরদিন শিয়ালদহ কোর্টে জমায়েত। ১৮ জানুয়ারি শনিবার এবং ২০ জানুয়ারি সোমবার— শিয়ালদহ কোর্টচত্বর এক উত্তাল সময়ের সাক্ষী হয়ে রইল। আরজিকর হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের মামলার রায়দান ছিল ১৮ জানুয়ারি। ঘটনার ১৬২ দিন এবং বিচার শুরুর ৬৮ দিন পর শিয়ালদহ অতিরিক্ত দায়রা বিচারকের আদালতে রায় ঘোষিত হয়— সঞ্জয় রাই-ই একমাত্র দোষী। ২০ জানুয়ারি সাজা ঘোষণা করলেন বিচারক অনির্বাণ দাস— যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫০,০০০ টাকার জরিমানা।

১৮ এবং ২০— দু-দিনই সব নিয়মের নিগড়কে অগ্রাহ্য করে দূর-দূরান্তের বহু সাধারণ মানুষ এসে যোগ দেন। প্রতিবাদী গান, কবিতা, স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে শিয়ালদহ এলাকা। ১৮ তারিখ রায় ঘোষণার দিন জুনিয়র চিকিৎসক আন্দোলনের নেতারা অভয়া মঞ্চের কর্মসূচিতে যোগ দেন। জুনিয়র চিকিৎসকরা WBJDF-এর পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ লিফলেট বিতরণ করেন, যেখানে তদন্তপ্রক্রিয়ার ২০টি গভীর অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়। বিভিন্ন বক্তব্যে মেদিনীপুর মেডিকেল কলেজে জাল স্যালাইনে প্রসূতিমৃত্যু আর দুর্নীতি ঢাকতে চিকিৎসকদের অন্যায় সাসপেনশন এবং আস্ফাকুল্লা নাইয়ার বাড়ি পুলিশি অভিযানের প্রসঙ্গও উঠে আসে।

এই দু-দিনের শেষ কর্মসূচি ছিল শিয়ালদহ থেকে মৌলালি পর্যন্ত মিছিল এবং মানববন্ধন। ২০ তারিখ মৌলালিতে কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।

১৮ তারিখ পুণ্যদা ছিলেন না কলকাতায়। তখনও তিনি উত্তরবঙ্গ থেকে ফেরেননি। মেসেজে জানালেন, ফোনে লাইভ দেখছেন ক্লিনিকের ফাঁকে ফাঁকে। ১৮ তারিখ রাতে একটা মেসেজ পেলাম— “আমি আর তমোনাশ থাকতে পারিনি, মনীষার সঙ্গে তোমরা কয়েকজন এই ক-দিন সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছ। তোমাদের স্যালুট জানাই।”

সেই রাতে উত্তেজনায় ঘুম আসেনি। যাদবপুর ছাড়ার পর তেমনভাবে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না— নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। ভিতরে ভিতরে কোথাও একটা যন্ত্রণা হত, চারপাশের পরিবেশ আরও বিমুখ করে দিয়েছিল। অভয়া-হত্যা আর পরবর্তী গণজাগরণের অভিঘাতে অনেকের মতো আমিও রাস্তায় নেমেছিলাম। অদলীয় প্রতিবাদী মঞ্চ হিসেবে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম অভয়া মঞ্চকে। কিন্তু আগে বুঝিনি যে এই আন্দোলন আমার অস্তিত্বের অংশ হয়ে উঠবে। সেই দিনই ভেঙে গিয়েছিল চারপাশের সব দেওয়াল। জীবনের অর্ধশতাব্দী পরে অনুভব করলাম— কুসুমাকীর্ণ পথ আমার জন্য নয়। শুধু অভয়ার বিচারই আমার একমাত্র লক্ষ্য নয়; মেঠো রাস্তায়, অসংখ্য মানুষের শ্রমে আর ঘামে খুঁজতে হবে জীবনের মানে।

কাকে কোন কথাটা বলে রাতের ঘুম কেড়ে পথের স্বপ্ন দেখাতে হবে— এটা পুণ্যদার চেয়ে ভালো আর ক-জন জানেন! তাই আজও মেডিকেল কলেজের নবীন চিকিৎসকরা নিয়মিত যাতায়াত করেন চেঙ্গাইলে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তিরিশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে নিঃশব্দে গড়ে উঠছে গণস্বাস্থ্য আন্দোলন।

দিনে দিনে অভয়া মঞ্চের সঙ্গে সম্পর্ক যত নিবিড় হয়েছে, সক্রিয়তা যেমন বেড়েছে, সমানুপাতিক হারে পুণ্যদার সঙ্গে যোগাযোগও আরও নিয়মিত হয়েছে। সোদপুর স্টেশনের পাশে এক প্রতিবাদসভায় গেছি। পুণ্যদা চেঙ্গাইলের ক্লিনিক সেরে পৌঁছালেন প্রায় সাড়ে আটটায়। পায়েল চাইছে পুণ্যদা যেন শেষ পর্যন্ত থাকেন, তাই কিছুতেই তাঁকে বক্তৃতা দিতে ডাকছেন না। আমরা যতই বলি— আমাদের অনেক দূর ফিরতে হবে, পুণ্যদাও অনেক সকালে বেরিয়েছেন, কালও ভোরেই বেরোবেন, সুতরাং ফেরার প্রয়োজন তাঁরই সবচেয়ে বেশি— পায়েল অবিচল। নির্বিকার পুণ্যদাও। ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম-সংলগ্ন রাস্তায় ভিড় উপচে পড়ছে; পথচলতি মানুষ কাজ ভুলে বক্তৃতা শুনছেন, গান শুনছেন। এই পরিবেশে পুণ্যদার অ্যাড্রিনালিন রাশ হয়; সব ক্লান্তি ভুলে বসে রইলেন রাত দশটা পর্যন্ত। শেষ বক্তা ছিলেন পুণ্যদা। বক্তৃতা শেষে আমরা ফিরছি, সঙ্গে পুণ্যদা। হঠাৎ দেখলাম— এক অতি উৎসাহী বক্তা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মাইক নিয়ে অভয়ার নির্যাতনের কথা বলতে বলতে প্রবল অশ্রুবিসর্জন শুরু করলেন। সামনের সারিতে অভয়ার মা-বাবা। সংগঠক এবং আমরা সবাই হতবিহ্বল। পুণ্যদা ফিরে এলেন। বক্তার কাছ থেকে মাইকটা নিয়ে নিলেন। ঘোষণা করলেন— “আমরা কেউ কাঁদছি না, কারণ আমাদের চোখে আর এখন জল নেই— আগুন আছে।”

আজও প্রতিমুহূর্তে অনুভব করি সেই আগুনের উত্তাপ। এই আগুনটাই আমাদের থামতে দেবে না— তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে প্রতিদিন।

