নহি যন্ত্র — চার

সৈকত ভট্টাচার্য

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

 

শুভ কিছু একটা ভাবছিল। জয়দা কিছু বলার আগেই সে বলে বসল, এই যে প্রাচীন গ্রিসের এই জটিল যন্ত্রপাতির কথা বললে, সেটা তো তাহলে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রাচীনতম উদাহরণ হিসাবে ধরাই যায়, তাই না?

—উঁহু, জয়দা এক মুখ ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে বলল।
—কেন? আমি প্রশ্ন করলাম। শুভ কথাটা খারাপ বলেনি কিন্তু।
—এই মনে কর, তুই যে তোর নতুন কেনা বাইকটায় চড়ে রোজ আপিস যাস, সেটা কি একটা আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্ট মেশিন?
—না, মানে… এবার আমাদের দুজনেরই মাথা চুলকনোর পালা।
—কেন না? জয়দা আবার প্রশ্ন করে।
—ওটা তো একটা মেকানিকাল যন্ত্র। মানে, তেল ভরলে ইঞ্জিন চলবে। এর মধ্যে কম্পিউটার-টম্পিউটার তো নেই। একটু ভেবে বললাম।
—কারেক্ট। এবার আর একটা উদাহরণ ধরা যাক, শুভ যে কম্পিউটারে দিবারাত্র ফিফা খেলছে। এদিকে মাঠে গিয়ে ফুটবল পায়ে তো দূরে থাক, হাতে নিয়ে দেখেছে কি না সন্দেহ আছে— সেই ফিফা কম্পিউটার গেম— সেটা কি একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদাহরণ?

শুভ মিনমিন করে একটা প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু বোধহয় বৃহত্তর স্বার্থে সেটা গিলে ফেলল। তারপর বলল, না মনে হয়।

—কেন মনে হয়? জয়দা নাছোড়। অবশেষে আমরা দুজনেই হাল ছেড়ে বললাম, জানি না, তুমি বলো।
—এই সমস্ত যন্ত্রপাতি বা কম্পিউটার গেম— তাতে একটা জিনিস নেই, যেটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রয়োজন। কী বল তো?
—কী? বলে এর ওর দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকোচ্ছি। জয়দা হতাশ হয়ে বলল, নাহ, সেটা তোদেরও নেই দেখছি।
—কী নেই? শুভ আবার জিজ্ঞেস করে।

আর তক্ষুনি দরজার দিক থেকে একটা মেয়েলি গলায় উত্তর এল, বুদ্ধি!

আমাদের ফ্ল্যাট মোটামুটি অবারিত দ্বার। দিনের বেলায়, বিশেষ করে আমরা যতক্ষণ লিভিং রুমে বসে গুলতানি করি, বা রবি ঠাকুর রান্নাবান্না করে, দরজাটা খোলাই থাকে। এখনও তাই ছিল। আর সেই খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে কখন যে মঞ্জুশ্রী মাথা গলিয়েছে সেটা কেউ খেয়ালই করিনি। দরজার দিক থেকে হঠাৎ ‘বুদ্ধি’ শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি মহীয়সী সেখানে একটা ট্রলি হাতে দাঁড়িয়ে হাসছেন।

—আরে, তুই? কোথা থেকে? কীভাবে? একযোগে বলে উঠলাম। আমাদের বুদ্ধিহীন বলে অপমান করাটার কথা খেয়ালই রইল না।

মঞ্জুশ্রী ঘরে ঢুকে ট্রলিটা একদিকে দাঁড় করিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে পড়ল আমাদের সঙ্গে। তারপর বলল, আগে জয়দার গল্পটা কন্টিনিউ হোক। পরে আমার বৃত্তান্ত বলছি।

রান্নাঘর থেকে রবি ঠাকুর মঞ্জুশ্রীর গলা শুনতে পেয়েই দেখি একটা থালায় চারটে লুচি আর আলুরদম সাজিয়ে নিয়ে চলে এসেছে। মঞ্জুশ্রী সেটা হাতে নিয়ে, রবি ভাইয়া, ইউ আর জিনিয়াস, বলে একটুকরো লুচি মুখে চালান করল। রবিও একটা কান এঁটো করা হাসি দিয়ে রান্না ঘরে অন্তর্হিত হল ফের।

