ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিবিপ্লব

বিশ্বনাথ উদিত

 

অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন ট্রাম্পের এই নীতির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকা নিজেই। সে দেশের শিল্প উৎপাদনের উপাদান, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসে, তার জোগানের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে, অতিরিক্ত শুল্কজনিত উপাদানের দাম বাড়ার কারণে সাধারণভাবে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে এবং সেই প্রভাব কতদূর পৌঁছবে তা এখন আলোচনার বিষয়। মনে রাখতে হবে, অন্যান্য দেশও ট্রাম্পের নীতির জবাবে আমেরিকা থেকে আমদানির উপর কর বসাতে পারে। সামগ্রিকভাবে আমেরিকায়, এমনকি সারা বিশ্বে মন্দা শুরু হওয়াও সম্ভব

 

ট্রাম্প আমেরিকাকে মহান করে তুলবেন (Make America Great Again – MAGA), এই তাঁর ঘোষিত ব্রত। তাঁর ধারণা, আমেরিকা নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। সারা বিশ্ব থেকে অভিবাসীরা এসে আইনি ও বেআইনিভাবে আমেরিকার সম্পদ ভোগ করছে। তাছাড়া, সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হওয়ায়— আর্থিক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মান, শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির অবস্থান, সামরিক শক্তি প্রভৃতি সব দিক থেকেই— সারা বিশ্বে দাদাগিরি করার সুযোগের বিনিময়ে তাকে নানারকম আর্থিক, সামরিক বা অন্য সাহায্য দিতে হয়। যেমন ইজরায়েল এবং ইউক্রেনকে আর্থিক, সামরিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য। আবার, এমন অনেক গবেষণায় তাকে উৎসাহিত করতে হয় যা সারা বিশ্বেরই সমস্যা, যেমন পরিবেশ দূষণ। এইসব গবেষণা থেকে আমেরিকা সরাসরি অন্য দেশের তুলনায় বেশি লাভবান হয় না, কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকে এবং এগিয়ে থাকার কারণে অন্যের সমীহ পায়।

এ-কথাও মনে রাখতে হবে যে আমেরিকা এই সমীহ আদায় করেছে সারা বিশ্ব থেকে মেধা সংগ্রহ করে, যার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ সে-দেশে এসেছে আমাদের ভারতবর্ষ থেকে। এই মেধা তারা আকর্ষণ করেছে তাদের শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষ দিয়ে, মেধাবী ছেলে-মেয়েরা পরম আগ্রহে সে দেশে গেছে, নিজেদের উজাড় করে দিয়ে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারপর আমেরিকান ব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশের এই সব কৃতী সন্তানেরা এখন আমেরিকান রাষ্ট্রের অচ্ছেদ্য অঙ্গ। আবার, আমেরিকার সমৃদ্ধিতে আকৃষ্ট হয়ে অনেক মানুষ বেআইনিভাবে সে-দেশে প্রবেশ করেছে এবং বসবাস করছে। আমেরিকার সমৃদ্ধিতে এদের অবদান নগণ্য, ট্রাম্প এদের বোঝা মনে করছেন। এতদিন আমেরিকা এদের প্রতি অনেকটাই উদার মনোভাব রেখেছিল।

হঠাৎ করে আমেরিকার উদারতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা যেন উধাও হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ যুদ্ধের পরিণতি নির্ধারণ করেছিল। তা না হলে আজকের বিশ্বের চেহারাটাই অন্যরকম হত। তারপর রাষ্ট্রপুঞ্জের তত্ত্বাবধানে একটু একটু করে বিশ্বের দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতা ও আদানপ্রদানের ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যে কাজে আমেরিকার অবদান ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধের পর রাশিয়া যেমন তার পশ্চিমদিকে প্রভাব বিস্তার করে, আমেরিকাও কানাডা ও ইউরোপের প্রধান দেশগুলিকে নিয়ে NATO (উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন) গঠন করে, বিশেষত পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে। অবশ্যই গঠনমূলক কাজের সঙ্গে এমন অনেক কাজই তারা করেছে, যা ইতিহাসে তাদের কলঙ্ক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ভিয়েতনামের যুদ্ধ এইসব কলঙ্কের অন্যতম, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়াও ছিল তাদের এক কলঙ্কজনক সিদ্ধান্ত।

