
শুভদীপ ঘোষ
চলচ্চিত্র ও সময় সংক্রান্ত এই আলোচনায় 'সময়' বস্তুটি কী, তা জানা, একটা প্রাথমিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত 'সময়' কী, এ এক আদি অকৃত্রিম প্রশ্ন। এর সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল সময়ের সঙ্গে আমাদের ও চলচ্চিত্রের সম্পর্ক বা সম্পর্ক-সংক্রান্ত। অর্থাৎ, যদি চেতনা অনুপস্থিত থাকে, তাহলে কি সময়ও অনুপস্থিত থাকবে? বিশেষ করে যেখানে চলচ্চিত্রের (বস্তুত, যে-কোনও শিল্পের) ও চেতনার সম্পর্ক অনস্বীকার্য। চেতনা না থাকলে চলচ্চিত্র থাকবে না, অচেতন মানুষের কাছে চলচ্চিত্র কেন, জগতটাই তো অনুপস্থিত। এদিকে, স্বপ্নাবিষ্ট অবস্থায় আমাদের বাহ্যজ্ঞান থাকে না বটে, অর্থাৎ আমি ও আমার চারপাশের বস্তুজগৎ আলাদা এই বোধ লুপ্ত থাকে বটে, কিন্তু চেতনা থাকে, নইলে স্বপ্নটা দেখছে কে?
আপনি ঠিক করলেন ক্রিস্টোফার নোলানের (১৯৭০-) ছবি ‘ওপেনহাইমার’ (২০২৩) দেখতে যাবেন। আপনি যদি হন অতি-সচেতন দর্শক, তাহলে নিশ্চয়ই এতদিনে পড়ে ফেলেছেন ছবিটি নিয়ে যাবতীয় আলোচনা এবং এমনকি পড়ে ফেলেছেন ওপেনহাইমার (১৯০৪-১৯৬৭) ও ম্যানহাটন প্রজেক্ট সংক্রান্ত নারায়ণ সান্যালের (১৯২৪-২০০৫) তথ্য-উপন্যাস ‘বিশ্বাসঘাতক’। সিনেমা আপনার কাছে নিছক বিনোদনের চেয়ে একটু বেশি কিছু। আবার এও হতে পারে এসব আপনি কিছুই পড়েননি, স্রেফ বিনোদনের অভিপ্রায় ঢুকে পড়তে চাইছেন ‘ওপেনহাইমার’-এর প্রদর্শনীতে। আপনি যেরকম দর্শকই হন, আপনি যাই করুন, একটি ব্যাপার নিশ্চিত যে আপনাকে জেনে নিতে হবে ছবিটির প্রদর্শনের সময় এবং ছবিটি কতক্ষণের। এই একটি ব্যাপার উপন্যাস, কবিতা, গল্প বা নাটক পড়ার সময় কিন্তু থাকে না। বড় উপন্যাস বা দীর্ঘ কবিতা যতটা বিষয়ের ব্যাপ্তিকে সূচিত করে, দীর্ঘ সময়কে ততটা সূচিত করে না। কিন্তু একটি চলচ্চিত্রের বা অভিনীত একটি নাটকের থাকে একটা প্রারম্ভিক সময় ও থাকে অবধারিতভাবে একটা ব্যাপ্ত সময়। যেমন ‘ওপেনহাইমার’-এর প্রদর্শনের সময় যদি হয় সন্ধ্যা ৬টা, তাহলে তার ব্যাপ্ত সময় হবে ১৮০ মিনিট। তার মানে, আমরা যা বলতে চাইছি তা হল, আসলে, চলচ্চিত্রে সময়ের মধ্যে রচিত হয় স্থান। সাহিত্য-মাধ্যমে ব্যাপারটা হয় ঠিক উল্টো, মানে, সেখানে স্থানের মধ্যে রচিত হয় সময়।
এখন চলচ্চিত্র ও সময় সংক্রান্ত এই আলোচনায় ‘সময়’ বস্তুটি কী, তা জানা, একটা প্রাথমিক কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত ‘সময়’ কী, এ এক আদি অকৃত্রিম প্রশ্ন। বিআর চোপড়ার (১৯১৪-২০০৮) মহাভারত মনে আছে? “ম্যায় সময় হু…”, নব্বইয়ের দশকে রবিবার সকাল ৯টায় প্রদর্শিত কমবেশি ১ ঘণ্টা ব্যাপ্ত এই মহাভারত সিরিয়াল ছিল প্রত্যেক ভারতবাসীর বাধ্যতামূলক দূরদর্শন-বিলাস। এই “ম্যায় সময় হু…” হল নিরবধি সেই সময় বা কাল যা জগতে সংঘটিত যাবতীয় ঘটনার মূক পর্যবেক্ষক। একজন অনুপস্থিত, কিন্তু সর্বত্র উপস্থিত দার্শনিক যেন, যে সব কীর্তিকলাপের সাক্ষী, কিন্তু তাঁর নিজের কিছু করার নেই। অর্থাৎ ‘সময়’ নিয়ে দার্শনিক চিন্তাভাবনা সেই আদিকাল থেকেই বিদ্যমান। ‘সময়’ ব্যাপারটা নিয়ে চলুন নির্দিষ্টভাবে আরেকটু ভাবা যাক।
