মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প-জমানায় গর্ভপাতের অধিকারের হালহকিকত

নূপুর রায়চৌধুরী

 


সবার মনেই এখন এক বিশাল প্রশ্ন: ওয়াশিংটনে ক্ষমতায় আসা জিওপি গর্ভপাত সম্পর্কে ঠিক কেমন ভূমিকা নিতে চলেছে? বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী বছরগুলিতে গর্ভপাতের অ্যাক্সেস সরাসরি নিষিদ্ধ না করেও জাতীয়ভাবে তা সীমাবদ্ধ করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো নতুন কোনও উপায় অবলম্বন করতে পারে। গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টির কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখলেই হয়তো আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতে সঠিক সময়ে মিলে যাবে

 

সালটা তখন ১৯৬৮। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে গর্ভপাত-সংক্রান্ত আইন সংস্কারের দাবিতে জনগণের ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদের ঝড় বয়ে চলেছে। গোটা দেশটাই তখন এক গভীর রাজনৈতিক অস্থিরতার দ্বারপ্রান্তে। সে সময় গর্ভপাত আইন খতিয়ে দেখা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব ছিল রাজ্যগুলির উপর, ফেডারেল সরকারের নয়। মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত; সে বিষয়ে ছিল প্রবল আইনি কড়াকড়ি। ফলস্বরূপ বিপুল সংখ্যক অনিরাপদ ও অবৈধ গর্ভপাত এবং অকাল প্রাণহানি ঘটতে থাকে— সব মিলিয়ে রাজ্যগুলি তাদের গর্ভপাত-সংক্রান্ত আইন পরিবর্তনের জন্য দেশব্যাপী জনরোষের মুখে পড়ে।

এমনই এক দ্রোহকালে শিকাগো শহরতলির এক গর্ভবতী গৃহবধূ জয় তাঁর স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে একটি সাধারণ জীবনযাপন করছিলেন। কিন্তু এই দ্বিতীয় গর্ভাবস্থা তাঁকে ধীরে ধীরে প্রাণঘাতী হৃদরোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। গর্ভপাত করানো ছাড়া তাঁর সামনে আর কোনও পথ খোলা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ রাজ্যেই তখন গর্ভপাত অবৈধ। জয়ের মামলা পর্যালোচনার জন্য পুরুষ ডাক্তারদের যে প্যানেলটি নিযুক্ত করা হয়েছিল, তাঁরা কিছুতেই জয়ের গর্ভাবস্থার ইতি টানতে রাজি হলেন না— এমনকি তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্যও নয়। সমস্যার সমাধানের জন্য জয় যখন ছুটোছুটি করছেন, তখনই তাঁর পরিচয় হয় শিকাগোর এক গুপ্ত সংস্থা ‘জেন কালেক্টিভ’-এর সঙ্গে। পরিচয় হয় দুই অসাধারণ মহিলার সঙ্গে— ভার্জিনিয়া ও গোয়েন। ভার্জিনিয়া নারীর স্বাস্থ্যের প্রতি দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আর গোয়েন প্রতিনিয়ত এমন এক দিনের স্বপ্ন দেখেন যখন সমস্ত মহিলার গর্ভপাতের সুযোগ থাকবে— সে তাঁদের আর্থিক সামর্থ্য যাই হোক না কেন। ভার্জিনিয়াদের কর্মকাণ্ড জয়কে এতটাই অনুপ্রাণিত করে যে নিজের জীবনকে সমস্ত রকম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে তিনি তাঁদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এই যে সিনেমাটির কথা এতক্ষণ বললাম, তার নাম ‘কল জেন’। ৬০-এর দশকের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পটভূমিকায়, মার্কিন নারীদের স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটিকে পুনর্কল্পনা করার সাহস দেখানো একদল মহিলার গল্প।

ভাবছেন, আজকের আলোচনায় কেন এই পুরনো দিনের ছায়াছবির গল্পের অবতারণা?