প্রতিবাদী চার চিকিৎসকের আইনি চিঠির বিরুদ্ধে ২৯ জানুয়ারি West Bengal Medical Council অভিযানের প্রস্তুতি-সংক্রান্ত মিটিং। মিটিং শেষে পুণ্যদা এসে বললেন, WBMC-র কর্মসূচি শেষ হলে আমার বাড়িতে এসো, কথা বলব। এর কিছুদিন আগে ফোন পেয়েছিলাম— “২১ ফেব্রুয়ারি আমরা বার্ষিক বক্তৃতামালা আয়োজন করি। এবার তুমি একজন বক্তা। অভয়া আন্দোলন নিয়ে বলবে। তোমার বন্ধু সব্যসাচী স্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে বলবে।”

এই বক্তৃতার জন্যও কথা বলা খুব জরুরি ছিল। WBMC-র কর্মসূচি-শেষে পুণ্যদা আলাপ করিয়ে দিলেন বাগিদির (লিলি দে সরকার) সঙ্গে। পুণ্যদা আর বাগিদির সঙ্গেই গেলাম সল্টলেকে ওঁদের বাড়ি। সেই প্রথম যাওয়া। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি যে এখানে আমি এর আগে কখনও আসিনি।

সন্ধে ছটা থেকে শুরু হল আলোচনা— অভয়া আন্দোলন, ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ। সাড়ে নটায় থামতেই হল— বাড়ি ফিরতে হবে। বুঝলাম, এই আলোচনা শেষ হওয়ার নয়; চলতেই থাকবে।

ফিরে এলাম এক অমূল্য উপহার নিয়ে— পুণ্যদার লেখা পা মিলিয়ে পথ চলা— গণস্বাস্থ্যের এক নিরলস কর্মী-সংগঠকের অসাধারণ প্রতিবেদন।

বইমেলায় অভয়া মঞ্চ প্রকাশ করল প্রতিবাদী কবিতার সঙ্কলন দ্রোহের দিনলিপি। বই প্রকাশের পর স্লোগান দিয়ে মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন পুণ্যদা। তমোনাশদার পরিকল্পনায় বইমেলায় ‘অভয়াহত্যা নিয়ে জনতার বিচার’ও বেশ সফলভাবে চলল। দ্রোহের দিনলিপি প্রকাশের দিনই কোর্ট থেকে মেডিকেল কাউন্সিলের অবৈধ রেজিস্ট্রারকে অপসারণের নির্দেশ। কিছুদিন আগেই অভয়া মঞ্চের প্রতিবাদী জমায়েতের সাফল্য। সবাই দারুণ খুশি।

এরই মধ্যে হঠাৎ এক অসাধারণ দৃশ্যের জন্ম হল। সন্ধে নাগাদ মণীষাদির (মণীষা আদক) প্রবেশ বইমেলায়— আর তিরবেগে ছুটে এসে পুণ্যদাকে প্রবল আলিঙ্গন। এই জয়োল্লাসে সবাই চমকিত ও পুলকিত। তিরিশ বছরের পরিচিত বন্ধুর এমন ভালোবাসার “আক্রমণে” পুণ্যদাকে বেশ অভ্যস্তই মনে হল। হেসে বললেন, “মণীষা যখন এগুলো আগে করত, আমি খুব embarrassed feel করতাম। এখন আর অসুবিধা হয় না!” অনুভূতির স্বাভাবিক অনাড়ষ্ট প্রকাশ আমাদের সমাজে মেয়েদের মধ্যে যেমন খুব বেশি দেখা যায় না, আবার পুণ্যদার প্রজন্মের বাম নেতাদের মধ্যেও সচরাচর দেখা যেত না। এই স্বাভাবিকতাই পুণ্যদা, মণীষাদির মতো মানুষদের ভিড়ের থেকে আলাদা করে দেয়। মণীষাদির ব্যক্তিত্বটা খুব আকর্ষণীয়। একেবারেই উচ্চকিত নয়, মিছিলের সামনে থাকেন না, বক্তৃতা দিতে চান না, কিন্তু নীরবে নারী-নির্যাতনবিরোধী এক ধরনের ‘rapid response force’ তৈরি করে চলেছেন।

প্রণতি প্রকাশনীর স্টলে হাতে পেলাম রুমঝম ভট্টাচার্যের লেখা দীপ জ্বেলে যাও— পুণ্যদার জীবন অবলম্বন করে লেখা উপন্যাস। তার সঙ্গে আশিস কুণ্ডুর দল্লী রাজহরা ডাখয়েরি আর ডাঃ পুণ্যব্রত গুণের লেখা শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েক বছর। পরবর্তী একটা সপ্তাহ কাটল যেন ঘোরের মধ্যে। এক দিনে শেষ করলাম দীপ জ্বেলে যাও। তারপর পড়লাম শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েক বছর। আততায়ীর গুলিতে নিহত নেতার দেহ দু-হাতে নামানো, মরদেহ নিয়ে নিয়োগীজির পরিবারের সঙ্গে ভিলাই যাত্রা— এক অচেনা পুণ্যদা— আমার নেতা, আমার রাজনৈতিক শিক্ষক! বুকের মধ্যে এক অসহায় যন্ত্রণা অনুভব করি— ভারতবর্ষে বিপ্লবের এক তাজা স্বপ্ন শেষ করে দিল খনিমালিকদের ভাড়াটে গুণ্ডাদের দেশি পিস্তলের গুলি।

স্বপ্নদ্রষ্টা আমার নেতা যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কোনও স্বপ্ন দেখছেন, মুখে হালকা একটা হাসি! যেন ‘নিয়োগীজী’ বলে ডাকলেই চোখ খুলে বলবেন ‘কেয়া খবর ডাক্তারসাব’!… নিয়োগীর মৃত্যুতে আমি দুঃখ পাইনি, কেননা যে জীবনে যে মৃত্যু তিনি চেয়েছিলেন তা পেয়েছেন— শ্রেণীসংগ্রামে শহীদ হয়েছেন।”

—পুণ্যব্রত গুণ, শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েক বছর

শঙ্কর গুহ নিয়োগী ও ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার অন্যান্য কমরেডের সঙ্গে পুণ্যব্রত গুণ। ডাঃ গুণের ফেসবুক ওয়াল থেকে

 

যাদবপুর ৮বি-তে We the People-এর জনসভা। পুণ্যদাকে বললাম দীপ জ্বেলে যাও আর শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েক বছর শেষ করেছি। বললেন, তোমার বড় মেয়েকে পড়িও, যে ডাক্তার হতে চায়। ভুতুম Kalinga Institute of Medical Science-এ ভর্তি হওয়ার পর প্রথম মেসেজ করেছিলাম পুণ্যদাকে। উত্তর পেলাম— “অভিনন্দন জানিও। আশা করি আমাদের ব্যাটন বহন করবে।”

