আলী তারেক
অনেকদিন পর রোকেয়াকে দেখে একটু নড়ে গিয়েছিল শাহেদ। নব্বই দশকের শুরুর দিক। পুষ্ট ঠোঁটে, নরম গালে সস্তা রং, আর কুড়ি-উত্তীর্ণ ভরাট শরীরে চকচকে রঙিন আঁটোসাঁটো পোশাক তো ছিলই, কিন্তু বেশি চমকে গিয়েছিল রোকেয়ার আগের সেই কুণ্ঠিত, মায়াময় চোখে ঠিক নির্ভীকতা নয়, একরকম ঔদ্ধত্য দেখে। আহত ঔদ্ধত্য। ঝলমলে লাল সিনথেটিক ওড়না রোকেয়ার বাড়ন্ত দেহরেখা ঢাকার বদলে প্রবলতর করে তুলেছিল। শুধু তার ছোট বোন রাবেয়ার পক্ষ হয়ে রোকেয়া যখন অভিযোগের মুখ খুলেছিল, তখন ওই অচেনা সাহস, শক্তি আর প্রতিবাদী ব্যঞ্জনার পেছনেও রোকেয়ার নিষ্পিষ্ট লাবণ্যের একটা ছোঁয়া এসে ছুঁয়েছিল শাহেদকে। একটু।
—রাবেয়ারে ইয়াসমিন আপায় মারে।
রোকেয়ার মদির দেহভঙ্গি আর প্রতিবাদী কণ্ঠের পেছনে লুকিয়ে থেকে ভীরু চোখে তাকিয়েছিল রাবেয়া। রোকেয়ার ছোট বোন। চার-পাঁচ বোনের সবচেয়ে ছোট। বয়স বারো-চোদ্দো বছর হলেও দেখে মনে হয় আরও কম।
—ইয়াসমিন?
শাহেদের গলায় অবিশ্বাস ছিল। রোকেয়ার কথায় অবিশ্বাস নয়, ইয়াসমিন কারও গায়ে হাত তুলতে পারে সেই ভাবনায় অবিশ্বাস। যে রোকেয়াকে শাহেদ চেনে সেই রোকেয়া মিথ্যা বলবে সেটা শাহেদের চিন্তায় আসবে না। ছোট রাবেয়ার উপর ততটা বিশ্বাস ওর নেই। কিন্তু অভিযোগটা যেহেতু রোকেয়ার মুখ থেকে এসেছে, তাই তাতে শাহেদ অবিশ্বাস করেনি। কিন্তু নিজের বোন ইয়াসমিনকে তো ও চেনে। রোকেয়ার কাছে অবশ্য সেই অর্থ পৌঁছয় না। শাহেদের কণ্ঠে প্রশ্নের আভাসকে রাবেয়ার অভিযোগকে মিথ্যা হিসেবে খারিজ করে দেওয়ার উদ্দেশ্য হিসেবে ধরে নেয়।
—এই, তুই ক, তোরে ইয়াসমিন আপা কী করসে। ক।
রোকেয়া পায়ে সস্তা চকচকে হাফ হিলের জুতায় আত্মবিশ্বাসী আওয়াজ তুলে পেছনে ঘুরে রাবেয়ার বাহু খামচে জোর করে সামনে নিয়ে আসে। রোকেয়াকে কখনও জুতা পরতে দেখেছে বলে মনে পড়ে না শাহেদের। মা কালেভদ্রে কখনও রোকেয়াকে কিছু কিনতে পাঠালে হয়তো পুরনো স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে অনভ্যস্ত পায়ে চট চট শব্দ তুলে অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে বাইরে গিয়েছে, আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছে।
যদিও সেই স্মৃতির উপরও শাহেদ খুব একটা নির্ভর করতে পারে না। নাহলে ওদের বাড়িতে যে ক-বছর কাজ করেছিল, রোকেয়ার ব্যক্তিগত কোনও সময় বা জায়গা যেমন ছিল না, তেমনি ওর পা দুটো অরক্ষিতই ছিল। রোকেয়ার মায়াভরা শরীর, দয়াভরা কণ্ঠস্বর, ভীরু চাহনি আর বিরল হাসির একটা সাধারণ পরিচায়ক ছিল কোমলতা। শুধু দীর্ঘদিনব্যাপী কাজের ভার, আর ঘন্টার পর ঘণ্টা বাথরুমের ভেজা মেঝেতে বসে কাপড় ধোয়ার কাজে রোকেয়ার পা দুটো, বিশেষ করে পায়ের আঙুলগুলোতে ঘা হয়ে খসখসে কর্কশ হয়ে থাকত। সেই পায়ে আজকে চুমকি বসানো, সস্তা লাল মখমলের ছই দেওয়া হিলজুতা। জুতার সামনের ফাঁক দিয়ে তিনটে করে আঙুলের ডগা উঁকি দিচ্ছে। সেখানে শাহেদের চোখে চট করে আগের সেই বিধ্বস্ত বিক্ষত দশা চোখে পড়ে না।
—ক!
রোকেয়ার গলায় বোনের প্রতি একটু ঝাঁঝ। বোনকে ধরে রাখতে পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে থাকা রোকেয়ার কামিজের বড় গলার ভেতর দিয়ে ওর উন্নত বক্ষের ঢাল চোখে পড়ে। শাহেদ রাবেয়ার দিকে চোখ সরায়।
রাবেয়া কালো রোগা খাটো শরীরের উপর ললিপপের মতো গোল মাথাটা সোজা রেখে একটু স্পর্ধাভরে শাহেদের দিকে একবার তাকায়, চোখের মণির নীচে পরিষ্কার সাদা অংশ জ্বলজ্বল করে। রাবেয়ার ভঙ্গিমায় শাহেদ একটু অবাক হয়। এই সকালবেলাতেই রাবেয়া শাহেদকে চা দিতে এসে বেশ আহ্লাদী গলায়, শাহেদ বাজারে গেলে যেন তার গায়ে মাখার সাবান নিয়ে আসে সেই তদবির করে গেছে। এখন শাহেদদের এক আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে এসে বোনকে পেয়ে হঠাৎ অপরিচিত বনে গেছে।
—ইয়াসমিন তোকে মারসে? শাহেদ জিজ্ঞেস করে। প্রশ্নটাতে বিস্ময়ের ভাগ যতটা কমানো যায় সেই চেষ্টা।
রাবেয়া চোখ নামায়।
—ক, রোকেয়া সাহস দেওয়ার জন্য বোনের কানের কাছে এসে এবার নরম করে বলে, তোর চুল টানে যে কস না ক্যা?
রাবেয়া শাহেদের হাঁটুর কাছাকাছি একটা জায়গায় চোখ রেখে ক্ষীণ কিন্তু তীব্রস্বরে বলে, ইয়াসমিন আফায় আমারে চুল ধইরা টানসে।
—ইয়াসমিন… শাহেদ বিড়বিড় করে।
আত্মীয়ের বড় মেয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনজনের থমথমে ভঙ্গি দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। কী হয়সে শাহেদ?