–যেটা বলছিলাম, বলে জয়দা আবার গল্পে ফিরল, বুদ্ধি! আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জন্য প্রয়োজন ইন্টেলিজেন্স বা বুদ্ধিমত্তার। ওই সমস্ত যন্ত্রপাতি বা এই কম্পিউটার গেমস চলে নির্দিষ্ট বাঁধা পথে। যেমনটি কোড করা আছে বা যেমনভাবে কলকব্জার ব্যবস্থাটা তৈরি করা আছে, ঠিক তেমনভাবেই চলবে যন্ত্র। সেখানে যন্ত্রের নিজস্ব কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। কিন্তু যে সমস্ত যন্ত্র আর্টিফিশিয়ালি ইনটেলিজেন্ট, সেখানে তোর ইনপুট অনুযায়ী কিছু সিদ্ধান্ত নিতে তারা সক্ষম।
—যেমন চ্যাটজিপিটি? আমি বললাম।
—হ্যাঁ, যেমন চ্যাটজিপিটি। তুই ধর বললি যে এমন একটা বাঘের ছবি এঁকে দাও যার দুটো লেজ আর তিনটে শিং। চ্যাটজিপিটি অমনি তোকে অমন একটা অদ্ভুত বাঘের ছবি এঁকে দিচ্ছে। এমন বাঘের ছবি তাকে কি আগে থেকে শেখানো আছে? নাহ। কিন্তু তোর প্রশ্ন অনুযায়ী ও ভাবতে পারছে যে বিষয়টা ঠিক কী চাইছিস তুই, আর সেই অনুযায়ী কাজ করছে। এই ভাবা-টাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আসল সম্পদ।
—বুঝলাম। স্বগতোক্তির ঢঙেই বললাম আমি।
—গুড। আর এই আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জগতের আদিপুরুষ বলা যায় এই পারসেপট্রন-কে।
—তার কাজ কী ছিল? মঞ্জুশ্রী লুচি শেষ করে আঙুল চাটতে চাটতে প্রশ্ন করল।
—তেমন কাজ কিছু ছিল না, এটা একেবারেই একটা অ্যাকাডেমিক প্রোজেক্টের ফল ছিল। ফ্র্যাঙ্ক রোজেনব্ল্যাট, অর্থাৎ যাঁর মস্তিষ্ক থেকে এই পারসেপট্রনের উৎপত্তি, তিনি বলেছেন যে, এমন একটা যন্ত্র তিনি বানাতে চেয়েছিলেন যে একটা নির্দিষ্ট জিনিসকে দেখে চিনতে পারবে— যে-কোনও দিক থেকেই দেখানো হোক, বা তার আকৃতি বড় বা ছোট করা হোক না কেন। যেমন একজন মানুষ যদি যন্ত্রের ‘পরিচিত’ হয়, তবে তাকে সামনে, পিছন, পাশ যে-কোনও দিক থেকেই যন্ত্রের সামনে দাঁড় করানো হোক, বা তার পরনে যাই থাকুক না কেন যন্ত্র তাকে চিনতে ভুল করবে না।
—তা এ আর এমন কী ব্যাপার, সেই ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলার বিভিন্ন দিক থেকে তোলা ছবি যন্ত্রের মগজে রেখে দেওয়া গেল। এবার ছবি আর সামনের ভদ্রলোক একই কি না সেটা তো একটা কম্পিউটার কোড করেই বোঝা যায়। মঞ্জুশ্রী একটু ভেবে বলল।
—উঁহু, এবার যদি একজনের বদলে অমন এক লাখ লোক হয়? কত ছবি রাখবি মেমরি তে?
—তা অবিশ্যি ঠিক। মঞ্জুশ্রী হার স্বীকার করল।
—তোর এই প্রশ্নটা আসবে বলেই রোজেনব্ল্যাট সেটাও পরিষ্কার করে রিপোর্টে লিখে গেছেন যে, এই যন্ত্রের মস্তিষ্কে প্রচুর ছবি রেখে দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। বরং, এই যন্ত্র অমন প্রতিটি তথ্য আলাদা করে রেখে দিলে যত জায়গা দরকার, তার চাইতে অনেক কম জায়গা ব্যবহার করেই আপেলকে আপেল আর কমলাকে কমলা বলে চিনতে পারবে! অর্থাৎ কি না যন্ত্র শুধু মুখস্থ বিদ্যা ব্যবহার করে পরীক্ষা পাশ করবে না, রীতিমতো মগজাস্ত্র ব্যবহার করবে।
—মগজাস্ত্র! শুনলেই ফেলুদার কথা মনে পড়ে যায়। বললাম আমি।
—ঠিকই, যন্ত্রের এই মগজের ব্যাপারটা কিন্তু মানুষের স্নায়ুতন্ত্র থেকেই কিছুটা অনুপ্রেরিত। জয়দা আমাকে বলল।
—কীরকম? জিজ্ঞেস করি আমি।
—তাহলে তো আবার অন্য কথায় যেতে হয়। আচ্ছা, আগে রোজেনব্ল্যাটের কথাটা শেষ করি, তারপর না হয়…

