পূবালী ও তার প্রিয় কবি

প্রতীক

 

 

আজও হবে না। গত সপ্তাহে হয়নি, কারণ ধনেখালিতে মালগাড়ি বেলাইন হয়ে গিয়ে বেশ খানিকক্ষণ ট্রেন বন্ধ ছিল। লাল বাড়িই ঢুকল রাত সাড়ে বারোটায়, ক্লান্ত শরীরে খিদে তেষ্টায় কাহিল হয়ে। পরদিন সকাল থেকে টুনির ধুম জ্বর। সোমবার লাল চলে যাওয়ার পরেই কিন্তু ওর শরীরটা ঠিক হতে শুরু করল, মঙ্গলবার থেকে স্কুলেও যাওয়া শুরু করল। মাঝখান থেকে যতক্ষণ লাল ছিল, মেয়েটা এক মুহূর্ত মাকে কাছছাড়া করল না, সোমবারে নিজের সঙ্গে মায়ের স্কুলটাও কামাই করিয়ে দিল। তার আগের সপ্তাহেও হয়নি, কারণ লাল আসেনি। সেই শুক্রবার রাতে পূবালী যখন শুয়ে শুয়ে শনিবার রাতের কল্পনা করছে (কারণ টুনির সেদিনটা দিদুর কাছে থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল), তখনই লাল ফোন করে জানাল, মঙ্গলবার সিএম আসছেন, বুঝলে? এখানে মিটিং করবেন। বেশ কিছু কাজ মিটিয়ে রাখতে হবে। কাল সারাদিন কাজ না করলে আর টাইম পাব না। তাই কাল আর যাচ্ছি না। রোববার সকাল সকাল চলে যাব। এমন সহজভাবে বলল, যেন জানে না যে পূবালীর স্কুলে একটা চাকরির পরীক্ষার সিট পড়েছে, রবিবার ভোরে বেরিয়ে যেতে হবে ওকে। সারা সপ্তাহ হিন্দমোটর থেকে নৈহাটি ডেলি প্যাসেঞ্জারি করার পর রবিবারেও ও জিনিস করতে হলে রাতে বাড়ি ফিরে যে মানুষ নয়, ছিবড়ে পড়ে থাকে— সেটা লাল বোঝে না?

আগে পূবালীর রাগ হত। ইদানীং মনে হয়, লাল সত্যিই বোঝে না। নইলে আজও এই কাণ্ড করত? টুনির আজ ভোরে পূবালীর বোন-ভগ্নীপতির সঙ্গে সিমলা বেড়াতে যাওয়া ঠিক হয়েছিল অনেকদিন ধরে। শাশুড়িও মেয়ের বাড়ি গেছেন, জামাইষষ্ঠীর আগে ফিরবেন না। বাড়ি খালি। দুজনে একা থাকার এমন সুযোগ বহুবছর মেলেনি। ব্যাপারটা লাল যে জানত না তা তো নয়। অথচ কাল সন্ধেবেলা বাড়ি ঢুকে মোজা খুলতে খুলতেই উল্লসিত হয়ে বলল, ভূপেন আর ওর বউকে কাল দুপুরে খেতে বলেছি, বুঝলে? ওদের বিয়ে হয়েছে ছ-মাস হয়ে গেল। এরপর তো বাচ্চা কোলে খেতে আসতে হবে। পূবালীর অন্ধকার মুখ দেখে আশ্বাস দিয়ে বলল, আরে তোমার কোনও কষ্ট হবে না। আমি চা-টা খেয়ে নিয়ে এখনই বাজার করে আনছি, সকাল হলেই রান্নাবান্না শুরু করে দেব। তুমি শুধু রীনাদিকে সবজি-টবজিগুলো কেটে দিতে বোলো। রান্নার হাত যে লালের অসম্ভব ভালো তাতে সন্দেহ নেই, নিজে হাতে বাজার না করলে ও রেঁধে শান্তিও পায় না। ফলে পূবালীকে কুটোটাও নাড়তে হবে না। কিন্তু এতদিন পরে একটু স্বামী-স্ত্রীতে থাকার সময় পাওয়া গেছিল, সেটাও নববিবাহিত সাবর্ডিনেটকে নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে নষ্ট করতে হত? শঙ্করলালের মন দখল করার আশা তো অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছে পূবালী, অন্তত শরীরের দাবিটুকু যে মেটানো দরকার— সে বোধও নেই লোকটার। শাশুড়ি ছেলের প্রশংসা করতে গিয়ে অনেককেই বলেন, অর জ্যাঠায় ভোলানাথের নামে নাম রাখসিল তো, পোলায় নামের দাম রাখসে। অ্যাক্কেরে সোজা মানুষ, মনে কোনও প্যাঁচঘোচ নাই। পূবালী শুনতে পেলেই মনে মনে বলে, আজ্ঞে না। কুমারসম্ভবের শিবের মতো আদর করার ক্ষমতাও ওর নেই, আর শিবঠাকুরের মতো বউ মরে গেলে দক্ষযজ্ঞ লাগিয়ে দেওয়ার লোকও ও নয়। ওর নাম হওয়া উচিত ছিল নির্বোধলাল।

অথবা উভয়সঙ্কট। মাথাটা যখন ঠান্ডা থাকে তখন স্বামীকে মনে মনে এই নামেই ডাকে পূবালী। উভয়সঙ্কট সামন্ত। বেশ লাগে শুনতে। পূবালীর কাছে ও তো উভয়সঙ্কটই। লোকটা একেবারে বাজে হলে কোনও সমস্যা ছিল না। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই যদি মদ গিলে বাড়ি ফিরত, বউ কিছু বলতে গেলে চুলের মুঠি ধরে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিত, তাহলে পূবালী ব্যাগপত্তর গুছিয়ে বাপের বাড়ি চলে যেত চিরতরে। ঝামেলা মিটে যেত। চাকরি করা মেয়ের তো আর ভরণপোষণের চিন্তা নেই; আবার বিয়ে হলে হত, না হলে না হত। লাল নিপাট ভালোমানুষ হওয়াতেই হয়েছে বিপদ। বাড়িতে থাকতে বউয়ের মাথা ধরলেই সে ডাক্তার ডাকতে চায়। সপ্তাহান্তে বাড়ি এসে বউয়ের শরীর কোনও কারণে সামান্য খারাপ দেখলেই কোনও কাজ করতে দেয় না। বাসন-টাসন সব মেজে ফেলে, কাজের লোক কামাই করলে ঘর ঝাঁট দেওয়া-মোছার কাজটাও করে। টুনি পেটে থাকার সময়ে যা যত্ন করেছিল তাতে পূবালীর শাশুড়ির তো বেশ গোঁসা হয়েছিল। জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির মাসিমাকে একদিন বলেছিলেন, আজকাল তো মেয়ে হইয়া জন্মাইছ কি মাথা কিন্যা নিছ। আমাগো কালে তো এমন হয় নাই… তিনখান পোলা, একখান মাইয়ার জন্ম দিছি। শাশুড়ি-ননদরা একটা দিনও জিগাইছে কী খাইতে সাধ হয়, কোনও কষ্ট হইতাছে কিনা? কেউ একখান কাজ কইর‍্যা দিছে? অ্যাত্তো বড় পেট নিয়া ঘরের কাজ, রান্নাবান্না সবই করছি। আর এহন আমাগো বাড়িতে যা চলতাছে… নাটক কইলেও ঠিক হয় না। অ্যাক্কেরে সিনেমা।

কিন্তু বউ সুস্থ থাকলে দুটো মিষ্টি কথা বলা, বাড়ির সকলের চোখ এড়িয়ে এসে একটু জড়িয়ে ধরা, বিকেলের দিকে বউ-মেয়েকে নিয়ে কাছেপিঠে ঘুরতে বেরোনো— এসবে কোনওদিন লালের উৎসাহ নেই। পূবালী বিয়ের দেড় বছরের মাথায় একবার রেগে গিয়ে লালকে বলে ফেলেছিল— সব বিয়েতেই একটা হানিমুন পিরিয়ড থাকে। শুধু আমার বিয়েতেই দেখলাম প্রথম দিন থেকে কেবল দায়িত্ব আর দায়িত্ব। ওই একবারই। কারণ এ-কথায় লাল যে উত্তর দিয়েছিল তাতে সেদিনই বোঝা হয়ে গেছিল এই লোকটাকে কিছু বলেই কোনও লাভ নেই। বলেছিল— বিয়ে তো দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার জন্যেই করে।

পূবালী তারপর ভেবেছিল লাল বোধহয় সমকামী। বাড়িতে বলে উঠতে পারেনি, তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিয়ে করেছে। কিন্তু তা যে নয় তার প্রমাণ পাওয়া যেত। কালেভদ্রে। পূবালী ভেবেছিল হয়তো লাজুক লোক, যত দিন যাবে তত স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠবে। তখন ব্যাপারটা আর কালেভদ্রে থাকবে না। কিন্তু সে পরিবর্তন আর হল না। তাছাড়া যে ভাইপো-ভাইঝি-ভাগনিদের সঙ্গে আদিরসাত্মক ইয়ার্কি মারতে পারে সকলের সামনে, তাকে লাজুকই বা বলা যায় কী করে? এই পরিবারের ছেলেমেয়েরা তো সব ছোটকা বলতে অজ্ঞান। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে বড়দা, মেজদা, ছোড়দারা এ-বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পরেও তাদের ছেলেমেয়েরা খোঁজ রাখে— নেক্সট উইকেন্ডে ছোটকা বাড়ি আসছে কিনা। তাদের সব ব্যক্তিগত শলাপরামর্শ ছোটকার সঙ্গে। যেসব আবদার বাবা-মায়ের কাছে করতে পারে না সেগুলোও ছোটকার কাছেই করে। এমনকি পূবালীর ননদ টুকু আর ওর বর দেবরাজের অমতে সিডিউলড কাস্ট ছেলেকে বিয়ে করল ওদের একমাত্র মেয়ে, সে-বিয়েতে সাক্ষী হিসাবে সই করল মামা শঙ্করলাল সামন্ত আর মামি পূবালী সামন্ত।

ফলে এই লোককে ঘৃণা করাও যায় না। উভয়সঙ্কট। অগত্যা পূবালী অবজ্ঞা করতে শিখে নিয়েছে।

মাসের পর মাস হাতটা পর্যন্ত ধরেনি? ধরেনি।

কোনও আলোচনা না করে ছোড়দার ধেড়ে ছেলেকে লেটেস্ট মডেলের আইফোন কেনার টাকা দিয়ে দিয়েছে? দিয়েছে।

কোনও সপ্তাহে ফোন করে বলেছে, এ-সপ্তাহে খুব খাটনি গেল। বড্ড টায়ার্ড লাগছে। এবারটা যাচ্ছি না। পূবালী তাতেও আচ্ছা বলে ফোন কেটে দিয়েছে।

পুজোর সময়ে দাদা, বৌদি, বোন, ভগ্নিপতি, ভাইপো, ভাইঝি, ভাগ্নি, মা আর টুনির জন্যে জামাকাপড় কিনে এনেছে; সব ঘটা করে দেখানোর পর জিভ কেটে বলেছে, এ হে! পুবুর জন্যে তো কিছু কেনা হয়নি! হয়নি। পূবালী নিজের জন্যে, টুনির জন্যে, শাশুড়ির জন্যে আর লালের জন্যে যা কেনার তো কিনেই রেখেছিল।

যখন মনের ভার এত বেশি হয়ে যায় যে কিছুটা না নামালে দম আটকে আসে, তখন সহকর্মী সঞ্চয়িতা আর অগ্নিমিত্রাদির সঙ্গে স্কুল ফেরত কোন্নগরে নেমে পড়ে কফিহাউসে পরপর ৩-৪ গ্লাস কোল্ড কফি খেয়েছে পূবালী। বলেছে, আমি ভাবি, লোকটার বিয়ে করার কী দরকার ছিল? যদি আমাকে দাসী-বাঁদীর মতো খাটাত, তাহলেও নয় কথা ছিল। কিন্তু নিজের সব কাজ তো নিজেই করে। কোনওদিন এক গ্লাস জলও চায়নি আমার কাছে। তাহলে?