বেলা কবে গিয়াছে বৃথাই
এতকাল ভুলেছিনু তাই
হঠাৎ তোমার চোখে, দেখিয়াছি সন্ধ্যালোকে
আমার সময় আর নাই….
মানতেই হবে কাব্যের অসামান্য ধ্বনি, অলঙ্কার ইত্যাদি বাদ দিয়েও রবি ঠাকুরের কবিতার এই অংশটি যথাযথ অর্থবহ। বিষয়ী (subjective) দৃষ্টিভঙ্গিতে বললে বলতে হয়, উক্ত লাইনগুলিতে কিছু বাস্তব ও কিছু সম্ভাব্য পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তোলা সময়ের যে অনুষঙ্গ রয়েছে, তা সহজেই আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে ‘সময় কী?’ তাহলে? এ প্রসঙ্গে সেইন্ট অগোস্টিনের (৩৫৪-৪৩০) একটি লেখার উল্লেখ করি—
For what is time? Who can readily and briefly explain this? Who can even in thought comprehend it, so as to utter a word about it? But what in discourse do we mention more familiarly & knowingly, than time? And, we understand, when we speak of it; we understand also, when we hear it spoken of by another. What then is time? If no one asks me, I know; if I wish to explain it to one that asked, I know not…
অনেকটা “ম্যায় সময় হু…”-র ব্যঞ্জনা কি? পুরোপুরি নয়। শেষ লাইনটি, “কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস না করে, আমি জানি; যদি আমি বিষয়টা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি যে জিজ্ঞেস করেছে তাকে, আমি জানি না…”, কিন্তু কেন? ধরা যাক, এই বাক্যটি— “পাঁচ ভাই একসাথ, মারছে ঘুষি খাচ্ছে ভাত, আরও পাঁচ সাথে তার, কেমন আছেন, নমস্কার” (জয় বাবা ফেলুনাথ)।

ভাই, ভাত ইত্যাদি শব্দের দ্যোতক বস্তুটিকে আমরা বাস্তবে পেয়ে যাই, কিন্তু ‘পাঁচ’? ‘পাঁচ’ শব্দের কোনও দ্যোতক বস্তু বা বিষয় বাস্তবে আছে কি? লক্ষ করার বিষয়, ‘পাঁচ’ শব্দের দ্যোতক কোনও বস্তু বাস্তবে না থাকলেও এই শব্দটি কিন্তু আমাদের কাছে অর্থহীন নয়! এ ব্যাপারে মনে পড়বে ডেরেক জার্মান (১৯৪২-১৯৯৪) নির্দেশিত ১৯৯৩ সালের ‘উইটগেনস্টাইন’ ছবিটির কথা। ছবিটির নির্মাণশৈলীতে আধুনিক নাট্যশৈলীর আদল আছে। ভিয়েনায় জন্মানো কেমব্রিজ-শিক্ষিত দার্শনিক লুডভিগ উইটগেনস্টাইনের (১৮৮৯-১৯৫১) জীবন ও চিন্তাধারার একটি নাটকীয় প্রকাশ ছবিটি। উইটগেনস্টাইনের প্রধান আগ্রহ ছিল ভাষার প্রকৃতি এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে। পরিচালক ডেরেক জার্মান উইটগেনস্টাইনের শৈশব থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়ে শেষে কেমব্রিজে অধ্যাপনা এবং বার্ট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০) ও জন মেইনার্ড কেইনসের (১৮৮৩-১৯৪৬) সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের মাধ্যমে চিত্রিত করেছেন সমগ্র জীবনটিকে।