হ্যাঁ হ্যাঁ করে সমস্বরে আমরা সমর্থন জানাই।

—অতএব রোজেনব্ল্যাট বললেন যে তাঁর প্রস্তাবিত এই যন্ত্র অমন তথ্যভাণ্ডারকে মুখস্থ করবে না, বরং তাকে ভালো করে বুঝে নেবে। ঠিক যেমন অঙ্ক বা ফিজিক্স পড়ার সময় আমরা ভালো করে বিষয়টা বুঝে নিতাম। মুখস্থ না করে। তাতে লাভ কী হত?
—একদম গতে বাঁধা প্রশ্নের বাইরে অন্য কোনও প্রশ্নের উত্তরও যাতে আমরা দিতে পারি। মঞ্জুশ্রী বলল।
—কারেক্ট। যন্ত্রের ক্ষেত্রেও তাই। যদি সমস্ত তথ্যকে কেবলমাত্র নিজের মেমোরিতে রেখে তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখে এবং আপেলকে আপেল আর কমলাকে কমলা বলে চিহ্নিত করে, তবে একটু অন্য জাতের আপেল বা কমলা যা তার তথ্যভাণ্ডারে নেই, তাকে আর চিনতে পারবে না। অতএব যন্ত্রকে বোঝানো দরকার, মুখস্থ নয়।
—কিন্তু জয়দা, শুভ হঠাৎ মুখ খুলল, আমরা ইতিহাস তো মুখস্থ করেই পাশ করেছিলাম। তার বেলা?

জয়দা কয়েক মুহূর্ত শুভর দিকে অপলকে তাকিয়ে থেকে বলে উঠল, তোর কী হয়েছে রে? এমন ইনটেলিজেন্ট প্রশ্ন তোর মুখে!

মঞ্জুশ্রী আর আমি কথাটা বিদ্রূপাত্মক ভেবে হেসে উঠতেই, জয়দা বলল, আরে হাসছিস কেন? গুড কোয়েশ্চন। তবে এই মুখস্থবিদ্যার বিষয়টায় পরে আসব। এখন না। রোজেনব্ল্যাটের যন্ত্র মুখস্থ করতে জানত না, জানত কেবল বুঝে নিতে বিষয়টা।

—যন্ত্র কীভাবে বোঝে? জানতে চাইলাম আমি।
—সম্ভাবনার সাহায্যে। জয়দা উত্তর দিয়ে একটু চুপ করল।
—সম্ভাবনা মানে প্রোব্যাবিলিটি? মঞ্জুশ্রী বলে উঠল।
—ইয়েস ম্যাডাম। সম্ভাবনা মানে প্রোব্যাবিলিটি— একটা ফলের আকার, গন্ধ, রং ইত্যাদি বিচার করে যন্ত্র বলবে যে হ্যাঁ, এই ফলটা আপেল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অতএব এটা আপেল।
—সেটা কীভাবে বের করবে? স্বাভাবিক প্রশ্ন এসে গেলও মুখে।

জয়দা কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল, সেটাও নাহয় ব্যাকলগে রাখা রইল স্নায়ুতন্ত্রের সাথে। আগে রোজেনব্ল্যাট…