—আরে এটা একটা টাইপ। এরা এরকমই হয়, অগ্নিদি সান্ত্বনা দিয়েছেন। মায়ের বাধ্য ছেলে তো, মা বিয়ে করতে বলেছে তাই করে নিয়েছে।
—এ আবার কী কথা? বউ হবে আমার, আর বিয়ে করব মায়ের কথা শুনে? মেয়েদের কথা না হয় কোনও ফ্যামিলিতে শোনা হয় না। একটা ছেলে বলতে পারে না, আমি বিয়ে করতে চাই না?

সঞ্চয়িতার পেটে পেটে দুষ্টু বুদ্ধি। বলে, সে যা-ই বলো, লালদা কিন্তু মানুষ খারাপ না। যতবার দেখা হয়েছে, কী সুন্দর ব্যবহার। মুশকিল তোমাকে নিয়ে।

—মানে! আমার কী দোষ?
—দোষ না। তোমার সুড়সুড়ি বেশি আর কি। লালদা তাল দিয়ে উঠতে পারে না।
—ভ্যাট… পূবালী লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
—মাক্কালি বলছি। আমার বর যদি লালদার মতো হত, আমি বেঁচে যেতাম। জামাকাপড়ের চয়েস ভীষণ খারাপ, এদিকে রেগুলার আমার জন্যে কিছু না কিছু কিনে নিয়ে আসবে। আমাকে নিয়ে গিয়ে কিনলে আমি নিজের পছন্দমতো কিনতে পারি, তা না। সবসময় সারপ্রাইজ দিতে চায়। অবশ্য ক্যাশমেমোগুলো হারায় না। তাই নিয়ে আমাকে প্রতিবার পালটাতে দৌড়তে হয়। আর সুড়সুড়ি এত বেশি… বাপ রে বাপ! দিন নেই রাত নেই, বেডরুম, ড্রয়িং রুম মানামানি নেই…
—ওকে, ওকে। উফ! বাবা! তোমরা না… অনেকটা সিনিয়র অগ্নিদির ধমকে সঞ্চয়িতা থামে।

ওর মুখে যে লজ্জামিশ্রিত তৃপ্তি লেগে থাকে, ব্ল্যাক কফিতে পরের চুমুকটা দেওয়ার সময়ে ও যে আপন মনে হাসে, সেটা পূবালীর চোখ এড়ায় না। নিজের দীর্ঘশ্বাসটা স্ট্রয়ে চালান করে দিয়ে গলায় টেনে নেয় ঠান্ডা কফি। সঞ্চয়িতা বকবকে মেয়ে। ও অবলীলাক্রমে অগ্নিদিকে জিজ্ঞেস করে বসে, দিদি, আপনারা এখনও করেন? সত্যি সত্যি বলুন।

অগ্নিদি প্রথমে হেসে একটা চড় তোলেন। তারপর বলেন, শোন, তোদের দাদার এই ডিসেম্বরে রিটায়ারমেন্ট আর আমার তার পরের পরের ডিসেম্বরে। আমাদের এখন যা বয়স, তাতে ওইসব আর অত ভালো লাগে না। এখন ভালো লাগে সাহচর্যটা। বুঝলি? ধর, একসঙ্গে একটা ভালো সিনেমা দেখলাম বা কোনও শান্ত জায়গায় বেড়াতে গিয়ে একটু চুপ করে বসে থাকলাম…

—সিনেমা হল ফাঁকা থাকলে কিছু করো না? সঞ্চয়িতা ফুট কাটে।
—এবার কিন্তু এই ভরা কফি হাউসে তোর কান মুলে দেব আমি। পাজি মেয়ে— বলে অগ্নিদি সঞ্চয়িতার পিঠে গুম করে কিল মারেন।

এমন কথোপকথন কত বছর ধরে হয়েই চলেছে। সেদিন অগ্নিদি একটা নতুন কথা বললেন।

—কিছু মনে করিস না, পূবালী। তোর বরের কোনও অ্যাফেয়ার-ট্যাফেয়ার নেই তো? মানে দুনিয়ায় কিন্তু এরকম অনেক লোক আছে যারা দু-জায়গায় দুটো সংসার চালায়। কেউ কেউ বহুবছর পরে ধরা পড়ে যায়, তখন একটা কেলেঙ্কারি হয়। অনেকে আবার এত সেয়ানা যে বউছেলেমেয়ে তাকে দাহ করতে গিয়ে আবিষ্কার করে বাবুর দ্বিতীয় পক্ষ ছিল। আর তোর বরের পক্ষে তো এটা করা খুব সোজা। বদলির চাকরি করে, একাই থাকে সারা সপ্তাহ।

উত্তরটা দিতে গিয়ে হাসি পেয়ে যায় পূবালীর। বিশ বছর হল বিয়ে হয়েছে, এই সন্দেহ তার অনেক আগেই হয়েছিল। ফলে প্রথমদিকে লাল বদলি হয়ে নতুন কোথাও গেলেই সে কোনও না কোনও ছুটিতে গিয়ে কিছুদিন থেকে এসেছে। নাঃ! ওসব কিছু নেই। কিন্তু…

—আমার সতীন আছে একজন।
—সে কী! তুই জানিস? কোনওদিন বলিসনি তো!
—কী হবে বলে? এই সতীনকে তো ঝাঁটা মেরে তাড়ানো যায় না। ফটোগ্রাফি।
—ফটোগ্রাফি!
—হ্যাঁ, বাবু আমার শখের ফটোগ্রাফার। কতবার যে দামী ক্যামেরা কেনার পিছনে কত টাকা খরচ করেছে! নিয়মিত আপগ্রেড করে। আমি তো বিন্দুবিসর্গ বুঝি না ওসবের। প্রতিবারই বোঝানোর চেষ্টা করে অবশ্য… এই লেন্স সেই লেন্স, অমুক অ্যাঙ্গল তমুক অ্যাঙ্গল…
—বাবা! এত চাপের একটা সরকারি চাকরি করেও শখটা বজায় রেখেছে! ছবি তোলার সময় পায় কখন?
—আমাদের জন্যে সময়ের অভাব। ওটার জন্যে ওর সময়ের অভাব হয় না। তবে বেশ ভালো ছবি তোলে। আমি চোখে দেখে যেটুকু বুঝি। ও যখন যেখানে থেকেছে, আপনি গেলেই দেখতে পেতেন চারদিকের দেওয়ালে ফ্রেম করা সব ছবি। আমরা যখন দূরে বেড়াতে যাই তখনও ও পাগলের মতো ছবিই তুলে যায়। টুনি আর আমি যেন উপস্থিতই নেই। বেশ কয়েকটা পুরস্কারও পেয়েছে। ফটোগ্রাফারদের কমিউনিটির কীসব ম্যাগাজিনে নিয়মিত ছবি ছাপাও হয়।

সঞ্চয়িতা লাফিয়ে ওঠে— ও মা! তাহলে তো লোকটা আর্টিস্ট, আর তুমি সাহিত্যের মানুষ। দারুণ ম্যাচ হওয়ার কথা ছিল। কোথায় যে গোলমাল…

—কপাল। আমার কপাল। লোকটার সব রোম্যান্স ক্যামেরাতেই শেষ হয়ে যায়।

প্রতিবারের মতো এবারেও সেই একই জায়গায় এসে কথাটা শেষ হল।

 

দুই.

নিজের কপালের উপর রাগটা পূবালীর ঝপ করে কমে গেল কলকাতা বইমেলায়।

দে’জ-এর স্টলে ঢোকার লাইনটা বেশ লম্বা হয়ে গেছিল। পূবালী একবার ভেবেছিল ঘুরে এসে পরে ঢুকবে, কিন্তু খেয়াল হল, সেদিন শনিবার। যত বিকেল গড়ায় তত এই স্টলগুলোয় ভিড় বাড়ে। ভিতরে ঢুকলেও গুঁতোগুঁতির চোটে কবিতার বইগুলো শান্তিতে উলটেপালটে দেখা যায় না। গরম লাগছিল বলে কার্ডিগানটা খুলতে গিয়ে সবসুদ্ধু সামলাতে না পেরে বইয়ের একটা প্যাকেট পড়ে গেল। ছত্রখান বইগুলো তুলতে যাওয়ার আগেই এক সুপুরুষ ভদ্রলোক ক্ষিপ্র গতিতে কোত্থেকে এসে ঝট করে গুছিয়ে হাতে তুলে দিলেন। ধন্যবাদ দেওয়ার সময়ে পূবালীর মনে হল মুখটা চেনা চেনা। কিন্তু ভদ্রলোকের বোধহয় তাড়া ছিল। কোনওমতে মৃদু হেসে ওয়েলকাম বলেই এসবিআই প্যাভিলিয়নের দিকে দৌড়লেন। পিছনে দাঁড়ানো দীর্ঘদেহী বৃদ্ধ তাঁর স্ত্রীকে বললেন, ঝুমার বর না? স্ত্রী বেশ বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন, এটা একটা পরিচয় হল? বাংলায় এখন কজন লিখছে ওর মতো? বলো ঝুমা ওর বউ। পূবালী কথাগুলো শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে ফেলেছিল, বৃদ্ধা হেসে বললেন, চিনতে পারেননি? কবি রক্তিমাভ সরকার। ওর শ্বশুর-শাশুড়ি আসলে আমাদের পাশের ফ্ল্যাট তো, ওর বউকে আমরা ছোটবেলা থেকে দেখছি। তাই আমার হাজবেন্ড ওরকম বলছে।

সেদিনও নগ্নতায় পুকুরে সাঁতার
এখন নদীর জলে এ দাহ মেটে না।
আদিগঙ্গার পাড়ে বসে মনে পড়ে সেই
ডুব দিলে শব্দ হত ‘টুব টুব টুব’।
কে জানে ক-খানা ফুল ফুটে আছে কচুরিপানায়,
কে জানে কজন বউ চান করতে আসে
অম্লান মৈথুনের পর।

