এবার লক্ষ্য— পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতীয় বাঙালি

অশোক মুখোপাধ্যায়

 


বিজেপির যে বিভাজনের অস্ত্র, তা এখন আর শুধু হিন্দু-মুসলিম দ্বিবচনে সীমাবদ্ধ নেই। মণিপুর ও ছত্তিশগড়ে সে আদিবাসীদের উপর ভয়াল আগ্রাসন নামিয়ে এনেছে। রাজ্যে রাজ্যে গরিব বস্তিবাসীদের উপর বুলডোজার চালাচ্ছে। এনআরসি-এনপিআর এখন এসআইআরের ছদ্মবেশে আসছে— ‘অনুপ্রবেশ’-এর আতঙ্ক দেখিয়ে। বিহারে যে পঁয়ষট্টি লক্ষ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে কেটে দিয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই গরিব। অথচ তাঁদের মধ্যে একজনও বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা পাওয়া যায়নি। নেই বলেই। এই সর্বগ্রাসী হামলারই অঙ্গ হচ্ছে বাংলা ও বাঙালির উপর আক্রমণ। রাজ্যে রাজ্যে হুজ্জুতি করতে করতে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবাংলাতেও ওরা ঢুকবে

 

বাঙালি মানেই বাংলাদেশি!!

উত্তর ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বিগত কয়েক মাস ধরে পশ্চিমবাংলা থেকে অভিবাসী বাঙালি শ্রমিকদের উপর এক অভূতপূর্ব আক্রমণ চলছে। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, আসাম— অর্থাৎ যেখানে যেখানে বিজেপি-পরিচালিত রাজ্য সরকার রয়েছে, সেই সব রাজ্যেই বাঙালিদের উপর এই আক্রমণ এক নিখুঁত ধাঁচে পরিণত হয়েছে।

কী রকম সেটা?

প্রথমে বস্তি বা ঝুপড়ি এলাকায় গিয়ে গরিব, বিত্তহীন মজুরদের বেছে নাও। তারা বাংলায় কথা বলছে দেখলেই লক্ষ করো— কোথায় যায়, কোথায় থাকে, কী খায়। মোটামুটি নিশ্চিত হলে যে এরা বাঙালি মুসলমান, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দাও।

এবার পুলিশের একটা দল আসবে। কাগজপত্র দেখতে চাইবে। যদি আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার কার্ড দেখাতে না পারে, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। অবিলম্বে কয়েকজনকে ঘর থেকে বের করে টেনে নিয়ে গিয়ে একটু দূরে দাঁড় করানো কালো ভ্যানে তুলবে।

আর যদি কাগজগুলি দেখাতে পারে, তখন গালাগালি শুরু করবে। বাংলাদেশি ঘুসপেটিয়া বলে সুসংস্কৃত হিন্দিতে গাল পাড়া হবে। কার্ডগুলিকে বলা হবে জাল। তারপর একই কায়দায়— কালো ভ্যান।

এর সঙ্গে মারধর। ঘরের জিনিসপত্র ভেঙে ফেলা, ছুড়ে ফেলা।

থানায় নিয়ে গিয়ে জাল কেসে প্রথমে লক-আপে পুরে দেবে।

নামগুলি যদি হিন্দু হয়?

কী বলছেন আপনি!

বাঙালি কখনও হিন্দু হয় না। বাঙালি মানেই মুসলমান। বাংলাদেশি।

গেরুয়া দিল্লিওয়ালারাও সেই একই গুরুর শিষ্য কিনা! পশ্চিম পাকিস্তানের শাহকুল ১৯৭১-এর আগে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মুসলমান মনে করত না। তাদের উপলব্ধি ছিল— মুসলমান কখনও বাঙালি হয় না; ওটা হিন্দুদের একচেটিয়া ব্যাপার। মুসলমান মানেই পাকিস্তানি। উর্দুভাষী। আর অমিত শাহদের বিদ্যে হচ্ছে— হিন্দু হলে শুধু হিন্দুস্তানি হবে, হিন্দিভাষী হবে। বাঙালি কেন হবে? বাংলায় কেন কথা বলবে?

অতএব হিন্দু নাম দেখাচ্ছে আর বাংলায় কথা বলছে মানে হল— এরা আসলে বাংলাদেশের মুসলমান; ভারতে ঢুকে হিন্দু সেজে রয়েছে— অতএব আরও জাল।

সহজ যুক্তিজাল।

জাল যুক্তিও বলা যেতে পারে।

এরা যদি মতুয়া হয়? এদের কাছে শান্তনু ঠাকুরের দেওয়া ‘মতুয়া কার্ড’ থাকে? প্রাক-নাগরিক পরিচয়পত্র হিসাবে?

দূর মশাই! এরা সবাই যদি পদ্মভোটার হয়, তবে বাংলায় কথা বলবে কেন?