কিন্তু আমাদের আগ্রহ হল ভাষাবিশ্লেষণী দার্শনিক উইটগেনস্টাইনের সেই বক্তব্যে, “For a large class of cases – though not for all in which we employ the word ‘meaning’, it can be defined thus: the meaning of a word is its use in language.” অর্থাৎ, কোনও দ্যোতক বস্তু জগতে থাকতেই হবে এমন নয়, বরং লক্ষ করতে হবে ‘পাঁচ’ শব্দটি ভাষায় কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং সেটাই পাঁচ শব্দের নিয়ন্ত্রক! সময়ের ক্ষেত্রেও কি তাহলে তাই? সময়ের দ্যোতক কোনও বস্তু না পেলেও আমরা ‘সময়’ শব্দের অর্থ খুঁজব ভাষায় তার ব্যবহারে? ‘সময়’ নিয়ে বিশ্বব্যাপী চিন্তার যে ইতিহাস তাতে সময় সংক্রান্ত সমস্যা দ্যোতনার সমস্যা এবং শব্দের অর্থ নয়, ব্যবহারই প্রণিধানযোগ্য— ব্যাপারটা সন্দেহাতীত নয়। হতে পারে এর গূঢ়ার্থ ভাষাবিশ্লেষণের নিজস্ব পথে আরও গভীরে নিহিত। কিন্তু সে পথ আমাদের অভিপ্রেত নয়, কারণ সময় ও চলচ্চিত্র সংক্রান্ত এই আলোচনায় তা হবে অপ্রাসঙ্গিক। এই অংশের উল্লেখ রইল এই জন্য যে অতি-আধুনিক কালেও ‘সময়’ যে জ্ঞানের একটা অস্পষ্ট অঞ্চল, সেটা সূচিত করা।
এর সঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল সময়ের সঙ্গে আমাদের ও চলচ্চিত্রের সম্পর্ক বা সম্পর্ক-সংক্রান্ত। অর্থাৎ, যদি চেতনা অনুপস্থিত থাকে, তাহলে কি সময়ও অনুপস্থিত থাকবে? বিশেষ করে যেখানে চলচ্চিত্রের (বস্তুত, যে-কোনও শিল্পের) ও চেতনার সম্পর্ক অনস্বীকার্য। চেতনা না থাকলে চলচ্চিত্র থাকবে না, অচেতন মানুষের কাছে চলচ্চিত্র কেন, জগতটাই তো অনুপস্থিত। এদিকে, স্বপ্নাবিষ্ট অবস্থায় আমাদের বাহ্যজ্ঞান থাকে না বটে, অর্থাৎ আমি ও আমার চারপাশের বস্তুজগৎ আলাদা এই বোধ লুপ্ত থাকে বটে, কিন্তু চেতনা থাকে, নইলে স্বপ্নটা দেখছে কে? ভারতীয় চিন্তা বলে, হালকা ঘুমেই মানুষ স্বপ্ন দেখে, গভীর ঘুমে স্বপ্ন তো দেখেই না, এমনকি অতি-গভীর ঘুমে মানুষের সময়-চেতনাও সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়ে যায়! মনে হয় যখন ঘুমিয়েছি, তখনই উঠলাম! স্বপ্নাবিষ্ট মানুষের চেতনাকে নিয়ে ক্রিস্টোফার নোলান নির্মাণ করেছিলেন ‘ইন্সেপশান’ (২০১০) ছবিটি। যাঁরা প্রখ্যাত পরিচালক লুই বুনুয়েলের (১৯০০-১৯৮৩) ১৯৭২ সালে নির্মিত ‘দ্য ডিসক্রিট চার্ম অফ দ্য বুর্জোয়া’ দেখেছেন, তাদের কাছে নোলানের ‘ইন্সেপশান’-এর ‘স্বপ্নের ভিতর স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন’ অবশ্য নতুন কিছু নয়।

কিন্তু সম্পূর্ণ চেতন অবস্থায় আপনি যখন ‘ওপেনহাইমার’ দেখতে ঢুকছেন তখন, কিংবা একজন মুমূর্ষু অচেতন মানুষের কাছে ‘সময়’ বিষয়টা তাহলে ঠিক কী দাঁড়ায়? আসুন দুটি মতামত নেওয়া যাক:
Whether, if soul (mind/consciousness) did not exist, time would exist or not, is a question that may fairly be asked, for if there cannot be someone to count, there cannot be anything that can be counted.