এই সেই কবি! তিনি এসে আমার হাত থেকে ছিটকে পড়া বই গুছিয়ে তুলে দিয়ে গেলেন! শিউরে উঠল পূবালী। তাই বুঝি ভদ্রলোককে চেনা চেনা লাগছিল। বইয়ের ফ্ল্যাপে দেখা মুখ, ফেসবুকে দেখা মুখ, ফলে চট করে চিনতে পারা যায়নি। ইশ! ওঁর নতুন বইটার জন্যেই তো আসলে এতক্ষণ এই একটা স্টলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা। নইলে তো কলেজ স্ট্রিটে দে’জ-এর দোকানে ঢুকে অনেক শান্তিতে সময় নিয়ে দেখেশুনে কবিতার বই কেনা যায়। কিন্তু রক্তিমাভ সরকারের নতুন বইয়ের জন্যে অতদিন অপেক্ষা করা যাবে না।

যত দিন যাচ্ছে, টুনির বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা স্বভাবটা কমার বদলে বেড়েই চলেছে। সেটা কাটাতেই পূবালী ওকে মাসি, মেসোর সঙ্গে বেড়াতে যেতে জোর করেছে। শুধু লেপ্টে থাকলে কথা ছিল, আবার ওর ঠাকুমার মতোই হাজারটা প্রশ্ন করা স্বভাব হয়েছে। স্কুল থেকে একদিন একটু বইপাড়া ঘুরে ফিরলেই— কোথায় গেছিলে? কেন গেছিলে? আমাকে ছাড়া গেলে কেন? আমার জন্যে কী এনেছ?— করে অতিষ্ঠ করে। অথচ ঠাকুমার সঙ্গে থেকে থেকে এমন টিভি দেখার নেশা হয়েছে যে কিছুতেই বইয়ের নেশা ধরানো যায়নি। স্মার্ট টিভি আসার পরে আবার নাতনি ঠাকুমাকে ওয়েব সিরিজের নেশা ধরিয়েছে। সুতরাং ওর জন্যে বই নিয়ে গেলেও সে বইয়ের পাতা কাটা হয় না। কিন্তু বয়ঃসন্ধি যত কামড়ে ধরছে তত মেয়ের রাগ, অভিমান বাড়ছে চড়চড়িয়ে। শাশুড়ির গোমড়া মুখ তো আছেই। এতসব সামলে আজকাল ন-মাসে ছ-মাসে যাওয়া হয় কলেজ স্ট্রিট। ততদিন অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই পূবালীর। অনলাইনে অর্ডার দিয়ে আনানো যায় বটে, কিন্তু প্যাকেট বাড়িতে গেলেই আগে ঝাঁপিয়ে পড়বে টুনি। দেখে শুনে বলবে, ধুর! এসব কী বই পড়ো? কিছুই বোঝা যায় না। বছর দুই-তিন আগে পর্যন্তও পূবালী বোঝানোর চেষ্টা করেছে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ বা জয় গোস্বামী পড়ে শুনিয়ে কবিতার স্বাদ পাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। আজকাল আর ভালো লাগে না। চুল আঁচড়াতে গিয়ে রোজই দুটো করে বেশি পাকা চুল চোখে পড়ে, চোখের তলার কালিটাও যেন আগের দিনের চেয়ে পরের দিন এক পোঁচ বেশি মনে হয়। পনেরোয় পা দেওয়া মেয়েকে কবিতা ধরাতে না পারার হতাশা আরও বেশি ক্লান্ত করে দেয়। তাছাড়া ২২ বছর ধরে ক্লাসে কবিতা পড়ানোর অভিজ্ঞতা পূবালীকে বলে— যে মেয়ে এখনও কবিতার রস পায়নি, তার এ জীবনে আর ও রস পাওয়া হবে না। ভস্মে ঘি ঢালার উদ্যম আর নেই।

রক্তিমাভ সরকারের চেয়ে মারুত চট্টোপাধ্যায়ের নামডাক বেশি। পূবালী দুজনের লেখাই পড়ে দেখেছে। মারুতের ছন্দের উপর দখল অবশ্যই রক্তিমাভর চেয়ে বেশি। কিন্তু মারুতের কবিতা কেমন যেন হাঁটুজল, রক্তিমাভর কবিতায় গলা পর্যন্ত ডুবে যাওয়া যায়। তবে পূবালীর রক্তিমাভর কবিতার ভক্ত হওয়ার একেবারে ব্যক্তিগত একটা কারণ আছে। সে-কথা কাউকে বলে না, বলার নয়। আমার ধূসর ভাষাজন্মান্ধের সূর্যাস্ত আর আমি মানসীর কবি নই বইগুলো পড়ে মনে হয়েছে— এই কবির বহু কবিতা যেন তারই জন্যে লেখা। বিশেষ করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরার মতো রক্তিমাভর কবিতায় যে নারী ফিরে ফিরে আসে, সেই তন্দ্রা, যেন পূবালীই। আর কেউ নয়। এই কবির প্রতি তাই এক ধরনের অধিকারবোধ তৈরি হয়েছে ২০১৫ সালে এঁর কবিতা প্রথমবার পড়ার পর থেকেই। সেই কবি এত কাছে এলেন, পূবালী চিনতে পারল না! অসম্ভব বেদনায় নতুন বইটা হাতে নিয়ে স্টল থেকে বেরোল সে। নতুন বইয়ের গন্ধ, বিশেষ করে প্রিয় কবির নতুন বইয়ের গন্ধ, শোঁকার আনন্দ উপভোগ করতে পারল না।

আরেকদিন আসার সময় হবে না বলে মনখারাপ নিয়েই মেলার বাকিটা ঘুরে নিতে হল, কেনাকাটাও হল। কিন্তু সব বিস্বাদ লাগছিল। তবে চিরনিন্দিত কপাল তাকে বাঁচিয়ে দিল শেষপর্যন্ত। আটটা বাজার একটু আগে করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ডের দিকের গেটটা দিয়ে বেরিয়ে ফাঁকা বাসে উঠে প্রথম সারির জানলার ধারের সিটটায় বসল পূবালী। সব ব্যাগপত্তর পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে দম ফেলার ফুরসত পেয়েই হাতের ব্যাগটা থেকে বার করল তোমার মেঘের কাছে ঋণ— রক্তিমাভর নতুন বই। আর ঠিক তখনই, ফাঁকা বাসটায় যে দু-তিনজন বসেছিল তাদের চমকে দিয়ে সশব্দে উঠে এলেন কবি। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বসে পড়লেন পাঠিকার পাশে। মিনারেল ওয়াটারের বোতলটার ঢাকনা খুলে এক চুমুকে অনেকটা খেয়ে নিয়ে তৃষ্ণার শান্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলতে যতটুকু সময় লাগে, ততটুকুই পূবালীর লাগল ঠিক করে ফেলতে যে এই সুযোগ ছাড়া যাবে না। যতই লজ্জা লাগুক, যতই অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে নিজে থেকে আলাপ করার ইতিহাস নাতিদীর্ঘ হোক।

—আপনি রক্তিমাভ সরকার না?

একটাও চুল পাকেনি, নাকি কলপ করা? কবি হেসে মাথা নাড়তেই প্রশ্নটা মনে এল।

—এই বইটায়… একটু… একটা সই করে দেবেন?

কবি একটু অস্বস্তিতেই পড়লেন। হ্যাঁ… দিতাম তো নিশ্চয়ই… কিন্তু… আমার কাছে তো পেন নেই…

পূবালী সাততাড়াতাড়ি নিজের ব্যাগ থেকে বার করে দিল তিন টাকার পেনটা। ইশ! এঁকে পাওয়া যাবে জানলে একটা পার্কার-টার্কার রাখা যেত সঙ্গে।

—কিছু মনে করবেন না, আমার হাতের লেখা কিন্তু খুব খারাপ। আসলে হাতে লেখা একদমই হয় না তো। খবরের কাগজে চাকরি করি, ফলে সারাক্ষণ কম্পিউটারে কাজ…
—আর কবিতা?
—ওটাও হয় ল্যাপটপে নয় ফোনেই লিখি। ইন ফ্যাক্ট, ফোনেই বেশি লেখা হয়। আসলে কখন লেখা আসবে আগে থেকে বোঝা যায় না তো। ধরুন এই বাসে যেতে যেতে একটা লাইন মাথায় এল। তখুনি লিখে না রাখলে হারিয়ে যাবে। ফলে সঙ্গে সঙ্গে ফোনে টাইপ করে ফেলি। পরে বাকি কবিতাটা আর কাগজে লেখার এনার্জি থাকে না। তাছাড়া আজকাল তো সব জায়গায় সফট কপিই দিতে হয়, ফলে হাতে লিখলেও আবার সেই টাইপ করতেই হবে। এত সময় কোথায় বলুন?

পূবালীর কবিকে নিয়ে কল্পনা একটু ধাক্কা খেল। রক্তিমাভ সরকারের সুন্দর মুখখানা ছবিতে দেখে সে কল্পনা করেছিল একজন দীর্ঘদেহী ভাবালু মানুষকে, যে জানলার পাশের টেবিলে বসে একটা-দুটো করে লাইন লেখে আর বাইরে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত পরে আবার কয়েক লাইন লেখে। দীর্ঘদেহীটা মিলেছে, কিন্তু এই ভদ্রলোক তো কলম দিয়ে লেখেনই না। হাতের লেখা দেখলে মুগ্ধতা আরও কেটে যাওয়ার ভয়ে পূবালী বইটা ফেরত নিয়েই ঝট করে ব্যাগে পুরে ফেলল।

বাড়ি ফিরতেই যথারীতি কী কেনা হল দেখতে লাফিয়ে পড়ল টুনি। একটা বইও পরে আর উলটে দেখবে না, কিন্তু বাড়িতে নতুন বই এলে ওর দেখা চাই-ই চাই আর একেবারে নাকের সঙ্গে লাগিয়ে গন্ধ শোঁকা চাই। ব্যাপারটা পূবালীর ভালো লাগে। মেয়ের সঙ্গে বাবারই মিল বেশি হয়ে গেল, তার কিছুই মেয়ে পেল না— এই কথাটাই মনে হয় সারাক্ষণ। একমাত্র এই স্বভাবটা একেবারে পূবালীর ছোটবেলার স্বভাব। কিন্তু যদি ওটা করতে গিয়ে টুনিই আগে দেখে ফেলত রক্তিমাভ কী লিখেছেন, তাহলে পূবালীর মনখারাপ হত। টুনির সবেতেই তাড়াহুড়ো করার স্বভাব থাকায় ওই পাতাটা ওর চোখে পড়ল না। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সে যখন কানে হেডফোন লাগিয়ে নেটফ্লিক্স খুলে মশারির ভিতর ঢুকেছে, তখন শুয়ে না পড়ে পাশের ঘরে গিয়ে সন্তর্পণে বইটা খুলল পূবালী। না, ভদ্রলোক একটু বেশিই বিনয়ী। হাতের লেখাটা ঠিক কবিসুলভ না হলেও নেহাত কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং নয়। আর যা লিখে দিয়েছেন—

তন্দ্রা জড়ানো ছিল না আমার দুঃসময়
কালঘুম তাই লেগেছে মিষ্টি সেই ভোরেও
এ জনমে তুমি আমার চোখের সব পাতায়
তাই বুঝি বিষে মরতে পারি না ভুল করেও।

