শুভ প্রতিম
‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’ এবং কয়েকটি সহযোগী সংগঠন মিলে কথা বলা হয় সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষত বিজেপি-শাসিত রাজ্যে প্রহৃত, বিতাড়িত অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে। যদিও এর মধ্যে আম আদমি পার্টি-শাসিত পাঞ্জাবেও বাঙালি অভিবাসী শ্রমিক হয়রানির খবর এসেছে। এই পর্বে আমরা কথা বলি বিভিন্ন পরিসরে অভিবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে। যেমন বাংলাদেশে পুশব্যাক থেকে ফিরে আসা বিএসএফ ও মহারাষ্ট্র পুলিশের হাতে নির্যাতিত শ্রমিক, পুনরায় ফিরে যেতে চাওয়া শ্রমিক, হেবিয়াস কর্পাস করা শ্রমিক, কোচবিহারে ছিটমহলের অধিবাসী, মতুয়া ইত্যাদি। প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয়েছে। আজ দ্বিতীয় পর্ব
প্রায় ১১ বছর আগে যখন দাসিয়েরছরা গিয়েছিলাম তখন কথা হয়েছিল বিষ্ণু বর্মন, নজরুল ইসলাম, খলিলুদ্দিন-সহ আরও বহু মানুষের সঙ্গে। এঁরা সকলে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ি থানার ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়েরছরার বাসিন্দা ছিলেন। সে এক আজব অভিজ্ঞতা! ছিটমহলের মধ্যেও সেখানে ছিল আর এক ছিটমহল। ২০১২ সাল, আমরা প্রায় ২৮ দিন ছিলাম বাংলাদেশের উত্তরপ্রান্তে, রংপুর ডিভিশনে। সেখানে লালমনিরহাট, হাতিবান্ধা, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম জেলার ১৭টি ভারতীয় ছিটমহলে এবং ভারতীয় ছিটমহলের মধ্যে থাকা ১টি বাংলাদেশি ছিটমহলে সমীক্ষা করা হয়।[1] “বাংলাদেশ নয়, ভারতই আমাদের রোজগারের ঠিকানা”— বলেছিলেন তাঁরা। “এখানের দুই হাজার মানুষ যদি দিল্লি, মুম্বাই যায় কাজ করতে, তাহলে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে যায় মাত্র দুশো জন। এখানের মানুষ যখন ভারতে যায় তখন তাদের অনুপ্রবেশকারী-র তকমা দেওয়া হয়। অথচ আমরা ভারতীয়, আমরা ভারতীয় ছিটমহল দাসিয়েরছরার বাসিন্দা।”[2]
দেশভাগ এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের নামে জমি তথা টেরিটরি কব্জা রাখার নীতির প্রত্যক্ষ শিকার ছিলেন এখানের বাসিন্দারা। ২০১৫-তে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি হয়, সাধারণ মানুষ স্বস্তি পান, ছিটমহলগুলি ভৌগোলিকভাবে যে দেশের মধ্যে আছে সেই দেশের রাজস্বগ্রামে পরিণত হয়। বিনিময় হয় ভূখণ্ডের, কিন্তু মানুষের বিনিময়? বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ভারতীয় ছিটমহলের ভারতীয় নাগরিকরা ভারতে চলে আসতে চান। এই চাওয়া শুধু হিন্দুদের পক্ষ থেকেই ছিল না, ছিল মুসলমানদের পক্ষ থেকেও। ৯২২ জন মানুষ সেই চুক্তিবলে ভারতে আসেন।[3] কিন্তু ভারতের মধ্যে থাকা বাংলাদেশি ছিটমহলের কোনও বাসিন্দা বাংলাদেশে যেতে চান না। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে। বাংলাদেশ থেকে আসা ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দাদের দিনহাটা, হলদিবাড়ি, মেখলিগঞ্জে আবাসনে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়। দাসিয়েরছরার মানুষদের অনেককেই প্রথমে দিনহাটা কৃষিবাজারের অস্থায়ী শিবিরে রাখা হয়, পরে তাঁদের জন্যে নির্মিত ফ্ল্যাটে। উল্লেখ্য, তাঁদের পরিবার-পিছু একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয় দিনহাটা-১ পঞ্চায়েতের নবনির্মিত আবাসনে।
৩১ জুলাই, ২০১৫ ছিটমহলের চুক্তির দিন যেন স্বপ্ন সাকার হওয়ার দিন। বহু আন্দোলনের শেষে জয়লাভ হল। দিনটি তারপর থেকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসাবে পালিত হয় সাবেক বাংলাদেশি ছিটমহলগুলিতে আর আবাসনে যথাক্রমে ‘ভারতীয়’ হওয়ার আর ‘ভারতভূমি’-তে আসার আনন্দে। কেমন আছেন ওঁরা, এই দশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে? বিষ্ণু বর্মন, নজরুল ইসলাম, খলিলুদ্দিনদের ‘দেশ’-এ ফেরা কেমন হল? ‘অনুপ্রবেশকারী’ তকমা থেকে কি মুক্ত হলেন তাঁরা?