ট্রাম্প ক্ষমতায় ফেরার আভাস পেয়েই আস্ফালন শুরু করে দিলেন— যেন মদমত্ত। তিনি ইউক্রেন থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার হুমকি দিলেন, সে-দেশের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে, যিনি চরম শৌর্যের পরিচয় দিয়ে রাশিয়ার আগ্রাসনের মোকাবিলা করছেন, স্বৈরাচারী বলে এবং নানাভাবে অপমান করে ক্ষমতাচ্যুত করার ভয় দেখাচ্ছেন। তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ কেড়ে নিতে চাইছেন নির্লজ্জভাবে অতীতের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যের বিনিময়ে। এমনকি আমেরিকার উপর থেকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার এই যুদ্ধের ভার ঝেড়ে ফেলতে তিনি ইউক্রেনকে নিজের ভূখণ্ডের একটা অংশ রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে চাপ দিচ্ছেন। কানাডা ও ইউরোপের দেশগুলির কাছে আমেরিকার এই ভূমিকা শুধু অবিশ্বাস্য নয়, প্রায় বজ্রাঘাততুল্য। কারণ তা ন্যাটো-র নৈতিকতা-বিরোধী। আমেরিকার সঙ্গে তাদের মহাজোট— ন্যাটো— মার্কিন শক্তির উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তাদের প্রতিরক্ষার চিন্তা-ভাবনা, প্রস্তুতি, সবকিছুই আমেরিকার আশ্বাসের উপর নির্ভরশীল। বস্তুত ইউরোপ এতদিন ছিল বড় দাদার উপর নির্ভরশীল ছোট ভাইয়ের মতো। সেই দাদা এখন ধমক দিচ্ছে, ইউরোপকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। প্রতিরক্ষায় তাদের ব্যয় বাড়াতে হবে। সেটা একরকম, হয়তো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক নয়। কিন্তু এ-কথা তো পারস্পরিক আলোচনাতে আসতে পারে, হুঙ্কার কেন? আর ইউক্রেনকে এতদিন আশ্বাস দিয়ে, তার গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন দিয়ে তারপর চরম দুঃসময়ে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ানো তো বিশ্বাসঘাতকতা! আমেরিকাই তার অত্যাধুনিক উপগ্রহ প্রযুক্তির সাহায্যে ইউক্রেনকে সতর্ক করেছে রাশিয়ার আক্রমণের পরিকল্পনা সম্বন্ধে। তারপর সব রকম কৌশলগত ও সামরিক সহায়তা দিয়ে তার পাশে থেকেছে। প্রায় সমগ্র ন্যাটো শক্তি নীতিগতভাবে একত্র হয়েছে, তারপর এক চরম মুহূর্তে ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই দায় ঝেড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। ন্যাটো জোটের দেশগুলির কাছে এই অবস্থা ছিল অচিন্ত্যনীয়। স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপ আমেরিকার উপর বিশ্বাস হারিয়েছে। জন্মের পর পঁচাত্তর বছর ধরে পারস্পরিক নির্ভরতার আদর্শ স্থাপন করে ন্যাটো আজকে অনিশ্চিত, যদিও আমেরিকা এই সামরিক জোট ত্যাগ করেনি। ইউরোপ হঠাৎ করে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে মার্কিন-নির্ভরতা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছে, মূলে নাড়া খেয়েছে। তার মেধা আছে, সম্পদ আছে, কিন্তু যুদ্ধের প্রস্তুতি নেই, অথচ যুদ্ধ দোরগোড়ায়। এই নাড়া দেওয়াটাই যদি ট্রাম্পের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে তা সফল।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ট্রাম্প সারা বিশ্বে হুলুস্থুল ফেলে দিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস বিশ্বের দেশগুলি আমেরিকাকে লুটেপুটে খাচ্ছে তাঁর উদার অর্থনীতির সুযোগ নিয়ে, যার ফল আমেরিকার বেকারি ও দারিদ্র্য। চিন তার ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে উদারতার সুযোগ নিয়ে। চিনের সঙ্গে বাহির্বাণিজ্যে তার বিরাট ঘাটতি। চিন নানারকম কারসাজি করে, যেমন মুদ্রার বিনিময়মূল্য কমিয়ে রেখে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের উৎপাদন বজায় রাখতে কম দামে তা অন্য দেশে রপ্তানি করে (ডাম্পিং), ইত্যাদি কৌশলে সুযোগ নিচ্ছে। চিন থেকে আমেরিকা অনেক বেশি আমদানি করে, রপ্তানির তুলনায়। সামরিক শক্তিতেও চিন দ্রুত প্রায় সমকক্ষ হয়ে উঠেছে, চিনকে ঠেকাতে হবে। আর শুধু চিন নয়, ট্রাম্প যেন লাগামছাড়া; সব দেশের সঙ্গেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক একতরফা পুনর্মূল্যায়ন করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, ভারত, এমনকি ছোট্ট দেশ ভিয়েতনাম বা আফ্রিকার বতসোয়ানার সঙ্গেও বাণিজ্যিক সম্পর্কে বড় পরিবর্তন এনেছে। তাঁর ভাবটা এমন, যেন ‘হেডঅফিসের বড়বাবু’র মতো বলছেন: কারও কথার ধার ধারি নে, সব ব্যাটাকেই চিনি। … এই না বলে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায়। চিনের উপর আমদানি শুল্ক চাপালেন ৫৭ শতাংশ, জাপানের উপর ৩২, ভারতের উপর ২৬, ভিয়েতনামের উপর ৪৬ আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপর ২০ শতাংশ।

