
রোহিন ভাট
ভাষা কখনওই অনিচ্ছুক বক্তার ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হলে বেঁচে থাকতে পারে না। আমরা ভারতীয়রা সবাই এক— যারা সংবিধানের প্রতি আনুগত্য রাখি এবং যার সামনে আমরা সবাই সমান। কিন্তু সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে, আমরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা, বিভিন্ন দেবতার উপাসনা করা, ভিন্ন ভিন্ন খাবার খাওয়া এবং বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরা বহু জনগোষ্ঠীর সমষ্টি। আসলে এই নিয়ে বিতর্কের বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রকল্প হল একরূপতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, যেখানে যে-কোনও ভিন্ন পরিচয় মুছে ফেলা হবে যদি তা নির্ধারিত ছাঁচের সঙ্গে খাপ না খায়। কিন্তু এই প্রচেষ্টা অবাস্তব এবং অসম্ভব
গুজরাতে বড় হতে হতে, গুজরাতি অহঙ্কার বা “গুজরাতি অস্মিতা” ধারণাটি আমার চারপাশের মানুষদের কথায় বারবার উঠে আসত। আমরা এই গর্ব অনুভব করতাম আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের নৃত্য, আমাদের খাবার-সহ নানা বৈচিত্র্যময় উপাদান থেকে, যা আমাদের গুজরাতি পরিচয় গড়ে তুলেছিল। তবে সম্ভবত এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি ছিল গুজরাতি ভাষা। বস্তুত, প্রাদেশিক ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি এই গর্ব ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিক থেকে বিজেপির একচেটিয়া দখলে চলে যায়।
আমি অনেক চিন্তা করছি, সলিল ত্রিপাঠীর বই The Gujaratis: A Portrait of a Community পড়া শেষ করার পর থেকে, পাশাপাশি সাম্প্রতিক জাতীয় শিক্ষানীতি (NEP) বিতর্কের প্রসঙ্গেও। এনইপি-বিতর্ক ক্রমশ উত্তরের বিরুদ্ধে দক্ষিণের সংঘাত হিসেবে আকার নিচ্ছে।
হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রবল অবস্থান নিয়েছেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে অভিযুক্ত করেছেন যে, তামিলনাড়ু জাতীয় শিক্ষানীতির প্রস্তাবিত তিন-ভাষার নীতি গ্রহণ না করে শুধুমাত্র দুই ভাষা— তামিল ও ইংরেজি— অবলম্বন করায় রাজ্যের জন্য নির্ধারিত তহবিল মঞ্জুর করা হচ্ছে না। আমি প্রায়ই ভাবি, গুজরাতি অস্মিতা (গৌরব) কোথায় হারিয়ে গেল? একসময় যখন মোদির গৌরব যাত্রা-য় ‘জয় জয় গরবি গুজরাত’ বাজানো হয়েছিল, তখন ভাষাগত অহং দেদার দেখানো হয়েছিল। কিন্তু আজ বিজেপি-শাসিত গুজরাত হয়তো এই চাপিয়ে দেওয়া নীতির সঙ্গে আপস করে নিয়েছে। তবে আমি এই লেখায় দেখাতে চাই যে এই ইস্যু ঐতিহ্যগত বিতর্কের কাঠামোরও বাইরে বিস্তৃত এবং এটি ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক ধারণারও পরিপন্থী।
গুজরাত মহারাষ্ট্র থেকে পৃথক হয়েছিল মহাগুজরাত আন্দোলনের ফলে, যা মূলত একটি ভাষা-আন্দোলন। স্বাধীনতার পর ভারতীয় রাজ্যগুলোর পুনর্গঠনের ইতিহাস আমাদের শেখায় যে ভারত আসলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমষ্টি, এবং এটি একাধিক রাজ্যের একটি ফেডারেল ব্যবস্থা।
১৯৫৩ সালে গঠিত States Reorganisation Commission (রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন), যা ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিল, তারা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে:
ভাষাভিত্তিক রাজ্যের দাবি শুধু সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের প্রতিফলন নয়। এর ব্যাপকতর উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন ভাষাগত গোষ্ঠীর জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।”
সংবিধান প্রণেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হল ধর কমিশন-এর কাছে বিআর আম্বেদকরের জমা দেওয়া ‘মহারাষ্ট্র অ্যাজ আ লিঙ্গুইস্টিক প্রভিন্স’ (একটি ভাষাভিত্তিক প্রদেশ হিসেবে মহারাষ্ট্র) শীর্ষক স্মারকলিপি। সেখানে তিনি লেখেন—
যাঁরা ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পক্ষে, তাঁদের সাধারণ বিশ্বাস হল— প্রতিটি রাজ্যের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। সুতরাং, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের সুযোগ থাকা উচিত। অন্য কথায় বলতে গেলে, এই রাজ্যগুলিতে নিজস্ব স্বতন্ত্র জাতীয়তা বিকশিত হওয়ার সমস্ত উপাদানই মজুত রয়েছে, এবং তাদের সে স্বাধীনতা থাকা উচিত যাতে তারা পরিপূর্ণভাবে নিজেদের জাতীয় সত্তা গড়ে তুলতে পারে।