ভুবনেশ্বর চলে যাওয়ার আগে ভুতুমকে নিয়ে চেঙ্গাইল গেলাম। এই অভিজ্ঞতাগুলো জীবনে আমূল বদল আনার ক্ষমতা রাখে— আমার কাছে একরকমভাবে, ভুতুমের কাছে আর একরকমভাবে। ভুতুম ওর মতো করে দেখেছে, ওর মতো করে লিখেছে। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে নিয়মিত হেলথ চেক-আপ, রুটিন টেস্ট এবং প্রয়োজন হলে ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরলের ওষুধ খাওয়ার সচেতনতা তৈরি করে অনেক বড় অসুখ প্রতিরোধ করা যায়। ন্যূনতম মূল্যে উচ্চমানের চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে মডেল ক্লিনিকগুলি নতুন সমাজের স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিশা দেখাচ্ছে।

আমি তখন ভাবছিলাম অন্য কথা। ৩৫ বছর বয়সে নেতা হারিয়ে, সংগঠন হারিয়ে কলকাতায় ফিরেছিলেন তিনি। কী অসম্ভব মনোবল আর প্রত্যয় নিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন এই শ্রমজীবী স্বাস্থ্য-উদ্যোগ। ৮বি-র জনসভায় এবং পরে বহু জায়গায় বলেছেন— একদিকে শ্রমজীবী মানুষ, অন্যদিকে নিজের নতুন সংসার গড়ে তোলার গল্প। বাগিদির স্কুলের চাকরি আর বাবা অধ্যাপক অতীন্দ্রমোহন গুণের নীরব সমর্থন এবং অকুণ্ঠ সহায়তা ছাড়া এই লড়াই সম্ভব হত না।

কলকাতায় ফেরার বছর দুয়েক পরে অর্কর জন্ম। বাগিদির মাসের মাইনে থেকে জমানো টাকায় নার্সিংহোমের খরচ মেটানো। কৃতী চিকিৎসক-পুত্রের মা এবার খুব স্বাভাবিকভাবেই চান— ছেলে সংসারী হোক, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে পারিবারিক উপার্জন বাড়াক, সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করুক। কিন্তু সে তো হওয়ার নয়। উনিশ বছর বয়স থেকে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে শুরু করেছে যে ছেলে, তাকে কি এত সহজে চেনা ছকের গতে বাঁধা জীবনে ফেরানো যায়!

নতুন সমাজ গড়ার নিরলস লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি— অস্ত্র দিয়ে নয়, স্ক্যালপেল আর স্টেথো নিয়ে। স্বপ্নের সমাজের স্বাস্থ্যের ভিত্তি নির্মাণ করে চলেছেন চেঙ্গাইল, বাউরিয়া, নৈহাটি, সুন্দরবন, জলপাইগুড়ি, মাথাভাঙ্গা আর উত্তরবঙ্গের চা-বাগানের মডেল ক্লিনিকগুলিতে।

পুণ্যদা লিখেছেন, “নিয়োগীজীর সঙ্গে বেরোনোর সুযোগ আমি হারাতে চাইতাম না, কেননা সেটা হত এক প্রাণবন্ত ক্লাস।” (পুণ্যব্রত গুণ, শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েক বছর)। পুণ্যদার সঙ্গে যখন সময় কাটানোর সুযোগ হয়, আমারও ঠিক এমনটাই মনে হয়।

১৯৯২-এর ১ জুলাই ভিলাই রেল অবরোধে পুলিশের গুলিতে ১৫ জন শ্রমিকের আত্মবলিদান, দাল্লি রাজহরা থেকে একা গাড়ি নিয়ে ভিলাই থানায় গিয়ে পুলিশের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক, সাথীদের মরদেহ নিয়ে ফেরা— ২০২৫ বইমেলা চলার সময়ে পুলিশের অতিসক্রিয়তায় না হওয়া ভাঙ্গড় ভূমি উচ্ছেদ কমিটির ডাকা এক মিছিল থেকে ফেরার পথে রুদ্ধশ্বাসে শুনেছিলাম এই কাহিনি। মাঝে মাঝে মনে হয়, একজন মানুষ কী করে এত কর্মকাণ্ডের শরিক হতে পারেন! শহিদ হাসপাতালে নিরলস কাজ, নিয়োগীর মৃত্যুর পর জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা, সংগঠনের ভেতরে শ্রেণিস্বার্থের লড়াইয়ের জেরে বাংলায় ফিরে কানোরিয়া আন্দোলনে যোগদান, শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়নের সঙ্গে বিচ্ছেদ, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ গড়ে তোলা এবং তিরিশ বছর ধরে বিরামহীন গণস্বাস্থ্যের হোলটাইমার হিসেবে কাজ করে যাওয়া, স্বাস্থ্যশিক্ষা নির্মাণ ট্রাস্ট ও তার নির্দিষ্ট কর্মসূচির তত্ত্বাবধান, ‘Doctors’ Dialogue’ ওয়েবজিন এবং ‘স্বাস্থ্যের বৃত্ত’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদকের দায়িত্ব, ২০১৭ থেকে চিকিৎসক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে Joint Platform of Doctors-এর জয়েন্ট কনভেনর হওয়া, ২০২৪-এর আগস্ট থেকে অভয়া আন্দোলনে অংশগ্রহণ, ২৮ অক্টোবর থেকে অভয়া মঞ্চের কনভেনরের দায়িত্ব গ্রহণ— এই এতগুলি কাজের প্রতিটির ধরন ও পদ্ধতি অন্যটির চেয়ে আলাদা। পুণ্যদাকে কোনওদিন একটার সঙ্গে আরেকটাকে ওভারল্যাপ করতে দেখিনি।

এই সময় আর একবার মেডিকেল কাউন্সিল অভিযান হয়, অবৈধ রেজিস্ট্রার মানস চক্রবর্তীকে অপসারণের দাবিতে। শোনা যাচ্ছিল অভীক, বিরূপাক্ষ-ও নাকি গোপনে এসেছে। হঠাৎ ঠিক হওয়া JPD-র কর্মসূচি, অন্য নেতারা কেউ আসতে পারেননি। পুণ্যদা চেঙ্গাইলের ক্লিনিক থেকে এলেন। মাইকে স্লোগান নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কি চলছে। পুণ্যদা বললেন, প্রতিবাদ তো গুনগুন করে হয় না, জোরের সঙ্গেই হয়। যতক্ষণ অবৈধ পদাধিকারীরা ভেতরে থাকবে, স্লোগান চলবে। তাতেও মানানো যাচ্ছে না। তখন অকুতোভয়ে বললেন, তাহলে আমাদের গ্রেপ্তার করুন, কিন্তু স্লোগান চলবে।

স্লোগান চলল। একে একে নাটের গুরুরা বেরোতে শুরু করলেন। মাথা নিচু করে দৌড়ে গাড়িতে উঠে পলায়ন। এই ধরনের দাগী অপরাধীদের মান-সম্ভ্রম কমই থাকে। সবাই পালানোর পরেও প্রতিবাদী স্লোগান থামছে না, সবাই দারুণ উত্তেজিত।

পুণ্যদা একটু কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, আমি এবার বেরোই, আমার ছেলে আজ ইংল্যান্ডে ফিরে যাবে। শুনে বিস্মিত লাগে— ছেলে অনেক দিনের জন্য চলে যাবে বহুদূরে, আর তিনি অবিচলভাবে পুলিশকে বললেন “গ্রেপ্তার করুন”!