রক্তিমাভ
কলকাতা বইমেলা ২০২৫

এ সেই তন্দ্রার কবিতা। কবি অবশ্যই জেনে লেখেননি যে এই কবিতাগুলোর ওই বইয়ের মালিকের কাছে আলাদা অর্থ আছে। আসল ব্যাপারটা বোঝা মোটেই শক্ত নয়। নিশ্চয়ই বহু পাঠক-পাঠিকাই ওঁকে বলে তন্দ্রার কবিতা তাদের খুব প্রিয়। তাই উনি এই অপরিচিত পাঠিকাকেও তন্দ্রার কবিতাগুলো থেকেই কয়েকটা লাইন লিখে দিয়েছেন। পূবালী সবই বুঝল, না বোঝার মতো হাঁদা সে নয়। তবু তার ভাবতে ইচ্ছে করল— কবি কিছু জেনে, নিদেনপক্ষে কিছু ভেবে, এই লাইনগুলো লিখেছেন। বিয়ের পরে এই প্রথমবার নিজের কপালকে ধন্যবাদ দিল সে। ঠিক যখন হাত থেকে বইয়ের প্যাকেটটা পড়ে গেল, তখনই ওখান দিয়ে যাচ্ছিলেন রক্তিমাভ। একে কপালজোর ছাড়া কী-ই বা বলা যায়? পরদিন কাগজ পড়ে জানা গেছিল, সেদিন পাঁচটা থেকে এসবিআই অডিটোরিয়ামে এক অগ্রজ কবির বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান ছিল। নির্ঘাৎ তাতে যোগ দিতেই যাচ্ছিলেন উনি। কী আশ্চর্য ভদ্রতাবোধ! ছড়িয়ে পড়া বইগুলোকে পাশ কাটিয়েই তো চলে যেতে পারতেন। গেলেন না তো! এইসব ভাবতে ভাবতে সে রাতে ঘুম এসে গেল পূবালীর।

পরদিন রবিবার। সেদিন মা কেন অত বেশি আদর করল, সারাদিন ডেকে ডেকে কথা বলল— তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না টুনি। ভালো লাগল, আবার বড় হয়েছে বলে বেসিনের কল সারাতে আসা মিস্তিরিকাকুর সামনেই চুমু-টুমু খাওয়ায় একটু লজ্জাও করল। তবে টুনি ভেবে দেখল, মোটের উপর মা এরকম থাকলেই ভালো হয়। ইদানীং কেমন যেন হয়ে গেছে। ছুটির দিনেও তেমন কথাবার্তা বলে না, তার কথায় বা ঠাম্মার কথায় একটুতেই খেপে ওঠে। ঠাম্মা তো আজকাল মাকে বেশ ভয়ই পায়। কোন কথায় যে খেপে উঠবে বুঝে উঠতে পারে না। তাই অনেক কথা টুনিকে দিয়ে বলায়। একদিন এতই অকারণে রাগ করেছিল যে টুনি আর থাকতে পারেনি, কাঁদতে কাঁদতে বলে দিয়েছিল, বাবা থাকেই না, তুমি কথায় কথায় মেজাজ করো, এত অপছন্দ হলে জন্ম দিয়েছিলে কেন? আর রেসপন্সিবিলিটি নিতে না পারলে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিতে পারতে। অনেক শান্তিতে থাকতাম। যতদূর মনে পড়ে, ছোটবেলায় মা এরকম ছিল না। মা আবার আগের মতো হয়ে গেলে ভালোই হয়। এইসব ভাবতে ভাবতে রবিবার রাতে টুনির চমৎকার ঘুম হয়েছিল মাকে জড়িয়ে। যদি জানত মা বেশি স্নেহশীল হয়ে উঠেছিল অপরাধবোধে, তাহলে হয়তো ঘুমটা অত ভালো হত না।

আসলে শনিবার রাতে একটা রোমান্টিক স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল পূবালী। সেই স্বপ্নের নায়ক টুনির বাবা ছিল না। ফলে ঘুম ভেঙে নিজেকে কেমন অশুচি মনে হচ্ছিল। রবিবার সাতসকালে স্নান করা তার স্বভাব নয়, কিন্তু সেদিন টুনি ঘুম থেকে ওঠার আগেই স্নান সেরে নিয়েছিল। তারপর টুনির বাবাকে একটা ফোন। সেই সপ্তাহেও সে জানিয়েছিল আসতে পারছে না। রবিবার অফিস নেই, বেলা পর্যন্ত ঘুমোবার ইচ্ছে ছিল সারা সপ্তাহের খাটনির পর। সাড়ে ছটায় বউয়ের ফোনে ঘুম ভাঙতে লাল ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছিল, ভেবেছিল মায়ের একটা ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেছে। পূবালী খেজুড়ে আলাপ শুরু করায় সে মোটেই খুশি হয়নি। মিনিট তিনেক পরেই বলে দিয়েছিল, এইগুলো বলার জন্যে কাকভোরে ফোন করে কেউ? রাখো তো, একটু ঘুমোতে দাও। অন্যদিন হলে পূবালী রেগে যেত এই ব্যবহারে। কিন্তু সেদিন মনে হয়েছিল, এই ব্যবহারটা তার প্রাপ্য। ছি ছি! পরপুরুষকে নিয়ে ওইসব স্বপ্ন কেউ দেখে! পাপস্খালন করতে রান্নার লোককে জলখাবার করতে বারণ করে টুনির প্রিয় ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানাল নিজে হাতে। সারাদিন চোখের আড়াল করল না মেয়েকে, তারপর সন্ধেবেলা নিজে থেকেই পিৎজা খাওয়াতে নিয়ে গেল। এর কদিনের মধ্যেই যা ঘটল, তাতে পূবালী ভাবতে বাধ্য হল যে তার কপাল খারাপ তো নয়ই, বরং বিশেষরকমের ভালো।

তোমার মেঘের কাছে ঋণ সঙ্গেই ঘুরছিল, স্কুলে অফ পিরিয়ডে আর ফেরার সময়ে ট্রেনে বাসে বসার জায়গা পেলে পড়ার জন্যে। একদিন পাশে রেখে টিফিন খাচ্ছে, ভূগোলের উমাদি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা নতুন বেরিয়েছে?

—হ্যাঁ, এই তো বইমেলা থেকে কিনলাম।
—কেমন লেখে রে ছেলেটা?
—মন্দ না। আমার তো ভালোই লাগে।

পূবালী সাবধানী হয়ে কমিয়ে বলল।

—ওই যে মারুত বলে কে একটা ছেলের খুব নাম শুনি… তার চেয়েও ভালো?
—ওভাবে তো ঠিক বলা যায় না, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার। তবে আমার তো এঁর লেখাই বেশি ভালো লাগে। বৈচিত্র্য বেশি, গভীরতা বেশি…
—যাক, ওকে তাহলে বলব আমার স্কুলে তোমার একজন ফ্যান আছে। আমাদের বাড়িতে তো কবিতা পড়ার লোক কেউ নেই, আমরা বরং কবি বলে প্যাঁক দিই। মাঝে মাঝে রেগে যায় বুঝতে পারি, কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠ শালী-ভায়রাভাইকে কিছু বলে উঠতে পারে না বেচারা।

পূবালী ঠিক করে রেখেছিল আগ্রহ দেখাবে না, কিন্তু কী করে যেন মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, আপনার আত্মীয় উনি!

—উনি কি রে! আমার তো হাঁটুর বয়সী, তোর বয়সী কি তোর চেয়ে একটু ছোট হবে। আমার ছোটমামার জামাই। আমি তো আবার মামাবাড়িতে মানুষ, ফলে মামাতো বোনরা আমার নিজের বোনের মতোই। আর রক্তিম ছেলেও ভালো। ওইজন্যে খুব যাতায়াত। গতবছর লাদাখ গেলাম না? ওরা দুজন আর আমরা তিনজনেই তো।

কিছুদিন ধরে চুল কেবল পাকছে না, চোখে পড়ার মতো করে উঠতেও শুরু করেছে। সে দুঃখও পূবালী বুকেই চেপে রাখে। কিন্তু সেদিন বাড়ি ফিরে জামাকাপড় ছেড়ে চুল আঁচড়াতে গিয়ে একটা কথা ভেবে হাসি পেল। সামনের দিকের চুল উঠে গিয়েই বোধহয় কপালটা চওড়া হয়ে গেছে, তাই এসব ঘটতে শুরু করেছে। পরের মাসেই উমাদির ছেলের বিয়ে। সেখানে অবশ্যই রক্তিমাভ সরকারের দেখা পাওয়া যাবে আরেকবার। এবার আর অত লজ্জা-টজ্জার ধার ধারবে না। তাছাড়া লজ্জা পাওয়ার আছেটা কী? উনি কবি, পূবালী অনুরাগী পাঠক। সাহিত্যিকরা তো অনুরাগী পছন্দ করেন। পূবালী নিজের ভালোলাগা প্রিয় কবিকে জানাবে— এই তো।

 

তিন.

—এই যে ভাই তোমার ফ্যান। খোঁজ করছিলে না?

বিয়েবাড়িতে ঢুকে কনের হাতে সকলে মিলে উপহারের প্যাকেটটা দিয়ে গ্রুপ ফটো তোলা শেষ হতে না হতেই যেভাবে উমাদি টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে পূবালীকে রক্তিমাভর সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন, তাতে লজ্জাই লাগল। কিন্তু কবির প্রথম কথাতেই জড়তা কেটে গেল।

—আরে! আপনাকে তো চেনা চেনা লাগছে! বইমেলায় দেখা হল, না?
—আপনার মনে আছে!
—মনে থাকবে না? কবিতা আর কজন পড়ে বলুন? যারা উপন্যাস-টুপন্যাস লেখে তাদের কথা আলাদা। প্রচুর বিক্রি, প্রচুর পাঠক। অনেককে তো বাউন্সার-টাউন্সার নিয়েও ঘুরতে হয়। আমাদের হাতে গোনা মনোযোগী পাঠক আছে। তাদের ভোলা যায়?
—আপনি আমার খোঁজ করছিলেন?

পূবালীকে এই প্রশ্নটা এভাবে করতে দেখলে ওর সহকর্মীরা চমকে যেত। ওকে স্কুলে লজ্জাবতী লতা বলা চালু আছে। কথাটা ছাত্রীদের কানেও গেছে, ফলে তারা আড়ালে লতাদি বলে। হয়তো আয়নায় নিজের এই আত্মবিশ্বাস দেখতে পেলে পূবালীও থতমত খেয়ে যেত। এক্ষেত্রে রক্তিমাভই থতমত খেল। তার সামনে পাঠকরা সাধারণত শ্রদ্ধায়, বিনয়ে নুয়ে পড়ে। কেবল মহিলারা নয়, পুরুষরাও। কিন্তু ইনি এমনভাবে প্রশ্নটা করলেন যেন ইনিই একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি। কিন্তু কবি ঝানু, অনেক বড় বড় লোকজনের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তিনি জানেন কী করে পিছলে যাওয়া লাগাম ধরে নিতে হয়।

—আসলে উমাদিই অনেকদিন ধরে বলছে আপনার কথা। আমাদের স্কুলে তোমার একজন ফ্যান আছে… তোমার সব বই পড়েছে… এইসব। প্রথমে ভাবছিলাম ইয়ার্কি করছে, শালীরা যেমন করে আর কি। তা আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম ইনি আবার কে? মারুতের এরকম অনেক ফ্যান-ট্যান আছে। ও আর আমি একসঙ্গে কোথাও গেলে সে এক অভিজ্ঞতা। নিজেদের মধ্যে দুটো কথা বলা যায় না। ঠিক কোনও না কোনও গুণমুগ্ধ এসে হাজির হবে, সেলফি তুলতে চাইবে…
—আপনার হিংসে হয়?