—আরিস্টট্যাল (৩৮৪-৩২২ বিসি)
এবং,
Time exists in reality as a mind-independent continuum, but is distinguished into earlier and later parts only by the mind.
—গিলস (১২৪৩-১৩১৬)
অন্যদিকে প্রখ্যাত জার্মান চিন্তাবিদ ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) মনে করতেন সময় ও স্থান উভয়ই প্রকৃত প্রস্তাবে ইন্দ্রিয়-সংবেদনের অনিবার্য ও সার্বিক প্রাক-উপকরণ। তাঁর মতে, সময় (ও স্থান) ইন্দ্রিয়-সংবেদনের বিষয় নয়। সময় ও স্থান বরং আগে থেকে উপস্থিত সেই আধার বা আকার, ইন্দ্রিয়-সংবেদনের বিষয়সকল যার মধ্যে অনুভূত হয়। কান্টের চিন্তার স্বাতন্ত্র্য অভাবনীয়। মনে হয় আমরা যেন জন্মগতভাবে সময়ের মধ্যে প্রোথিত।
এদিকে উপরে উক্ত মত দুটির মধ্যে আরিস্টট্যালে ‘মনস্তাত্ত্বিক সময়’ (Psychological time) ও ‘ভৌত সময়’ (Real time)-এর পার্থক্যের আধুনিক ধারণার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ‘মনস্তাত্ত্বিক সময়’কে ব্যক্তিগত সময়ও বলা যায়। অর্থাৎ, ‘মনস্তাত্ত্বিক সময়’ বলতে আমরা যা নির্দেশ করতে চাই তা হল সেই প্রবহমান সময়, যে সময়-পরিসরে আপনি ‘ওপেনহাইমার’ ছবিটি স্বমনে অনুধাবন করছেন। এই সময় (বা সময়-প্রবাহ) দর্শকের চেতনপ্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ‘ভৌত সময়’-এর সঙ্গে এর বিভাজনরেখাটি খুব সূক্ষ্ম। ‘ভৌত সময়’ হল সেই সময় যাকে ঘড়ি পরিমাপ করে, দর্শকের বা আপনার চেতনা-নিরপেক্ষভাবে।
‘মনস্তাত্ত্বিক সময়’ চেতনা-সাপেক্ষ। অর্থাৎ চেতনার সক্রিয়তায় মনস্তাত্ত্বিক সময় স্থগিত হতে পারে, কিন্তু ‘ভৌত সময়’ পারে না। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে কিংবা “ধুর, ছবিটা ভালো লাগছে না” বলে আপনি যদি ‘ওপেনহাইমার’-এর মাঝে আসন ছেড়ে উঠে চলে যান, তাহলে সেই মুহূর্তে ছবির সঙ্গে সম্পৃক্ত আপনার ‘মনস্তাত্ত্বিক সময়’ থমকে যাবে, কিন্তু ‘ভৌত সময়’ থমকাবে না।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, চলচ্চিত্রে সময়কে ধরে রাখতে হয় স্থানের পরিসরে। চলচ্চিত্রের অভ্যন্তরীণ সময় (Reel time) ও স্থানের সম্পর্ক কী এবং ভৌত, মনস্তাত্ত্বিক ও অভ্যন্তরীণ সময়ের সম্পর্কই বা কীরকম, তা নিয়ে কিছু বলার আগে আমাদের ‘সময়’ ও ‘সময়-প্রবাহ’ নিয়ে আরও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। পূর্বোক্ত গিলসের মতামতের মধ্যে সময়কে ‘মন বা চেতনা-কর্তৃক পরিমিত (measured) হতে পারে’ এরকম একটি বিষয় হিসেবে ভাবার ইঙ্গিত রয়েছে। আরিস্টট্যাল আরও একধাপ এগিয়ে মনে