অতীতের গর্ভেই বর্তমানের জন্ম— প্রতিটি ঘটনাই পূর্ববর্তী ঘটনার ফলস্বরূপ ঘটে, এবং সেখান থেকেই সময় এগিয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে। এটিই সময়ের এক অবিচ্ছেদ্য প্রক্রিয়া। তাই আমাদের আজকের আলোচনার প্রেক্ষাপটে এই সিনেমার রূপকল্প অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

১৯৬৮ সাল এবং তার পরবর্তী বছরগুলিতে সংঘটিত মার্কিন নারী-মুক্তি আন্দোলনের ধারাবাহিক বিক্ষোভ জনসাধারণের মনোভাব ও রাষ্ট্রের আইনি দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এতে এমন এক সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়, যা আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের পক্ষেও বিষয়টিকে আর উপেক্ষা করা অসম্ভব করে তোলে। এই যুগসন্ধিক্ষণে যে ঐতিহাসিক আইনি লড়াইটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল, সেই দিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা শুরু হোক।

সেটা ছিল ১৯৭০ সালের মার্চ মাস। টেক্সাস-নিবাসী গর্ভবতী নর্মা ম্যাককরভে, যিনি ছদ্মনামে পরিচিত ছিলেন ‘জেন রো’, টেক্সাসের গর্ভপাত আইনকে চ্যালেঞ্জ করে ডালাস কাউন্টির জেলা অ্যাটর্নি হেনরি ওয়েডের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। বাদী রো তাঁর বক্তব্যে বলেন যে, টেক্সাসের গর্ভপাত আইন— যা একজন মহিলার জীবন রক্ষার ক্ষেত্র ছাড়া গর্ভপাতকে অবৈধ ঘোষণা করে— তা অসিদ্ধ, কারণ সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর ‘ডিউ প্রসেস ক্লজ’-এর ভিত্তিতে একজন মহিলার গর্ভপাত-সংক্রান্ত গোপনীয়তার অধিকার ফেডারেল আইনে আগে থেকেই সুরক্ষিত রয়েছে।

প্রায় তিন বছরের টানাপোড়েনের পর, ১৯৭৩ সালে গর্ভপাতকে বৈধ ঘোষণা করে ৭-২ ভোটে ‘জেন রো’-র পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট তাদের যুগান্তকারী রায় দেয়। এই রায়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন গর্ভবতী মহিলার গোপনীয়তার অধিকার রক্ষিত হয়, তেমনি অপরদিকে মাতৃস্বাস্থ্য ও ভ্রূণের জীবনরক্ষায় রাষ্ট্রের স্বার্থও বজায় থাকে। গর্ভপাতকে অপরাধের কালিমা থেকে মুক্ত করে এই রায়, এবং গর্ভপাত-বিষয়ে রাজ্য আইন প্রণয়নের জন্য একটি ফেডারেল কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে।

নিজেদের শরীরের উপর স্বায়ত্তশাসন এবং ব্যক্তি-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মার্কিন নারীরা বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠেন। কিন্তু দক্ষিণ-পন্থী (রিপাবলিকান) ও ধর্মীয় রক্ষণশীলরা এই রায়ের কট্টর বিরোধিতা করে। গর্ভপাতের অধিকারে সীমাবদ্ধতা আরোপ এবং শেষ পর্যন্ত তা রদ করার জন্য তাঁদের চিরাচরিত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। এই প্রচেষ্টার মধ্যে ছিল রক্ষণশীল বিচারক নিয়োগ, রাজ্যস্তরের বিধিনিষেধের জন্য চাপ সৃষ্টি, এবং গর্ভপাতের সুযোগের বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলা।

এরপর ১৯৯২ সালের ‘প্ল্যানড প্যারেন্টহুড বনাম কেসি’ মামলার সিদ্ধান্তও ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার পথেই হাঁটে এবং দেশব্যাপী গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকারকে আরও একবার জোরদার করে তোলে।

সত্যি বলতে, ‘রো বনাম ওয়েড’ যেমন লিঙ্গসমতা ও প্রজনন অধিকারের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে, তেমনি এটি আমেরিকান সমাজে গর্ভপাত নিয়ে চলমান বিতর্ককেও ক্রমাগত উসকে দিয়েছে।