সংবিধানের ৩৫১ নম্বর অনুচ্ছেদ ভারতীয় ইউনিয়নের ওপর হিন্দি ভাষার প্রসার ও উন্নয়নের দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তবে সংবিধানসভার বিতর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ওডিশার সদস্য লক্ষ্মীনারায়ণ সাহু যুক্তি দিয়েছিলেন যে ৩৫১ নম্বর অনুচ্ছেদটির প্রতিটি প্রাদেশিক ভাষার স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যেও কাজ করা উচিত, কারণ এটি জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৩৫১ নম্বর অনুচ্ছেদের পাঠ বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে, কেন্দ্র সরকার কোনও রাজ্যকে শিক্ষা অনুদান বন্ধ করে তার স্কুলগুলোতে জোরপূর্বক হিন্দি শেখানো বাধ্যতামূলক করতে পারে না। সংবিধান কেন্দ্রকে হিন্দি ভাষার প্রসারে যথেষ্ট ক্ষমতা প্রদান করেছে, এবং এই প্রসার ঘটানো তার একান্ত অধিকারের মধ্যেই পড়ে। তবে, ৩৫১ নম্বর অনুচ্ছেদ কেন্দ্রকে কোনও রাজ্যকে হিন্দি শেখানোর জন্য বাধ্য করার ক্ষমতা দেয় না।
ধরা যাক, কেন্দ্র সরকার যদি সংবিধানের ২৫৬ অনুচ্ছেদের অধীনে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাজ্যকে নির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলেও এটি সম্ভব নয়। কারণ, ২৫৬ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা কেবল সেইসব আইনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যেগুলি পার্লামেন্ট বা রাজ্য বিধানসভায় পাশ হয়েছে। কিন্তু জাতীয় শিক্ষানীতি (NEP) এ-দুইয়ের কোনওটিই নয়, ফলে এর আওতায় কোনও রাজ্যের ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া সাংবিধানিকভাবে বৈধ নয়।
দ্বিতীয়ত, আসুন সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ বিশ্লেষণ করি। এতে বলা হয়েছে:
ভারতের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে বসবাসকারী যে কোনও নাগরিকগোষ্ঠী, যারা একটি স্বতন্ত্র ভাষা, লিপি বা সংস্কৃতি বহন করে, তাদের তা সংরক্ষণের পূর্ণ অধিকার থাকবে।
এই অনুচ্ছেদটি সংবিধানের পূর্বোক্ত আদর্শের আলোকে ব্যাখ্যা করা উচিত। এখানে ব্যবহৃত “যে কোনও নাগরিকগোষ্ঠী” শব্দগুচ্ছ শুধু তামিলনাড়ুর জনগণকেই নয়; বরং এটি গুজরাত, মহারাষ্ট্র, আসাম, বাংলা, পাঞ্জাব-সহ সমস্ত রাজ্যের মানুষকেই অন্তর্ভুক্ত করে। তাদের নিজস্ব ভাষা ও লিপি রক্ষা ও সংরক্ষণের পূর্ণ অধিকার রয়েছে। আর রাজ্য সরকার রাজ্যের জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কিছুই নয়। অতএব, ভাষা সংরক্ষণের প্রশ্নে রাজ্য সরকার কেন্দ্রের চেয়ে রাজ্যের জনগণের ইচ্ছার প্রতি বেশি দায়বদ্ধ।
ভাষা কখনওই টিকে থাকতে পারে না যদি তা অনিচ্ছুক বক্তার ওপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমরা ভারতীয়রা সবাই এক— যারা সংবিধানের প্রতি আনুগত্য রাখি এবং যার সামনে আমরা সবাই সমান। কিন্তু সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে, আমরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা, বিভিন্ন দেবতার উপাসনা করা, ভিন্ন ভিন্ন খাবার খাওয়া এবং বিভিন্ন ধরনের পোশাক পরা বহু জনগোষ্ঠীর সমষ্টি।
এখানে বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রকল্প হল একরূপতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, যেখানে যে-কোনও ভিন্ন পরিচয় মুছে ফেলা হবে যদি তা নির্ধারিত ছাঁচের সঙ্গে খাপ না খায়। কিন্তু এই প্রচেষ্টা অবাস্তব এবং অসম্ভব।
আলফঁস দোদে-র ছোটগল্প ‘দ্য লাস্ট লেসন’-এর নায়ক এক হৃদয়বিদারক মন্তব্য করে, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার ফরাসি শিক্ষককে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং ফ্রান্সে বাধ্যতামূলকভাবে জার্মান ভাষা শেখানো শুরু হয়: “ওরা কি কবুতরগুলোকেও জার্মান ভাষায় গান গাইতে বাধ্য করবে?”
আমি ভাবছি, হিন্দির ক্ষেত্রেও কি তাই?
*লেখক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং The Urban Elite v Union of India বইটির গ্রন্থকার। বর্তমান লেখাটি দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ গত ২১ মার্চ ইংরেজিতে প্রকাশিত।