করেছিলেন সময় হল তাই, যা দিয়ে গতি/চলন পরিমাপ করা যায়। কিন্তু এই মত পরবর্তীকালে দর্শনে ইম্যানুয়েল কান্ট ও বিজ্ঞানে আইজ্যাক নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭)-এর হাতে পড়ে পরিবর্তিত হয়। আইজ্যাক নিউটনের মতামত ছিল, “পরম, প্রকৃত ও গাণিতিক কাল নিজেই প্রবাহিত হয়, এবং বাইরের কোনও কিছুর সঙ্গে তা সম্পর্কহীন।” কান্টের চিন্তার ভিত্তিভূমি ছিল নিউটনের এই বিজ্ঞান। বলাবাহুল্য, কান্ট-নিউটনের এই ধারণাও পরবর্তীকালে বাতিল হয়ে যায়। সেই আলোচনায় আমরা পড়ে আসব।
এখন ‘সময়-প্রবাহের’ দু-ধরনের ধারণার উল্লেখ প্রয়োজনীয়। সময় বা সময়-প্রবাহ রৈখিক না বৃত্তাকার? আরিস্টট্যালের মত ছিল, সময় বৃত্তাকার। কারণ বৃত্তের পরিধির যেরকম শুরুর বিন্দু বলে কিছু থাকে না— যেহেতু একটি বিন্দুকে প্রথম বিন্দু ভাবলে অবধারিতভাবে তার পূর্বে একটি বিন্দু পাওয়া যাবে, সেই একইরকমভাবে প্রথম সময়ের পূর্বে একটা সময় পাব (সৃষ্টির শুরু অর্থাৎ সময়ের শুরু বা বিগ ব্যাং তত্ত্ব তখন কল্পনাতীত)। বলাবাহুল্য, কান্ট-নিউটনের হাতে এই চিন্তা বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং সময়ের রৈখিক ধারণা ক্রমে প্রবল হয়ে ওঠে।
এখন চলচ্চিত্রের আঙ্গিনায় এই ব্যাপারটি কীরকম? মনে রাখতে হবে একটি ছবির প্রারম্ভের দৃশ্য বা বিষয় ছবির শেষে বা ক্লাইম্যাক্সে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ পুনরাবৃত্তি (যা চলচ্চিত্রের নিজস্ব ভাষা হিসেবে পরিলক্ষিত) কিন্তু অভ্যন্তরীণ সময়ের বৃত্তায়ন নয়। সময়ের রৈখিকতা এখানে বজায় থাকছে। পূর্বোক্ত ‘ভৌত সময়’ অবশ্যই রৈখিক, অর্থাৎ সামনের ও পিছনের দিকে (সময়ের আর কোনও দিক বা মাত্রা আমাদের ধারণার অতীত), কারণ এই ‘সময়’ ও নিউটনের ‘সময়’ একই। অর্থাৎ সন্ধ্যা ৬টায় শুরু হয়ে রাত ৯টায় ‘ওপেনহাইমার’ শেষ হওয়ার সময় (৬টা-৯টা চলচ্চিত্র-নিরপেক্ষ)। অন্যদিকে, ‘মনস্তাত্ত্বিক সময়’ স্থূলভাবে বললে চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত অপরিমিত (unmeasured) ‘ভৌত সময়’। কাজেই এটি চেতনার তথা দর্শকের তথা আপনার ব্যক্তিগত সময় পরিসর।
এখন সময়-প্রবাহের মানদণ্ড যদি পরিমাপ (measurement) হয়, তাহলে ‘মনস্তাত্ত্বিক সময়’-এর বেলায় রৈখিকতার প্রশ্ন অবান্তর, কারণ এটি আসলে বিশুদ্ধ মানসিক ক্রিয়া। চলচ্চিত্রের অভ্যন্তরীণ সময়ের ক্ষেত্রটি আবার বিচিত্র, কারণ এখানেই চলচ্চিত্রের একান্ত নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়। ছবির ঘটনা এখানেই বিস্তার লাভ করে। এছাড়াও