অর্থাৎ, এই পদ্ম-পুলিশের মতে তারা আরও, আরও বেশি জাল!

আসাম কিংবা দিল্লিতে আবার এখানেই শেষ হচ্ছে না। তাদের পুলিশ সেই বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকদের বস্তি, এমনকি স্থায়ী বাসিন্দাদের ঘরবাড়িও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।

 

অনুপ্রবেশ— এক অ্যাডাল্ট জুজু!!

এর শুরু হল কীভাবে?

গত ২ মে ২০২৫, কেন্দ্রীয় সরকার সমস্ত রাজ্য সরকারের কাছে একটি গোপন সার্কুলার পাঠায়। তাতে বলা হয়, সারা দেশ নাকি বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেছে। প্রতিটি রাজ্য পুলিশকে এক মাসের মধ্যে তাদের খুঁজে বের করতে হবে এবং সবাইকে হয় বাংলাদেশে পুশব্যাক করে দিতে হবে, অথবা ডিটেনশন ক্যাম্প বানিয়ে সেখানে ঢুকিয়ে দিতে হবে। তার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে রিপোর্ট পাঠাতে হবে।

স্বভাবতই, নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে সাজোসাজো রব পড়ে যায়। এক মাস তো খুবই কম সময়। তাই সেই সব রাজ্যের পুলিশ যেমন তৎপর হয়ে ওঠে, গেরুয়া বাহিনীও তাদের সাহায্য করতে মাঠে নেমে পড়ে। ঘরছুট শ্রমিকরা যে সমস্ত গরিব মহল্লা ও বস্তিতে দল বেঁধে থাকে, সেই সব এলাকায় তাদের আনাগোনা শুরু হয়। বাংলায় কথা বলছে টের পেলেই— হয় তারাই হামলা শুরু করে দেয়, নয়তো সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় থানায় খবর দিয়ে পুলিশ ডেকে আনে।

অতঃপর—

মহারাষ্ট্র, গুজরাত এবং হরিয়ানায় এই ধরনের শয়তানি হামলা ও অন্যায় আটকের একাধিক ঘটনার খবর আদানি–আম্বানির কৃপাধন্য বড় বড় গণমাধ্যমে না বেরোলেও, সোশাল মিডিয়ার মঞ্চ থেকে বাইরে আসতেই চারদিকে হুলুস্থুল পড়ে যায়। তার পর ওড়িশা, আসাম ইত্যাদিতেও একই ছবি। স্বভাবতই, এর ফলে পশ্চিমবঙ্গেই সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এদিকে পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ক্ষমতায় আসার আশায় যে শুভেন্দু–সুকান্ত বাহিনী দিন গুনছে, অথচ তাদের বগলের তলা দিয়ে বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে, তারা বুঝতে পারে— এতে তাদের ২০২৬-এর থালায়ও ছাই পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং তারাও হয়তো ভেতরে ভেতরে মিউ মিউ করে পদ্মনেতাদের কাছে ঘটনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা চেয়েছিল।

এবার, ২১ জুলাই তৃণমূল কংগ্রেসের জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাংলা ভাষার সপক্ষে, মাঝে মাঝে হিন্দিতে ভাষণ দিতে দিতে প্রথম জানান সেই সার্কুলারের কথা। ভিনরাজ্যে বাংলার শ্রমিকদের উপর আক্রমণের জবাবে তিনি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে এক “ভাষা আন্দোলন”-এর প্রসঙ্গ তোলেন।

বিশিষ্ট ভাষাবিদ পবিত্র সরকার একই সঙ্গে এক বিবৃতিতে মমতা ব্যানার্জির বক্তব্য সংশোধন করার প্রয়াসে ঘোষণা করেন যে, বাংলা ভাষার উপর কোথাও কোনও আক্রমণ হচ্ছে না; আক্রমণ হচ্ছে বাঙালি অভিবাসী শ্রমিকদের উপর। পশ্চিমবঙ্গে রুজি-রোজগার নেই বলেই এত হাজার হাজার যুবক অন্য রাজ্যে যাচ্ছে। ফলে এই আক্রমণের জন্য প্রকারান্তরে টিএমসি সরকারই দায়ী। সুতরাং…

অন্যদিকে, দুই আনন্দবাজারি কলমবাজ মহিলা দাবি করলেন, তাঁরা নাকি প্রায়ই হিল্লি–দিল্লি, মুম্বই, আমেদাবাদ ঘুরে বেড়ান, কিন্তু কোথাওই বাঙালিদের বা বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ দেখেননি। সুতরাং…

সুতরাং এর থেকে সাহস পেয়ে দিল্লি পুলিশ এক চমকপ্রদ কাণ্ড ঘটাল। তারা একদল বাঙালি শ্রমিককে আটক করে তাঁদের ভাষা সম্পর্কে জানতে চেয়ে বঙ্গভবনে চিঠি পাঠাল— দেখুন তো, এই শব্দগুলো কি বাংলাদেশি বলে মনে হয়? এরা যারা বলছে, তাদের কি অনুপ্রবেশকারী বলে মনে করা যায়?

