সৈকত ভট্টাচার্য
পূর্ব প্রকাশিতের পর
উনিশশো আটান্ন সালের জুলাই মাসের সাত তারিখ। মিস্টার এমিল বার্ডের আজ বেজায় তাড়া। তিনি ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর একজন ‘লেগম্যান’। শহরের খুচরো খবরাখবর সংগ্রহের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যস্ত আছে। বড় খবরের জন্য উচ্চপদস্থ সাংবাদিকেরা আছেন। খবর জোগাড় করা মাত্র চটজলদি হেড-অফিসে টেলিফোন করে রি-রাইটারদের জানিয়ে দেওয়াই তাঁর কর্তব্য। পরদিন কাগজে সে-খবর গুরুত্ব সহকারে ছাপা হলে শিরোনামের তলায় নাম যায় সেই রি-রাইটারের। আর নইলে বড় বড় খবরের চাপে কোনওমতে এক কোণায় নামগোত্রহীনভাবে পড়ে থাকে একটা খুচরো খবর।
আজকের খবরটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ কি না, তা তিনি এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না। আমন্ত্রণ এসেছে খোদ ইউএস ন্যাভাল রিসার্চ থেকে। সেখানে ফ্রাঙ্ক রোজেওনব্ল্যাট নামে এক ছোকরা কী একটা কম্পিউটার দেখাবে নাকি। বার্ড যেটুকু খোঁজ খবর পেয়েছেন তাতে খুব একটা কিছু আশাব্যাঞ্জক মনে হয়নি। কম্পিউটার তিনি আগেও দু-একবার দেখেছেন। বছর দু-এক আগেও তো আর্থার স্যামুয়েল নামে আইবিএম কোম্পানির একজন গবেষক তাঁদের নতুন কম্পিউটার মেশিন IBM 704-কে দিয়ে চেকার্স খেলে দেখিয়েছিলেন নিউ ইয়র্কে। তখন বার্ডের পোস্টিং ছিল নিউ ইয়র্কের মধ্যেই।
এই ফ্রাঙ্ক রোজেনব্ল্যাট ছোকরাও যে সে-রকমই কিছু একটা ভেল্কি দেখাতে চায় তাতে সন্দেহ নেই। কৌতূহল হচ্ছে বার্ডের। তার উপর আমেরিকার ন্যাভাল রিসার্চের অনুষ্ঠান যখন, কফি আর স্ন্যাক্সটাও মন্দ হবে না!
সেদিন যথাসময়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। আর পরদিন নিউ ইয়র্ক টাইমসের পঁচিশের পাতায় ব্রুকলিন সেভিংস ব্যাঙ্কের বিজ্ঞাপন আর নানাবিধ বইয়ের খবরের মাঝে ছোট্ট এক কলামের একটা খবর স্থান পেল। নিউ ইয়র্ক অফিসের রি-রাইটার শিরোনাম দিয়েছিলেন— New Navy Device Learns By Doing, সঙ্গে সাব-হেডিং— Psychologist Shows Embryo of Computer Designed to Read and Grow Wiser. এই পুঁচকে খবরের ‘সাবজেক্ট’টা যে কয়েক দশকের মধ্যে বিশ্বের একটা অন্যতম আশ্চর্যের জন্ম দেবে— যাকে মানুষ জানবে এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নামে— সে-কথা সে বেচারা লেগ-ম্যান বা রি-রাইটার কারও দূর-কল্পনাতেও আসার কথা নয়। আসেওনি।
—তা কী হয়েছিল সেদিন? জয়দা থামতেই আমি জিজ্ঞেস করি।
চেন্নাই থেকে ব্যাঙ্গালোর আসার পরেও রবিবার সকালের লুচি-তরকারি আর মোহনভোগের মেনুটা আমাদের পাল্টায়নি। রবি ঠাকুর সাতসকালে এসে গেছে। ওকে একটা চাবি দেওয়াই থাকে যাতে আমাদের যোগনিদ্রার কোনওরূপ ব্যাঘাত না ঘটে। জয়দা উঠে যায় অবিশ্যি। সকালে উঠে একটু হাত-পা ছুড়ে ঘাড়-টাড় বেঁকিয়ে, যাকে ও বলে ‘স্ট্রেচিং’, একটা বই নিয়ে সোফায় গা এলায়। আজকেও তার ব্যত্যয় হয়নি। আমি পরে উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে বসে বললাম, সেদিন মহাবিশ্বের জন্মরহস্যের গল্প বলে তো ক্ষান্ত দিলে— তারপর?