চলচ্চিত্র নির্মাণের যে কারিগরি দিক এই অংশ মূলত তার নিয়ন্ত্রণাধীন। যাঁরা টম টাইকারের (১৯৬৫-) ১৯৯৮ সালে নির্মিত ‘রান লোলা রান’ ছবিটি দেখেছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ভৌত, মনস্তাত্ত্বিক ও অভ্যন্তরীণ সময়ের চলচ্চিত্রীয় ধাঁধায় চমকিত হয়েছেন। কুড়ি মিনিটের তিনটি পর্বের প্রত্যেকটিতে লোলাকে দেখানো হয় বার্লিন শহরের মধ্যে দিয়ে দৌড় যেতে। প্রত্যেকবারই ঠিক সময়ে অর্থ সংগ্রহ করতে ও প্রেমিককে রক্ষা করতে সে ব্যর্থ হয়। প্রত্যেকবার প্রথম থেকে ছবি শুরু হয়। সময়ের পাকদণ্ডীতে লোলার দৌড়ের ছন্দকে বেঁধে ফেলেন পরিচালক। ভৌত, মনস্তাত্ত্বিক ও অভ্যন্তরীণ সময়ের গোলকধাঁধার এক অনির্বচনীয় চলচ্চিত্রীয় অভিজ্ঞতা এই ছবি। প্রত্যেকবারের ‘ঘটনা’ আগেরটির চেয়ে কিছুটা আলাদা।

চলচ্চিত্রের অভ্যন্তরীণ সময়ের ভাবনার আরও গভীরে ডুব দেওয়ার আগে প্রয়োজন এই ‘ঘটনা’ (event) ও তৎসংক্রান্ত চিন্তার যে বিবর্তন, তা নিয়ে সামান্য আলোচনার। পূর্বে উল্লেখিত কান্ট-নিউটনের চিন্তায় সময় রৈখিক এবং স্থান-নিরপেক্ষ, এবং একইভাবে স্থানও সময়-নিরপেক্ষ। এর মানে, সময় ও স্থান পরম (absolute)। এই ধারণাকে ভেঙে দিয়ে যিনি যুগান্তরের সূচনা করেছিলেন, তাঁর নাম হেরমান মিনকাউস্কি (১৮৬৪-১৯০৯)। তিনি বললেন, ‘স্থান-নিরপেক্ষ সময়’ বা ‘সময়-নিরপেক্ষ স্থান’ বলে কিছু হয় না; যা হয় তা হল ‘স্থান-কাল অবিচ্ছেদ’ (spacetime continuum)। এ-ব্যাপারে কথা আর না বাড়িয়ে, উল্লেখ করতে চাই শুধু দুটি সিদ্ধান্তের।
এক— স্থানের তিনটি মাত্রা (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা) এবং সময়ের একটি মাত্রাকে যুক্ত করে মিনকাউস্কির চতুর্মাত্রিক ‘স্থান-কাল অবিচ্ছেদ’-এ নিউটনের বিন্দু (যেহেতু স্থান ও কাল পরস্পর নিরপেক্ষ) দিয়ে তৈরি জগৎ প্রতিস্থাপিত হয় ‘ঘটনা’ (যেহেতু স্থানকাল এক হয়ে যায়) দিয়ে গঠিত জগতে। মিনকাউস্কির জগতে প্রতিটি বিন্দুর একটি ‘রেখা’ (গাণিতিক রেখা, বাস্তবের রেখা নয়) থাকে, যাকে ‘জগৎ রেখা’ (World Line) বলা হয়।
দুই— মিনকাউস্কির এই ধারণাই আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’ (General Theory of Relativity)-এর ভিত্তি।
পরিচালক পল উইলিয়াম স্কট অ্যান্ডারসনের (১৯৬৫-) ছবি ‘ইভেন্ট হরাইজান’ (১৯৯৭) উপরে উল্লেখিত ‘জগৎ রেখা’ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে হলিউডীয় জগঝম্প সৃষ্টি করেছে। তথাপি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, একমাত্র হলিউডই সাহস করে ও বিপুল অর্থ খরচ করে দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের ছবি তৈরির প্রয়াস চালিয়ে আসছে।