শাহেদ ফাঁকা চোখে একবার তাকায়। প্রশ্নটা কী বিষয়ে ছিল সেটা বুঝে ওঠার আগে রোকেয়া বলে ওঠে।
—রাবেয়ারে মারে। ইয়াসমিন আফায় মারে। খালাম্মায় মারে। বড় আফা…
শাহেদ সঙ্কুচিত বোধ করে, কানে ঝিমঝিম করে। আত্মীয়ের মেয়ে অপ্রস্তুত বাতাসের ভেতর থেকে কী একটা অজুহাত বের করে চলে যায়। শাহেদ ঘটনার ঘনঘটার দিকে চোখ ফেরায়। রোকেয়া অনড় দাঁড়িয়ে।
—আমি দেখব। শাহেদের দুর্বল গলায় শ্লেষ্মাজড়িত শব্দ বের হয়। ওর আশ্বাসে রোকেয়া আশ্বস্ত হয়েছে বলে বোঝা যায় না। শাহেদ একবার কেশে গলা পরিষ্কার করে বলে, রোকেয়া, আমি কখনও তোর গায়ে হাত দিসি?
এ-কথাটা বলার সময় শাহেদ এক পা সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। যে-মানুষটা এত বছর এক বাড়িতে ছিল, যার প্রতি এত সমবেদনা, এত সমব্যথা বোধ করে এসেছে, সে এভাবে বয়সের দূরত্ব, জীবনের পথে অজানা কিছুদূর চলার অধিকারে এভাবে শাহেদকে দূরে দাঁড় করিয়ে অভিযোগের বাণ ছুড়বে, সেই অসহায়তা কিছুটা কমাতেই এই কাছে চলে যাওয়া। রোকেয়া পিছু হটেনি। তবে সেই না হটা প্রতিবাদের নয়। চোখ সামান্য নামিয়ে, কণ্ঠ সামান্য নামিয়ে বলেছিল, না।
তাতে শাহেদ সরে আসেনি। ব্যথাতুর চোখে সামান্য নামানো রোকেয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল, সে চোখেও রং ছিল, কাজল নয়, মাসকারা বা সেরকম কিছু একটা। একটু পরে রোকেয়ার কঠিন চোয়াল একটু সহজ হল। নাকে, মুখে, গালে একটা ছোট কাঁপন তুলে আবার তাকিয়েছিল শাহেদের চোখে। তারপর যোগ করেছিল, জ্বি না ভাইয়া।
—আমি দেখব। প্রথম কথাটার পুনরাবৃত্তি করে শাহেদ তাড়াতাড়ি সরে গিয়েছিল, যাতে গলার উপর উঠে আসা দলাটা চোখে পানি হয়ে না আসতে পারে।
কারণ, এবার যে-চোখে রোকেয়া তাকিয়েছিল, একটা দিনের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল শাহেদের।
***
রাইতের বেলা কামকাজ শ্যাষ কইরা ঠান্ডা শানের মাইঝার উপর পুরান পাতলা তোষক পাইতা যহন শুই, পাশে সেগুনকাঠের খাটের উপর সাদা সিনথেটিক মশারির নিচে মোটা গদিতোষকের উপর আফারা ঘুমায়া, আমার খয়েরি রঙ্গের মশারি ফ্যানের বাতাসে নড়ে, খ্যাতে হারাদিন নাঙ্গলটানা গাইগরুর ন্যাকলা কেলান্ত শরীলে স্যাৎ কইরা চোখ বুইজা আসার আগে বাড়ির কতা মনে হরে। গেরামের বাড়িত মাটির মাইঝাতে রাতের বেলা গরম ত্যাতো বেশি না। তয় দিনের বেলা মা-এ আর বুইনগুলার যে কী গরমের মইদ্দে দিন যায়, আর বাপের কতা তো কইবারই পারুম না, খ্যাত থিকা যহন ফেরে, গায়ের চামড়া রোদে পুইড়া এমন চকচক করে য্যান বাপের পিঠের দিকে চাইয়া চিরুনি দিয়া চুল আঁচড়ানো যাইব। হেই কতা মনে পড়তে শুরু করলে এই আরামে আর আরাম পাওয়া যায় না। ঘুমখান আইসা বাচায়া দিয়া যায়।
ঘুমের মইদ্দে স্বপন দেহি না। কেলান্ত শরীলে চোখ বুজি, গুম আহে, হের পর আজান হুনি, খালাম্মায় ডাক দেয়। উইঠা পড়ি। স্বপন দেহি না।
সেদিন মনে হয় দেকলাম। দেকলাম না, বুজলাম। গায়ে-গতরে বুজলাম। নদীর পারে ফ্যানের ন্যাকলা বাতাস, শা শা কইরা শব্দ, হেই বাতাস মশারির ন্যাকলা আমার গায়ে আইসা লাগতাসে, তার মইদ্দে কেডায় আমারে দইরা আসে। আমার হাঁটুর উপর হের পা, আমার প্যাটের উপর হাত, আমার বাম কানে শ্যালো টিউবওয়েলের তোড়ের মতো নিঃশ্বাসের শন শন। আমার বাম কনুইর উপর কার বুকের ঢিব ঢিব। কিসু সুময় চুপ মাইরা যাই। আমারও বুক ঢিব ঢিব করে। কিসুক্ষণ খালি নদীর বাতাস, শ্যালো ইঞ্জিলের নৌকার মতন ধ্বক ধ্বক আওয়াজ। যহন বোজার চেষ্টা করতাসি এইডা কি স্বপন নাহি, সেই স্বপনের মইদ্দেই আমার নাঙ্গলের গরুর ন্যাকলা কেলান্ত শরীর সেই ঢিব ঢিবের মইদ্দে আবার ঘুমায়া পড়ে। খালি কহুন জানি সেই স্বপনের মইদ্দে ঘুমের মইদ্দে সেই কেডা জানি আমার মুখ নিয়া…
***
রোকেয়ার তখন বয়স হবে চৌদ্দ-পনেরো। আরও বেশিও হতে পারে। কিংবা কম। ওদের বয়স জানা কঠিন। অনুমান করা আরও কঠিন। তবু শাহেদের ষোলো-সতেরো বছরের উত্তুঙ্গ শরীর বলত ওই রকমই বয়স। চৌদ্দ বা পনেরো। শাহেদ যখন সকালে ঘুম থেকে উঠত, ততক্ষণে রান্নাঘরের অনেক কাজ হয়ে যেত। নাস্তা তৈরি, চা তৈরি। কাপড় কাচাও শুরু হয়ে যেত কোনও কোনও দিন। সব কিছুতেই মেয়েটার হাতের ছোঁয়া। আবার অনেক কিছুতেই ছোঁয়াটা যেন ঠিক ছোঁয়া হয়ে না দাঁড়ায় তারও চেষ্টা ছিল। থালা-বাসনগুলো ধুয়ে রেখেছে, কিন্তু শাহেদকে যে থালাটা দেওয়া হবে, সেটা নিয়ে মা কপাল কুঁচকে ময়লা খুঁজবে। ময়লা পাওয়া গেল কি গেল না, বিড় বিড় করে একটা অভিযোগের ধুয়া তুলে রান্নাঘর থেকে আরেকবার ধুয়ে নিয়ে আসবে।