এভাবেই চলল বেশ কয়েক বছর। কিন্তু ২০১৮ সালের মার্চ মাসে মিসিসিপি রাজ্য তাদের ‘গর্ভকালীন বয়স আইন’ প্রণয়ন করে। এই আইনে বলা হয়, কেবলমাত্র চিকিৎসাগত জরুরি অবস্থা ব্যতীত গর্ভধারণের ১৫ সপ্তাহের পরে সব ধরনের গর্ভপাত মিসিসিপিতে নিষিদ্ধ। এই আইনকে কেন্দ্র করে আবার সমস্যার কালো ছায়া ঘনিয়ে আসে। জ্যাকসন শহরে অবস্থিত মিসিসিপির শেষ গর্ভপাত ক্লিনিক ‘জ্যাকসন উইমেন্স হেলথ অর্গানাইজেশন’ ওরফে ‘পিঙ্ক হাউস’, এবং সেখানকার একজন ডাক্তার মিসিসিপির এই আইনকে চ্যালেঞ্জ করে মিসিসিপির তৎকালীন রাজ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তা টমাস ডবসের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এই মামলাটি পরবর্তীতে ‘ডবস বনাম জ্যাকসন উইমেন্স হেলথ অর্গানাইজেশন’ নামে পরিচিতি পায়।

প্রথমে মিসিসিপির দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা আদালত এবং পরে পঞ্চম সার্কিট কোর্ট অফ আপিল— উভয়েই রায় দেয় যে মিসিসিপির ১৫ সপ্তাহের গর্ভপাত-নিষেধাজ্ঞা অসাংবিধানিক, কারণ এটি ‘রো বনাম ওয়েড’ এবং ‘প্ল্যানড প্যারেন্টহুড বনাম কেসি’ মামলাগুলির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ভ্রূণের কার্যকারিতার (foetal viability) আগ পর্যন্ত মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকারকে লঙ্ঘন করে।

সুতরাং, নিম্ন আদালতগুলো যে জ্যাকসন উইমেন্স হেলথ অর্গানাইজেশনের পক্ষেই ছিল, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। এমনকি তারা মিসিসিপি রাজ্যকে এই আইন কার্যকর করা থেকে বিরত রাখার নির্দেশও দেয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও, ২০২১ সালের মে মাসে মামলাটি সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছে যায়।

জনান্তিকে বলে রাখা ভালো যে, ১৯৮০ সালের পর থেকেই দক্ষিণের অন্যান্য অংশের মতো মিসিসিপিও ক্রমশ রিপাবলিকান ঘাঁটিতে পরিণত হয়। গর্ভপাতের অধিকার সীমিত করার জন্য রাজ্যকর্তারা বহু বছর ধরেই ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন— যেভাবেই হোক ‘রো বনাম ওয়েড’-কে নস্যাৎ করার ফন্দি আঁটছিলেন। তাঁরা ভালো করেই জানতেন যে তাঁদের প্রণীত আইন অসাংবিধানিক, কিন্তু ততদিনে সুপ্রিম কোর্টে এক রক্ষণশীল পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আর মিসিসিপি তখনই ঝোপ বুঝে কোপ মারে।

এরপরের চাঞ্চল্যকর ঘটনার সাক্ষী মহাকাল। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাদী ও বিবাদী— উভয়পক্ষের মৌখিক সওয়াল-জবাব উপস্থাপিত হয়, এবং ২০২২ সালের ২৪ জুন সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসে— মার্কিন সংবিধান মোটেই মহিলাদের গর্ভপাতের অধিকার প্রদান করে না। কোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ‘রো বনাম ওয়েড’ ও ‘প্ল্যানড প্যারেন্টহুড বনাম কেসি’— দুই মামলাকেই বাতিল করে দেয়। রাজ্য সরকারের হাতে গর্ভপাত নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই এই নতুন রায় মার্কিন নারীদের প্রায় পাঁচ দশকের সুরক্ষিত গর্ভপাত-অধিকার নিমেষে ছিনিয়ে নিল। মহিলাদের শারীরিক স্বায়ত্তশাসন ও গোপনীয়তার সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হল। এর ফলে নারী ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলি অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল, এবং সম্পর্কিত অন্যান্য স্বাধীনতাও সম্ভাব্যভাবে ক্ষুণ্ন হল। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের হস্তক্ষেপকে প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার লঙ্ঘন হিসাবে চিহ্নিত করাটা মোটেই অতিরঞ্জন নয়।