আমি মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেলাম।

—তাহলে একটা বড়সড় পরিমাণের তথ্য বা ডেটার অন্তর্নিহিত বিন্যাসকে শিখে একটা যন্ত্র যদি আপেলকে আপেল আর কমলাকে কমলা হিসাবে বুঝে ফেলতে পারে— মানে, অবশ্যই আপেলের আপেল হওয়ার সম্ভাবনা আর কমলার কমলা হওয়ার সম্ভাবনা সর্বোচ্চ বলে দাবি করতে পারে, তবে তাকে বলা হবে পারসেপট্রন। কিন্তু এই জিনিসটা এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, তখন কিন্তু এতটাও সহজ ছিল না। কারণ, কম্পিউটারের ক্ষমতা এতটা উন্নত হয়নি তখনও। রোজেনব্ল্যাট এরকমভাবে পরিকল্পনা করলেন যে, কম্পিউটারকে দুইরকম কাগজ দেখানো হবে। একটাতে কাগজের ডানদিকে দাগ দেওয়া, আর অন্যটা বাঁদিকে দাগানো। পারসেপট্রনের কাজ হবে এই দুই ধরনের কাগজকে চিনে ফেলা। যন্ত্রের গায়ে দুটো আলো লাগানো থাকবে— ডানদিকে দাগী কাগজ হলে একটা আলো জ্বলবে, আর যদি বাঁদিকে হয় তাহলে অন্যটা।
—এরকম কেন? কম্পিউটারের স্ক্রিনে লিখে দিলেই তো হয়। শুভ জিজ্ঞেস করল।
—এ কি আর আমাদের পার্সোনাল কম্পিউটার রে! সে যুগে সব ঘরজোড়া বিশাল বিশাল যন্ত্র। আইবিএমের সেভেন জিরো ফোর মডেল ব্যবহার করা হয়েছিল পারসেপট্রনের জন্য। তখন তা ছিল যাকে বলে একেবারে কাটিং এজ টেকনোলজি। একমাত্র যন্ত্র যা কি না জটিল সব অঙ্ক কষে ফেলতে পারে। অবিশ্যি জটিল বলতে ক্যালকুলাস-ট্যালকুলাস ভেবে বসিস না। একেবারেই যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ।
—সেটা আবার জটিল হল কী করে? আমি প্রশ্ন করি।
—তার আগে কম্পিউটার সেটাও পারত না কি না! জয়দা একগাল হেসে জবাব দিল।
—এটাও যদি না পারে তাহলে যন্ত্রটার নাম ‘কম্পিউটার’ রাখা হয়েছিল কেন? মঞ্জুশ্রী জিজ্ঞেস করল।

কেন জানি না, ও সবসময়ই এমন সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে তা আমাদের কারও মাথায় কোনওদিন আসে না! যেমন একটা যন্ত্রের নাম কম্পিউটার— তার নামকরণের পিছনে যে একটা অর্থবহ উদ্দেশ্য আছে, অর্থাৎ তার কাজই হবে কম্পিউট মানে হিসেবনিকেশ করা— সেটা আমাদের মাথাতেই আসেনি! যাই হোক, ওর প্রশ্নটা শুনেই ব্যাপারটা মাথায় এল। ওমনি সঙ্গে সঙ্গে— হ্যাঁ হ্যাঁ কেন কেন?— করে মাথা দুলিয়ে সঙ্গ দিলাম।