ওদিকে, আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, জনগণনা বা ভোটার তালিকায় নাম তোলার সময় কেউ যদি মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা লেখেন, তবে ধরে নেওয়া হবে— তাঁরা বিদেশি, অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে আগত অনুপ্রবেশকারী!

সমীকরণটা তাহলে দাঁড়াল কী?

ভারতে থেকে বাংলায় কথা বলছ? তার মানে তুমি বাংলাদেশি। তার মানে তুমি অনুপ্রবেশকারী। উইপোকা। ঘুসপেটিয়া!

আর কেন্দ্রীয় সরকার এখন ঘুসপেটিয়া খুঁজে বের করতে এবং বিতাড়িত করতে মরিয়া। অতি সম্প্রতি শিয়ালদহের হামলার ঘটনাই যেন একেবারে ঘরের দরজায় এসে কড়া নেড়ে জানিয়ে গেল— ওরা পৌঁছে গেছে!

 

আসল লক্ষ্য— বাংলা ও বাঙালি!!

ব্যাপক হইচইয়ের ফলে পদ্মশিবিরকে একটু নড়েচড়ে বসতেই হল। পশ্চিমবাংলায় বাঙালিদের মনে যদি এই তথ্যটা একবার গেঁথে যায় যে বিজেপি— এবং আসলে সঙ্ঘও— আদ্যন্ত বাংলা ভাষা-বিদ্বেষী এবং বাঙালিবিরোধী, তাহলে সুকান্ত-শুভেন্দু-শমীকদের পায়ের তলার খড়খড়ে মাটি আরও আলগা হয়ে যাবে। ফলত, ওদের এক মাতব্বর বুদ্ধিজীবীকে ময়দানে নামতেই হল। না না না, আমরা বাংলাভাষারও বিরোধী নই, বাঙালিদের উপরও আমাদের কোনও রাগ-বিদ্বেষ নেই। আমরা তো কেবল অনুপ্রবেশকারী খুঁজে খুঁজে মরছি!

হ্যাঁ, ওদের আইটি সেলের কর্তা অমিত মালব্য X-handle (টুইটার)-এ এক লম্বা বাণী পোস্ট করে ফেলল।

বেশ, বেশ। আসুন, সেটাকে এবার প্যারা বাই প্যারা নেড়েচেড়ে দেখা যাক—

১ম প্যারা: Mamata Banerjee’s reaction to Delhi Police referring to the language used by infiltrators as ‘Bangladeshi’ is not just misplaced, it is dangerously inflammatory.

বিবৃতিটা লক্ষ করুন।

যাদের দিল্লি পুলিশ ধরে এনে ভাষা পরীক্ষা করতে চাইছে, তারা যদি আগেই “infiltrators” হিসেবে সনাক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তাদের ভাষা নিয়ে দি-পুর এত মাথাব্যথা কেন? কেস তো ওইখানেই খতম হয়ে যায়। তুমি ধরেই নিয়েছ— তুলে আনা লোকগুলো “বাংলাদেশি”, অতএব তাদের ভাষাও বাংলাদেশি। এটাই তো আসল কথা। এটা চিঠি দিয়ে বঙ্গভবনকে জানিয়ে দেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে— আমরা কতিপয় “বাংলাদেশি” ধরেছি; তাদের ভাষা বাংলা নয়, অতএব তোমরা এটা নিয়ে আর বাগড়া দিও না, হইচইও কোরো না। মনে রাখবে— বাংলা বলছে দেখে পদ্মপুলিশ ধরলেই বুঝে যাবে, ওরা বাংলাদেশি ঘু…!

মালব্য বিবৃতিটা লেখার সময় এটা খেয়াল করেনি। এই দাবিটাই যে আরও অনেক বেশি dangerous এবং inflammatory, সেটা লোকটার মনে ছিল না। দিল্লিতে কাজ করতে যাওয়া নিরীহ বাঙালি মজুরদের ধরে তাদের গায়ে “বাংলাদেশি” তকমা লাগিয়ে দিয়ে, তাদের ভাষাকেও “বাংলাদেশি” বলে দিলে দিল্লির কেন্দ্র-রাজ্য পদ্ম সরকারের আর কোনও ঝামেলাই থাকে না!

অতএব, ওদের সম্মিলিত আক্রমণের লক্ষ্যটা যে পশ্চিমবাংলার বাংলা ও বাঙালি— সেটা এখন আর কোনওভাবেই অস্পষ্ট রাখা যাচ্ছে না।

২য় প্যারা: Nowhere in the Delhi Police letter is Bangla or Bengali described as a ‘Bangladeshi’ language. To claim otherwise and call upon Bengalis to rise against the Centre is deeply irresponsible. Mamata Banerjee should be held accountable — perhaps even under the National Security Act — for inciting linguistic conflict.