সেই থালায় নাস্তা হবে। তারপর চা হবে, সে রোকেয়ারই করা, কিন্তু চায়ের কাপে মা আবার কিছু ময়লা খুঁজে পাবে।
কখনও কখনও সত্যি সত্যি কিছু পেয়ে যেত— বাসনে ময়লা কিংবা অন্য কোনও কাজে অন্য কোনও ভুল, বা গাফিলতি— সত্যি বা অনুমিত। কিংবা আর কারও ভুল, কিংবা নিজেরই ভুল, কিংবা কোনও ভুল নয় অন্য কোনও কারণে হতাশা বা বিরক্তি। তখন হাতের কাছে রান্নার কোনও হাতা, বা ক্রোধ আরও তীব্র হলে খুন্তি, বা রুটি বানানোর বেলনা নিয়ে, তীক্ষ্ণফলা ছুরির মতো গালি-মুখে রোকেয়ার পিঠে, বা আর কোথাও, শাহেদ কখনও দেখেনি, মা দেখাতে চায়নি বলেই হোক, বা শাহেদের পক্ষেও দেখা সম্ভব ছিল না বলেই হোক, জোরে বাড়ি, গুঁতো বা খোঁচা মারার সঙ্গে সঙ্গে রোকেয়া কিঁউ করে কেঁদে উঠত— কেঁদে ওঠার শব্দের তীক্ষ্ণতা, আর ব্যাপ্তিকাল নির্ভর করত অস্ত্রের প্রকার আর আঘাতের তীব্রতার উপর। তবে বাড়ির শব্দটা শাহেদ কখনও ঠিক শুনে উঠতে পারেনি, কারণ আঘাতের মুহূর্তে মা-র গালাগালির আওয়াজটা একটা উচ্চতায় পৌঁছে যেত, আর ঠিক তার পরেই রোকেয়ার কান্নার শব্দটা এসে আঘাতের আওয়াজটা ঢেকে ফেলত। শাহেদের অবশ্য ইচ্ছা করত থালিটা বা চায়ের কাপটা ছুড়ে মেঝেতে ফেলে দেয়। তার বদলে, দুই হাতের তালুতে কপালের দুপাশে রগ চেপে শক্ত হয়ে বসে থাকত কিছুক্ষণ। রোকেয়ার কান্নার শব্দ কমতে কমতে থেমে যাওয়া পর্যন্ত শাহেদ ভারী ভারী নিশ্বাস নিয়ে যন্ত্রণাটা নিয়ন্ত্রণে আনত।
সেদিন রোকেয়াকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। হাঁটুর নীচে বেশ বড় করে কেটে গিয়েছিল। কীভাবে কেটেছিল সেটা নিয়ে শাহেদ নিশ্চিত ছিল না। সকালে রান্নাঘর থেকে একাধিকবার মারের শব্দ এসেছে শাহেদের ঘরে। বিভিন্ন তীক্ষ্ণতায় আর বিভিন্ন ব্যাপ্তিকালে। কিছু ধ্বস্তাধ্বস্তি আর হাড়িপাতিলের ঠোকাঠুকির শব্দও এসেছে। একটা কিছু সেদিন মাকে বেশি জ্বালাচ্ছিল, বা যন্ত্রণা করছিল, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বভাবতই রোকেয়ার উপর দৈহিক আঘাতের আকারে পর্যবসিত হচ্ছিল। সকালের নাস্তার শেষে দুপুরের রান্নাবান্নার ক্রিয়াকলাপ শুরুর আগে যে একটা ছোট প্রশমতা চলে আসে, সেটি এল।
তারপর হঠাৎ আর একবার যখন রোকেয়ার কান্নার শব্দ ভেসে এল, সেটা ছিল একটু অন্যরকম। তাতে ভয়ের চেয়ে ব্যথার অংশটা বেশি ছিল। শাহেদ কিছুক্ষণ নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করে যখন দেখল যে কান্নার তোড় কমছে না, তখন উঠে গিয়ে দেখে রান্নাঘরের মেঝে রক্তে সয়লাব। আর ইয়াসমিন আর মা একটা পুরনো কাপড়ে সেই কাটা বাঁধার চেষ্টা করছে। একটা জগে করে পানি এনে যখন কাটার উপরে ঢেলে দেওয়া হল, তখন ইয়াসমিনের মুখে একটা বিকট ভয়ের শব্দ। শাহেদ তাকিয়ে দেখে, কাটার নিচে হাড় দেখা যাচ্ছে।
ইয়াসমিন মুখে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে শাহেদকে বলে, ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। সেলাই দিতে হবে। শাহেদের বুকের ভেতর তখন নানা ধরনের অনুভূতির ঠোকাঠুকি চলছে, কোন অনুভূতিটার আগে মুখোমুখি হবে সেটা ভাবতে ভাবতে ইয়াসমিন আবার তাড়া দেয়, তাড়াতাড়ি যা, একটা রিকশা ডেকে নিয়ে আয়। আমি ওকে নিচে আনতেসি।
শাহেদ লুঙ্গি পড়েই রাস্তার দিকে দৌড় দেয়।
***
আত্মীয়ের বাসা থেকে ফিরে শাহেদ নিজের বিছানার উপর বসেছিল অনেকক্ষণ। ইয়াসমিনের প্রতি অভিমান রাগ আর অভিমানের জের সামলে ওঠা। ইয়াসমিন বাসাতেই ছিল। হয়তো ড্রয়িংরুমে সিঙ্গল সোফার উপর পা তুলে বসে কোনও দলছাড়া ভাবনার গভীরে। এ সময়গুলো বোনদেরকে শাহেদের একটু দূরের মনে হত। দূরের মানুষ নয়, একটু অস্পৃশ্য, একটু অগম্য, কি একটা স্বচ্ছ পর্দায় ওদের চারপাশ ঢাকা, যেখানে শব্দ, দৃশ্য বা যে-কোনও বার্তা একটু ধীরে পৌঁছায়, একটু ভোঁতা হয়ে। একটু ঘোলা হয়ে। সেই অদৃশ্য আড়াল লঙ্ঘন করার মধ্যে শাহেদের কাছে অব্যাখ্যেয় একটা বাধা ছিল।
সেই কাছাকাছি বয়সেরই রোকেয়ার তো সে-রকম কোনও বিলাসিতার সুযোগ ছিল না। জাগ্রত প্রতিটা মুহূর্ত কোনও না কোনও কাজে লেগে থাকতে হবে। সোফা বা চেয়ার, বা বিছানা, রান্নাঘরের টুলের চেয়ে বেশি উচ্চতার কোনও জায়গায় বসারই তো কোনও ব্যাপার ছিল না। এসব ভেবে শাহেদের নিঃশ্বাস আরেকটু ঘন, আরেকটু দ্রুত হয়। এবার হাঁটুর উপর কনুই রেখে অপেক্ষা করে ইয়াসমিনের ধ্যান ভাঙার।