এই মামলার রায়ের শুনানির পরই আমেরিকা জুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ, আইনি মোকাবিলা এবং গর্ভপাত নিষিদ্ধ বা কঠোরভাবে সীমিত করার জন্য রাজ্যগুলির ভিতরে ইতিমধ্যেই বিদ্যমান গর্ভপাত আইনগুলিতে জোড়াতালি দেওয়ার ধুম পড়ে যায়। এই সিদ্ধান্তের ফলে গর্ভপাত ক্লিনিকগুলি রাতারাতি তাদের ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়; হেলথ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলি জটিল নতুন আইনের মারপ্যাঁচ বুঝে উঠতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে; আর গর্ভনিরোধ ও আইভিএফের মতো সহায়ক প্রজনন-অধিকারের ক্ষেত্রেও জনগণের মধ্যে এক প্রবল অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।

মানুষের প্রতিক্রিয়াও তীব্রভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে— গর্ভপাত-অধিকার সমর্থকরা মহিলাদের, বিশেষ করে প্রান্তিক সম্প্রদায়ের নারীদের স্বাস্থ্য ও সমৃদ্ধির উপর এই রায়ের অসম প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে; অন্যদিকে বিরোধীরা গর্ভপাতের ক্ষেত্রে ফেডারেল সুরক্ষার অবসানে যারপরনাই সন্তোষ প্রকাশ করে।

‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার রায় বাতিলের প্রতিক্রিয়ায় ২০২২ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে বাইডেন প্রশাসন প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা রক্ষা ও সম্প্রসারণের জন্য একাধিক নির্বাহী আদেশ ও নির্দেশিকা জারি করে। এর মধ্যে নির্বাহী আদেশ ১৪০৭৬ ও ১৪০৭৯ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৪০৭৬ নম্বর আদেশটি গর্ভপাত-সংক্রান্ত প্রচার, তহবিল বরাদ্দ এবং গর্ভপাত ক্লিনিকে প্রবেশাধিকারের স্বাধীনতা আইন প্রয়োগে রাজনীতিকরণের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক সরকারি উদ্যোগের নির্দেশ দেয়। অপরদিকে ১৪০৭৯ নম্বর আদেশে গর্ভপাতকে “স্বাস্থ্যসেবা” হিসেবে পুনঃশ্রেণিবদ্ধ করা হয়, যাতে ঐচ্ছিক গর্ভপাতের জন্য করদাতাদের তহবিল ব্যবহারের পথ সুগম হয়।

‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজ্যভেদে গর্ভপাতের সুযোগের দৃশ্যপট উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে গেছে। অনেক রাজ্যের আইনসভা নতুন নতুন গর্ভপাতবিধি তৈরি করেছে, আবার কেউ কেউ বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞাগুলি কার্যকর করতে শুরু করেছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কিছু রাজ্য গর্ভপাত সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে বা কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ করেছে; আবার কিছু রাজ্যে গর্ভাবস্থার নির্দিষ্ট পর্যায়ে— যেমন ৬, ১২, ১৮ সপ্তাহ, বা ভ্রূণের কার্যক্ষমতার কাছাকাছি সময়ে (প্রায় ২৪ সপ্তাহে)— গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে কিছু রাজ্য গর্ভপাতের সুযোগ বজায় রেখেছে বা আরও প্রসারিত করেছে।

মোটের উপর, গর্ভপাতের অনুমোদিত গর্ভকালীন সীমা এখন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে সেই রাজ্যের নীতির উপর, যেখানে এই প্রক্রিয়াটি সম্পাদিত হচ্ছে।