এখন, মিনকাউস্কির মস্তিষ্কপ্রসূত যে ‘ঘটনা’র কথা উল্লেখিত হল, চলচ্চিত্রেও তার বাস্তব ভূমিকা আছে। কারণ চলচ্চিত্রের অভ্যন্তরীণ সময়ে সংঘটিত ন্যারেটিভ (গল্প) বা নন-ন্যারেটিভ (তথ্যচিত্র) আসলে বাস্তব ঘটনা (ন্যারেটিভ হলে অভিনীত এবং নন-ন্যারেটিভ হলে বাস্তবিক ঘটনা)। বাস্তবের চতুর্মাত্রিক (স্থানের তিনটি ও সময়ের একটি মাত্রা) ‘ঘটনা’ চলচ্চিত্রে ত্রিমাত্রিকতায় (স্থানের দুটি ও সময়ের একটি মাত্রা) আবদ্ধ হয়। এই বিবর্তিত রূপ আবার আলোকসম্পাত, ইমেজের গঠন, ক্যামেরার অবস্থান ও ফ্রেমের গভীরতার উপর নির্ভরশীল। তবে স্থানকাল অবিচ্ছেদ এখানেও রক্ষিত। অর্থাৎ স্থান-নিরপেক্ষ কাল ও কাল-নিরপেক্ষ স্থান এখানেও অর্থহীন। চলচ্চিত্রের প্রত্যেকটি পৃথক দৃশ্যের একটি নিজস্ব স্থান-কাল চেতনা থাকে, যা ক্যামেরার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, আবার একটি অংশের সমস্ত দৃশ্যের সমন্বিত স্থান-কাল চেতনা থাকে, যা মূলত ক্যামেরা ও সম্পাদনার উপর নির্ভরশীল। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার মূল প্রতিপাদ্য হল ‘বস্তুর উপস্থিতি স্থান-কাল অবিচ্ছেদকে বাঁকিয়ে দেয়।’ একইভাবে এর সূত্র ধরে বলা যায়, একক ও সামগ্রিক স্থানকাল অবিচ্ছেদ্যতার বিস্তৃতি ইমেজের যথাযথ সংযোগে বা উপস্থিতিতে তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে ওঠে। স্থান ও কালের পারস্পরিক বিনিময়যোগ্যতাও ছবির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। যেমন, সংক্ষিপ্ত সময়ের কোনও অ্যাকশনকে স্লো মোশনে অনেকগুলো ফ্রেমে বিস্তার ঘটিয়ে কালকে স্থানে রূপান্তরিত করা সম্ভব। নিও লিফট থেকে বেরিয়েই টের পায় তার উপর অতর্কিত হামলা হবে, তারপরই ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ (১৯৯৯) ছবির সেই বিখ্যাত স্লো মোশনে অ্যাকশনের দৃশ্য! এখানে কাল বা সময় আসলে রূপান্তরিত হচ্ছে স্থানে।

এর উল্টোটা কী হবে? মানে, মোশনকে দ্রুত বাড়িয়ে দিয়ে স্থানকে কালে রূপান্তরিত করা হলে? ধরা যাক, প্রতিদ্বন্দ্বী (১৯৭০) ছবির সেই দৃশ্যটির কথা, যেখানে সিদ্ধার্থ ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্টারভিউ রুমে ভাঙচুর করে বেরিয়ে আসার পরের মুহূর্তটি। হ্যাঁ, মোশনকে দ্রুত করে দেন সত্যজিৎ রায়। দেওয়াল, মাঠ, প্রান্তর সব কিছু তছনছ হয়ে দ্রুত চলে যায়, তারপর রিকশার দৃশ্যের উপর আছড়ে পড়ে সিদ্ধার্থর স্বগতোক্তি “আজ আমাকে অনেক দিনের চেনা…”। আমরা অনুভব করি যে, ওই ইন্টারভিউয়ের দিনটির পর বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে—প স্থান রূপান্তরিত হয়েছে কালে।