বুঝুন ঠেলাটা!

পশ্চিমবাংলা থেকে ঘরছুট শ্রমিকদের ধরেই— বিনা বিচারে, বিনা তদন্তে— “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে, তাদেরই ভাষাকে বলছে “বাংলাদেশি”! দি-পু তো এটাই করেছে। তার পরেও মালব্য বলছে, দি-পু নাকি বাংলা ভাষাকে “বাংলাদেশি” বলেনি— বাংলাদেশিকেই বাংলাদেশি বলেছে!

একেই মেঠো বাংলায় বলে যুক্তিজিলিপি।

৩য় প্যারা: Let me explain. লোকটা এবার ব্যাখ্যা করে বোঝাচ্ছে। বেশ, শুনে নিই খানিক প্যাচাল। Delhi Police is absolutely right in referring to the language as Bangladeshi in the context of identifying infiltrators. The term is being used to describe a set of dialects, syntax, and speech patterns that are distinctly different from the Bangla spoken in India. The official language of Bangladesh is not only phonologically different, but also includes dialects like Sylheti that are nearly incomprehensible to Indian Bengalis.

আবার বলি— দি-পু সঠিক বলেছে এটা ধরে নেওয়া যেত, যদি তারা আগেই সিদ্ধান্ত না নিয়ে, যাদের ধরেছে তাদের “অনুপ্রবেশকারী” বলে দাগিয়ে না দিয়ে, যে শব্দগুলিকে তারা “ভারতে ব্যবহৃত নয়” বলে মনে করছে, সেগুলো সনাক্ত করে বঙ্গভবন নয়, পশ্চিমবাংলার ও বাংলাদেশের বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানীদের মতামত চাইত— দেখুন তো, এই শব্দগুলি ভারতের না বাংলাদেশের?

যেমন, কাউকে খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যা করা হয়েছে সন্দেহ হলে পুলিশ আগে সম্ভাব্য খুনের জায়গায় পাওয়া বিষের পাত্রটি পাঠায় ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে। নিজেরাই বিষের নাম বা ব্যবহারকারীর অপরাধ বাতলে দেয় না— এমনকি জানলেও বা বুঝলেও নয়। আগে নিশ্চিত হয়ে নেয়— ওটা বিষ, ওটা অমুক বিষ, পাত্রে তার মারণমাত্রায় উপস্থিতি ছিল, ব্যবহারকারীর হাতের ছাপ পাওয়া গেছে, ইত্যাদি।

কিন্তু মালব্য, দিল্লি পুলিশের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে এবং “বাংলাদেশি” ও “রোহিঙ্গা” ধরার বদনেশায়, এই সব সহজ যুক্তির কথাই মনে রাখেনি।

মালব্য সম্ভবত জানেই না— না জানা অবশ্য দোষের নয়, যদি না সেই অজ্ঞতাকেই জ্ঞান বলে ধরে নিয়ে অন্যকে জ্ঞান দিতে থাকে— বাংলা ভাষার কতগুলো উপভাষা আছে। পশ্চিমবাংলার সমস্ত জেলায়ও কি একই শব্দশৃঙ্খল ব্যবহৃত হয়? ভারতের অন্য রাজ্যে— ত্রিপুরা, আসাম, ঝাড়খণ্ড, দিল্লি— যে বিপুল সংখ্যক বাঙালি বাস করে, তাদেরও কথ্য শব্দশৃঙ্খল ভিন্ন ভিন্ন! বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যেমন ভিন্ন বাচনিক ভঙ্গি, তেমনি পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলায় এবং ভারতের অন্য রাজ্যের বাঙালিদেরও তাই।

তাহলে কোনও একটি বাচনভঙ্গিকে “বাংলাদেশি” দাগানোর আগে তো নিশ্চিত হতে হবে— যাদের ধরা হয়েছে, তাদের কথায় ব্যবহৃত শব্দপুঞ্জ পশ্চিমবঙ্গের বা ভারতের কোনও জেলায় বাঙালিদের দ্বারা ব্যবহৃত হয় কি না!

এই কাজটা না করে— এমনকি করার চেষ্টাটুকুও না করে— দি-পু এবং মালব্য কী করে নিশ্চিত হয়ে গেল যে “ওদের” ভাষাভঙ্গিটা “বাংলাদেশি”? পদ্মশিবির আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে; এখন চাপাচাপি করছে, সবাই যেন সেটাই মেনে নেয়।

এই দেখুন, তার প্রমাণ।

৪র্থ প্যারা: There is, in fact, no language called “Bengali” that neatly covers all these variants. “Bengali” denotes ethnicity, not linguistic uniformity. So when the Delhi Police uses “Bangladeshi language,” it is a shorthand for the linguistic markers used to profile illegal immigrants from Bangladesh — not a commentary on Bengali as spoken in West Bengal.