একটা বিষয় কিন্তু লক্ষণীয়— যখন ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলাটি বাতিল করা হয়, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ছিলেন জো বাইডেন। ক্রমবর্ধমান প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সংকটের মধ্যেও মহিলাদের গর্ভনিরোধ ও গর্ভপাতের সুযোগরক্ষায় বাইডেন প্রশাসনের যথেষ্ট দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল, এবং তার জন্য উপযুক্ত নির্বাহী আদেশও বলবৎ ছিল। অথচ সেই জমানাতেই সুপ্রিম কোর্টের রায় দেশব্যাপী গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকারকে শেষ করে দিতে সক্ষম হয়— অবাক হওয়ার মতো ঘটনাই বটে! আসলে এটি রিপাবলিকানদের দশকব্যাপী চাপের ফল, যা শেষ পর্যন্ত বাইডেন প্রশাসনের আমলেই পূর্ণতা পায়।

প্রশ্ন জাগে— কীভাবে ঘটল এই অঘটন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের কাঠামো সম্বন্ধে দু-চার কথা জেনে নেওয়া যাক।

মার্কিন সুপ্রিম কোর্টে একজন প্রধান বিচারপতি এবং আটজন সহযোগী বিচারপতি থাকেন। প্রধান বিচারপতি আদালতের নেতৃত্ব দেন এবং ফেডারেল বিচারব্যবস্থায় একটি অনন্য ভূমিকা পালন করেন; তবে মামলার রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে নয়জন বিচারপতিরই সমান ভোটাধিকার থাকে। বিচারপতিরা প্রেসিডেন্ট-দ্বারা মনোনীত হন এবং সিনেটের অনুমোদনের পর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তাঁরা মৃত্যু, পদত্যাগ বা অভিশংসন না হওয়া পর্যন্ত পদে বহাল থাকেন।

এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের গঠন পরিবর্তনশীল— এটি কেবলমাত্র প্রেসিডেন্টের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়; বরং প্রেসিডেন্ট ও সিনেটের যুগ্ম অনুমোদনেই বিচারপতিদের নিয়োগ কার্যকর হয়।

‘ডবস বনাম জ্যাকসন’ মামলার সময় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন জন রবার্টস; সহযোগী বিচারপতি হিসেবে ছিলেন স্যামুয়েল আলিটো, ক্ল্যারেন্স থমাস, স্টিফেন ব্রেয়ার, সোনিয়া সোটোমায়র, এলেনা কাগান, নিল গোরসাচ, ব্রেট কাভানাঘ এবং অ্যামি কোনি ব্যারেট। ওই মামলায় গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার রহিত করার পক্ষে মত দেন পাঁচজন বিচারপতি— আলিটো, থমাস, গোরসাচ, কাভানাঘ ও ব্যারেট; আর বিপক্ষে ভোট দেন তিনজন— ব্রেয়ার, সোটোমায়র এবং কাগান। প্রধান বিচারপতি রবার্টস মামলার পক্ষে থাকা পাঁচ বিচারপতির সিদ্ধান্তের সঙ্গেই সহমত পোষণ করে তাঁর মতামত লিপিবদ্ধ করেন। ফলস্বরূপ, ৬-৩ ব্যবধানে গোরসাচরা জয় লাভ করেন। সুপ্রিম কোর্টে রক্ষণশীল বিচারপতিদের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠাটাই ছিল ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার পতনের কেন্দ্রীয় কারণ।

এই পরিকল্পনা রূপায়িত হওয়ার সময়রেখাটা কেমন ছিল, আসুন সেটা একবার ঝালিয়ে নেওয়া যাক। ২০১৬ সালের নভেম্বর নির্বাচনের সময় রিপাবলিকান দলের মনোনীত প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। ভোটের প্রচারাভিযানের সময় থেকেই ট্রাম্প ভোটারদের ক্রমাগত প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁর দল ক্ষমতায় এলে, প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি সুপ্রিম কোর্টে এমন বিচারপতি নিয়োগ করবেন, যাঁরা ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলাটি বাতিল করতে সফল হবেন।

ভোটে রিপাবলিকানদের জয় হয়। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি ৪৫তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প প্রথমবারের মতো শপথ গ্রহণ করেন। সকলের কাছেই তখন থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাতের আইনি অবস্থায় এবার একটি বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। কার্যভার গ্রহণের পরপরই, ১০ এপ্রিল ২০১৭-তে ট্রাম্প রক্ষণশীল বিচারপতি নিল গোরসাচকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ করেন। এরপর ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ব্রেট কাভানাঘ এবং ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে অ্যামি কোনি ব্যারেটের মনোনয়নও কার্যকর করেন তিনি।