জয়দা বই থেকে মুখ তুলে বলল, শুনবি?
—অবশ্যই।
তবে শোন, বলে উপরের ‘মুখরা’টা বলল। ইতিমধ্যে শুভও এসে জুটে গেছে। মোবাইল ঘাঁটলেও কান যে এদিকে খাড়া, সেটা মাঝেমধ্যে ওর ‘হুঁ’ শুনে বুঝতেই পারছিলাম। ভূমিকার পর জয়দা যে থামল, তার পিছনে রবি ঠাকুরের ভাইয়া, খানা লাগা দুঁ? প্রশ্নের সঙ্গে গরম লুচির মনমোহিনী সুবাস হচ্ছে আসল কারণ। অতএব জয়দা চল, বাকিটা খেতে খেতে বলছি বলে খাবার টেবিলের দিকে প্রস্থান করল।
—পারসেপট্রন শব্দটা শুনেছিস?
ধুম্র-উদ্গমকারী কষা আলুরদমের থেকে একটা গোটা আলুকে অর্ধেক লুচি দিয়ে পেঁচিয়ে মুখে চালান করে গরমে হুশ হুশ করে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জয়দা জিজ্ঞেস করল।
আমরা দুজনেই পেন্ডুলামের মতো মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম।
জয়দা সেটা আড়চোখে দেখে ফের জিজ্ঞেস করল, ফ্র্যাঙ্ক রোজেনব্ল্যাটকে চিনিস?
শুভ ফিসফিস করে বলল, আদ্যনাথের নাম শোনোনি, খগেন কে তো চেনো?
জয়দা সেটা শুনেও পাত্তা না দিয়ে নিজেই বলল, ফ্র্যাঙ্ক রোজেনব্ল্যাট ছিলেন একজন আমেরিক্যান মনস্তত্ত্ববিদ। অবিশ্যি তাঁকে ‘মনস্তত্ত্ববিদ’ বললে তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়। কারণ মনস্তত্ত্ব ওঁর পড়াশোনার বিষয় হলেও কাজকর্মের সিংহভাগ জুড়ে মানুষের মনের বদলে ছিল যন্ত্রের ‘মন’। অর্থাৎ কি না যন্ত্রকে মানুষ করে তোলা যায় কি না, তাই ছিল ওঁর মূল গবেষণার বিষয়!
—মানে, রোবট? শুভ জিজ্ঞেস করল।
—উম… ঠিক রোবট নয়। আবার রোবটও বটে। হেঁয়ালি করল জয়দা।
—একটু ঝেড়ে কাশো দেখি। বললাম আমি।
—ওই যে তখন যে ঊনিশশো আটান্ন সালের জুলাই মাসের কথা বলছিলাম, তার আগের বছর কর্নেল এরোনটিক্যাল ল্যাবের একটা বিশেষ প্রোজেক্টের একটা রিপোর্ট প্রকাশ পায়। প্রোজেক্টের নাম— প্রোজেক্ট পারা।
—পাড়া? শুভ বাধা দেয়।
—হ্যাঁ, আমাদের ‘পাড়া’ নয়, পারা— পি-এ-আর-এ— যার পুরো কথা হল, পার্সিভিং অ্যান্ড রেকগনাইজিং অটোমেশন। এই রিপোর্টে রোজেনব্ল্যাট প্রথম একটা শব্দ ব্যবহার করলেন— পারসেপট্রন— শুনেছিস কখনও?
—নাহ, মাথা নাড়লাম আমি। কিন্তু এটা শুনে সেই হুগো ছবির অটোমেটন-এর কথা মনে পড়ল। এটা কি সেরকম কিছু?
জয়দা কিছু উত্তর দেওয়ার আগে পাশ থেকে শুভ জিজ্ঞেস করল, হুগো আবার কোন সিনেমা?