আসলে, পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের ধরে ধরে বাংলাদেশি তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। তারপর বলছে, না না, আমরা পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের কিছু বলছি না, পশ্চিমবাংলার বাংলাকেও দাগাচ্ছি না। আমরা যে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের আটক করেছি, তাদের বলা ভাষাকেই “বাংলাদেশি” বলছি।

তা, কী করে বুঝলেন, ওরা বাংলাদেশি?

বা রে, ওরা যে বাংলায় কথা বলছে! তার মানেই তো ওরা বাংলাদেশি।

 

Bengali নামে কোনও ভাষা নেই”?

বটে? আপনি নিশ্চিত??

আপনি কি জানেন, ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তফসিলে ভারতীয় ভাষাগুলির একটি তালিকা আছে? সংবিধানটি প্রথমে ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল। সেটাই এখনও ভারতের সংবিধানের একমাত্র স্বীকৃত ভাষ্য। তো, সেই তফসিলের ভাষার তালিকায় অসমীয়া ভাষার পরেই লেখা আছে “Bengali”— স্পষ্ট ইংরেজি অক্ষরে। “There is, in fact, no language called Bengali” লিখবার আগে অমিত মালব্যর কি উচিত ছিল না সেই সংবিধানের পৃষ্ঠাটা একবার পড়ে দেখা?

তবে পড়া বা জানার জন্য পরিশ্রম নাকি গেরুয়া শিবিরে হারাম বলে বিবেচিত হয়! পড়ে আর জেনেই যদি কাজ করব, তাহলে আর বিজেপি করতে যাব কেন?

ফলে মালব্য এটাও জানে না যে প্রমিত বাংলা— লিখিত ভাষায় যা ব্যবহার করেন বাঙালিরা— তা ভারতের সমস্ত রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালি, পশ্চিমবাংলার বাঙালি এবং বাংলাদেশের বাঙালি— সবারই এক এবং অবিভিন্ন ভাষা। বাংলা ভাষার মোটামুটি আশি হাজার শব্দের মধ্যে হয়তো বিশ-পঁচিশটি শব্দ স্থানভেদে আলাদা। সুতরাং জেনে রাখা দরকার, এই প্রমিত বাংলা— called “Bengali”— neatly covers all these variants. বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রকাশিত দুটি বাংলা অভিধান নিয়ে তুলনা করলেই এটা জানা যেত।

আবার ইংরেজিতে English, Spanish, Italian লিখলে যেমন একসঙ্গে ইংল্যান্ড, স্পেন বা ইতালির অধিবাসীদেরও বোঝায়, তাদের ভাষাকেও বোঝায়, ঠিক তেমনই Bengali শব্দের দ্বারা ইংরেজিতে বাংলা ভাষাকেও বোঝানো হয়, বাঙালিদেরও বোঝানো হয়। আগে বাঙালিদের জাতিসত্তা বোঝাতে ইংরেজিতে Bengalee লেখা হত। আজকাল আর কেউ সেটা লেখে না— Bengali-ই লেখে।

এটা জানার জন্য মালব্যদের প্রায় কোনও পরিশ্রমই করতে হত না— দরকার ছিল শুধু সদিচ্ছার। দিল্লি পুলিশের কথা এক্ষেত্রে ধরছি না, কারণ ওরা হচ্ছে হুকুমের চাকর। উপর থেকে আর এক অমিতের বাঙালি ও বাংলা-বিদ্বেষী দপ্তর যা হুকুম দিয়েছে, ওরা সেটাই করেছে। কিন্তু যে তাদের হয়ে সাফাই দিতে এল, তাকে তো একটু জেনে-শুনে আসতে হয়!

না জানলে কী হয়, দেখা যাক!

৫ম প্যারা— For context, Ananda Math was written in Bangla of the era, against the backdrop of the Sanyasi Rebellion.

একই বাক্যে একসঙ্গে দুটো ভুল— একটা ভাষাগত ভুল, আর একটা ইতিহাসের তথ্যগত গোল। শুদ্ধ বাক্যটা হবে: For context, Ananda Math was written in Bengali of the era, against the backdrop of the British Raj. সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ছিল সেই উপন্যাসের উপকরণ, আর তার প্রেক্ষিত ছিল ব্রিটিশ শাসন। গেরুয়া কোম্পানি কিন্তু কিছুতেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি পরাধীন আমল থেকে চলে আসা তাদের অচলা ভক্তিকে টলতে দেয় না। মুচলেকা-বীর সাভারকর কথা দিয়েছিল কিনা! ফলে প্রেক্ষিতের জায়গায় উপকরণ বসিয়ে ব্রিটিশ শাসনকে এখনও তারা আড়ালে রাখতে চায়।