ট্রাম্পের পছন্দের এই তিন বিচারপতি আরও দুইজন রক্ষণশীল বিচারকের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘রো বনাম ওয়েড’-কে উৎখাতের পক্ষে ভোট দেন। সুতরাং ট্রাম্পের সহায়তাতেই যে ‘রো বনাম ওয়েড’ মামলাটি নাটকীয়ভাবে বাতিল হল, তা বুঝতে নিশ্চয়ই এখন আর কোনও সংশয় নেই। ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের সময়ও ট্রাম্প সুযোগ পেলেই ‘রো বনাম ওয়েড’ উল্টে দেওয়ার কৃতিত্ব নিজে দাবি করেছেন।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা বিচারপতি মেরিক গারল্যান্ডকে সুপ্রিম কোর্টে আনতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা মিচ ম্যাককনেল ওবামার সেই মনোনয়ন আটকে দেন এবং ২০২০ সালের নির্বাচনের ঠিক মুখে তড়িঘড়ি করে ব্যারেটের নিয়োগ নিশ্চিত করেন।

২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল ‘মেক্সিকো সিটি নীতি’র পুনঃস্থাপন ও সম্প্রসারণ। সমালোচকদের কাছে এটি পরিচিত “গ্লোবাল গ্যাগ রুল” নামে। এই নীতি পরিবর্তনের ফলে আইনি গর্ভপাত পরিষেবা প্রদান, প্রচার বা সমর্থনকারী আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলির জন্য মার্কিন বিশ্বস্বাস্থ্য তহবিল বন্ধ হয়ে যায়— এমনকি যদি সেই কার্যক্রমগুলি তাদের নিজস্ব, অ-মার্কিন অর্থ দিয়েও পরিচালিত হয়ে থাকে।

‘রো বনাম ওয়েড’ মামলা বাতিলের সিদ্ধান্তের পর যেহেতু রাজ্য-পর্যায়ে গর্ভপাত নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে, তাই অনেক রাজ্যই ভোটারদের মতামতের জন্য গর্ভপাতের বিষয়টিকে ব্যালটে জায়গা দিয়েছে। ফলে ২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনের সময় ব্যালটে শুধু রাষ্ট্রপতি পছন্দই নয়, গর্ভপাতের অধিকারও এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ইস্যু হয়ে ওঠে।

এই নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার সময় মহিলাদের প্রজনন অধিকারে বিশ্বাসী, ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী কমলা হ্যারিস অঙ্গীকার করেছিলেন যে, নির্বাচিত হলে তিনি নারীর প্রজনন অধিকার রক্ষায় একটি জাতীয় আইন পাশ করবেন। অন্যদিকে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্প গর্ভপাতের বিষয়ে প্রচারণার সময় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রেখেছিলেন। যদিও তিনি বলেছিলেন যে গর্ভপাত বিষয়ে ফেডারেল নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তিনি ভেটো দেবেন, কিন্তু বিতর্কের সময় যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল— তার ডেস্কে এমন কোনও খসড়া পৌঁছালে তিনি তাতে স্বাক্ষর করবেন কি না— তখন তিনি প্রায়শই সরাসরি উত্তর দেওয়া এড়িয়ে যান। ঠিক একইভাবে, গর্ভপাতের ওষুধ মাইফেপ্রিস্টোনের অ্যাক্সেস এবং গর্ভপাতকারিণীদের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়েও তিনি জনগণকে মিশ্র সঙ্কেত দেন। ট্রাম্পের প্রাক-নির্বাচনী বার্তায় ধোঁয়াশা থাকলেও, তাঁর দলের গর্ভপাত-বিরোধী কিছু কৌশলবিদ যে নতুন আইন ছাড়াই দেশব্যাপী গর্ভপাত কার্যকরভাবে নিষিদ্ধ করার জন্য ১৯ শতকের ‘কমস্টক’ আইন ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছিলেন, এ কথা কিন্তু আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের কাছে চাপা থাকেনি। ট্রাম্প কেবল প্রকাশ্যে এসব নথি থেকে নিজের দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিলেন। আচ্ছা, গর্ভপাত বিষয়ে ট্রাম্পের সেই সময়কার ভাসা-ভাসা উত্তরগুলো কি তাহলে সব লোক দেখানো, ভোটের প্রাক্কালে সংবেদনশীল বিষয় থেকে নাড়াঘাঁটা না করার অজুহাত ছিল? কে জানে!