১৯৯৯-এর ওড়িশা সাইক্লোনে রিলিফ ওয়ার্কের গল্প প্রথম শুনেছিলাম ফোনে। দু-বছরের অসুস্থ ছেলে বাড়িতে— বাড়াবাড়ি কিছু হলে বড় নার্সিংহোমে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই। তাই পুণ্যদার রিলিফ টিমে যাওয়ায় সায় দিতে পারছেন না বাগিদি, ভয় পাচ্ছেন। এই সময় আনন্দবাজার-এ একটি ছবি বেরোল— দু-তিন বছরের একটি শিশু রাস্তা থেকে রিলিফের চাল খুঁটে খাচ্ছে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ছবিটা মেলে ধরলেন বাগিদির সামনে। এরপর আর ওড়িশা অভিযানে সবুজ সঙ্কেত পেতে পুণ্যদার অসুবিধা হয়নি।

এর পরের গল্পটাও আমার কাছে রিলিফ ওয়ার্কের মতোই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। রিলিফের কাজ সেরে ফিরছেন। অর্ককে কোনওভাবেই ORS খাওয়ানো যাচ্ছে না। ছোট্ট অর্ক ঠোঁট চেপে ধরে ব্যর্থ করে দিচ্ছে প্রাথমিক চিকিৎসার সব প্রচেষ্টা, ক্রমশই নির্জীব হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ফ্লুইড চালানো ছাড়া উপায় নেই। পুণ্যদা বাড়ি ফিরে ঘুমন্ত অর্কর মাথার কাছে গিয়ে একবার জোরে ডাকলেন— “অর্ক!” নিমেষে চোখ খুলে গেল। বাবা’কে দেখে মুখে খুশির ছোঁয়া। সেই সুযোগে ORS-এর গেলাস মুখের সামনে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “খেয়ে নে বাবা।” অর্ক চুপটি করে লক্ষ্মীছেলের মতো বাবার কোলে বসে ORS-এর গ্লাস শেষ করে ফেলল। কোথাও ভর্তি করার প্রয়োজন হল না।

বাড়ি থাকলে এখনও— বাবা বাড়ি ফিরে বা বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে না ডাকলে— আঠাশ পেরোনো অর্কর খুব অভিমান হয়।

২০২৫-এর ১ মার্চ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তোলপাড়। এবারের শো-স্টপার স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী। কোন এক দুর্জ্ঞেয়, দুর্দম প্রণোদনায় মন্ত্রী চালককে হুকুম করেন সবেগে গাড়ি চালিয়ে ডেপুটেশন দিতে আসা ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে। বিক্ষোভরত ইংরেজি স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র ইন্দ্রানুজ রায় লুটিয়ে পড়ে গাড়ির চাকার তলায়। ছাত্রের পায়ের উপর দিয়ে চলে যায় শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি। ছাত্রের শরীরের উপর দিয়ে মন্ত্রীর দম্ভের রথচালনা— বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে এমন কখনও ঘটেছে বলে জানা নেই।

বিক্ষোভের বারুদে অগ্নি-সংযোগ করে এই ঘটনা। স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্রবিক্ষোভে কিছুক্ষণের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে যায় যাদবপুর এলাকা, থানা ঘেরাও শুরু হয়। ২ মার্চ থেকে যাদবপুরের বিক্ষোভ ক্রমে বিস্ফোরণের চেহারা নেয়। অভয়ার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা প্রতিবাদী অভয়া মঞ্চ আরও বহু প্রতিবাদী মানুষ এবং সংগঠনের সঙ্গে যাদবপুরের ছাত্র আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ায়। মার্চ মাসের প্রতিটি দিনই কোনও না কোনও প্রতিবাদ কর্মসূচি। ক্যাম্পাসের বাইরে যাদবপুর থেকে গোলপার্ক অবধি দুটো বড় মিছিল হয়। ৩ তারিখ বিকেলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র ইউনিয়ন ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে বড় মিছিল। ২৫ মার্চ ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের মিছিল হয়, যাতে যোগ দেন সবাই, এমনকি ভিন্ন রাজনীতির মানুষেরাও। অভয়া মঞ্চের বহু মানুষই এই মিছিগুলোতে অংশ নেন।

অভয়া আন্দোলনের বাইরে এই দুটি মিছিলেই পুণ্যদার সঙ্গে অনেকটা পথ হাঁটা। দুদিনই চেঙ্গাইলে ক্লিনিক শেষ করে এসে মিছিলে পা মেলান। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে জানলাম দুটি বইয়ের কথা— মাও সে-তুং-এর দেহরক্ষী চেন চাং ফেং-এর On the Long March with Chairman Mao আর চৌ এন লাই-এর দেহরক্ষী ওয়েই কুও লু-র On the Long March as Guard to Chou En Lai। বললেন, এই বই দুটোর থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ‘শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েক বছর’ নামটা ঠিক করেছিলেন। কিছুক্ষণ পর বললেন—

আমার খুব ইচ্ছা ছিল নিয়োগীজির ব্যক্তিগত সচিব অথবা ড্রাইভারের কাজ করা। যদি সেই সুযোগ পেতাম তাহলে ওঁকে আরও কাছ থেকে দেখতে পারতাম, বইটাও আরও ভালোভাবে লিখতে পারতাম। কিন্তু কিছুতেই রাজি হলেন না। হাসপাতালে আপনার অনেক কাজ, সেই কাজটাই ভালো করে করুন— মানুষের উপকার হবে। ব্যস, হয়ে গেল…

২৬ মার্চ, জনচেতনা মঞ্চের মিছিল ধর্মতলা থেকে কলেজ স্কয়ার। অভয়ার বিচারের দাবিতে। জনচেতনা মঞ্চের আহ্বায়ক সন্দীপ রায়ের সঙ্গে ওয়ার্কিং টিমের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কিঞ্চিৎ ঠান্ডা যুদ্ধ হওয়ার পরে স্টুডেন্টস হেলথ হোমে দেখা। আলাপ হয়নি, বক্তৃতা শুনলাম। পুণ্যদার কাছে আগেই শুনেছিলাম— পঞ্চায়েত যৌথ কর্মচারী সমিতির সম্পাদক সন্দীপ রায়। বক্তৃতা শুনে ভালো লাগল। বুঝলাম শুধু নেতাগিরি করেন না বা অকারণে হোয়াটসঅ্যাপ-যুদ্ধ করেন না— পথে নেমে কাজ করেন। প্রশাসনিক মহলে বহু বাধা সত্ত্বেও অভয়ার বিচার এবং নারীসুরক্ষার দাবি সামনে রেখে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন গড়ে তুলছেন। সবাইকে মিছিলে আসতে আহ্বান করলেন।