কবি আবার হোঁচট খেলেন, কিন্তু সামলে নিলেন।

—একেবারেই না। আমার কাছে এক হাজার গুণমুগ্ধের চেয়ে একজন মনোযোগী পাঠক বেশি মূল্যবান। আপনি আমার সব বই পড়ে ফেলেছেন শুনে…
—আমি বোধহয় আপনার প্রথম প্রকাশিত কবিতাটাও পড়েছি।
—বলেন কী! সে তো সেই ২০১১ সালে বেরিয়েছিল। যে পত্রিকায় বেরিয়েছিল সেটা উঠেও গেছে।
—হ্যাঁ, কিন্তু ২০২০ সালে আপনার যে সাক্ষাৎকার বেরিয়েছিল ন হন্যতে পত্রিকায়, তার মধ্যে তো ওটা আবার ছাপা হয়েছিল।

কবি এবার মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না। এই প্রথম খেয়াল হল যে দু-একটা চুল পেকে গিয়ে থাকলেও পাঠিকা বেশ সুন্দরী। অতঃপর একথা-সেকথা। রক্তিমাভর অনুরোধে গন্ধরাজ মাটনটা দু-পিস বেশি খেল পূবালী, রক্তিমাভ পাঞ্জাবিতে রসগোল্লার রস ফেলে অপ্রস্তুত হল এবং পূবালীর খিলখিল হাসি দেখে প্রসন্ন হল। ব্যাপারটা ঠিকঠাক এগোচ্ছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করার জন্যে পূবালী মিষ্টি পছন্দ করে না শুনে চোখ কপালে তুলে বলল, সেই হিন্দমোটর থেকে লেকটাউনে এসে এই সন্দেশটা না খেয়ে চলে যাবেন! বলেন কী! পাড়ার লোক জানলে একঘরে করে দেবে কিন্তু। এটা এখানকার জগদ্বিখ্যাত মিষ্টি।

—ধ্যাৎ! আমাদের ওখানে কেউ নামও শোনেনি। আপনি কবি বলে যা খুশি বলবেন নাকি?
—আরে লেক টাউন নিজেই তো একটা জগৎ। ঢোকার মুখে লন্ডনের বিগ বেনের স্মল ভার্শনটা দেখেননি?

কথার মিষ্টতায় মজে পূবালী একটার জায়গায় দুটো সন্দেশ খেয়ে ফেলল। তারপর যখন দুষ্টু সঞ্চয়িতা বেরোবার সময়ে এসে বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ গলায় বলল, পূবালীদি, আমরা তাহলে এগোচ্ছি, তখন পা মাটিতে পড়ল এবং লজ্জায় লাল হয়ে গেল।

—ও মা, সে কি! একসঙ্গেই ফিরব তো! দাঁড়া।
—না, আমি ভাবলাম তোমার হয়তো দেরি হবে…

পূবালী কটমটিয়ে তাকিয়ে সঞ্চয়িতাকে বুঝিয়ে দিল, তোর হচ্ছে। তারপর রক্তিমাভর চোখে চোখ রেখেই বুঝল, সে চাইছে পূবালী আরেকটু থাক। যতই কবি হোক, পুরুষ তো। এতদূর এগোতে দেওয়া যায় না। তাই সে দুম করে বলে বসল, যাওয়ার আগে আপনার গিন্নির সঙ্গে আলাপটা করিয়ে দিন। এতে রক্তিমাভর মুখের চেহারাটা যা হল তাতে পূবালী মজা পেল, আত্মবিশ্বাস বাড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল— সেটা ভালো কথা নয়। রক্তিমাভ বোকা বোকা হেসে বলল, তাকে এখন কোথায় পাবেন? সব অনুষ্ঠানবাড়িতেই সে হল অর্গানাইজার। এখন ভীষণ ব্যস্ত। কই, আশপাশে তো দেখতে পাচ্ছি না। পরে কখনও…

—আচ্ছা, আসি তাহলে। কথা হবে— বলেই সঞ্চয়িতার হাতটা ধরে হাঁটা দিল পূবালী। আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালে যদি রক্তিমাভর চোখে চোখ পড়ে যায় আর থেকে যাওয়ার ইচ্ছেটা যাওয়ার ইচ্ছের ঘাড়ে চেপে বসে? অত ভার বয়ে হাঁটার জোর নেই তার।

গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসেই সঞ্চয়িতা বলল, নাঃ! অগ্নিদি, আর পূবালীদিকে লতা-টতা বলা যাবে না, বুঝলেন? এখন রীতিমতো আশা।

অগ্নিদি সোজাসরল মানুষ। বুঝতে না পেরে বললেন, মানে! কী করল আবার? খামোখা পেছনে লাগছিস কেন মেয়েটার?

—খামোখা! আপনি খেয়াল করেননি!
—কী খেয়াল করব?
—আরে এতক্ষণ যে আমরা বিয়েবাড়িতে ছিলাম, কটা কথা বলেছে আপনার সঙ্গে? সারাক্ষণ তো একজনের সঙ্গেই…
—তোকে মারব ধরে, দাঁড়া, পূবালী থামানোর চেষ্টা করল।
—মেরে আমাকে মাটিতে পুঁতে দিলেও গাছ হয়ে বেরিয়ে যাব। বেরিয়েই গাইব, লতা কবির প্রেমে পড়েছে, ও দারোগা, লতা কবির প্রেমে পড়েছে, ও…

এবার অগ্নিদি ঝুঁকে পড়লেন— ওই সবুজ পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা কবি বুঝি? হ্যাঁ, খুব হেসে হেসে কথা বলছিল বটে। একবার দেখেছিলাম।

—ধুর, বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে। ও কীরকম দুষ্টু আপনি জানেন না? উনি আসলে একজন বিখ্যাত কবি। আমার খুব প্রিয়। উমাদি জানেন বলে আলাপ করিয়ে দিলেন…
—হ্যাঁ মা, তাই তুমি এত মাঞ্জা দিয়ে এলে আর বিয়েবাড়ি ঢুকেই লতা থেকে আশা হয়ে গেলে। ইয়ে হ্যায় রেশমি জুলফোঁ কা অন্ধেরা ন ঘবরাইয়ে/জহাঁ তক মেহক হ্যায় মেরে গেসুয়োঁ কি চলে আইয়ে। উউউফ! পুরো ওইরকম লাগছিল তোমাকে। মাইরি বলছি।

সঞ্চয়িতা একটু এসব নিয়ে ফাজলামি করতে ভালোবাসে জানলেও, ওই গানটার উল্লেখে পূবালী আহত হল। অগ্নিদিও বললেন, যাঃ! পূবালী ওরকম ঢলানি টাইপ না। এইসব বলিস না।

পূবালী জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে দেখে সঞ্চয়িতা অবশ্য বুঝল বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। হাত ধরে খুব ক্ষমা-টমা চাইল। পূবালীও ক্ষমা করল, কারণ ওর মনটা যে ভালো আর ও যে সত্যিকারের বন্ধু, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বালি স্টেশনে নামিয়ে দেওয়ার সময়ে ফের হাত ধরে বলল, অ্যাই, তুমি সত্যি ক্ষমা করেছ তো? পূবালী হেসে বলল, না, করিনি যা। কী হবে এখন? ও হাসল, তারপর যে কথাটা বলল, সেটা নিয়ে বাকি পথ একা একা ভাবতে ভাবতেই পূবালী দেখল সে হিন্দমোটর স্টেশনে নেমে পড়েছে।

—তোমাকে আজকের মতো খুশি কোনওদিন দেখিনি, পূবালীদি। তুমি হাসলেও মনে হয় কোনও একটা কষ্ট চেপে গেলে। এভাবে মানুষ বেশিদিন বাঁচে না গো। বাঁচতে গেলে এরকম আনন্দে থাকতে হয়। কেউ যদি তোমাকে এই আনন্দ দিতে পারে, তোমার জন্যে ভালো। সে তোমার স্বামী হোক আর না-ই হোক।

সঞ্চয়িতার এই স্বভাবটা আছে। সারাক্ষণ ফাজলামি করে, কিন্তু হঠাৎ এমন একেকটা গভীর কথা বলে দেয়!

শুক্রবারগুলো টুনির খুব খাটাখাটনি যায়। সকালে সাতটায় পড়তে বেরিয়ে যায়, সেখান থেকে সোজা স্কুল। ছটা নাগাদ স্কুল থেকে ফিরেই নাচের ক্লাস। ফিরতে ফিরতে আটটা-সাড়ে আটটা। খেতে বসেই ঢুলতে শুরু করে। তাই ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে পূবালী অবাক হল না। তবে আজকের সাজটার অনেকে প্রশংসা করল, রক্তিমাভও। তাই ইচ্ছে ছিল টুনি একবার দেখুক। নিজে সাজতে ভালোবাসে, কোথাও সেজেগুজে যাওয়ার থাকলে পাকা স্টাইলিস্টের মতো গম্ভীর মুখে মায়ের সাজের খুঁটিনাটি ও-ই ঠিক করে দেয়। ও যতটা সাজতে বলে ততটা পূবালী কিছুতেই সাজে না, সাজতে ইচ্ছে করে না বলে। তা নিয়ে টুনি অভিমান করে। আজ কিন্তু ও যেমন চায় তেমন সাজগোজই করেছিল পূবালী। গা ধুয়ে এসে ওর পাশে শুতে শুতে সাড়ে এগারোটা বাজল। বাড়ির সামনের রাস্তায় যথেষ্ট আলো আছে, তবু মিউনিসিপ্যালিটি অনাবশ্যক জোরালো একটা আলো লাগিয়েছে ঠিক জানলার উলটোদিকের ল্যাম্পপোস্টে। অন্যদিন টুনি ওই জানলাটা বন্ধ না করে শোয় না, কারণ ঘুমোতে গেলে ওর চাই ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু পর্দা টেনে দিলে যা আলো আসে তাতে টুনি ছটফট করে। আজ বোধহয় এত ক্লান্ত ছিল যে ওসব আর খেয়াল হয়নি। সেই আলোয় মুখটা দেখে পূবালীর সঞ্চয়িতার কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেল। টুনিও কি কষ্ট চেপে হাসে? ঘুমোচ্ছে, তাও মুখটা কেমন বিষণ্ণ লাগছে না? এখন যা বয়স হয়েছে, বাবা-মায়ের নিথর সম্পর্কটা তো ও বুঝতে পারে নিশ্চয়ই। সেটা চুপিচুপি ওরও আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে না তো! দুজনের কাছাকাছি সময়ে পিরিয়ড হয় যখন, মায়ের সুখের অভাব কি মেয়ের ক্ষতি করছে না? যদি পূবালী আনন্দে থাকে, টুনিও কি আরেকটু ভালো থাকবে না? অবশ্য গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। মোটে দুদিন তো দেখা হয়েছে। ঠিক করে কথা হয়েছে একদিন। তাছাড়া বিবাহিত লোক…

ভাবতে ভাবতে চোখ বুজে এসেছিল, মাথার কাছের টেবিলে রাখা ফোনটা টুং করে বাজল। এত রাতে কে!