তিনি যে কী করতে চাইছেন, তাঁর নিজের পরিকল্পনা সুচিন্তিতভাবে তৈরি কি না, তা কেউ জানে না। একটা কথা পরিষ্কার, এতদিন আমেরিকার আমদানি শুল্ক ছিল বিশ্বের সব প্রধান দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম, ট্রাম্প ইতিমধ্যেই সেখান থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন এবং ক্রমাগত সরে যাচ্ছেন। আমেরিকা ছিল মুক্ত-বাণিজ্য নীতির সবচেয়ে জোরালো প্রচারক। ১৯৮০-এর দশকে গৃহীত Washington Consensus নীতির মূল কথা ছিল বাণিজ্য উদারিকরণ। উন্নয়নশীল দেশগুলিকে এই উপদেশ দেওয়া হত। ১৯৯১ সালে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার থেকে ঋণ নেওয়ার সময় ভারতকেও সেই উপদেশ দেওয়া হয়েছিল। সে-কথা শুনেই হোক বা নিজের উদ্যোগেই হোক, ভারত ব্যাপকভাবে বাণিজ্য উদারিকরণ করেছিল। তার আগে থেকেই সারা বিশ্বে উদারিকরণের প্রবণতা শুরু হয়েছিল এবং এই মন্ত্রের মুখ্য উদ্গাতা ছিল আমেরিকা। বস্তুত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই, বিগত ৮০ বছর ধরে বিস্তর এবং ধারাবাহিক আলাপ-আলোচনা করে প্রায় সমস্ত প্রধান দেশই আমদানি উদারিকরণের পথে হেঁটেছে। যার ফলে আমেরিকার গড় আমদানি শুল্ক কমতে কমতে ২০২৪ সালে মাত্র ২ শতাংশের কাছে চলে আসে। এখন তা এক লাফে বেড়ে ২৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ট্রাম্পের আশা এভাবে তাঁর সরকারের প্রচুর আয় হবে, যার ফলে ব্যক্তিগত আয়ের উপর কর অনেক কমিয়ে দেওয়া যাবে, এমনকি সরকারের দেনা কিছুটা পরিশোধ করা যাবে। এ কি শিশুর আহ্লাদ নাকি পাগলের প্রলাপ, তা বোঝা দায়।

অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন ট্রাম্পের এই নীতির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমেরিকা নিজেই। সে দেশের শিল্প উৎপাদনের উপাদান, যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসে, তার জোগানের ক্ষেত্রে সমস্যা হবে, অতিরিক্ত শুল্কজনিত উপাদানের দাম বাড়ার কারণে সাধারণভাবে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে এবং সেই প্রভাব কতদূর পৌঁছবে তা এখন আলোচনার বিষয়। মনে রাখতে হবে, অন্যান্য দেশও ট্রাম্পের নীতির জবাবে আমেরিকা থেকে আমদানির উপর কর বসাতে পারে। সামগ্রিকভাবে আমেরিকায়, এমনকি সারা বিশ্বে মন্দা[1] শুরু হওয়াও সম্ভব। ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বে শেয়ার বাজারে ধস নেমেছে, আমাদের দেশেও তাই। এই হতাশা এখন করদূর ছড়ায়, সেদিকে সবাই তাকিয়ে আছে।

আমাদের দেশের পরিস্থিতি অবশ্য চিন বা আমেরিকার তুলনায় আপাতত খারাপ নয়। আমাদের দেশের হয়তো কিছুটা লাভও হতে পারে রপ্তানির ক্ষেত্রে কারণ আমাদের প্রতিযোগীরা, বিশেষত চিন, অনেক বেশি বাধার সম্মুখীন। ভারত আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে একটা সামগ্রিক বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য, কিছুটা যেমন মেক্সিকো ও কানাডার আছে আমেরিকার সঙ্গে। তা সম্ভব হলে ভারতের শিল্প অতিরিক্ত জোর পাবে। এখন সারা বিশ্ব একটা আলোড়নের মধ্যে পড়ে গেছে ট্রাম্পের প্রতিবিপ্লবের আঘাতে; কম্পমান ছবিটা ক্রমশ পরিষ্কার হবে। মার্কিনিরাই বা ট্রাম্পের খেয়ালিপনা কতদূর মেনে নেয় তাও এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। অন্যন্য দেশ পারস্পরিক বাণিজ্যে নতুন করে বাধা সৃষ্টি করবে না বলেই মনে হয়, বরং পারস্পরিক বোঝাপড়ায় যত্নশীল হওয়ারই কথা। মুক্ত বাণিজ্যের লক্ষ্যে ভারতের ব্রিটেনের সঙ্গেও আলোচনা চলছে। এটা আশার কথা। তবুও, মাত্র গত কয়েক মাসে পৃথিবীর যে পরিবর্তন হয়ে গেছে তা সম্ভবত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অভিঘাতের চেয়েও প্রভাবশালী।