—গুড কোয়েশ্চন। জয়দা বলল। আর এই কোশ্চেনটা করলি বলেই আমার আগের উত্তরটা যে অতিসরলীকৃত হয়ে গেছিল, সেটা স্বীকার করি। কম্পিউটারের কাজই কম্পিউট করা। কিন্তু এই সাতশো চারের আগের জেনেরেশনের কম্পিউটাররা কেবলমাত্র দুইয়ে দুইয়ে চার করতে পারত— আড়াইয়ে আড়াইয়ে পাঁচ করতে পারত না!
—মানে? ফ্লোটিং পয়েন্ট অপারেশন পারত না? ফস করে বলে ফেললাম।
—একদমই। তাদের দৌড় ছিল ওই পূর্ণ সংখ্যা অবধিই— দশমিকের ওপারে গেলেই অন্ধকার। আইবিএম-এর এই নতুন যন্ত্রর মধ্যে তুই যেটা বললি সেই ফ্লোটিং পয়েন্ট অপারেশন বা দশমিক পার করে হিসাব করার ক্ষমতা যুক্ত হয়েছিল। সাতশো চার কম্পিউটার নাকি সেকেন্ডে প্রায় বারো হাজার যোগ করতে পারত। আর এই ‘অত্যাধুনিক’ যন্তরটার দাম কত ছিল জানিস? বলে জয়দা চোখ গোল গোল করে আমাদের মুখের দিকে তাকায়।
—কত? দু-পাঁচ লাখ নিশ্চয়ই? শুভ বলে।
—কুড়ি লক্ষ মার্কিন ডলার! ভারতীয় টাকায় নিজেরাই কনভার্ট করে নে। বলে আমাদের হাঁ করা মুখগুলো দিকে চেয়ে একটা ‘হেঁ হেঁ’ করে একটা হাসি হেসে জয়দা আবার বলল, যাই হোক, কম্পিউটারের হাড়গোড় সম্পর্কে জানাটা এআই জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ— কিন্তু আপাতত রোজেনব্ল্যাটের কথাটা শেষ করি।
—এটাও তবে যোগ করে রাখি ব্যাকলগে। শুভ ফোড়ন কাটল।
—বেশ। তা এই কম্পিউটারের তো এখনকার মতো ডিসপ্লে ছিল না, ছিল একটা সিআরটি মনিটর— মানে ক্যাথোড রে টিউব মনিটর। সেখানে সংখ্যা-টংখ্যা ফুটে উঠত ঠিকই, কিন্তু সে দর্শকদের দেখিয়ে বোঝানোর মতো কিছু ছিল না। ফলে জনগণের সামনে প্রদর্শনের জন্য রোজেনব্ল্যাট দুটো আলাদা আলোর ব্যবস্থা করেছিলেন। যাই হোক, আউটপুট কীভাবে দেখানো হবে বা হয়েছিল সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল এই পুরো ব্যবস্থাটা কাজ কীভাবে করেছিল। ভাব, অ্যাদ্দিন আগে, ফটাফট করে পাইথন বা জাভাতে কোড লিখে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই, কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার বলতে অসংখ্য ডায়োড আর ট্রায়োড ভালভের সারি, এক একটা বোতাম টেপার সঙ্গে তাদের কেউ কেউ সিগনাল পাশ করবে, কেউ করবে না, আর সেই কম্বিনেশন দিয়ে হবে গণনা— এরকম একটা প্রায় প্রিমিটিভ কম্পিউটারকে বিভিন্ন ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে তাকে ট্রেইন করা কত বড় চ্যালেঞ্জ! আর এই আশ্চর্য কাজটাই করে ফেলেছিলেন রোজেনব্ল্যাট।
—কীভাবে? আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করি আমরা। প্রায় সমস্বরে।
—কীভাবে, সেটা বুঝতে গেলে জানতে হবে এই যন্ত্রের গঠনটা। রোজেনব্ল্যাটের পারসেপট্রনের ছিল তিনটে অংশ। এক, সেন্সরি সিস্টেম বা যাকে বলা যায় যন্ত্রের দর্শনেন্দ্রিয় অর্থাৎ চোখ। দুই, অ্যাসোসিয়েশন সিস্টেম বা যন্ত্রের মগজ— চোখ দিয়ে দেখার পর যেখানে সেই ছবিটা বিভিন্ন ইলেকট্রনিক সার্কিটের মধ্যে দিয়ে ঘোরাফেরা করবে এবং তার ফলে যন্ত্র বুঝবে যে ছবিটা কীসের। আর সব শেষে রেসপন্স সিস্টেম যার মাধ্যমে যন্ত্র জানাবে যে সে ছবিটা দেখে কী বুঝল।
—দর্শনেন্দ্রিয় আর বাচনেন্দ্রিয় তো ঠিক আছে। মগজটা কীভাবে তৈরি হয়েছিল? মঞ্জুশ্রী জিজ্ঞেস করে।
—মস্তিষ্ক আর কী দিয়ে তৈরি হবে? স্নায়ু দিয়ে! যান্ত্রিক স্নায়ু। আমাদের স্নায়বিক ব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে? এই মনে কর, আমি শুভর কান মুলে দিলাম…

জয়দার কথা শুনে শুভ তাড়াতাড়ি মাথা পিছনদিকে সরিয়ে নেয়। জয়দা সেটা লক্ষ্য করে বলে—