“The iconic Vande Mataram was composed separately, in Sanskrit, and later grafted into the novel. Jana Gana Mana, originally composed and sung as a Brahmo hymn, was written in Sanskritised Bangla.”— এই বাক্যেও দুখানা ভুল। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দেমাতরম’ গানটা সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়নি, বরং সেকালের সংস্কৃতায়িত সাধু বাংলায় রচিত হয়েছিল। পুরো গানের কথা পাঠ করলে এবং মনে রাখলেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। আর রবীন্দ্রনাথের ‘জনগণমন’ গানটিও ব্রাহ্মগীতি ছিল না। সেটি কংগ্রেস অধিবেশনে দেশাত্মবোধক গান হিসাবে গাওয়ার জন্যই রচিত হয়েছিল। এর ভাষাও একেবারেই সংস্কৃতায়িত বাংলা নয়; ছিল তখনকার সাপেক্ষে অবিভক্ত বাংলার প্রমিত কথ্য বাংলা ভাষা। ফলে শুদ্ধ বাক্যটা হবে:

“The iconic Vande Mataram was composed separately, in Sanskritized Bengali, and later grafted into the novel. Jana Gana Mana, originally composed and sung as a patriotic song for a Congress Session, was written in Standard Bengali.”

আসলে দিল্লি পুলিশের “Bengali”-র বদলে “Bangladeshi language” লেখাটাকে ন্যায্যতা দিতে গিয়ে মালব্যকে এখন ইংরেজির “Bengali” শব্দটাকে উড়িয়ে দিয়ে সেখানে “Bangla” বসাতে হচ্ছে। এভাবে একটা ভুল ও ধাপ্পা আড়াল করতে গিয়ে তাকে আরও বড় ভুল এবং এক বিরাট অন্যায় করতেই হচ্ছে। করতেই হবে।

 

বাংলা ভাষার শরীর

এই সমস্ত আলোচনা চলাকালীন অনেককেই বলতে শোনা গেছে— সে যাই বলুন, বাংলাদেশের বাংলা আর পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষায় নাকি বিস্তর পার্থক্য। সেদিক থেকে দিল্লি পুলিশ বা তাদের দালাল অমিত মালব্য যেন খুব ভুল কিছু বলেনি।

কথাটা কি আদৌ সত্য?

না। আগেও বলেছি, আবারও বলছি— গোটা কুড়ি-পঁচিশটা শব্দ বাদ দিলে দুই পারের বাংলায় লিখিত ও প্রমিত রূপে কোনও পার্থক্য নেই।

আছে কেবল কথ্য ভঙ্গিতে।

কিন্তু সেটাও এমন নয় যে দুইপারে শুধু দুইরকম কথ্য ভাষা। পুরনো অবিভক্ত বাংলাকে ধরলে দেখা যাবে, তার প্রায় প্রতিটি জেলার কথ্য ভাষাভঙ্গিই আলাদা। অমিত মালব্য হয়তো কোথাও সিলেট বা শ্রীহট্টের নাম শুনেছে, কিন্তু ময়মনসিংহ আর পাবনার, নোয়াখালি আর বরিশালের কথ্যভাষায় যে কতটা স্বাতন্ত্র্য আছে, সে সম্বন্ধে বোধহয় এই নবোত্থিত ভাষাপণ্ডিতদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। চট্টগ্রামের কথা আর তুলছিই না। একইভাবে পশ্চিমবাংলাতেও হুগলি আর পুরুলিয়া জেলার কথ্য বাংলায় বিশাল পার্থক্য রয়েছে; মেদিনীপুর ও মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

পশ্চিমবাংলার প্রসঙ্গে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে দুটি দৃষ্টান্তমূলক কাহিনি শোনাই।

২০০০ সালের কথা। বিজ্ঞান-শহিদ জিওরদনো ব্রুনোর মৃত্যু-চতুর্শতবর্ষ। সেই উপলক্ষে (তখনও অবিভক্ত) মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়ায় এক বিজ্ঞান সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজ্য-স্তরের এক বিজ্ঞান কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। আমি একটি লিফলেট তৈরি করে তার শিরোনামে লিখেছিলাম— “নতুন যুগের বৈতালিক জিওরদনো ব্রুনো” ইত্যাদি। ‘বৈতালিক’ শব্দটি নিয়েছিলাম নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস বৈতালিক থেকে, ঋণ স্বীকার করেই।

তীব্র আপত্তি এল স্থানীয় সংগঠকদের তরফে। তাঁরা বললেন, মেদিনীপুর জেলায় ‘বৈতাল’ বললে লোকে বোঝে কুমড়ো। ফলে এতে ব্রুনোকেও অনেকে কুমড়ো-ব্যবসায়ী বলে ভাববে। শব্দটা পাল্টাতেই হবে। না হলে অনুষ্ঠান করা যাবে না। শেষ পর্যন্ত আমাকেও শব্দটা সত্যিই পাল্টাতে হয়েছিল।