—হুগো দেখিসনি? আমি এবার একটু আপার-হ্যান্ড নেওয়ার সুযোগ পেলাম। মার্টিন স্করসেসের প্রথম থ্রি-ডি ছবি। ওখানে একটা যন্ত্র-মানুষ আছে, যার নাম অটোমেটন।
—উঁহু, জয়দা শুধরে দিল, ওর নাম অটোমেটন না। অটোমেটন মানে হল এমন যন্ত্রচালিত জিনিস, যাকে পরিচালনা করার জন্য কোনও মানুষের দরকার পড়ে না। হুগোর বাবা অমন একটা ভাঙা, অকেজো যন্ত্র-মানুষকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তারপর বাপ-ব্যাটা মিলে ওটাকে চালু করার চেষ্টা করেন। এরকম কিছু একটা গল্প ছিল না?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
—অনেকদিন আগে দেখেছিলাম। অল্প অল্প মনে আছে। তবে অটোমেটন-এর কথাই যখন বললি, অ্যান্টিকিহ্থিরা মেকানিজম-এর নাম শুনেছিস?
খুব স্বাভাবিকভাবেই শুনিনি। মাথা নেড়ে আমরা দুজনেই সেটা জানান দিলাম।
—প্রাচীন গ্রিসের একটা অটোমেটন-এর উদাহরণ। উনিশশো সালে গ্রিসের অ্যান্টিকিহ্থিরা দ্বীপের কাছে সমুদ্রের মধ্যে প্রাচীন এক জাহাজের ভগ্নস্তূপ পাওয়া যায়। সেটা কোনও বাণিজ্যতরী ছিল বলেই অনুমান। তার মধ্যে নানারকম গ্রিক দেবদেবীর মূর্তি, অলঙ্কার, মুদ্রা, বাসনকোসনের সঙ্গে একটা ভাঙাচোরা যন্ত্রও পাওয়া যায়। অবিশ্যি দু-হাজার বছর জলের তলায় থাকার পর তাকে আর যন্ত্র বলে চেনার উপায় ছিল না। চিনতেও পারেনি কেউ। বাকি সমস্ত উদ্ধার হওয়া জিনিসের সঙ্গে একেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল এথেন্সের আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়ামে। বছর দুয়েক পর স্ভরোনস নামে একজন গ্রিক নিউমিসম্যাটিস্ট— নিউমিসম্যাটিস্ট কথাটার মানে জানিস তো?
—যারা কয়েন কালেক্ট করে? আমি জানতাম। কারণ ছেলেবেলায় আমার কয়েন কালেক্ট করার শখ ছিল বেশ। সেই সূত্রে কোথাও থেকে শুনেছিলাম শব্দটা।
—কারেক্ট। তবে শুধু মুদ্রা সংগ্রাহক বললে সঠিক বলা হয় না, যারা প্রাচীন মুদ্রা বা কারেন্সি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তারা হল ‘নিউমিসম্যাটিস্ট’। তা এমন এক প্রাচীন মুদ্রা বিশেষজ্ঞ ‘স্ভরোনস’, অস্ট্রিয়ান ইন্সটিটিউটের সেক্রেটারি, বন্ধু উইলহেলমের সঙ্গে ওই ভগ্নস্তূপের মধ্যে থেকে খুঁজে পেলেন অরূপরতন। উনিশশো দুই সালের তেইশে মে এক গ্রিক সংবাদপত্র প্রথম এই খবরটা প্রকাশ করল যে এই দুই ভদ্রলোক কাঠ আর মাটির মধ্যে থেকে যে ব্রোঞ্জের টুকরোগুলো খুঁজে বের করেছেন, সেগুলোকে কোনও যন্ত্রের অংশ বলেই সন্দেহ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে স্ভরোনসও খবরের কাগজে একটা প্রবন্ধ লিখে জানালেন যে তাঁর এটাই বিশ্বাস যে এই ভাঙাচোরা টুকরোগুলো আসলে এক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার জন্য ব্যবহৃত এক যন্ত্রের অংশ। অন্যদিকে কন্সটান্টাইন র্যাডোস নামে আর এক বিশেষজ্ঞ এই যন্ত্রাংশগুলো পরীক্ষা করে বললেন যে এ তো প্রাচীন গ্রিসে ব্যবহৃত জ্যোতির্বিজ্ঞানের কোনও যন্ত্র হতেই পারে না! এমন জটিল কলকব্জাওয়ালা যন্ত্র সেই দু-হাজার বছর আগে কীভাবে তৈরি হবে? পরে অন্য কোনও জাহাজডুবির ফলে নিশ্চয়ই এটা সমুদ্রের তলায় স্থান পেয়েছিল। নাহলে এ অসম্ভব! এই নিয়ে রীতিমতো বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। দেশবিদেশের বৈজ্ঞানিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ, ঐতিহাসিক সকলে মিলে যোগ দিলেন সেই বিতর্কে। যাঁরা স্ভরোনসের পক্ষে ছিলেন, তাঁরাও বিস্ময়বিমূঢ় ছিলেন প্রাচীন গ্রিসে এমন জটিল যন্ত্রর সম্ভাবনা নিয়ে। প্রখ্যাত জার্মান ফিলোলজিস্ট— আশাকরি তোদের মনে আছে ফিলোলজিস্ট মানে কী?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ, তিব্বতের গল্প বলার সময় বলেছিলে। যাঁরা প্রাচীন লিপি বিশেষজ্ঞ। দুজনে একসঙ্গেই প্রায় বলে উঠলাম।
—রাইট। অ্যালবার্ট রেহ্ম ছিলেন প্রখ্যাত জার্মান লিপি-বিশারদ। তিনিও আসরে অবতীর্ণ হলেন। যন্ত্রের টুকরোগুলোর গায়ে প্রাচীন গ্রিকে কিছু অস্পষ্ট লেখা উৎকীর্ণ করা ছিল। সেখানে পাওয়া গেল আলেকজান্ডারের সময় ব্যবহৃত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী কিছু মাসের নাম। কিন্তু যন্ত্রের ব্যবহার কী ছিল তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েই গেল। রেহ্ম বললেন, আর যাই হোক, এ তো সামান্য একটা জ্যোতির্গণক যন্ত্র হতেই পারে না। তার মধ্যে এইরকম প্রকৌশলী কারিকুরি থাকা অসম্ভব! রেহ্ম যন্ত্রটার একটা তাত্ত্বিক পুনর্নির্মাণ করার কাজে হাত দিলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে সে কাজ শেষ হল না।
—যাহ, তাহলে? শুভ হতাশ হয়ে বলল।
—আমি কিছুদিন আগে একটা বই পেলাম। আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির ‘হিস্ট্রি অফ সায়েন্স’-এর অধ্যাপক ডেরেক প্রাইসের লেখা। পুরনো বই। উনিশশো চুয়াত্তর সাল নাগাদ লেখা। আমেরিকান ফিলোজফিক্যাল সোসাইটি থেকে প্রকাশিত। এই ভদ্রলোক রেহ্মের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করেন। এই বইতে তারই খুঁটিনাটি বর্ণনা। তোদের সেই সব অত বিশদে বললে বোর হবি।
—কিন্তু জিনিসটা আসলে কী ছিল? জিজ্ঞেস করলাম।
—সূর্য-চন্দ্রের অবস্থান নির্ণায়ক একটা যন্ত্র। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে কবে কখন সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হবে তা একদম সঠিকভাবে বলে দেওয়া সম্ভব হত বলে ধারণা করছেন ডেরেক প্রাইস। পুরো জিনিসটার যে একাশিটা টুকরো পাওয়া গেছে, তার থেকে জিনিসটার একটা পুনর্নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। মানে, অবশ্যই খাতায়কলমে— ছবি এঁকে, অঙ্ক কষে। সেটা অনুযায়ী যন্ত্রটা