খবর পেলাম দিনাহাটা আবাসনের ৭ জনকে আটক করেছিল হরিয়ানা পুলিশ বাংলাদেশি সন্দেহে। দক্ষিণ মশালডাঙ্গার একটি পরিবার দিল্লিতে থাকে, খবর এল তাঁরাও হয়রানির শিকার। খবর আরও ছিল, ১০ বছরে তাঁদের প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির খাতিয়ান দীর্ঘ। সে-প্রসঙ্গে অন্য লেখায় আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।
দিনহাটার এনক্লেভ সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে কথা হল হরিয়ানার বাহাদুরগড়ে ইটভাটায় কাজ করা শ্রমিক ও ঠিকাদার, অর্থাৎ লেবার কন্ট্রাক্টারের সঙ্গে। রবিউল হক, তাঁর স্ত্রী রশিদা বেগম আর তাঁদের নাবালক দুই ছেলে ও মেয়েকে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করা হয়েছিল। “প্রায় ২ বছর ওখানে কাজ করছি, এরকম কখনও হয়নি,” জানালেন রবিউল। পাশেই বসেছিলেন ঠিকাদার সামসুল হক।
প্রায় ৯ বছর আমি লেবার নিয়ে যাওয়ার কাজ করছি। ওপার থেকে যখন এখানে এলাম তখন এই কাজটাই ধরলাম। এবারে এখান থেকে ৮ জন লেবার নিয়ে গিয়েছিলাম। আবাসিকের লেবার ছিল, ছিল আশেপাশের গ্রামেরও। সেদিন বিকেল ৪টের সময় দিল্লি পুলিশের একটা টিম এল, বলল কাগজপত্র নিয়ে দিল্লির শালিমারবাগ থানায় দেখা করতে। আমরা কী কারণে যেতে হবে জানতে চাইতে জানাল ‘তোরা বাংলাদেশি কিনা তা দেখা হবে।’ কী করব, ৩ হাজার টাকা ভাড়ার গাড়ি নিয়ে পরের দিন থানায় গেলাম। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড দেখালাম, দেখল, মোবাইল ফোন জমা নিল।
রবিউল জানালেন,
কিন্তু রেসিডেনশিয়াল সার্টিফিকেট দেখাতেই অবাক হল। ‘ইয়ে ক্যা হ্যায়?’ আমরা আমাদের ছিটমহলি জীবনের কথা বলতে শুরু করলাম, বেশ অবাক হল। আমরা বললাম, আমরা ভারতীয় ছিলাম মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে, বাংলাদেশের ভিতরে। এখন এখানে এসেছি, মোদি-হাসিনার চুক্তির বলে। কী বুঝল কে জানে!
থানায় গিয়ে কতজন ছিল দেখলেন জানতে চাওয়াতে রবিউল বললেন, প্রায় শ-তিনেক হবেই। “বাংলাদেশি ছিল, জানেন?” বুঝলেন কী করে— জানতে চাওয়াতে বললেন, “প্রায় ৭ দিন ছিলাম, যারা বাংলাদেশি তারা নিজেরাই বলছিল, আমাদের দেশে পাঠিয়ে দিক, চলে যাব।”
“খুব ভয় পেয়েছিলাম,” জানালেন খলিলুদ্দিন।
না আমি যাইনি এবারে, কিন্তু আমিও লেবার হিসাবে কাজে যাই, এবারে গেলে যে কী হত? এখনও অনুপ্রবেশ শব্দটা আমাদের তাড়া করে বেড়ায়, জানেন তো? নিজ গ্রাম, পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে এইখানে এলাম। আমরা কোচবিহার রাজ্যের রাজার প্রজা ছিলাম, কোচবিহার ভারতে বিলীন হল, আমরাও হলাম, তবে বহু বছর বাদে, ১৯৪৭-এ হল না, হল ২০১৫-তে। কিন্তু আদৌ আমরা ভারতীয় হলাম কি?
ভারতবর্ষ হে
খুব মনে আছে সেই দৃশ্য। আমরা তখন বাংলাদেশের উত্তরপ্রান্তে। লালমনিরহাট জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। বৃদ্ধ শামসুল আলি আর বিমলচন্দ্র রায় আমাদের দেখাচ্ছিলেন, “ওই হেথায় ইন্ডিয়া।” এঁরা বাঁশকাঠা ছিটমহলের বাসিন্দা। অদূরে ভারত সীমান্ত আর তারপরেই অস্পষ্ট থেকে ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকা সবুজঘেরা একটা গ্রাম। শামসুল আলি ভারতে চলে আসতে চেয়েছিলেন। কেন ভারত, জানতে চাইলে বলেছিলেন— “ভারতই তো আমার দেশ। আমরা তো চেয়েছিলাম আমাদের ছিটমহল থেকে ভারতে যাওয়ার করিডর করা হোক। আমরা এখানেই থাকব আর মূল ভারতভূখণ্ডে যেতে-আসতে পারব।” ছিটমহল বিনিময় চাননি তিনি। “আর যদি একান্তই বিনিময় হয় আমি চলে যাব মূল ভূখণ্ডে, জানিয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময়ের ফলে তাঁদের ছিটমহল বাংলাদেশে বিলীন হয়ে যায়। শামসুল আলির আর ভারত আসা হয়নি।”
কিন্তু শামসুল আলির একদা ছিটমহল থেকে আসা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হল। সদ্য কৈশোর পেরোনো মুহম্মদ আলামিন, সূর্য মণ্ডল, আব্দুল হাকিম, মাকসেদুল মণ্ডলের সঙ্গে আলাপ হল সেই আবাসনেই। আবাসনের সিঁড়িতেই বসেছিল তারা। আলামিন ২০১৯ সালে মাধ্যমিক পাশ করেছে, সূর্য দিনহাটা কলেজে ইতিহাসের ফাইনাল ইয়ার। আব্দুল হাকিম ১২ ক্লাস পাশ, দিল্লির গাজিয়াবাদে সেলসম্যান হিসাবে কাজ করে গত দেড় বছর ধরে। কিন্তু ফিরে এসেছে, ভয় পাচ্ছে ফিরে যেতে। এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে এরা। কলেজপড়ুয়া, অভিবাসী শ্রমিক আজ এক কাতারে।
প্রতিবার ২১ জুলাই পালন করি আমরা ‘ছিটমহলের স্বাধীনতা দিবস’ হিসাবে, এই আবাসনে। ছিটমহলে থাকার সময় আমরা যখন পঞ্চগড়ে থাকতাম কিছু বাংলাদেশি আমাদের ১৫ আগস্ট পালন করতে বাধা দিত। শত বাধা সত্ত্বেও আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করতাম, তেরঙ্গা উত্তোলন করতাম, কোরাসে গাইতাম জাতীয় সঙ্গীত। ১০ বছর হল কোচবিহারে এলাম। এখন আমাদের আবার ‘বিদেশি’ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এবারের ২১ জুলাই এল যেন বড় ভয়ের বার্তা নিয়ে। আমাদের এখন বাইরে বেরোতেও ভয় লাগে।
জানাল আবাসনের সিঁড়িতে বসে থাকা আড্ডা।
অভিবাসী শ্রমিকদের এই বিপন্নতা কিন্তু রাজনীতিরই নির্মাণ। আমরা যদি আন্তঃরাজ্য অভিবাসী শ্রমিক আইন (Inter-State Migrant Workmen Act, 1979)-এর দিকে নজর দিই তাহলে দেখব অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা, রোজগার ও স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তার জন্যে যে যে নির্দেশগুলি দেওয়া হয়েছে তার কোনওটাই সঠিকভাবে পালন করেনি কোনও রাজ্যের সরকারই। আইন অনুসারে অন্য রাজ্যে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিক এবং সে-রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে থাকার কথা ছিল আর একটি স্তর, তা নিয়োগকারীর অথবা শ্রমিকদের ঠিকাদারের। আইন বলছে যে সংস্থা পাঁচজনের বেশি আন্তঃরাজ্য শ্রমিক নিয়োগ করছে, তার নথিভুক্তি করা দরকার। যে ঠিকাদার ভিনরাজ্যে শ্রমিক নিয়ে যাচ্ছে তারও নথিভুক্তি করা দরকার। এই আইন বাস্তবে প্রয়োগ করলে কোনও শ্রমিকের বৈধতা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে নিয়োগকারী বা মালিক-শ্রমিকের মধ্যস্থতাকারী সংস্থাকে তলব করা যেত। প্রশাসন নথিভুক্তির প্রতি দৃষ্টি দেয়নি, তাই দরিদ্র, প্রায় অর্ধশিক্ষিত শ্রমিকেরা বারেবারেই অন্য রাজ্যে ‘অপরাধী’ বলে গণ্য হয়ে চলেছে। সংশ্লিষ্ট রাজ্যটির বিকাশে তার অবদান নগণ্য করে তাকে গণ্য করা হচ্ছে বহিরাগত উপদ্রব বলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়্বেছে অধুনা রাষ্ট্রদর্শন যেখানে মুসলিম মানে ‘শত্রু’, হিন্দুরাষ্ট্রের শত্রু এই বোধ।
চালাকির কথা হল, মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টাকে বাঙালি তথা বাংলা ভাষার ওপর আঘাত বলে গুলিয়ে দিতে চাইছেন। বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ। ‘মুসলিম’ বলেই এই আক্রমণ বলতে সমস্যা কোথায়? অ্যাজেন্ডা তো তাই!
[1] Roy Chowdhury, Subha Protim. Survey Summary of 22 Enclaves and Exclaves in India and Bangladesh.
[2] ‘না-নাগরিকের নাভিশ্বাস’: ভারত-বাংলাদেশ জটিল মানচিত্রে অবস্থিত ছিটমহলের যাপনকথা, কষ্টকথা; মাসুম, ২০১৫।
[3] Singh, Shiv Sahay. 5 years after land border agreement, former enclave dwellers in dire straits. The Hindu. Aug 3, 2020.