২০২৫ সালের কথা। একটি বিজ্ঞানপত্রিকায় নাস্তিকতা নিয়ে একটা প্রবন্ধ পাঠিয়েছিলাম। সেখানে এক জায়গায় ‘খাটালি’ শব্দটি ছিল। সম্পাদক ফোন করে জানতে চাইলেন, আমি কি ভুল করে ‘খাটুনি’ লিখতে গিয়ে ওটা লিখে ফেলেছি? আমি যখন তাঁকে জানালাম, এটা বাঁকুড়া–পুরুলিয়ার মানভূমিয়া ভাষার শব্দ— ‘খাটুনি’র অর্থেই ব্যবহৃত হয়। তখন উত্তর ২৪ পরগনার ওই সম্পাদক বেশ অবাক হলেন। এবারে অবশ্য শব্দটিকে আমি বাঁচাতে পেরেছিলাম।

সুতরাং মালব্যরা শুধু সিলেট নিয়ে মাথা ঘামানোর বদলে বাংলা ভাষার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে বিষয়টা নিয়ে একটু খোঁজখবর নিলে ভালো করত। অবশ্য তাতে তাদের অনুপ্রবেশ-কীর্তনে অসুবিধা হত।

দুনিয়ার সমস্ত ভাষার ক্ষেত্রেই কথ্য ভাষাভঙ্গিতে এইরকম আঞ্চলিক পার্থক্য দেখা যায় বলেই লিখিত ভাষায় এক ধরনের প্রামাণ্য বা প্রমিত ভাষাশৈলীর (standard linguistic style) প্রয়োজন হয়। যেমন ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রে— ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশের কথ্য ভাষায় নানা রকমফের থাকলেও— সাহিত্য, বিজ্ঞান বা অন্যান্য বিষয়ের লেখালিখিতে তারা সকলেই একটি সর্বমান্য ভাষাশৈলী ব্যবহার করে। তাতে কিছু শব্দের বানানে বা কিছু শব্দের ব্যবহারে সামান্য পার্থক্য ছাড়া আর বিশেষ ভিন্নতা থাকে না। যাঁরা এই সব দেশের প্রকাশিত বইপত্র নিয়মিত পড়েন, তাঁরা বিষয়টি ভালো করেই জানেন।

বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও তাই। বাংলাদেশের একটি ভালো উপন্যাস আর পশ্চিমবাংলার একটি ভালো উপন্যাস হাতে নিয়ে তুলনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। পারিবারিক সম্পর্ক বোঝানোর ক্ষেত্রে মাসি, মেসো, পিসি, পিসে, দাদা, দিদি ইত্যাদির জায়গায় ওপারে খালা, খালু, ফুপা, ফুপি, ভাই, আপা— এই ধরনের কিছু শব্দ আলাদা ঠেকে। কিংবা এপারে আমরা যেখানে লিখি “দেওয়া”, “দিই”, “কল করবেন”, “নেমন্তন্ন”, ওপারে লেখা হয় “দেয়া”, “দেই”, “কল দিয়েন”, “দাওয়াত”— এইরকম। এরকমই মোটামুটি কুড়ি-পঁচিশটা শব্দের পার্থক্য দেখা যায়। ও-দেশের মুসলমান জনগণ আব্বা-আম্মা বললেও সরকারি কাগজপত্রে পিতা-মাতাই লেখেন। কিন্তু একটা চারশো পাতার উপন্যাসে, যেখানে এক লক্ষাধিক শব্দ থাকে, সেখানে এই পার্থক্যবাচক শব্দগুলির ব্যবহার দুই সহস্রাংশের বেশি হবে না।

তবুও একটা খচখচানি রয়ে যায়। ভারতীয় হিন্দু বাঙালিদের এক বড় অংশের মধ্যে ওই দুই সহস্রাংশ পার্থক্যেও যেন একরকম মুসলমানি আঁশটে গন্ধ লেগে থাকে বলে বমনভাব আসে। অনেকে মুখ ফুটে বলতে পারে না, কেউ কেউ বলেই ফেলে।

তাদের সমস্যা মূলত দুটি— এক, তীব্র মুসলমানবিদ্বেষ; দুই, হিমালয়সম অজ্ঞতা।

বিদ্বেষের কারণেই তারা সহজে অমিত শাহ-অমিত মালব্যদের শিবিরে গিয়ে মিশে যায়। সেকুলার উদারতার মুখোশ পরলেও সারা দেহমনময় গেরুয়া খোসপাচড়াগুলো ঢেকে রাখতে পারে না। উপযুক্ত ঘটনার সময়ে অশিক্ষা ও অসংস্কৃতির ফিনফিনে জামাকাপড়ের ভেতর দিয়েও সেগুলো ভালোই দেখা যায়। আনন্দবাজার কোম্পানির লেখিকাদের বেলায় আমরা সেটাই স্পষ্টভাবে দেখেছি।