একই দিনে করুণাময়ীতে একটি কর্মসূচি— সঠিক ও ভেজাল ওষুধ নিয়ে। আমার সেখানেই যাওয়ার ইচ্ছা আগে। পুণ্যদা বললেন, আমি আগে করুণাময়ীতে যাব— ওষুধ নিয়ে বলতে হবে, তারপর কলেজ স্কোয়ারে চলে যাব। সল্টলেকে যারা থাকে তারা করুণাময়ীর কর্মসূচি সেরে কলেজ স্ট্রিট যাবে। অভয়া মঞ্চের বাকিরা সবাই জনচেতনার মিছিলে হাঁটবেন ধর্মতলা থেকে। নির্দেশমতো মণীষাদি আর অভিজিৎদার নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যায় অভয়া মঞ্চের সদস্যরা যোগ দিলাম মিছিলে। মিছিল শেষে পথসভা। পথসভাও যখন শেষ পর্যায়ে, পুণ্যদার ফোন এল— “রাস্তা জ্যাম ছিল তাই দেরি হল, আমহার্স্ট স্ট্রিট ক্রসিং-এ এসে গেছি।” সন্দীপদার সঙ্গে তখনও আলাপ নেই, তাও দূতের কর্তব্য পালন করলাম। পুণ্যদার জন্য সভা শেষ না হয়ে চলতে থাকল।

এই মিছিল আর পথসভার সূত্রেই সন্দীপদার সঙ্গে আলাপ বাড়ল; জেলা সংগঠনগুলির কথা এবং সেখানে ৯ আগস্টের সম্ভাব্য পরিকল্পনার কথা জানলাম, পুণ্যদাকে জানালাম। বললেন— সন্দীপকে বোলো আমাকে ফোন করতে।

তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো মাস। সন্দীপ রায় জেলার পাশাপাশি অভয়া মঞ্চের কেন্দ্রীয় কর্মসূচিগুলিরও অন্যতম উদ্যোক্তা এবং পুণ্যদার অন্যতম ভরসার মানুষ হয়ে উঠেছেন। দেখলাম— সন্দীপদার এত বছরের সংসদীয় বাম রাজনীতির প্রতি আনুগত্য, ছাত্র ফেডারেশনে দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা, একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ— কোনওটাই পুণ্যদার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাঁড়াল না। পুণ্যদা বামপন্থী হলেও সংসদীয় বাম শিবিরের লোক নন— এই তথ্য জানা সত্ত্বেও কোথাও শ্রদ্ধার ঘাটতি হল না, সিঙ্গুর–নন্দীগ্রাম প্রসঙ্গ তুলে এক দিনের জন্যেও কোনও অশ্রদ্ধা, অবিশ্বাস বা সন্দেহ দেখলাম না। পুণ্যদার দ্বার সবসময়েই অবারিত— নিজের ছোট গণ্ডি থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর মুক্তির স্বপ্ন দেখা সব মানুষই পুণ্যদার পরমাত্মীয়।

লক্ষ্যের প্রতি নিষ্ঠ হলে এমনই হয়। পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর বিশ্বাস অটুট রেখে ভিন্ন মতের মানুষরাও একসঙ্গে পথ চলতে পারেন— যদি সেই পথচলা কোনও বৃহৎ লক্ষ্যের অভিমুখে পরিচালিত হয়।

পুণ্যদা প্রতিমাসে উত্তরবঙ্গে যান— জলপাইগুড়ি, মাথাভাঙ্গা আর কার্শিয়ং-এর মার্গারেট’স হোপ নামে এক বন্ধ চা-বাগানের ক্লিনিকে। শ্রমজীবী মানুষের চিকিৎসক তিনি; শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা— বারো মাসই ৬৫ বছর বয়সেও নন-এসি কোচে যাতায়াত করেন। সন্দীপদা একদিন বললেন, একটু বোঝাতে পারো তো পুণ্যদাকে— এই বয়সে এতটা ধকল ঠিক হচ্ছে না। জানালাম পুণ্যদাকে। তিনি খুব মজা পেয়ে বললেন, সন্দীপকে বোলো, ওর পার্টি যদি এসির টিকিট কেটে দেয়, তাহলে ওই পার্টিতেই জয়েন করব। সন্দীপদার চটজলদি উত্তর— পার্টির দরকার হবে না, পুণ্যদা চাইলে ওঁর জন্য সন্দীপ নিজেই ব্যবস্থা করে দিতে পারবে!

এই হালকা মজাগুলো চলতেই থাকে, বাড়তে থাকে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, বোঝাপড়া— অভয়া মঞ্চ না গড়ে উঠলে আদানপ্রদানের এই সুযোগগুলো কোনওদিনই তৈরি হত না। ভিন্নমতাবলম্বী মানুষদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং লক্ষ্যে অবিচলতাই অভয়া মঞ্চের শক্তি।

মার্চ মাসের মাঝামাঝি কোনও একদিন— তারিখ মনে নেই। পুণ্যদার কাছ থেকে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগে যোগ দেওয়ার আহ্বান পেলাম। সঙ্গে শ্রমজীবীর লিখিত আদর্শ ও নীতি— মেহনতি মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার আন্দোলনে যুক্ত থাকার অঙ্গীকার, মেহনতি মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষার আন্দোলনে যুক্ত অন্য চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতিশ্রুতি। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ মনে করে অপেক্ষাকৃত কম খরচে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিসঙ্গত আধুনিক চিকিৎসা জনতার কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। যত রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচিই নেওয়া হোক, জনতার স্বাস্থ্যের অবস্থার সামান্যতম পরিবর্তনও হতে পারে না, যদি না স্বাস্থ্য কর্মসূচি খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-সংস্কৃতির আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকে। জনসাধারণকে অসুখের আর্থসামাজিক কারণ সম্বন্ধে জানিয়ে চিকিৎসা বিষয়টাকে ধোঁয়াশামুক্ত করা এবং জনসাধারণের হাতে চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধের সহজ প্রযুক্তিগুলো তুলে দেওয়াকে দায়িত্ব বলে মনে করে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ। দেশি–বিদেশি, সরকারি–বেসরকারি ফান্ডিং এজেন্সির অর্থের ওপর নির্ভরতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ জনতার উদ্যোগে তাঁদের সামর্থ্যের ওপর দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা স্বনির্ভর কর্মসূচির পক্ষপাতী। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী ও রোগীদের মধ্যে এমন সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে, যেমনটা হবে শোষণহীন নতুন সমাজে। এর সঙ্গে লেখা ছিল— “যদি সহমত হও তবেই সদস্যপদ নিও, যদি সদস্যপদ নিতে না চাও, তাহলেও সম্পর্ক থাকবে।” বুকের ভিতর দারুণ ঝড়…