***
বাউরি বাতাসে পাল তুইলা নৌকা বাইয়া হুমরা বাইদা আইসিল মউয়ারে লইয়া বামনকান্দা গেরামে— দাদির কাসে গল্প হুনসি, ছোডোবেলায়। বেশি বুজি নাই, খালি মউয়ার লাইগা পরান ফাইটা কান্দন আইত। বুকের মইদ্দে হু হু কইরা বাউরি বাতাস বইত। হেই বাতাসে আমার খয়েরি মশারির পাল তুইলা কোন ঘাটে আইলাম। নদের চান আমারে দইরা শোয়। আমার গায়ে হাত বুলায়, মুখ বুলায়, আমার মুখে মুখ দিয়া মনে লয় আমান গিলা ফেলবার চায়। আমার খ্যাতের গরুর ন্যাকলা কেলান্ত শরীর লয়া আমি গুম আর স্বপনের মৈদ্যেখানে ঝকঝকা আলের উপর এলায়া হুইয়া থাহি। একখান পশমও লাড়াই না, য্যান হুমরা বাইদা নদের চানের লিগা যে বিষলইক্কা ছুরি আমার হাতে দরায়া দিসিল, সেই ছুরি নিজের বুকে ঢুকাই দিসি। খালি নদের চানের সোহাগে আমার জ্যান্ত-মরা শরীলখান য্যান ইচ্ছামতীর গা বাইয়া সুখের ঢেউয়ে কুলকুল কইরা ভাইসা যায়।
***
বেলা বেড়ে গিয়েছিল, গলির মোড়ে তাই কোনও রিকশা ছিল না। শাহেদ যখন মেইন রোডের দিকে ছুটছিল ওর মাথায় তখন রান্নাঘরের মেঝের রক্তলালের একটা ঝোড়ো তৈলচিত্র, তার ঠিক মাঝখানে যেন প্যালেট ছুরি দিয়ে সরিয়ে দেওয়া রঙের নীচে ক্যানভাসের বীভৎস সাদা রং— রোকেয়ার উন্মীলিত হাড়। কী সাদা! কী বীভৎস সাদা! আর তার ভেতরেই আরেকটা ভাবনা ওর মাথার ভেতরে ঢুকে পড়ে, বা বরাবরই ঢুকে থাকে এখন শুধু সময় বুঝে খাটের নীচ থেকে ঝটাত বের হয়ে এসে, অন্য এক আন্দোলন তৈরি করে। ইয়াসমিন কি সঙ্গে যাবে ডাক্তারের কাছে? নাকি ওকেই একা নিয়ে যেতে বলবে? একা যেতে হলে রোকেয়ার সঙ্গে রিকশায় বসবে শাহেদ। ওর সঙ্গে স্পর্শের ভাবনায় শাহেদের শরীর একটু কেঁপে উঠলে একটা রিকশার বেলের শব্দ আর একটা ডাকে শাহেদের ঘোর ভাঙে।
—কই যাইবেন স্যার?
রিকশাওয়ালা শাহেদের তীব্র তাড়া দেখে প্যাডেল মারার জন্য প্যাডেলের উপর দাঁড়িয়ে পড়েছে, কণ্ঠস্বরে সমব্যথী উদ্বেগ।
রিকশা নিয়ে বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখে ইয়াসমিন রোকেয়াকে নিয়ে নিচে চলে এসেছে। রোকেয়ার পায়ে কাপড় বাঁধা, কাপড় এরই মধ্যে রক্তে ভিজে উঠেছে, কয়েক ফোঁটা গড়িয়ে গোড়ালির দিকে বিভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে শুকিয়ে থমকে আছে— যেন রান্নাঘরের সেই রক্তিম চিত্রকর্মের একটা ক্ষুদ্র আর সহনীয়তর প্রতিকৃতি। রোকেয়ার পায়ে পুরনো স্পঞ্জের স্যান্ডেল, খসখসে আঙুলগুলো ব্যথায় একসঙ্গে চেপে আছে। শাহেদ রোকেয়াকে রিকশায় উঠতে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গিয়ে রোকেয়াকে কোথায় ধরবে কীভাবে ধরবে সেই ভাবনা পূর্ণ করার আগে ইয়াসমিন বলে, আমি উঠাচ্ছি, তুই লুঙ্গি চেঞ্জ করে আয়।
শাহেদ দৌড় দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে কয়েক সেকেন্ডে প্যান্ট পরে এসে দেখে রিকশা ছেড়ে দিয়েছে। হুডের ফাঁক দিকে পেছন দিয়ে মাথা বাড়িয়ে ইয়াসমিন চিৎকার করে বলেছিল, তুই আরেকটা রিকশায় আয়।
শাহেদ আর কোনও রিকশা পায়নি। দৌড়াতে দৌড়াতে চলে গিয়েছিল ডাক্তারের অফিস পর্যন্ত। দু-একটা রিকশা যে দূর থেকে দেখেনি তা নয়। কিন্তু তত দূর এগিয়ে গিয়ে রিকশা যাবে কি যাবে না সেই দরবার করে, জোরে চালাতে অনুরোধ করার পরেও রিকশাআলা কতটা কথা শুনবে, কতটা বুঝবে শাহেদের ব্যগ্রতা আর ব্যগ্রতার কারণ, সেই সব অনিশ্চয়তার চেয়ে দৌড়াতে থাকাকেই বেশি সমীচীন মনে করেছিল। শুধু মনে হয়েছিল স্যান্ডেল না পরে জুতা পরে এলে ভালো হত। দু-এক মিনিট বেশি লাগত, কিন্তু রাস্তার গর্ত, ড্রেন, পাশে বসা ফেরিওয়ালা, পথিক, যানবাহন, আবর্জনার স্তূপ এড়িয়ে দৌড়ানোটা সহজ হত। একই সঙ্গে এটাও বুঝেছিল যে ওই দু-এক মিনিট সময় দেওয়ার মতো মন ওর ছিলই না। এক— রাস্তাটা যে দৌড়ে পার হবে সেটা রাস্তায় নামার আগে ভাবেনি। আর যদি সেটা ভেবেও থাকত, তখন মনের যে ব্যগ্রতা, তাতে করে অত কিছু ভাবার পরেও ওই দু-মিনিট সময়, যেখানে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকা, সেটা মেনে নেওয়ার শক্তি হয়তো থাকত না। আর অবশেষে যে দৌড়াতেই হল, স্যান্ডেল পরে সেই সময়টা বেশিই লাগল, কিন্তু দৌড়েছে তো, এক জায়গায় স্থির হয়ে তো থাকেনি, তার কি যেন একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। রোকেয়ার ব্যথার যে রেশ, আর তার শুশ্রূষার জন্য যে ত্বরা, সেই ত্বরার উত্তরে শরীর সাড়া দিয়েছে তার ভেতর কোথায় যেন একটা অযৌক্তিক তুষ্টি আছে।