অজ্ঞতা? হ্যাঁ, সে এক বিরাট কিসসা।

যাঁরা মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ভাবতে থাকেন, তাঁরা নাকি দিব্যি এক সংস্কৃত-মাখন-সমৃদ্ধ বাংলায় কথা বলেন ও লেখেন— তাঁরা প্রায় কেউ জানেন না, দিনের বেশিরভাগ সময় যা বলেন এবং কাগজে-কলমে যা লেখেন, তার ষাট শতাংশই সেই মুসলমানি আঁশটে গন্ধযুক্ত শব্দমালা। শুধু খালা আর আপা নয়, বাবা, কাকা, দাদা, মামা— এই শব্দগুলিও তুর্কি উৎসের। বাজারে গেলে, লেখালেখিতে বসলে, সব জায়গাতেই সেই মুসলমানি শব্দেরই ব্যবহার করতে হয়। যতরকম ক্রিয়াপদ তাঁরা বলেন বা লেখেন, তার অধিকাংশই এসেছে উর্দু থেকে।

না জেনে গলা ফাটালেও, এর থেকে তাঁদের মুক্তি নেই।

মালব্যরা যেটা চাইছে— বাংলা থেকে হিন্দিতে শিফট করবেন? সেও উপায় নেই। হিন্দি নামে পরিচিত ভাষাটির আবার গোটা ব্যাকরণটাই পারসি— লিঙ্গ, বচন, বিভক্তি, সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ সবই ম্লেচ্ছ উৎসের। কোথাও কোনও “দেবভাষা”-র ছাপ নেই। বাংলা ভাষার চাইতেও অনেক বেশি আঁশটে— সে সরকারিভাবে বিশেষ্যপদগুলিতে যতই সংস্কৃত শব্দ জুড়ুক না কেন!

তাহলে বাঁচার উপায়?

একমাত্র উপায়, বিদ্বেষ থেকে নিজেকে মুক্ত করা। তাহলেই কেবল অজ্ঞতা থেকেও মুক্তি সম্ভব। গ্রিস দেশের সেই বিখ্যাত দার্শনিক সোক্রাতেস প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বলে গিয়েছিলেন— “জ্ঞান আর নৈতিকতা অবিভাজ্য।” একটি ছাড়া অন্যটির অস্তিত্ব নেই; তারা একসঙ্গেই থাকে। এই থিসিস আজও ভুল প্রমাণিত হয়নি।

এর পরিপূরক থিসিসটাও সত্য— “অজ্ঞতা আর অনৈতিকতাও অবিভাজ্য।” এই দুটোও একসঙ্গেই থাকে। বাংলা, বাংলা ভাষা ও বাঙালি-বিরোধীদের দেখলেই, তাদের বচন শুনলেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

 

শিক্ষা এবং দায়িত্ব

একটা আক্রমণ আসছে। ভয়ঙ্করভাবে। এবং আসতেই থাকবে। বিজেপির যে বিভাজনের অস্ত্র, তা এখন আর শুধু হিন্দু-মুসলিম দ্বিবচনে সীমাবদ্ধ নেই। মণিপুর ও ছত্তিশগড়ে সে আদিবাসীদের উপর ভয়াল আগ্রাসন নামিয়ে এনেছে। রাজ্যে রাজ্যে গরিব বস্তিবাসীদের উপর বুলডোজার চালাচ্ছে। এনআরসি-এনপিআর এখন এসআইআরের ছদ্মবেশে আসছে— ‘অনুপ্রবেশ’-এর আতঙ্ক দেখিয়ে। বিহারে যে পঁয়ষট্টি লক্ষ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে কেটে দিয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই গরিব। অথচ তাঁদের মধ্যে একজনও বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা পাওয়া যায়নি। নেই বলেই। সেই কারণেই পদ্মভোট কমিশন বাতিল লোকদের তালিকা প্রকাশ করতে চাইছিল না, কারণ তাতে ছলচাতুরি ধরা পড়ে যেত। এই সর্বগ্রাসী হামলারই অঙ্গ হচ্ছে বাংলা ও বাঙালির উপর আক্রমণ। রাজ্যে রাজ্যে হুজ্জুতি করতে করতে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবাংলাতেও ওরা ঢুকবে। অমিত মালব্যর বচন তারই প্রাথমিক শঙ্খধ্বনি— “আমরা আসছি”!!

আমাদেরও পাল্টা প্রস্তুতি নিতে হবে— যুক্তি-তর্কের হাতিয়ার হাতে নিয়ে, বিদ্বেষমুক্ত মন নিয়ে সত্যকে জেনে। ভাষা-সাম্প্রদায়িকতাকে সর্বপ্রযত্নে প্রতিহত করতেই হবে।

“বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি— জেনে যাক দুর্বৃত্ত।”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...