ঘুমিয়ে পড়েছেন?
বাড়ি পৌঁছলেন কখন?

হোয়াটস্যাপে কবি রক্তিমাভ সরকার। সামনের মাসে কোনও একদিন দক্ষিণ কলকাতার কোথাও কবিতাপাঠের আসর আছে। তার খবর দেবেন বলে নম্বরটা নিয়েছিলেন। পূবালীর ভাবতে ইচ্ছে হয়েছিল ওটা ছুতো, কিন্তু ভাবেনি। এবার আশ্চর্য উত্তেজনায় গা কেমন করে উঠল। ভাগ্যিস রাস্তায় থাকতে এই মেসেজ আসেনি, ভাগ্যিস টুনি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। পূবালীর মনে হল— এ তো আহ্বান! তন্দ্রা সিরিজের সেই কবিতাটার মতো—

চন্দ্রে তোমার গন্ধ লেগে আছে
তন্দ্রা তুমি এখন কতদূর?
উলটোদিকে বইছে দেখো হাওয়া
ফিরেই এসো আমার হৃদয়পুর।

মালকোষের ধ্যানে আমীর খান
প্রবল প্রেমে ডাকেন বলে এসো
আমার কথা না হয় থাক বাদ
বীতরাগেই ভাসাবে বলে ভেসো।

 

চার.

টিচার-ইনচার্জ অমৃতার ভয়ে ছাত্রীরা তো বটেই, দিদিমণিরাও তটস্থ থাকত এতকাল। ইংরেজির সঞ্চয়িতা, ওয়ার্ক এডুকেশনের রূপার মতো দু-একজন ছিল, যারা কিছুটা মুখে মুখে কথা বলার সাহস করত বা চালাকি করে অমৃতার অনেক একুশে আইন বরবাদ করে দিত। কিন্তু বাকিদের দিয়ে সে সাবধান-বিশ্রাম করিয়ে এসেছে দশ বছর ধরে। হঠাৎ আবিষ্কার করল, যাকে সে সবচেয়ে নিরীহ মনে করেছিল, সেই পূবালী কালকেউটের মতো ফণা তুলতে শিখে গেছে। ব্যাপারটা সামান্য। ছুটি হওয়ার একটু আগে টিচার্স রুমে এসে অমৃতা বলেছিল, পূবালী, শাশ্বতীদি, সুলেখাদি। তোমরা ছুটির পরে থেকে যাবে। পরীক্ষার সিট প্ল্যানগুলো করে বাড়ি যাবে। ঘোষণা শেষ করে উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে যাওয়াই অমৃতার দস্তুর, কিন্তু পিছন ফিরতেই পূবালী বলে উঠল, তুমি থাকছ? অমৃতা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেনি প্রথমে। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে— আমি! আমি কেন থাকব?

—তাহলে আমরা কেন থাকব? ওভারটাইম দেবে?
—মানে! এটা কি ফ্যাক্টরি নাকি?
—আমিও তো তাই বলছি। এটা স্কুল, ফ্যাক্টরি নয়। স্কুলের কাজ স্কুলের টাইমেই হবে। সোমবার থেকে পরীক্ষা, কালকে মেয়েরা বিশেষ কেউ আসবে না। কাল সারাদিন টাইম পাওয়া যাবে সিট প্ল্যান করার। ছুটির পরে থাকা-ফাকা হবে না।
—স্কুল কীভাবে চলবে সেটা আমি ঠিক করব।
—তাহলে কাজগুলোও সব নিজে করো। অন্যদের বলবে না।

সন্ত্রস্ত শাশ্বতীদি বলতে গিয়েছিল, না না, ঠিক আছে। পূবালী তোর তাড়া থাকলে তুই বেরিয়ে যাস। আমি আর সুলেখা করে নেব…

পূবালী বলল, কেন করবে? আজকেও তো বেশি মেয়ে আসেনি, কতগুলো ক্লাস খালি গেল। টিচার-ইনচার্জের তখন খেয়াল হয়নি? নিজে প্রায়ই ছুটির আগেই ব্যাগ ঝুলিয়ে বাড়ি চলে যাবে, আর আমাদের ছুটির পর থেকে কাজ করতে হবে? কোন দেশি নিয়ম এটা?

পূবালীর কথা শুনে গোটা টিচার্স রুমের চক্ষুস্থির, অমৃতার মনে হচ্ছিল রাগের চোটে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। পূবালী আবার কাটা ঘায়ে নুন ডলে দেওয়ার মতো করে মুখের সামনে আঙুল নেড়ে বলল— শোনো অমৃতাদি, তুমি হচ্ছ টিচার-ইন-চার্জ। তুমি আমাদের বস না। আমরা সবাই সরকারি চাকরি করি, সকলেরই বস হল সরকার। স্কুলের স্বার্থে অনেক সময় অনেক স্যাক্রিফাইস করতে হয়, বেশিক্ষণ থাকতে হয়। ভালো করে বলবে আর নিজেও স্যাক্রিফাইস করবে। তাহলে সব করে দেব। অর্ডারি সুরে কথা বলবে না, অন্যায় আবদার করবে না।

অমৃতার অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু কী বলবে ভেবে পেল না। এসেছিল নিঃশব্দে বেড়ালের মতো, গেল ভাল্লুকের মতো ফোঁসফোঁস করতে করতে। ঠিক করল, ম্যানেজিং কমিটির মিটিং ডেকে শায়েস্তা করবে।

ভীতু দিদিমণিরা শঙ্কিত হলেন এর কী ফল হবে ভেবে; কেউ কেউ খুশি হলেন দজ্জাল টিচার-ইনচার্জকে অ্যাদ্দিনে আচ্ছা করে দেওয়া গেছে বলে। সঞ্চয়িতা উঠে এসে পূবালীর গলা জড়িয়ে দু-গালে দুটো চুমুই খেয়ে বসল। তারপর কানে কানে বলল, কবির কী জাদু! আসলে অগ্নিদি সিনিয়র লোক বলে তাঁকে বলতে লজ্জা পেয়েছে পূবালী। গোটা দুনিয়ায় একমাত্র সঞ্চয়িতাই জানে, ছ-মাসে রক্তিমাভর সঙ্গে হোয়াটস্যাপে কথাবার্তা অনেকদূর এগিয়েছে। দুজনেই অসুখী দাম্পত্যে আটকে আছে। পূবালী বলে ফেলেছে, কেন তন্দ্রার কবিতাগুলো তার সবচেয়ে প্রিয়। এ-কথার কোনও উত্তর তৎক্ষণাৎ আসেনি। এমনকি পরদিন দুপুর পর্যন্ত আর একটা লাইনও লেখেনি রক্তিমাভ। পূবালীর আশঙ্কা হয়েছিল— বোধহয় বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। সম্পর্কের ইতি ঘটল। কিন্তু সেদিন টিফিনের পরের ক্লাসটা সেরে এসে আশাহত হতে হবে ধরে নিয়েই পূবালী ব্যাগ থেকে যেই ফোনটা বার করল, দেখল লকস্ক্রিনে রক্তিমাভর অপঠিত বার্তার নোটিফিকেশন। কী ছিল সেই বার্তায়?

তন্দ্রা, কালও চাঁদ উঠেছিল
কালও ঘুম এসে চলে গেছে
আমি জানি, তুমিও জেগেই ছিলে।
মাঝের ওই মাঠটুকু পার করে এই দুই চোখ
তোমাকে দেখতে পায় বিছানার কোণে।
অর্ধেক জ্যোৎস্নায় তুমি শুয়ে থাকো
তোমার দয়িতের নাক বাকি অমাবস্যায় ডাকে।
আমারও যে ঘুম নেই কত যুগ
শুধু তন্দ্রা, বাঁচিয়ে রেখেছ।

এই কবিতার কথা অবশ্য সঞ্চয়িতাকে বলেনি পূবালী। কবিতাটা ‘অর্ধেক জ্যোৎস্না’ নামে সেবার সর্বাধিক বিক্রীত কাগজের শারদীয় পত্রিকায় বেরোল। স্টেশনের নিউজস্ট্যান্ড থেকে কেনা কপিটা বুকে জড়িয়ে একদিন দুপুরে দারুণ ঘুম হল পূবালীর। সেটা চোখে পড়ায় টুনি খুব অবাক হল। মায়ের এ আবার কীরকম বাচ্চা মেয়ের মতো আচরণ! ব্যাপারটা অবশ্য তার ভালোই লেগেছে। মা ছোট মেয়েদের মতো আচরণ করলে মাকে একটু কাছের লোক বলে মনে হয়। গত কয়েক বছরে তো কেবলই মায়ের সঙ্গে তার দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছিল। সবে কয়েক মাস হল মা সেই ছোটবেলার মতোই আদর করছে আবার। টুনির ভয় হয়— এই ব্যাপারটা বেশিদিন টিকবে না। কোনও একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে মা আবার সেই খিটখিটে মানুষটা হয়ে গেছে।

এর মধ্যে লাল যতবার বাড়ি এসেছে, বউকে হাসিখুশি দেখে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। প্রত্যেকবার বাড়ি এসে বউয়ের গোমড়া মুখ দেখতে কার ভালো লাগে? লাল লক্ষ করে দেখেছে, যেবার এসে ওইটা হয়, সেবার গিন্নির মেজাজটা তবু একটু নরম থাকে। নইলে একেবারে উঠতে বসতে কথা শোনায়। যা রোজগার করো সবই তো বিলিয়ে দাও। টুনির ভবিষ্যতের চিন্তা তো তোমার দাদারা করবে; খরচখরচা মিটিয়ে দিলেই বাবা হওয়া যায় না; বিয়ের পর থেকে কোনওদিন কিচ্ছু চাইনি। ওটাই ভুল হয়ে গেছে; তোমার একটা নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানোর মতো বউ হওয়া উচিত ছিল… ইত্যাদি নানা কথা প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে পূবালী বলত লাল এলে। অবশ্য সারাদিনের মধ্যে কোনও একটা সময়ে। বাকি সময়টা দরকার ছাড়া কথাও বলত না। লাল তাতে স্বস্তি বোধ করত। সে কোনওদিনই মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে পারে না। তাদের বাড়ির পুরুষরা কেউই বউয়ের আঁচলধরা নয়। এ নিয়ে লাল যথেষ্ট গর্বিত। আজকাল বন্ধুবান্ধব, সহকর্মীদের অনেককেই দিনরাত আমার বউ এই, আমার বউ সেই বলতে শোনে সে। এত বাড়াবাড়ি করার কী আছে মাথায় ঢোকে না। বিয়ে করা সামাজিক কর্তব্য। করেছিস, সংসার করছিস, বাচ্চাকাচ্চা হয়েছে, মিটে গেছে। এত গদগদ হওয়ার কী আছে রে বাপু? যাদের নতুন বিয়ে হয়েছে তাদের লাফালাফি তবু সহ্য করা যায় বয়সের ধর্ম ভেবে। কিন্তু অসীম ধাড়ার আর বছর পাঁচেক চাকরি বাকি, তার এখনও বউয়ের রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হওয়ার কী আছে?