শঙ্কর গুহ নিয়োগীর স্বপ্ন আর আদর্শ নিয়ে গড়ে তোলা ‘শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ’ থেকে সদস্যপদ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন ‘শহিদ হাসপাতাল’-এর চিকিৎসক, ‘ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা’র অন্যতম সংগঠক ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ। দেওয়াল ভেঙে গিয়েছিল কবেই, এবার উজানস্রোতে ভাসার পালা। মাথার মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘুরতে থাকে পুণ্যদার সেই দিনের কথা— “দায়িত্বটা মাথায় রেখো। পথের আন্দোলনের মধ্যে সক্রিয়ভাবে থেকে আন্দোলনকে দেখা, আন্দোলনের ইতিহাস লেখা— এই সুযোগ সবার থাকে না। চলমান অভয়া আন্দোলন আর গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের ইতিহাস লিখতে হবে তোমাকে।”

এমন কত মানুষের চলার পথ বদলে দিয়েছেন পুণ্যদা। বদলে দিলেও ওঁর মতো লক্ষ্যে অবিচল আর কতজন থাকতে পারে! মাঝে মাঝে যখন সোশাল মিডিয়া অথবা অন্যান্য লঘু আনন্দে গা ভাসিয়ে ফেলি, সংক্ষিপ্ত বকুনির মেসেজ আসে— “অকারণ শক্তিক্ষয় করছ আজকাল, সময় নষ্ট করো খুব।”

এই দু-লাইনের ওজন ২০০০ কুইন্টালের চেয়েও বেশি। জীবনের সব আনন্দ-উপভোগ যাঁর কাছে শুধু মানুষের পাশে থাকার সংগ্রাম, তাঁর কাছে নতজানু হতেই হয়।

সোম থেকে শনি— সপ্তাহে ছয় দিন ক্লিনিক করেন পুণ্যদা। সোম, মঙ্গল, বুধ, শনি— চার দিন চেঙ্গাইলের শ্রমিক কৃষক মৈত্রী কেন্দ্র; বৃহস্পতিবার বারাসাত সিটিজেন্স ফোরাম; আর শুক্রবার নৈহাটি। ঝড়, জল, তুফান— সব কিছুকে উপেক্ষা করে কোনওদিন সাড়ে ছটায়, কোনওদিন ৭টায় বেরিয়ে পড়েন। উত্তরবঙ্গের তিনটি জায়গায় চার দিনের ক্লিনিক সেরে সোমবার সকালে ফেরেন, সেদিনটাও ছুটি নেন না— সকালে বাড়ি ফিরে এক ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়েন চেঙ্গাইলের শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উদ্দেশে। এর মধ্যেই চলে মিটিং, মিছিল, রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা। তাঁর নেতা শঙ্কর গুহ নিয়োগী সম্পর্কে লিখেছেন পুণ্যদা—

ভোর হোক বা গভীর রাত— কখনও তাঁকে রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক আলোচনায় ক্লান্ত হতে দেখিনি।

—পুণ্যব্রত গুণ, শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েক বছর

পঞ্চাশ পেরোনোর আগেই ঘাতকের গুলিতে নিহত নেতার আদর্শ আর অক্লান্ত কর্মোদ্যোগকে মাথায় রেখে প্রতিদিন সূর্য-চন্দ্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, ৬৫ বছরেও অবিরাম দৌড়ে চলেছেন পুণ্যদা।

 

অভয়ার বিচারের দাবিতে বেহালায় সাইকেল মিছিল সংগঠিত করার ‘অপরাধে’ ১১ আগস্ট থানায় ডাক পড়েছিল অভয়া মঞ্চের দুই কনভেনরের। সেই সময় ফেসবুক প্লাবিত হয় অজস্র লেখায়, যেগুলোর বিষয় একটাই— পুণ্যব্রত গুণের চিন্তা এবং কাজের বৃত্তে রাষ্ট্রযন্ত্রের দুরধিগম্যতা।

পুণ্যব্রত গুণ-ঝড়ে ফেসবুক কাঁপিয়েছিলেন নবীন চিকিৎসক থেকে প্রবীণ সাংবাদিক এবং আরও বহু মানুষ। আমি এক লাইনও লিখিনি। পরিচয়ের বয়স তখন এক বছরও হয়নি। শুধু পড়তাম। মুগ্ধ হয়ে পড়তাম। পড়লাম সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরীর লেখা ‘পাটোয়া থেকে মমতা, পুণ্যর প্রতিস্পর্ধী যাপন’—

মাসি গৌরী আইয়ুব। মেসো আবু সৈয়দ আয়ুব। ওর বাবা অতীন্দ্রমোহন গুণ। ইত্যাদি প্রভৃতি তালিকা দীর্ঘ করা যেত। কিন্তু এগুলো কোনও পরিচয়ই নয় গণচিকিৎসক ডাক্তার পুণ্যব্রত গুণের। কারণ বংশকৌলিন্যজাত সামন্ততান্ত্রিক ধারণাকে পুণ্য ঘৃণার বস্তু বলে মনে করেন।… ১৯৯১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শঙ্কর গুহ নিয়োগী ভিলাইতে খুন হওয়ার পর, দল্লি রাজহারায় যাই। সেখানে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার নেতা পুণ্য তখন আমাদের কাছে যেন ভিনগ্রহের মানুষ। সংগঠনের কাজ বলতে তখন ওর ঘাড়ে শহিদ হাসপাতালের যাবতীয় দায়িত্ব। সকালে আউটডোর, ইমারজেন্সি সামলে তার পরিচালনা— যাকে ইংরেজিতে বলে Alpine to elephant— সব পুণ্যর দায়িত্বে। খনি এলাকার গরিব মানুষের একমাত্র ভরসা শহিদ হাসপাতাল। সঙ্গে আরও দুই বঙ্গসন্তান— ডাক্তার শৈবাল জানা, অপরজন তাঁর স্ত্রী আল্পনা দে সরকার। ওরা ছ মু মো (ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা)-র দফতর-লাগোয়া কমিউনে সবার সঙ্গে পংক্তিভোজন করত। সংগঠনের হোল-টাইমার। ওদের ঘুম বা বিশ্রামের ঠিকঠিকানা ছিল না। রাতবিরেতে কল এলেই একছুট্টে হাসপাতালে (একাধিক দিন সে ঘটনার সাক্ষী ছিলাম)। শুধু কি তাই— ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার প্রচারের নিউজলেটার, হিন্দি/ইংরেজি/বাংলা সম্পাদনা, ডাক্তারি জার্নাল, বইপত্র ঘাটাঘাঁটির পর কখন যে ঘুমোতে যেত, কোনওদিন বুঝতে পারিনি।

শ্রমিক–কৃষক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের তিরিশ বছর এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের পঁচিশ বছর উপলক্ষে মেডিকেল কলেজে একটি অনুষ্ঠানে (৭ এপ্রিল ২০২৫) এসেছিলেন বিপুল চক্রবর্তী-অনুশ্রী চক্রবর্তী। পুণ্যদার পরিকল্পনামতো আমি তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দিই। ফেরার পথের আড্ডায় অনুশ্রীদি ঠিক এ-রকমই বলেছিলেন— “পুণ্য কখন ঘুমোতে যেত, আমরা কেউ জানতাম না!”