আইনস্টাইনের ধারণায়, বাস্তবে সদা গতিশীল বিশ্বে গতির নীতি একের সঙ্গে অন্যের তুলনা করেই শুধুমাত্র নির্ধারিত হয়। চলচ্চিত্রেও গতির (চিত্রের নিজস্ব গতি) তাৎপর্য ও ব্যঞ্জনা ব্যক্ত হয় শুধুমাত্র ইমেজের সঙ্গে ইমেজের তুলনার নিরিখে। মিনকাউস্কির যুগান্তকারী ধারণায় আমরা দেখেছি ‘সময়’ ঘটনার বিন্যাস মাত্র, এবং একইভাবে ছবির ‘অভ্যন্তরীণ সময়’কেও আমরা দেখতে পারি। আইনস্টাইনের ধারণায়, দুটি ভিন্ন ভিন্ন বেগে ধাবমান মহাকাশযানের একটির কাছে কোনও একটি ‘ঘটনা’ যা ‘বর্তমান’, অপরটির কাছে তা ভবিষ্যৎ হতে পারে (যেহেতু আপেক্ষিক বেগের কারণে যার বেগ বেশি, তার কাছে সময় ধীরে প্রবাহিত হয়)। অর্থাৎ, একটির কাছে যে ঘটনা বাস্তব, অপরটির কাছে তা বাস্তব নাও হতে পারে।
Travel to the future জাতীয় যে চলচ্চিত্রগুলি হলিউডে হয়ে থাকে, তার শিকড় যে বাস্তবে, অর্থাৎ সময়ের অন্তর্নিহিত চরিত্রে নিহিত তা বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয় না। এ ব্যাপারে Twin paradox-এর উল্লেখ করা যেতে পারে। যমজ ভাইয়ের একজন যদি আলোর কাছাকাছি গতিতে শূন্যে পাড়ি দেয় এবং সময়ের ব্যবধানে ফের পৃথিবীতে ফিরে আসে, তাহলে সে প্রবেশ করবে তার ভাইয়ের ভবিষ্যতে। অর্থাৎ, তার বয়স বাড়বে না কিন্তু তার ভাইয়ের বয়স অনেক বেড়ে যাবে। Travel to the past-ও একইভাবে সম্ভব, পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। ১৯৯৩ সালে হলিউডের কমেডি ছবি Groundhog Day-তে এই ধরনের Time loop-এর মজা রয়েছে। ১৯৮৫ সালে নির্মিত Back to the Future-ও এ জাতীয় ভাবনারই ফলস্বরূপ।
Grandfather paradox আবার আরেক বিচিত্র ব্যাপার। সময়যন্ত্রে (যা আলোর চেয়ে বেশি বেগে ধাবমান) চেপে অতীতে পৌঁছে কেউ যদি তার দাদুকে হত্যা করে, দিদিমার সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্বেই, তাহলে তার মায়ের জন্ম হবে না। তখন যে অতীতে গেল, সে কে? স্টিফেন হকিং এর বিরোধিতা করেছিলেন Chronology Protection Conjecture-এর মাধ্যমে। এ অবশ্য সম্পূর্ণ অন্য আলোচনার বিষয়। এখানে তার শুধু উল্লেখটুকু থাকল।
সময় এবং চলচ্চিত্র সংক্রান্ত আমাদের বর্তমান আলাপের আপাতত এখানেই ইতি টানা যাক।
*এই প্রবন্ধটির একটি আদি রূপ ইতিপূর্বে হ্যালো টেস্টিং বাংলা কবিতা পত্রিকার শারসীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল