
মিলিন্দ মুরুগকর
আজ আমরা আওরঙ্গজেব নিয়ে আলোচনা করছি, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর মাত্র ৮০ বছরের মাথায় ব্রিটেনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে সরাসরি আধিপত্য কায়েম করে এবং তীব্র শোষণের সূচনা করে। তারা ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে ভারত থেকে প্রায় ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ লুঠ করেছিল। এই লুঠ ১.৮ বিলিয়ন ভারতীয়র দারিদ্র্য ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবুও, আজ ব্রিটিশ অফিসারদের সমাধি আমাদের বিব্রত করে না
আজকের মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে আওরঙ্গজেব প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহাসিক ঘটনা আজ যেন অস্বস্তিকরভাবে সাম্প্রতিক। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা যেন মধ্যযুগীয় যুদ্ধ পরিচালনা করছি। কৃষকের আত্মহত্যা বা বেকারত্বের মতো সমস্যা চলমান থাকলেও, সে-সব নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন কী? বরং আমাদের সামনে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন হল— আওরঙ্গজেব!
এই মানসিকতা থেকে চলুন একটু কল্পনা করি: ধরা যাক মধ্যযুগের হিন্দুস্তান, যার ভৌগোলিক সীমানা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের মতো নির্ধারিত, এবং তার নিজস্ব এক বাহিনী রয়েছে যা এই অঞ্চল রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। এবার ধরা যাক, উজবেকিস্তান দেশটিও একইভাবে নির্দিষ্ট সীমানা ও প্রতিরক্ষাবাহিনী নিয়ে গঠিত। ধরুন, উজবেকিস্তান থেকে এক যোদ্ধা— আওরঙ্গজেব— হিন্দুস্তানে প্রবেশ করলেন, দেশের কেন্দ্রীয় শাসন দখল করলেন এবং শাসন চালালেন। শেষ পর্যন্ত, হিন্দুস্তানের জনগণ তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল, এবং তাঁকে পিছু হটতে বাধ্য করল। এই পরিস্থিতিতে, আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হলে,[1] হিন্দুস্তানে কেবল তাঁর একটি সমাধি রয়ে গেল, কিন্তু তাঁর সেনাবাহিনী ও পরিবার ফিরে গেল উজবেকিস্তানে। এরকম হলে আজকের দিনে আওরঙ্গজেব কি আমাদের জন্য কোনও সমস্যার কারণ হতেন? সম্ভাব্য উত্তর হল— না।
এই কল্পিত পরিস্থিতিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ঐতিহাসিক বাস্তবতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায়। যদিও আজ আমরা আওরঙ্গজেব নিয়ে আলোচনা করছি, তাঁর মৃত্যুর মাত্র ৮০ বছরের মাথায় ব্রিটেনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে সরাসরি আধিপত্য কায়েম করে এবং তীব্র শোষণের সূচনা করে। অর্থনীতিবিদ উৎসা পট্টনায়কের গবেষণা অনুযায়ী, ব্রিটিশরা ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে ভারত থেকে প্রায় ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদ লুঠ করেছিল। এই লুঠ— যা আমাদের বর্তমান জিডিপির ১০ গুণেরও বেশি— ১.৮ বিলিয়ন ভারতীয়র দারিদ্র্য ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ব্রিটিশদের নৃশংসতা সম্পর্কে বাড়িয়ে বলা সম্ভবই নয়। জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড তার একটি উদাহরণ মাত্র। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের পর ভারতীয়দের দমন করতে ব্রিটিশরা যে নিষ্ঠুরতা চালিয়েছিল, তা কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার মতো। ভারত থেকে যে বিপুল সম্পদ লুঠ করা হয়েছে এবং যে হিংস্রতা চালানো হয়েছে, তার মাত্রা অবিশ্বাস্য। তবুও, আজ ব্রিটিশ অফিসারদের সমাধি আমাদের বিব্রত করে না।
এর মূল কারণ হল, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করলেও তাদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর পথে হাঁটেননি। তাঁদের দৃষ্টিতে ছিল একটা ঐক্যবদ্ধ ভারত, যেখানে অতীতের ক্ষোভকে কেন্দ্র করে নয়, বরং ভবিষ্যতের লক্ষ্যকে সামনে রেখে পথ চলা হবে। তাঁরা জাতীয় চেতনায় ব্রিটিশ-বিরোধী বিদ্বেষ স্থায়ীভাবে গেঁথে দেওয়ার পরিবর্তে গণতন্ত্র ও উদারতাবাদের মূলনীতিগুলির ওপর জোর দিয়েছিলেন। অতীতের বোঝা বহন না করে বরং সহনশীলতা ও মুক্তচিন্তার চর্চা করাই তাঁদের লক্ষ্য ছিল।
আওরঙ্গজেব এবং মুঘলরা[2] উজবেকিস্তানের কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন একটি জটিল রাজনৈতিক পরিবেশের একটি অংশ মাত্র। মুঘল সাম্রাজ্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মতো কোনও বহির্দেশীয় রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত না। তৎকালীন হিন্দুস্তানের নির্দিষ্ট কোনও রাজনৈতিক সীমানা ছিল না, এবং হিন্দুস্তানকে রক্ষার জন্য কোনও নির্দিষ্ট সামরিক বাহিনীও ছিল না। হিন্দুস্তানের সেনারা বিভিন্ন রাজাদের হয়ে যুদ্ধ করত এবং প্রায়ই তাদের আনুগত্য বদলাত। এই প্রেক্ষাপটে, আওরঙ্গজেব বা অন্যান্য মুঘল শাসকরা হিন্দুস্তানের উপর কর্তৃত্ব করতেন— এই বক্তব্যের কি প্রকৃত অর্থে কোনও সারবত্তা থাকে?