যদিও পুণ্যদা এসব মানেন না। অতিশয়োক্তি বলে উড়িয়ে দেন। আমাকে বহুবার পরামর্শ দিয়েছেন— “কলেজে যাওয়া–আসার পথে ঘুমিয়ে নাও, তাহলে কাজের সময় বাড়াতে পারবে।” এটাও নাকি নিয়োগীজির উপদেশ। তিনিও নাকি এভাবেই যাওয়া-আসার পথে ঘুমিয়ে নিতেন। পুণ্যদাও তাই করেন। ঘুমের মতো আবশ্যিক শারীরবৃত্তীয় কাজটিও যে নেতার নির্দেশ মেনে রাজনৈতিক সচেতনতার সঙ্গে করা যায়— পুণ্যদার সঙ্গে আলাপ না হলে কী করে জানতাম!

খুব সাম্প্রতিক একটি ঘটনা মনে পড়ল। ভুবনেশ্বরের ট্রেন ধরতে সাতসকালে হাওড়ায় হাজির হয়ে শুনলাম— ট্রেন আড়াই ঘণ্টা লেট। পুণ্যদার ফোন এল। কখন পৌঁছাব, কোথায় খাব, মেয়ের সঙ্গে কখন দেখা হবে— এই সব নিরীহ নিখাদ কুশল-জিজ্ঞাসার পরেই বললেন— “কালকের মিটিংয়ের মিনিটসের খাতাটা সঙ্গে এনেছ তো? বসে না থেকে অ্যানালিসিসটা করে ফেলো।” যাতায়াতের পথে ঘুমিয়ে নেওয়ার সুপরামর্শকে আর একটু বিস্তৃত করে অপেক্ষার সময়টাতেও সুনিদ্রার পরিকল্পনা করেছিলাম— সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল!

২৪ ঘণ্টার প্রতিটি ঘণ্টা, প্রতিটি মিনিট, প্রতিটি সেকেন্ডের সদ্ব্যবহার শিখতে হয় পুণ্যদার কাছে।

তার মানে এই নয় যে শুধু কাজ করেন— নিজেই বলেন, মানুষের সঙ্গে অনেকটা গল্প না করলে অনেকটা বোঝা যায় না। কাজের মধ্যে গল্প; গল্পের মধ্যেই কাজ সেরে ফেলা; কাজের ফাঁকে ঘুম; ঘুমিয়ে উঠেই পঞ্চেন্দ্রিয় সজাগ করে কাজে নেমে পড়া। মিলিটারি ডিসিপ্লিন বললে আপত্তি করেন। দিনে-রাতে, শয়নে-স্বপনে-জাগরণে— প্রতি মুহূর্তে নিজেকে ‘গণমুক্তিফৌজ’-এর সৈনিক মনে করেন। এ এক আশ্চর্য অনুশীলন।

এই পর্যন্ত পড়ে যদি মনে হয় পুণ্যদার জীবনটা শুধু রাজনৈতিক বিশ্বাস আর শৃঙ্খলার নিগড়ে বাঁধা, তাহলে ভুল হবে। পুণ্যদা তত্ত্বে আটকে থাকার মানুষ নন। সমাজ-সংসারের প্রতি সাধারণীকৃত ভালোবাসা নিয়ে তিনি তাত্ত্বিক আন্দোলনে বিশ্বাসী নন। পুণ্যদা রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষ— যাঁর হৃদয়ের উষ্ণতা আর অপ্রতিরোধ্য চৌম্বকশক্তিতে আকৃষ্ট হন বহু মানুষ। নিজে অবশ্য এসব মানেন না; বলেন, “লোকের আমাকে ভালোবাসা অথবা অপছন্দের একটাই কারণ— আমার অনেকগুলো মুখ নেই, সব জায়গায় একটাই মুখ।”

সামাজিক-অর্থনৈতিক সাম্যের লক্ষ্যে অবিরাম লড়াইয়ের পাশাপাশি সূর্যের উত্তাপ, চন্দ্রের স্নিগ্ধতা আর আজীবন অটুট চারিত্রিক সঙ্গতি এবং সততা— এই হল পুণ্যদার মন্ত্রশক্তি। তাই ‘শ্রমজীবী’র নবীন চিকিৎসক মৃন্ময়, আপন, আদিত্য, অভিজিৎ, সাবিত, রাহুলদেব, অভনি, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মী সীমা, শ্যামলী, কপিল এবং আরও অনেকের প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি, প্রেম-বিরহ-বিবাহ— সব ডিটেইলস মুখস্থ পুণ্যদার। পুণ্যদা এদের শুধু শিক্ষাগুরু নন— অভিভাবক, পরামর্শদাতা এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই ঠাকুরপুকুর থানার ওয়ারেন্ট বেরোনোর পর মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র–চিকিৎসক অনীক চক্রবর্তী লেখেন—

পুণ্যদার জীবন আর তার কাজের আগুনে আমি-আমরা শুধু মোমবাতি জ্বালাইনি, মশালও সাজিয়ে রাখা আছে। সে মশাল বের করা হয় না, আওয়াজ তোলা হয় না— তার কারণ অন্য কিছু নয়, শুধুই ঘেন্না। এই সরকার এবং তার শাসনব্যবস্থার প্রতি। তার সীমাহীন ঔদ্ধত্য, ঔদাসীন্য আর নির্লজ্জতার প্রতি। কিন্তু তার মানে এই নয় এখনও চুপ থাকব… নিতান্ত দুঃস্বপ্নেও পুণ্যদাকে ছোঁয়ার ধৃষ্টতা দেখালে আমার জন্যও একটা জায়গা রাখবেন আপনাদের জেলের ভেতর। মশাল নিয়েই যাব।