অর্থনৈতিক আঘাত কতটা ব্যাপক হবে তা এই মুহূর্তে সঠিকভাবে বলা খুব সহজ নয়। তার একটা কারণ ট্রাম্প বা চিনের জিনপিং বা অন্যান্য দেশ কেউই থেমে থাকবে না, পরিবর্তনশীল অবস্থার সঙ্গে নিজেদের লক্ষ্য অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়ে চলবে। সাধারণভাবে অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন আমেরিকার ও চিনের বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে, এবং অন্যন্য দেশও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মন্দার শিকার হবে। কিন্তু সেই মন্দা কেটে যাবে, যদিও কতদিনে তা বলা মুশকিল, দু-বছর নাকি তার বেশি তা নির্ভর করছে অনেক কিছুর উপর। যেমন, ইউরোপের অনেক দেশ এখন ভীত হয়ে পড়েছে আমেরিকার উপর আস্থা হারিয়ে। ন্যাটো-অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো বিশ্বাস করত কেউ তাদের সহসা আক্রমণ করবে না। তারা নিজেদের শক্তিতে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করার জন্য তৈরিও নয়। এখন আমেরিকার উপর আস্থা হারিয়ে ইউক্রেনের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে তারা প্রতিরক্ষায় ব্যয় বাড়াচ্ছে এবং এই ব্যয় বৃদ্ধি মন্দা প্রতিহত করতে সাহায্য করবে।[2]

এখানে উল্লেখযোগ্য একটা এখনও-ক্ষীণকায় ধারা, যা ক্রমশ শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনাযুক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের তাড়নায় বেশ কিছু দিকপাল বিজ্ঞানী জার্মানি ছেড়ে আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন। যা আমেরিকার বিজ্ঞান গবেষণাকে সমৃদ্ধ করেছিল। এখন ট্রাম্প গবেষণায় বরাদ্দ কমাচ্ছেন ও নানাভাবে হস্তক্ষেপ করছেন, পক্ষান্তরে সমূলে কম্পিত ইউরোপ বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ বোধ করছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে উন্মুক্ত রেখেছে। তাই বিজ্ঞানী অভিবাসনের বিপরীত গতির কথা ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। এই আশঙ্কা বাস্তবায়িত হলে তা আমেরিকার পতনে গতি আনবে। আর চার বছর পরে যদি ট্রাম্প চলে গিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট এসে নতুন করে আঘাতে প্রলেপ দিতে চান, তা হবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। ইতিমধ্যে অভাবনীয় কিছু ঘটে কি না তাও দেখার, ট্রাম্পের হাতে অসীম ক্ষমতা, যেমন আছে পুটিনের ও জিনপিঙের।

পরিশেষে, একটা কথা খুব মনে হচ্ছে। ১৯২৩ সালে তৎকালীন জার্মান রিপাবলিকের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও বিদ্রোহ করার জন্য হিটলারের পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়, কিন্তু হিটলার আট মাসেই মুক্তি পান। অনেকেই বলেছেন, এই শিথিলতা না থাকলে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত। ট্রাম্পও বিস্তর অভিযোগ থেকে শুধুমাত্র একটু ধমক খেয়ে পার পেয়ে গেছেন, হিটলারের একশো বছর পরে। ইতিহাস তার জন্য কতটা প্রভাবিত হবে?

 


[1] আমরা মন্দা শব্দটা বৃহত্তর অর্থে ব্যবহার করছি। অর্থনীতিতে যাকে বলে stagflation, অর্থাৎ বৃদ্ধির হার খুব কম সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি চলছে, বর্তমানে আমেরিকা সম্ভবত সে পথেই চলেছে এবং অন্য দেশকে প্রাভাবিত করছে। কিন্তু এই অবস্থা অচিরে অর্থনৈতিক সংকোচনে, যাকে বলে recession, পর্যবসিত হতে পারে। অনেকটাই নির্ভর করছে ট্রাম্প এবং অন্যান্য দেশের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার উপর।
[2] বর্তমানে বিশ্বের সামগ্রিক সামরিক চিত্রটা মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। একটা যুদ্ধ বেধে গেলে সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যেতে পারে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5044 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...