পূবালীর শাশুড়ি অপর্ণা কিন্তু ভাবগতিক ভালো বুঝছেন না। নাতনি স্কুলের চৌকাঠ পেরোতে চলল, এই বয়সে হঠাৎ বউমার নতুন করে সাজগোজ করার শখটাকে উনি মোটেই ভালো চোখে দেখছেন না। বউমার চুল পাকতে শুরু করেছে অনেকদিন, কিন্তু কলপ করা শুরু করেছে হালে। তার উপর স্কুল যাওয়ার সময়ে আজকাল বেশ সময় নিয়ে জামাকাপড় বাছাবাছি করতে দেখেন। টুনি বাড়িতে থাকলে তাকে জিজ্ঞেসও করে, দ্যাখ তো, এটা পরব? ভালো লাগবে? ব্যাপারটা ছেলেকে অপর্ণা দু-একবার বলেছেনও, কিন্তু সে তো ভোলানাথ। তার বক্তব্য হল, আরে নিজের আনন্দে আছে থাক না। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছ। তোমার দেখাশোনায় কোনও গাফিলতি করছে কি? না, তা করছে না। অপর্ণা বউমার উপর রেগে গেলে দু-চারটে খারাপ কথা খরখরিয়ে বলে দেন বটে, তা বলে ছেলের কাছে বানিয়ে বানিয়ে অভিযোগ করার মানুষ নন।

ওদিকে কবি রক্তিমাভর অন্তরঙ্গ বন্ধু, কবি মারুত, একদিন জিজ্ঞেস করল, কী রে, তোর দিদিমণির ব্যাপারটা কদ্দূর এগোল?

—ধৈর্য ধরতে হবে। খেলিয়ে তুলতে হবে। তাড়াহুড়ো করলে চলবে না।
—দেখা-টেখা করেছিস, নাকি শুধু হোয়াটস্যাপেই…
—সেই বিয়েবাড়ির পরে একবারই।
—কোথায়?
—স্প্যানিশ ক্যাফে।
—তা কী বুঝলি?
—ওই যেমন হয়। পেটে খিদে মুখে লাজ।
—তা খিদে মেটাবি কবে? এক বইমেলা গিয়ে আরেক বইমেলা আসতে চলল তো।
—আরে দাঁড়া, খিদে যতদিন বজায় আছে ততদিনই তো খেলাতে পারব।
—বলিস কী! একবার শোয়া হয়ে গেলেই তোকে ডাম্প করবে? হেব্বি মহিলা তো তাহলে!
—ধুর বাল! আমাকে ডাম্প করবে একটা সামান্য স্কুলের দিদিমণি? সে-কথা নয়। খিদেটা বাড়িয়ে তুলছি, যাতে একবার আঙুল নেড়ে ডাকলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
—খুব তো রেলা নিচ্ছিস। ঝুমার জানতে পারার রাস্তাটা বন্ধ করেছিস তো? আগেরবার তো তোকে কান ধরে বিছানা থেকে তুলে এনেছিল, বলেই খ্যাক খ্যাক করে হাসতে শুরু করল।

রক্তিমাভকে অপমানটা বোকা বোকা হেসে হজম করতেই হল, কারণ কথাটা শতকরা একশো ভাগ সত্যি। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে মারুত যোগ করল, আরেকটু হলেই নিউজ হয়ে যেত। অনেক ফোনাফুনি করে সামলেছিলাম। বারবার কিন্তু এসব করতে পারব না।

—আরে এই কেসে ওসব ঝামেলা নেই। ঝুমা যেন জানতে না পারে সে ব্যাপারে দিদিমণি নিজেই সাবধান থাকে। ঝুমার পিসতুতো দিদি ওদের স্কুলেই পড়ায় না? তার মাধ্যমেই তো আলাপটা হল। আমার সঙ্গে প্রেম করছে এটা ঝুমা জানা মানেই ওর গোটা স্কুল জেনে যাবে। আর মুখ দেখাতে পারবে? তার উপর ইন্টিরিয়র এলাকার গার্লস স্কুল। এলাকার লোক জেনে গেলে চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে, বুঝলি?

শুনে মারুত মনে মনে বলল, শালাকে আন্ডারএস্টিমেট করে ফেলেছি। ব্যাটা আমার থেকেও বেশি ঘাঘু। কত দিক ভেবেচিন্তে ছিপ ফেলেছে!

 

পাঁচ.

গরম ভাতের মতো প্রেমিকার ছবি নিয়ে
জীবনের আনাচে কানাচে
উত্তাপেরা আজও বেঁচে আছে।
শহরতলির বিছানাতে
তারাদের ছুটি নেওয়া রাতে
উবু হয়ে কত দর্শকাম
সেই পরী খোঁজে অবিরাম।
তারা সব আলনার কোলে
অথবা হেঁশেলে অবহেলে
ডানা রেখে গৃহিণী হয়েছে।
উদোম জ্যোৎস্নার মতো কামনা অসাড়,
বেদনা অপার।
জলকেলি জন্য এসে
একেলা সাঁতার।

বলুন তো এটা কাকে নিয়ে লেখা?

পূবালী স্পষ্ট বুঝতে পারলেও, পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদ্যুৎ খেলে গেলেও, উত্তরে স্মাইলি ছাড়া কিছু দিল না। বছরখানেকে রক্তিমাভর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যত বেড়েছে, কথাবার্তা যত অন্তরঙ্গ হয়েছে, তত তার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করেছে— মন মন, তোমার শরীর নাই, কবি? কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর একজন ভদ্রমহিলা এ-কথা জিজ্ঞেস করতে পারে না কোনও পুরুষকে। এতদিন পর মাঝরাতে হোয়াটস্যাপে এসে পড়া এই কবিতা জানিয়ে দিল— কবির শরীর আছে। সে শরীর পূবালীর জন্যে উদগ্রীবও হয়ে আছে। জেনে নিশ্চিন্ত লাগল, আবার ঘুমও উড়ে গেল। টুনি রোজকার মতো ফোনে কী একটা সিরিজ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ল, তখন রাত একটা। কিন্তু পূবালীর কিছুতেই ঘুম এল না। পারলে তৎক্ষণাৎ সে ছুটে চলে যেত রক্তিমাভর কাছে। কাজটা কি ভালো হত? শঙ্করলাল সামন্তের জন্যে নিশ্চয়ই নয়। মণিদীপা সরকারের জন্যেও নয়। কিন্তু যার বর শারীরিক, মানসিক কোনও সম্পর্কই রাখার প্রয়োজন বোধ করে না, কেবল দায়িত্ব পালন করে যায়— তার জন্যে কাজটা কী এমন খারাপ? যার বউ বরকে পাত্তা না দিয়ে এর-তার সঙ্গে প্রেম করে বেড়ায়— তার জন্যেই বা কেন খারাপ? এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই ভোর হতে দেখল পূবালী। দুপুরে বার্তালাপ হল—

শুধু স্মাইলি দিলেন যে?

আর কী চেয়েছিলেন?

উত্তর

কিসের?

একলাই সাঁতার দিয়ে যাব?

আমি কী জানি?

আপনি ছাড়া কে জানবে? জলকেলিতে আপনাকেই তো চাই

ছিঃ!
অন্যের বউকে এইসব বলছেন?
সাহস তো কম নয়

কী করব বলুন?
সবই আমার কপালের দোষ
নিজের বউয়ের মন পেলাম না
যার মন পেলাম বলে ভাবছি তিনিও ধরা দিচ্ছেন না
আমারই ভুল
সোনার হরিণ কি আর এত সহজে ধরা দেয়?
স্রেফ কয়েকটা হোয়াটস্যাপ মেসেজে আর এক কাপ কফিতে?
আপনার জন্যে কত কবিতা যে লিখেছি, আরও কত মাথায় ঘুরছে
কেমন করে যে আপনাকে বোঝাই

কবিরা মহিলাদের বানিয়ে বানিয়ে এরকম অনেক কথা বলে
যে মহিলাকে পছন্দ হয় তাকেই বলে
আমাকে কচি খুকি পেয়েছেন?

অনেকে বলে ঠিকই। কিন্তু আপনার-আমার ব্যাপারটা আলাদা
বিশ্বাস করুন
আপনি যে আমার কতখানি জায়গা ভরাট করেছেন পূবালী
আপনাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে পারলে আমার জীবনটাই বদলে যাবে

পূবালী লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেলল যে তারও একই অবস্থা। তারপর শুরু হয়ে গেল অভিসারের স্থান, কাল নির্ধারণ। একবার করে ঠিক হয়, আর বাতিল হয় পূবালীরই কোনও না কোনও আশঙ্কায়। প্রতিবার বাতিল হয় আর রক্তিমাভ আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে, পূবালী আরও মরিয়া। টুনি সভয়ে দেখে, মা আবার কথায় কথায় রেগে যাচ্ছে। এরকম সময়ে একদিন টিচার্স রুমের সবচেয়ে দুষ্টু মেয়ে সঞ্চয়িতা আলোচনা উস্কে দিল— কে কে আরেকবার সুযোগ পেলে এখনকার বরটাকেই নেবে বলো? আর কে কে বদলাতে চাও? দেখি কোনদিকে বেশি লোক হয়।

অঙ্কের পঞ্চাশোর্ধ্ব চন্দ্রাদি সাততাড়াতাড়ি হাত তুলে বললেন, আমি বাবা রাখার দলে। কিন্তু সঞ্চয়িতা ছাড়বে না।

—ওসব হাত-ফাত তুললে হবে না। ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলতে হবে কেন এই বরকেই চাও, বা কেন নতুন বর চাও।

চন্দ্রাদি বললেন, এর আবার ব্যাখ্যা কী রে বাপু! সেই কবে বাপ-মা দুজনকে জুতে দিয়েছে, আর কি কোনও পুরুষ জীবনে চক্ষে দেখেছি? সে-ও আর কাউকে দেখেনি। সুখে দুঃখে এতগুলো বছর কাটালাম একসঙ্গে। খামোখা বুড়ো বয়সে সুস্থ শরীর ব্যস্ত কত্তে যাব কেন?

রূপা বলল, এখনকার কথা তো হচ্ছে না। ধরো তোমাকে আবার তোমার বিয়ের বয়সের চন্দ্রা বর্মণ করে দেওয়া হল। তাহলে কী করবে?

চন্দ্রাদি সেই নিজের বরের পক্ষেই ভোট দিলেন। ইতিহাসের সালমা আর বন্যা, কেমিস্ট্রির রুক্মিণী কিন্তু বুক ফুলিয়ে বলে দিল— ওরা সুযোগ পেলে বদলে ফেলত। পূবালীর বুক ঢিপঢিপ করছিল। সবাই যদি বলত এখনকার বরকেই চায়, তাহলে বোঝা যেত কেউ ভেঙে বলতে চাইছে না। পূবালীও অনায়াসে মিথ্যে কথাটা বলে দিতে পারত। কিন্তু বেশ কয়েকজনের কথা শোনার পরে সত্যিটাই বলতে ইচ্ছে করছে, অথচ ভয়ও হচ্ছে। সঞ্চয়িতা ছাড়া রক্তিমাভর ব্যাপারে আর কেউ জানে না বলেই তো পূবালী জানে। কিন্তু উমাদি আবার কিছু জেনে বসে নেই তো? এখন যদি পূবালী নিজের স্বামীকে বদলে ফেলতে চায় শুনে দুয়ে দুয়ে চার করে ফেলে!

দানটা অবশ্য পূবালী পর্যন্ত এসে পৌঁছল না। অগ্নিদির কাছে পৌঁছতেই উনি বললেন, জানি না বাবা আজকাল তোদের এসব মনে আসে কেন। আমরা তো জানতাম বিয়ে জন্মজন্মান্তরের সম্পর্ক। আমাদের মা-মাসিদের আলাদা ব্যাপার ছিল। তখন তো বাপ-মা যার গলায় মালা দিতে বলত তাকেই দিতে হত। অন্য উপায় ছিল না। আমরা তো আর সেই আদ্যিকালের লোক নই; আমার লাভ ম্যারেজ, আমার দাদার লাভ ম্যারেজ, আমার দুই বোনেরও লাভ ম্যারেজ। তা নিজে দেখেশুনে এমন লোককে পছন্দ করবই বা কেন, যাকে বদলে ফেলতে ইচ্ছে করবে?

ভূগোলের অদিতিদি বলল, সব বাড়ির সিচুয়েশন এক নয় গো দিদি। অনেক বাড়িতে এখনও মেয়ের মতকে পাত্তা দেয় না। আবার এরম বাড়িও আছে যেখানে বাবা-মা, ছেলেমেয়ে সকলেরই প্রেম করে বিয়ে। ফলে…

—না রে অগ্নি, প্রেম করে বিয়ে করলেই যে শান্তি পাওয়া যাবে তারও আজকাল গ্যারান্টি নেই, উমাদি বলে উঠলেন। সবাই থমকে গেল।
—সে কী রে! এরম বলছিস? অগ্নিদি জিজ্ঞেস করলেন।
—এই আমার মামাতো বোনের জীবনটাই দ্যাখ না…
—কোন বোন? রক্তিমাভ সরকারের বউ? পূবালীর ঠোঁটে এসে যাওয়া প্রশ্নটা সঞ্চয়িতা করে ফেলল।
—হ্যাঁ। ওদের তো প্রেম করেই বিয়ে। সেই কলেজ থেকে প্রেম। দুজনেই এমএ পাশ করতে না করতেই চাকরি পেয়ে গেল, বিয়েও হয়ে গেল ভালোয় ভালোয়। ভালোই তো ছিল শুনতাম। ছেলেপুলে হয়নি বটে, সে তো আজকাল কতজন ছেলেপুলে চায়ও না। এখন শুনছি জামাইয়ের নাকি চরিত্র খুব খারাপ।

সঞ্চয়িতা পূবালীর উলটোদিকের চেয়ারেই বসে। দুজনের চোখাচোখি হল। সঞ্চয়িতা জানতে চাইল— খুব খারাপ মানে?

—আর বলিস না। আমাদের বাড়িতে কত যাতায়াত করেছে… ভালো, ভদ্র ছেলে ভাবতাম। মাসখানেক হল ঝুমা ব্যাগপত্তর নিয়ে বাপের বাড়ি চলে এসেছে, বলছে ডিভোর্স দেবে। ছেলেটার নাকি একাধিক অ্যাফেয়ার।
—একাধিক!
—হ্যাঁ রে। আগে তো আমাদের বলেনি, আমার মামা-মামি জানত। মাস ছয়েক আগে নাকি বাইপাসের ধারে কোন হোটেল থেকে কান ধরে বাড়ি নিয়ে এসছিল ঝুমা। রক্তিমের অফিসেরই কে দীপাকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল। ও সেদিনই চলে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু বদমাশটা হাতে-পায়ে ধরে আটকেছিল। বলেছিল আরেকটা চান্স দাও, আর কখনও হবে না। মামা-মামিও বুঝিয়েছিল, ভুল মানুষমাত্রেই করে। দ্যাখ যদি শুধরে যায়…

রূপার মুখে কিছুই আটকায় না, বলে দিল— শুধরোবে না হাতি। কুকুরের লেজ কোনওদিন সোজা হয় না, পুরুষমানুষের সুড়সুড়ি কোনওদিন যায় না।

অন্যদিন সিনিয়ররা মৃদু ধমক দিতেন। কিন্তু উমাদি বললেন— তা যা বলেছিস। এখন নাকি একসঙ্গে তিন-চারটে মেয়ের সঙ্গে চালাচ্ছে। একদিন মাল খেয়ে আউট হয়ে বাড়ি ফিরেছিল, ঝুমা দেখে রাত বারোটা-একটাতেও টিং টিং করে ফোনে মেসেজ এসেই যাচ্ছে। তারপরে কীসব কায়দা কলম করে ফোনটা আনলক করে দেখে সব মহিলাদের মেসেজ। সবার সঙ্গেই প্রেমে ডগোমগো, সবাই জানে তাকে ছাড়া রক্তিমের চলবে না। এমন বদ।

স্কুলের সবচেয়ে জুনিয়র দিদিমণি, বাংলা বিভাগের সদ্যবিবাহিত শুচিস্মিতা বলল— এই মেয়েগুলোই বা কারা? এরা জানে না যে উনি বিবাহিত? না জানার তো কথা নয়, রক্তিমাভ সরকার যথেষ্ট বড় নাম।

পূবালীর যে ঘাড় ঝুলে পড়েছে সেটা সঞ্চয়িতা ঠিকই খেয়াল করেছিল। সে মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করল— কিন্তু উমাদি, কিছু মনে কোরো না… আমি শুনেছি ওঁর বউও নাকি… মানে একটু… লুজ ক্যারেকটার?

—যাঃ! এসব কে বলে তোদের? ও জীবনে একটা প্রেম করেছে, একটাই বিয়ে। সত্যি যদি ওরকম স্বভাব হত তা-লে এই নিয়ে রাগারাগি করে বাড়ি চলে আসত? আজকাল তো এরম কতই হয়। স্বামীও ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়, স্ত্রীও। নামকরা লোকেদের মধ্যে তো এসব জলভাত শুনি। ঝুমা তা-লে তেমন করেই থেকে যেতে পারত না?

 

ছয়.

সঞ্চয়িতা পূবালীকে অনেক করে বোঝাল যে এই জঘন্য মিথ্যেবাদী লোকটার সঙ্গে আর একদিনও সম্পর্ক রাখা উচিত নয়। পূবালী সব শুনল এবং একমত হল। তারপর রক্তিমাভর কথামতো এক শনিবার হাফছুটির পর কবির এক পরিচিতের নিউটাউনের ফাঁকা ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছল। কবির রুচি আছে— সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে পিয়ানোয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর, ফ্ল্যাট রুম ফ্রেশনারে ম ম, ঢুকতেই কবি নিজে হাতে পূবালীকে খাওয়ালেন এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস, ইয়া বড় একটা চিকেন কবিরাজি আর বলরাম মল্লিক রাধারমণ মল্লিকের সন্দেশ। হাত মুখ ধুয়ে আসতেই কবি ভারি রোম্যান্টিক গলায় কানের কাছে মুখ এনে বললেন, আপনার জন্যে নিজে পছন্দ করে একটা জিনিস কিনেছি। বড় বেডরুমটায় আছে। গিয়ে দেখুন প্লিজ।

পূবালী হেসে বলল— আমি অনেকদূর থেকে আসছি, এটা মনে রেখে যে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন এতেই আমি কৃতার্থ। ওটা আমার লাগবে না। আপনার তো আরও অনেক মক্কেল আছে আমার মতো, তাদের কাউকে পরতে বলবেন।

কবি যে বজ্রাহত তা পরিষ্কার দেখা গেল, কিন্তু ওই যে, সামলে নেওয়ার শিক্ষা।

—এসব তুমি কী বলছ, তন্দ্রা?
—তন্দ্রা নম্বর কত? যাকগে বাদ দিন। আমার, আপনার দুজনেরই সময় বাঁচানো দরকার। যেটা বলব বলে এসছিলাম সেটা বলে বেরিয়ে পড়ি, আপনি অন্য কোনও তন্দ্রাকে ডেকে নিন…
—ছি ছি, এসব কী…
—ন্যাকামোটা এবার বন্ধ করুন না, পূবালী লাল ছাড়া কাউকে এভাবে ধমকেছে বলে নিজেই মনে করতে পারল না। শুনুন, আপনি আমার সঙ্গে শুতে চাইছিলেন তো? আমিও আপনার সঙ্গে শুতে চাইছিলাম। কিন্তু তফাত কী বলুন তো? আপনি শোয়ার জন্যে একটা পছন্দসই শরীর খুঁজছিলেন, আর আমি এমন একটা মানুষের সঙ্গে শুতে চাইছিলাম যে আমাকে ভালোবাসে। আপনার সঙ্গে শোব না, কারণ আপনার ভালোবাসার ক্ষমতাই নেই। এরকম লোকের সঙ্গে শোয়ার থেকে বোধহয় ইমপোটেন্ট লোকের সঙ্গে শোয়াও ভালো। ইমপোটেন্ট লোককে তাও দয়া করতে পারি। আপনি দয়ারও অযোগ্য। এটাই বলতে এসেছিলাম। চলি।

পরপর এতগুলো চড় খেয়ে কবি রক্তিমাভ সরকার এক চুল নড়তে পারলেন না, পূবালী বেরিয়ে এল। অবশ্য অধ্যবসায়ের অভাব থাকার অভিযোগ এই কবির বিরুদ্ধে করা যাবে না। কারণ তিনি পরদিন দুপুরে হোয়াটস্যাপে পাঠালেন সেই কবিতা, যা পূবালীর বহুকাল ধরে মুখস্থ এবং উমাদির ছেলের বৌভাতের রাতে কবির প্রথম মেসেজ পেয়ে মনে পড়েছিল। সেই ‘চন্দ্রে তোমার গন্ধ লেগে আছে’ ইত্যাদি।

উত্তরে পূবালী লিখল—

ওহে ভাদ্রমাসের কুকুর
এখন বেলা দুপুর।
চাঁদ উঠিলে রাতে
বউয়ের নরম হাতে
খাইলে দুমাদ্দুম
বেরিয়ে যাবে দেশসুদ্ধ পীরিত করার ধুম।

তারপর ব্লক করে দিল।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...