একটা কাঠের ফ্রেমওয়ালা ফুটখানেক লম্বা, আধ ফুট চওড়া একটা চ্যাপ্টা বাক্সের মধ্যে রাখা ছিল। বাক্সের সামনে-পিছনে দুখানা দরজা এবং সামনের দিকে একটা আর পিছনের দিকে দুটো ডায়াল। আর এই দুই ডায়ালের মাঝে অজস্র ঘড়ির মতো কলকব্জা। সামনের ডায়ালের কাজ ছিল বছরের কোন সময়ে সূর্য বা চন্দ্র কোথায় থাকবে তা নির্দেশ করা— প্রতি চার বছর অন্তর যে বছরে একটা করে অতিরিক্ত দিন যোগ হয়ে লিপ-ইয়ার হয়, তাও এই যন্ত্রনির্মাতার জানা ছিল। ফলে তাও যন্ত্রের হিসাব থেকে বাদ পড়েনি। পিছনদিকের দুটো ডায়ালের মধ্যে উপরেরটা যে ঠিক কীসের জন্য তা নিয়ে একটু ধোঁয়াশা ছিল। তবে যেটা সবচাইতে যুক্তিপূর্ণ ধারণা সেটা হল, এটা মেটোনিক সাইকেল নির্দেশক।
—সেটা কী জিনিস? প্রশ্ন করি আমি।
—খ্রিস্টের জন্মের প্রায় তিনশো বছর আগে মেটোন নামে এক গ্রিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী প্রথম এই তত্ত্বটা দেন। তিনি বলেন যে উনিশ বছর বা দুশো পঁয়ত্রিশ চান্দ্রমাস— মানে এক অমাবস্যা থেকে আর এক অমাবস্যা— অন্তর সূর্য এবং পৃথিবীর সাপেক্ষে চাঁদের অবস্থান ঠিক একই জায়গায় ফিরে আসে। এই দুশো পঁয়ত্রিশ চান্দ্রমাসের সাইকেলটাকে বলা হয় মেটোনিক সাইকেল। তো, আমাদের যন্ত্রটার পিছনের দিকের উপরের ডায়ালের দুশো পঁয়ত্রিশটা ভাগ করা ছিল বলে সংলগ্ন গিয়ারের দাঁতের সংখ্যা এবং অবশিষ্ট কিছু দাগ থেকে অনুমান করা গেছে। আর নীচের দিকে ডায়ালটা ছিল গ্রহণের সময় নির্দেশক। শুধু দিন নয়, একেবারে দিন-ক্ষণ দুইই।
—বাপরে! সেই দু-হাজার বছর আগে গ্রিসে এত কিছু কে বানাল? শুভ অবাক হয়ে গেছে।
লুচি-তরকারি কখন শেষ হয়ে গেছে। হাত ধুতে যাওয়ার কথা খেয়াল নেই কারও। রবি ঠাকুর দুপুরের খাবার বানানো শুরু করে দিয়েছে।
—সেটাই তো মিস্ট্রি। তবে অনুমান করা যায় যে সেই সময় গ্রিসের রোডস দ্বীপের কোনও এক ইঞ্জিনিয়ারের সৃষ্টি। কোনও অজ্ঞাত কারণে যন্ত্রটা বাকি সব জিনিসের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল ওই মালবাহী জাহাজে। তারপর তার সলিলসমাধি ঘটে। আর তার সঙ্গে এমন একটা অত্যাশ্চর্য যন্ত্র দু-হাজার বছরের জন্য হারিয়ে যায় সমুদ্রের তলায়। এই নিয়ে বেশ কয়েকটা তথ্যচিত্র হয়েছে— ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, বিবিসি— অনেকেই বানিয়েছে। সুযোগ পেলে দেখিস। দারুণ ইন্টারেস্টিং।
—দেখতে হচ্ছে তো। বলেই দেখি শুভ অলরেডি মোবাইলে সার্চ করা শুরু করে দিয়েছে।
—যাই হোক, এ তো তোর ‘হুগো’ সিনেমার অটোমেটন থেকে হাইপারলিঙ্কে চলে গেছিলাম আমরা। চল হাত ধুয়ে সোফায় বসি আগে, তারপর ফেরত যাই সেই ফেলে আসা পারসেপট্রনের কথায়।


সোফায় বসে ব্যালকনির ফরাসি-জানলাটাকে হাট করে খুলে দিয়ে বেশ মৌজ করে একটা সিগারেট ধরাল জয়দা।
[আবার আগামী সংখ্যায়]