সেটা আবিষ্কার করে, হাঁপাতে হাঁপাতে নাভিশ্বাস উঠে গেলেও, নিজের উপর একটা রাগ হয়েছিল শাহেদের। মেয়েটার কষ্টে তার উদ্বেগের এই আতিশয্যের ভেতরও নিজের দায়িত্বপালনের ভূমিকাটা যথার্থ হল কিনা তার দিকে তার মনের এত নজর, সেই থেকে একটা অপরাধবোধ। অবশেষে, যখন ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছেছিল, নিঃশ্বাসের তুমুল দমকে ঘোলা হয়ে আসা চশমার কাচ খুলে রোকেয়াকে তার স্মৃতিতে প্রথম একটা চেয়ারে বসতে দেখে অদ্ভুত লেগেছিল। তারই ঠিক পাশের চেয়ারে ইয়াসমিন বসে, সেও এক আচানক দৃশ্য। কিন্তু তার চেয়ে বেশি অদ্ভুত ছিল রোকেয়ার চেহারায় ব্যথার অভিব্যক্তির অনুপস্থিতি। ওর হাতে একটা কোনও আইসক্রিম, নিশ্চয় ইয়াসমিন কিনে দিয়েছে। আগে কখনও রোকেয়া এই আইসক্রিম খায়নি সেটা ওর খাওয়ার ধরন দেখে বোঝা যায়, যদিও শাহেদদের বাসায় বহুবার কেনা হয়েছে, রোকেয়া কখনও পায়নি। চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়া দাগ গালে নিয়ে, যে দাগ ওই গালে বহুবার দেখেছে শাহেদ, কী ব্যাপারে রোকেয়ার মুখে একটু হাসির আভাস। ইয়াসমিনের দিকে তাকিয়ে দেখে, সে মুখেও তাই— একটা হাসির আভাস, আর একটা কী সন্তুষ্টি, মনে হল রোকেয়ার মনটা পায়ের ব্যথা থেকে সরাতে ইয়াসমিন কিছু একটা করেছে, আর সেটা কাজও করেছে, তাই এই সন্তুষ্টি।
চশমা খুলে দেখতে পাওয়ার জন্য শাহেদ অনেকটা কাছে চলে গিয়েছিল। যদিও রোকেয়ার পাশের চেয়ারটা খালি ছিল, শাহেদকে দেখে কাটা পায়ে রোকেয়া উঠে পড়তে শুরু করে, আর সেই কসরতের চাপে কাটা জায়গায় ব্যথা পেলে মুখ কুঁচকে গলা থেকে একটা চাপা আওয়াজও বেরিয়ে পড়ে। ইয়াসমিনের বকায় আর হাতের টানে আবার বসে পড়ে। অপ্রস্তুত শাহেদের শরীর তখন বাতাসের জন্য আকুলিবিকুলি, কিন্তু রোকেয়ার পাশের চেয়ারে বসা ওর পক্ষে নানা কারণেই সম্ভবপর নয়। তাই ওয়েটিং রুমের চারপাশটা দেখে নিয়ে উল্টো কোনার দিকে দুটো চেয়ার খালি পেয়ে বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে কোমরে হাত দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ওরই একটাতে গিয়ে বসেছিল।
***
—তুই নাকি রাবেয়াকে মারিস? চুল ধইরা টানিস?
সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে আসতে শুরু করলে অন্য ঘরে ইয়াসমিনের পায়ের ধীর আওয়াজ পাওয়া যায়। ডাইনিংরুমে আলো জ্বালেনি। সেই আবছা অন্ধকারের আড়াল রেখে শাহেদ বোনকে প্রশ্ন করে। শাহেদের হঠাৎ মনে হয়, রাবেয়া কাছাকাছি কোথাও আছে। কোথাও, কোনও দেওয়াল বা দরজার আড়ালে, বা এই ঘরের অন্ধকার আবছায়ার আড়ালেই লুকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে কান পেতে আছে। দুপুরে শাহেদের সঙ্গেই আত্মীয়ের বাসা থেকে ফিরেছিল। পথে কোনও কথা বলেনি শাহেদ। একটা অপরাধবোধ আর একটা সম্ভাব্য ভুল অভিযোগের মাঝখানে দোটানায় থেকে চুপ মেরে গিয়েছিল।
ইয়াসমিন তখন-তখন উত্তর দেয়নি। হয় সিঙ্গল সোফায় পা তুলে বসে যে দেশে চলে গিয়েছিল সে দেশ থেকে এখনও পুরোপুরি ফিরতে পারেনি, কিংবা অভিযোগের অসম্ভাব্যতায় কিছুটা মূক হয়েছে।
রাবেয়া শাহেদের কথা শুনছে সেটা জেনেই শাহেদ ওর প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে।
—তুই রাবেয়াকে মারসিস? চুল টানাটানি করিস?
এর মধ্যে সন্ধ্যা আরও নিবিড় হয়েছে। ইয়াসমিন সেই জড়তা ছেড়ে বলে, কী বলিস এসব? তারপর গলা উঁচিয়ে রাবেয়াকে ডাকে, রাবেয়াআআআ।
সঙ্গে সঙ্গেই কাছেই কোথাও থেকে রাবেয়ার গলা ভেসে আসে, হ আফা। নরম পায়ে দুজনের পাশে এসে দাঁড়ায়। অন্ধকারে কালো রাবেয়াকে দেখা যায় না, শুধু দেখা যায় ওর সাদা রঙের ফ্রক।
—লাইট জ্বালাস নাই কেন? ইয়াসমিন হালকা মেজাজে বলে।
রাবেয়া বিড়ালের মতো নিঃশব্দে দৌড় দিয়ে গিয়ে লাইট জ্বালায়। বিড়ালের মতোই কোথাও কোনও কিছুর সঙ্গে ধাক্কা লাগে না। আলোর ধাক্কায় তিন জোড়া চোখ একটু কুঁচকে যায়। যেন শাহেদকে ভালো করে বুঝতে পারছে না এভাবে তাকিয়ে ইয়াসমিন আবার জিজ্ঞেস করে, কী বললি তুই?
রাবেয়া এবার ইয়াসমিনের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রায় গা ঘেঁষে। ওর কালো মুখে কোনও অপরাধবোধ নেই, ভয় নেই, বরং সামান্য অনুযোগ। দুই ভাইবোন সেই মুখের দিকে তাকায়।
***
ইচ্ছামতী নদীত পানি বাড়ে, কমে। আবার বাড়ে, আবার কমে। আমার ঠান্ডা শানের নৌকায় খয়েরি মশারির পালে ফ্যানের বাতাস ওঠে, বাতাস নামে, নদের চান আন্ধারের ভিতরে আইসা আমার শরীলে হামলা দেয়, কেলান্ত শরিল আমার অপেক্ষায় থাহে। কুনদিন নদের চান আইব কুনদিন আইব না ট্যার পাই না। যেদিন আহে, কুনোদিন আমার স্বপনের ভিতরে ঢুইকা পড়ে, আমি মউয়া হয়া চানরে জড়ায়া ধরি, চান ধরা দেয়, হেই সুখত গুম ভাইঙ্গা যায়, আমি চানরে ছাইড়া দিই। শরীল ছাইড়া দিই। চান আমার গোটা শরীলে সুখের আগুন লাগায়া দিয়া চইলা যায়। আমি ঠায় হয়া হুইয়া থাহি, একহান পশমও লাড়াই না।
বিয়ানবেলা আজানের সুম খালাম্মার ডাকে গুম ভাংগে। হারাদিন ছেড়া কাপড়ে শরীলের উদলা উদলা জায়গার শরম আর পায়ের আঙুলে ঘায়ের ব্যাদনা নিয়া কাম কইরা কইরা হেই আগুন ঠান্ডা করি। নদের চান আমার ব্যাক দিক দিয়া ঘুইরা বেড়ায়, আমারে য্যান চেনে না। না, ভুল কইলাম। হেয় আমারে চেনে— এই রোকেয়ারে চেনে, হুমার বাইদার মিয়া মউয়ারে চেনে না। আমার চোখেত চোখ ফেলে না। আমি দেহি না হেয় আমার চোখেত চোখ ফেলে নাহি ফেলে না। আমি ফেলি না, কেমনে দেহুম হেয় ফেলে কি না? হের্ পরও আমার মন জানে হেয় ফেলে না।
হেই আটাশির বানে ইচ্ছামতি যহন ইচ্ছামতো ঘরবাড়ি ভাসায়া নিয়া গেসিল, তার পরের কয় মাস বানভাসি হয়া বাপ মা আর এক গাদা বুইনগুলারে নিয়ে এহানে ওহানে ঘুইরা মরলাম। তারপর একদিন আসমা খালা ডাহা শহরের এই চাকরির খবর আইনা দিল। ঘরবাড়ি গোয়ালগরু বেবাক হারানো বাপে আমার য্যান হাতে চান পাইল। হের পর তিন-চাইর বছর কাইটা গেসে, নদের চান একবারের লাইগাও আমার চোখে চোখ ফেলে নাই।
ক্যামনে ফেলব? নদের চানের তো হুমার বাইদার মাইয়া মউয়ারে লাগব। মশারি পালে ইচ্ছামতীর বাউরি বাতাস লাগায়া বামনকান্দার ঘাটে নামে যে মউয়া। হারাদিন গালাগালি আর লাথিগুঁতা খায়া চোখের পানি ফেলানো রোকেয়ারে লয়া হেয় করবটা কী?
***
ওয়েটিংরুমে বসে শাহেদ হাল আমলের কোনও নায়িকার ছবির প্রচ্ছদওয়ালা একটা সচিত্র পত্রিকা উল্টেপাল্টে দেখে। মাঝে মাঝে পত্রিকার উপর দিয়ে রোকেয়ার কাটা জায়গার দিকে চোখ চলে যায়, ব্যান্ডেজের উপর রক্তের রাজত্ব আরও পরিসর বাড়িয়েছে কি না বোঝার চেষ্টা করে। রোকেয়ার উরুর উপর রাখা ওর বাঁ হাতের উপর ইয়াসমিনের ডান হাত। সেটুকু সাহসের চালান করে দিয়ে ইয়াসমিন স্বভাবসুলভ কৌতূহলী চোখে ওয়েটিংরুমের বিচিত্র সব রোগী আর রোগীর সঙ্গী/অভিভাবকদের দেখে। শাহেদ ইয়াসমিনের চোখে অন্যদের দেখে, নিজে দেখে না।
ইয়াসমিন পা নাড়ে ঘনঘন। রোকেয়ার পাগুলো স্থির। কাটা পায়ে ব্যথা, কীভাবে নাড়বে। কিন্তু শাহেদের মনে হয়, পায়ে কাটা না থাকলেও রোকেয়া পা নাড়ত না। ওর চারপাশের দেওয়ালগুলো খুব চাপা, খুব ছোট ঠাসাঠাসি জায়গা, পা নাড়ার জায়গা নেই। কোনওরকম নড়াচড়ারই জায়গা নেই। অপ্রস্তুত চেয়ারটার উপর জবুথবু বসে মেঝের দিকে, যেখানে দেখার মতো কিছুই নেই, সেখানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে। চোখদুটোও যেন সেই ঠাসাঠাসি জায়গার ভেতর আটকা। ইয়াসমিনের স্বচ্ছন্দ চোখ পুরো ঘর ঘুরে যখন শাহেদের চোখে পড়ে, শাহেদের চোখে তখন প্রশ্ন, কীভাবে কাটল? ইয়াসমিন ঠোঁট হালকা চেপে মাথা ঝাঁকিয়ে না করে, আম্মা করে নাই। শাহেদ তার চোখে অবিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু তার আগেই রোকেয়ার ডাক পড়ে।
ডাক্তার চশমার উপর দিয়ে রোকেয়ার মুখ, ছেঁড়া জামা, পুরনো স্যান্ডেল আর পায়ের খসখসে ঘা দ্রুত জরিপ করে আসার কারণ জিজ্ঞেস করে। যদিও রোকেয়া ইয়াসমিনের হাতে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ব্যথাভরা মুখে ঘরে ঢুকেছে। ব্যান্ডেজটা খুলে একবার দেখে কম্পাউন্ডারকে ডাক দেয়।
—আইডিন দিয়া চাইরটা সেলাই দিয়া দাও আমজাদ। তারপর ইয়াসমিনকে লক্ষ করে বলে, ওই বেঞ্চিতে নিয়া শুয়ায় দ্যান। বলে সামনে থেকে একটা খাতা বের করে তাতে একটা কলম বুলিয়ে নিবিড় চোখে কিছু একটাতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেন।
—আপনি সেলাই দিবেন না? ইয়াসমিন জিজ্ঞেস করে।
—সেলাই-ফোঁড়াই তো আমজাদই করে।
—আগের বার শাহেদের কপালের সেলাই তো আপনিই করলেন।
—করসিলাম?
ডাক্তার রোকেয়ার দিকে আরেকবার তাকায়। তারপর ছাতা পড়া পাউরুটি মুখে পড়ে যাওয়ার মতো গলায় বলে, শাহেদকে করসিলাম…। ছাতা পড়া রুটি মুখে পড়ার অভিব্যক্তিতে হোক, বা শব্দদুটির উচ্চারণে অবজ্ঞার কারণে হোক, ইয়াসমিনের মুখভঙ্গি হঠাৎ পাল্টে গেলে ডাক্তার মাঝপথে থেমে যায়। তারপর বলে, আসলে একখান জরুরি কাজ পইড়া গেসে। আর আমজাদ কিন্তু আমার চেয়ে ভালো কাজ করে। বেঞ্চিটায় শুয়ায় দেন। আমজাদ, কাজটা ভালো কয়রা কইরা দাও।
ইয়াসমিন আর কথা না বাড়িয়ে বেঞ্চির দিকে এগিয়ে যায়। রোকেয়া বেশ ধ্বস্তাধস্তি আর আহ-উহ করে হাঁটু ভাঁজ করে খুব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে শোয়। দুই বাহু বুকের কাছে আড়াআড়ি করে আব্রু ঢাকে। আমজাদ একটা ট্রেতে করে সেলাইয়ের জিনিসপত্র নিয়ে আসে। স্টেনলেস স্টিলের ট্রের সঙ্গে স্টেনলেস স্টিলের ছুরি, কাঁচির বাড়িতে ঠুন ঠান শব্দ হলে ইয়াসমিন মুখ কুঁচকে দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়ানো শাহেদকে ডাক দেয়।
—তুই এদিক আয়। আমি দেখতে পারব না। বলে রোকেয়ার হাতে একটা হালকা চাপ দিয়ে ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। শাহেদ চুপচাপ এগিয়ে এসে একটু তফাতে দাঁড়ায়। রোকেয়ার চোখদুটো চেপে বন্ধ করা। ছোট বাচ্চারা যখন ঘুমানোর ভান করে সেইরকম লাগে। শাহেদের বুকের ধুকপুক বেড়ে যায়। ওদিকে ক্যাটকেটে নীল হাফশার্ট পরা মধ্যবয়স্ক আমজাদ নির্বিকার হাতে ট্রে থেকে টিংচার আয়োডিন লাগানোর কাঠিটা ভিজিয়ে কাটা জায়গাটা ঘষতে শুরু করে দেয়।
***
—তুই রোকেয়াকে কী বলসিস? ইয়াসমিন জিজ্ঞেস করে।
রাবেয়া মুখ নামিয়ে আরেকটু কাছে ঘেঁষে ইয়াসমিনের।
ইয়াসমিন রাবেয়ার ঘাড়ে হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয়। থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করে, তুই কী বলসিস? আমি তোকে চুল ধরে টানি? তারপর শাহেদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী বলসে রোকেয়া তোকে?
—তাই তো বলল। শাহেদ বলে। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে, যেন বলতে চায়— তুইও?
রাবেয়ার দিকে তাকিয়ে ইয়াসমিনের যেন কিছু একটা মনে পড়ে। তারপর একটা অবিশ্বাসের হাসি হাসে। শাহেদের দিকে তাকিয়ে বলে, হ্যাঁ টানি তো। ওর চুল বাঁধে কে? চুলে তেল দিয়ে দেয় কে? আমিই তো দিই। তখন তো চুল টানতেই হয়। বলে রাবেয়ার দিকে তাকায়। রাবেয়ার চোখ এখন মেঝের দিকে।
—তুই কীভাবে এই কথা বললি রাবেয়া? হ্যাঁ? বল আমাকে!
সন্ধ্যার একটা ঝিঁঝিঁপোকা শব্দ করে উঠলে শাহেদ ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। শরীরের উপর থেকে কী যেন একটা ভার হঠাৎ করে সরে গেছে। আর সেই নির্ভারতাই যেন আরেক ভার হয়ে বসে শাহেদের শরীরে। চেয়ারে বসে এবার রাবেয়ার দিকে তাকায়। বারো-তেরো বছর বয়সের মেয়েটা, যাকে নয়-দশ বছরের বেশি মনে হয় না, যে মেয়ে বাবা মা ভাই বোন গোটা একটা গ্রাম ছেড়ে দিয়ে এইখানে অনাত্মীয় অপরিচিত বাড়িতে উদয়াস্ত খাটে, সেই বাড়িতে যে মানুষটার গায়ে ওর জন্য সবচেয়ে বেশি মায়া, তার নামে অপবাদ দিয়ে বহুদিন পর দেখা হওয়া বড় বোনের কাছে করুণা পাওয়ার জন্য সত্যের সঙ্গে মিথ্যাকে মেশাল, তার প্রতি রাগ হবে নাকি হবে না, সেটা ঠিক করে উঠতে পারে না শাহেদ।
ইয়াসমিন কোমরে হাত দিয়ে রাবেয়ার থেকে দুই কদম দূরে দাঁড়িয়ে। রাবেয়া মেঝে থেকে মাথা তুলে অনেকটা পথ বেয়ে ইয়াসমিনের চোখের দিকে তাকায়। তারপর সেই চোখে চোখ রেখেই ওই দু-কদম পার হয়ে এসে বলে, আমি আপনাকে চাই।
ইয়াসমিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, যা ভাত চড়া, যা। রাবেয়া রান্নাঘরে ঢুকে গেলে, ইয়াসমিন ফিসফিস করে শাহেদকে বলে, রোকেয়া সম্পর্কে একটা কথা শুনলাম।
—কী কথা?
***
আমার শরীলে যহন জোয়ার ভাটা শুরু হয়, তহন ইচ্ছামতীর জোয়ার ভাটা আমার বোঝা সারা। কুন্ সুম পানি বাড়ে, কুন্ সুম নামে, আমার শরীল দিয়া কইতে পারতাম। অহনে এই ডাহা শহরের বামনকান্দা ঘাটে আমার নদের চান কোন জোয়ারে আসে কোন ভাটায় চইলা যায় সেই হিসাবও একসুম বুইজা ফেলসি। আইজকা হেই রাইত। আমার গা ছমছম করে।
ফ্যানের শা শা বাতাসের ভিতরে মশারি জোরে নইড়া ওঠে। আমি থম মাইরা যাই। মশারি তুইলা ঢোকে চান, ফ্যানের বাতাসের থিকা জোর বাতাস চানের নিঃশ্বাসে, তার ক্ষুধার ওমে ঘর জ্বইলা যায়। আমারে হাপটায় ধরে। এ ছিঃ, চানের গাও দেহি পুরা উদলা! আমার ঠোঁট যেন কুইশাল, চুইষা ছোবড়া বানায় দেয়। হের বুকের ঢিবঢিবিতে মনে অয় বাড়ির ব্যাককের ঘুম ভাইঙ্গা যাইব। চান হামাগুড়ি দিয়ে নীচে চইলা যায়। কাঁপা কাঁপা হাত দিয়া আমার পাইজামার নাড়া উটকায়। আমার হাত দুইখান হ্যারে থামাইবার লাইগা উইঠা যাইবার চায়, জোর কইরা থামায় রাহি। চান আন্ধারের মইদ্দে কেমনে যেন নাড়া খুইলা ফেলে, আমি দম বন্দ কইরা পইড়া থাহি। আমার পাইজামা টাইনা পায়ের কাসে জড়ো করে। আমার বুক কেদোর মইদ্দে পড়া সাইতান মাসের ন্যাকলা ধড়ফড় করে। তয় চান তর তর কইরা আরো নীচে যায়। আমার পায়ের ঘা-ধরা খসখসা আঙুলগুলান ঠোঁট দিয়া ঘইষা দেয়, চানের নিঃশ্বাসের ওমে আমার পায়ের পাতা জ্বইলা যায়।
হের পর উদলা চান উইঠা আসে আমার গায়ের উপর, আর পারি না গুমের ভান করতে, হাঁটু ভাঁজ কইরা আমার উদলা কোমর বাঁচানোর চেষ্টা করি। চান চাপ দিয়া হাঁটু নামায়া দেয়। আমি আবার হাঁটু ভাঁজ করি, আবার নামায়া দেয়। আমি আবার উঠাই। এবার হে হাত দিয়া না নামায়া গোটা শরীল দিয়া আমার শরীলের উপর হুইয়া পড়ে। চানের নিঃশ্বাসে আমার গাল, নাক, মুখ জ্বইলা যায়। তার মদ্দেই কুন্ হান থিহা যেন পানির সোরত আইসা চোখ দিয়া নাইমা আমার গাল ভাসায়া দিয়া যায়। সেই সোরতে ইচ্ছামতীর জোয়ারভাটা আমার শরীল বাইয়া নদের চানের উদলা শরীলে গিয়া মিশ্যা যায়। আমি বামনকান্দার ঘাট ছাইড়া ইচ্ছামতীর শরীলে ঝাঁপ দিবার চাই, কিন্তু ইচ্ছামতী গেল কই, এইডা তো গাং, আজদাহার ন্যাকলা কালো মিশমিশা গাং, এর কুনো তীর দেহি না, কোনও কুলকিনারা খুঁইজা পাই না। গহীন দরিয়ার মইদ্দে ঢেউয়ের মাতায় চইড়া কুন্ আন্ধারের ভিতর ভাইসা চইলা যাই।
***
আমজাদের চর্মসার আঙুলে ধরা নতুন চাঁদের মতো বাঁকা কালো সুইয়ের প্রথম ফোঁড়ে রোকেয়ার গলায় হেঁচকির মতো একটা শব্দ উঠতে গিয়ে মাঝপথে থমকে যায়। একপ্রস্থ কাপড়ের নীচে অন্তর্বাসবিহীন অরক্ষিত স্তনযুগলের রক্ষায় আড়াআড়ি বাহুদুটো আরও চেপে বসে। কুঁচকানো চোখের দুই কোণে এক ফোঁটা করে পানি জমে চোখের পাপড়িতে আটকে থাকে।
—মাইয়া শক্ত আছে। আমজাদ মোটা কালো সুতা টান দিয়ে সোজা করে বলে।
দ্বিতীয় ফোঁড়ে রোকেয়ার গলায় হু হু করে একটা শব্দ হয়। ডানচোখের পানির ফোঁটাটা বড় হতে হতে বাদলবাতাসে গাছপাকা পেয়ারার মতো পাপড়ি থেকে টুপ্ করে খসে পরে। কপালের পাশ দিয়ে গড়িয়ে কানের উপর হালকা জুলফিতে আটকে যায়। রোকেয়া দুই হাতে দুই বাহু খামচে ধরে। শাহেদ নিজেকে খেয়াল করে নিঃশ্বাস ধরে আছে। আধ পা এগিয়ে, হাতদুটো প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে সাবধানে শ্বাস ছাড়ে।
তৃতীয় ফোঁড়ে এমন কি রোকেয়ারও শক্তির বাঁধ ভাঙে, একটা সংক্ষিপ্ত বিলাপ শাহেদকে রান্নাঘরের হাতা, খোন্তা, বেলনার কথা মনে করিয়ে দেয়। রোকেয়া এবার নিজের বাহু ছেড়ে বাঁ হাতটা ঝট করে নিজের কোমরের পাশে বেঞ্চিতে রাখে। সেখান থেকে ছয় ইঞ্চি দূরে দাঁড়িয়ে শাহেদ। জোরে জোরে বারদুয়েক শ্বাস ফেলে রোকেয়া মাথা ঘুরিয়ে ঘোলাটে চোখে শাহেদের দিকে তাকায়। তারপর ভেজা চোখে ঠোঁটে একটা কাঁপন তুলে বিড়বিড় করে বলে, নদের চান।
—কী বললি? শাহেদ বহুদিন পর রোকেয়ার চোখের দিকে তাকায়। রোকেয়াও তাকিয়ে আছে, মুখের নানান প্রান্তে কষ্টের কাঁপুনি। শাহেদের ভেতর একটি কিছু ভেঙে যেতে শুরু করে।
আত্মীয়ের বাসায় রোকেয়ার সঙ্গে যখন অনেক বছর পরে দেখা তখন এইভাবে রোকেয়া শাহেদের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। বলেছিল, জ্বি না ভাইয়া।
আমজাদ শেষ সেলাইয়ের জন্য সুই তুলে ধরে। শাহেদের ছয় ইঞ্চি সামনে বেঞ্চির উপর রোকেয়ার বাঁ হাত, আসন্ন ব্যথার আশঙ্কায় মুষ্টিবদ্ধ। শাহেদের খুব ইচ্ছা করে হাতটা ধরে। বেঞ্চির নীল রেক্সিনের রঙের মতো নীল রঙা হাফশার্ট পরা আমজাদ তখন একহাতে রোকেয়ার পা চেপে ধরে আরেক হাতে সুইটা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
***
ইয়াসমিন শাহেদকে নিয়ে ওর ঘরে যায়। দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানার উপর বসে।
—রোকেয়াকে কেমন দেখলি?
শাহেদ ইয়াসমিনের এই হঠাৎ ঔৎসুক্য আর এই লুকোছাপার ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারে না। তবু ইয়াসমিনের কাছে রোকেয়ার সাজপোশাকের পরিবর্তনের কথা বলে। সস্তা মেকাপের কথা বলে। চুমকি লাগানো লাল হাফ হিলের কথা বলে। জুতার ফাঁকে বের হয়ে থাকা তিনটি করে পরিষ্কার, মসৃণ আঙুলের কথা বলে না। শাহেদের দিকে চোখ তুলে তাকানোর কথা বলে না।
ইয়াসমিন শাহেদকে বলে রোকেয়া সম্পর্কে সে কী শুনেছে। রোকেয়া নাকি এখন বেশ্যাদের সর্দারনী। গ্রাম মফস্বল থেকে মেয়ে নিয়ে আসে ঢাকা শহরে, ব্যবসা করে। তাই এত সাজ, তাই এতটা জোর। আরও কী কী বলতে থাকে ইয়াসমিন। কিন্তু শাহেদের বুক ধক করে ওঠে, সেদিন রোকেয়ার পায়ের কাটাটা সেলাই করবার সময় যেভাবে ওর নিজের বুক চারবার ধক ধক করে উঠেছিল। ইয়াসমিনের কথা আর কানে যায় না, মনটা কেমন ঘোলাটে হয়ে যায়। একটা ভয়ঙ্কর ঝড় দানা বাঁধতে থাকে। সেই ঝড় সামলে উঠতে অনেকটা সময় লাগবে শাহেদের। তাই পূর্বাভাসের শো শো শব্দ তাণ্ডবের গর্জনে পরিণত হওয়ার আগে একবার ভাবতে চায়— সেদিন ওর ছয় ইঞ্চি দূরে নীল রেক্সিনের উপর মুঠো করে শুয়ে থাকা ওই সহায়সন্ধানী হাতটা যদি ধরত শাহেদ? তাহলে কী হত?
***
রোকেয়া এখন কোথায় কে জানে। আমজাদ কম্পাউন্ডারের সুই-এর নীচে শুয়ে শাহেদের চোখের দিকে তাকিয়েছিল, ব্যথার আগুনভরা চোখে। সেই দৃষ্টির কথা মাথায় এলে, বারবার একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে যায় শাহেদের।
তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই? কেমন হবে, আমিও যদি নষ্ট মেয়ে হই?