এর পরের ঘটনা আমরা সকলেই জানি। কমলা হ্যারিস নির্বাচনে হেরে যান। ট্রাম্প দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন এবং ২০ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে দেশের ৪৭তম ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনরায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সিংহাসনে বসেই, জানুয়ারির ২৪ তারিখে, বাইডেনের ২০২২ সালের নির্বাহী আদেশ ১৪০৭৬ ও ১৪০৭৯ কার্যকরভাবে বাতিল করে ‘এনফোর্সিং দ্য হাইড অ্যামেন্ডমেন্ট’ শিরোনামে নিজের নতুন নির্বাহী আদেশ জারি করেন ট্রাম্প। ‘হাইড অ্যামেন্ডমেন্ট’ ঐচ্ছিক গর্ভপাতের জন্য ফেডারেল করদাতাদের অর্থ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই আইনটি কিন্তু নতুন কিছু নয়— ১৯৮০ সালে এটি প্রথম কার্যকর হয়েছিল। গর্ভপাতের অ্যাক্সেস সীমিত করার লক্ষ্যে ট্রাম্প এই পুরনো নীতিটিকেই নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করলেন।

২০২৫ সালের শেষের দিকে, যে ১২টি রাজ্যে গর্ভপাত সম্পূর্ণরূপে অথবা গর্ভকালীন ছয় সপ্তাহের কাছাকাছি সময়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো হল— অ্যালাবামা, আরকানসাস, আইডাহো, কেনটাকি, লুইসিয়ানা, মিসিসিপি, ওকলাহোমা, নর্থ ডাকোটা, সাউথ ডাকোটা, টেনেসি, টেক্সাস এবং ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া। টিপ্পনি হিসেবে বলা যায়, প্রায়শই ছয় সপ্তাহের আগেই একজন নারী নিশ্চিতভাবে জানতে পারেন না যে তিনি গর্ভবতী হয়েছেন— অতএব এই রাজ্যগুলিতে গর্ভপাত নিয়ে যে প্রচণ্ড কড়াকড়ি রয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

‘রো বনাম ওয়েড’ মামলার রায় বাতিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক রাজ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়ে ওঠে তথাকথিত ‘ট্রিগার ল’ বা ‘স্বয়ংক্রিয় আইন’। এগুলি এমন পূর্বনির্ধারিত রাজ্য আইন, যা রো বনাম ওয়েডের পতনের সঙ্গে সঙ্গে অবিলম্বে বা অল্প সময়ের মধ্যেই কার্যকর হওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই আইনগুলির ফলে গর্ভপাতকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়, চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর ফৌজদারি মামলা দায়েরের আশঙ্কা তৈরি হয় এবং কিছু রাজ্যে মহিলাদের ভ্রমণ করে অন্য রাজ্যে গিয়ে গর্ভপাত করানোর ক্ষেত্রেও নানা আইনি জটিলতা আরোপিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ট্রিগার ল-ই আজকের আমেরিকায় গর্ভপাতের স্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি সঙ্কুচিত করেছে।

সবার মনেই এখন এক বিশাল প্রশ্ন: ওয়াশিংটনে ক্ষমতায় আসা জিওপি গর্ভপাত সম্পর্কে ঠিক কেমন ভূমিকা নিতে চলেছে? বিশেষজ্ঞদের ধারণা, আগামী বছরগুলিতে গর্ভপাতের অ্যাক্সেস সরাসরি নিষিদ্ধ না করেও জাতীয়ভাবে তা সীমাবদ্ধ করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো নতুন কোনও উপায় অবলম্বন করতে পারে। গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টির কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখলেই হয়তো আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতে সঠিক সময়ে মিলে যাবে।

 

তথ্যসূত্র:

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...