ব্রিটিশ শাসন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল, যেমনটি আধুনিক শাসনকাঠামোগুলো করে থাকে। এটি শুধুমাত্র কর আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং বাণিজ্য, অর্থনীতি, পুলিশি ব্যবস্থা, শিক্ষা, বিচার এবং বিভিন্ন গণ-কাজের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত ছিল। এর বিপরীতে, মধ্যযুগীয় শাসকদের শাসনব্যবস্থা এ-ধরনের সর্বাত্মক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বৈশিষ্ট্য বহন করত না। তাদের ক্ষমতার প্রভাব সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে খুব সীমিত ছিল। সুতরাং, আওরঙ্গজেব বা অন্যান্য মধ্যযুগীয় শাসকদের শাসন এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসনের মধ্যে এই মৌলিক পার্থক্য বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের মধ্যযুগীয় ইতিহাস নিয়ে অতি-আসক্তি কমাতে সাহায্য করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, আমরা সেইভাবে পরাধীন ছিলাম না, যেভাবে অনেক সময়েই বিশ্বাস করা হয়।
“যদি আমরা আমাদের মধ্যযুগীয় ইতিহাস ভুলে যাই, তবে আমরা আবার দাস হয়ে যাব”— এই যুক্তি আজকাল প্রায়ই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই ধরনের বক্তব্য আসলে ফাঁপা, কারণ মধ্যযুগের “আমরা” এবং আজকের “আমরা” সম্পূর্ণ ভিন্ন। যখন জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাই ছিল না, সীমান্ত বলে কোনও কিছু নির্ধারিত ছিল না, এবং সেগুলোর সুরক্ষার জন্য কোনও নির্দিষ্ট সেনাবাহিনীও ছিল না, তখন ঐক্যের অভাবের কারণে বিদেশি আক্রমণ ঘটেছে— এমন দাবি করা অবাস্তব। যদি আমরা আজকের প্রতিরক্ষা নিয়ে সত্যিই কোনও শিক্ষা নিতে চাই, তবে আমাদের উচিত ১৯৬২ সালে চিনের অনুপ্রবেশ ও ১৯৯৯ সালের কার্গিল সংঘাতে পাকিস্তানের আগ্রাসন থেকে শিক্ষা নেওয়া, কোনও মধ্যযুগীয় আক্রমণ থেকে নয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছিল, তা আজ ক্ষীণ হয়ে গেছে। এর পরিবর্তে, এখন এক ধরনের জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা মধ্যযুগের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে— এমন এক জাতীয়তাবাদ, যা আমাদের চেতনাকে সর্বদা অস্থির করে রাখে।
অতএব, সম্ভবত আরও দীর্ঘ সময় ধরে আওরঙ্গজেব “আমাদের মানসিক জগতের ওপর কর্তৃত্ব” করে যাবেন।
[1] Rezavi, Syed Ali Nadeem. Aurangzeb tried to use religion to hide his failures — he couldn’t. It’s a lesson for all rulers. The Indian Express. Mar 21, 2025.
[2] Yashee. The grave of Aurangzeb: What it tells us about the man, his life. The Indian Express. Mar 23, 2025.
*লেখক অর্থনীতিবিদ। লেখাটি গত ২১ মার্চ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়