জীবনে যা যা কাজ করেছেন পুণ্যদা, সবগুলোই অপরাজেয় প্রত্যয় আর গভীর নিষ্ঠা নিয়ে করেছেন, চটজলদি কিছু পাওয়ার আশায় করেননি। অভয়ার বিচারের লক্ষ্যে খুব বেশি রাস্তা এখনও অতিক্রম না করা গেলেও অভয়া মঞ্চ হতাশাগ্রস্ত না হয়ে, শক্তিশালী অস্তিত্ব নিয়ে ১৫ মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে— এর জন্য পুণ্যদার নেতৃত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এই অভূতপূর্ব অদলীয় রাজনৈতিক মঞ্চ গণআন্দোলন পরিচালনা করে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী— যে পরিকল্পনা ঠিক হয় অভ্যন্তরীণ সভায়। এই সভাগুলোতে অনেক মানুষ আসেন। সব সভার মতো এখানেও মতবিনিময়ের পাশাপাশি ব্যক্তিগত স্তরে গণসংযোগও চলতে থাকে। ব্যক্তিগত সংযোগের ক্ষেত্রে পুণ্যদার বিশেষ পারদর্শিতা থাকলেও মিটিং একবার শুরু হয়ে গেলে আর একবারও অন্যদিকে মন দিতে দেখিনি পুণ্যদাকে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবার বক্তব্য মন দিয়ে শুনবেন, মতামত দেবেন। মিটিংয়ের মধ্যে সামান্যতম গল্প করাও পুণ্যদার অপছন্দ।

পুণ্যদার এই প্রবল সিরিয়াসনেস প্রায় প্রতি মিটিংয়ে অনেক অনাবিল মজার গল্প তৈরি করে। বড় মিটিং বা শিক্ষাশিবির— অনেক লোক, পিছনে কথা বন্ধ করা যাচ্ছে না— পুণ্যদা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে পরীক্ষার হলের ইনভিজিলেটরের মতো পায়চারি শুরু করে দেন। একদিন সামনের সারিতে বসে সইয়ের কাগজ হাতে নিয়ে গল্প করতে গিয়ে বকুনি খেলাম আমি আর ঝুম্পাদি। ঝুম্পাদি পুণ্যদার বাবা অধ্যাপক অতীন্দ্রমোহন গুণের ছাত্রী। পুণ্যদার বকুনি খেয়ে খুবই আবেগাপ্লুত গলায় বলল— “আগে স্যার বকতেন, এখন দাদা বকছেন!” কোনও এক দুর্জ্ঞেয় কারণে পুণ্যদার কাছে বকুনি খেলে প্রীতির পরিমাণ বর্ধিত হয়। আমরা চুনোপুঁটিরা বিপুল আনন্দ উপভোগ করি যখন পুণ্যদা গম্ভীর হয়ে মাইকে বলেন— “মানস, তমোনাশ, উৎপল— পিছনে বসে কথা বলছ, সামনে এসে বসো।” সভায় প্রবল হাস্যরোল। বিনা বাক্যব্যয়ে, কোনও প্রশ্ন না করেই মানসদা (ডাঃ মানস গুমটা), তমোনাশদা (ডাঃ তমোনাশ চৌধুরী) আর উৎপলদা (ডাঃ উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়) সলজ্জ মুখে বাধ্য ছাত্রের মতো সামনের সারিতে এসে বসে পড়েন। ডাঃ তমোনাশ ভট্টাচার্যদা পুণ্যদার টাকি হাউজ স্কুল এবং মেডিকেল কলেজের ‘ভাই’ হওয়ার সুবাদে প্রায় প্রতি মিটিংয়ে বকুনি খান।

ভিন্ন রাজনৈতিক ধারার প্রতিবাদী মানুষের মধ্যে এই শ্রদ্ধা ও প্রীতির বন্ধন, পুণ্যদার প্রতি সর্বস্তরে এক গভীর আস্থা ও আনুগত্য— এ শুধু পুণ্যদার অর্জন নয়। এ অর্জন অভয়া মঞ্চের, যে ছকভাঙা প্রতিবাদী মঞ্চের সঙ্গে পুণ্যদার যোগাযোগ অনিবার্য ছিল। সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরী যথার্থই বলেছেন—

ঘরের খেয়ে বনের মোষতাড়ুয়া পুণ্য যে অভয়া মঞ্চ গড়ার অন্যতম পুরোধা হবে, সেটা ওর রাজনৈতিক জীবনবোধের একপ্রকার অনিবার্য পরিণতি। রাষ্ট্রীয় রক্তচক্ষু দেখার অভ্যাস ওর আছে। প্রতিস্পর্ধাও ততোধিক।

রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই প্রতিবাদীরা জোটবদ্ধ হচ্ছেন অভয়া মঞ্চকে কেন্দ্র করে, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ছে গণস্বাস্থ্যের আন্দোলন। জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস, ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট এবং অভয়া মঞ্চ ও তার বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন হেলথ ক্যাম্প এবং রিলিফ ক্যাম্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। এই সম্মিলিত সংগ্রামই একদিন ছিনিয়ে আনবে বিচার, বন্ধ করবে নারীনির্যাতন এবং ধর্ষণ। দিনবদলের স্বপ্ন দেখাচ্ছে অভয়া মঞ্চ। এই সময় পুণ্যদার মতো মানুষদের আরও অনেক অনেক দিন— পথে নামার পূর্ণ শক্তি নিয়ে— পাশে থাকা প্রয়োজন।

খুব ভালো থাকুন কমরেড। রাত-প্রভাতের স্বপ্ন দেখান আরও অনেক মানুষকে, এবং সুন্দর সমাজ গড়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত করুন আমাদের আগামী প্রজন্মকে।

লাল সেলাম।।

 

কৃতজ্ঞতা:

  1. বিপুল চক্রবর্তী, অনুশ্রী চক্রবর্তী
  2. অধ্যাপক কাঞ্চন সরকার
  3. লিলি দে সরকার
  4. অর্কপ্রভ গুণ
  5. অভয়া মঞ্চ এবং শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ ও স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণের সব প্রতিবাদী বন্ধুরা
  6. চিত্রঋণ: নারায়ণদাস বসু, অভিষেক মৈত্র, নীল মালাকার, www.punyabratagun.com.

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. গোপার লেখা “অভয়া আন্দোলন এবং ডাঃ পুণ্যব্রত গুণের সঙ্গে এক বছর” আজ খুব ভাল করে পড়লাম। পড়তে পড়তে মনে পরে গেল, বেশ কিছু বছর আগে, রবিন মণ্ডলের উপর বুদ্ধদার ( দাসগুপ্ত) একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম- সেই ডকুমেন্টারিতে মানুষ রবিন মণ্ডল এবং শিল্পী রবিন মণ্ডল কোথায় যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেছিল। পুন্যদাকে নিয়ে গোপার লেখাতেও দেখলাম, ব্যক্তি পুন্যদা আর আন্দোলনের পুন্যদাকে আলাদা করা যাচ্ছে না। “চার নম্বর প্লাটফর্ম” এর আমি কেউ নই ; শুধু মাত্র একজান পাঠক , ২০১৯ থেকে বা তার আগে থেকে। তবুও ওদের পক্ষ থেকেই গোপাকে জানাইঃ ওয়েলকাম টু “চার নম্বর প্লাটফর্ম” । আরও লেখা চাই …।

  2. অসাধারণ বর্ণনা। সেনাপতিকে আন্তরিক শুভেচ্ছা আর লেখিকাকে অভিনন্দন জানাই ।

আপনার মতামত...