সোহিনী ভট্টাচার্য

পাঁচটি কবিতা

 

তফসিল

যে সাড়ে পাঁচ বেলা আমাদের আলাপের সুযোগ হবে আমি সেই সময়ের মধ্যেই তৈরি করতে চাই গেহলরের বুকে থাকা অন্য কোনও এক বিরাট পাহাড় কেটে একটা রাস্তা, আমি চাই উলের উষ্ণতা ভরে থাকা একটা কিংবা দুটো দুপুর কাছিমের গতিতে গড়িয়ে যাক রাতের ছায়ায় ঢাকা কনকনে মাঘমাস অবধি, ভাবতে চাই কতটা দুরন্ত প্রেমে মজে বিখ্যাত গায়িকার সঙ্গে শেষমেশ আর কেন একসাথে থাকা সম্ভব হয়নি কোনও এক চেনা বা অচেনা লেখকের। চাই একসাথে বুঝতে বিশ্ব-গোলার্ধের প্রান্তে থাকা যাপনের কথা যা প্রতিমুহূর্তে দিনের উজ্জ্বল আলোয় স্পষ্ট করে দিচ্ছে শরীরের হাজার ক্ষত, কোন আবেগে সেই শিল্পী শানিত বেলওয়ারির ওপর অনায়াসে নেচে গাঢ় সবুজ রক্তে রাঙিয়ে দিয়ে ছেড়ে যাচ্ছেন বন্দর, ছেড়ে যাচ্ছেন সেই নাচঘর সেই সাজসজ্জা চিরতরে। যে সাড়ে পাঁচ বেলা আমাদের দেখা হবে আমি হিসেব করে নেব ঠিক কতটা চাল আর ডাল মিশিয়ে রেঁধে রাখব আমার সন্তানদের জন্য, তারা মোট কজন আমার কাছে খাবে। আমি ভাবব সেবারের যুদ্ধে যাকে হারিয়েছি যে আমার সহযোদ্ধা তাকে নিয়ে আমি আরও কতগুলো যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, হয়তো ব্যক্ত করব আমার দুঃখ, হয়তো করব না। তোমার খবর দেব ওই মেয়েটির যার জ্বরে গা পুড়ছে যার মাথার উপর খোলা আকাশ পিঠের নিচে ফুটপাথ। এই নিয়ে ওর এক মাসের মধ্যে ছয়বার জ্বর হল, বিগত পাঁচবার সামলেছে এবার বোধহয় আর সারবে না। আমি চা খেতে খেতে ভেবে নেব এরপরে মাসের শুরুতে নাকি শেষে আমার বেরোতে হবে পরবর্তী গন্তব্যে। তোমায় যে সাড়ে পাঁচবার আমি দেখতে পাব আমি পেরিয়ে যেতে শুনব সময়কে, পেরিয়ে যেতে যেতে সময় জানিয়ে যাবে তোমার চলে যাওয়ার কথা যা আমার অবগত। জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখব পৃথিবীর মুখ আমি দেখতে পাচ্ছি, গুনগুন করে উঠব হয়তো “একটা জীবন অসম্ভবের মতো অবাক করা, তোমার আমার আজ আগামীর দান তোমার আমার এই হাতেই ধরা”। সাড়ে পাঁচবারের মধ্যে আড়াইবার আমি চিঠি লিখব তোমায় তোমারই সামনে বসে। চোখের ভাষাকে অক্ষরদান করলে তাকে কেমন সুন্দরী দেখায় এটা আমারও তো অজানা। তুমি আমি মুখোমুখি যে সাড়ে পাঁচবার বসার সুযোগ পাব সব হুবহু একই থাকবে বিশ্বাস করো! কেবল আমি আর একটু করে হিসেবি হয়ে উঠব প্রতিবার।

 

শীতকালীন পরাজয়

বাবার একটা কালো রংয়ের শাল ছিল। মিহি সুতোর কাজ ছিল ধার ঘেঁষে। প্রতিবার শীতকালের ঠান্ডা গায়ে লাগার আগেই বাবা বের করতেন শালটি। ধুয়ে শুকিয়ে গায়ে চাপিয়ে কিছুক্ষণ থাকার পরে বলতেন ঘাম হচ্ছে। আমরা বাকিরা ভাবতাম ঠান্ডায় সক্কলে জমে যাচ্ছি আর বাবা বলেন কিনা ঘাম হচ্ছে তাও আবার একটা শাল গায়ে চাপিয়ে! জানি না এই বয়সে এসে মনের এখন এই কথাটির অন্য কোনও গভীর বাঁক খুঁজতে চাওয়ার অর্থ কী। বাবা শালটি খুলে রাখতেন, ভাঁজ করে যত্নে আবার রেখে দিতেন নিজের জন্য বরাদ্দ আলমারির সবচেয়ে নীচের তাকে। শীতের দুপুরে কখনও গানের বইগুলির সঙ্গে শালটি নিয়ে ছাদে রোদ্দুরে বসে বিছিয়ে দিতেন মাদুরের ওপর। বইগুলো উষ্ণতা পেয়ে হাত পা সজাগ করে আড়মোড়া ভেঙে উঠত। অক্ষরগুলো আলোর মুখ দেখে আরও বেশ কিছুটা স্পষ্ট হত। শালটি তারে ঝুলে থেকে দৃশ্যত জানিয়ে যেত এই নিয়ে কততম বছর সে ঢাল হয়ে বাবার শরীরে জড়িয়ে থাকতে সক্ষম হচ্ছে কিন্তু বাবার অস্বীকৃত মুখমণ্ডল যেন সবটুকু বুঝেও সেই যোদ্ধাসম ওম গ্রহণে বিমুখ। এই দুইয়ের সম্পর্কের মাঝে কোথাও আমি এসে পড়েছিলাম, আচমকা। বাবার মৃত্যুশয্যায় কেন যে একটিবার শালটি জড়িয়ে দিলাম না! বাবা চলে গেলেন, একা। রেখে গেলেন শালটি। আজ চেষ্টা করতে ইচ্ছে হয় সেই পুরনো শীতের রোদে মিঠে নলেনের মতো আদর খুঁজে নিতে। এই মুহূর্তে বাবার সেই কালো শালটি আমার হাতে, আমার শরীর জুড়ে তার ওম, তার চিরকালীন আবেগ, তবে বেশ কিছুটা দুর্বল।

 

আসল ছবি

গাঢ় রঙের শাড়ির আঁচলে ঢাকা মর্মস্থল। এক জোড়া উদাস চোখ আকাশ দেখছে কেবলই প্রতিদিন। মুখটা পরিপাটি আর শরীরে এক অদ্ভুত মাদকতা। বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকে মুখ বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির কোলে, সন্ধে নামতে তখনও দেরি। পাশেই কোনও গৃহস্থের শাঁখের আওয়াজ গুনে গুনে তিনবার বেজে থেমে গেল। গুমোট একটা গরমে ক্রমাগত ঘামছে শরীর, কারখানার কাজ চলছে, শ্রমিকদের একনাগাড়ে নিঃশেষিত হওয়ার শব্দ কানে আসছে। রাত বাড়লে সব শব্দ, সব বাস্তবতা, সব উচিত-অনুচিতকে কবর দিয়ে মশারি টাঙিয়ে নিতে হয়। তারপর এমনই এক ঘর্মাক্ত সন্ধেবেলায় আলোড়ন ওঠে পাড়ায়, কে যেন বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহনন করল। মেয়েটা উন্মাদনা থেকে মৃত্যু অবধি কেবল যুদ্ধ করে গেল।

 

জানা যেত হয়তো

বিশ্রীভাবে বেড়ে ওঠা দেওয়ালগুলো, বাড়িটা খুব অস্বস্তিকর পুরনো, পুরনোর টান আর সেই টানে আকাশভোলানো হাসির চিহ্ন নেই, গাছগুলো মৃত, মালি কয়েকশো বছর আগে থেকেই নিরুদ্দেশ, নিরুত্তাপ গোটা কয়েক প্রাণের আনাগোনা, তাদের নোনা ত্বকে স্মৃতির ভার, চোখ বুজে যাওয়া বিদীর্ণ জরা, হাত-পায়ে যুগের নিষ্ঠুর জং, শুষ্ক চুলের সাথে চামড়ায় বলিরেখার অপার আঁকিবুকি তাল মেলায়, বইপত্র আলমারির গহীন কোটরে, উঠোনে সকালে মুখ চাওয়া একে অপরের, দুপুরে জানলার লোহার শিকের ভেতরের ক্লান্ত ব্যর্থতা, আকাশের গিলে খেতে আসা, দাঁড়কাকের উগ্র চোখরাঙানি, মাটির ভাঁড় শুকনো, তেষ্টায় বুক ফেটে কাঠ, মৃত্যুর এক নারকীয় খেলা ঘর-বাগানময়, তবু বিরামহীন অপেক্ষা, নিরন্তর অজানা প্রতীক্ষা।

 

জন্মক্ষণ

তোমার ফেরার খবর পেলাম। এখন শহরের অলিগলি তোমার গল্প মুখস্থ আওড়াতে পারে। তুমি এলে মন্দা বাজারের বিক্রিবাট্টা দ্বিগুণ হয়, সোনালী রোদ নম্র হয়ে আসে, নীল নদী সাতরঙা স্রোতে সেজে ওঠে, ফুটপাথের খিদের সঙ্গে পাল্লা রেখে ঘুম জড়িয়ে আসে চোখে, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যায় সমস্ত পরাধীন শেকল ছিঁড়ে। তুমি এলেই এই সব হয়। আবার হয়তো যাবতীয় এই সবকিছু সবসময়ই হয় চারপাশে কেবল তুমি এলে আমার চোখ ফোটে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...