—না না, সত্যি মুলছি না। মনে কর, মুলে দিলাম। তাহলে তোর ব্রেইন কীভাবে বুঝবে যে তোর কান মোলা হয়েছে? তোর শরীরের অন্যান্য স্নায়ু আরামসে নিদ্রা যাচ্ছে, কিন্তু কানের স্নায়ুগুলো কান্নাকাটি করে মগজের কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছে যে তাদের বিরক্ত করা হচ্ছে। এবার কী ধরনের বিরক্ত তার শ্রেণিবিভাগ করতে মস্তিষ্ক জানে। ওই কানের স্নায়ুদের বয়ে আনা খবর থেকে সে বুঝে যাচ্ছে যে কানে পিঁপড়ে কামড়েছে, নাকি কেউ মুলে দিয়েছে! যন্ত্রের স্নায়ুদেরও মোটামুটি এরকমই কাজ। যদিও প্রাণীদের স্নায়ুতন্ত্রের সূক্ষ্ম জটিলতার ধারেকাছে আসে না সে। পারসেপট্রনের অ্যাসোসিয়েশন সিস্টেম বা এ-সিস্টেমের মধ্যে এমন কতগুলো ভালভ লাগানো হয়েছিল যারা সেন্সরি সিস্টেম থেকে আসা সিগন্যাল অনুযায়ী অন হবে বা অফ হবে— অর্থাৎ হয় সিগন্যালকে ছেড়ে দেবে, নয়তো আটকে দেবে। এবার যন্ত্রের বাচনেন্দ্রিয় বা রেসপন্স সিস্টেম সেই কম্বিনেশন অনুযায়ী কাজ করবে। খুব সহজভাবে যদি বলি, মনে কর, তিনটে ভালভ আছে। এবার যদি ভালভ নম্বর এক কাজ করে, মানে অন হয়ে থাকে, আর বাকি দুই অফ, তাহলে ধরা যাক রেসপন্স সিস্টেমের লাল আলো জ্বলবে। আর যদি বাকি দুটো ভালভ অন থাকে, প্রথমটা অফ, তাহলে নীল আলো জ্বলবে। অন্য কোনও কম্বিনেশনে কোনও আলোই জ্বলবে না। কিন্তু যন্তরটা জানবে কী করে যে কখন অন বা কখন অফ করতে হবে? তার জন্য শিক্ষা দরকার। আমাদের পুরনো উদাহরণটাই আবার নিই। আপেল বনাম কমলালেবু। যন্ত্রকে আপেল আর কমলা চেনানো প্রয়োজন। তার জন্য বিভিন্ন ধরনের আপেল আর বিভিন্ন ধরনের কমলা দরকার— সেগুলোকে বলে ট্রেইনিং ডাটা বা শিক্ষণীয় তথ্য। এবার রোজেনব্ল্যাটের যন্ত্রের লাল আলো আর নীল আলো জ্বলার জন্য দুটো স্যুইচ আছে। যেগুলো টিপলে ওই নির্দিষ্ট ভালভ অন অফ হবে আর লাল বা নীল আলো জ্বলবে— এটা ম্যানুয়ালি করা যাবে। এখন যন্ত্রের ওই নীল আলোর স্যুইচ টিপে রেখে ক্যামেরার সামনে যত আপেল আছে, সব দেখিয়ে যাওয়া হল— আবার লালবাতি জ্বালিয়ে দেখানো হল সব কমলা। আর পারসেপট্রন বুঝে ফেলল যে ক্যামেরা থেকে কোন ছবি আসলে কোন ভালভকে অন করতে হবে, কোনটাকে অফ। মানে ইনপুট অনুযায়ী এই ভালভের অন বা অফের একটা ফর্মূলা তৈরি করে মেমরিতে রেখে দিল। এবার তুমি স্যুইচ ছেড়ে দিয়ে যদি আপেল বা কমলা দেখাও— তখন ক্যামেরা থেকে আসা অপটিক্যাল সিগন্যালই ওই স্যুইচের কাজ করে দেবে আর নীল বা লাল আলো জ্বালিয়ে দেখিয়ে দেবে যে সে আপেল আর কমলা আলাদা করতে পারছে।
—এ তো বাচ্চাদের অঙ্ক শেখানোর মতো গল্প! মঞ্জুশ্রী বলে উঠল। চেন্নাইয়ে দুঃস্থ বাচ্চাদের জন্য ইশকুল চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে ও সেটা ভালোই জানে।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5217 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. নহি যন্ত্র — পাঁচ – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...